#আরোও_একবার_বসন্ত,১০,১১
#১০ম_পর্ব
– মাষ্টার হয়েছিস? আমাকে আদব কায়দা শিখাচ্ছিস? মনের রাখিস পৃথিবীতে তোর আগে আমি এসেছি।
বলেই শিপনকে অগ্রাহ্য করে ভেতরে ঢুকে পড়ে প্রিয়ন্তী। ভেতরে ঢুকতেই তার চোখ পড়ে সোফায় বসা মেহমানদের দিকে। প্রায় সাত থেকে আটজন মানুষ এসেছে। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে সিঙ্গেল সোফার দিকে তাকাতেই প্রিয়ন্তীর চোখজোড়া আটকে গেলো। ভেবেছিলো এই অদ্ভুত বিরক্তিকর মানুষটির সাথে ইহজীবনে দেখা হবে না। কিন্তু উপরওয়ালা তার ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে আরাফাত নামক ব্যাক্তিটির সাথে পুনরায় তার দেখা করিয়ে দিলো। সিঙ্গেল সোফায় কালো শার্ট পরিহিত শ্যামবর্ণের পুরুষটি বসে রয়েছে। চুল গুলো বেশ কায়দা করে স্টাইল করা, আজ চোখে চশমা নেই৷ তবে চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে লেন্স পড়ে রয়েছে। কারণ আরাফাতের চোখের মনি ধূসর বর্ণের, কিন্তু আজ হালকা নীলাভ লাগছে। অবশ্য বেশ মানিয়েছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চোখের লেন্স এবং চুলের স্টাইল সব মিলিয়ে সাউথের হিরো হিরো লাগছে। মানুষটার সাথে আজ দু মাস পর দেখা হয়েছে ব্যাপারটা প্রিয়ন্তীর কাছে মন্দ লাগছে না। কিন্তু হঠাৎ ই মনটা উদাস হয়ে গেলো। কারণ আরাফাত ব্যাতীত সেখানে পাত্রের ন্যায় কাউকেই লাগছে না। তবে কি এই সেই ছেলে যার সাথে ছুটকির বিয়ের কথা শিপন বলছিলো। প্রিয়ন্তী চেয়েছিলো আরাফাতের সাথে তার প্রফেশনালী দেখা না হোক। কিন্তু সে কখনোই চায় নি এভাবে আরাফাতের সাথে দেখা হোক। অবশ্য একজন সাতাশ বছরের যুবক একজন একুশ বছরের যুবতীকেই বিয়ে করতে চাইবে। এটাতে এতো অবাক হবার কিছুই নেই। আরশাদ নামক ছেলেটির সাথে আজকে পরিচয় না হলে প্রিয়ন্তী এই বিয়েতে আপত্তি করতো না হয়তো। সে পুরুষ একজন পথচারী বাচ্চাকে বাঁচাতে চোখ বন্ধ করে নিজের অর্থ খরচ করতে পারে সেই মানুষটি তার বোনের জন্য বেশ উপযোগী একজন মানুষ। কিন্তু রুপন্তী আরশাদকে ভালোবাসে। ছেলেটাও মন্দ নয়৷ সে তাকে কথা দিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি তার বড় ভাই এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে প্রিয়ন্তীকে। তারপর পুরো পরিবারকে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে আসবে। চিন্তার ঝাপিটুকু বন্ধ করে বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো প্রিয়ুর। অচেনা পুরুষের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে মানুষ আর চাহনী নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সবাইকে সালাম দিলো সে। শিপন তাড়াতাড়ি দরজা আটকিয়ে ভেতরে আসলো৷ রাফিজা বেগম অবাক কন্ঠে বলেন,
– তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না মা! যদি পরিচয়টা দিতে
সাথে সাথেই শিপন পেছন থেকে বলে উঠলো,
– আমার বড় বোন। আপু উনি পাত্রের মা।
– ওহ! ভালো আছো মা?
– জ্বী আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন আন্টি?
– আল্লাহ রেখেছেন। এই বয়সে অসুস্থ থাকাটা স্বাভাবিক।
– একটু নিয়মে থাকতে হবে এটুকুই।
– তা মা তুমি কি করো?
– আমি পেশায় ডাক্তার। এ.এস হাসপাতালে চাকরিরত আছি।
– বাহ! আলহামদুলিল্লাহ।
রাফিজা বেগমের সাথে বেশ সুন্দর করেই কথা বলছে প্রিয়ন্তী। একজোড়া অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখজোড়া আর কারোর নয় আরাফাতের। প্রিয়ন্তী নামক নারীটি তার মনের দরজায় বারংবার কড়া নাড়ছিলো এই দু মাস যাবৎ। ব্যাপারটা ইনফ্যাচুয়েশন থেকে বেড়িয়ে অন্যকিছুতে রুপ নিয়েছে এটা সে এতোদিন না বুঝলেও আজ এই মূহুর্তে মনটা বেশ ভালো করেই তাকে জানান দিচ্ছে। যে মূহুর্তে প্রিয়ন্তী ঘরে প্রবেশ করেছে। সেই মূহুর্ত থেকে তার চোখজোড়া প্রিয়ন্তীতেই আটকে রয়েছিলো। নারীটিকে দেখা মাত্র হৃদপিন্ডের গতি যেনো দ্বিগুন হয়ে গেছে। নারীটি তার থেকে বয়সে বড় জানা সত্ত্বেও বেহায়া মনটি তার দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে রয়েছে। প্রিয়ন্তীর ব্যবহার স্বাভাবিক থেকেও স্বাভাবিক। এতে শিপন খানিকটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়। ধীরে ধীরে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় শিপন তাকে। সেই সুবাদে আরাফাতের সাথেও তার পরিচয় হয়। আরাফাত পাত্র নয় বরং পাত্রের বড় ভাই। প্রিয়ন্তী এবং আরাফাতের চোখাচোখি হয়। আরাফাত স্মিত হাসি দিয়ে তাকে অভিবাদন জানায়। আরাফাতের স্মিত হাসিটি বরাবরের ন্যায় স্নিগ্ধ। এর মাঝেই রাফিজা বেগম প্রশ্ন করে উঠেন,
– মা তোমার স্বামীকে দেখছি না। সে কি কাজে রয়েছে?
কথাটা শুনতেই প্রিয়ন্তীর হাসি যেনো মিলিয়ে গেলো। এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে সে ক্লান্ত। সে ডিভোর্সি, কথাটা এই চার বছরে শ’খানেক বার সে বলেছে। রাফিজা বেগম অধীর আগ্রহে উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছেন। শিপনের বুকটা একটা মূহুর্তের জন্য ধক করে উঠে। বেশ ভালোভাবেই জানা আছে তার বড় বোন এখন কি উত্তর দিবে। কিন্তু ডিভোর্সি কথাটা শোনা মাত্র রাফিজা বেগমের কি রিয়েকশন হবে এটা চিন্তা করলেই ভয়টা গাঢ় হচ্ছে। এতোটা এডভ্যানস এখনো বাংলাদেশের মানুষ হয়ে পারে নি, ডিভোর্সি মেয়ে শুনলেই নাক ছিটকাবে। তারপর যেহেতু মেয়ে ডিভোর্সি তাই পুরো দোষটা মেয়ের উপর দিবে, মা-বায়ের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। অতঃপর ছোট মেয়েকেও এই পাল্লায় ফেলবে। তাই দেরি না করেই বলে উঠলো সে,
– আপু অবিবাহিত।
শিপনের কথাটা শোনামাত্র প্রিয়ন্তী তার দিকে অবাক নয়নে তাকায়। প্রিয়ন্তীর তীক্ষ্ণ চাহনী থেকে শুকনো ঢোক গিলে শিপন। মিথ্যে বলাটা একেবারেই সহ্য হয় না প্রিয়ন্তীর। আর অজানা মানুষকে কেনো মিথ্যে বলতে হবে এটা বুঝে পায় না সে। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে প্রিয়ন্তী তাকে বলে,
– মিথ্যে বলার দরকার নেই শিপন। বিয়ের সম্পর্কে মিথ্যে জিনিসটা খুব খারাপ। আন্টি আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। চার বছর হয়ে গেছে। আসলে শিপন ভেবেছে আপনারা খানিকটা ব্যাকডেটেড মানুষ। আমার ডিভোর্সের কথা শুনে ছুটকিকে জাজ করবেন। ছেলে মানুষ তো!
প্রিয়ন্তীর নির্বিকার বক্তব্য আরাফাতের ভেতরটা নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। আরাফাত অবাক নয়নে প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকতো। এদিকে রাফিজা বেগমের মুখেও কালো মেঘের আবরণ পড়ে যায়। বড় বোন ডিভোর্সি ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। এদিকে প্রিয়ন্তীর সৎ সাহস দেখে রাফিজা বেগমের বড় ভাই আকরাম সাহেবের মুখে একটা প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। বড় বোনকে দেখেই তিনি ছোট বোনের স্বভাবের আন্দাজ করতে পারছেন। আমতা আমতা স্বরে রাফিজা বেগম বললেন,
– কেনো ডিভোর্সটা হয়েছিলো?
– সে বলেছিলো আমি নাকি মেন্টালি আনস্টেবল। আর আমি বলবো সে আমাকে ভালোবাসতো না। এখন দুটো মানুষের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারা হতেই পারে। আপনি কোনটা বিশ্বাস করবেন সেটা আপনার উপর।
শিপন এটাই ভয় পাচ্ছিলো। এতো ভালো পরিবার থেকে সম্বন্ধ এসেছে, সে চেয়েছিলো ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে যাক। কিন্তু প্রিয়ন্তী নামক মানুষটি নিজের জিদকে প্রাধান্য দিবেই। ডিভোর্সের ব্যাপারটা চেপে গেলে কি হতো! তাড়াতাড়ি ভেতরে যেয়ে রুপন্তীকে পাঠাতে বললো সে স্নেহাকে। চায়ের ট্রে নিয়ে কাঁপা হাতে বসার ঘরে প্রবেশ করে সে। ভয় লাগছে, পাছে তারা যদি সম্মতি দিয়ে দেয় বিয়েতে। রুপন্তিকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো প্রিয়ন্তীর। শাড়ি পড়া মাথায় ঘোমটা তোলা বাচ্চাদের মতো কোমল মুখখানা দেখে রাফিজা বেগমের বেশ মনে ধরলো। এমন একখানা বৌ ই তো চাই তার ঘরে। কিন্তু মনে খচখচটা বেশ জোরালোভাবেই শুরু হলো। বড় বোনের মতো হলে তো একই ঘরে থাকা দায় হয়ে যাবে। ডিভোর্স কাদের হয়! যারা সংসারে মানিয়ে নিতে পারে না। যদি বাপু মানিয়ে নিতেই পারতে তবে ডিভোর্স কেনো হতো? তাকে শক্ত ভাবেই মেয়েকে বুঝিয়ে দিতে হবে তার পরিবারে এসব ডিভোর্স টিভোর্স হয় না। সবাইকে সালাম দিয়ে চা তুলে দিলো রুপন্তী। জাহানারা বেগম বসার ঘরে রুপন্তীর সাথে উপস্থিত হলেন। রুপন্তীকে দেখে রাফিজা বেগম ধীর কন্ঠে বললো,
– ভালো আছো?
– জ্বী আলহামদুলিল্লাহ
– তা তোমাকে কিছু প্রশ্ন করি?
রাফিজা বেগমের প্রশ্ন শুনে প্রিয়ন্তীর ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে যায়। রুপন্তী ধীর কন্ঠে ছোট করে “জ্বী” বলে। এরপর রাফিজা বেগম প্রশ্ন করে,
– তুমি রান্নাবান্না পারো?
– জ্বী অল্পকিছু টুকটাক।
– বাহ আলহামদুলিল্লাহ, একটা কথা সুন্দর মতো বলে দেওয়াটা ভালো। বিয়েটা ছেলে খেলা নয়। ঝামেলা হবে, ঝগড়া হবে। তবে এসব ডিভোর্স টিভোর্সে যাতে ব্যাপারটা না গড়ায়। যদি এমন কোনো ইচ্ছে থাকে বলে দাও আমরা আগাবো না। তোমাদের ঘরে তো ডিভোর্সের ধাচ আছে।
রাফিজা বেগমের কথাটা তীরের মতো বাঁধলো প্রিয়ন্তীর বুকে। জাহানারা বেগম যেনো হতভম্ব হয়ে গেলেন। আকরাম সাহেব এবং আরাফাত রাফিজা বেগমকে থামতে বলছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। রাফিজা বেগমের কথাটার উত্তর না দিয়ে পারলো না প্রিয়ন্তী। ধীর কন্ঠে বললো,
– আন্টি আপনি কিভাবে জানলেন আমার ঘরে ডিভোর্সের ধাঁচ আছে? সবার বিয়ে তো সফল হয় না। আর আমার বিয়েটা সফল হয় নি বলে যে কারোর বিয়ে সফল হবে না এমনটা তো আর নয়!
– তুমি যেভাবে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলো তোমার বিয়ে যে টিকবে না এটা তো বোঝাই যাচ্ছে।
কথাটা শুনেই প্রিয়ন্তীর ভেতরটা চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। এই উক্তিটি তাকে ভেতর থেকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। শিপন এতোক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। রুপন্তী রীতিমতো চোখের পানি ছেড়ে দেয়। ধীর কন্ঠে শিপন বলে,
– আন্টি আপনি না জেনে আমার বোনকে এক্যুজ করবেন না। আমার বোনকে দেখেছেন তো এই প্রথম। তাকে নিয়ে এই উক্তিটি কি করা কি আপনার সাজে!
– এক্যুজ না! যা সত্যি তাই বলছি। আর বড় বোন এমন হলে না জানি ছোট টা কেমন হবে।
– আন্টি আপনি আপনার মূর্খতার প্রমাণটা আর দিবেন না প্লিজ!
খুব ঠান্ডাভাবে কথাটা বললো প্রিয়ন্তী। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না প্রিয়ন্তী। ক্ষত জায়গাটা থেকে পুনরায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। প্রিয়ন্তীর ঠান্ডা কন্ঠের বাক্যটি শুনেই……………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#আরোও_একবার_বসন্ত
#১১তম_পর্ব
– আন্টি আপনি আপনার মূর্খতার প্রমাণটা আর দিবেন না প্লিজ।
খুব ঠান্ডাভাবে কথাটা বললো প্রিয়ন্তী। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না প্রিয়ন্তী। ক্ষত জায়গাটা থেকে পুনরায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। প্রিয়ন্তীর ঠান্ডা কন্ঠের বাক্যটি শুনেই রাফিজা বেগমের মুখখানা আষাঢ়ের ঘন কালো আকাশের ন্যায় হয়ে গেলো। রাফিজা বেগমকে এমন দ্বারা অপমাণ ইহজীবনে কেউ করে নি। উপস্থিত সবাই যেনো থতমত খেয়ে গেলো। অন্য সময় শিপন কিংবা স্নেহা বাধা সাধে কিন্তু আজ কিছুই বলছে না তারা। কারণ প্রিয়ন্তীর কথায় যৌক্তিকতা রয়েছে। রুপন্তী এখনো মাথা নিচু করে রয়েছে। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। তার জন্যই নিজের বড় বোনকে এমন দ্বারা কটাক্ষ করে কথা শুনতে হইছে। অন্যসময় হলে হয়তো প্রতিবাদ করতো। কিন্তু এমতাবস্থায় তার প্রতিবাদের সুরটুকু বেয়াদবি বলে গণ্য করা হবে। তাই সে চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। বিয়েটা ভেঙ্গে যাক এটা সেও চায়। তবে তার বদলে নিজের মায়ের মতো বড় বোনকে এমন জগণ্য কথা শুনতে হবে এটা যেনো কিছুতে মানতে পারছে না রুপন্তী৷ প্রিয়ন্তী ডিভোর্সি, কথাটা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না আরাফাত। রাফিজা বেগম ডিভোর্স, দ্বিতীয় বিয়ে ব্যাপারগুলোকে একেবারেই মেনে নিতে পারে না। সে যখন দশ বছর তখন সে তার বাবাকে হারায়। তখন রাফিজা বেগম চাইলেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু তিনি করেন নি। নিজের স্বামীর স্মৃতিকে আকড়ে বাচ্চাগুলোকে মানুষ করেছেন। তাই সবাইকে নিজের সাথে তুলনা করেন। প্রিয়ন্তী ডিভোর্সি কথাটা তাকে যতটা নাড়িয়েছে তার থেকে বেশি তার মাকে ভাবিয়েছে। তার ফলস্বরুপ কথার পিঠে কথা, আজ ব্যাপারটা এই অবধি গড়ানো। অবশ্য বারবার নিজের মাকে থামতে বলতে বলতে ক্লান্ত আরাফাত। এখানে প্রিয়ন্তীকে এতগুলো কথা শুনানো মোটেই তার মায়ের উচিত হয় নি। কিন্তু অন্য একটি মেয়ে তার মাকে এভাবে করে অপমাণ করবে এটাও ঠিক মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আরাফাতের। যতই হোক দোষ করলেও অপমাণটা তার মাকে করা হচ্ছে। তাই এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে আরাফাতকে। সে চেয়েছিলো তার ভাই যে মেয়েকে ভালোবাসে তাকে তার বাড়ির বউ করে নিয়ে যাবে। কিন্তু কথার তিক্ততা এতোটা ভয়ানক রুপ নিয়েছে যা থেকে কোনো শুভ সম্পর্ক গড়ে তোলা আদৌ ও সম্ভব নয়। আরাফাত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ধীর কন্ঠে বললো,
– আমার মা হয়তো মূর্খ, সে আপনার মতো ডাক্তার নয়। সামান্য গৃহিনী। তার জীবনটা আমাদের চার দেওয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ। সে এতোটা এডভ্যান্স নয়। তাই তার কথাবার্তাটা আদিমকালের মানুষের মতোই। বুঝেও না মাঝে মাঝে কোথায় কি কথা বলতে হয়। তাই আপনাকে নানা কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছে। আমি তার হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমার মা একটু ঠোঁটকাঁটা। মনে যা আসে তাই মুখের উপর বলে দেন। এটুকু ভাবেন না কোথায় কোন উক্তিটা সাজে। তবে আমি অবাক হয়েছি, অবাক হয়েছি আপনার আচারণে।
আরাফাত কথাটা বলে কিছুটা থামলো। প্রিয়ন্তী অবাক নয়নে আরাফাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফাতের চোখজোড়া কেনো যেনো ব্যথিত মনে হলো। কাতর দৃষ্টিতে মাথা নিচু করে কথা বলছে। উপস্থিত সবাই চুপ করে বসে রয়েছে। কারণ আরাফাতের ন্যায় ভারসম্পন্ন ছেলে কখনোই অযৌক্তিক কথা বলে না। ঠান্ডা গলায় আবার বললো,
– আপনিই তো বললেন, প্রতিটা মানুষ আলাদা, তাদের চিন্তাধারা আলাদা। তাই আমার মায়ের চিন্তাধারা আপনার থেকে আলাদা। তবে সবার সামনে তাকে মূর্খ বলে অপমাণটা না করলেও পারতেন। আমরা এখানে একটা নতুন সম্পর্কের খাতিরে এসেছিলাম। আমার ভাই আপনার বোনকে ভালোবাসে। তাই তার থেকে খোঁজ পেয়ে আমি শিপন সাহেবের সাথে কথা বলি। আরশাদ জানে না আমরা হুট আজ রুপন্তীকে দেখিতে আসবো। ওকে খানিকটা চমকে দেবার উদ্দেশ্যে আমাদের এখানে আসা। মেয়ে দেখাটা খানিকটা বাহানা। রুপন্তীকে আমাদের সবার পছন্দ। কিন্তু এখানে আসার পর বুঝতে পারলাম আমাদের দু পরিবারের মধ্যে সম্বন্ধ হওয়া সম্ভব নয়। এখানে আমার মায়ের দোষটা হয়তো বেশি। সে আপনার ক্ষত জায়গায় আঘাত করেছে। তবে আপনিও তাকে অপমাণ করার সুযোগ ছাড়েন নি। আমি জানি আপনি বলবেন এতে রুপন্তীর কি দোষ? এখানে রুপন্তীর দোষ নেই। তবে থাকতে তো দুজনকেই হবে। আমার মনে হয়তো এটা থেকে যাবে আপনি তাকে অপমাণ করেছেন। আর রুপন্তীর মনে এটা থাকবে আমার মা আপনাকে কটু কথা বলেছে। আবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনাদের কাছে। আপনাদের সময় নষ্ট করলাম। চল মামা।
বলেই হাঁটা দিলো আরাফাত। আরাফাতকে চলে যেতে দেখে আকরাম সাহেব ও উঠে দাঁড়ালেন। একে একে সবাই বেড়িয়ে গেলো প্রিয়ন্তীর বাসা থেকে৷ পিন পতন নীরবতা বিরাজমান। প্রিয়ন্তোর অনুভব হলো তার গাল দিয়ে নোনাপানি গড়িয়ে পড়ছে। সে কেনো কাঁদছে! রাফিজা বেগমের কটু কথা তাকে কাঁদাচ্ছে নাকি আরাফাতের বলা শেষ কথাগুলো। বুঝতে পারছে না প্রিয়ন্তী৷ ঘড়ির কাটার টিকটিক আওয়াজ কানে আসছে। এতোটা নীরব এই বাসাটা হয়তো কখনোই ছিলো না
_____________________________________________________________________________________
রাত আটটা,
আকাশে মেঘ করেছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। বলা যায় না, আবহাওয়াবিদ এমন কোনো কথা নিউজে বলে নি। আজ সারাটাদিন ভ্যাপসা গরম পড়েছিলো। কেউ বলবে না এবার দেশে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়েছিলো। মাত্র ফাল্গুনের শেষ এখনই এমন গরম পড়লে না জানি বৈশাখ কিংবা ভাদ্রে কতটা গরম পড়বে। আবহাওয়াটা বেশ ঘুমোট। বাতাস বইছে কিন্তু সেটা স্বস্তিজনক নয়। ঝড় হবার পূর্বাভাস হয়তো। বাইরের প্রকৃতির সাথে আরাফাতের মনোস্থিতির মিল রয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে একের পর এক সুখটান দিয়ে যাচ্ছে আরাফাত। আজকের ঘটনাটা তাকে বারবার ভাবাতে বাধ্য করছে। প্রিয়ন্তী নামক নারীটি নিকোটিনের ন্যায় তার হৃদয়ের বিস্তার করে নিয়েছে। কিছুতেই তার প্রতি আকর্ষণটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না সে। কিন্তু তাদের মধ্যে বন্ধুত্বটুকু হবার অবকাশ নেই। প্রিয়ন্তীর ডিভোর্সটা তাকে ততটা ভাবাচ্ছে না যতটা তার মা তাকে ভাবাচ্ছে। আরাফাতের জীবনে তার মার থেকে মূল্যবান কেউ নেই। কারণ তার মা তাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন। অপরদিকে প্রিয়ন্তী এককথায় বলতে গেলে তার জীবনের প্রথম নারী যার প্রতি তার আকর্ষণ কাজ করছে। কিন্তু আজ যে ঘটনা ঘটেছে তাতে এই দুই নারীকে একত্র করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ যখন রুপন্তীকে দেখতে তাদের বিল্ডিং এর সামনে গিয়েছিলো কোথাও কোথাও মন বলছিলো প্রিয়ন্তীর সাথে দেখাটা হলে মন্দ হবে না। কিন্তু এভাবে দেখা হবে এটা ভাবতে পারে নি। নিকোটিনের ডোজ বাড়াতে হবে, মাথা থেকে প্রিয়ন্তী নামক নারীকে মুছে ফেলতে হলে। তাই সিগারেটটা শেষ হতে না হতেই আরেকটি সিগারেটে আগুণ জ্বালালো আরাফাত।
– ভাই, ডেকেছিলে?
আরশাদের কথায় চিন্তার দোটানা থেকে বাস্তবে ফিরে আরাফাত। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটি রেলিং এ চেপে নিভায় সে। তারপর নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে বারান্দা থেকে রুমে আসে আরাফাত। ঠান্ডা গলায় বললো,
– হুম, তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো৷
– কি কথা?
– আজ আমরা রুপন্তীর বাসায় গিয়েছিলাম।
– কখন গিয়েছিলে? আমাকে বলোনি কেনো?
– ভেবেছিলাম তোমাকে এসে জানাবো। আসলে গতকাল রাতে কথা হয়েছিলো রুপন্তীর ভাইয়ের সাথে। মাও হুট করে বায়না করলো। মামারাও রাজী ছিলো৷ তাই আজ বিকেলেই গিয়েছিলাম।
– যাক বাঁচালে, রুপু আমাকে জানিয়েছিলো কেউ তাকে দেখতে আসবে। তাহলে তো আর ঝামেলাই নেই। কথা কি পাকাপাকি হয়ে গেছে?
আরশাদের প্রশ্নের উত্তর নেই আরাফাতের কাছে। আরাফাতের চোখ মুখ বলে দিচ্ছে সেখানে সুখময় কোনো ফলাফল আসে নি। অবাক কন্ঠে পুনরায় আরশাদ বললো,
– ভাই কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
– তোমার আর রুপন্তীর বিয়েটা সম্ভব নয় আরশাদ!
– মানে?
এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাফাত। বিছানায় বসে ধীর কন্ঠে বিকেলে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বিস্তারিত বললো আরশাদকে। আরশাদের ঠিক কি ভাবে রেসপন্স করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। রুপন্তীর কথাটা ভেবেই বুক কেঁপে উঠছে। আরাফাতের কথা শেষে বরফ ঠান্ডা গলায় আরশাদ বললো,
– প্রিয়ন্তী আপুর ক্ষত স্থানে মা এতবড় আঘাতটুকু না করলেই পারতো ভাই।
– মায়ের দোষ অনেক বেশি আমি জানি, কিন্তু সেখানে দুজনের কেউ ই ছেড়ে কথা বলছিলো না।
– কেনো বলবে না ভাই? তুমি জানো প্রিয়ন্তী আপুর অতীতটা কতোটা হৃদয় কাঁপানো? যে মানুষটা জানোয়ারের মতো তাকে মারতো, তার সাথে পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবন থাকা স্বত্তেও তাকে ছেড়ে অন্য কোনো নারীতে মত্ত হয়েছিলো সেই জানোয়ারটার সাথে ডিভোর্স হবার জন্য কেনো প্রিয়ন্তী আপুকেই সব অপবাদ মাথা পেতে নিতে হবে। আর একটা কথা, বিয়েটা আমি রুপুকেই করবো। একটা জানোয়ারের জন্য প্রিয়ু আপুর জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। তার বিবাহিত জীবন সুখময় ছিলো না তাই বলে আমার আর রুপুর ও হবে না এটার কোনো মানে নেই।
– এটা সম্ভব নয় আরশাদ
– অনেক কিছুই পৃথিবীতে অসম্ভব থাকে ভাই। নিজের ইচ্ছে শক্তি থাকতে হয় মাত্র। তাহলে দেখবে সবই সম্ভব।
কথাটা বলে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় আরশাদ। তার শেষ উক্তিটি এখনো কানে বাজছে আরাফাতের। ইচ্ছে শক্তি থাকলে আসলেই কি সব সম্ভব হয়!!
অপরদিকে,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রিয়ন্তী। চুল উড়ছে তার বাতাসে। বাতাসটা ঘুমোট হলেও মন্দ লাগছে না তার। রুপুর কথাটা মনটাকে বেশ ভাবাচ্ছে। মেয়েটা আরশাদকে ভালোবাসে। কি ভেবেছিলো আর কি হলো। ওই মূহুর্তে চুপ করে গেলে হয়তো এতোদূর কথা আগাতো না। কিন্তু কেনো যেনো নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে গিয়েছিলো প্রিয়ন্তী। বুক থেকে অচিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। সব শেষে নিজের দোষটার মাত্রা সর্বাধিক লাগছিলো। শিপন ঠিক ই বলতো, তার জন্য হয়তো ছুটকির জীবনে সুখ আসবে না।
– আপু, আসবো?
কথাটা কানে আসতেই পেছনে ফিরে প্রিয়ু। দরজার ওপারে তখন………….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি