শব্দহীন_বৃষ্টি (১৯)+(২০)

0
951

শব্দহীন_বৃষ্টি
(১৯)+(২০)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
একটু আগেই প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে গেছে মনজুর মোর্শেদ এর শোবার ঘরে। স্তব্ধ হয়ে আছে চারজন ব্যক্তি। মাহির মা,বাবা আর নিরবের মা,বাবা। খাটের পাশেই পড়ে আছে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো। মাহি দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে আছে। চোখজোড়া সিক্ত সাথে মন। নিরব ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেছে মাহিদের বাড়ি থেকে। কোথাও তার দৃষ্টি নেই যেন শুধু এগিয়ে চলছে। আসার সময় বাবার সাথে গাড়ি করে এসেছিলো কিন্তু এখন তার কোন দিকেই খেয়াল নেই।

–” নিরব না! নিরব এ্যই নিরব “। রিকশা থেকে নামতে নামতে ডেকে উঠলো সাগর। এই ডাকে যেন হুঁশ এলো তার। মাহিদের গেইটের পরই সাগরদের বাড়ির গেইট আর রাস্তা।

–” সাগর ভাইয়া! আপনি এখানে? ” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো নিরব। সাগরের ডাক শুনেই থেমে গেছে সে।

–” আমাদের বাড়ি এটা। ” বাড়ির দিকে ইশারা করলো।

–” ওহ”।

–” তুমি এমন হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

–” আমি?” কোন সঠিক উত্তর খুঁজে পেল না। নিরব নিজেই জানে না কোথায় যাচ্ছিলো সে।

–” এ্যাই তোমার হাতে কি হয়েছে রক্ত কেন?” আৎকে উঠেছে সাগর । টপটপ করে ডান হাতের আঙ্গুল আর তার উপরের অনেকখানি জায়গা গড়িয়ে রক্ত ঝড়ছে নিরবের। রাগের বশে টের না পেলে ও এখন যেন চিনচিনে ব্যাথা টের পেল সাগরের প্রশ্নে। কাটা জায়গা অনুভব করতে পারলো তবুও মুখে হাসি রেখে বলল, ” তেমন কিছু না”।

সাগর আর এক মিনিট ও ব্যয় না করে নিরবকে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। নিরব বারবার বলছিলো সে ডক্টর দেখিয়ে নিবে কিন্তু সাগর শুনলো না। উল্টো বলল, যেতে যেতে অনেকটা রক্তক্ষয় হবে। তার চেয়ে বরং আমাদের বাড়িতে একজন হাফ ডক্টর আছে আগে তাকে দেখাই”।

নিরব আর জোর করতে পারেনি। সাগরের সাথে তাদের বাড়িতে ঢুকে গেল। সাগর আজ লাঞ্চ নিয়ে যায় নি। বাড়িতে খুশির খবর বাবা আর চাচু অনেক টাকা প্রোফিট করেছে ব্যবসায় সেই খুশিতে দুপুরে ভালমন্দ আয়োজন হচ্ছে । তারওপর বাবা বলেছে বাড়ির জন্য আরো একটা গাড়ি কেনা হবে খুশি একটু এক্সট্রা তাই দুপুরে বাড়িতে খাবে বলেই এসেছে সে।

–” শ্বাশুড়ি আম্মা একটু জলদি বাইরে আসেন তো”। বাড়িতে ঢুকেই সাগর হাঁক ছাড়লো। তাহমিনা তখন মাত্র পায়েস এর হাঁড়িটা চুলা থেকে নামিয়ে রাখছিলেন।

–” কি ব্যাপার জামাই বাবার গলা না!” তাহমিনা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো। কাজের মেয়েটি ডাইনিং এ খাবার রেখে আসার সময় দেখেছে সাগর এসেছে সাথে আরো একজন আছে। আর তার হাত দিয়ে রক্ত ঝড়ছে।

–“মেঝু খালাম্মা ! বড় খালাম্মা কই?” আতঙ্কিত চোখ মুখ করে জিজ্ঞেস করলো কাজের মেয়ে সালেহা।

–” কি হয়েছে সালেহা তোর চোখ মুখ এমন কেন?”

–” খালাম্মা গো সাগর ভায় য়ে এক ব্যাডা লইয়া আইছে আর ব্যাডার আত দিয়া রক্তের বন্যা বইতাছে…..” সালেহার কথা শেষ হওয়ার আগেই আবার সাগরের ডাক শোনা গেল। সে শুধু তাহমিনাকেই ডাকছে৷ বাড়ি ফিরে সাগর প্রথমে মা’কে ডাকে কিন্তু এখন হঠাৎ শ্বাশুড়ি বলে ডাকছে! নিশ্চিত কিছু হয়েছে ভেবে তাহমিনা ও রান্নাঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে যেতেই সাগর বলল, “নিরবের হাতটা একটু দেখেন তো জলদি”। সাগরের ডাক শুনে অবশ্য ড্রয়িংরুমে সবাই জড়ো হয়ে গেছে। তিথি কে দেখে সাগর বলল, ” জলদি ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে আয় তো”।

তাহমিনা ভালো করে হাতটা চেক করে বলল, স্টিচ লাগবে না তবে কাটার ধরণ ভালো নয়। চামড়া একদম ছিলে,থেঁতলে গেছে। আমি আপাতত পরিষ্কার করে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছি। যেহেতু কাঁচ লেগেছে হসপিটালে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ইনজেকশন লাগিয়ো আর মেডিসিন ও নিও। নয়তো ইনফেকশনের ভয় আছে। আর এখন খাবার খাওয়ার পর একটা পেইন কিলার দিচ্ছি খেয়ে নাও।” প্রাথমিক একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে তাই সাগর খেতে বসেছে সাথে নিরবকে ও বসিয়েছে জোর করে। কেউ প্রশ্ন করেনি হাত কেটেছে কি করে। ডান হাত কাটায় নিরব নিজ হাতে খেতে ও পারবে না দেখে শামসুন্নাহার খাবার মেখে মুখের সামনে তুলে ধরলেন নিরবের। অবাক চোখে চেয়ে আছে সে অচেনা অজানা একটা ছেলেকে এত যত্ন! কি অমায়িক মানুষ গুলো। সাগর মাত্র ভার্সিটির একজন সিনিয়র হিসেবে পরিচিত নিরবের। গান, ব্যান্ড এর সুবাদে কয়েকবার মিউজিক কনসার্টে নিরব গিটারিস্ট ছিলো সাগরের সাথে। গত এক বছর যাবৎ তো কোন প্রকার যোগাযোগ ও ছিলো না। অথচ আজ দেখতে পেয়ে একদম আপনজনের মত ডাকলো আবার হাত দেখে বাড়ি এনে যত্ন আত্তি আবার ট্রিটমেন্ট কিছুই বাদ রাখলো না।নিরব মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো এত কিছুর জন্য।

–” কি হলো হা করো”। শামসুন্নাহার বললেন।নিরব মুখ খুলল। সাগর খাওয়ার ফাঁকে সংক্ষেপে মা,চাচী,দাদুনী,তিথি আর সালেহার পরিচয় ও দিলো। নিরব ও নিজের পরিচয় দিলো। সাগর যখন জিজ্ঞেস করলো নিরব এদিকে কোথা থেকে আসছিলো ওভাবে।তখন ইতস্তত করতে করতে বলেই দিলো সে তার খালার বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে এবং পুরো ঘটনা কি ছিলো। নিরব আর তার বাবা যখন মাহিদের বাসায় এসেছে তার আধ ঘন্টা পরই মাহির বাবা ও এসেছেন অফিস থেকে৷ নিরবের মা নিজেই কল করে আসতে বলেছিলেন। এরপর তারা সবাই গিয়ে বসেছে শোবার ঘরে। বড়রা কি যেন কথা বলবে। বড়রা কি কথা বলেছে তা জানতো না মাহি আর নিরব তারা দু’জন সোফায় বসেই পড়ালেখার কথা আর ফাজলামোতেই ব্যস্ত ছিলো। এরপরই চামেলি মাহি আর নিরবকে ডেকে নিয়ে যান। তারা রুমে ঢুকতেই নিরবের মা শিউলি বলেন, ” যা নিরব মিষ্টি নিয়ে আয় গিয়ে”।মিষ্টির কথা শুনে নিরব বেশ অবাক হয় কিন্তু মাহি অবাক হয় নি। তার মনে হয়েছে খালামনি আজ আসার সময় কিছু নিয়ে আসেনি তাই বোধ হয় এখন আনতে বলছে। কিন্তু মাহির ধারনা মুহুর্তেই ভুল প্রমাণিত করে শিউলি আবার বলেন, ” এই মাহি শোন বিয়ের পর আমাকে খালাই ডাকবি না মা ডাকবি তা এখনই ঠিক করে নে”। এই একটা কথায় চোখ বেড়িয়ে এসেছিলো মাহির। নিরবের ও মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এরপরই এক কথায় দু’কথায় নিরবের রাগ চড়ে যায় আর কর্ণার টেবিলে থাকা ল্যাম্পে ঘুষি মেরে বসে। ল্যাম্প ওয়ালের সাথে লাগানো থাকায় সব কাঁচ ওয়ালে লেগে নিরবেরই হাতে গেঁথে যায়। ওই অবস্থায়ই সে ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে আর রাস্তায় সাগর তাকে দেখতে পায়।

নিরবের যখন সম্পূর্ণ ঘটনা বলা শেষ হয় তখন সাগর পাতে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণ সবার খেয়াল নিরবের দিকে থাকলে ও এখন সবার দৃষ্টি সাগরের দিকে।

–” কি হইছে নাতজামাই হাত ধুইলা ক্যান? ”

–” একটা জরুরি কাজ করতে ভুলে গেছি। হাতে সময় ও কম!”

–” তাতে কি খাবার পাতে পানি ঢাললি কেন?” কঠিন গলায় ছেলেকে বললেন শামসুন্নাহার।পাতের খাবার নষ্ট করা তিনি একদম পছন্দ করেন না। নিরবকে খাওয়াতে খাওয়াতে তির্যক চোখে তাকালেন সাগরের দিকে। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সাগর চলে গেছে৷ আর সে যেতেই অস্বস্তিতে ভুগতে লাগলো নিরব।

–” কি এমন অন্যায় করে ফেলছি আমি সবাই আমায় কেন রাগ দেখাচ্ছো? আল্লাহ আমার ছেলেটা কোথায় গেল তার হাত দিয়ে কত রক্ত ঝড়ছে। ” শিউলি কাঁদছে আর একা একাই বিলাপ করছে। একটু আগেই নিরবের বাবা তার মা’কে অনেক কথা শুনিয়েছে। চামেলি ও বড় বোনকে ছাড়েনি কারণ, তারা সবাই বারবার করে বলেছিলো মাহি আর নিরবের সাথে আগে আলাদা ভাবে কথা বলতে। তারা দু’জনকে নিয়ে কি ভাবে। যদিও চামেলি বোনের মতোই ভাবতো নিরব, মাহি ভালোবাসে বা পছন্দ করে একজন আরেকজনকে। তবুও সে কনফার্ম হতে চেয়েছিলো। নিরব আর মাহির বাবা দু’জনেই বলেছিলে তারা ভাই বোনের চেয়ে আলাদা ভাবে না কেউ কাউকে। কিন্তু নাহ, শিউলি শোনেন নি কারো কথা। তিনি জেদ ধরেছিলেন বিয়ে হবে তো নিরবের সাথে মাহির হবে। তার একমাত্র ছেলের জন্য অচেনা মেয়ে আনলে কি ভরসা সেই মেয়ে তাকে সারাজীবন দেখবে কিনা। আবার তার বিশাল সম্পত্তি ও লুটপাট না হয়ে যায়।অথচ নিরব মাহিকে আর মাহি নিরবকে আপন ভাই বোনের মত দেখে। সকল আবদার,আহ্লাদ নিরব অনায়েসেই পুরন করে মাহির কারণ মাহিকে সে তার একমাত্র বোন বলে মানে।সেই বোনকে নিয়ে অন্য কোন অনুভূতি তার কখনো আসবে না।

নিজের ডেস্কে বসে পেপারওয়েট হাতে নিয়ে অবিরত ঘুরিয়ে যাচ্ছে সাগর। কপালের মধ্যভাগে এক কুঞ্চিত রেখা স্পষ্ট। বহুকাল বাদে আজ সে কোন মেয়েকে নিয়ে ভাবছে।বহুকাল! হ্যা হবে অনার্স শেষ হওয়ার আগেই সে প্রেমের ডিগ্রিতে ফেইল করেছিলো। তারপর আর কোন মেয়েকে নিয়ে ভাবেনি। দোলাকে ভালো লেগেছিলো কিন্তু সেই ভালোলাগা মাস দু’য়েকের মধ্যেই ইতি টেনে ছিলো। এখন ও কথা হয় দোলার সাথে দোলা বিদেশে গিয়ে কারো প্রেমে পড়েছে৷ এখন সে পরিবারের থেকে লুকিয়ে লিভ ইন করছে সেই ছেলের সাথে। সাগর জানে দোলা নিজেই বলেছিলো। কিন্তু তাতে সাগরের কি? আজ সাগরের ভাবন ঘর দখল করে আছে মাহিয়া নুর। না চাইতে ও চোখে ভেসে উঠছে কাল রাতের সেই দৈবশক্তি পূর্ণ মুহুর্তটি৷ বারবার অনুভব হচ্ছে ঘাড়ে মাহির নখের আঁচড় আর শিউরে উঠছে তার সারা শরীর। এ কেমন শিহরণ! মেয়েটাকে নিয়ে তো সে কখনো এরকম কিছু ভাবতে চায় নি। তবুও ভাবনায় আসছে সে আর ঠিক তখন থেকে আসছে যখন নিরবের মুখে শুনেছে মেয়েটির সাথে নিরবের বিয়ে হবে। তবে কি সাগর জেলাস হচ্ছে ! কি করে সম্ভব! ভেবে পায় না সে। নিরব তো বললো তার পক্ষে মাহিকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মাহিকে বোনের চেয়ে বেশি কিছুই ভাবে না।

–” সাগর সাহেব কি একটু বেশিই চিন্তিত? ” পাশের ডেস্কের ডেইজি হঠাৎ প্রশ্ন করায় চমকে গেল সাগর। ভাবনায় বাঁধা পেল সে।

–” ইয়ে মানে, নাহ আমি চিন্তিত নই”।

–” আপনার সাদা মুখে হঠাৎ বর্ষার কালো মেঘ দেখা দিচ্ছে তো তাই ভাবলাম”।

–” নাহ, তেমন কিছু না।”

–” লাঞ্চ করেন নি ঠিকমত। আপনার চোখ মুখ শুকনো লাগছে চলুন আমি কফি খাওয়াবো।” ডেইজি নিজের ডেস্ক থেকে দাঁড়িয়ে গেল।

–” না না আমি ঠিক আছি। লান্চ ও করেছি। ” সাগর হকচকিয়ে গিয়েছিলো। এই মহিলা বেশ গায়ে পড়া স্বভাবের। বয়সে সাগরের থেকে ও তিন চার বছরের সিনিয়র, ডিভোর্সি । অফিসে লোকমুখে শুনেছিলো মহিলার এমন গা পড়া স্বভাবের কারণেই তার ডিভোর্স হয়েছে। সুন্দর, সুদর্শন ছেলে দেখলেই পিছনে লাগে। সাগর এই অফিসে আছে আট মাসের বেশি সময় ধরে। এ ক’মাসে ডেইজির টার্গেট ছিলো সাগর আর বসের ছেলে। ছুঁক ছুঁকে স্বভাব নিয়ে বসের ছেলের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ ও পেয়েছে বহুবার কিন্তু সাগর এর কাছে পাত্তা পায় নি। আজ ও কোনমতে এড়িয়ে গেল সে৷ আজ মাথায় শুধু মাহিয়ার ভাবনা চিড়বিড় করছে। এতদিন চেয়ে এসেছে মেয়েটা যেন দূর হয় অথচ আজ মনে হচ্ছে ওই চরম বেয়াদব মেয়েটাকে কিছুতেই নিজে থেকে দূর করা যাবে না৷ কোথা ও যেন এক টুকরো প্রশান্তির হাওয়ার কাজ করে ওই মেয়েটা। কিন্তু তার করারই বা কি আছে।

সারাদিন মন খারাপ নিয়ে ঘরবন্দী করে রেখেছিলো মাহি নিজেকে। খালামনি আর খালু যাওয়ার সময় ডেকেছিলো সে দরজা খোলেনি। বিছানায় গড়িয়ে দিন পার করেছে। সন্ধ্যের আগে তার ছোট্ট বাটন মোবাইলে কল এলো নিপার নম্বর থেকে। ফোন কানে নিয়েই বেশ অবাক হলো মাহি৷

–” বিয়ে!”

চলবে

#শব্দহীন_বৃষ্টি
(২০)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
___________________________
আজ এত দেরি করলেন কেন? রেলিঙে ঠেস দিয়ে বসে প্রশ্ন করলো মাহি। সাগর এদিক ওদিক খুঁজতে থাকলো কিন্তু নাহ, কাউকেই চোখে পড়ছে না ও ছাঁদে কিন্তু সে তো স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে মাহির গলা। এবং তা খুব কাছ থেকে শুনেছে। আজ সন্ধ্যায় গাড়ির শো-রুমে যাওয়ার কথা ছিলো চাচুর সাথে। সমুদ্র কাল আসবে তাই সে বলেছে তার বাবা আর সাগর মিলেই যেন কেনে গাড়িটা। আর তাই সাগর ঘন্টা দুই চাচুর সাথে শো-রুম ঘুরে বাড়ি ফিরেছে। চাচুর কোন গাড়িই ঠিকঠাক পছন্দ হয়নি। এখন ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে মাত্রই ছাঁদে উঠেছে।

–” এত খোঁজাখুঁজি করার কি আছে? চোখ তো আপনার তৃষ্ণার্ত নয় আমায় দেখার জন্য।” আবার ভেসে এলো মাহুর কন্ঠ।

–” ফাইজলামি করছো কেন?” সাগর আবার খুঁজতে লাগলো। কন্ঠস্বরটা খুব কাছে কিন্তু কোথায় মেয়েটা। কাউকে দেখা যাবে না এখানে এতোটা ও অন্ধকার নয়।

–” ধ্যাৎ! কি যে বলেন না। ফাইজলামি করবো কেন আপনি কি আমার বেয়াই হোন নাকি?” মাহি বোধ হয় কথাটা বলে একটু হাসলো।

–” এত রাত বিরাতে ছাঁদে কি কাজ তোমার? ” ধমকের সুরে বলল সাগর।

–” ওমা সাদা টি-শার্ট ভাইয়া দেখছি খুব রেগে গেছেন!”

–” আজাইরা কথা বন্ধ করে সামনে আসো।”

–” আগে বলুন আমায় সামনে আসলে কি পাবো?” ন্যাকামি করে বলল মাহি।

–” কি পাবে মানে! আমি কি তোমায় কিছু দেবার জন্য ডেকেছি?” আশ্চর্য হলো বেশ।

–” তা হবে কেন, এটা তো ফরমালিটি গার্লফ্রেন্ড এর জন্য বয়ফ্রেন্ড দেখা করতে এলে কিছু না কিছু নিয়ে আসে।” খিল খিল করে হাঁসছে মাহি আর সেই হাসির শব্দ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রেলিং এর পেছনে মানে নিচে বসে কথা বলছে সে। কিন্তু সাগর মাহির কথায় এতোটাই অবাক যে তাকে খুঁজে দেখার কথা বেমালুম ভুলে বসেছে। মাথায় রাগ উঠছে তিরতির করে। অনেকটা হাওয়ার বেগে। কি ভয়ানক কথা বলে মেয়েটা একেবারে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড এ আপডেট হয়ে গেছে।

–” এ্যাই মেয়ে কি সব ফাইজলামি কথাবার্তা বলছো?” হুংকার করে উঠলো সাগর কিন্তু মাহি তো ভয় পাবার মেয়ে নয়। বরং উল্টো রাগাতে উঠে দাঁড়ালো সাগরের পেছন দিকে। রেলিঙের এপাশে সাগর ওপাশে মাহি ঠিক কালকের মত। মাহির নিঃশ্বাস সাগরের পিঠে পড়ছে এপাশে মুখ করে দাড়িয়ে আছে বলে।

–” আমি কি ভুল কিছু বলেছি এলোমেলো সাহেব?”

–” তোমার কি একটু ও লজ্জা করে না বয়সে এত বড় একটা ছেলের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে?”

–” যেখানে ছেলেটা বাচ্চা মেয়েটাকে জাপটে ধরে চুমু খাওয়ার সময় লজ্জা পায় না সেখানে মেয়েটা কেন লজ্জা পাবে কথা বলতে? বলুন, বলুন।” মাহির গলায় দুষ্টুমি কিন্তু সাগর ভড়কে গেছে।

–” কি সব বলছো মাহিয়া? কেউ শুনতে পেলে জানো কি ভাববে?”

–” ভাববে এবাড়ি মেয়ে ও বাড়ির ছেলে রাতের আঁধারে ছাঁদে দাঁড়িয়ে প্রেম করছে চুমু খা… ” শেষ বাক্য কমপ্লিট করার আগেই সাগর উল্টো ফিরে মুখ চেপে ধরলো মাহির।

–” বাড়াবাড়ি একদম ভালো নয় মেয়ে মাথায় রেখো কথাটা। না আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড আর না তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড। আর না আমি তোমায় জোর করে চুমু খেয়েছি। কাল রাতে যা হয়েছে সেটা শুধুই রাগ ছিলো যা আমি কখনোই তোমার সাথে করতে চাইনি।” সাগর পরপর বলে চলছে মাহি ফ্রীজ হয়ে গেছে সাগরের স্পর্শে। আধ আলোছায়ায় মুহুর্ত পাল্টে গেছে। একজনের শরীরের অজানা উত্তাপ অন্যজনকে নিরুত্তাপ করে দিচ্ছে। এক দারুণ অনুভূতি শীতল শান্ত স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছে মাহির শরীরে আর সাগর! তার দেহে যেন হঠাৎ করেই এক ভয়ংকর অগ্নিলাভা সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। চারপাশে সব জ্বলসে যাচ্ছে। আশেপাশে কি আগুন আছে কোথাও! নাকি মাহিয়া নিজেই এক আগুন। থমথমে লাগছে চারপাশ কোথাও একটু আওয়াজ নেই। নিরব ছাঁদের পরিবেশ হুট করেই সরব হয়ে উঠলো। সিঁড়ির দিকে আওয়াজ পাওয়া গেল সমুদ্র আর তিথির। সাথে বোধ হয় শৈবাল ও আছে৷ সাগর ছেড়ে দিলো মাহিকে ছিটকে সরে আসলো একটু দূরে৷ তখনই ছাঁদে উঠে আসলো এক এক করে তিন ভাই বোন।

–” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া! কেমন আছো?” হাসি হাসি মুখে সমুদ্র জিজ্ঞেস করলো সাগরকে৷ মাহি তো পেছনে এখন যদি সমুদ্র প্রশ্ন করে মাহি আর আমি ছাঁদে কেন? সাগরের মনে হলো সে একটু ভয় পাচ্ছে। কিন্তু ভয় পাওয়ার কি আছে সে তো ডাকেনি মাহিয়াকে। দেখা হওয়াটা কাকতালীয়। আদৌ ও কাকতালীয়! নিজেই নিজেকে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করে বিব্রত হচ্ছে সাগর এদিকে ভাই বোন গুলো বেশ কৌতুহল নিয়ে তাকে দেখছে।

–” বর মশাই কথা বলো না কেন?” তিথির প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল।

–” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছি। তুই কেমন আছিস আর এত তাড়াতাড়ি এলি কি করে?”

–” প্লেনে এসেছি। সারপ্রাইজ দিবো বলে কাউকে জানাই নি। ” সমুদ্রের কথা বোধ হয় কানে যায়নি তার। সে একটু বাঁকা হয়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করলো। মাহি কোথায় গেল! এখানেই তো ছিলো। এবার পুরোপুরি পিছনে ফিরে অবাক হলো মাহি নেই। এখান থেকে তাূের ছাঁদের দরজায় যেতে হলে কম করে ও ত্রিশ সেকেন্ড লাগবে। ওরা কি কেউ দেখেনি মেয়েটাকে!

–” কি ব্যাপার ভাইয়া কি ভাবছো। ওদিকে কি দেখো ভাবি এসেছিলো নাকি?” টিপ্পনী কেটে বলল সমুদ্র। সাগর অন্যমনষ্ক থাকায় খেয়াল করেনি সে ও আস্তে করে বলল, ” হু”।

–“সিরিয়াসলি!”

–” এক থাপ্পড় লাগাবো কি আজাইরা কথা বলিস? চল নিচে চল। ” বলেই সাগর তিথি আর শৈবালের হাত ধরে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। মনে মনে এখনও ভাবছে মেয়েটা উধাও হলো নাকি!

সাগর যখন সবাইকে নিয়ে নিচে গেল মাহি তখন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। সমুদ্রের গলা শুনে সাগর যখন সামনে ফিরে তাকালো মাহি তখন ঝুপ করে সেখানেই বসে গেল। রেলিঙের আড়াল থাকায় কারো চোখে পড়েনি।

সারাদিন মন খারাপ নিয়ে কাটিয়েছিলো মাহি। আজ নিজের বিয়ের কথা শুনে কেঁদেছিলো খুব। শেষে কিনা নিরব ভাইয়ার সাথে বিয়ের কথা ভেবেছে তারা। এ ও সম্ভব যেই ভাইকে সে আপন ভাই ভাবে সেই ভাইকে বিয়ে! নিজের মনের দুঃখ কমার আগেই আবার খবর পেল নিপার বিয়ে ঠিক। নিপা রাজী নয় বয়স তো এখনও আঠারো হয়নি। তারওপর সে সমুদ্র কে ভালোবাসে দু’বছরের বেশি সময় ধরে। এটা ঠিক সেই ভালোবাসার খবর সমুদ্রের জানা নেই। হয়তো একটু আধটু টের পেত সে তবুও তো নিপার ভালোবাসা সত্যি তো ছিলো। নিজের দুঃখ সাথে প্রাণের প্রিয় বান্ধবীর দুঃখ মিলেমিশে একাকার হয়ে দুঃখের বন্যা হয়ে গিয়েছিলো। তারপর রাতের বেলায় সেই দুঃখ আরো এক গামলা বেড়ে গেল সাগরের জন্য মশার কামড় খেয়ে অপেক্ষা করতে গিয়ে। যদিও সাগর আসবে তার কোন নির্দিষ্টতা ছিলো না। তবু অবুঝ মন ধরে নিয়েছিলো আজও ছাঁদে আসবে মানুষটা হলো ও তাই। তাতে লাভ কি দেখা হলে তো আর দু’চারটা মিষ্টি কথা ভুল করে ও বলবে। হনুমানের দাদা একটা হুহ।

রাতের খাবার আগেই শেষ হয়েছিলো তবুও এখন সবাই ডাইনিংয়ে বসেছে৷ কারণটা সমুদ্র । সে এখন খাওয়ার নামে বসলেও মূল উদ্দেশ্য গাড়ি নিয়ে কথা বলবে। ভীষন রকম এক্সাইটেড সে কত বছর পর বাড়িতে একটা নতুন গাড়ি আসবে। আর সেই গাড়ি সে নিজেই পছন্দ করবে। বড় বাবা বলেছে সমুদ্র যেহেতু এসে গেছে তবে তার পছন্দেই কেনো। সাগর বলল, তবে তাই হোক৷ তারা সবাই হাসিখুশি গাড়ি নিয়ে কথা বলছিলো। শৈবাল ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে সাগরের কোলে বসে আছে৷ তার মা অনেকবার নিতে এসেছিলো সে যায় নি। কিন্তু সাথী আর যুথি চেয়েও আসতে পারছে না এদিকটায় পড়ার নামে সন্ধ্যে থেকে ঘরে রেখেছে। মন খারাপ হয় খুব আজকাল দু’বোনের। কেমন যেন এক ঘরে লাগে নিজেদের আর সব দোষ শিলা ভাবীর। শিলা ভাবীর আলাদা হওয়া দেখেই মা এমন করলো। কি লাভ আলাদা হয়ে ওখানে সবাই মজা করছে, মনে মনে এই ভাবছিলো সাথী ঠিক তখনি চোখে পড়ে সাগরের৷ বুকের ভেতরটা কাঁটা দিয়ে উঠে। দূর থেকে তাকিয়ে আছে বোন দু’টো তার। কত্ত আদরে বড় করেছে অথচ আজ চাচীর অমন হঠাৎ বড়লোক আর আধুনিক হওয়ার শখ তার সন্তানদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

–” নিচে আয়।” সাগর ডাকলো দু’বোনকে। যুথি চলেই আসছিলো কিন্তু সাথী বলল, ” মা বকবে রে যুথি খাবার খেতে বলেছিলো”।

–” তুই না গেলে না যাবি আপু। আমি তো যাবো ভাইয়া ডেকেছে মা দেখি কি করে।” যুথি খুব রেগেই বলল৷ সাথী আবার ও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই হুংকার ছাড়লো সাগর, আর এক সেকেন্ড ও যদি দেরি করিস তবে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না”। কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দৌড়ে এলো দু’বোন। জয়নব সবটা দেখেছে নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। মেয়েদের সে মিশতে বারণ করে না কিন্তু সেই মেশা সারাদিনে একবার কি দু’বার। পুরো সময় পড়াশোনা আর আধুনিক হওয়ার জন্য জোর খাটানো। আধুনিকতা কি সাজসজ্জা আর পোশাকআশাকে হয়!

আজ বহুদিন বাদে হাওয়া বেগম খুব বেশিই খুশি। নাতি নাতনি প্রায় সবাই একসাথে শুধু সৈকতটা নেই। খুশি মনে রাত দুপুরে সেমাই রাঁধতে বসে গেছেন বৃদ্ধা মহিলা৷ ঘোষণা দিয়েছেন আজ পার্টি হবে। কাল ও হবে তবে কাল ছাঁদে হবে জমিয়ে। সৈকত কে আসতে বলবে। আজকের মত সেমাই বেড়ে দিচ্ছেন সব নাতি নাতনি কে। শৈবাল ঘুমিয়ে পড়েছে তিথিও ঘুম ঘুম অবস্থা । সাগর শৈবাল কে ঘরে দিয়ে এসেছে কিন্তু তিথিকে ঘুমুতে যাওয়ার কথা বললে জবাব দিলো, ” আমি ঘুমালে আমার সেমাই কে খাবে? ভাবি কে দিয়ে দিবে?” কাঁদো কাঁদো গলা তিথির আর চমকে গেল সবাই৷ সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে দাদুনী বললেন, ” কোন ভাবী?”

–” আ আমি কি জানি? ”

–” কেন ছাঁদে যে সমুদ্র ভাইয়া বললো তুমি ভাবি এসেছিলো”। তিথির কথাটা ছিলো দাদুনীর কাছে বোমা বিস্ফোরণের মত।

–” কিহ!”

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here