শব্দহীন_বৃষ্টি (৩২)

0
1161

শব্দহীন_বৃষ্টি
(৩২)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
Never lie to me
Never ever lie to me
Yours i Don’t wanna be
Don’t come back to me (2)
And i swear i died when you said goodbye
I don’t wanna cry when it comes the night
You held my hands by the time i was lonely
Your whisper voice was my favorite melody
You kissed my lips and then you left slowly
Now i…..

সাদা টি-শার্ট ,আলুথালু চুল,ধারালো চোয়াল কুঞ্চিত ভ্রু-যুগল ।গিটারের তারে আঙ্গুল চলছে। লিরিক্স এর সাথে ঠোঁটের কোণে ভাজ পড়ছে কখনোবা প্রসারিত হচ্ছে৷ চোখের পাতায় যেন একরাশ অভিমান ভর করেছে যার ফলে পাতা দু’টো বারবারই বন্ধ হয়ে আসছে৷ আগে কখনো কন্ঠমণিটা এত উঁচু লাগেনি। আজ একটু বেশিই চোখে পড়ছে কারণ কি? খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগলো সাগরকে আর তার শ্রবণশক্তিও যেন গুণে গুণে কয়েকটা শব্দই শুনতে পাচ্ছে.

You kissed my lips and then you lefy slowly…… চোখ বুঁজে নিয়েছে মাহি বন্ধ চোখে ভেসে উঠলো সেই অন্ধকারময় রাত। ছেলেটি কামড়ে ধরেছিলো মেয়েটির ঠোঁট আর মেয়েটি খামচে দিয়েছিলো তার ঘাড়। ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হয়ে গেল মাহির। বুকের ভেতর ওই মানুষটার জন্য তুফান অথচ ঠোঁটে হাসি ফুটছে পুরনো রাত মনে করেই। অকস্মাৎ করতালি শুনে চোখ খুলে তাকায় মাহি। তার পাশ ঘেঁষে বসা মিনহা এবং আরো কয়েকজন মেয়ে হাত তালি দিচ্ছে । সাগরের গান শেষ হয়ে গেল। এত জলদি! মাহি তো ঠিকঠাক শুনতেই পারলো না পুরনো স্মৃতিরা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো সেই ছাঁদে। স্মৃতির ঘোর ভাঙতেই আশেপাশে চোখ বুলালো মাহি কিন্তু সাগরের দেখা মিলল না। বড্ড ছটফট লাগছে তার সাগর কি একটু মিস করেনি তাকে এতদিনে? কেন একটু কথা বলতে চাইছে না মাহির খুব কষ্ট হয়। গত কয়েকটা মাসে মৃত্যুসম যন্ত্রণা সহ্য করেছে সাগর থেকে দূরে থাকার চেষ্টায়।

নিরব গান গেয়েছিলো একটা তার ফিয়ন্সিকে ডেডিকেট করে। গানের ক্ষেত্রে তার পারদর্শীতা তেমন নেই শখ তার বাদ্যযন্ত্রেই বেশি আর সেটাতে খুব পাকা সে। তাই তো যেখানে সবার ডিমান্ড সাগরের গান সেখানে সাগরের ডিমান্ড নিরবের কিবোর্ড বাজানো। গিটারে অবশ্য সাগর, সমুদ্র দুই ভাই প্রায় সমানই। পুরো কনসার্ট মেতেছে আজ দু’ভাইয়ের কন্ঠে। সমুদ্র আগে কখনও এমন জনবহুল জায়গায় গান করেনি। স্কুল পিকনিক কিংবা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সামনেই তার সীমাবদ্ধতা ছিলো। আজ সাগর নিজেই বলেছে এখানে গাইতে। ডাক্তারি পড়া সমুদ্রের মায়ের ইচ্ছে সমুদ্রের শখ বড় মিউজিসিয়ান হওয়া কিন্তু মায়ের স্বপ্নে তার শখ,ইচ্ছে চাপা পড়ে গেছে। সাগর জানে ভাইয়ের স্বপ্ন আর তাই শখ পুরন করার সুযোগ না করে দিতে পারলেও ক্ষণিকের সুখ তো খুঁজে দিতেই পারে।
কনসার্ট চলবে রাত বারোটা অব্ধি কিন্তু মাহি,মিনহার কথা ভেবে নিরবকে চলে যেতে হবে দশটা বাজার আগেই। এদিকে বাড়ি থেকে একের পর এক কল আসছেই সাগরের। বাড়ি যেতে বলেছে বাবা কারণ বলেনি আবার এও বলেছে সমুদ্রের যাওয়া লাগবে না।

অস্থির, চঞ্চল মনে কোথাও একটু ঝড়ের আভাস পাচ্ছে সাগর। মাহিকে দেখার পরই হয়েছে এমনটা। মন বলছে একটিবার মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করবে কেন করছে এমন? কি দোষ সাগরের! প্রথমে নিজেই পাগলামো করে সাগরের সবটা জুড়ে দখল নিলো সাগর যখন সেই দখলে হস্তক্ষেপ করতো তখন বাঁধা মানেনি। আর যখন সাগর তার দখলদারত্বের কাছে হার মানলো ঠিক তখনি মেয়েটা সব ছেড়ে দূরে সরে গেল৷ মনের জমিনে কাঙাল করে গায়েব হয়ে গেল। কে দিলো এত অধিকার তাকে? জিজ্ঞেস তো করতেই হবে একটিবার কিন্তু কি করে? গায়ের টি শার্ট ভিজে চুপসে লেপ্টে আছে সাগরের গায়ে। সমুদ্র স্টেজে তা দেখে সাগর ফোনটা পকেটে রেখে মাহিকে খুঁজতে লাগলো পেয়েও গেল। কিন্তু তাতে লাভ হলো না মাহির পাশে মিনহা বসে আছে৷ নিরব নেই পাশে। সাগর একবার ভাবলো সামনে যাবে আবার মনে হলো মিনহা বা নিরব ঠিক ভাবে নেবে না ব্যাপারটা৷ নিজের মধ্যে নিজে যখন দোটানায় মাহিকে নিয়ে ভাবছে তখন নিরব পেছন থেকে ডেকে উঠলো ” সাগর ভাই”!

–” হ্যা নিরব বলো। ”

–” হৈ চৈ শুনতে পাচ্ছেন?” নিরবের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাগর পরক্ষণেই ভ্রু স্বাভাবিক করলো ” ওহ হ্যা। কনসার্টে তো হৈ চৈ হবারই কথা। ”

–” আমি সেই হৈ চৈ এর কথা বলছি না।”

দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সাগর। নিরবের কথার অর্থ ধরতে পারছে না সে।

–” সাগর ভাই আমি আপনার আর সমুদ্রের কথা বলছি। কান পেতে শুনুন গান শেষ হতেই সবাই আপনাদেরকেই চাচ্ছে বারবার। জাস্ট মাতিয়ে দিয়েছেন আপনারা। ” নিরব বলেই চলছে এমন আরো অনেক প্রশংসামুখর বাক্য। সাগরের সেদিকে কান নেই৷ বাড়ি থেকে আবারও কল করছে।

–” কি লাভ হলো এমনটা করে?” চামেলি হতাশার সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন।

— “কিসের কথা বলছো?” মনজুর বেশ অবাকই হলেন চামেলির কথায়।

–” কিসের কথা আবার? সাগরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে৷ সেই পাত্রীর সঙ্গেই হয়েছে যার সমন্ধ তুমি এনে দিয়েছিলে। ”

–” এ তো ভালো খবর। তুমি কি করে জানলে । ”

–” সাগরের মা মিষ্টি পাঠিয়েছেন তার ছোট চাচীকে দিয়ে তখনই শুনলাম। কেন করলে এমন বোকামি? সাগরের মত সুপাত্র কেউ কি এভাবে হাতছাড়া করে?” চামেলির চোখ মুখে একটা আফসোসবোধ স্পষ্ট । একমাত্র মেয়েকে এভাবে চোখের সামনে রাখার আর কোন সুযোগই রইলো না। এ পাড়ায় চিরুনি তল্লাশি চালালেও এমন পাত্র আর পাবেন না। সাগরদের পরিবারের অনেক সুনাম এলাকা জুড়েই বিশেষ করে তাদের বাড়ির ছেলেদের চলাফেরা, আচার-আচরণ সব কিছুই প্রশংসার কাবিল।

–” আমি কিন্তু প্রস্তাবটা সরাসরি ফিরিয়ে দেই নি। শুধু বুঝিয়েছিলাম মাহির বয়সটা বিয়ের যোগ্য হয়নি এখনও। আর কিছু সময় অন্তত তার ইন্টারমিডিয়েট কমপ্লিট হওয়া দরকার। অপেক্ষা মনে মনে আমারও ছিলো যেন তারা একটিবার বলে কিছুদিন পরই বিয়েটা হবে বা আকদ করিয়েও রাখা যায়। কিন্তু তারা খুব তাড়াহুড়ায় আছে ছেলের বিয়ে নিয়ে সেখানে আমি আর কি করবো বলো?”

–“তুমি নিজেই বলে দেখতে,,,

–” কি বলছো মাহির মা! মেয়ের বাবা হয়ে আমি সেধে এ কথা বলতে পারি? তারা যদি একটু ইঙ্গিত দিতো তবে না হয় আমিও কিছু বলতাম আগ বাড়িয়ে বলা যায় না এসব কথা৷ ” দুই স্বামী -স্ত্রীতে আরো বেশ কিছুক্ষণ এ নিয়েই আলাপ চলল। দু’জনের মনেই একটু আফসোস সাগরকে মেয়ের জামাই হিসেবে পাবে না বলে।

রাত দশটা বাজে মিনহার পক্ষে আর সম্ভব নয় কনসার্ট উপভোগ করা। এ পর্যন্ত কয়েকবার তার বাড়ি থেকে কল এসেছে। যতোই হোক নিরবের সাথে এখনও বিয়েটা হয়নি তাই তারা একদমই নিতে পারছে না এমন রাত অব্ধি তাদের ঘোরাফেরা। নিরবও সিচুয়েশন বুঝে মাহি আর মিনহাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো কনসার্ট প্লেস থেকে৷ গাড়িটা পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট কোন জায়গা ছিলো না সেখানে তাই ফ্যাক্টরির সামনেই দাঁড় করিয়েছিলো। মাহি আর মিনহাকে দাঁড়াতে বলে নিরব গাড়ির কাছে যাচ্ছিলো রাস্তায় এনে পরেই মাহি আর মিনহাকে উঠাবে। হঠাৎ কানে এলো কেউ মাহি বলে ডাকছে।

–” কেউ মাহিয়া বলে ডাকলো না!” নিরব কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো। মিনহা বলল, ” মাহিকে কে ডাকবে এখানে?”

–” আমি ঠিক শুনতে পাচ্ছি আওয়াজটা এদিকেই আসছে।”

নিরব আর মিনহার কথপোকথন বুঝতে বাকি নেই মাহির । সে নিজেও শুনতে পাচ্ছে সাগরের গলার স্বর। মাহি হয়তো অনুভব করতে পাচ্ছে সাগরের মনের লুকানো খবর তাই আর এখানে দাঁড়াতে চাচ্ছে না এক মুহুর্তও।

–” কেউ ডাকছে না ভাইয়া চলো গাড়ি বের করো ” বলে মাহি পা বাড়ালো গাড়ির দিকে৷ ততক্ষণে সাগর এসে তার হাত ধরে টানলো, ” মাহিয়া দাঁড়াও। ”

সাগর বোধ হয় ভুলেই গেছে মাহির সাথে আরো দু’জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এখানে৷ সে এখনও মাহির হাত ধরেই রেখেছে এদিকে মিনহা আর নিরব বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে সাগরের মুখের দিকে৷

–” কি হয়েছে সাগর ভাইয়া?” নিরবের কথায় যেন সাগরের হুঁশ এলো। সে মাহির হাত ছেড়ে দিলো৷ কয়েক সেকেন্ড সংকোচ নিয়েই চুপ থেকে বলল, ” আমার একটু কথা ছিলো মাহির সাথে যদি তুমি কিছু মনে না করো দু’মিনিট সময় চাইছি।”

নিরব হতবুদ্ধি যেন বলল, ” হ্যা হ্যা বলুন সমস্যা নেই।” কিন্তু নিরব ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে দেখে সাগর হতাশ হয়ে নিরব আর মিনহার দিকে তাকালো। মিনহা হয়তো বুঝতে পেরেছে কিছু তাই নিরবের হাতে চিমটি কেটে ইশারা করলো এখান থেকে সরে যেতে৷নিরব বোকার মত মিনহার দেকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো ” চিমটি কাট,,, আর কিছু বলার সাহস পায় নি মিনহার অগ্নিদৃষ্টি দেখে। তৎক্ষনাৎ দু’জনেই জায়গাটা থেকে সরে গেল। গাড়ির কাছে যেতেই মিনহা টিশার্টের ওপর থাকা শার্টের কলার টেনে ধরলো, ” এই ছেলে তোমার কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছিলো?”
–” এমন কি করলাম? ”

–” ছোট বোনের বিরহালাপ এ সামনে থাকতে চাও।” নিরব যেন একটু চমকালো মিনহার এ কথায়।

–“বিরহআলাপ মানে?”

–” বোঝো না? সাগর ভাইকে খেয়াল করেছো কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো এসে সামনে দাঁড়ালো । মাহির হাত ধরে কেমন কথা বলতে চাইলো।”

–” এতে বিরহআলাপের কি হলো। তারা দু’জন প্রতিবেশি তার উপর এক সময় মাহি টিউশনও পড়েছে সাগর ভাইয়ার কাছে।” নিরবের কাছে সাগরের এভাবে মাহির হাত ধরা কথা বলতে চাওয়া কিছুতেই অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। কিন্তু মিনহার মন বলছে এখানে কাহিনি কিছু আছে তবে সেটা প্রেম ভালোবাসাঘটিত ব্যাপার।

–” ওরে আমার বুদ্ধুমানব কেমন ভাই আপনি। এই আপনি না বলতেন মাহির সব খবর আপনার জানা। কলিজার টুকরো সে আপনার আর এটা জানেন না আপনার কলিজার টুকরোতে কেউ কব্জা করে বসে আছে।”

–” কি বলতে চাইছো তুমি? সাগর ভাই আর মাহি,,,,!

–” এক্সাক্টলি, দু’জনে প্রেমে পুড়ে যাওয়া কয়লা। প্রেম করে কিনা তা তো আন্দাজ করতে পারছি না। তবে আসার পর থেকে মাহিকে যতটুকু খেয়াল করেছি সে সাগর ভাইকে অন্যরকম করে দেখছিলো। কারো গানই সে শোনেনি ঠিকঠাক অথচ সাগর ভাই যতবার স্টেজে ছিলো অপলক দেখেছে মাহি ওনাকে। এমনকি,,,,

–“এত কিছু কি করে বুঝলো আমার জানপাখিটা?” দুষ্টুমি করে বলল নিরব।

–” যেভাবে বোঝার সেভাবেই এখন ওদের কথা ছাড়ো আমাকে একটু আদর করো তো।”

–” হায় হায় মেয়ে কি বলে ছিহ, লজ্জা করে না!” নিরব গাড়িতে বসতে বসতে বলল কথাটা৷ রাগ হলো মিনহার যেখানে নিরব নিজে একটু আদর,সোহাগ করবে সেখানে তার চাইতে হচ্ছে । যত্তসব বোরিং লোক।

মিনহার অভিমান টের পেয়ে নিরব সিট বেল্ট বেঁধে দেওয়ার বাহানায় মিনহার মুখের কাছে চলে এলো। মিনহা কিছু বুঝে উঠার আগেই চটাস করে তার গালে চুমু খেয়ে বসলো।

মাহি চিবুক নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। একটিবার তাকাচ্ছে না সাগরের দিকে তবুও তার বুকের ভেতর খামছে ধরলো কিছু একটা যেন। ফ্যাক্টরির পেছন দিকটা একদম নির্জন৷ ভেতরের গানের আওয়াজ আসছে তবে এদিকটায় একদমই মানুষজন নেই। সাগর ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে মাহির মুখের দিকে তাক করলো। তীব্র আলোকরশ্মি হঠাৎ চোখে মুখে পড়ায় চেহারা কুঁচকে ফেলল মাহি। এই কুঁচকানো মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল সাগর। ভ্রু দু’টো কেমন আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। কপালের মধ্যভাগে ছোট দুটি রেখার উদয় হয়েছে। সামনের কাটা কিছু চুল অবাধ্যতা বজায় রেখে মাহির গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। চোখের পাতা পুরোপুরি বন্ধ না হয়ে একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাহিকে কি একটু আদুরে লাগছে! বুঝে পায় না সাগর নাকি বিরক্তি মেখে আছে তার মুখটা জুড়ে। কই আগে তো মাহিকে দেখলে অন্যকিছুই মনে হতো আজ তা মনে হচ্ছে না।

–” এখানে কেন নিয়ে এলেন? ”

–” কেমন আছো?” সাগরের এ প্রশ্নে যেন বেশ অবাক হলো মাহি। চোখ মেলে একবার গভীর দৃষ্টিতে দেখলো সাগরকে তারপর ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি টেনে জিজ্ঞেস করলো ” এটা জানতে এখানে নিয়ে এসেছেন?”

–” ছাঁদে আসো না কেন?”

–” এসব প্রশ্ন করতেই এখানে,,,,,, কি সমস্যা তোমার এভোয়েড করছো কেন আমায়? মাহির কথার মাঝেই সাগর প্রশ্ন করলো ।

–” এভোয়েড করবো কেন?”

–” তবে ছাঁদে আসো না কেন ফোন দাও না কেন?”

–” দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল এক্সাম আর মাত্র তিন মাস বাকি। আর ফোন কি আমি রেগুলার দিতাম নাকি?” মাহির কথা শুনে সাগর বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। এই যে এত গুলো মাস মাহি তার পেছনে পাগলের মত পড়েছিলো তা কি ছিলো! আজ কত স্বাভাবিকভাবেই না কথা বলছে মেয়েটা। প্রাপ্তবয়স্ক সাগর এক সতেরো বছর বয়সী মেয়ের সামনে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে? আগে তো কখন সে কারো সামনে এভাবে নিজের স্বকীয়তা হারায়নি। তবে আজ কেন এমন করছে।

–” মাহিয়া তোমার বাবা নিজে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলো।”

–” এখন এ প্রসঙ্গ আসছে কেন। আমার বাবার যা ঠিক মনে হয়েছে তাই করেছে। নিরব ভাইয়া ওয়েট করছে আমায় যেতে হবে। ” মাহি আর অপেক্ষা না করে ফিরে যেতে লাগলো। সাগর আবার তার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো। মাহি একবার হাতের দিকে আরেকবার সাগরের দিকে তাকালো। ঘামে ভিজে টি শার্ট একদম লেগে আছে শরীরে সাগরের। এলোমেলো চুল গুলোও কিছুটা ভিজা কপালে লেগে আছে। মাহির খুব ইচ্ছে করছে সাগরের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িভর্তি গালটাতে হাত রেখে একটাবার বলতে, ” আপনাকে এমন ছন্নছাড়া রুপে একটুও মানায় না। আপনাকে তো ভারী ব্যক্তিত্বে। এমন পাগল পাগল আর কাতর দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। কিন্তু হায়! মাহির কি সে অধিকার আছে নাকি? আগের মাহিও তো আর নেই।

–” আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব নিরবকে বলে দাও ফোন করে।” গম্ভীর গলায় বলল সাগর।

–” আমি ভাইয়ার সাথেই যাবো।”

–” বললাম না আমার সাথে,,,,

–” কেন করছেন জোর? কোন অধিকারে? আমি আমার ভাইয়ের সাথেই যাবো।” চিৎকার করেই বলে মাহি আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। সাগর থ এ কোন মাহিকে দেখছে সে? চার মাস আগেও এই মাহি তার সাথে একটু কথা বলতে অন্ধকার রাতে ছাঁদে অপেক্ষা করতো৷ কলেজ টাইমের আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেত রাস্তায় রিকশা থামিয়েও কথা বলতো আর আজ! চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল৷

গাড়ির দরজা লক করে খুব সতর্ক ভাবেই মিনহাকে একটা বড়সড় চুমু খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আর তখনই কোথা থেকে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে সমুদ্র উপস্থিত হয় সেখানে। গাড়ির কাঁচে টোকার শব্দ শুনে বিরক্তিতে মুখ কালো হয়ে আসে নিরবের। রাজ্যের সকল গালি বিড়বিড় করতে করতে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ” শালা আমার প্রেমের দুশমন” বিড়বিড় করে কাঁচ নামালো নিরব।

–” ভাই তুই আসার আর সময় পেলি না।”

–” আমি কি জানতাম নাকি এখানে রোমান্টিক সিন চলছে? ”

–” ডাকলে কি জন্য? ”

–” ওহ হ্যা, আমার ভাই ভাবী কই?” সমুদ্রের এই প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল নিরব।

–” তোমার ভাই বাবী!”

–” হ্যা আপনার বোন আর আমার ভাই কোথায় গেল? বাড়ি থেকে কল আসছে দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে।”

–” ওহ হো তার মানে কি মাহি আর সাগর ভাই ইন আ রিলেশনশিপ? ”

–” আরেহ নাহ “। সমুদ্র আর কিছু বলার আগেই মাহি এসে দাঁড়ালো সেখানে।

–” ভাইয়া বাড়ি চলো।” মাহি গিয়ে পেছনের সিটে বসে গেল। নিরব কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো তখনই সাগর এলো সেখানে। সমুদ্রও কিছু বলার চেষ্টায় ছিলো তার আগেই সাগর বলল, ” গিটার নিয়ে আয় আমি বাইক বের করছি।” সাগর একটিবারও আর মাহি কিংবা নিরব কারো দিকে তাকায়নি। চুপচাপ চলে গেছে। নিরবও আর মাহিকে ঘাটে না তার চোখে পড়ছে মাহি কাঁদছে । মন খারাপ হলো মিনহারও কিন্তু আপাতত কিছুই বুঝে আসছে না নিরব আর মিনহার।

বাড়ি ফিরতেই দাদুনী ডাকলো ” নাতজামাই এনে আসো।”

–” দাদুনী, ঘামে ভেজা আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

–” আরে ফেরেশ হওন লাগবো না আগে আসো। ” বলেই হাওয়া বোগম ডাইনিং টেবিলে রাখা মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা মিষ্টি নিলেন হাতে। সাগর সামনে আসতেই একটা তার মুখের সামনে ধরলেন। বিনা বাক্যে সাগর মিষ্টি মুখে পুরতেই সমুদ্রও দাদুনীর সামনে এসে মুখ হা করলো। হাওয়া বেগম আরেকটা মিষ্টি সমুদ্রের মুখে দিতেই সমুদ্র জিজ্ঞেস করলো কিসের মিষ্টি?

–” সাগরের বিয়া ঠিক হইছে হেই মিষ্টি । ” দাদুনীর মুখের কথা মুখ থেকে বের হতেই যেন সাগর সমুদ্র দু’জনেরই মিষ্টি গলায় আটকে গেল৷ দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক সেকেন্ড নিজেকে স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা করে সোজা চলে গেল দোতলায় নিজের ঘরে। মুখের মিষ্টিটা গিলতে আর পারেনি সোজা ছোট্ট বিনটাতে উগলে দিলো। হুট করেই ওয়ালে একটা ঘুষি মেরে বাথরুমে ঢুকে গেল।

দাদুনীর সাথে কয়েকমিনিটের বাকযুদ্ধ করে সমুদ্রও চলে গেল নিজের ঘরে। তার যুদ্ধের বিষয়বস্তু ছিলো সাগরের কেন এখন বিয়ে ঠিক করা হলো। ভাইয়া এখনও জবে তেমন কোন উন্নতি করেনি। দু’একটা প্রমোশন পাক জেঠিমা আর বড় বাবাকে সেই প্রমোশনের চেহারা দেখাক পরে না হয় বউ আনবে। শিলা ভাবিকে দেখছেন কেমন ভাইয়ার সব কিছুতে একাই ভাগ বসিয়েছে৷ আসলে সমুদ্রের যুদ্ধের কারণ সাগরের উপর রাগ। সাগর মাহিকে ভালোবাসে এ ব্যাপারে সাগর কনফিউজড হলেও সমুদ্র কনফিউজড নয়। সে দূর থেকেই ভাইয়ের আচার আচরণের খোঁজ রেখেছে৷ বয়সে ছোট হওয়ায় কখনও কিছু বলে উঠতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে সাগর কেন বোঝে না নিজের মনের কথা। কেন বাড়িতে বলে না সে মাহিকে বিয়ে করবে। আর তো কিছুদিন মাহি কলেজ শেষ করতে তারপর না হয় আবার বিয়ের প্রপোজাল দেওয়া যেত। এরপরও যদি মাহির পরিবার রাজী না হতো তবে সমুদ্র কিডন্যাপ করে নিতো মাহিকে। মাহি তো রাজীই শুধু উঠিয়ে এনে বিয়ে পড়িয়ে দিলেই ঝামেলা খতম।

মাহিয়া বাড়ি ফিরে চুপচাপ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। ঘুম আসবে না আজ আর। সাগর কেন ওভাবে ডেকে নিয়ে গেল তাকে৷ কেন জানতে চাইলো ছাঁদে না আসার কারণ? তবে কি সাগরও তাকে মিস করে? ভালোবেসে ফেলেছে তাকে! কি করে সম্ভব! অন্ধকার ঘরটাতে নিজেরই নিঃশ্বাসে হাওয়া যেন ভারী হয়ে উঠছে। দমবন্ধ লাগছে তার। পাশের ঘরেই মাহিম এখনও পড়ছে। মাহির কান্না পাচ্ছে চোখ ছলছল। চিৎকার করে কাঁদার একটুও সুযোগ নেই শব্দহীন কান্নায় ভেঙে আসছে বুকটা।অঝোর শ্রাবণের মতোই ঝরছে গাল বেয়ে তপ্ত অশ্রুরা একদম নিঃশব্দে ।

কাল বিয়ের ডেইট ফিক্সড করতে যাবে সাগরের বাবা। সাথে আরো কিছু মুরুব্বি যাবেন। মাহির বাবাকেও বলা হয়েছে। যেহেতু বিয়ের প্রস্তাবটা উনার মাধ্যমেই ঠিক হয়েছে তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি থাকবেন। সাগর মেয়ের ছবি দেখেছিলো সামনাসামনি দেখেনি। তাই ঠিক হয়েছে কাল সাগরও যাবে সাথে সাগরের দু’একজন বন্ধু আর সমুদ্র। কিন্তু সমুদ্র মুখের ওপর না করে দিয়েছে। সে কালই রাজশাহী ফিরে যাবে। এসেছিলো এক সপ্তাহের ছুটি পেয়ে এখন আর থাকার ইচ্ছে নেই। হোস্টেলেই ঠিক আছে সে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here