THE_BOOK #পর্ব_২২,২৩

0
232

#THE_BOOK
#পর্ব_২২,২৩
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
২২

রক্তিম সূর্য পশ্চিমে ডুবে গেছে অনেকক্ষণ ধরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসছে। ঘন গাছের কারণে এমনিতেই জঙ্গলে আলো ঠিকমতো ঢুকতে পারে না। তার উপর সূর্য ডুবে গেছে। তাই চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। এখনও চাঁদের দেখা মেলেনি। একটা সরোবরের পাশে বসলো রা’দ আর নূর। পানিতে ওদের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা পদ্ম পানির ঢেউয়ে ভাসছে। রা’দ বিষ্ময়ে পদ্মগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। পাশেই নূর তার লম্বা সাদা পোশাক ছড়িয়ে বসে আছে। আর নিজের ব্যাগে কিছু একটা গোছাচ্ছে। রা’দ এক পলক নূরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,”পদ্মগুলো খুব সুন্দর।”

নূর কিন্ঞ্চিৎ হেসে বলে,”হুম”

“তবে আপনার সৌন্দর্য্যের কাছে সব সৌন্দর্য হার মানায়। এই প্রকৃতি আপনার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য।”

“আপনি এতো কথা কোথা থেকে শিখলেন??প্রথম থেকেই একটার পর একটা রোমান্ঞ্চকর কথা বলছেন!!!”

রা’দ পানির দিকে দৃষ্টি মেলে নিঃশব্দে হাসলো বলল,”আপনি খুশি হননি?? শুনেছি মেয়েদের নাকি রূপের প্রশংসা করলে তারা খুব খুশি হয়। তাহলে আপনি কেন খুশি হচ্ছেন না??”

নূর ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,”আপনার প্রশংসায় আমার পেট ভরবে না। এখন চলুন ফিরে যাই। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। এতদিন একজনের খাবার জোগাড় করতাম আর আজকে দু’জনের তাই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে চলুন।”

নূর ঘোড়ার দিকে হাঁটা ধরলো। রা’দ উঠে নূরের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল,”আমি সত্যি আপনাকে বিপদে ফেলে দিলাম।”

নূর ততক্ষণে ঘোড়ায় চড়ে বসেছে। নিচে তাকিয়ে সে বলে,”আমার বিপদ হয়নি। বিপদে পড়েছিলেন আপনি। কিন্তু এখন আমার সাথে না গেলে পরে আবার বিপদে পড়তে পারেন।”

রা’দ নূরের হাত ধরে ঘোড়ায় উঠে বসে। ঘোড়া ছুটছে, চাঁদ উঠেছে আকাশে তাই চারিদিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। সেই আলোতে ঘোড়া এগিয়ে যাচ্ছে। আর দুজন মানব মানবি কে দেখা যাচ্ছে যারা দুজন দুজনের সাথে মিশে আছে। নূরের সামনে আসা ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসের কারণে রা’দের মুখের উপর এসে পড়ছে। আপাতত রা’দ এই মূহূর্তটা উপভোগ করতেছে। একটা চাঁদ আকাশে আর দ্বিতীয় চাঁদ রা’দের সামনে। এটা ভাবতেই রা’দের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

………………….

বাইরে কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। নূরজাহান লাঠির সাথে মাংস ঝুলিয়ে পোড়াচ্ছে। একটু পর পর লাঠি ঘোরাচ্ছে, একটু দূরে গাছের সাথে ঘোড়াটা বেঁধে রেখেছে। আগুনের লাল আলোয় সাদা ঘোড়াটাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। নূর কাঠের তৈরি টুলটায় বসে আছে। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে তার পোশাক। দুই হাঁটুতে হাত রেখে বসে আছে সে। পাশেই তার ময়ূরটা গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ময়ূরটা অদ্ভুত শব্দ বের করলো তার মুখ থেকে। নূর সামনে তাকিয়ে দেখে রা’দ এসেছে। নূর মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল,”চুপপপ।”

রা’দ এসে নূরের পাশের টুলটায় বসে পড়লো।
তার পর আগুনের দিকে তাকলো। লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে। নূরের মুখে সেই আভা পড়তেছে। ফর্সা মুখে লাল আভা পড়ায় আরো আকর্ষণীয় লাগছে তাকে। রা’দ কিছু বলল না।

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেল রা’দ। নূর মেঝেতে বিছানা করছে। রা’দকে দেখে সে বলে উঠলো,”আপনি চৌকিতে শুয়ে পড়ুন।”

“আর আপনি??”

“আমি এখানে ঘুমাবো।”মেঝেতে পাতা বিছানা দেখিয়ে বলে।

“আমার জন্য আপনি কেন কষ্ট করবেন??আমি নিচে ঘুমাচ্ছি আপনি চৌকিতে ঘুমান।”

“না না, আপনি অসুস্থ হাতে পায়ে মাথায় এখন ও ব্যথা আছে আপনি শক্ত মেঝেতে ঘুমাতে পারবেন না।”

রা’দ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল নূরের চোখের দিকে তাকিয়ে। চুপচাপ সে নরম বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ শূন্যে তাকিয়ে থেকে নূরের দিকে তাকালো। নূর ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। রা’দ কাত হয়ে নূরের দিকে ফিরে শুয়ে সেদিকে তাকায়। এই মেয়েটার কি আছে যে এতটা টানছে রা’দকে?নিজেকে সামলানো যে মুস্কিল হয়ে যাচ্ছে। এতো সুন্দর কোন মানবি হয়?? কিছু কিছু মানুষকে আল্লাহ্ নিজের হাতে বানায় তা নূরকে না দেখলে বোঝাই যেতো না। সত্যি আল্লাহর সৃষ্টির কোন তুলনা হয় না। তার সব সৃষ্টিই সেরা। রা’দ আনমনেই এসব ভাবছে আর হাসছে।

রাত গভীর হয়ে গেছে। থেকে থেকে হায়না আর অন্যান্য পশু পাখির কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। হায়নাগুলো বোধহয় আবার খাদ্যের সন্ধানে বের হয়েছে। সেদিন তো রা’দকে খেয়েই ফেলেছিল প্রায়। নূরজাহানের কারণে সে আজ বেঁচে আছে। এতো রাতেও রা’দের চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না সে একধ্যানে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। হারিকেনের আলোয় নূরের মুখটা অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। নূরের পাশ ঘেঁষে শুয়ে আছে তার ময়ূরটা। রং বেরঙের পেখম দ্বারা আবৃত লেজ খানা নূরের উপর দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছে সে। দেখে মনে হচ্ছে নূর ময়ূরের পেখমের পোশাক পড়ে আছে। এই মুহূর্তে নূরকে ময়ূরকন্যা মনে হচ্ছে রা’দের। ময়ূরদের রাজ্যের রাজকুমারী নূরজাহান। এই কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে লাগলো রা’দ। রা’দের এখন অসহ্য লাগছে। ঘুমটা তার আসছেই না,কি জ্বালা যন্ত্রনা?? নূরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়েছে। রা’দের আরো বেশি বিরক্ত লাগছে এখন।

এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো রা’দ। কিন্তু কতো রাতে ঘুমিয়েছে সে জানে না কারণ ওর কাছে ঘড়ি নেই। আর এই জঙ্গলের ভেতরে ঘড়ি!!এটা তো অসম্ভব কথা। তবে রা’দ যে ভোর ভোর ঘুমিয়েছে সেটা ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে। কারণ অনেক বেলা হয়ে গেছে এখন ও রা’দ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তার ঘুম ভাঙ্গার নামই নেই।

বিকট এক আওয়াজে রা’দের ঘুম ভাঙল।ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। আশেপাশে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার। তবে কি এখন ও সকাল হয়নি??রা’দ মেঝেতে তাকিয়ে দেখলো নূর নেই। রা’দ তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো। সাথে সাথে আরেকটা বিকট শব্দ শুনতে পেলো। রা’দ এবার বুঝতে পারলো যে এটা মেঘের শব্দ। আকাশে বোধহয় মেঘ করেছে তাই দিন থাকা সত্ত্বেও চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। সাথে সাথে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ আসছেই। রা’দ ধীর পায়ে বাইরে এলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলায়। কিন্তু নূরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। ময়ূরটা তার বিশাল পেখম মেলে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। বৃষ্টি গায়ে মাখার জন্য লাফালাফি করতেছে। এতক্ষণ গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো তবে এখন ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা এসে পড়লো মাটিতে। চারিদিক শো শো শব্দে মুখরিত করে ধরনীর বুকে নেমে পড়লো পানির ধারা। বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগল সে।

হঠাৎ দেখলো নূরজাহান দৌড়ে আসছে ঘরের দিকে। সে ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে। পরনের লম্বা পোশাক গায়ে লেপ্টে আছে। পোশাকের নিচের অংশ কাঁদায় মাখামাখি। দুহাতে পোশাক উচু করে দৌড়ে আসতেছে। রা’দ হাক দিয়ে বলে,”আস্তে নূর এভাবে দৌড়ে আসলে পড়ে যেতে পারেন।”

রা’দের বলা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হলো না। রা’দের কথা শেষ হতেই মুখ থুবড়ে পড়লো নূর। মাটি পিচ্ছিল হয়ে আছে সেখানে পা দিতেই পড়ে যায় সে। কিন্তু উঠতে চেয়েও নূর পারলো না। পায়ে চোট লেগেছে খুব, দাঁড়াতে গিয়েও আবার বসে পড়লো। রা’দ দূর থেকে বুঝে গেল যে নূর ব্যথা পেয়েছে। সে বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই বৃষ্টির মধ্যে নেমে পড়লো।
এগিয়ে এসে পাজাকোলে তুলে নিলো নূরকে।নূর দুহাতে রা’দের গলা জড়িয়ে ধরলো। ঘরে এসে চৌকির উপর নূরকে বসিয়ে দিয়ে একটা কাপড় জাতিয় কিছু এনে নূরকে দিয়ে বলল,”মাথাটা মুছে নিন নাহলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। একটু আস্তে আসবেন তো?? দেখলেন তো এখন হলো কি?? এভাবে যখন তখন বের হওয়া ঠিক নয়।”

নূর মাথা মুছতে মুছতে রা’দের দিকে তাকালো। রা’দকে বিচলিত দেখাচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে নূর নয় চোট পেয়েছে রা’দ। রা’দকে ছটফট করতে দেখে নূর বলল,”এতো ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?? সামান্য লেগেছে, তাছাড়া এসবে অভ্যস্ত আমি।”
রা’দ হাটুমুড়ে বসে বলল,”সামান্য লেগেছে??এটা আমায় বিশ্বাস করতে হবে??সামান্য ব্যথা পেলে আপনি হাঁটতে পারতেন। দেখি কোথায় লেগেছে??”
নূরের পা নিয়ে নিজের হাঁটুর উপর রেখে পরখ করে দেখতে লাগল রা’দ। নূর মুচকি হেসে বলল,”আমার কিছু হয়নি। ওষুধ লাগালে কালকেই ক্ষত সেরে যাবে। উঠে বসুন এখন।”
রা’দ উঠে নূরের পাশে বসে বলল,”আপনার ক্ষত তো সেরে যাবে কিন্তু আমার ক্ষতের কি হবে??”
নূর মাথা মুছতে মুছতে বলল,”তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না।”

“এই ক্ষত তো ঠিক হবে কিন্তু আমার হৃদয়ে যে ক্ষত হয়েছে তা কিভাবে ঠিক করবেন??”

“হৃদয়ে ক্ষত হয়েছে মানে??”

“প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই রক্ত বন্ধ করতে হলে আপনাকে প্রয়োজন।”

বলতে বলতে নূরের এক হাত রা’দ নিজের বুকে রাখলো। রা’দের বুকের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। ও বুঝতে পেরে গেছে যে রা’দ ওর প্রতি দূর্বল। নূরের মুখে লজ্জার ছাপ দেখতে পেল রা’দ। মাথা নিচু করে ফেলেছে নূর এতটাই লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু রা’দ তবুও নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভেজা শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে নূরের। নূরকে লজ্জা পেতে দেখে রা’দ যেন বেসামাল হয়ে পড়েছে। শক্ত করে নূরের হাত চেপে ধরে বলল,”লজ্জা পেলে আপনাকে আরো সুন্দর দেখায় নূর। এতোটাই সুন্দর যা আমি বর্ণনা করতে পারব না।”

নূর এবার চোখ তুলে রা’দের দিকে তাকালো।রা’দ বলল,”ভেজা পোশাক বদলে ফেলুন।”

বলেই রা’দ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নূর আস্তে আস্তে উঠে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর জামা বদলে নেয়। আবারো সেই একই রকম পোশাক পড়লো। দরজা খুলে রা’দকে ভেতরে আসতে বলল। রা’দ‌ ভেতরে আসতেই নূর বলল,”আপনিও তো ভিজে গেছেন। কি পড়ার জন্য দেই বলুন তো?? আমি তো এখানে একাই থাকি। কিছু তো নেই।”

রা’দ নিজের শরীরের দিকে চোখ বুলায়। শার্টটা ভিজে গেছে কিন্তু জিন্সের প্যান্ট থাকায় সেটা অতোটা ভেজেনি যে খুলে ফেলতে হবে। কিন্তু শার্ট চেঞ্জ করতেই হবে।নূর কি যেন একটা ভেবে ব্যাগ থেকে চামড়ার একটা কোট বের করলো। তবে কোটটার হাতা নেই। নূর সেটা রা’দকে দিয়ে বলল,”আপাতত এটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। আপনার জামাটা শুকিয়ে গেলে না হয় পড়ে নিবেন।”

রা’দ নিজের শার্টটা খুলে নূরের দেওয়া পোশাকটা পড়ে নিলো। কিরকম অদ্ভুত দেখাচ্ছে রা’দকে। নূর রা’দের শার্টটা বারান্দায় মেলে দিয়ে আসলো। দরজা বন্ধ করে দিলো যাতে বৃষ্টির ঝাপটা না আসতে পারে। নূর হাঁটতে গিয়ে আবার হোঁচট খেলো। তবে পড়লো না তার আগেই রা’দ শক্ত হাতে নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরলো।

নিজের সাথে শক্ত করে ধরে আছে নূরকে। বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে তার। খুব মোহনীয় লাগছে নূরকে। রা’দ আর নিজের সাথে পারছে না এভাবে লড়াই করতে। এই নূরজাহান নামক মেয়েটি তার চাই। সে ফিসফিস করে বলল,”আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হলে নূরজাহান নামক ওষুধ চাই।”
বিনিময়ে নূর কিছুই বলল না কয়েটকা ঢোক গিলল। রা’দ আবার বলল,”আপনার মাঝে কি আছে নূর??যা আমাকে এতোটা টানছে??
এটাকে কি ভালোবাসা নামে আখ্যায়িত করা যায়?? তৃষ্ণা পেলে পানি খেলে যেমন তৃষ্ণা মিটে যায় তেমন আমার আপনার তৃষ্ণা পেয়েছে। কিন্তু এই তৃষ্ণা কি আদৌ কোনদিন মিটবে?? আপনার তৃষ্ণা তো আমার সারাজীবন থাকবে নূর।”

নূর কিছু বলতে পারছে না। রা’দের সংস্পর্শ ওকে বাক্যহারা করে ফেলেছে। চোখ পিটপিট করে সে রা’দের দিকে তাকালো। রা’দের মুখ ক্রমাগত নূরের দিকে এগিয়ে আসছে। নূর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটুও নড়ছে না।
একসময় রা’দের নাক স্পর্শ করলো নূরের নাকে। নূর সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। রা’দ ও নিজের চোখজোড়া প্রায় বন্ধ করে ফেলেছে। যখন রা’দের ঠোঁট জোড়া নূরের কোমল গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁট স্পর্শ করবে তখনই দরজায় টোকা পড়লো। সাথে সাথে দু’জনে চমকে উঠলো।

কে এলো এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে??এই জঙ্গলে তো কারো আসা সম্ভব নয় তাহলে কে??নূর আর রা’দ একে অপরের দিকে তাকালো। দু’জনেই বুঝতে পারছে না যে কে এসেছে??রা’দ নূরকে কিছু ইশারা করে চৌকির উপর বসতে বলে দরজা খুলতে গেলো।

চলবে,,,,,,,,,,

#THE_BOOK

#পর্ব_২৩

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে শ্বাস নিলো রা’দ। এখনো সে দরজা খোলেনি। বাইরে থেকে বৃষ্টি আর মেঘের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রা’দ হাত বাড়িয়ে ছিটকিনি খুলে দরজা খুলে ফেলে। সামনে থাকা ব্যক্তিদের দেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলে। রা’দ তাদের চিনতে পারছে না। কেমন যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে সে। রা’দ প্রশ্ন করলো,”আপনারা কারা??”

রা’দের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরা অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছে। অবাক করা কন্ঠে একটি মেয়ে বলে ওঠে,”আমাকে চিনতে পারছিস না রা’দ??আমি পূর্ণাশা তোর বন্ধু!!”

রা’দ ভাঙা গলায় বলল,”আমার বন্ধু??”

অভিনব রা’দের কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকি দিয়ে বলে,”রা’দ তুই আমাদের চিনতে পারছিস না হুমম??”

অভিনব রা’দকে ঝাকাতেই যেন রা’দের সম্বিৎ ফিরে এলো। একহাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। একটু পর চোখ খুলে তাকালো বলল,”তোরা এখানে???”

অভিনব বলে,”যাক চিনতে পেরছিস তাহলে!!”
“কিন্তু এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে আর এই গভীর জঙ্গলে তোরা এলি কিভাবে??”
রা’দের কথা শুনে লাবন্য পূর্ণাশা আর অভিনব বাইরে তাকালো তারপর আবার রা’দের দিকে তাকালো।

“বাইরে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে বুঝি???”
অভিনবের কথায় রা’দ কপাল কুঁচকে ফেলল।বলল,”পাগল তুই??আমি তো স্পষ্ট দেখতেই পাচ্ছি যে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর মেঘ ও ডাকছে। কিন্তু তোদের দেখে মনে হচ্ছে না যে তোরা বৃষ্টি মাথায় এসেছিস। একটুও ভিজিসনি,কেন বলতো??”
অভিনব কিছু একটা ভাবলো তারপর বলল,”আমরা ছাতা আর রেইনকোট পরে এসেছি তাই ভিজিনি। কিন্তু আমরা কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো??”

“ওহ হ্যা ভেতরে আয়।”
ওরা তিনজনই ভেতরে ঢুকলো। তিনজনের দৃষ্টি গেল নূরজাহান এর দিকে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওরা নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে রইল। নূরজাহান ও অবাক হয়ে ওদের দেখছে। রা’দ ওদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে, “ওর নাম নূরজাহান। সেদিন আমাকে বাচিয়েছিলো। ও না থাকলে হায়নার দল আমাকে খেয়েই ফেলতো। আর নূর ওরা হলো আমার বন্ধু। অভিনব পূর্ণাশা আর লাবন্য।”

রা’দ সবার সাথে নূরজাহানের পরিচয় করিয়ে দিলো। অভিনব ইশারায় লাবন্য আর পূর্ণাশাকে কিছু বলল তা ওরা দুজন বেশ বুঝতে পারছে। পূর্ণাশা লাবন্যর কানে কানে ফিসফিস করে বলল,”দ্যা বুক এর কথা মিলে গেছে লাবন্য। দেখেছিস রা’দ আমাদের প্রথম দেখাতে চিনলো না। আর এই সেই পরীকন্যা।দেখেছিস কি সুন্দর দেখতে। আমাদের তাড়াতাড়ি রা’দকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে নয়তো রা’দ এবং আমাদের মৃত্যু অনিবার্য।”
লাবন্য তাতে সায় দিয়ে বলল,”হুম, আমাদের প্ল্যান মাফিক এগোতে হবে যাতে এই নূরজাহান কিছু টের না পায়। যদি মেয়েটা কিছু টের পায় তাহলে সর্বনাশ।”

ওরা দুজনে কিছু কথা বলে হাসিমুখে নূরজাহানের সাথে পরিচিত হলো। রা’দ বলল, “তোরা আমাকে এভাবে ফেলে চলে গিয়ে ঠিক করিসনি। কিন্তু তোরা জানলি কীভাবে যে আমি এখানে আছি??এই গভীর জঙ্গলে এলি কিভাবে তোরা??”

অভিনব চৌকিতে বসতে বসতে বলল,”সেটা সিক্রেট তোকে বলা যাবে না।”

“এটা আবার কেমন সিক্রেট??”
লাবন্য এগিয়ে এসে বলল,”ওর কথা বাদ দে তো!! সবসময় মজা করে। আমরা অনেক কষ্টে তোর খোঁজ পেয়েছি। যাকগে সেসব বাদ দে। তোকে খুঁজে পেয়েছি এটাই অনেক।”

পূর্ণাশা এগিয়ে গেলো নূরজাহানের দিকে। হাসিমুখে বলল,”আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য।”

নূরজাহান এতোক্ষণ টেবিলের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের সব কথা শুনছিলো কিছু বলেনি সে। তবে এবার তো মুখ খুলতেই হবে। কিছু না বলে তো থাকা যাবে না। তাই ভদ্রতার সাথে বলল,”এটা আমার কর্তব্য ছিলো। একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষকে তো সাহায্য করতেই হবে।”

রা’দ এগিয়ে এসে বলে,”আপনার পায়ে তো ব্যথা আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? চলুন বসবেন।”
নূরের হাত ধরে চৌকির সামনে গিয়ে অভিনবকে উঠিয়ে নূরকে বসিয়ে দিলো। অভিনব এতে অবাক হলো না। যেন ও আগে
থেকেই জানতো রা’দ এমনটা করবে। অভিনব রা’দের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চেষ্টা করল কারণ নূরের দিকে রা’দ যত তাকাবে ততই মায়ায় জড়িয়ে পড়বে। তাই অভিনব বলল, “এটা কি পড়েছিস??ভালোই তো দেখাচ্ছে তোকে!! একদম জংলি দের সরদার।”

বলেই অভিনব হেসে উঠলো। রা’দ কঠোর দৃষ্টিতে অভিনবের দিকে তাকালো। অভিনব ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অন্যদিকে তাকায়।রা’দ কিছু না বলে নূরের পাশে বসে পড়লো। তারপর এটা ওটা বলতে লাগলো। নূর ও তার উওর দিচ্ছে।

পূর্ণাশা লাবন্য আর অভিনব নিরব দর্শকের মতো তা দেখে যাচ্ছে। এমন তো ছিলো না রা’দ। তিনদিন পর দেখা অথচ ওদের সাথে ভালোভাবে কথাই বলতেছে না। অভিনব বাইরে যেতে যেতে লাবন্য পূর্ণাশাকে বাইরে আসতে বলে। ওরা অভিনবের পিছন পিছন বেরিয়ে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে লাবন্য বলল,”আমাদের হাতে বেশি সময় নেই অভিনব। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।”

“কিন্তু রা’দকে আগে এখান থেকে সরাতে হবে তারপর যা করার করতে হবে।”
পূর্ণাশা বতিব্যস্ত হয়ে বলল,”কিন্তু রা’দ কি যাবে??দেখছিস না কিভাবে মেয়েটার সাথে লেগে রয়েছে। ভাগ্যিস সঠিক সময়ে আমরা এসে পড়েছি নাহলে যে কি হতো??”

লাবন্য বলল,”রা’দকে চোখের মায়াজালে এখানে আটকে ফেলেছে ওই মেয়েটা। নাহলে তোরাই দেখ এখানে ঝড় বৃষ্টি কোথায় হচ্ছে?? চারিদিক তো পরিস্কার। আর এটা কোন গভীর জঙ্গল নাকি??এখান থেকে পনেরো মিনিট গেলেই মেইন রোড। অথচ রা’দকে দেখ।”
লাবন্য আর কিছু বলল না। চুপ করে বাইরে তাকালো সে। ওরা তিনজন আবার ভেতরে গেল। রা’দ এখনও কথা বলতেছে নূরের সাথে। অভিনব পূর্ণাশার দিকে ইশারা করলো। পূর্ণাশা টেবিল থেকে একটা চারকোনা কাঠের বাক্স হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,”বাহ খুব সুন্দর তো বাক্সটা। এটা কোথা থেকে এনেছেন??”
বলতে বলতে সে নূরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।নূর কিছু বলতে যাবে তার আগেই পূর্ণাশার হাত ফসকে বাক্সটা পড়ে গেল। পড়লো তো পড়লো নূরের পায়ের উপর। নূর ব্যথায় ‘আহ্’
করে উঠতেই রা’দ বলল,”কি হয়েছে আপনার??”
কাঠের বাক্সের কোণায় লেগে নূরের পা কেটে গেছে। রক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। রা’দ বিচলিত হয়ে নূরের পা ধরে বলল,”এটা কি করলি তুই???”
পূর্ণাশা অসহায় কন্ঠে বলল,”সরি আমি একদম বুঝতে পারিনি। ইশ কতখানি কেটে গেছে। রক্ত ও তো বের হচ্ছে খুব।”

অভিনব এগিয়ে এসে বলল,”আগে তো রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে। কি দিয়ে যে বন্ধ করি??”

“এখানে তো ওষুধ পাওয়া যাবে না। শুনেছি জঙ্গলে নাকি ঔষধি গাছ থাকে ওখান থেকেই আনতে হবে দেখছি। অভিনব তুই যা।”
লাবন্যর কথা শুনে অভিনব বলে উঠলো, “আমি যাবো!! তাও জঙ্গলে?? আমার তো ভয় লাগছে,এই ঝড় বৃষ্টির সময় যদি কোন বিপদ হয় তো?? তাছাড়া আমি তো ওইসব গাছ চিনি না।”
লাবন্য রাগন্বিত কন্ঠে বলল,”তুই পারিস কি হ্যাঁ??দেখছিস না কত রক্ত বের হচ্ছে??”

রা’দ দাঁড়িয়ে বলল,”কারো যেতে হবে না আমিই যাচ্ছি।”
লাবন্য পূর্ণাশা দ্রুত নূরের পাশে গিয়ে বসে।

“তুই যা ততক্ষণে আমরা নূরজাহানের খেয়াল রাখবো।”
রা’দ পূর্ণাশার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,”দেখিস,প্লিজ ওর যেন কোন ক্ষতি না হয়?? তাহলে তোদের বন্ধু বাঁচবে না।”

রা’দের কথা শুনে ওরা তিনজন থমথমে মুখে তাকালো। রা’দ বাইরে গিয়ে আবার ফিরে আসে। নূরের কাছে গিয়ে বলল,”চিন্তা করবেন না। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।”

নূর স্নিগ্ধ হেসে বলল,”অপেক্ষা করবো।”

রা’দ দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল। অভিনব বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রা’দের চলে যাওয়া দেখলো। মিনিটের মধ্যে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল রা’দ।

অভিনব দ্রুত ঘরের ভেতরে আসলো। পূর্ণাশা আর লাবন্যর দিকে ইশারা করতেই ওরা দাঁড়িয়ে পড়লো। নূরজাহান ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এখনও সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। অভিনব গিয়ে হেঁচকা টানে নূরকে দাঁড় করায়। এতে নূর ভিষন অবাক হয়ে গেল কিন্তু কিছু বললো না। অভিনব নূরের দুহাত পিছমোড়া করে বেঁধে দিয়ে পেছন থেকে নূরকে ধরেই রাখলো। নূর কাতর কন্ঠে বলল, “এসব কি করছেন আপনারা?? ছাড়ুন আমাকে!!!”

অভিনব বলল,”সরি পরীকন্যা নূরজাহান আপনাকে দ্যা বুক থেকে মুক্তি দিতে আর আমাদের প্রাণ বাঁচাতে এটা করতেই হবে।”

নূরজাহান অবাক হয়ে বলল,”পরীকন্যা!!কি বলছেন এসব!!আমি কোন পরীকন্যা নই।আমি মানুষ,সাধারণ মানুষ।”
লাবন্য বলল,”না আপনি পরীকন্যা। তা আপনি এখন বুঝতে পারছেন না। তবে আমাদের আসতে দেরি হলেই বুঝে যেতেন।”

পূর্ণাশা ব্যাগ থেকে ধারালো ছুরি বের করে অভিনবের দিকে ছুঁড়ে মারলো। অভিনব সাথে সাথে ক্যাচ ধরলো। পূর্ণাশা আহত গলায় বলে,”সরি ফর দিস। মুক্তি পেতে হলে আপনাকে মরতে হবে। আমাদের কিছু করার নেই।”

নূরজাহানের চোখ থেকে পানি পড়তেছে। কি হচ্ছে তা ও নিজেও বুঝতে পারছে না। সে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,”রা’দকে বলেছিলাম যে আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি। ওর আসা অব্দি পর্যন্ত আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। আমি অপেক্ষা ক,,,,”

নূর আর কিছু বলার আগেই ওর গলায় ধারালো ছুরি চালিয়ে দিলো অভিনব। গলার রগ কেটে যাওয়ায় সেখান থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। অভিনব নূরের হাতের বাঁধন খুলে দিলো সাথে ওকে ছেড়ে দিলো। নূর মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে গেল। রক্তে গোসল করে গেছে সে। একহাতে গলা চেপে ধরেছে আর একহাত মেঝেতে রেখেছে। নূরের পরনের সাদা পোশাক লাল হয়ে গেছে। এই লাল পোশাকেও নূরকে কম সুন্দর লাগছে না। ঠিক আগের মতোই সুন্দর লাগছে। রা’দ নূরকে লাল রঙের পোশাকে দেখলে হয়তো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে। নূরের দৃষ্টি দরজার দিকে। সে এখনো রা’দের আসার অপেক্ষায় রয়েছে। বেঁচে থাকতে চাইছে রা’দকে দেওয়া কথা রাখার জন্য। কিন্তু সেটা যে আর সম্ভব হচ্ছে না। চোখ দুটো যে তার টানছে। শরীর থেকে সব রক্ত বের হয়ে ফর্সা শরীর আরো ফর্সা হয়ে গেছে। ফলে শরীরের প্রতিটা রগ দেখা যাচ্ছে ‌। নীল হয়ে গেছে রগ গুলো। নূর শেষ চেষ্টা করছে রা’দের জন্য। এই বুঝি রা’দ চলে এলো। রা’দের হাত ধরে সে মৃত্যু বরণ করতে চায়। কিন্তু না রা’দ এলো না।

আস্তে আস্তে নূরজাহানের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো। যে হাতে গলা চেপে ধরেছিল সে হাত আলগা হয়ে গেল। মেঝেতে ছড়িয়ে দিলো হাত দুটো। শেষ নিঃশ্বাস টা নূর বড় করে নিলো। তারপর নিথর হয়ে গেল তার দেহ। হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল তার। সাথে সাথে সাদা আলো নূরের শরীর থেকে এক ঝলকানিতে বেরিয়ে গেল।

চলবে,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here