আরোও_একবার_বসন্ত #অন্তিম_পর্ব

0
623

#আরোও_একবার_বসন্ত
#অন্তিম_পর্ব

প্রিয়ন্তীর কথার ধরণ অনেকটাই আলাদা। চার বছর আগের প্রিয়ন্তী আর আজকের প্রিয়ন্তীতে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। ঠোঁটের কোনায় ম্লান হাসি একে ইরফান বলে,
– আজ রাতে ইন্ডিয়ার জন্য রওনা দিচ্ছি। তাই তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। দেশে ফেরা হবে কি না জানা নেই।
– মানে?
– সামিহার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো একমাসের বেশি তাকে বাঁচানো যাবে না, ওর চিকিৎসার জন্যই ইন্ডিয়া যাওয়া। ওখানের ভিসার জন্য এপ্লাই করছিলাম অনেকদিন। হয়েও গেছে। ছয়মাসের ভিসা। আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি। ওকে যদি আল্লাহ আমার কাছে ফিরিয়ে দেন তো আলহামদুলিল্লাহ। আর না ফিরিয়ে দিলে দেশে ফিরবো না। জার্মানিতে আমার ভিসা রয়েছে। ওখানেই চলে যাবো মেয়েকে নিয়ে। এ দেশে থাকলে সামিহার স্মৃতি আমাকে বাঁচতে দিবে না। চারটা বছর বলে কথা।

ইরফানের কন্ঠ কাঁপছে। তার চোখের কোনায় অশ্রু ভিড় করেছে। এখানে আসার আগেও বেশ রাগ হচ্ছিলো প্রিয়ন্তীর। কিন্তু এখন বেশ দয়া হচ্ছে ইরফানের উপর। একটা সময় এই ভারী শরীরটার কঠোর প্রহার সহ্য করতে হতো। অথচ আজ সেই ভারী শরীরটির অংশীদার মাথা নত বসে রয়েছে। ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে প্রিয়ন্তী বললো,
– বুঝলাম, তা আমার কাছে কি চাই। কেনো জরুরি তলব?
– চাই তো বটেই। আমি ক্ষমা চাই প্রিয়ু। তোমার সাথে করা অন্যায়গুলোর ফল আজ আমার দুধের বাচ্চাটা পাচ্ছে। একটা কথা আছে না! মানুষের কর্মফল কিছু হলেও দুনিয়াতেই ভোগ করতে হয়। এই ছয় ছয়টা মাস কি নরক যন্ত্রণা সহ্য করছি তোমার ধারণাও নেই। বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি সত্যি ই সামিহাকে অনেক ভালোবাসি। তোমার প্রতি আমার মোহ ছিলো জআনি শুনতে খুব খারাপ লাগছে। আমাকে খুব নিচ মনে হচ্ছে কিন্তু এই সত্যিটা লুকোনোর কোনো মানে হয় না। সামিহা মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। ও আসার পর ভালোবাসতে কি করে হয় সেটা শিখেছি আমি। শুধু দেহের চাহিদাই ভালোবাসা নয় এটা শিখেছি আমি। আমাদের সংসারটাও বেশ সুখের ছিলো। কিন্তু ওই যে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমার পাপের ভাগটা স্রষ্টা তাকে কেড়ে নিয়ে দিচ্ছে। তোমার উপর অনেক অন্যায় করেছি, নির্যাতন করেছি। মেরেছি, তোমাকে ধোকা দিয়েছি। তবুও আমায় ভালোবেসেছো। আমি মূর্খ তোমায় পায়ে ঠেলেছি। সেই পাপের শাস্তি ই পাচ্ছি। তবুও নির্লজ্জের মতো ক্ষমা চাচ্ছি। শুধু এই আশায়, যদি তোমার ক্ষমা পেলে আল্লাহ একটু দয়া দেখায় আমার উপর। বাচ্চাটা খুব ছোট তো। তুমি বললে আমি তোমার পাও ধরতে রাজি আছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও

প্রিয়ন্তী অনুভব করলো তার গাল ভিজে এসেছে। মনের মাঝে যাকে ঘৃণার সর্বোচ্চ সারিতে দাঁড় করে রেখেছিলো সেই মানুষটার দুঃখে আজ তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। ভালোবাসা কত কিছুই না পারে। ভালোবাসার টানে আজ ইরফানের মতো মানুষ তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছে। হায়রে মানুষ, হায়রে ভালোবাসা। মুচকি হেসে ধীর কন্ঠে বলে প্রিয়ন্তী,
– আমি তোমায় কবে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার মনে তোমার প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই। হয়তো বিশ্বাস করবে না তবে আমি তোমাকে কখনো বদদোয়া দেই নি। তুমি সুখে থাকো এটাই চেয়েছি। হ্যা আমার জন্য ও সুখ চেয়েছি। কিন্তু তোমাকে অসুখী রাখুন এটা কখনো চাই নি। আমি তোমাকে সেদিন ক্ষমা করে দিয়েছি যেদিন তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো। আমি প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পেরেছি। আমার মনে আর ভয় ছিলো না কেউ আমাকে মারবে কেউ আমাকে নির্যাতন করবে। এটা ঠিক সমাজের নানা কটু কথার সম্মুখীন হয়েছি। দোষ না থাকলেও চরিত্রহীনার ট্যাগ পেয়েছি। তবুও আমি তোমার খারাপ হোক এটা চাই নি। চেয়েছি তুমি সুখে থাকো। কারণ আমি তোমার মোহ হলেও তুমি আমার ভালোবাসা ছিলে।
– তুমি কি আমাকে এখনো?
– নাহ, এখন আমার মনে তোমার প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই, নেই অভিমান, নেই রাগ আর নেই ভালোবাসা। কারণটা কি জানতে চাও? কারণ আমার জীবনেও আরোও একবার বসন্ত এসেছে। আমার স্বামী রুপে। সে আমার জীবনটাকে নতুন ভাবে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। তুমি ছেড়ে দিবার পর যাও নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম বাবা মারা যাবার পর একেবারেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিলাম। দিন কাঁটানোর জন্য কাঁটাতাম। কিন্তু এই বাইশ দিন আমি বেঁচেছি। আমি আমার জীবনটাকে বাঁচার মতো বেঁচেছি। আজ উঠছি ইরফান। বাসায় ও হয়তো এসে পড়েছে। দোয়া করি যেনো তোমার স্ত্রী সুস্থ হয়ে যায়। আল্লাহর দুনিয়ায় অবাস্তব কিছুই নেই।

বলেই উঠে দাঁড়ালো প্রিয়ন্তী। ইরফানও হাসি মুখে তার থেকে বিদায় নিলো। রাত আটটার ফ্লাইট। সামিহাকে রেডি করাতে হবে। ক্যাফে থেকে বের হতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। এই অসময়ে এমন বৃষ্টি হবে আশা করে নি প্রিয়ন্তী। হাতের কাছে ছাতার ছ ও নেই। এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে সে। কাধের ব্যাগটা মাথায় দিয়ে দৌড় দিতে যাবে তখনই একটা লাল ছাতা কেউ তার মাথার উপরে ধরে। বৃষ্টির বিন্দু মুখে না পড়ায় মাথা তুলে তাকায় প্রিয়ন্তী। মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো কাকভেজা হয়ে ইউনিফর্মে দাঁড়িয়ে আছে আরাফাত। আরাফাতকে দেখতে পেয়ে যেনো হাতে চাঁদ পাবার মতো আনন্দ হলো প্রিয়ন্তীর। ইরফানকে বিদায় দিয়েই আরাফাতের কাছে যাবার কথাই চিন্তা করেছিলো সে। কিন্তু লোকটাই তার কাছে চলে এসেছে। ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি টেনে প্রিয়ন্তী বললো,
– আপনি এখানে?
– আসলে কাজ ছিলো। ভাবলাম বৃষ্টি হচ্ছে ছাতা এনেছেন কিনা। ইরফানের সাথে কথা হলো?
– হু
– এখন কোথায় যাবেন?
– যেখানে আপনি নিয়ে যাবেন?
– আমার সাথে যাবেন কেনো?
– ভালোবাসি তাই

নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো প্রিয়ন্তী। এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেলো আরাফাত। আজ মনের মাঝে ঝড় উঠেছিলো। কালবৈশাখী থেকেও ভয়ানক। ভয় হচ্ছিলো প্রিয়ন্তীকে হারাবার। কিন্তু এখন যেনো ভয়টা দমে গেলো। মনটা শান্ত হয়ে গেলো। যতটা শান্ত প্রকৃতি হয় ঝড়ের শেষে। অবাক নয়নে আরাফাত বললো,
– সত্যি? ভেবে বলছেন তো
– আমি আপনার মতো না ভেবে কিছু বলি না।
– একটু বেশি ভাবেন কিনা।
– বাইশ দিন মোটেও বেশি নয়।
– অবশ্যই বেশি। জানেন কত ভয় পেতাম

দুজনের খুনশুটির অন্ত নেই। ছাতা ধরে রেখেছে আরাফাত। রাস্তার ধার দিয়ে হেটে যাচ্ছে দুজন। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বাদলদিনেই যেনো শুরু হয়েছে তাদের নতুন পথচলা।
________________________________________________________________________________________________

দু মাস পর,
প্রিয়ন্তীদের বাসায় বসে রয়েছে রাফিজা বেগম, আকরাম সাহেব, আরাফাত এবং আরশাদ। প্রিয়ন্তী রান্না ঘরে স্নেহার সাথে চা বানাতে ব্যাস্ত। আজকে রুপন্তী এবং আরশাদের বিয়ের পাকাপাকি কথা বলতে এসেছেন তারা। রুপন্তীকে আংটি পড়িয়ে দিয়েছেন রাফিজা বেগম। আত্নীয় বলতে বড় ভাইকেই নিয়ে এসেছেন। বোনরা ঝামেলা বাধাবে বিধায় কাউকেই আনেন নি। আংটি বদল শেষে জাহানারা বেগমের উদ্দেশ্যে রাফিজা বেগম বলেন,
– আপা, সব তো হয়েই গেলো এখন দেয়া পাওনার কথা বলি?

রাফিজা বেগমের কথা শুনে সবার আক্কেলগুড়ুম হবার জোগাড়। পুলিশের মা কি না যৌতুক চাচ্ছে! আরাফাত মায়ের হাত টেনে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
– পাগল হয়ে গেলে নাকি? তুমি যৌতুক নিবে?
– তা নিবো না? আমার আরশাদের বিয়ে বলে কথা!
– মা

শিপন ফুসছে কিন্তু বড় বোনের শ্বাশুড়ি বিধায় কিছুই বলতে পারছে না। জাহানারা বেগম দুই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজেকে মানিয়ে নিলেন। ধীর কন্ঠে বললেন,
– কি চাই আপনার আপা?
– দেখুন আমি ছেলের মা। যদিও আমার গাড়ি, ফ্রিজ, এসি, গহনা চাইলেও কম হবে কিন্তু আমি তা চাইবো না। আমি আপনার খুব মূল্যবান একটা জিনিস চাইবো। যা আপনি অনেক বছর ধরে নিজের কাছে গুছিয়ে রেখেছেন
– কি সেই মূল্যবান জিনিস?
– আপনার মেয়ে, প্রিয়ন্তী। আরশাদ এবং রুপন্তীর এক শর্তেই বিয়ে হবে সেটা হলো একই জায়গায় প্রিয়ন্তী এবং আরাফাতের ও বিয়ে হবে।

রাফিজা বেগম এমন একটা জিনিস চাইবে এটা কল্পনাও করতে পারেন নি জাহানারা বেগম। এদিকে আরাফাতের মনে হলো জানে পানি এলো। এতক্ষণ মার কর্মকান্ডে দম আটকে আসছিলো। সে তো ভয়ে ছিলো তার সে দজ্জাল বউ না মায়ের মাথাই ফাটিয়ে দেয়। জাহানারা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
– আলহামদুলিল্লাহ, স্নেহা মিষ্টি আনো। সবাই মিষ্টিমুখ করি। একই সাথে দু মেয়ের বিয়ে হবে বলে কথা৷

স্নেহা মিষ্টি নিয়ে এলে সবাই মিষ্টিমুখ করে নিলো। আরাফাতের চোখ প্রিয়ন্তীকে খুজছে। তার দজ্জাল বউকে দেখতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটার সাথে আবারো বিয়ের বন্ধনে বাধা পড়বে সে কিন্তু এবার আর লুকিয়ে নয়। সবার সামনে, সবার সম্মতিতে।

গোধুলির সময়, ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ন্তী। বাতাসে শাড়ির আঁচলটা উড়ছে। ঢেউ খেলানো চুলগুলো বাতাসের মাদকতায় মাতাল হয়ে গেছে। এই সময়টা সবথেকে প্রিয় তার। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। পেছনে না ফিরেও বলতে পারবে মানুষটি কে। অভিমানী কন্ঠে মানুষটি বললো,
– জানো সারাটা বাড়ি খুজেছি তোমাকে, আর তুমি এখানে।
– কেনো খুজছিলে?
– জানো আমাদের ও বিয়ে হবে, একই সাথে। রুপন্তী এবং আরশাদের বিয়ের দিন আমাদের বিয়ে ও ঠিক করেছে মা
– তাই নাকি?
– হু, জানো আমার খুব ইচ্ছে ছিলো তোমাকে লাল বেনারসিতে দেখবো। আল্লাহ আমার ইচ্ছে পূরণ করলেন।

বলেই প্রিয়ন্তীর ঘাড়ে মুখ ডুবালো আরাফাত। প্রিয়ন্তীর গায়ের গন্ধ তার অনেক ভালো লাগে। কেমন জানে মাতালকরা গন্ধ। এর মাঝেই প্রিয়ন্তী বলে উঠে,
– আচ্ছা আরাফাত?
– হু?
– তুমি আমায় কেনো ভালোবাসো?
– জানি না, ভালোবাসার কোনো কারণ নেই। বলতে পারো আমার তোমার সব কিছু ভালো লাগে। তুমি যখন হাসো তখন আমার বুকে একটা শান্তির পরশ বুলিয়ে যায়। তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। তোমার পাগলামি, রাগ, অভিমান সবকিছুর মায়ায় আমি জড়িয়ে আছি। এক কথায় আমি গোটা তুমি কে ভালোবাসি।
– শোনো
– বল
– ভালোবাসি
– অনেক ভালোবাসি

আরাফাত প্রিয়ন্তীর কাঁধে ঠোঁট ছোয়ালো। আবেশে চোখ বুঝে আসলো প্রিয়ন্তীর। এ এক মাতাল করা পরিবেশ। প্রিয়ন্তীর জীবনের খরা শৈত্যপ্রবাহের অন্ত হয়েছে। বসন্তের রুপে আরাফাত এসেছে তার জীবনে। আরোও একবার বসন্তে তার জীবন ও রঙ্গিন হয়েছে। সূর্য পশ্চিমে ঢেলে পড়ছে। আকাশ তার রঙ পাল্টাচ্ছে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়ন্তী এবং আরাফাত। কি মনোরম দৃশ্যটি!

||সমাপ্ত||

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here