শব্দহীন_বৃষ্টি অন্তিম_পর্ব(১ম অংশ)

0
1541

শব্দহীন_বৃষ্টি
অন্তিম_পর্ব(১ম অংশ)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
__________________________

‘হাসপাতাল’ কারো জন্য মৃত্যুপুরী কারো জন্য আনন্দপুরী হিসেবেই প্রমাণ হয়। কেউ কেউ প্রিয়জনকে নিয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে। কেউ কেউ আবার প্রিয়জনের শেষ নিঃশ্বাসের গভীর দুঃখ সঙ্গে নিয়ে ফিরে যায়।হাসপাতালের ইমার্জেন্সি কামরার সামনে ভীর জমে আছে এক বিশাল পরিবারের। যেই পরিবারের একটা মানুষও বাকি নেই হাসপাতালে আসার।সেই পরিবার আর অন্য কারো নয় শহিদুল ইসলাম এর। কাজের দু’জন লোক বাদে সাগরের পুরো পরিবার জড়ো হয়েছে হাসপাতালে। এমনকি শিলাও উপস্থিত হয়েছে তার অসুস্থ শরীর নিয়ে। তার চার মাসের প্রেহন্যান্সিতেই বেশ রকম অসুস্থতা দেখা দিয়েছে।সাথীর সাথে হওয়া এমন একটা সংবাদ শোনার পর তারও মনটা মানছিলো না দূরে থাকতে৷ মাহি হাসপাতালে সাগরের সাথেই এসেছিলো সাথীকে নিয়ে। এখন সবার একসাথে কান্নারত চেহারা দেখে নিজের মধ্যে নিজেকে সামলে নিতে পারছে না।কেমন যেন আতঙ্ক অনুভব করছে। একে একে সবাইকে দেখছে। সাথীর মা কাঁদতে কাঁদতেই জ্ঞান হারিয়েছে দু’বার। সাথীর বাবা ডুকরে কাঁদছেন সাগরের বাবাকে ধরে। পাশেই সাগরের মা হাওয়া বেগমকে সামলাচ্ছেন। বৃদ্ধা কাঁদতে গিয়ে শ্বাস নিতে পারছেন না ঠিকঠাক। সৈকতও উনাকেই চেপে ধরে আছে বাহুতে তার নিজের চোখে জল গড়াচ্ছে। শৈবাল,যুথি আর তিথি তিনজন জড়োসড়ো এক জায়গায় তাদের আঁকড়ে রেখেছে সমুদ্রের বাবা তবে উনার মুখভঙ্গি যথেষ্ট কঠিন হয়তো মনের আঘাতে মস্তিষ্কে রক্ত চড়ে গেছে। সমুদ্রের মা সাথীর মা’কে সামলে রাখার চেষ্টা করছেন শিলাও এগিয়ে এসেছে এটা দেখে মাহির মনে হলো এখন তার নিজের আতঙ্ক সরিয়ে আগানো দরকার। শিলার এই শরীরে কাউকে সামলানো সম্ভব নয় তার নিজেরই কেয়ার দরকার। মাহি দ্রুত এগিয়ে সমুদ্রের মায়ের সাথে নিজেই ধরলো সাথীর মা’কে৷ জ্ঞান ফেরেনি জয়নবের তাই ধরাধরি করে একটা খালি কেবিনে নিয়ে ডক্টর ডাকলো।ডক্টর চেক করে বলল বি পি লো হয়ে গেছে। ওদিকে সাথীর চিকিৎসা চলাকালীন এক ডক্টর ইমারজেন্সি রুম থেকে বেরিয়ে জানালো রক্ত দরকার। কিন্তু সাথীর রক্ত শুধু মাত্র সৈকতের সাথে মিলে। তাদের পুরো পরিবারে সাথী আর সৈকতের রক্তই ও পজেটিভ। সৈকত রক্ত টেস্ট করতে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল সৈকতের রক্ত নেওয়া যাবে না। কিছুদিন আগেই সে ভাইরাসজনিত জ্বরে আক্রান্ত ছিলো এমনকি এখনও সেই জ্বর তার শরীরে আছে। নার্সের মুখে কথাটা শুনতেই হাওয়া বেগম কান্নামুখেই সৈকতের গায়ে হাত দিলো। আঁতকে উঠলেন তিনি। সত্যিই সৈকতের শরীরে এখনও জ্বর৷ শিলা বেশ অবাক হলো ক’দিন ধরে আবারও সৈকতকে তার অসুস্থ মনে হয়েছিলো কিন্তু নিজের অসুস্থতা শুরু হওয়ার পর আর তা লক্ষ্য করেনি। হয়তো সৈকত ইচ্ছে করেই লুকিয়ে গেছে নিজের অসুস্থতা। হঠাৎ আবারও জয়নবের চিৎকার শোনা গেল। জ্ঞান ফিরেই আবার কাঁদছেন তিনি আর তখনি একজন ডাক্তার যাচ্ছিলেন এপাশ দিয়ে। সবেই ফিরছিলেন লাঞ্চ করে এমন চিৎকার করা কান্না শুনে একটু বিরক্ত হলেন। হসপিটালে এভাবে কান্নাকাটি করলে পেশেন্টের ওপর প্রভাব পড়ে কেন বোঝে না পরিবারের লোক গুলো? বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই করিডোরে এসে থমকে গেল ডক্টর। “মেয়েটা কি মাহি?” হ্যা মাহিই তো ভেবে আরেকটু আগালো ডক্টর আয়ান।

–” মাহি তুমি এখানে?” বলেই ডক্টর আয়ান রশীদ খেয়াল করলো মাহির পা থেকে মাথা পর্যন্ত । সাদা কলেজ ড্রেসটায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।

–” মাহি কি হয়েছে তোমার গায়ে এত রক্ত,,,,মাহি আয়ানকে থামিয়ে বলল আমার কাজিন এর সাথে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে।” কথাটা বলার সময় মাহির চোখ বেয়ে জল গড়ালো আর এই জলেই আয়ানের বুকে হঠাৎ এক ব্যাথার উদ্রেক হলো।

–” কোথায় এখন সে আর কি রকম এক্সিডেন্ট?”

–” এটেম্পট টু রেপ অর মার্ডার উই আর নট কনফার্ম।বাট শি ইজ,, বলতেই কেঁদে দিলো মাহি৷ পাশেই সাগরের বাবা আর সাথীর বাবা ছিলেন। আয়ান মাহিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল ওয়েট আমি চেক করছি।” বলেই আয়ান রিসেপশনের দিকে গেল। আবার পাঁচ মিনিট বাদে ফিরেই অপারেশন থিয়েটারের কথা বললেন নার্সদের৷ এরপর সাথীকে নিয়ে আরো ঘন্টা পার হলো অপারেশন থিয়েটারে। তারপরই ডাক্তাররা একে একে চারজন বের হলেন তার মধ্যে ডক্টর আয়ানও ছিলো। মাহি তখনও হাসপাতালেই ছিলো। সে বার কয়েক সাগরকে খুঁজেছে আশেপাশে। সবাই আছে শুধু সাগর নেই। মনের ভেতর অজানা ভয় জেগে উঠলো মাহির কোথায় গেল মানুষটা?

ডক্টর আয়ান ওটি থেকে বের হয়েই প্রথমে প্রশ্ন করলেন, ” পেশেন্টের বাবা কোথায়?” রিয়াদ সাহেব চোখ মুছে সামনে এগিয়ে এলেন তা দেখে আয়ান হালকা হেঁসে বলল, ” আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল আপনার বাচ্চাটা এখন বিপদ মুক্ত। পাশের কেবিনে সম্ভবত আপনার ওয়াইফ চেতনা হারাচ্ছেন বারবার। এখন আপনার করণীয় নিজের চোখ মুখ মুছে আপনার ওয়াইফকে জানাবেন মেয়ের অবস্থা। এবং হ্যা কান্নাকাটির আওয়াজটা যেন আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়েছে জানতে পারি।” মাহি সহ উপস্থিত সকলে একটু অবাক হলো আয়ানের কথা শুনে। কেমন যেন একটু রুড আবার একটু সফটও মনে হলো। তার ব্যবহারটা যথেষ্ট আজব লাগলেও আপাতত সবাই আল্লাহকে শুকরিয়া জানাতে ব্যস্ত৷ সাগরের বাবা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন ” রক্তের কথা বলা হয়েছিলো আমাদের তা কি জোগাড় হয়েছে?” কথাটা শুনে পাশ থেকে আরেকজন ডক্টর বলল, ” ডক্টর আয়ান এর মত আত্মীয় থাকতে আপনাদের টেনশন কিসের। রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় আয়ান নিজেই রক্ত দিয়েছেন। ”
শহিদুল ইসলাম শুনেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সাথে মনের মধ্যে কৌতুহলও জাগলো ডক্টরের কথা শুনে ” আত্মীয়”! কেমন আত্মীয় কে এই আয়ান?কিন্তু এই মুহুর্তে মনের ভয় দূর হয়েছে তাই নিজেদের মেয়েকে এক পলক দেখার জন্য উতলা তিনি।সাথীকে দেখার জন্য সবাই অস্থির হয়ে থাকলেও ডক্টর আপাতত মা আর বাবাকে পারমিশন দিয়েছেন। রিয়াদুল ইসলাম জয়নবকে নিয়ে সাথীকে শিফট করা কেবিনে নিয়ে গেলেন। ডক্টর আয়ান নিজেই আবার ফিরে এলেন। সবাই আতঙ্কে ছিলো বলেই কারো খেয়াল হয়নি জিজ্ঞেস করার সাথীর আঘাত কতটুকু বা কিরকম৷ সবাই শুধু কেঁদেকেটেই অস্থির ছিলো৷ কিন্তু মাহির কথা খেয়াল ছিলো বিধায় আয়ান আবার নিজ থেকে এসে বলল, ” এটাতো পুলিশ কেইস হওয়ার কথা। আপনারা কি পুলিশে খবর দিয়েছেন?” আয়ানের কথা শেষ হতেই পেছন থেকে সাগরের গলা শোনা গেল ” হয়েছে পুলিশ সঙ্গেই এসেছে৷” আয়ান পেছন ফিরে দেখলো সাগরকে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট গলায় কালো টাই পরিহিত এক পুরুষ। সাদা শার্টটা শুকিয়ে যাওয়া রক্তে রঙিন৷ গলার টাইয়ের বাঁধনও ঢিলা হয়ে আছে অনেকটা। শার্টের ইন খুলে আছে বেশিরভাগটাই আয়ান খেয়াল করলো লোকটা তার চেয়ে একটু সিনিয়রই হবে। এতক্ষণে মাহিও খেয়াল করলো সাগরকে৷ ফর্সা চোখ মুখ ফুলে পাহাড় হয়ে আছে। আয়ান পুলিশের সাথে কথা বলে জানালো রেপের চেষ্টা হয়েছিলো কিন্তু ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে রাগে হয়তো ইট বা ভারী কিছু দিয়ে কাঁধে আঘাত করা হয়েছে ভিক্টিমকে। আর সেই আঘাতেই মেয়েটা গুরতর আহত হয়েছে৷ পুলিশের সাথে কথা বলে জানা গেল আসামিও মারাত্মক আহত মৃত্যুর আশংকাও রয়েছে আর তাই চেয়ারম্যানও নাকি কেইস করেছে সাগরের নামে। পরিবারের এক চিন্তা কমলেও অন্য চিন্তা ঢুকে গেছে৷ সারাদিন মাহি হসপিটালেই ছিলো ডক্টর আয়ান প্রায় অনেকবারই এসে চা, কফি, খাবার সবকিছুর জন্যই ফোর্স করে গেছে। সবাই চিন্তিত থাকায় কেউ তখন ব্যাপারটা ধরেনি কিন্তু শিলা অনেকটা ফ্রী এদিক ওদিক নজর দিচ্ছিলো বলে সে খেয়াল করেছে৷

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা যখন ঘরমুখো তখন মাহিকে নিতে তার বাবা এসেছে৷ সঙ্গে এসেছিলো সাগরের হবু শ্বশুর। তিনি অবশ্য ঘটনা শুনেছেন বিকেলে বাজার করতে গিয়ে। স্কুলের কোন মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে আর কথায় কথায় জানতে পারলেন মেয়েটি নতুন আত্মীয় বাড়ির৷ তাই নিজেই মাহির বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন যাওয়া ঠিক হবে কিনা। মনজুর সাহেব প্রথমে ইতস্তত করে পরে নিয়েই এলেন। সন্ধ্যার পর মাহি বাড়ি ফিরলে তার মা’কে দেখে অবাক হয়। এতোটা চিন্তিত দেখে মনে হচ্ছিলো দূর্ঘটনাটা মাহির সাথেই হয়েছে। বিভিন্ন দোয়া,দুরুদ পড়ে মাহিকে ফুঁকে দিলেন চামেলি৷ এরপর মাহি সোজা বাথরুমে ঢুকে লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হলে চামেলি খাবার খাওয়ালেন জোর করে। মাহির গলা দিয়ে খাবার নামলো না ঠিকঠাক বারবার মনে পড়ছে সকালের ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা। যেন কেউ বারবার চোখের পর্দায় লাইভ দেখাচ্ছে। কি ভয়ানক যন্ত্রণা পেয়েছে সাথী। আর সাগর! মনে পড়তেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল মাহি। কি হিংস্র সেই দৃশ্য সাগরের চোখে মুখে হিংস্রতা যেন পুরো দুনিয়া কাঁপিয়ে তুলছিলো৷ নিহান তার জায়গা থেকে মাথাটা তোলার সুযোগ পায়নি এমন করে মারছিলো সাগর তাকে। মাহি নিজের ঘরে এসে কি মনে করে জানালার কাছে দাঁড়ালো। এই মুহুর্তে সাগরকে কোথাও দেখার প্রত্যাশা সে করে না কারণ সৈকত ভাইয়া অনেক জোর করেই তাকে বাড়ি পাঠিয়েছে কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে ফিরতে। সৈকত ভাইয়ার জ্বরটা একটু বেড়েছে তাই তারা একটা কেবিন বুক করেছে আলাদা। হঠাৎ চোখ গেল সাগরদের গেইটে৷ মনে হলো কেউ রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে ভেতরে গেল। এক মুহুর্তে মাহির মনে হলো মানুষটা সাগর। পরেই আবার মনে হলো চোখের ধোঁকা কারণ সাগর আরো একটু স্বাস্যবান। জানালা থেকে সরে যেতে নিলেই আবার চোখে পড়লো কেউ দ্রুত বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। হ্যা এখন বোঝা গেল মানুষটা সাগর নয় সমুদ্র । এই ছেলেটা সাগরের মতোই হয়েছে অনেকটা। রাজশাহী থেকে এত দ্রুত কি করে এলো সমুদ্র? প্লেনে!

আজও আকাশে চাঁদটা আছে সেই চাঁদের আলো ভূলোক থেকে দ্যুলোকে এসে আধিপত্য বিস্তার করেছে চারপাশে। এই মনোমুগ্ধকর আলোতে মনের যত কষ্ট আছে সবটাই সাগর চাইছে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিতে। কিন্তু পারছে না সে কিছুতেই৷ ছাঁদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহির মন টিকছিলে না ঘরে বারবার মনে পড়ছে সাথীর কথা সেই সময়টার কথা তাই মা বাবা নিজ কক্ষে যেতেই সে ছাঁদে চলে এসেছে। দূর থেকেই সাগরকে চোখে পড়ছে৷এগিয়ে এসে আজ প্রথমবার মাহি রেলিং টপকালো৷ কোমড় পর্যন্ত রেলিংটা টপকাতেও মাহির বেশ কসরত করতে হলো তবুও করলো ওপাশের মানুষটার জন্য । নিঃশব্দে যেতে চেয়েছিলো মাহি কিন্তু তা আর হয়নি৷ সাগরদের ছাঁদের ফুলের টবে লেগে পায়ে ব্যাথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো মাহি৷ আওয়াজ শুনে সাগর ফিরে তাকালো।

–” মাহিয়া!” অস্পষ্ট স্বরে বলল সাগর।
মাহি পা ধরে নিচে বসেছিলো তা দেখেও সাগর এগিয়ে আসেনি। কয়েক সেকেন্ড পা ধরে বসে থেকে আবার উঠে দাঁড়ালো মাহি। এগিয়ে গেল সাগরের একদম কাছে।কয়েক মিনিট মৌনতায় কাটলো দু’জনের। ভেতরে ভেতরে সাগর ভেঙেচুরে একাকার তা যেন মাহির চোখে আপনাআপনি ভেসে উঠছে। সাগর হঠাৎ মাহির মুখে তাকিয়ে বলল, ” তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না মাহিয়া। কখনো না।”

–” কিসের ঋণ?” চকিতে প্রশ্ন করলো মাহি।সাগরের গলা কান্নায় ভারী হয়ে আছে তাই কথা বলতে চেয়েও ঠিকঠাক বের করতে পারছে না মুখ থেকে৷ মাহি আবার জিজ্ঞেস করলো, ” বলুন কিসের ঋণ?”

–” আজ তুমি না দেখলে আমার বোনটাকে ওই কুত্তার বাচ্চা শেষই,,, কথা থেমে গেল সাগরের কান্না এবার চোখ মুখ ছলকে উপচে এলো। মাহি কপট রাগের সুরে বলে বসলো, ” বন্ধ করুন এই ন্যাকামির কান্না আর ঢঙের ফরমালিটি।” মাহির গলা কাঁপছে সেও কি কাঁদছে! আশ্চর্য সে তো সাগরের কান্না থামাতে চেষ্টা করছে তবে সেও কেন কাঁদবে৷ মাহি আবার বলল, আপনি কি কান্না থামাবেন? সাথী ঠিক আছে এটাই তো আমাদের কাছে বড় পাওয়া আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া৷ এখানে ঋণের কথা কেন বলছেন আমি না দেখলে কেউ না কেউ অবশ্যই দেখতো৷ আল্লাহ চেয়েছেন বিধায় এমন হয়েছে। ” মাহি বুঝদারের মত আরো কিছু বলতে চাইলেও সাগরের কান্নার স্বর কানে ঢুকছে বলেই পারছে না। বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে এই মানুষটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে৷ সাগর হঠাৎ করেই দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লো পাশেই রাখা বেঞ্চটিতে৷ দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে আর কান্নার দমকে তার সুঠাম দেহটাও বারবার কেঁপে উঠছে৷ মাহির হাত পা যেন অসাড় হয়ে গেছে বহুকষ্টে সাগরের কাঁধে হাত রাখতেই সাগর আচমকা তার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। “আর একটু দেরি হলেই আমি আমার কলিজার একটা টুকরো হারিয়ে ফেলতাম মাহিয়া। কতোটা যন্ত্রণা সহ্য করছে আমার বোন৷ আমি পারলাম না সেইফ রাখতে। কেন একটু সতর্ক থাকলাম না আমি? আমরা কলিজার তিনটা টুকরোকে আমি সারাজীবন আগলে রাখবো বলেছিলাম অথচ পারলাম না।” কান্নার মাঝে বারবারই বিড়বিড় করতে লাগলো সাগর। মাহি জানে সাগরদের বাড়িতে সাথী,যুথি আর তিথি তাদের পুরো পরিবারে একদম ননীর পুতুলের মত। বাবা,চাচা থেকে ভাইরা পর্যন্ত তাদের খুব আগলে রাখে। আর মাহি গত দেড় বছরের যাতায়াতে যতটুকু দেখেছে বোন তিনটা সাগরের কাছে একদম অমূল্য রতনের মতন। মাহি সাগরের অবস্থা বুঝে এক চুল ও নড়লো না নিজ জায়গা থেকে যতক্ষণ না সাগর নিজে থেকে তাকে ছাড়ছিলো। সাগরেরও হুঁশ ছিলো না কান্নায় ভেঙে সে মাহিকে জড়িয়ে ধরেছিলো৷ যখন খেয়াল হয়েছিলো তখন আর এক মুহুর্ত দেরি না করে সোজা ছাঁদ থেকে নেমে গিয়েছিলে। আর মাহি! সে তো চাঁদের আলোয় ঘেরা নিস্তব্ধ ছাঁদটায় বেশ কিছু সময় থমকে দাঁড়িয়ে ছিলো। কতক্ষণ ছিলো তার জানা নেই শুধু বারবার পেটের কাছে জামাটা ছুঁয়ে দেখছিলো। সাগরের চোখের পানিতে ভেজা জামার এই অংশটুকু।
টানা পাঁচদিন সাথীকে হাসপাতালে রাখা হয়েছিলো৷ কাঁধের ঘা একটু টানটান হতেই ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু কাউন্সিলিং চলেছে পুরো দশদিন। সাথীর বয়স খুবই কম সেই তুলনায় মেন্টাল ট্রমা অনেক বেশি তাই ডক্টর কাউন্সিলিং এর কথা জানালে ডক্টর আয়ান রশীদ নিজের পরিচিত এক লেডি ডক্টরকে কনসাল্ট করেন। মানসিক দিক দিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হতে হতে কাঁধের ঘা প্রায় সেরেই গিয়েছে সাথীর। স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি এখনও তার উপর সাগরকে কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে অনেক৷ নিহান এ পর্যায়ে বেঁচে গেলেও তার সারাজীবনের সুস্থ জীবন আর স্বাভাবিক নেই। বুকের ভেতর চোট কম লাগলেও মাথার চোট অনেক ছিলো। তাই তার আচরণ স্বাভাবিক লাগছে না। ডক্টর জানিয়েছে আঘাতটা ব্রেন পর্যন্ত আর এটা রিকোভার হওয়ার চেয়ে পরবর্তীতে আরো বেশি ড্যামেজ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এক প্রকার মৃতের মত জীবিত বলা যায় তাকে। কোর্টে সাগর সম্পূর্ণ সত্যি স্টেটমেন্ট দিয়েছিলো আর বেদম মেরেছে নিহানকে সেটাও স্বীকার করেছিলো।সাগরের শাস্তি হওয়ার কথা ভেবে তার পুরো পরিবারই ভেঙে পড়েছিলো কিন্তু এখানেও আল্লাহর কৃপায় সাগরের কোন শাস্তিই হয়নি। তবে হ্যা জরিমানা হয়েছিলো তিন লাখ টাকার। কারণ যে এলাকায় সাথীকে নিহান আটকেছিলো সেখানকার স্থানীয়রা স্বাক্ষী দিয়েছিলো যা ঘটেছে সবটা নিহানের আক্রমণের কারণে। নিজের বোনকে বাঁচাতেই সাগর নিহানকে মেরেছিলো। কোর্ট আবেগের মূল্য দেয় না এখানেও তাই হচ্ছিলো। তাই সাগরের জেল মাফ হলেও জরিমানা করা হয়েছিলো। সাধারণ মানুষ মুখে মুখে বলে উঠলো আইন কানুন শুধু নামের নয়তো আসামীর জন্যও কেন জরিমানা?

মাস দুই কেটে গেছে সাথীর সাথে ঘটে যাওয়ার ঘটনার। সাগরের বিয়ের ডেট ছিলো এক মাস পরেই। কিন্তু সাথীর অবস্থা আর সবার মনের অবস্থা বিচার করে কনেপক্ষ নিজেই ডেইট পিছিয়েছে আরো এক মাস। দুই মাসে সাথী প্রায় একদম সুস্থ হয়ে উঠেছে। যদিও মানসিক আঘাত এখনও অনেকটা তাজা। সবাই ভাবলো হয়তো বাড়ির মহল চেঞ্জ হলেও সাথীর জন্য ভালো হয়৷
গত দু’মাসে মাহি না পারতেই সাগরের চোখে পড়েছে। সেটাও শুধু কলেজ যাওয়ার সময় রাস্তায় কিংবা রিকশায়। এছাড়া সাগর আর মাহিকে দেখেনি। দেখতে চেষ্টা করেনি এমন নয় সাগর প্রতিনিয়ত খুঁজেছে মাহিকে৷ মন থেকে চেয়েছে মাহিকে দেখার দোয়া। কবুল হয়নি। তার ফিয়ন্সি সুরমা অনেকদিন অপেক্ষা করে একদিন হুট করে নিজেই কল দিয়েছে সাগরকে৷ সাগরকে মেয়েটির নাম্বার অনেকদিন আগেই দিয়েছিলো শিলা। বলেছিলো, ” হবু বউয়ের সাথে একটু কথা বলে নিও। নয়তো বিয়ের পরপরই ইজি হতে পারবে না দু’জন।” সাগর নাম্বারটা সেইভও করেছিলে কিন্তু সময় আর সুযোগের অভাবে আর কল করে নি। বলা যায় সময়, সুযোগ বাহানা মন থেকে তাগিদই পায়নি সে। মেয়েটা যেদিন কল করেছিলো সেদিনই হাজারটা অভিযোগ করে বলেছিলো বিয়ের আগেই এমন দ্বায়িত্ব জ্ঞানহীন বিয়ের পর কেমন হবে! সাগর প্রতিউত্তর করেনি৷ ক্ষণে ক্ষণে শুধু মনে হয়েছে এই বিয়েটা হলে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না৷ তার সমস্ত সত্তা জুড়ে তো ওই বাচ্চা নেয়েটির বিচরণ। কি করে সে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে৷ মাহি কি আর একটি বার এসে জেদ ধরতে পারে না? বলতে পারে না আপনি এই বিয়েটা করবেন না। সাগরের জীবন বাঁধাধরা নিয়মে কেটে যাচ্ছে মনের আর্তনাদ মনেই থেকে যাচ্ছে৷ শব্দহীন বৃষ্টি অনবরত মনের চোখে ঝড়ছে। কেউ দেখার নেই তার সঙ্গে কেউ ভেজার নেই বৃষ্টিতে৷ শুধু আছে বুক ভরা হাহাকার আর প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস। দেখতে দেখতে এসে গেছে গায়ে হলুদের রাত। আজ ছাঁদেই আলোক রশ্মিতে সাজিয়ে ছোট্ট করে হলুদের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। ছাঁদ ভর্তি সাগরদের আত্মীয়রা। সেই আত্মীয়ের মাঝে দোলাও উপস্থিত তার সাথে এসেছে দোলার অস্টেলিয়ান বয়ফ্রেন্ড নিক৷ স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ যেতেই তার এক হালি বয়ফ্রেন্ড হয়েছে আর এই নিক তার বর্তমান বয়ফ্রেন্ড। অনুষ্ঠান ছোট করে হলেও সাগরের বন্ধুরা প্রায় সবাই উপস্থিত৷ তামিমও উপস্থিত আর তামিমের কারণেই নিপা জানতে পেরেছে সাগরের বিয়ের কথা। নিপার খুব কান্না পাচ্ছিলো শুনেই। তার মত কি তার বেস্ট ফ্রেন্ডও নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলল! নিপা নিজেকে সামলাতে না পেরেই ফোন করেছিলো মাহিকে। কিন্তু কি আশ্চর্য মাহি একদম স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে৷

হলুদ ফাংশন শুরু হতেই সাগর কেমন হাসফাস করতে লাগলো। প্রথমেই সাগরের বাবা আর মা তাকে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়েছে৷ তারপর চাচা চাচীরা এরপরই সৈকত কিন্তু শিলা দেয় নি হাওয়া বেগম বলেছেন “পোয়াতি মাইয়াগো হলুদ মেন্দি দরন লাগে না” ব্যস বাড়ির বড়রা আর তাকে হলুদ ছুঁতে দেয়নি৷ সমুদ্র এক দিন আগ পর্যন্তও মুখ ফুলিয়ে ছিলে এই বিয়ে নিয়ে। সময় করে একবার সাগরের সাথে তুমুল বন্ধদরজা যুদ্ধও করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাগরের কাছ থেকে একটা জবাব পেয়ে চুপচাপ ঘরে থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। সাগরের জবাব ছিলো, ” যার কথা ভেবে তুই আমার সাথে লড়ছিস তাকে গিয়ে একটিবার জিজ্ঞেস করে দেখিস তো সে আমায় আদৌও ভালোবাসে কিনা? আই সোয়্যার সে একটিবার বলুক বাসে আমি এই মুহুর্তে তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবো। পৃথিবীর প্রত্যেকটা বাঁধা অতিক্রম করেই তাকে আপন করে আনবো।”

চলবে
(আর একটু বাদ পড়ে গেল। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here