একগুচ্ছ_ভালোবাসা,পর্ব : ২০ (শেষ পর্ব)

0
428

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা,পর্ব : ২০ (শেষ পর্ব)
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)

সময়, কাল ও জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে। কারোর জন্যই নয়। মানুষটা যতটাই প্রিয় হক না কেন! সেই প্রিয় মানুষটার জন্যেও সময় থামে না। জীবন থামে না। জীবন একটা বহমান নদীর মতো। যার পথগুলো সোজা নয় আঁকাবাঁকা। মাঝে মাঝে পাড়ে উপচে পড়ে সুবিশাল ঢেউ। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পানির কনাগুলো। তাকে ছাড়াও আমি কাটিয়ে দিয়েছি পাঁচ পাঁচটি বছর। বদলেছে জীবনের ধরন। বদলেছে সময়। তবে মনের কোণায় কোথাও সে আজও উঁকি দেয়। দিন শেষে তার জন্য বুকটা হাহাকার করে। আফসোস হয় সেদিনটার জন্য!

সোফায় বসে বসে ছবির অ্যালবাম দেখছিলাম। আমার বাম হাতটা গালে। মনটা উদাসীন। সব ছবিতে হাত বুলাচ্ছি। হঠাৎ এক ছবিতে চোখ পড়তেই আমার উদাহীন ভাবটা কেটে গেল। ঠোঁটের কোনে হাসির রেশ ফুটে উঠল। ছবিটা ৫ বছর আগের। সেই ফার্মহাউজটাতে তোলা ছবি। কৃষ্ণচূড়া ফুল নামানোর চেষ্টায় বেশ মগ্ন তখনই ছবিটা তুলেছিলেন অনুরাগ। অ্যালবামের পাতা উল্টাতেই আরেক চমক পেলাম। এই ছবিটাও আমার। তবে আমি একা নেই সেই ছবিতে। অনুরাগ আর আমার মেয়ে অদ্রিজাও আছে। সেদিন অনুরাগ আমার পা কেটে যাওয়ার কারণে অদ্রিজা সমেত কোলে তুলেছিলেন। সেটা চুপি চুপি ক্যামেরা বন্দি করেছিলেন বোরহান ভাইয়া। আগের দিনের কথাগুলো ভাবছিলাম আর মুচকি মুচকি হাসছিলাম। কারো পায়ের শব্দ পেতেই সিঁড়ির দিকে তাকালাম। ধুপধাপ করে দৌড়ে এসে আমার কোলে বসে পড়ল ছোট্ট পরিটা। সে আর কেউ নয় অদ্রিজা। ওর জন্য আমি আর অনুরাগ আর কোনো সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা ভাবিনি। যদিও অনুরাগ বলেছিলেন। উনার ধারণা আমি মাতৃত্বের সাধ উপভোগ করতে পারিনি। আমিই উনার ধারণাকে পাল্টেছি। দেখিয়ে দিয়েছি অদ্রিজা আমার মেয়ে। ও আমার মাতৃত্বের সাধ পূরণ করেছে। আমি চাই না অন্য কেউ ওর আদরের ভাগ বসাতে আসুক। আমি একটু গম্ভীর গলায় বললাম….
–“অদু সোনা! এভাবে দৌড়ে কেউ সিঁড়ি থেকে নামে? পড়ে গেলে কি হবে বলো তো?”
অদ্রিজা বায়না করা কন্ঠে আমার গলা জড়িয়ে বলল….
–“ও মাম্মা, আমি একটু এক্সাইটমেন্টে দৌড়ে এসেছি।” (আমার গালে চুমু খেয়ে)
–“কিসের এতো এক্সাইটমেন্ট আমার অদুর শুনি?”
কথাটা বলে ওকে জড়িয়ে ধরতেই ও আমার সামনে আমার ফোন তুলে ধরল। তারপর হাসোজ্জল গলায় বলে উঠল…
–“ভিডিওটা দেখো।”
আমি ভ্রু কুঁচকে ভিডিও অন করতেই দেখতে পেলাম অনুরাগ আমার কানের পিঠে কৃষ্ণচূড়ার ফুল গুঁজে দিচ্ছেন। আমার চেহারার চকমকে এক্সপ্রেশন আসতেই উনি আমার হাত ভর্তি ফুল গুঁজে দিয়েছিলেন। এই ভিডিওটা যদিও আমার অজান্তে আমার ফোনে হুট করে হয়েছিল। অদ্রিজার হাসির ভিডিও করতে গিয়ে আমাদের এই মূহুর্তটাও ভিডিও হয়েছিল। তবে ভিডিওটা আমার কাছে ভীষণই প্রিয়। ভিডিও শেষ হতেই অদ্রিজার দিকে তাকালাম। ও চিকন গলায় বলল….
–“আচ্ছা মাম্মা? ওইটা তুমি আর পাপা ছিলে না?”
–“হুমম তো?”
অদ্রিজা দুষ্টুমি কন্ঠে বলল…
–“ওয়াও! কত কিউট কাপল ছিলে তোমরা।”
এতটুকু পিচ্চি মেয়ের এমন কথায় কাশি উঠে গেল আমার। অদ্রিজা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পিঠে থাবা দিতে থাকল। কাশি থামতেই ওকে বললাম…
–“কি ব্যাপার অদু মনি? এমন কথা কোথায় থেকে শিখেছো?”
অদ্রিজা খানিকটা ভাব নিয়ে ওর লম্বা লম্বা চুল পেছন দিকে ঠেলে বলল….
–“আরে মাম্মা, আমরা ডিজিটাল বাচ্চা। আমাদের এসব শিখতে হয় না। নিজে নিজেই শিখে যাই।”
–“তাই না?” (ভ্রু উঁচিয়ে)
–“হুমম একদম তাই। তুমি অ্যালবাম দেখছো? আমিও দেখব!”
কথাটা বলে আমার পাশে ঠেস লাগিয়ে বসে পড়ল অদ্রিজা। আমি একটু হাসলাম। ও হেলে পড়ল অ্যালবামের ওপর। নিজে নিজেই অ্যালবামের পাতা উল্টিয়ে দিল। তারপর একটা ছবি দেখিয়ে বলল…
–“মাম্মা দেখো তোমাদের বিয়ের ছবি।”
আমি ছবির দিকে তাকালাম। সত্যিই আমার আর অনুরাগের বিয়ের ছবি। দ্বিতীয় বার বিয়ের ছবি। আমি সেদিন পূর্ণাঙ্গভাবে নতুন বউ সাজার স্বপ্নটা পূরণ করতে পেরেছিলাম। লাল রাঙা বেনারসি, হাত ও গলা ভর্তি গয়না। আমার পাশেই নিজের সুন্দর মুখ খানা নিয়ে বসে আছেন অনুরাগ। তার পরণে সাদা রঙের শেরওয়ানী। বেশ মানিয়েছে। আমি অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালাম।
–“হ্যাঁ ওটা আমাদের বিয়ের ছবি।”
ও আমার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালো। উৎসাহ নিয়ে বলল…
–“আমি কোথায় মাম্মা?”
–“এইযে তুমি।” (অন্য ছবি দেখিয়ে)
–“ওমা, আমি ছোট ছিলাম? আমাকে তো চেনায় যাচ্ছে না। কত বজ্জাত ছিলাম দেখো! তোমার বিয়ের শাড়ি ধরে টানাটানি করছিলাম।” (নাক ফুলিয়ে)
আমি ওর কথায় বিস্তর হাসলাম। ওকে এক হাত জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বললাম….
–“মটেই না অদু সোনা। তুমি ছোট থাকতেও আমার লক্ষী মেয়ে ছিলে এখনও তাই আছো। সারাজীবন তাই থাকবে।”
আমার কথায় আমার হাত জড়িয়ে ধরে অ্যালবামের পাতা আবারও উল্টালো অদ্রিজা। ঠিক তখনই টেবিলে কফির কাপ রাখার শব্দ হলো। আমরা অ্যালবাম থেকে হাত সরিয়ে কফির কাপ রাখার মালিকের দিকে তাকালাম।

অনুরাগ হাতে একটা কফির কাপ নিয়ে মুখে একটা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম…
–“আপনি? (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) ওহ সরি সরি। অ্যালবাম দেখতে দেখতে কখন সাড়ে সাতটা বেজেছে খেয়ালই করিনি।”
উনি আমার পাশ ঘেঁষে বসে পড়লেন। কফির কাপে হালকা চুমুক দিয়ে শীতল গলায় বললেন….
–“নো প্রবলেম। তাছাড়া সারা বছর তো তুমি নিজেই কফি বানিয়ে সবাইকে খাইয়ে আসছো। শুধু আজকের দিনটা ছাড়া। আমি জানি আজকের দিনটা তোমার সবই কিছু অগোছালো লাগে। না হয় এই গোছানোর দায়িত্বটা আমার!”
আমার মুখটা ভার হয়ে গেল। অদ্রিজা আমার শাড়ির আঁচল টেনে বায়না করা কন্ঠে বলল…
–“মাম্মা-পাপা দেখো না। ওরা তো আমার মা আর আমার মামা না?”
আমি আর অনুরাগ তাকালাম। চোখে পানির বন্যা ভাসতে শুরু করল। অনুরাগ আমার মনের অবস্থা বুঝতেই আমার হাত ধরলেন। আমি উনার শক্ত করে ধরে বললাম….
–“হ্যাঁ অদু। ওটা তোমার মা। আর ওটা তোমার মামা।”
–“উনারা আমার মতো একটা মেয়েকে ছেড়ে কীভাবে দূরে থাকেন বলো তো? আমি ওদের ওপর এত্তগুলা রেগে আছি।” (মুখ ফুলিয়ে)
আমার চোখ থেকে পানি পড়ার আগেই সেটা লুকিয়ে ফেললাম। অনামিকা আর বর্ণদার ছবি দেখে অতীতগুলো যে একে একে ফুটে উঠছে। তার সাথে পুরোনো ঘা তরতাজা হয়ে উঠছে। গলা খাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলার চেষ্টা করলাম….
–“তারা তো সেলফিশ সোনা। তাই ওরা থাকতে পেরেছে। আমরা তো সেলফিশ নই। স্বার্থপর নই আমরা।” (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
অদ্রিজা মুখ ফুলিয়ে বলল….
–“ঠিক। আমি ওদের মতো সেলফিশ নই।”
আমার চোখ থেকে গড়গড়িয়ে পানি পড়ছে। হুহু করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অনুরাগ অদ্রিজাকে বলে উঠলেন…
–“অদ্রিজা! অ্যালবাম আর দেখার দরকার নেই। ওটা আমাকে দাও।”
–কিন্তু কেন পাপা? আমি দেখতে চাই।”
অনুরাগ উঠতে নিলে উনার হাত ধরে বসিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললাম….
–“থাক না। ছোট মানুষ তো।”
–“ঠিক আছে। সেখানে আজ যাবে না?”
আমি একমনে তাকিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বললাম…
–“যাব তো অবশ্যই। সবাই উঠুক ঘুম থেকে আগে। প্রতিবছর এই সময় তো সেখানে যাই আমি। আপনার সময় হবে?”
অনুরাগ আমার হাতে হাত রেখে বললেন…
–“হুমম। আমি তোমার সাথে যাব।”

সকাল ৯ টা। সবাই ব্রেকফাস্ট করছে বসে বসে। আমি সবাইকে খাবার এগিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তবে একজনকে না দেখে আশেপাশে তাকিয়ে বললাম….
–“অর্ণব! নৌশিন কোথায়? খেতে আসেনি?”
অর্ণব খাবার মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে ব্যস্ত ভঙিতে বলল…
–“আরে ভাবি ও তো নুসাইবা কে খাওয়াতে একেবারে নাজেহাল হয়ে গিয়েছে। আমিও চেষ্টা করেছিলাম তবে অফিসে যেতে হবে। তাই আর কি খেতে বলল নৌশিন।”
–“তাহলে তো আমাকে বললেই পারত। আমার কাছে তো নুসাইবা দুষ্টুমি কম করে। আচ্ছা তোমরা খাও আমি দেখে আসছি।”
কথাটা বলে খাবার টেবিল থেকে দূরে সরে আসতেই নুসাইবা দৌড়ে এসে আমার পিছনে লুকোনো সাড়া! পেছন পেছন নৌশিনও ক্লান্ত অবস্থায় এসে আশেপাশে নুসাইবাকে খুঁজছে। আমি ওর উদ্দেশ্যে বললাম….
–“নৌশিন, তুমি খেতে বসো। আমি নুসাইবাকে খাইয়ে দিচ্ছি।”
নৌশিন নিজের কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ক্লান্ত ভঙিতে বলল…
–“না ভাবি। আজকে আমার হাত থেকে ওর ছাড় নেই। ওকে মেরে মেরে খাওয়াবো।”
–“একদমই না। ও ছোট। একটু দুষ্টু তো হবেই। তুমি যাও তো খেতে বসো।”
কথাটা বলে ওর হাত থেকে খাবারের বাটি এক প্রকার কেঁড়ে নিলাম। নৌশিন আমতা আমতা করে গিয়ে অন্য সবাইকে খাবার এগিয়ে দিতে লাগল। এই মেয়েটাও হয়েছে। কখনই আমি ছাড়া খেতে বসবে না। আমি ওর বড় বোনের মতো। তাই আমি ছাড়া ও খাবে না কিছুতেই না। আমি নুসাইবাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললাম…
–“কি নুসাইবা? মায়ের সাথে এতো দুষ্টুমি কেন হুমম? মা রেগে যায় দেখো না? রেগে মাইর দিলে?”
নুসাইবা আধো আধো গলায় বলল…
–“আ..আম্মি কে রাগাতে আমাল ভালো লালে।”
কথাটা বলে দাঁত বের করে হেঁসে দিল নুসাইবা। ওর কথা শুনে আমি অবাক। বলে কি মেয়েটা? নৌশিনকে রাগাতে ভালো লাগে? মেয়েটা তো হারে হারে বজ্জাত!

অদ্রিজাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে এখন আমি আর অনুরাগ নিজেদের গন্তব্যে ছুটে চলেছি। অদ্রিজাকেও সাথে নিতে চেয়েছিলাম। ওকে কাজ ছাড়া করতে মনটা টানে না। তবে মেয়েটাকে সেই জায়গাটাকে বেশ ভয় পায়। তাই নিয়ে আসতে পারিনি। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করলেন অনুরাগ। আমি চমকে তার দিকে তাকাতেই উনি বললেন…
–“আমরা পৌঁছে গেছি অনুশ্রী।”
সামনে তাকালাম। ওপরে বড় বড় করে লিখা ‘কবরস্থান’। আমার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে থাকল। অনুরাগ আমার ঘাড়ে হাত রাখতেই আমি ইশারা করে বললাম আমি ঠিক আছি। গাড়ি থেকে নেমে দুজনে ঢুকলাম কবরস্থানের ভেতরে। মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দিলাম। অনুরাগও মাথায় টুপি দিলেন। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে সামনে এগোতেই একটা কবরের সামনে গিয়ে থামলাম। আমার নিঃশ্বাস ক্রমাগত দীর্ঘ নিশ্বাসে পরিনত হলো। কবরের ওপরে খোদাই করে লিখা ‘মোহাম্মদ শাহনূর’। তার মানে অন্যকারো কবর দেওয়া হয়েছে। তাতে কি? আমি জানি এখানে আমার বর্ণদা রয়েছে। গত ৪ বছরে নতুন ৪ টে কবর পড়েছে। তবুও ভালোবাসার টানে বার বার ছুটে এসেছি এই দিনে। মনটাকে জানে এখানে বর্ণদা আছে। হাত বাড়িতে এগোতে লাগলেই অনুরাগ আমার এক হাত টেনে ধরলেন। আমি আর এগোতে পারলাম না। তার বুকে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। এটা নতুন কিছু নয়। হত ৫ বছরে এটাই ঘটে আসছে। কান্নার বেগ আর কমবে না। বাড়বে। নিজের কষ্টগুলো কান্নার মাধ্যমে হাওয়ায় মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব আমি। কিন্তু না পেরেও ব্যর্থ চেষ্টা করব। করতেই থাকব। সেদিন এমনটা না হলেও পারত। সেই ষড়যন্ত্রের শিকার সে না হয়ে আমি হলেও পারতাম। গল্পটা হয়ত অন্যরকম হত! আজও মনে পড়ে সেই কালো সন্ধ্যা!

অতীত…
গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়েও নিজের গায়ে কোনো আঘাত পেলাম না। কোনো ব্যাথা না পেয়েও চোখ খুলতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু ধপ করে একটা শব্দ হলো। সেটা কানে আসতেই চোখটা খুললাম। আশেপাশে রক্তের সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে। নিচে তাকিয়েই থমকে গেলাম। বর্ণদা হাত পা গুটিয়ে পড়ে আছে। তার পেট থেকে অণর্গল রক্ত বের হচ্ছে। মুখটা এক হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। পা ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছে। কাঁপতে কাঁপতে নিচে বসে পড়লাম। ততক্ষণে সব মুখোশধারী মানুষ পালিয়েছে। অনুরাগ দৌড়ে আমার কাছে এসে আমার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসলেন। বর্ণদা তখন কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। আমি তখন মূর্তির ন্যায় বসে আছি। এ দৃশ্য যে কত কষ্টের সেটা বেশ বুঝছি। হৃদয়টাতে কেউ ক্রমাগত ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে যেন। এবার কেঁদেই দিলাম। বর্ণদাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরতেই অনুরাগ অদ্রিজাকে নিয়ে নিল। হয়ত সেদিন অনুরাগও বুঝেছিলাম আমার সাথে বর্ণদার অন্তিম সময় টা দেওয়া প্রয়োজন। বর্ণদার বুকে মাথা রেখে শব্দ করে কাঁদছিলাম। তখন আমার হাত ও শাড়ি রক্তে মাখামাখি! মাথা উঠিয়ে কান্না না থামিয়ে থামা থামা গলায় বললাম….
–“কেন করলে বর্ণদা? এটা কেন করলে তুমি? কেন এলে আমার সামনে? কেন নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছো?”
বর্ণদা কিছু বলতে পারছে না। আমি রক্তাক্ত হাত দিয়ে নিজের গাল মুছে তার মাথা উঠিয়ে বললাম….
–“তুমি চিন্তা করো না। তুমি ঠিক হয়ে যাবে দেখো। শুধু তুমি তোমার চোখটা বন্ধ করো না। অনুরাগ প্লিজ এম্বুল্যান্স কে কল করুন না।” (চেঁচিয়ে)
অনুরাগ ততক্ষণে এম্বুল্যান্সকে কল করতে বসেছেন। তখনই বর্ণদা মাথা নাড়াল। অনেক কষ্টে আটকা আটকা গলায় উঠল….
–“না রে নুড়ি। এম্বুল্যান্স ডেকে কোনো লাভ নেই। আমার হাতে বেশি সময় যে নেই রে। আমি বুঝতে পারছি আস্তে আস্তে আমার দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।”
–“এমন বলো না তুমি। এমন বললে আমার কি হবে বলো তো? তুমি তো কথা দিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। দিয়েছিলে তো।”
বর্ণদা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও আলতো হাসলো। আমার গাল নিজের কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে বলল…
–“হ্যাঁ কিন্তু ভাগ্য তো আমার সাথ দিল না। তোকে তো বলেছিলাম আমি তোকে আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে রক্ষা করব। আমি আমার কথা রেখেছি। আর শোন। অনুরাগ না তোকে খুব ভালোবাসে রে। ওকে কষ্ট পেতে দিস না। যদিও আমার প্লানিং ছিল যে তোকে অনুরাগের সাথে মিলিয়ে দেব। এখান থেকে ঢাকায় ফেরার পর। তোদের বিয়ে দেখব নিজ চোখে। কিন্তু আমার পোড়া কপাল! ভালো থাকিস রে। আর অনুরাগের সাথে সব ভুল বোঝাবুঝি মি……”

বর্ণদার কথা সম্পূর্ণ হলো না। যন্ত্রণাদায়ক চিৎকার করে উঠল সে। আমি পাগলের মতো কাঁদলাম। হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গেল বর্ণদা। মুখ থেকেও গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ল তার। চোখজোড়া খোলায় থেকে গেল। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। আমার গাল থেকে হাত সরে গেল। চিরতরে সরে গেল।
চিৎকার করে তাকে জড়িয়ে কেঁদেছিলাম। কিন্তু সে ফেরেনি। অনুরাগ আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। তার বুকে পড়ে পাগলের মতো বলেছিলাম।
–“আমি দোটানাতেই তো ভালো ছিলাম অনুরাগ। আমি দোটানায় থাকতে চাই। ওকে এনে দিন না।”
সেদিন বর্ণদাকে এনে দিতে পারেননি অনুরাগ। মা, মামা, অনামিকার মতোই স্বার্থপর হয়ে চলে গিয়েছিল আমার কাছ থেকে। পরে জানতে পেরেছিলাম আসল সত্যিটা! মামি মা নিজে পরিকল্পিত প্লান করেছিল। আমাকে মারার জন্য। কিন্তু ভাগ্য দেখো। নিজের ছেলে হারিয়ে বসল চিরতরে। নিজের ছেলেকে হারানোর শোকে নিজেই সবাইকে সত্যিটা বলেছিলো। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আজও জেলে পচছে মামি। তবে আমি তো আমার বর্ণদাকে হারাতে চাইনি কোনোদিনও! তাহলে কেন হারিয়ে গেল?

সেদিন থেকে ভেবে নিয়েছিলাম আমি যাকে ভালোবাসব সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তাই কাউকে ভালোবাসব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সব ভালোবাসার মানুষ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। এমনকি অদ্রিজার থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। কারোর সাথে কথা বলতাম না। নিজেকে ঘরের কোনে বন্দি করে রাখতাম সব সময়। এভাবে ৬ মাস কাটানোর পর অনুরাগ আমাকে এসব ভুল ধারণা থেকে বের করে আনেন। এক মূহুর্তের জন্যও একা ছাড়েননি লোকটা। আমাকে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে দ্বিতীয় বারের জন্য বিয়ে করে একেবারে আমাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিলেন উনি। প্রথমে অমত করলেও পরে উনার ভালোবাসা আমার মনের মাঝে গড়ে তোলা উনার প্রতি #একগুচ্ছ_ভালোবাসা জেগে ওঠে। আজ মিলেমিশে একাকার হয়েছি আমরা।

অতীত থেকে বেরিয়ে এলাম অনুরাগের ডাকে। উনি থমথমে গলায় বললেন….
–“যেতে হবে অনুশ্রী।”
আমি মাথা নাড়ালাম। এক পলক তাকালাম কবরের দিকে। পারব না কখনো শুনতে নুড়ি ডাকটা। থাক শুয়ে নিজমনে বর্ণদা। আমিও তার জন্য মনে হাজারো অভিমান ও কষ্ট নিয়ে থাকি।
কবরস্থান থেকে বের হলাম। মনটা এখনো বেশ ভার। অনুরাগ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন….
–“তুমি কি আমার আকাশ হবে?
মেঘ হয়ে যাকে সাজাবো
আমার মনের মতো করে।
তুমি কি আমার নদী হবে?
যার নিবিড় আলিঙ্গনে ধন্য হয়ে
তরি বেশে ভেসে যাব কোন
অজানা গন্তব্যের পথে। ”

আমি হাসলাম। উনার এই পাগলামো গুলো আমাকে প্রতিদিন মুগ্ধ করেছে। প্রতি মূহুর্তে মুগ্ধ করেছে। উনি আমাকে রাঙিয়েছে নিজের #একগুচ্ছ_ভালোবাসায়। আমি হাসির থেকে পড়ল খানিকটা দীর্ঘনিশ্বাসও। কারোর মুখ থেকে নুড়ি শব্দটি না শোনার আফসোস। আর কাউকে হারানোর ভয়ে তাকে বুকের মাঝে আগলে রাখার আকাঙ্ক্ষা!

?সমাপ্ত?
বি.দ্র. অনেকের কাছে শেষ পর্বটি হ্যাপি হবে আবার অনেকেও কাছে স্যাড। গল্পের এক মুখ্য চরিত্র ছিল বর্ণ। তার ভালোবাসাগুলো অসমাপ্ত থেকে গেল। এমনই কিছু বাস্তব চিত্র আছে। যেসব ভেসে বেরায় আমাদের চারপাশে। এই গল্পে আমি তেমনই বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here