একগুচ্ছ_ভালোবাসা,১৭,১৮

0
286

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা,১৭,১৮
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ১৭

হাঁটতে নিয়ে পায়ে ব্যাথা পেলাম। থেমে গিয়ে পা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। ব্যাথা একটু কমেছে। পুরোটা কমেনি। ডান পায়ে কম জোর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই আমার ঘুমন্ত চোখে এসে ধরা দিল অনুরাগ, বর্ণদা আর সুনয়না। অনুরাগের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছেন। বর্ণদাও বেশ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুনয়নার দিকে। তার কপালের ভাঁজ দেখ এটা নিশ্চিত সে হালকা রেগে আছে। ব্যাপারটা কি? সকাল সকাল এমন কি হলো?
নিচে নামতেই আমাকে দেখে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন অনুরাগ। আমি আশেপাশে তাকালাম। আমরা চারজন ছাড়া এখানে কেউ নেই। অদ্ভুত! সবাই কি এখনো ঘুমিয়ে আছে? বর্ণদা হুট করে কাতর কন্ঠে বলে উঠল,,,,
–“কিরে নুড়ি! কাটা পা নিয়ে নিচে আসার কি কোনো দরকার ছিল? নিচে এলি কেন?”
আমি অনুরাগের দিকে তাকালাম। ঘুম ঘুম গলায় বললাম,,,,
–“বাড়িতে একজন মানুষ আছে জানো না? তার গলা উপর পর্যন্ত কেন? ফার্মহাউজের আশেপাশে সব বাড়িতে যাবে। আচ্ছা? কি হয়েছে আমায় একটু কেউ বলবে? এতো চেঁচামেচি কেন?”
কথাটা বলে বড়সড় ঘুমের হাই তুললাম আমি। অনুরাগ আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই মুখ বন্ধ হয়ে গেল আমার। মুখ বন্ধ করে স্ট্রেট দাঁড়ালাম। উনি তেতে বলে উঠলেন….
–“সুনয়না তোমার আর বর্ণের সাথে বাজে আচরণ করেছে সেটা বলোনি কেন আমায়?”
আমি হতবাক হয়ে চেয়ে থাকলাম। উনাকে কি বলল এই কথাটা? বর্ণদা? বর্ণদার দিকে এক পলক তাকালাম। তারপর উৎসুক হয়ে বললাম,,,
–“কে বলল আপনাকে এটা?”
–“কে বলতে পারে তোমার মনে হয়?”
আমি আবারও বর্ণদার দিকে তাকালাম। হেঁটে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,,,
–“বর্ণদা তুমি বলেছো?”
বর্ণদা একেবারে সোজাসাপটা ভাষায় কোনোরকম ভঙ্গিমা না করে বলল,,,
–“হ্যাঁ নুড়ি। আমিই বলেছি। আসলে কি বলতো? সুনয়নার মতো কিছু মেয়ে থাকে যাদের লজ্জাশরম বলে অনুভূতিটা কমই থাকে। থাকলেও একটা সময় পর তারা জলাঞ্জলি দিয়ে দেয়। ওর নোংরা কথাগুলো সেদিন আমার মাথায় বড় সড় রাগ তুলে দিয়েছিল। ভেবেছিলাম ওকে কিছু বলব। কিন্তু ও তো অনুরাগ ভাইয়ের মেহমান। ওর আগের স্ত্রীর বোন। তাই ভাবলাম কথাটা বলা উচিত অনুরাগ ভাইকে। উনিই যা ব্যবস্থা নেবার নেবেন।”
বর্ণদার কথা শেষ হতেই অনুরাগ বলতে শুরু করলেন,,,
–“অনুশ্রী, কথাগুলো তোমার আগে বলা উচিত ছিল। কেন বলোনি? বর্ণ কথাটা না বললে জানতেই পারতাম না সুনয়নার ব্যবহার বাজে হয়ে যাচ্ছে।”

আমি ভাবলেশহীন হয়ে অনুরাগের উদ্দেশ্যে বললাম,,,
–“জেনে কি এমন করেছেন? চেঁচামেচি ছাড়া? কিছুই তো করতে পারেন নি। আর আমার কথা শোনার সময় আপনার নেই। অবশ্য আপনার কেন ছোট থেকেই আমার কথা শোনার সময় কারোর নেই। তাই বলিনি।” (বর্ণদার দিকে তাকিয়ে)
এতক্ষণ চুপচাপ ছিল সুনয়না। আমার কথা শেষ হতে না হতেই ও আমার দিকে এগিয়ে এসে নিজের চোখজোড়া দিয়ে অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে কঠোর গলায় বলে উঠল,,,
–“আচ্ছা অনুরাগদা? ওরা আমার সামনে প্রেম করে বেড়াবে। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে। অথচ আমি কিছু বললেই দোষ হয়ে যাচ্ছে? এ তোমার কেমন বিচার?”
বর্ণদা এবার ভীষণ রেগে গেলো। সুনয়নার নোংরা কথাবার্তা শুনে চোখমুখ ঘৃনায় জড়িয়ে নিলাম। এই মেয়ে তো যা হয় তাই বলে চলেছে। বর্ণদার শ্যামারঙা মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ মুখে উঠেছে। দ্রুত কিছু একটা বলার আগেই অনুরাগ তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কারণ বর্ণদা সহজে হুটহাট করে রেগে যায় না তবে যদি একবার রেগে যায় তাহলে সে কাউকে মানে না। তাকে শান্ত করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। অনুরাগ জোর গলায় বলে উঠল…..
–“মুখ সামলে কথা বলো সুনয়না। তুমি ভুলে যেও না তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছো। এসব নোংরা বলার আগে মুখে বাঁধছে না তোমার? কি বলেছো অনুশ্রী আর অনুরাগ কে? ও যদি চলে যায় তাহলে তুমি আমায় বিয়ে করতে পারবে? এমন চিপ কথাবার্তা কি করে বলতে পারো তুমি? তোমাকে আমি ছোট বোন হিসেবে ভাবতাম। আর তুমি কি না ছিহ!”
কথাটা বলে নিজের হাত দিয়ে কপাল ঘষতে লাগলেন অনুরাগ। বুঝতে পারছি উনি বেজায় রেগে আছেন। বার বার ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছি আমি। নেত্রা আপুনি বা মা চলে এলে ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে পড়বে। সিনক্রিয়েট তৈরি হবে বেশি করে। তাই হালকা ভয় করছে আমার। সুনয়না আবারও চেঁচিয়ে বলে উঠল….
–“কেন? অনুশ্রী তো তোমাকে বিয়ে করতে পেরেছিল। আমি কেন আমার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে পারব না? কেন চান্স পাব না? অনামিকাদির জন্য তো প্রথমবার তোমাকে বিয়ে করতে পারিনি আমি। দ্বিতীয়বার এই মেয়েকে বিয়ে করে তুললে। এখন কি না তুমি নিজ হাতে ওকে তার প্রেমিকের মিলিয়ে দেবে। সিরিয়াসলি! তোমার মতো স্বামী না খুব কমই আছে। বাট আমি এসব কথা বললেই কি আমি চিপ কথাবার্তা বলি? বাজে আচরণ করি?”
কথাটা শেষ হতে না হতে চড় বসানোর আওয়াজ হলো জোরেসোরে। আমি আর বর্ণদা চমকে তাকালাম। সুনয়না গালে হাত দিয়ে আছে। অনুরাগ রাগে লাগাতার ফুঁসছেন। অনুরাগ আঙ্গুল উঁচিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সুনয়নার উদ্দ্যেশে বললেন,,,
–“এই চড়টা দরকার ছিল তোমার জন্য। যখনই কাউকে চিপ কথাবার্তা বলতে যাবে তখনই এই চড়টার কথা তোমার মনে পড়বে। আমি অনুশ্রীকে কেন বর্ণের সাথে মিলিয়ে দিচ্ছি জানো? কারণ আমি বুঝি ভালোবাসা হারানোর কষ্ট। আর অনুশ্রী তো আমার ভালোবাসে না। তাকে ভালোবাসাহীন জীবনে বেঁধে রাখার মতো অধিকার আমি পাইনি। তাই আমি স্বইচ্ছায় ওকে মিলিয়ে দিচ্ছি। আর একটা কথা অনেক টলারেট করেছি তোমায়। কাল সন্ধ্যায় আমরা এখান থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেব। তুমি আমাদের সাথে আমার বাড়িতে নয়। নিজের বাড়িতে যাবে। তোমাকে আর দেখতে চাই না আমি।”
কথাটা বলে রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ধুপধাপ করে উঠে গেলেন অনুরাগ। উনার একটা একটা পায়ের ধাপেও যেন ফ্লোর কেঁপে কেঁপে উঠছে। সুনয়নাও আমার দিকে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে দ্রুত নিজের রুমের দিকে চলে গেল। বাকি রইলাম আমি আর বর্ণদা। আমি ঠাঁই ভাবলেশহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কোনো হেলদোল নেই আমার। মাথায় একটা কথা বার বার বাজছে। ‘আর অনুশ্রী তো আমায় ভালোবাসে না’ কথাটার মাঝে গভীর এক ক্ষত অনুভব করছি আমি। উনার এই কথাটা আমার মনটাকে জোরেসোরে আঘাত করছে। আমি কি সত্যিই ভালোবাসি না উনাকে? হয়ত বাসি বা বেসে ফেলেছি। সেটা হয়ত আজীবন অপ্রকাশিত হয়ে থাকবে। কারণ উনার হৃদয়ে শুধু অনামিকার স্থান!
আমার কাঁধে কেউ হাত রেখে ঝাঁকাতেই নিজের ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে হকচকিয়ে উঠে তাকালাম। বর্ণদা আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারল।
–“কি হয়েছে নুড়ি? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোকে কতবার করে ডাকলাম একবারের জন্যও জবাব দিলি না।”
–“না আসলে কিছু না। আচ্ছা বাড়ির বাকি সবাই কোথায় গো? এতো চিৎকার চেঁচামেচি হলো কেউ তো এলো না! ” (তার দিকে তাকিয়ে)
–“আরে সবাই তো বাইরে। বসে বসে আড্ডা দিতে ব্যস্ত।”
আমি তার থেকে নজর সরিয়ে একমনে বললাম,,,
–“ওহ আচ্ছা।”

দুপুর বেলা অদ্রিজার গায়ে তেল মালিশ করে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি। এই মেয়েটা যে বড় হয়ে প্রচন্ড মাপের চঞ্চল হবে সেটা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। একবার পা চালায় তো একবার হাত চালায়। যেন বক্সিং করছে। আমাকে ঠিক করে ওর গায়ে তেল মাখাতেও দিচ্ছে না। একটু জোরে হাত চেপে ধরলেই শব্দ করে কেঁদে উঠছে। অতি আদরে দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। আমি অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে ওর গায়ে তেল মাখাচ্ছি। হঠাৎই কোথা থেকে যেন দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ালেন অনুরাগ। উনার আগমনে উনার চোখমুখ দেখে চোখমুখ কুঁচকে নিলাম আমি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখে এক অজানা আতঙ্ক। তেলের বোতলের ছিপি লাগিয়ে। দাঁড়িয়ে সরু গলায় উনার উদ্দেশ্যে বললাম,,
–“কি হয়েছে আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ঘামছেন কেন?”
উনি থতমত খেয়ে নিজের হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস মোটা গলায় বললেন,,,,
–“না এমনি। আসলে তোমাকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে। গিফট হিসেবেও ধরতে পারো।”
আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। কিসের গিফট সেটা ভেবে পাচ্ছি না আমি। আর গিফট কেউ এভাবে আতঙ্কিত মুখে দেয় সেটা জানা ছিল না আমার। তীক্ষ্ণ গলায় বললাম,,,
–“কি গিফট? এমন কি গিফট যেটা দিতে আপনার ঘাম ছুটে যাচ্ছে?”
উনি কিছু না বলে পেছনে থাকা ডান হাতটা সামনে এনে ধরলেন। আমাকে এগিয়ে দিলেন। আমার দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণত্ব হলো। উনার হাত কাঁপছে। এক নজরে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। আমি হাত বাড়িয়ে উনার থেকে খামটা নিলাম। আস্তে আস্তে খামটা খুলে একটা কাগজ আবিষ্কার করলাম। উনার দিকে তাকাতেই উনি আবেগি চোখে আমায় কাগজটা খুলতে বললেন ইশারা করে। একটু একটু করে কাগজ খুললাম। অনেক লিখা সেই কাগজে। মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেই আমার পৃথিবী উলটপালট হয়ে যেতে শুরু করল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম….
–“ডি…ডিভোর্সের এপ্লি….কেশন!”
উনি গলা খাঁকারি দিয়ে বেশ ভারাক্রান্ত গলায় বলে উঠলেন….
–“হ্যাঁ। ডিভোর্সের এপ্লিকেশন। এটাই তোমার গিফট অনুশ্রী!”
আমার কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাগ, অভিমান, কষ্ট সব একসাথে জমা হলো। চিৎকার করে কেঁদে দিয়ে লোকটার গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করছে কোনো এক অজানা অভিমানের তরে। আমাকে চুপ দেখে উনি আটকা আটকা গলায় বলে উঠলেন,,,
–“খু…খুশি হওনি? আই থিংক এটা তো…তোমার লাইফের বেস্ট গিফট। এপ্লিকেশন দিতে আরো দেরি হতো। আমার পরিচিত লোক কে দিয়ে কাজ করাচ্ছি। আ..আমার মনে হয় ডিভোর্সের লেটার টাও খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব।”
আমি উনার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসলাম। জোর গলায় বললাম,,,
–“হ্যাঁ। আমি অনেক খুশি। সব থেকে খুশির দিন আমার। দেখুন না খুশিতে আমার চোখে পানি টলমল করছে।”
–“কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে তোমার এই পানি অন্য কারণে?”
আমি হাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুখে আবারও হাসলাম। মলিন গলায় বললাম….
–“আপনার মনে হলে তো কিছু করার নেই অনুরাগ।”
উনি উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। হাত পা কাঁপছে উনার। আশেপাশে তাকাচ্ছেন উনি। আমাকে কোনোমতে বলে উঠলেন,,,
–“দুপুর তো অনেকটাই হলো। তুমি অদ্রিজাকে কাপড় পরিয়ে নিচে নিয়ে এসো। আমার বেশ খিদে পেয়েছে।”
কথাটা বলে দরজার দিকে এগোতে লাগলেন উনি। আমিও পিছন ফিরলাম। হঠাৎই আবারও উনি বললেন,,,
–“আর মাত্র কয়েকটা দিন। কয়েকটা দিনই তোমাকে আমার মেয়ের খেয়ালটুকু রাখতে হবে। একটু সহ্য করতে পারবে আই হোপ!”
দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লাম উনার কথা শুনে। উনার মেয়ে? তার মানে উনি এখনো আমাকে অদ্রিজার মা বলে ভাবতেই পারেননি। ভাবার কথাও নয় অবশ্য। কারণ বাচ্চাটা তো অনামিকার স্মৃতি! ডিভোর্স এপ্লিকেশন হাত থেকে ইচ্ছে করে ফেলে দিলাম। পেপারটা দেখে কেমন জানি রাগ লাগছে। টলতে টলতে এসে ধপ করে বসে পড়লাম বিছানায়। বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে হাত পা ছড়িয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে বেয়ে পানি পড়ছে। অদ্রিজা হামাগুড়ি দিয়ে এসে আমার সামনে বসে হেলে তাকালো। আমি মাথা উঠিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। ইচ্ছেমতো চুমু খেয়ে নিলাম মেয়েটাকে। কারণ ওকে ছোঁয়ার অধিকার হয়তবা হারিয়ে ফেলতে বসেছি।

করিডোরের শেষ প্রান্তে খোলামেলা বারান্দার এক হাতে রেলিং ধরে আরেক হাতে সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অনুরাগ। আজ আবারও হয়ত নিজের ভালোবাসা হারিয়ে সে ছারখার হয়ে যেতে বসেছিল। আবারও আজ নিয়তি তার সাথে এমন খেলা খেলল যে তার অস্তিত্ব, তিল তিল করে নিজ মনে গড়া #একগুচ্ছ_ভালোবাসা কেও হারিয়ে ফেলতে বসেছে। অবশ্য একদিকে সে খুশি। নিজের প্রিয় মানুষকে খুশি দেখলে সবারই ভালো লাগে। সেই ক্ষেত্রে বেজায় খুশি ও। তবে নিজের অস্তিত্ত্বকে সে কি করে হারিয়ে যেতে দেবে? এতোদিনে কি অনুশ্রীর মনে একটু খানিও জায়গা হয়নি তার জন্য? হয়ত হয়নি। হারিয়ে যাক অস্তিত্ব। যা হারানোর হারিয়ে যাক। সে ক্লান্ত। বড়ই ক্লান্ত!

চলবে…..??
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ১৮
সারাদিন আর ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করল না। কিছুক্ষণ আগে সবাই বাইরে গিয়ে ঘুরে এসেছে। আসারই কথা! আমার জন্য তো কেউ ঘুরাফেরা করা বাদ দিতে পারে না। আমি নিজের পায়ে ব্যাথার বাহানা দিয়ে আর গেলাম না। তবে এটাও শুনেছি অনুরাগ যান নি। তার সাথে থেকে গেছে বর্ণদা। আমরা তিন মেরুর মানুষ হয়ে থেকে গেছি একা একা। অদ্রিজা খেলছে নিজমনে। ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি। জানি না ওর এই নিষ্পাপ মুখটা কখনো দেখতে পারব কি না! আজই ওকে মন ভরে দেখে নিচ্ছি। খেলার মাঝে অল্প অল্প করে আমার দিকে তাকাচ্ছে অদ্রিজা। মুখ দিয়ে বার বার যেন আমাকে আহ্বান জানিয়ে চলেছে সে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আশেপাশে আজানের প্রতিধ্বনি বইছে। তড়িঘড়ি করে নিজের মাথা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকলাম আমি। আযান শেষ হতেই অদ্রিজার কান্নাকাটি শুরু হলো। বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ছে ও। ওকে কোলে তুলে নিলাম। আজকে দুপুর থেকে ওকে নিয়ে বাইরে যাওয়া হয়নি। সে কারণে হয়ত ওর দমবন্ধ লাগছে। ছোট বাচ্চা তো! মেয়েটার নাকের সাথে নাক ঘষে আদুরে গলায় বললাম…
–“কি হয়েছে মাম্মা টার? বাইরে যাবে? বাইরে যাব তো আমরা। আযান দিয়েছে না সবে? এখন বাইরে যাওয়া হবে না সোনা।”
আমার কথায় কান্নার বেগ বাড়তে থাকল অদ্রিজার। ওকে নিয়ে রুমের বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে ইচ্ছে জাগল আমার। আস্তে আস্তে হেঁটে যেতে থাকলাম দরজার দিকে। দরজা খুলতেই হুট করেই অনুরাগ আমার সামনে চলে এলেন। আমাদের ওপর পড়তে পড়তে নিজেকে কোনোভাবে ব্যালেন্স করলেন উনি। মনে হয় উনিও দরজা খুলতে যাচ্ছিলেন সে কারণে আমি দরজা খুলতেই ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছিলেন উনি। আমাদের ওপর না পড়লেও ফ্লোরে পড়ে গেলেন ধপ করে। নিজের কোমড় চেপে বসে থাকলেন ফ্লোরে। মুখের রিয়েকশনটা বেশ অসহায় জনক। না পেরে ফিক করে হেসে ফেললাম। আমার হাসি দেখে কান্না বন্ধ হয়ে গেল অদ্রিজার। ও নিজের বাবার অবস্থা দেখে শব্দ করে হাসল। আমাদের হাসি দেখে অনুরাগের অসহায়ত্বের চেহারা আরো তীব্রতর হয়ে গেল। ঠোঁট উল্টে বলে উঠলেন….
–“কি ভাগ্য আমার! আমার অবস্থা দেখে কি না এখন আমার ছোট মেয়েটা তো হাসছেই তার সাথে আমার বউও হা….”
বাকিটা বলার আগেই যেন উনি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। যেন উনি নিজেও জানতেন না উনি কি বলছিলেন এতোক্ষণ। অবাক হয়ে বসে রইলেন। আমি কয়েক সেকেন্ড উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উনি কি বলতে চাইছিলেন? ‘তার সাথে আমার বউও হাসছে’ এমন কিছু কি উনি বলতে চাইছিলেন? আমাকে উনি বউ বলে সম্মোধন করছিলেন? চোখমুখ চমক দিয়ে উঠল।
মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে অনুরাগের দিকে তাকালাম। উনি মাথা নিচু করে উঠার চেষ্টা করছেন। কিন্তু অসফল হচ্ছেন। কোমড়ে হয়ত ব্যাথা পেয়েছেন উনি। আমি অদ্রিজাকে বিছানায় বসিয়ে দিলাম। তারপর উনার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি আমার হাত খেয়াল করলেও আমার হাত ধরলেন না। একা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা জারি রাখলেন। আমি একটু ভেংচি কেটে গলায় খাঁকারি দিয়ে বললাম….
–“বলছিলাম যে হাত ধরলে এমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না!”
উনি আমার দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা ভাবলেন। তারপর আমার হাতে হাত রাখতেই আমি উনার এক বাহু ধরে উঠানোর চেষ্টা করলাম। উনি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালেন। আমি উনাকে বিছানার দিকে নিয়ে যেতেই পায়ে হালকা চাপ লাগল। পড়ে যেতে নিলে অনুরাগ নিজের হাত দিয়ে আমার মাথা নিজের বুকে ঠেকিয়ে নিলেন। উনার বুকের বাম পাশে হৃৎস্পন্দন যেন লাগাতার সুন্দর ভাবে বেড়ে চলেছে।

উনি হুট করে বলে উঠলেন….
–“দেখো আমাকে ধরতে এসে নিজেই পড়ে যেতে নিচ্ছে! এই বয়সেই দুর্বল হয়ে পড়েছো?”
–“অবশ্যই না। আমার পায়ে লেগেছে বিধায় পড়তে নিচ্ছিলাম আপনার মতো একজন ছোটখাটো হাতিকে সামলানো তো কম বড় কথা নয়।”
উনার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে কথাটা বললাম আমি। উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সূক্ষ্ণ গলায় বললেন….
–“মানে কি বলতে চাইছো? আমি হাতি?”
–“কোনো সন্দেহ?” (ভ্রু নাচিয়ে)
–“তোমাকে তো আমি….”
পুরোটা বলার আগে থেমে ছোট শ্বাস ছেড়ে বললেন…
–“বাদ দাও। তোমার সাথে কথা বলা মানে নিজে কথার ক্ষয় হওয়া।”
আমি খানিকটা ভাব নিয়ে বললাম…
–“আমার সাথে কথায় পারলে না কথা বলতেন হুহ।”
তারপর উনাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসালাম আমি। উনি কোনোমতে বসে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে চোখ বন্ধ করলেন। আমি দূরে সরে যেতে নিলে আমার চুলে টান পড়ল। সাথে সাথে চোখমুখ খিঁচে আলতো চিৎকার দিলাম। পিছন ফিরতেই আবার চুলে টান পড়ল। চুলে হাত দিতে নিতেই অনুরাগ আমার হাত সরিয়ে নিলেন। তাড়াহুড়ো কন্ঠে বললেন….
–“ওয়েট। তুমি ছাড়াতে পারবে না। আমার ঘড়ির সাথে চুল বেঁধেছে। আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি।”
আমি মাথা নাড়াতেই আবারও চুলে টান পড়ল। উনি আমার চুল আলতো করে ধরে বললেন…
–“রিলাক্স, রিলাক্স!”
আমি চোখ বন্ধ করে থাকলাম। অনুরাগ আমার ঘাড়ের নিচে নিজের ঠান্ডা হাত ঢুকিয়ে দিলেন। আমি শিউরে উঠে কাঁচুমাচু হয়ে গেলাম। উনি নিজের ঘড়ি চুল থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি উনার ছোঁয়াতে বিমোহিত হয়ে চলেছি। রীতিমতো কাঁপছি আমি। হালকা ঘাড় ঘুড়িয়ে অনুরাগকে দেখার চেষ্টা করলাম। উনি চুল ছাড়াতে ছাড়াতে আমার চোখে চোখ রাখলেন। জানালা দিয়ে আসা জোরালো বাতাস আমার চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে গেল অনুরাগের গায়ে চারিপাশে। এভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম আমরা জানি না। তবে একে ওপরের প্রতি যেন ব্যকুল হয়ে পড়ছিলাম। বেশি বেশি মায়ার চাদরে মুড়িয়ে পড়ছিলাম দুজন। হঠাৎই অদ্রিজার আওয়াজে হকচকিয়ে উঠলাম আমরা দুজন। সাথে সাথে উনি আমার চুল থেকে নিজের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মিনিট দুয়েক পর চুল ছাড়াতে সক্ষম হলেন উনি।

আমি ততক্ষণে একপ্রকার লজ্জায় ঘেমে গিয়েছি। তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়লাম। তারপর মিনমিনে গলায় উনাকে জিজ্ঞেস করলাম…
–“আপনার কি খুব বেশি লেগেছে? মানে লাগলে গরম পানি নিয়ে আসতাম।”
উনি নিজের মুখটা ভার করে মলিন গলায় বললেন…
–“কেন লাগলে গরম পানি আনতে হবে কেন? কেন করছ আমার জন্য।”
–“ধরে নিন কোনো কিছুর তরে!”
কথাটা বলে নিজের শাড়ির আঁচল হাতে ধরে ঘাড়ে টানতে টানতে বেরিয়ে এলাম আমি। উনি তো বুঝবেন না আমি ভালোবাসার তরে এসব করছি। বুঝাতে চাইও না আমি।

গরম পানি আর রুমাল নিয়ে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই দেখলাম অনুরাগ ফ্লোর থেকে ডিভোর্সের এপ্লিকেশন লেটার উঠাচ্ছেন হেলে। আমাকে দেখে উনি কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বলে উঠলেন…
–“এতো ইম্পরট্যান্ট কাগজ এভাবে ফেলে রেখেছো কেন অনুশ্রী? মনে রেখো একবার এটা হারিয়ে গেলে আবার কিন্তু প্রায় ৩ মাস সময় লাগবে এপ্লিকেশন রেডি করতে।”
–“আমার কাছে ওটা একটা প্রয়োজনহীন কাগজ বলে মনে হয়েছিল তাই ফেলে দিয়েছি।” (বিরবির করে)

আমার বিরবির করে বলা কথাটা অস্পষ্ট উনার কানে ভেসে যেতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন….
–“কিছু বললে?”
–“নাহ। আমার কিছুই বলার নেই আর।”
কথাটা বলে রুমালে গরম পানি ভিজিয়ে নিলাম আমি। তারপর হঠাৎই মনে হলো লোকটা স্ট্রেট দাঁড়িয়ে আছে। অথচ কিছুক্ষণ আগে উনি জোরেশোরে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছিলেন। উনার দিকে সন্দেহি নজরে তাকালাম।
–“আপনার না একটু আগে কোমড়ে ব্যাথা লেগেছিল?”
আমার কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন অনুরাগ। অন্যহাত দিয়ে নিজের কোমড়ে হাত দিয়ে বললেন…
–“উফফ…ঠিক বলেছো কোমড়ে ভীষণ ব্যাথা!”
–“দেখি এদিকে আসুন আপনার কোমড়ে গরম পানির শেক দিয়ে দিই।”
উনি ধীর পায়ে এসে ধপ করে শুয়ে পড়লেন উপুড় হয়ে। আমি উনার গেঞ্জি তুলে হালকা করে শেক দিতে থাকলাম। উনি ওপাশে মাথা দিয়ে অদ্রিজাকে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসিয়ে চলেছেন। মেয়েটাও অদ্ভুত শব্দ করে হাসছে বার বার। আমি মাঝে মাঝে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়চ্ছি। বাবার ভালোবাসা গুলো বুঝি এমনই হয়। আমার তো সারা জীবন এমন ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্যটুকু হয়নি। প্রচন্ড স্বার্থপর আমার বাবা! ঘৃনা করি তাকে। অথচ একসময় আমার প্রিয় মানুষের তালিকায় বাবায় সব থেকে প্রথমে ছিল। হায় ভাগ্য! বুঝিনি আমি ছিলাম বাবার প্রয়োজনের প্রিয়জন।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। রাত ৯ টার কাছাকাছি। আজ আমরা তাড়াতাড়ি ডিনার করে ফার্মহাউজের বাইরে খোলা জায়গাটাই এসে বসেছি। মাঝখানে জ্বলছে আগুন। তার চারিপাশে বসেছি আমরা। আমার কোলে ছোট্ট অদ্রিজা। আগুন দেখে আকর্ষিত হয়ে চলেছে বার বার। বরাবরই নাকি ছোট বাচ্চাদের চকচকে জিনিসগুলো বেশি পছন্দ হয়। অদ্রিজাকে দেখে তা বুঝতে পারছি। আমার ডান পাশে বসে আছে নেত্রা আপুনি। আর বাম পাশে নৌশিন। আমার ঠিক সামনাসামনি আগুনের ওপাড়ে বসে আছেন অনুরাগ। তার ডান পাশে বর্ণদা আর বাম পাশে অর্ণব। তাছাড়া মা, বোরহান ভাইয়া, নীল ও সুনয়নাও বসে আছে। সুনয়নার মুখটা ভার। হয়ত সকাল বেলার ঘটনার কারণে। গল্পগুজবের মাঝে হুট করে নেত্রা আপুনি বলে উঠলেন….
–“এই এই সবাই শোনো। আমরা এতোজন বসে আছি। কিছু একটা না খেললে কি করে হয়?”
–“বুড়ি বয়সে ভীমরতি পেয়েছে তোমার নেতু? না মানে আমি তোমাকে কিছু বললে তো তাই বলো তাই তোমাকেও বললাম।”
বোরহান ভাইয়ার কথায় সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। নেত্রা আপুনি নিজের ফর্সা মুখটা ইতিমধ্যে লাল করে ফেলেছে। যেন নিজের চোখ দিয়েই ভাইয়াকে ভস্ম করে দিলে শান্তি পেত। আপুনির মুখ দেখে অনুরাগ সবাইর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন….
–“স্টপ স্টপ! নেত্রাদির কথায় এতো হাসাহাসির কি আছে হ্যাঁ? সে তো ঠিকই বলেছে। নেত্রাদি কি খেলা যায় বল তো?”
কথাটা বলে অনুরাগ নিজের গালে হাত দিয়ে আপুনির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমরা সবাই হাসি থামালাম। আপুনি খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন…
–“আই হ্যাভ এন আইডিয়া! আমি একটা চিরকুটে কিছু একটা লিখে রাখব। অনেক গুলো চিরকুটে একেকটা জিনিস লিখব। তারপর সবাইকে একটা একটা করে চিরকুট তুলতে হবে। সেখানে যা লিখা থাকবে সেটা করে দেখাতে হবে।”
আমরা সবাই আপুনির কথাতে সম্মতি জানালাম। মা সাথে সাথে নিজের ছোট ব্যাগ থেকে ছোট প্যাড আর কলম বের করে দিলেন। মায়ের কাছে কিছু থাক আর না থাক এই দুটো জিনিস হরহামেশাই পাওয়া যাবে। যেমনটা প্রথম দিনে দেখেছিলাম উনার কাছে। উনার একটাই কথা কখন কোন জিনিস লিখালিখি করতে হবে তার ঠিক নেই তাই একটা করে প্যাড আর কলম থাকা আবশ্যক।

উনি বের করতেই নেত্রা আপুনি অনেক কিছু লিখে চিরকুট ভাঁজ করে ফেললো। হাত মুঠ করে সবাইকে একটা একটা চিরকুট দিলো। সবার মতো আমিও একটা চিরকুট তুললাম। শেষমেশ যেই চিরকুট বাঁচল সেটা আপুনি নিলো। হাতে নিয়ে নিজের জায়গায় আরাম করে বসলো। সবার দিকে তাকিয়ে নেত্রা আপুনি বর্ণদার উদ্দেশ্যে বলল….
–“বর্ণ! আগে তোমাকে দিয়ে শুরু করা হক। তুমি চিরকুট টা খুলে দেখো।”
বর্ণদা চিরকুট খুলে দেখতেই গলায় খাঁকারি দিয়ে বলল….
–“ভালোবাসার প্রকাশ। আই মিন ওটাই লিখা আছে।”
নেত্রা আপুনি একটু মিষ্টি হেসে বলল…
–“সো বর্ণ তোমার বয়সী সব ছেলেরই তো আজকাল প্রেমিকা বা ভালোবাসার মানুষ থেকে থাকে। তোমারও নিশ্চয় আছে?”
–“সবার যখন থাকার কথা তখন হয়ত আমারও আছে।” (আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে)
আমি হালকা কেশে বর্ণদার থেকে নজর সরিয়ে নিলাম। সবাই মুখ টিপে হাসল বর্ণদার কথায়। আপুনি দুষ্টুমির সুরে বলল…
–“আচ্ছা ভাই তার নাম জানতে চেয়ে তোমায় আর লজ্জা দেব না। তুমি শুধু তোমার মতো করে যেকোনো ভাবে তার জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারো।”
বর্ণদাও হালকা হেসে মাথা চুলকিয়ে মিষ্টি গলায় বলে ওঠে….
–“জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়
পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে, নেই-এই আছে নেই- জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।” [জীবনানন্দ দাশ]
পুরো কথাটা আমার দিকে নিরবে তাকিয়ে বললো বর্ণদা। আমি নিচ দিকে তাকিয়ে অদ্রিজাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছি। সবাই যখন বর্ণদার বলা কবিতায় হাত তালি দিতে ব্যস্ত তখন আমি অনুরাগের মলিন মুখ দেখতে ব্যস্ত।
বোরহান ভাইয়া হাসোজ্জল গলায় বলে উঠলেন….
–“কেয়া বাত হায় বর্ণ! দিল খুশ হো গেয়া। আব অনুরাগ কি বারি হায়। অনুরাগ তুমি নিজের চিরকুট খোলো।”
অনুরাগ নিজের শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে মলিন হেসে আলতো করে চিরকুট খুলতেই বলে ওঠেন…
–“ভালোবাসার মানুষের জন্য গান।”
–“তাহলে আর কি গেয়ে দাও না অনুশ্রীর জন্য কয়েক লাইন গান শালাবাবু।”
কথাটা বলে নিজের মাথার চুল নাড়াতে থাকেন বোরহান ভাইয়া। অনুরাগ আমার দিকে অপলক নয়নে চাইতেই মুখটা লাল হয়ে এলো আমার। তবে আমার জন্য উনি গান গাইবেন ব্যাপারটা অসম্ভব। হয়ত অনামিকার জন্য গাইবেন। অনুরাগ গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠেন…
–“আমি কিন্তু বর্ণের মতো সুন্দর কন্ঠে গান গাইতে পারি না।”
কথাটা বলে নিজের মুখ দিয়ে সুর তুললেন উনি। চোখ বন্ধ করে ব্যাথিত সুরে বলে উঠলেন….
–“বাড়িয়ে দাও তোমার হাত
আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই।
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত
আমি আবার তোমার পাশে হাঁটতে চাই।
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত
তোমার হাত
কিভাবে কাচের দেয়াল যেনো আটকে থেকে যাই
কখনো ফুরোয় কথায়
অনেক সন্ধ্যে বেলায় তোমার ক্লান্ত চুলের হার।
ছোঁয়াও আমার মাথায়
এখন কৃষ্ণচূড়ার আলয়
আমাদের রাস্তা সাজানো।
ওহ-ওহ-ওহ-ওহ….”
উনার প্রত্যেকটা গানের লাইনে ফুটে উঠেছিল এক অসহনীয় যন্ত্রণা। যা তিলে তিলে পোড়াচ্ছিল আমায়। বড় বড় শ্বাস ফেলেও কূল পেলাম না আমি। উঠে আসতে মন চাইল। কিন্তু সবার সামনে উঠতে পারলাম না আমি। সবাই তালি আর সিটি বাজাতে ব্যস্ত। আমি টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আগুনের ওপাশে লোকটাকে দেখলে হৃদয়ে দহন বাড়ছে। নাহ আর থাকা সম্ভব নয়। একদিকে বর্ণদা আরেকদিকে এই মায়াজালে বন্দি করা লোকটা! নেত্রা আপুনিকে বলে উঠলাম…
–“আপুনি আমার না শরীর ভালো লাগছে না। মাথা ব্যাথা করছে খুব। আমি আসি। তোমরা খেলো।”
কথাটা বলে উঠতে নিতেই মা অস্থির গলায় বললেন….
–“সে কি? তুমি ঠিক আছো তো অনুশ্রী? গায়ে আবার জ্বর এলো না তো? এই নেত্রা দেখ না।”
–“না আমার কিছু হয়নি। শুধু একটু মাথা ব্যাথা। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি আসছি।”
কথাটা বলে অদ্রিজাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম আমি। পেছন থেকে শুনতে পেলাম নেত্রা আপুনির কন্ঠ।
–“আরে অনুশ্রী! অদ্রিজাকে অন্তত আমার কাছে দিয়ে যাও। নয়ত রেস্ট নিতে পারবে না তুমি।”
আমি আপুনির কথা শুনলাম না। শুনতে ইচ্ছে হলো না। মনটা সায় দিল না। এই পিচ্চিটা তো আর কয়েকদিনই আমার কাছে থাকবে তারপর তো!

ঘড়ির কাঁটা ১১ টায় ছুঁই ছুঁই। অনুরাগ সবে সবার সাথে গল্প করে ঘরে এসে ঢুকেছে। যদিও আগে আসার ইচ্ছে ছিল। তবে পারেনি এতোজনের মাঝে একা উঠে আসতে। রুমে আসতেই মুগ্ধতায় ভরে গেছে তার চোখ। অনুশ্রী আর অদ্রিজা ঘুমোচ্ছে। অদ্রিজা অনুশ্রীর ওপরে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। অনুশ্রীও হাত দুটো হাত দিয়ে সুন্দরভাবে অদ্রিজাকে আগলে ধরে আছে। যেন মা তার মেয়েকে বুকে নিয়ে ঘুমায় ঠিক তেমন। এমন দৃশ্য ভাগ্যিস মিস করেনি অনুরাগ। নেশাগ্রস্ত চোখ নিয়ে এগিয়ে আসে অনুরাগ। অনুশ্রীর কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে ওর মাথায় হাত ছোঁয়ায়। বড্ড ইচ্ছে করছে অনুশ্রীর কপালে চুমু আঁকতে। ভালোবাসার পরশ আঁকতে। সে তো পারে নিজের স্ত্রীকে চুমু খেতে। অবশ্যই পারে। নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে গিয়ে অনুশ্রীর কপালে আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায় সে। তার প্রথম ভালোবাসার পরশ! আর হয়ত শেষ ভালোবাসার পরশও!
আনমনে বলে ওঠে….
–“সরি অনুশ্রী। তোমাকে আজ বড্ড কষ্ট করিয়েছি। আমার কোমড়ে তো আজ লেগেছিল ঠিকই কিন্তু এতোটা কঠোরভাবে লাগেনি যে আমার হাঁটতে কষ্ট হবে। সবই ছিল তোমার ছোঁয়া পাওয়ার বাহানা। তোমার একেকটা ছোঁয়ায় এক অন্যরকম কম্পন সৃষ্টি হয় হৃদয়ে। সরি। ভেরি ভেরি সরি।”
কথাটা বলে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে সে। উঠে দাঁড়িয়ে অনুশ্রী আর অদ্রিজার ওপর চাদর টেনে দিয়ে অন্যপাশে গিয়ে গা এলিয়ে দেয় অনুরাগ।

চলবে….??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here