শব্দহীন_বৃষ্টি (২২)

0
899

শব্দহীন_বৃষ্টি
(২২)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
দেখতে দেখতেই বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। আর মাত্র আজকের দিন তারপরই বিয়ে। আজ মেয়ে বাড়ির গায়ে হলুদ। ছেলে পক্ষ আসবে মেয়েকে হলুদ দিতে কাল মেয়ে পক্ষ যাবে ছেলেকে হলুদ দিতে। মাহি তো আনন্দে আটখানা হয়ে গেছে। সকাল থেকেই পুরো ঘর মাথায় তুলে নিয়েছে ড্রেস বাছাই করা নিয়ে। মাহিম কে বলছে সব কাপড় নিয়ে নে কিন্তু মাহিম লজ্জা পায় সে যাবে না মাহির সাথে। তার একটাই কথা তোমার বান্ধবীর বিয়ে তুমি যাও। আমি যাবো না অপরিচিতদের মাঝে। মাহির মা টেশন করছেন মেয়েকে একা পাঠানো ঠিক হবে না ভেবে কিন্তু নিরব আশ্বাস দিলো সে ও যাচ্ছে । তাই ভয়ের কিছু নয় যদিও নিরব ছেলে পক্ষের মেহমান৷ নিপার হবু বর নিরবের বন্ধু কথাটা আজই জানতে পেরেছে নিরব৷ এমনকি যাওয়ার সময় নিরব নিজে মাহিকে দিয়ে আসবে তার বান্ধবীর বাড়িতে। হলুদের ড্রেস কোড ঠিক করা হয়েছে মেয়ে বাড়িতে ছেলে পক্ষ অবশ্য তেমন কোন প্ল্যান করেনি৷ হলুদের শাড়ি কেনার দ্বায়িত্ব প্রথমে নিপার চাচাতো বোন নিলেও পরে অন্য কাজের জন্য পারেনি। মাহির মা স্বইচ্ছায় সে কাজ করে এলো। অনেক বেছে তিনি তসর সিল্ক এর মধ্যে হলুদের গোলাপি মিশ্রিত শাড়ি পছন্দ করেছেন। ছেলেরা নাকি নিল পান্জাবি পড়বে বলেছে। মাহির তাতে কিছু যায় আসে না শাড়ি তার পছন্দ হয়েছে এখানেই কথা শেষ । মাহির ব্যাগ গোছানো শেষ । এই প্রথম মা কে ছেড়ে কোথাও থাকবে টানা তিনদিন৷ একটু একটু খারাপ লাগছে মাহির এখন আবার মনে পড়লো সেই মানুষটাকে ও দেখবে না এ ক’দিন। এমনিতেও এক সপ্তাহ ধরে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে না।

সেই রাতে মাহি যা করেছে তা লজ্জার। সাগর এমনটা করলেও ব্যাপারটা বোধ হয় এতখানি বিশ্রী লাগতো না যতোটা সে নিজে করায় লাগছে। আর সেই রাত থেকেই মাহি লজ্জা বোধ করছে খুব। সাগরের সাথে সে এতদিন যা করেছে সবটা খুবই বিশ্রী কাজ ছিলো। গায়ে পড়ে সে তাকে প্রেম নিবেদন করতো ছিঃ ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা আসছে। সেই এক চুমুতেই যখন টের পেল সাগর নিঃসাড় হয়ে নিজের হাত দু’টো তাকে স্পর্শ করা থেকে আটকে রাখছে তখনই মাহি সরে গিয়েছিলো। উহুম, সাগরের সামনে থেকে নয় শুধু বরং ছাঁদ থেকেই। আর সেই থেকেই মাহি আজ এক সপ্তাহ হয় রাতে আর ছাঁদে যায় নি এমনকি কোন ভাবে সাগরের চোখে ও পড়েনি। আগে নিয়ম করে সকালে জানালার পর্দা সরিয়ে চেয়ে থাকতো গেইটের দিকে সাগরকে দেখবে বলে৷ এখন ও দাঁড়ায় তবে পর্দা আড়ালে যেন ভুল করেও সাগরের দৃষ্টি তাকে দেখতে না পায়।কিশোরী মনের দীর্ঘ সময়ের আবেগ যেন হুট করেই গায়েব হয়ে গেছে তার। সেই রাতে করা আবেগী,জেদী কাজটা তাকে তার ভুল শুধরে দিয়েছে।জোর করে অধিকার খাটানো শুধু বেহায়াপনা বৈ কিছু নয়।

দুপুর হয়ে এলো সাগর এখনও বাড়ি আসেনি। কথা ছিলো আজ বাড়ি এসে লাঞ্চ করবে। এক সপ্তাহে আলোচনা বেশ হয়েছে সাগরের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে বলে। ফাইনালি সবার মত এক হয়েছে। প্রথমে অবশ্য শিলা অমত করছিলো পরে কি ভেবে রাজী হলো কে জানে? আজ হাওয়া বেগম নাতির সাথে কথা বলে কাল সকালেই যাবে চামেলির কাছে। কিন্তু সাগর আসলো বিকেলে আর এসেই ঝটপট তৈরি হয়ে কোথাও চলে গেল। আজ আর কথা বলা হলো না।

সময়টা সন্ধ্যের ঠিক আগ মুহুর্ত। মাহি নিজে সেজে সময় নষ্ট করতে পারবে না কিন্তু সাজতে হবে খুব গর্জিয়াস বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা। তাই পার্লার থেকে সেজে এসেছে। নীল আর হলুদের কম্বিনেশন এ শাড়ি বেশ লাগছে মাহিকে। শাড়ির পাড় অবশ্য গোলাপির মধ্যে তাই ঠোঁটের লিপস্টিক ও গোলাপি৷ আটপৌড়ে শাড়ির সাথে খোঁপা আর খোপায় সাদা দোপাটি। হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি চোখের কোল ভর্তি কাজল টানা। পায়ে আলতা ও লাগিয়েছে মাহি। শখ ছিলো বান্ধবীর বিয়েতে পরিপূর্ণ সাজ থাকবে। কিন্তু তা আর হলো কই কোমরের বিছাটাই তো আনতে ভুলে গেছে সে৷ কিছুদিন ধরেই মাহি একটু মোটা হয়েছে আর তাই বোধ হয় তার এ সাজে বয়সটা একটু বড়ই লাগছে৷ পার্লার থেকে ফিরেই নিপার পাশে বসে আছে। খুঁটে খুঁটে দেখছে নিপাকে৷

–” কি দেখছিস “? নিপা জিজ্ঞেস করলো।

–“তোকে” বলতে বলতে নিপার হাতের চুড়ি গুলো নাড়তে থাকলো মাহি। মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। কত পুরনো সম্পর্ক দু’জনের। দুই এলাকায় থাকলেও দু’জনের মনের মধ্যে দূরত্ব এক ইঞ্চি ও নয়। নিপা এমনিতেই কয়েক দিন ধরে কেঁদে চলছে তাই মাহি যথা সম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করছে৷ মাহি এক ফোটা চোখের পানি ফেলতেই নিপা আর নিজেকে সামলাতে পারবে না ভেবে মাহি উঠেই গেল। বান্ধবীর পাশে আর থাকা চলবে না।

–” তুই বোস আমি আন্টিকে জিজ্ঞেস করি ছেলে বাড়ির মেহমান কখন আসবে।” কথাটা বলার সময় মাহির গলাটা কি একটু কেঁপে উঠলো! নিপার দুপুর থেকে আটকে রাখা কান্না মনে হলো ফুলে ফেঁপে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সন্ধ্যের পরই এলো মেহমান ছেলে বাড়ি থেকে। মাহি তো রিসেপশনে দাঁড়িয়ে মহা খুশি আজ সে নিরব ভাইয়াকে খুব জ্বালাবে৷ ভাইয়া সম্পর্কে বেয়াই হবে বান্ধবীর বরের বন্ধু হিসেবে। কিন্তু নিপার মা হুট করেই মাহিকে রিসেপশন থেকে নিয়ে গেলেন। আসলে মাহিকে নিজ দ্বায়িত্বে এনেছেন তাই চাচ্ছেন না ওসব ছেলেপেলের মাঝে কোথাও না থাকুক৷ বিয়ে বাড়িতে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা অনেকটা উশৃংখল আচরণ করেন তিনি মনে করেন। আর মাহি আগে কখনো তার মা’কে ছাড়া কোথাও যায় নি তাই নিজের মেয়ের মত করেই একটু এক্সট্রা গার্ড দিতে চাচ্ছেন৷ মেহমান আসলে সেখানে নিরবকে দেখে একটু স্বস্তি পায় সে এবার নিশ্চয়ই আন্টি আর তাকে চোখে চোখে রাখবেন না। ভাইয়াকে তো চেনেন কিন্তু নাহ এবারও মাহির বেশ জ্বালা হলো৷ নিরব এসেই এদিক ওদিক ব্যস্ত বিশেষ করে নিপার সুন্দরী কাজিনদের সাথে ফ্লার্ট করায়। নিপা কে স্টেজে বসানো হলে মাহি মন খারাপ করে বসে পরলো তার পাশে৷ বসতে গিয়েই বেখেয়ালে শাড়ির একটা পিন ছুটে গেল তার। এদিকওদিক করে খুঁজে পাওয়া গেল না পিনটা। তার ধারণা হয়তো কোথাও পড়ে গেছে।আপাতত নড়াচড়া না করে নিপার পাশেই খুঁটি গেড়েছে। চারপাশে রোশনাই, হৈ হুল্লোড় সব মিলিয়ে হলুদ মুখর সন্ধ্যা খুব ধুমধামে কাটছে মাহির। কিন্তু দুঃখ একটাই বসা থেকে উঠতে পারছে না। শাড়িতে আনইজি লাগছে খুব । কোমড়ের পাশের পিনটা খুলেছে নিশ্চিত পেছন দিকটা দেখা যাবে উঠলেই।

–” সমুদ্র কি রাজশাহীতে?” মাহি চমকালো নিপার মুখে এই হলুদ সন্ধ্যায় এমন একটা প্রশ্ন শুনে।

–” কেন জানতে চাচ্ছিস?”

–” একটাবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে মাহি।”

–” এখন এসব বলা…. মাহিকে থামিয়ে আবার নিপা বলল, ” প্লিজ মাহি তুই অন্তত জ্ঞানমূলক কথা বলিস না। আমি বিয়েতে ঝামেলা করবো না৷ কিন্তু এতসবের মধ্যে এটাই সত্যি আমি সমুদ্র কে ভালোবাসি। সেই ক্লাস নাইন থেকে বাসি। আচ্ছা তুই তো ভালো বাসিস সাগর ভাইয়া কে। বলতো তোর কেমন লাগবে যদি তোর এখন অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যায়।” কথাটা শোনামাত্র মাহি দু’চোখ বুঁজে নিয়েছে। শ্বাস আটকে আসছে তার। ভাবতেই পারে না মাহি আজকাল সাগরবিহীন নিজেকে। সে জানে সাগর কে নিয়ে ভাবনা তার অবান্তর। সাগর কখনো তাকে ভালোবাসবে না এমনকি হয়তো ভালো চোখে দেখে ও না। গত সপ্তাহের ওই রাতটার পর তো নিশ্চয়ই সাগর তাকে বাজে মেয়ে ভাবে। আর এজন্যই তো মাহি আর তার সামনে যায়নি। নিপার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে কিন্তু এই কষ্ট উপশম করার ঔষধ তার জানা নেই। যেকোন মুহুর্তে তার বান্ধবীটি অশ্রুবিসর্জন দিতে পারে ভেবে উঠে গেল সে। কোন দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় নিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে গেল। হলুদের অনুষ্ঠান ছাঁদে হচ্ছে তাই আপাতত নিপাদের ঘরের মহল কিছুটা শান্ত। মাহি সেদিকেই যাচ্ছিলো হঠাৎ শাড়ির পাড়ে পা বেঁধে পড়তে যাচ্ছিলো।চোখ মুখ কুঁচকে মাত্রই আর্তনাদ করে উঠেছিলো কিন্তু পড়েনি মাহি। কারো শক্ত বাহুবন্ধনে আটকে আছে সে। হঠাৎ বাতাসে এক পরিচিত ঘ্রাণ ভেসে আসলো নাকে।ভয়ে কুঁকড়ে থাকা মাহি সাহস করে চোখ খুলতে চাইছে পরমুহূর্তেই মনে হলো ভুল ভাবছে সে। যেই ধরেছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা কিন্তু এই মুহুর্তে চোখ খুলে সাহায্যকারী ব্যক্তিটির দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। একটা সপ্তাহ ওই মানুষটাকে কাছ থেকে না দেখতে পারার কারণেই একটু বেশিই ভাবতো তাকে নিয়ে আর সেই ভাবনাই তার ভ্রমের সৃষ্টি করছে।

–” মেয়েটা ঠিক আছে তো, চোখ খুলছে না কেন?” আতঙ্কিত শোনালো জুয়েল এর কন্ঠ ।

চলবে
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here