অপেক্ষা
পর্ব-৭
__হুমায়ূন আহমেদ
সুরাইয়া আয়নার সামনে বসে আছে। তার চোখে মুখে হতভম্ব ভাব। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সিঁথির কাছের কিছু চুল তামাটে হয়ে আছে। কি ভয়ংকর কথা! চুল পেকে যাচ্ছে? না-কি হলুদ-টলুদ জাতীয় কোন রঙ লেগেছে? হলুদ রঙ লাগবে কিভাবে? কত বছর হল সে রান্না ঘরে যায় না। সুরাইয়া তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন— সুপ্ৰভা!
সুপ্ৰভা দরজা ধরে দাঁড়াল। সে আজ শখ করে তার মার শাড়ি পরেছে। নীল শাড়িতে সাদা সাদা বুটি। শাড়িটা যে এত সুন্দর আগে বোঝা যায় নি। পরার পর বোঝা যাচ্ছে। শাড়ি পরার জন্যে তাকে এত বড় লাগছে যে মনেই হচ্ছে না তার বয়স মাত্র তের। মনে হচ্ছে তরুনী এক মেয়ে যে সুযোগ পেলেই সবার চোখ এড়িয়ে তার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে গল্প করে। সুপ্ৰভা এমিতেই দেখতে সুন্দর-শাড়ি পরায় আজ তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। একটু আগে মিতু তাকে দেখে বলেছে—সুপ্ৰভা, খবৰ্দার শাড়ি পরবি না। হিংসায় আমার শরীর জুলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখবি সারা গায়ে ফোসিকা উঠে যাবে।
সুরাইয়া মেয়েকে দেখে বলল, সুপ্ৰভা দেখতো আমার মাথার চুল পেকে যাচ্ছে নাকি?
সুপ্ৰভা বলল, হুঁ।
ই আবার কি ধরণের কথা। হয় বল হ্যাঁ, নয় বল না। চুল পেকেছে?
সুপ্ৰভা ক্ষীণ গলায় বলল, হ্যাঁ।
সুরাইয়া তীব্র গলায় বলল, চুল পাকবে কেন? এখনই কেন চুল পাকবে?
সুপ্ৰভা এই প্রশ্নের কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। চুল পেকে গেলে সে কি করবে? সেতো আর একশ বছরের পুরানো ঘি মায়ের মাথায় মাখিয়ে তাঁর চুল পাকায় নি। এমিতেই সে মায়ের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে–আজ সকাল থেকে ভয় বেশী লাগছে। কারণ বান্ধবীর জন্মদিনে যাবার কথা যখন বলা হয়েছে মা বিশ্ৰী করে তাকিয়েছেন, কিছু বলেন নি। অথচ আগে ভাগে কথা ঠিক হয়ে আছে সবাই দল বেধে শাড়ি পরে যাবে। রাতে ঐ বাড়িতে থাকবে। সারা রাত গল্প করবে। তাদের বাড়িতে লেজার ডিস্ক প্লেয়ার আছে। সেই লেজার ডিস্কে ছবি দেখা হবে। যে ছবি দেখা হবে সেই ছবিও এনে রাখা হয়েছে, Sound of Music.
শাড়ি পরেছিস কেন?
সুপ্ৰভা খুবই অবাক হল। সে মাকে জানিয়েই শাড়ি পরেছে। আলমিরা থেকে মা নিজেই শাড়ি বের করে দিয়েছেন। এখন হঠাৎ এই কথা কেন?
শাড়ি পরার এইসব ঢং কোথেকে শিখলি? তুই কোথায় আছিস তুই জানিস না। পরের বাড়িতে দাসীর মত পড়ে আছিস-রঙ করতে লজ্জা লাগে না–বেহায়া মেয়ে?
সুরাইয়া দম নেবার জন্যে থামলেন। সুপ্ৰভা ভাবল এই ফাঁকে সে সরে যাবে। তবে এই কাজটা করাও ঠিক হবে না। সবচে ভাল হয় সে যদি মাকে রাগ ঝাড়ার পুরো সুযোগটা দেয়।
ঢং এর মেয়ে। ঢংতো ষোল আনার উপর দুআনা আঠারো আনা শিখেছিস ; যা শেখার তাতো শিখছিস না। অংকে পেয়েছিস এগারো। এমন কোন মেয়ে আছে যে অংকে এগারো পায়? বল, আছে কোন মেয়ে? দে, কথার জবাব দে। চুপ করে থাকলে টেনে জিভ ছিড়ে ফেলব?
সুপ্ৰভা মনে মনে মায়ের কথার জবাব দিল। এই কাজটা সে ভাল পারে। মা যখন প্রশ্ন করতে থাকেন তখন সে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে ঠিকই। তবে মনে মনে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেয়। যে কোন প্রশ্নই মা তিনবার চারবার করে করেন। মার একই প্রশ্নের জবাব সুপ্ৰভা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেয়। তার বেশ মজা লাগে।
কি সার্কাসের সংএর মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কথার জবাব দে? আছে কোন মেয়ে যে অংকে এগারো পায়?
সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, হ্যাঁ মা আছে। নন্দিতা বলে একটা মেয়ে আমাদের ক্লাসে আছে। সে পেয়েছে নয়। তোমার যদি বিশ্বাস না হয় তুমি নন্দিতার কাছে টেলিফোন করে জেনে নিতে পার। ওরা দারুণ বড়লোক। ওদের বাড়িতে তিনটা টেলিফোন। নন্দিতাও আজ জন্মদিনে যাবে। নন্দিতা পারবে লাল সিস্কের শাড়ি। রাজশাহী সিল্ক। সেরিকালচার বোর্ডে তার এক মামা চাকরি করেন। তিনি এনে দিয়েছেন।
সুরাইয়া বললেন—তুই এক্ষুণি শাড়ি খোল। বই খাতা নিয়ে বোস। ইমনকে বল অংক দেখিয়ে দিতে।
সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, দুপুর বেলা বই নিয়ে বসব কেন মা? ইমন ভাইয়াকেও অংক দেখিয়ে দিতে বলা যাবে না। তার জ্বর। সে বিছানায় শুয়ে কো কো করছে। শাড়ি খুলে ফেলতে বলছি খুলে ফেলছি কিন্তু কোন কাপড়টা পারব তাও বলে দাও। যা পরব সেটা নিয়েইতো তুমি কথা শুনাবে। এত কথা শুনতে কারোর ভাল লাগে না। বাবা যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে, আমার ধারণা তোমার কথা শুনে পালিয়ে গেছে। এবং সে নিশ্চয়ই লক্ষ্মী টাইপ কোন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে যে মেয়ে দশটা কথার উত্তরে একটা কথা বলে। তোমার মত ক্যাট ক্যাট করে না।
সুপ্ৰভা মার সামনে থেকে সরে গেল। তাকে দেখে মনেও হবে না সে মনে দুঃখ পেয়েছে বা মন খারাপ করেছে। বরং মনে হবে একটু আগে তার জীবনে মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। সেই আনন্দেই সে ঝলমল করছে। সুপ্ৰভা একতলায় মিতুর ঘরে ঢুকাল। রাতে সে মিত্র সঙ্গে ঘুমায়। মিতুর ঘরটাই তার ঘর। মিতু আপার ঘরে থাকতে তার ভালই লাগে। তবে আরো ভাল লাগতো যদি তার নিজের কোন ঘর থাকতো। পুরো ঘরটা সে সাজাতো নিজের মত করে। ঘরে খাট রাখত না। নন্দিতার মত মেঝেতে একটা ফোম বিছিয়ে রাখতো। নিজের একটা সিডি প্লেয়ার থাকতো। সারাক্ষণ গান শুনত।
মিতু কাঁচাকলার ভর্তা বানাচ্ছিল। কাঁচাকলা কুচিকুচি করে কেটে তার সঙ্গে তেতুল, কাঁচামরিচ, লবন মিশিয়ে ভর্তা। কাঁচাকলার কষের সঙ্গে পরিমাণ মত তেতুল মিশাতে পারলে অসাধারণ একটা জিনিস তৈরী হয়। তেতুলের পরিমান ঠিক করাটাই জটিল। বেশী হলেও ভাল লাগবে না, কম হলেও ভাল লাগবে না। যে কোন ধরণের ভর্তা বানানোর ব্যাপারে মিতু মোটামুটি একজন বিশেষজ্ঞ। সুপ্ৰভা মিতুকে ডাকে ভর্তা রাণী।
সুপ্ৰভা হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি আপা কেমন হয়েছে?
মিতু বিরক্ত গলায় বলল, আগে বানানো হোক তারপর দেখবি। তুই যা চট করে রান্নাঘর থেকে ধনে পাতা নিয়ে আয়। অল্প ধনে পাতা কচলে দিয়ে দি।
ধনে পাতা দিও না। আপা। কলা ভর্তায় ধনে পাতার গন্ধ ভাল লাগে না।
তোকে মাতব্বরী করতে হবে না। যা করতে বলছি কর।
সুপ্ৰভা ধনে পাতা আনতে গেল। মিতু কি মনে করে যেন মুখ টিপে হাসল। সব মানুষের কিছু বিচিত্ৰ স্বভাব আছে। মিত্রও আছে। তার বিচিত্র স্বভাবের একটা হচ্ছে যখন একা থাকে তখনই সে মুখ টিপে হাসে। আশে পাশে কেউ থাকলেই সে গম্ভীর। তখন তাকে দেখলে মনে হবে কাজ ছাড়া সে কিছু বুঝে না। কাজের বাইরের সব কিছুই তার অপছন্দ।
সুপ্ৰভা ধনে পাতা নিয়ে উপস্থিত হল। মিতু বলল, ইমনের জ্বর কত জানিস?
একশা চার। আমি ঠিক করেছি। ওর গায়ে পানি ভর্তি একটা কাপ ঘন্টা খানিক বসিয়ে রাখব। জ্বরের তাপে পানি গরম হবে। সেই পানি দিয়ে আমি চা বানিয়ে খাব।
সুপ্ৰভা খিল খিল করে হাসতে লাগল। মিতু আপাকে এই জন্যেই তার এত ভাল লাগে। গম্ভীর মুখে এমন মজার মজার কথা বলবে যে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা শুরু হয়। হাসি দেখে মিতু আপা আবার বিরক্ত হয়ে ধমক দেয়। কি আশ্চর্য মেয়ে, নিজেই হাসাবে আবার নিজেই ধমকাবে।
সুপ্ৰভা হাসি থামা। বিশ্ৰী শব্দ করে হাসছিস কি ভাবে? তুই তো হায়ানা না, মানুষ। তোর হাসি শুনে মনে হচ্ছে একটা মহিলা হায়ানা হাসছে। হাসি বন্ধ করা।
সুপ্ৰভা হাসি বন্ধ করতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মিতু আপাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। মিতু আপা কোন রকম সাজগোজ করে না, অথচ তাকে দেখে মনে হয় সবসময় বাইরে যাবার জন্যে সেজে আছে।
সুপ্ৰভা আয় একটা কাজ করি—ইমনের কাছে একটা উড়ো চিঠি পাঠাই।
কি উড়ো চিঠি?
প্রেমের চিঠি। কোন একটা মেয়ে লিখেছে। এ রকম। ভুল বাংলায় আজে বাজে টাইপ। চিঠি পড়ে তার আত্মা কেঁপে উঠবে। কাউকে বলতেও পারবে না, মুখ শুকনা করে ঘুরবে। আমরা দূর থেকে মজা দেখব। আইডিয়াটা কেমন?
ভাল। খুব ভাল।
চিঠিটা আমরা পোষ্টাপিস থেকে রেজিষ্ট্রি করে পাঠাব।
চিঠিটা কে লেখবে? তুমি? তোমার হাতের লেখাতো চিনে ফেলবে।
আমার চার-পাঁচ রকম হ্যাণ্ড রাইটিং আছে। চেনার কোন উপায়ই নেই।
তাহলে আপ চল লিখে ফেলি।
বললেইতো লিখে ফেলা যায় না, চিন্তা ভাবনা করে লিখতে হবে। রাতে লিখব। শুরুটা হবে কিভাবে জানিস–ওগো আমার প্রাণপাখি বুলবুলি।
সুপ্ৰভা আবারো খিল খিল করে হেসে উঠল। মিতু বিরক্ত গলায় বলল, বললাম না হায়নার মত হাসবি না।
হাসি আসলে কি করব? হা
সি আসলে হাসি চেপে রাখবি। হাসলে মেয়েদের যত সুন্দর লাগে হাসি চেপে রাখলে তারচে দশগুণ বেশী সুন্দর লাগে।
তোমাকে কে বলেছে?
আমাকে কিছু বলতে হয় না। আমি হচ্ছি সবজান্তা। সব কিছু জানি। এবং ম্যানেজ মাষ্টার—সব কিছু ম্যানেজ করতে পারি।
তুমি কি মাকে বলে আমার বান্ধবীর বাসায় যাবার ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবে? আজ রাতে ওর বাসায় থাকার কথা।
অবশ্যই ম্যানেজ করতে পারব। আমার কাছে এটা কোন ব্যাপার না।
তাহলে তুমি আমাকে যাবার ব্যবস্থা করে দাও।
আমি কেন করে দেব? তোর সমস্যা তুই দেখবি।
সুপ্ৰভা মন খারাপ করা গলায় বলল, আপা আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি খুব কঠিন হৃদয়ের মহিলা।
মিতু সহজ গলায় বলল, ভুল বললি। আমি কঠিন হৃদয়ের মেয়ে, এটা মাঝে মাঝে মনে হবার ব্যাপার না। সব সময় মনে হবার ব্যাপার।
মিতু উঠে দাঁড়াল। মিতুর সঙ্গে সঙ্গে সুপ্ৰভাও উঠে দাঁড়াল। মিতু বিরক্ত গলায় বলল তুই ছায়ার মত সারাক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকিসনাতো। বিরক্ত লাগে।
তুমি যাচ্ছ কোথায়? ছাদ পিছল হয়ে আছে আপা ছাদে যেও না। রেলিং নেই ছাদ, ধপাস করে পড়বে।
পড়ি যদি সেটা আমার সমস্যা। তোর সমস্যা না।
মিতু ছাদের দিকেই যাচ্ছে। যাবার আগে সে ফুপুর সঙ্গে দু একটা কথা বলে যাবে বলে ঠিক করল। শক্ত কিছু কথা। এই মহিলাকে তার ইদানীং অসহ্য বোধ হচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে আগ বাড়িয়ে কঠিন কথা শুরু করা যায় না। ফুপু তার সঙ্গে কখনো কঠিন কিছু বলেন না। বললে সুবিধা হত। কোমর বেঁধে ঝগড়া করা যেত।
সুরাইয়া মিতুকে দেখে সহজ গলায় বলল, কি ব্যাপার মিতু?
মিতু বলল, কলার ভর্তা বানিয়েছি। খাবে?
না।
খেয়ে দেখ না। ভাল হয়েছে।
ইচ্ছে করছে না। তোর ইউনিভার্সিটি কেমন লাগছে?
ভালও লাগছে না, মন্দও লাগছে না—সমান সমান লাগছে।
আশ্চর্য, ঐ দিন দেখেছি লাল হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস— আজি একেবারে ইউনিভার্সিটি।
লাল হাফপ্যান্ট?
হ্যাঁ, লাল হাফপ্যান্ট। আমার সব পরিষ্কার মনে আছে। আমাকে দেখে জিভ বের করে ভেংচি কাটলি।
তোমার পুরানো দিনের কথা খুব মনে থাকে। তাই না ফুপু?
হ্যাঁ, মনে থাকে।
ফুপু তোমাকে একটা কথা বলার জন্যে এসেছি। আমিতো কাউকেই কোন অনুরোধ টনুরোধ করি না। তোমাকে করছি।
কি অনুরোধ?
সুপ্রভার এক বান্ধবীর জন্মদিন। সুপ্রভার খুব ইচ্ছা জন্মদিনে যায়। ওকে যেতে দিও।
যেতে চাইলে যাবে। যেতে না দেবার কি আছে?
রাতটা ঐ বাড়িতে থাকবে। বান্ধবীরা মিলে হৈ চৈ গল্প গুজব করবে।
সকালে চলে আসবে। আমি বিকেলে দিয়ে আসব সকালে নিয়ে আসব। কাল আমার ক্লাস নেই।
ঠিক আছে।
ফুপু কলা ভর্তা একটু খেয়ে দেখ না। ভাল লাগবে। একটু মুখে দিলেই আরো খেতে চাইবে।
সুরাইয়া খানিকটা ভর্তা হাতে নিলেন তবে মুখে দিলেন না। মিতু চলে গেল ছাদে। সুপ্রভার অনুমতি এত সহজে আদায় হয়ে যাবে সে ভাবে নি। তার ধারণা ছিল অনেক যুক্তি টুক্তি দাঁড়া করাতে হবে। আজ মনে হয় ফুপুর মনটা কোন কারণে ভাল।
ছাদে এখনো রেলিং হয় নি। প্রতি বছর জামিলুর রহমান একবার করে বলেন–এই শীতে রেলিং দিয়ে দেব। খোলা ছাদ কখন কি হয়। শীত চলে যায় রেলিং দেয়া হয় না।
বর্ষার পানিতে শ্যাওলা পড়ে ছাদ পিছল হয়ে আছে। বুড়ো আঙ্গুল টিপে টিপে হাঁটতে হয়। যে কোন মুহূর্তে ছাদ থেকে মাটিতে নেমে আসার সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে হাঁটতে মিতুর অদ্ভুত ভাল লাগে। এটা এক ধরণের পাগলামীতো বটেই। মিতুর ধারণা সব মানুষের মধ্যে কিছু কিছু পাগলামী আছে–তার মধ্যেও আছে। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তার পাগলামী ক্ষতিকারক পাগলামী না। আজ সে ছাদে হাঁটাহাঁটি করল না। চিলেকোঠায় চলে গেল।
জামিলুর রহমান সাহেব সিঁড়ির পাশে এই ঘরটা বানিয়েছিলেন বাড়ির চাকর বাকিরদের থাকার জন্যে। ঘরটা মিতু নিয়ে নিয়েছে। দুটা নাম্বারিং লক দিয়ে ঘরটা তালা দেয়া। দু। দুটা তালা দেখে ধারণা হতে পারে ঘর ভর্তি মিত্র শখের জিনিস পত্র। আসলে ঘরটা প্রায় খালি। একটা চৌকি আছে। চৌকিতে পাটি পাতা। কোন বালিশ নেই। চৌকির পাশে ছোট্ট টেবিল। টেবিলে কিছু খাতা পত্র। কয়েকটা বল পয়েন্ট। দুটা ফাউন্টেন পেন। কয়েকটা পেনসিল। টেবিলের সঙ্গে কোন চেয়ার নেই, কারণ চেয়ার বসানোর জায়গা নেই। মিতু চৌকিতে বসেই গুটগুটি করে খাতায় কি সব লেখে। তবে বেশীর ভাগ সময় দরজা বন্ধ করে চৌকিতে শুয়ে থাকে। মাথার কাছের ছোট্ট জানালা দিয়ে হুহু করে হাওয়া খেলে। জানোলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। মনে হয় বাতাসটা আকাশ থেকে সরাসরি আসছে।
আজ মিতু দরজা বন্ধ করে ইমনকে উড়ো চিঠি লিখতে বসল। রুলটানা কাগজে লিখলে ভাল হত–এখানে রুল টানা কাগজ নেই। কিছু আনিয়ে রাখতে হবে।
মিতুর চিঠিটা হল এ রকম—
৭৭৬
হে আমার প্রাণসখা বুলবুল!
জানগো তোমাকে আমি প্রত্যহ কলেজে যাইতে দেখি এবং বড় ভাল লাগে। I love you very very much. Too much. So many love.
তোমার সঙ্গে কবে আমার পরিচয় হইবে? আমি বড়ই নিঃসঙ্গ। এখানে নতুন আসিয়াছি—কাহারো সঙ্গে পরিচয় হয় নাই। আগে যেখানে ছিলাম। সেখানে দুইটা অফার ছিল। তবে আমার পছন্দনীয় নহে। আমি দেখিতে মোটামুটি সুন্দরী। তবে একটু শর্ট। হাই হিল পরিলে বোঝা যায় না। সবাই বলে আমার চোখ খুবই সুন্দর। তুমি যেদিন বলিবে সেদিন আমার জীবন ধন্য হইবে।
জানগো তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কুজো হয়ে হাঁট কেন? আমার বান্ধবীরা তোমাকে নিয়া হাসাহাসি করে। তাহারা তোমাকে দেখাইয়া আমাকে বলে–ঐ দেখ তোর কুজো বর যাচ্ছে। ঠাট্টা করিয়া বর বলে তবে ইনশাল্লাহ একদিন তুমি নিশ্চয়ই আমার বর হইবে। ইহা আমার বিশ্বাস। I Love Love Love You You You Many hundrad Kiss. এবার ৫০ + ৩০,
B দায়
Your WIFE
“A”
চিঠি শেষ করে মিতু অনেকক্ষণ খিল খিল করে হাসল। না। এই কাগজে চিঠি লিখলে হবে না—রুল টানা কাগজ আনাতে হবে এবং আরো কাঁচা হাতে লিখতে হবে। চিঠি হাতে পেয়ে ইমনের মুখের ভাব কি রকম হবে কল্পনা করতেই ভাল লাগছে। আজই যদি চিঠিটা দেয়া যেত ভাল হত। রেজিষ্ট্রি করে পাঠালে চিঠি আসতে আসতে সাতদিনের মত লাগবে। সাত দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। উপায় নেই।
সুপ্ৰভা শাড়ি বদলেছে—এখন তাকে বাচ্চা একটা মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে শাড়ি না পরলেই তাকে ভাল দেখায়। সুরাইয়া বিছানায় আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মেয়েকে দেখে কাগজ নামিয়ে বললেন, সুপ্ৰভা কাছে আয়।
সুপ্ৰভা মার কাছে গেল। সে কিঞ্চিৎ আতংকিত। যদিও আতংকিত হবার মত কিছু করেনি। শাড়ি খুলে ফেলতে বলা হয়েছে—সে তা করেছে। অংক নিয়ে বসা হয়নি। যার কাছে বসার কথা সে জ্বরে আধমরা হয়ে আছে। কাজেই তার পক্ষে কিছু যুক্তি আছে।
বিকেলে তোর বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত!
হুঁ।
রাতে হুল্লোড় করার জন্যে থেকে যাবার কথা?
হুঁ।
তুই যেতে চাচ্ছিস?
হুঁ।
সুপারিশের জন্যে মিতুকে পীর ধরেছিস? হুল্লোড় করতে লজ্জা লাগে না?
সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, মোটেই লজ্জা লাগে না। বরং ভাল লাগে। ইচ্ছা করে সারাদিন হুল্লোড় করি।
বাসা থেকে যদি বের হোস আমি তোর ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব, বদ মেয়ে কোথাকার। কতবড় সাহস পীর ধরেছে। পীরকে দিয়ে সুপারিশ করায়। আজ থেকে রাতে তুই আমার সঙ্গে ঘুমাবি।
না। তোমার সঙ্গে ঘুমাব না।
বলেই সুপ্ৰভা চমকে উঠল। তার ধারণা ছিল কথাগুলি সে মনে মনে বলেছে—এখন দেখা যাচ্ছে মনে মনে বলেনি, শব্দ করেই বলেছে। পেনসিলে আঁকা ছবি পছন্দ না হলে রাবার দিয়ে ঘসে তুলে ফেলা যায়। অপছন্দের কথা মুছে ফেলার কোন ব্যবস্থা নেই, থাকলে সুপ্রভার জন্যে খুব ভাল হত।
সুরাইয়া বিছানা থেকে নেমে মেয়ের চুলের মুঠি ধরলেন। তারপরই দেয়ালে মাথা ঠুকে দিলেন। তীব্র যন্ত্রণায় সুপ্ৰভা কিছুক্ষণের জন্যে চোখে অন্ধকার দেখল। তার কপালের চামড়া কেটে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। সুরাইয়া মেয়েকে ছেড়ে দিলেন। তিনি রক্ত সহ্য করতে পারেন না। সুপ্ৰভা হাত দিয়ে কপাল চেপে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
জামিলুর রহমান একতলার বারান্দায় চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছেন। সম্প্রতি তিনি ট্রান্সপোটের ব্যবসা শুরু করেছেন। তার কাছে খবর এসেছে তার একটা ট্রাক দাউদকান্দির কাছে এক মহিলাকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছে। ট্রাকের ড্রাইভার পলাতক। পুলিশ ট্রাক জব্দ করে থানায় নিয়ে গেছে।
ট্রাক উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। মামলা মোকদ্দমায় টাকা যাবে। নানান ঝামেলা। ট্রান্সপোটের ব্যবসায় তাঁর আসাটা খুবই অনুচিত হয়েছে। বয়স হয়েছে। ব্যবসা পাতি এখন গুটিয়ে আনার সময়, তা না করে তিনি শুধু বাড়িয়েই চলছেন।
সুপ্ৰভাকে দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন, কি হয়েছে রে?
সুপ্ৰভা বলল, পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। মনে হয় কপাল ফেটে গেছে।
সারাদিন আছিস দৌড়ের উপর ব্যথাতো পাবিই। দেখি হাত নামা, কপালের অবস্থা দেখি।
সুপ্ৰভা হাত নামাল। জামিলুর রহমান আঁৎকে উঠলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, আয় আমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সুপ্ৰভা বাধ্য মেয়ের মত বড় মামার পেছনে পেছনে রওনা হল।
জামিলুর রহমান সুপ্ৰভাকে পছন্দ করেন। শুধু পছন্দ না, বাড়াবাড়ি ধরণের পছন্দ। তিনি তাঁর এই পছন্দের ব্যাপারটা সযতনে গোপন রাখেন। সুপ্রভার সঙ্গে দেখা হলেই ধমকের সুরে কথা বলার চেষ্টা করেন। ভুরু কুঁচকে তাকান। তারপরেও মনে হয়। হৃদয়ের গোপন ভালবাসার ব্যাপারটা ঠিক গোপন রাখতে পারেন না। খুব হাস্যকর ভাবে মাঝে মাঝে তা প্ৰকাশ হয়ে পড়ে। তিনি তাতে অত্যন্ত অপ্ৰস্তুত বোধ করেন।
সুপ্ৰভাও তার রসকষহীন কাঠখোট্টা বড় মামাকে খুবই পছন্দ করে। যে দিন কোন কারণে আগেই স্কুল ছুটি হয়ে যায় সে অবধারিত ভাবে চলে যায় তার বড় মামার পুরানো পল্টনের অফিসে। জামিলুর রহমান অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বলেন, অফিসে কি? তুই অফিসে আসিস কেন? তোকে কতবার নিষেধ করেছি। অফিসে আসতে?
এক্ষুণি চলে যাব মামা।
একা একা মেয়েদের এখানে সেখানে যাওয়া আমার অপছন্দ। তুই এসেছিস কি ভাবে? রিকশায় না হেঁটে?
হেঁটে।
ফ্যানের নিচে বোস—আর কোনদিন যদি অফিসে আসিস আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আছাড় দেব।
আচ্ছা দিও, বড় মামা কোক খাব।
কোক খাবার জন্যে এসেছিস?
হুঁ।
আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবি। এরপর থেকে স্কুলেই কোক কিনে খাবি। অফিসে আসবি না।
আচ্ছা।
জামিলুর রহমান বিরক্ত মুখে ভাগনিকে কোক এনে দেন। আগে দোকান থেকে আনাতে হত, এখন আনাতে হয় না। সুপ্ৰভা মাঝে মাঝে অফিসে এসে কোক খেতে চায় শুধুমাত্র এই কারণে তিনি অফিসের জন্যে একটা ফ্রিজ কিনেছেন। ফ্ৰীজ ভর্তি কোকের ক্যান। স্নেহ-মমতা-ভালবাসা এই ব্যাপারগুলি আসলেই খুব অদ্ভুত। কোন জাগতিক নিয়মকানুনের ভেতর এদের ফেলা যায়। না। জামিলুর রহমান এই মেয়েটিকে কেন এত পছন্দ করেন তা তিনি নিজে কখনো বলতে পারবেন না।
সুপ্রভার কপালে দুটা স্টিচ লাগল। ফেরার পথে জামিলুর রহমান সারাপথ ভাগ্নিকে বকতে বকতে এলেন। বকা এবং উপদেশের কম্বিনেশন।
সারাদিন ছোটাছুটি লাফালাফি করবি-ব্যথাতো পাবিই। নিয়ম নীতির ভেতর চলতে হয় না? এতবড় যে পৃথিবী সেও নিয়মের ভেতর দিয়ে চলে—সূর্যের চারদিকে একই পথে ঘুরে। পৃথিবী কি লাফালাফি ঝাপাঝাঁপি করে?
সুপ্ৰভা বলল, মামা তুমি এমন অদ্ভুত ধরণের কথা বলবেনাতো। আমার হাসি আসছে। আমি কি পৃথিবী না-কি যে লাফালাফি ঝাপাঝাঁপি করব না?
জামিলুর রহমানের ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে কোন ভাল উপহার কিনে দিতে যাতে তার মনটা খুশী হয়। কাজটা করতে লজ্জা পাচ্ছেন। কিছু কিছু মানুষ স্নেহ এবং ভালবাসাকে চরিত্রের বিরাট দুর্বলতা মনে করেন। সেই দুর্বলতা প্রকাশিত হয়ে পড়লে তাদের লজ্জার সীমা থাকে না।
মিতু বলল, কিরে তোর কপালে ব্যান্ডেজ কেন?
সুপ্ৰভা হাসি মুখে বলল, কপাল ফাটিয়ে ফেলেছি। এইজন্যে কপালে ব্যান্ডেজ।
কপাল ফাটালি কি ভাবে?
সিঁড়ি দিয়ে নামছি হঠাৎ রেলগাড়ি ঝমোঝম, পা পিছলে আলুর দম।
ফাটা কপাল নিয়ে জন্মদিনে যাচ্ছিস?
যাচ্ছি না। আপা।
যাচ্ছিস না?
না। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে জন্মদিনে যাবার দরকার কি?
মিতু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ তীক্ষ। ভুরু কুঁচকে আছে। মনে হচ্ছে সে রেগে যাচ্ছে। সুপ্ৰভা বলল, এই ভাবে তাকিয়ে আছ কেন? মিতু বলল, সুপ্ৰভা তুই আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবি না। কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে টের পাই। এখন বল কপাল কি ভাবে ফাটল?
মা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
ধাক্কা দিলেন কেন?
বান্ধবীর জন্মদিনে যেতে চাচ্ছিলাম-এই জন্যে।
এই কারণে জন্মদিনে যেতে চাচ্ছিস না?
হুঁ।
কাপড় পর–আমি তোকে দিয়ে আসব।
আপা থাক, আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে না।
কোন কথা না, আমি যেতে বলছি তুই যাবি।
আপা শোন, মা পরে বিরাট ঝামেলা করবে।
করুক ঝামেলা।
আপা প্লীজ, আমি যাব না।
সুপ্ৰভা, তুই আমার সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কোন দিন কথা বলবি না, এবং অবশ্যই রাতে আমার সঙ্গে ঘুমুবি না।
সুপ্রভা, তাকিয়ে রইল। মিতু এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাগে এখন তার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। সুপ্ৰভা বুঝতে পারছে না-মিতু আপা এত অল্পতে এমন রেগে যায় কেন।
সুপ্ৰভা।
জ্বি।
আমার ঘর থেকে তোর বালিশ, জিনিস পত্র সরিয়ে নিয়ে যা। আমি ঠাট্টা করছি না। আই মিন ইট।
তোমার সঙ্গে কথাও বলতে পারব না?
না।
লাস্ট একটা প্রশ্ন কি করতে পারি? ভাইয়াকে যে একটা উড়ো চিঠি দেবার কথা ছিল, সেই চিঠিটা কি লেখা হয়েছে?
মিতু প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে গেল। সুপ্রভার খুব মন খারাপ লাগছে। রাতে মার সঙ্গে ঘুমুতে হবে ভাবতেই জ্বর এসে যাচ্ছে।
ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে ইমনের ঘুম ভাঙ্গল। বিকেলে ঘাম দিয়ে তার জ্বর সেরেছে। সকাল থেকে কিছু খায়নি-ক্ষিধেও হয়নি। জ্বর সারার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিধেয় পেট মোচড়াতে লাগল। গরম ভাত, ডিমভাজা এবং শুকনো মরিচ ভাজা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করল। সে যদি বিখ্যাত কোন ব্যক্তি হত তাহলে ইন্টারভু্যতে জিজ্ঞেস করত—আপনার প্রিয় খাবার কি? সে বলত চিকন চালের গরম ভাত, নতুন আলু দিয়ে শিং মাছের ঝোল।
সে বিখ্যাত কেউ নয়। ইচ্ছে করলেই সে তার পছন্দের খাবার খেতে পারে না। তার জ্বর এখন সেরেছে, প্রচন্ড ক্ষিধে লেগেছে—উপায় নেই। বিকেলে এই বাড়িতে ভাত থাকে না। দুপুরের খাবার শেষ হলেই বাড়তি ভাতে পানি দিয়ে দেয়া হয়। পরদিন সকালে তিনটা কাজের মেয়ে নাশতা হিসেবে পান্তা ভাত খায়। বিকেলে কাজের সময় তাদের কাছে চাইলেও তারা তার জন্যে গরম ভাত রাধবে না। মিতুকে কি বলে দেখবে? মিতুকে বললে সে ড্রাইভার পাঠিয়ে শিং, মাছ কিনিয়ে আনবে। আবশ্যি নাও আনতে পারে। মিতুর কোন ঠিক ঠিকানা নেই। হয়ত বলবে, শিং, মাছ খেতে হবে না। এক গ্লাস দুধ খেয়ে শুয়ে থাক।
ক্ষিধে কমাবার জন্যে ইমন পুরো দুগ্ৰাস পানি খেয়ে ফেলল। পানিতে তিতকুটে স্বাদ–তার মানে জ্বর ভাব পুরো সারেনি। খালি পেটে পানি বেশি খেলে-নেশা নেশা ভাব হয়। ঘুম পায়। ইমন আবারো শুয়ে পড়ল। বিছানার চাদর এবং কথাটা বদলাতে পারলে ভাল হত। চাদরে এবং কাঁথায় জ্বর জ্বর গন্ধ। অসুখ সেরে যাবার পরে অসুখের গন্ধ নিয়ে শুয়ে থাকতে ভাল লাগে না। যদি লাগে তাহলে বুঝতে হবে অসুখ সারে নি। ইমনের শুয়ে থাকতে ভালই লাগছে। বৃষ্টির মত ঝমোঝম শব্দ হচ্ছে। অথচ বৃষ্টি হচ্ছে না। শব্দটা আসছে কোত্থেকে?
ইমনের ঘরটা বেশ বড়। তবে ঘরটা তার একার না-জামিলুর রহমানের দুই ছেলে শোভন এবং টোকনের একই শোবার ঘর। শোভনকে আপাতত বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বলে ঘরটা এখন ইমনের। দুই ভাইয়ের বয়স পচিশ। যমজ হলেও এদের চেহারা এবং স্বভাব চরিত্র আলাদা। শোভন ঠান্ডা স্বভাবের। টোকন উগ্ৰ। দুজন সারাক্ষণই একসঙ্গে থাকে। শোভনকে বের করে দেয়া হয়েছে বলে টোকনিও বের হয়ে গেছে। এরা জগন্নাথ কলেজে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হয়ে কিছুদিন ক্লাস করেছিল। এখন কি করে বা কি করে না পুরোটাই রহস্যে ঘেরা। ইমন দুই ভাইকেই বেশ পছন্দ করে। যে সব রাতে তারা থাকে না সেই সব রাতে একা একা ঘুমুতে ইমনের একটু ভয় ভয়ও লাগে। শোভনকে কেন বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ইমন জানে না। তার বড় মামা এক রাতে তার ঘরে এসে বলেছেন, শোভন যদি রাতে বিরাতে তার ঘরে থাকতে আসে আমাকে খবর দিবি। যত রাতই হোক আমাকে খবর দিবি। এই বাড়ির ত্রিসীমানায় তার আসা নিষিদ্ধ। ইমন শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা কাত করেছে, বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস তার হয় নি। জামিলুর রহমান ইমনের ঘর থেকে শোভনের খাটের তোষক চাদর সব সরিয়ে নিয়েছেন। শোভনের আলমিরা খুলেও জিনিসপত্র সরানো হয়েছে। টোকনের খাট বিছানা সব ঠিক আছে। ইমন শুয়ে আছে টোকনের খাটে।
সন্ধ্যাবেলা ইমনের ঘুম ভাঙ্গল মশার কামড়ে। মশা কামড়ে তার মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ঘর অন্ধকার। মনে হচ্ছে গভীর রাত। দরজা জানোলা বন্ধ বলে বোঝাই যাচ্ছে না মাত্ৰ সন্ধ্যা। গভীর রাত ভেবেই ইমনের একটু ভয় ভয় করতে লাগল। তার বাথরুমে যাওয়া দরকার। খাট থেকে নেমে বাতি জ্বলিয়ে বাথরুমে যেতেই ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে খাট থেকে নামলেই খাটের নিচ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে কেউ একজন এসে শীতল হাতে তার দুপা জড়িয়ে ধরবে। এই ভয় শৈশবের ভয়। শৈশবের কিছু কিছু ভয় মানুষের সঙ্গে থেকে যায়। মানুষের বয়স বাড়ে, শৈশবের অনেক কিছুই তাকে ছেড়ে যায়—ভয়টা ছাড়ে না। ভয় পেলে অবধারিত ভাবে ইমনের ছোট চাচার কথা মনে পড়ে। ছোট চাচার সঙ্গে তার দেখা হয় না প্রায় ছয় বছর। দাদীর মৃত্যুর পর পর হুট করে তিনি একদিন চলে যান সিঙ্গাপুর, সেখান থেকে মালয়েশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে সুইডেন। তার শেষ পিকচার কার্ডটা সুইডেন থেকে পাঠানো। সুন্দরী নীলচোখা এক মেয়ে বরফ দিয়ে তুষার মানব বানাচ্ছে। পিকচার কার্ডের উল্টোদিকে এলোমেলো ভঙ্গিতে লেখা
ইমন,
এখানে তেমন সুবিধা করতে পারছি না। স্পেনে এক বাঙ্গালী পরিবার থাকে। তাদের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ হয়েছে। তারা স্পেনে–যেতে আমাকে উৎসাহিত করছেন। কি করব বুঝতে পারছি না। আমার সিদ্ধান্ত চিঠি দিয়ে জানাব। সুইডেনের ঠিকানায় আপাতত কোন চিঠি দিবি না, কারণ আমি আগামীকাল বাসা বদলাব। সুপ্ৰভাকে আমার স্নেহ দিবি। সে কত বড় হয়েছে?
ইতি তোর ছোট চাচা
ছোট চাচার কাছ থেকে আসা এই শেষ চিঠি। ইমনের ছোট চাচার কর্মকান্ডে সবচে বেশি আনন্দিত হয়েছেন সুরাইয়া। তিনি গম্ভীর গলায় এখন প্রায়ই বলেন—
বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তোদের বংশগত রোগ। তোর বাপ যেমন উধাও হয়েছে, তোর চাচাও তাই করেছে। তোদের পূর্ব পুরুষের উদাহরণ খুঁজলে দেখবি তারাও এই কান্ড করেছে। তোদের গুষ্টিই হল ভবঘুরের গুষ্টি। আমি যে গোড়া থেকেই বলছি-তোদের বাবা ভাল আছে, যথা সময়ে উপস্থিত হবে। এই কথাটা প্ৰমাণ হলতো?
মাঝে মাঝে ইমনের মনে হয়-মার কথা শেষটায় সত্যি সত্যি। ফলে যাবে। কোন এক গভীর রাতে বাবা এসে উপস্থিত হবেন।
ইউনিভার্সিটির ভর্তি ফরমে বাবার নাম লিখতে হয়। সেখানে সে লিখেনি। মরহুম হাসানুজ্জামান। মরহুম শব্দ লিখতে তার ইচ্ছে করে না। বাবা যদি কোনদিনই না ফেরে তাহলে হয়ত সে কোনদিনই লিখতে পারবে না বাবা মরহুম হাসানুজ্জামান। ইমনের বয়স যখন আশি হয়ে যাবে তখন কি পারবে? না, তখনো পারবে না। অদ্ভুতভাবে একজন মরণশীল মানুষ অমর হয়ে যাচ্ছে।
খুট্ করে দরজা খুলল। সুপ্ৰভা মাথা বের করে বলল, ভাইয়া ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন? জ্বর কমেছে?
ইমন বলল, হুঁ।
কিছু খাবে? ক্ষিধে লেগেছে? স্যুপ খাবে?
স্যুপ?
আমার জন্যে বড় মামা স্যুপ আনিয়েছেন। আমার খেতে ইচ্ছা করছে না, তোমাকে গরম করে এনে দেব?
দে।
ভাইয়া তোমার মুখ কেমন যেন ফুলে লাল হয়ে আছে। মনে হয়। হাম উঠেছে।
হাম না, মশা কামড়েছে।
বাতি কি নিভিয়ে দিয়ে যাব না জ্বালা থাকবে?
জ্বালা থাকুক।
মিতু আপা কি তোমার ঘরে এসেছিল?
না।
ইমন বোনের ব্যান্ডেজ করা কপাল দেখছে। এর মধ্যে একবারও জিজ্ঞেস করেনি কপালে কি হয়েছে। সুপ্রভার ধারণা তার মা যেমন অদ্ভুত, তার ভাইয়াও অদ্ভুত। জগতের কোন কিছুতেই তার কিছু হয় না। সুপ্ৰভা যদি কোন কারণে হঠাৎ মরে যায়, সেই খবর ভাইয়ার কাছে পৌঁছলে সে এসে উঁকি দিয়ে দেখবে তারপর নিজের ঘরে ঢুকে দরজা টারজা বন্ধ করে বই নিয়ে বসবে। অন্যের বেলাতে সে যেমন উদাসিন তার নিজের বেলাতেও উদাসিন। প্রচন্ড জ্বর হলেও কাউকে বলবে না, আমার জ্বর। কাঁথা গায়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবে। ক্ষিধে লাগলে বলবে না, আমার ক্ষিধে লেগেছে। সবচে যেটা ভয়ংকর—মুখে হাসি নেই। কত মজার মজার ঘটনা চারপাশে ঘটছে, সে দেখবে কিন্তু হাসবে না। সুপ্রভার প্রায়ই ইচ্ছে করে এমন অদ্ভুত কিছু তাদের সংসারে ঘটুক যা দেখে ইমন হো হো করে হেসে উঠবে। সেই হো হো হাসির ছবি সে চট করে ক্যামেরায় তুলে ফেলবে।
ভাইয়া!
হুঁ।
সুনামগঞ্জের পাগলা পীর সাহেবের কথা তোমার বিশ্বাস হয়?
তার কোন কথা?
ঐ যে সে মাকে বলে গেল, বাবা বেঁচে আছেন, তোমার যেদিন বিয়ে হবে সেইদিন ফিরে আসবেন।
না। পীররা এই জাতীয় কথা সব সময় বলে।
দিন তারিখ মিলিয়ে বলে না। তারা বলে ফিরে আসবে, কবে আসবে তা বলে না। পাগলা পীর সাহেব কিন্তু কবে ফিরবেন তা বলেছেন।
এই পীর অন্যদের চেয়ে বোকা।
আমার কেন জানি মনে হয়। পীর সাহেবের কথা সত্যি হবে। তোমার যেদিন বিয়ে হবে সেদিন বাবা সত্যি সত্যি উপস্থিত হবেন।
উপস্থিত হলেতো ভালই।
সুপ্ৰভা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, সবচে ভাল হয় তুমি যদি এখন বিয়ে করে ফেল। বাবাকে আমরা তাহলে তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব। তুমি যত দেরিতে বিয়ে করবে। বাবাকে তত দেরিতে পাব।
ইমন তার বোনের দিকে তাকাল, কিছু বলল না। তার তোকানো দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রসঙ্গটা তার মনে ধরছে না। সুপ্ৰভা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। চোখ মুখ গম্ভীর করে বলল, শোভন ভাইয়ারা কি রাতে মাঝে মধ্যে আসে?
না।
আমার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল। আমি রিকশা পাচ্ছিলাম না। রিকশার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি লাল রঙের একটা গাড়ি এসে একেবারে আমার গা ঘেসে থেমেছে। প্ৰথমতো আমি ভয়ই পেয়ে গেলাম, তারপর দেখি পেছনের সিটে টোকন ভাইয়া, আর শোভন ভাইয়া। আমাকে দেখেই শোভন ভাই দিলেন এক ধমক, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শোভন ভাইয়ার কি যে স্বভাব, এমন ঠান্ডা মানুষ অথচ ধমক ছাড়া কথা বলতে পারে না। আমি বললাম, রিকশার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর বললাম, শোভন ভাইয়া তোমার সাথে যখন গাড়ি আছে তখন গাড়ি করে আমাকে নামিয়ে দাও। শোভন ভাইয়া বললেন, আমার ঠেকা পরেছে। বলেই হুস করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। দুজনই দাড়ি রেখেছে, মুখ ভর্তি দাড়ি। দেখে চেনাই যায় না। চেহারা একদম বদলে গেছে। ছেলেদের কত মজা, ইচ্ছা করলেই দাড়ি রেখে তারা চেহারা বদলে ফেলতে পারে। আমরা মেয়েরা সেটা পারি না। ঠিক না ভাইয়া?
হুঁ।
মেয়েদেরও দাড়ি গোফ গজানোর সিস্টেম থাকলে ভাল হতো। হতো না ভাইয়া?
কি জানি। বুঝতে পারছি না।
আমার কথা শুনতে কি তোমার বিরক্ত লাগছে?
না।
তাহলে এ রকম বিরক্ত বিরক্ত ভাব করে বসে আছ কেন?
ইমন জবাব দিল না। সুপ্ৰভা তার সঙ্গে প্রচুর কথা বলে। ইমনের ইচ্ছা করে কথা বলতে। কেন জানি বলা হয় না। সে শুধু শুনেই যায়। সুপ্রভার কপালে ব্যান্ডেজ। কি ভাবে ব্যথা পেল জানতে ইচ্ছা করছে কিন্তু জানার জন্যে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে না। ইমন যখন ঠিক করল এখন সে জানতে চাইবে তখনি সুপ্ৰভা চলে গেল। ইমনের মনে হল ভালই হয়েছে, প্রশ্ন করতে হল না।
রাতে সুপ্ৰভা মার সঙ্গে ঘুমুতে এল। বালিশ নিয়ে এসে ঝুপ করে বিছানায় পড়ে গেল। পড়ার সময় শব্দ একটু বেশি হল। আতংকে সুপ্ৰভা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল—এই বোধ হয় মা একটা ধমক দিলেন। সুরাইয়া ধমক দিলেন না, বরং উলটো হল, স্বাভাবিক গলায় বললে?