শব্দহীন_বৃষ্টি অন্তিম_পর্ব(শেষাংশ)

0
2240

শব্দহীন_বৃষ্টি
অন্তিম_পর্ব(শেষাংশ)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
_________________________
প্রেমের বর্ষন হয়নি তার আগেই বিরহ বর্ষন দু’জন মানুষের জীবনে। পাশাপাশি দু’টি ছাঁদ কত অন্ধকারময় রাতের স্বাক্ষী ওই দু’টি মানুষের হতে হতে না হওয়ার প্রেমের৷ আজ সেই দু’টো ছাঁদের একটিতে বিয়ের ছন্দ অন্যটিতে ঘোর বিরহবাতাস। মাহি সেই বিরহবাতাসে এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার আলোকসজ্জিত ছাঁদটিতে। চামেলি বার কয়েক ডেকে গেছে মেয়েকে হলুদে যাওয়ার জন্য মাহি বলেছে তার শরীরটা ভালো নেই যেতে পারবে না। তাই মাহিম আর চামেলি চলে গেছে। মনজুর সাহেব অফিস থেকে ফিরে পরেই যাবেন। মা আর ভাই বের হয়ে যেতেই সে গুটি গুটি পায়ে ছাঁদের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। উত্তর দক্ষিণ মুখী স্টেজ হওয়ায় মাহিদের পূর্বদিকে থাকা ছাঁদের দরজা থেকে সাগরের একপাশই চোখে পড়ছে। কাঁঠাল রঙা পাঞ্জাবী ফর্সা মুখে কি সুন্দর মানিয়েছে। এই মানুষটাই আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে অন্যকারো জীবনের আলো হয়ে আলোকিত করবে তাকে।হয়ে যাবে অন্যকারো ঠোঁটের হাসি, হৃদয়ের অস্তিত্ব ভাবতেই মাহির বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল।গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জলের ধারা। তার আশেপাশের অন্ধকার গাঢ় হয়েই আঁকড়ে ধরলো তাকে। সাগরকে দেখতে বেহায়া মনটা বারবার উড়ে চলে যেতে চাইছে তার কাছে। একপাশ থেকে একটু একটু দেখতে গিয়েও ঠিকঠাক দেখতে পারছে না কেউ না কেউ এসে তার পাশেই বসছে।বাঁধ ভাঙা নদীর দু’কূল যেভাবে উপচে আসে জলের ধারা ঠিক সেভাবেই মাহির দু’চোখের ধারা বেয়ে যাচ্ছে। সাগর চুপচাপ বসে আছে একে একে সবাই তাকে হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাহির পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব এলো না তাই এলোমেলো পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ঘরময় মাহির কান্নার আওয়াজ।

সমুদ্র রেগেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো এখনও ফেরেনি। এতে অবশ্য বাড়ির কারো কোন মাথাব্যথা নেই শুধু সাগর ছাড়া। সে চুপচাপ হলুদ গায়ে মাখছে যেভাবে যে চাইছে শুধু মন বারবার অশান্ত হয়ে তাকে ভেতরে ভেতরে উন্মাদ করে দিচ্ছে । গত একটা মাস ধরে অপেক্ষা করে গেছে মাহি যেন একটাবার তাকে বলে, ” আমি ভালোবাসি আপনাকে।কেন আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করবেন?” কিন্তু না এই মাহি আর তার দেখা আগের মাহিতে আকাশসম তফাৎ। চরম বেয়াদব চঞ্চল মাহি হারিয়ে গেছে কোথাও। কত কত বিকেল,সন্ধ্যা রাত সাগর অপেক্ষা করেছে মাহিকে একটু দেখার জন্য মাহি আসেনি। ওই ছাঁদেই তাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো আজও মনে প্রাণে চাইছে একটু দেখা হোক। হোক সেটা শেষ দেখা তবুও হোক। সাগর আড়চোখে তাকাচ্ছে পাশের ছাঁদটিতে হয়তো মাহি আসবে৷ সাথীকে আজ একটু উৎফুল্ল লাগছে সেজেগুজে ছাঁদেই বসে আছে সাগরের পাশে। তার হাতেই সাগরের ফোনটা। হঠাৎ বেজে উঠতেই সাথী এগিয়ে দিলো, ” ভাইয়া তোমার ফোন বাজছে।” সাগর মোবাইলটা হাতে নিয়ে চমকে গেছে অচেনা নম্বর দেখে। কলটা কি মাহি করছে! দ্রুত কল রিসিভ করে কানে লাগাতেই সাগরের মন ভেঙে গেছে। সুরমা ফোন করেছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে মেয়েটার সাথে তবে প্রত্যেকবারই কোন না কোনভাবে বাধ্য হয়ে। মেয়েটা বড় অধৈর্য্য আর রুঢ় স্বভাবের৷ অহংকারীও কিছুটা ঠিক শিলা ভাবীর বোন দেলার মত। সাগরের তেমনই মনে হয়েছে আবার হতে পারে তার মাহি নামের চঞ্চল হরিণীতে তার মনটা আটকা বলে ওই মেয়েটির এত খুঁত চোখে পড়েছে মেয়েটি এতোটাও অপছন্দনীয় হবার নয়। দু’চার কথা বলেই সাগর কল কেটে দিয়েছে। মোবাইলটা আবারও সাথীর দিকে এগিয়ে দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীণে সমুদ্রের নামটা ভেসে উঠেছে। রিসিভ করে কানে লাগিয়ে ঠিক দুই মিনিট চৌত্রিশ সেকেন্ড চুপ ছিলো সাগর এরপরই বসা থেকে উঠে কোন দিকে না তাকিয়েই সোজা বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। তার চলে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ভেসে আসছিলো অনেক গুলো কন্ঠস্বর। সবগুলো কন্ঠস্বরে উচ্চারিত হচ্ছিলো একই ধ্বনি, ” কোথায় যাচ্ছিস সাগর”? আকাশে তখন মেঘের গর্জন থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছিলো হয়তো কিছুক্ষণেই আবার বৃষ্টি শুরু হবে ।

রাত একটা, মাহি বসে আছে শিলার বেড রুমে। মাঝারি সাইজের ফোলা পেট নিয়েও শিলা সাজাচ্ছে মাহিকে। দোলা আর সাথীর মা মিলে একটু আগেই গোলাপি রঙের একটা জামদানি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। মাহির গোলগাল মুখটাতে মেকাপের ছোঁয়া দেবে না দেবে না করেও একটু দিয়েই দিলো শিলা। অনেক ভেবে স্টেজ থেকে খুলে দু’টো গোলাপি জারবেরা এনে খোঁপায় লাগিয়ে দিয়েছে৷ গোলাপি লিপস্টিক আর মোটা করে কাজল ব্যস এটুকুতেই নতুন বউয়ের সাজ পূর্ণ। সাথী,যুথি কাছ ঘেঁষে বসে আছে মাহির শুধু তিথিই গিয়ে বসে আছে সাগরের কোলে গলা জড়িয়ে। সাথে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার বর মশাই কেন মাহিপুকে বিয়ে করলো এখনতো মাহিপুও তার চকলেট অর্ধেক নিয়ে যাবে। দাদুনী বলেছে বরের সব জিনিস নাকি বউয়ের হয়ে যায় তবে মাহিপুও বর মশাইয়ের পকেটে থাকা সব চকলেট নিয়ে নিবে। সেই থেকেই কান্না আর সাগর ছটফট করছে এক বউকে সামলে অন্য বউকেও দেখতে হবে আজ তার বাসর বলে কথা।

কয়েক ঘন্টা আগে,,

সাগরের ফোনে সমুদ্রের নম্বর থেকে কল এলে সাগর ফোন কানে ঠেকিয়ে নির্বাক হয়ে যায়। কারণ ওপাশ থেকে ভেসে আসছিলো মাহির কান্নামাখা কন্ঠ । বারবার বলছিলো, ” কেন সে বুঝলো না আমার ভালোবাসা? কোথায় কমতি ছিলো একটা বার বললো না কেন আমায় ভালোবাসে। আমি তো বলেছি গত দু’টো বছরে ক্ষণে ক্ষণে জানান দিয়েছিলাম আমার অনুভূতি। আমার সবটা জুড়েই তো তার বসবাস।তার কি অজানা সেই কথা! সত্যি বলতে সে ভালোবাসে না আমায় আমিই তো যেচে পড়ে পেছনে পরেছিলাম তার। বেহায়া বেয়াদব মানুষ আমি আমার কি যোগ্যতা তার পাশে দাঁড়াবার? সঠিক মানুষ পেয়ে গেছে সে,,, বলেই কান্না ভেঙে পড়েছিলো মাহি। সেই কান্না সাগরের মনের শক্ত পরত উঠিয়ে বাধ্য করেছিলো হলুদের আসর ছাড়তে। তখনই স্টেজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলো সে৷ কয়েক সেকেন্ডেই নিজের বাড়ির গেইট পেরিয়ে প্রবেশ করেছিলো মাহিদের বাড়ি। মাহি তখনও কান্নায় পড়েছিলো ড্রয়িংরুমের এক কোণায়। সমুদ্র চলে গেছে কল মাহিকে কান্নায় রেখেই তারও যে বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো নিজের ভাই আর বান্ধুবীটির জন্য । মনে পড়েছিলো নিপার বিয়ের দিন তাকে বলা কথা গুলো।ভালোবাসা মানুষগুলোর কষ্ট সে উপলব্ধি করতে শিখেছে সেদিন থেকেই আর তাইতো সাগরের বলা অভিমানভরা অভিযোগ গুলো শুনে বেরিয়ে গিয়েছিলো বাড়ি থেকে। যোগাযোগ করেছিলো নিরবের সাথে আর দু’জনেই কথা বলে বুঝতে পেরেছিলো সাগর মাহির ভালোবাসায় বাঁধা কোথায়। “দ্বিধা” হ্যা দ্বিধায় পড়েই দু’জন দু’জনের ভালোবাসা অনুভব করতে পারেনি। মাহি দ্বিধায় ছিলো সাগর তাকে ভালোবাসে কিনা? আর সাগরও দ্বিধায় ছিলো মাহির ভালোবাসা সত্যিই যদি হয় তবে শেষবারের মত কেন চাইছে না তাকে। বাধ্য হয়েই সমুদ্রকে আসতে হলো মাহির কাছে। উষ্কেছিলো খুব মাহির মুখ থেকে সাগরের প্রতি অভিমানের সিন্দুক খুলতে৷ কাজে দিয়েছিলো সমুদ্রের বলা তাচ্ছিল্য ভরা কথা গুলো। আর তাতেই মাহি রাগে ক্ষোভে বলতে শুরু করেছিলো সাগর কেন তাকে বলেনি ভালোবাসার কথা। বুদ্ধি করেই তখন সমুদ্র কল দিয়েছিলো সাগরকে যেন শুনতে পায় সে মাহির অভিমান আর অভিযোগ মিশ্রিত সকল উক্তি। সাগর কল কাটতেই সমুদ্র বেরিয়ে গিয়েছিলো মাহিদের বাড়ি থেকে অপেক্ষা করেছে সাগরের পরবর্তী পদক্ষেপ এর৷ নিরব আর সমুদ্র সফল হয়েছে তাদের কাজে সাগর এসেছে মাহির কাছে তবে তারা ততোটাও আশা করেনি যতোটা সাগর করেছিলো। সাগর ক্ষুব্ধ চেহারায় দোতলায় উঠেই মাহিকে দেখেছিলো ফ্লোরে বসে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে৷ দিকদিশা ভুলে সাগর মাহির কাছে এসেই হ্যাচকা টানে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে মাহি কিছু বুঝে উঠার আগেই কষে তার গালে এক চড় বসিয়েছিলো।কি হচ্ছে কেন হচ্ছে তা বোঝার আগেই সাগর অগ্নিমূর্তি হয়ে বলেছিলো ” চল আমার সাথে।” কোথায়,কেন কিছুই বলেনি৷ বাহিরে তখন বজ্রপাত সাথে রিমঝিম শ্বদে বৃষ্টি হচ্ছিলো তুমুল। থাপ্পড়ের আঘাতের চেয়ে চমকটাই চেয়ে বেশি লেগেছিলো তার। কয়েক সেকেন্ড থ হয়ে শুধু সাগরকে দেখছিলো সেই মুহুর্তেও সাগরের এলোমেলো চুল গুলো মাহির চোখে বাঁধছিলো খুব। সাগর চোয়াল শক্ত করে দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেছিলো “চল আমার সাথে”। মাহির কি হলো কে জানে সেও তখন রাগী কন্ঠে বলেছিলো, “কোথায় যাবো আপনার সাথে? আপনি এখানে কেন এসেছেন বেরিয়ে যান,,, দরজা দেখিয়ে হাত উঠিয়ে ইশারা করতেই যাচ্ছিলো কি সাগর দৈত্যের আরো এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিলো তার গালে। আর সেই থাপ্পড়েই মাহি জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে সাগরের বুকে। মাহির যখন জ্ঞান ফিরে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে এক বদ্ধরুমে। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই ভয়ে চুপসে যায়। তার মাথা সাগরের কাঁধে পাশেই বসে আছে নিরব। সামনে একটা টেবিল। মুখোমুখি বসা এক মধ্যবয়স্ক লোক। ঘাড় উঠিয়ে পাশে তাকাতেই আবার চমকায় মাহি নিরব বসে আছে সাথে সমুদ্র । একপাশে ডক্টর আয়ান তার পাশেই তমাল।

–” সবাইকে দেখা শেষ হলে বল আমার খুব ঘুম পাচ্ছে বাড়ি ফিরবো।” হঠাৎ কানে এলো নিপা কন্ঠ। মাহি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো নিপাও আছে এখানে। চমকের পালা শেষ হয়নি মাহি তার আগেই সামনে বসা লেকটি বলল, ” বিয়ের কাজ শুরু করি?” আঁতকে উঠে মাহি “বিয়ে”! কথাটা বলেই আঁড়চোখে সাগরের দিকে তাকায়। সাগরের মধ্যে কোন হেলদোল না পেয়ে মাহি কাচুমাচু করেই বলল ” কার বিয়ে”!

–” আমার বিয়ে এই যে দেখ সমুদ্র কে তুলে নিয়ে এসেছি। ” বলেই হে হে করে হেঁসে উঠলো নিপা। কথাটা মজার ছলে বললেও তমাল ঠিকই চোখ পাকিয়ে তাকালো। থতমত খেয়ে নিপা বলল, ” মজা করছি গো এভাবে তাকাও ক্যান?” সমুদ্র আর নিরব হেঁসে ফেলল নিপার মুখ দেখে। নিপা আবার বলল, ” তোর আর সাগর ভাইয়ার বিয়ে। এবার চুপচাপ ফরমালিটি পুরণ কর বাড়ি গিয়ে আবার শরীয়ত মোতাবেকও বিয়ে হবে। আজ রাত বোধ হয় আমার সাধের ঘুম গচ্ছা গেল আজকের মত”।

মাহি তেমন কিছু না বুঝলেও চুপচাপ বিয়েটা সেরে নিয়েছে মাঝে একবার অবশ্য বলেছিলো আব্বুর সাথে কথা বলবো। নিরব জানালো তার আব্বু আম্মু এমনকি সাগরের পুরো পরিবারই রাজী আছে৷ বিয়ের রেজিস্ট্রিতে বয়স নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিলো। মাহির আঠারো বছর পূর্ণ হতে এখনও তিনমাস বাকি তাই আপাতত মিথ্যে তারিখ দিয়েই বিয়ে। বাড়ি ফিরতেই আরেক দফা বিয়ে হলো। এসবেই রাত কেটেছে অর্ধেকটা। হুট করেই শিলা বললো, ” দেবরে বিয়ে হলো বাসর হবে না এ কেমন কথা!” ব্যস আরেক দফা শুরু হলো আয়োজন বাসরঘর সাথে বউ সাজানো।সমুদ্র আর নিরবের কাঁধে বাসরঘরের দ্বায়িত্ব দোলা আর সাথী নিলো বউ সাজানোর দ্বায়িত্ব। শেষ পর্যন্ত বড় জা হিসেবে শিলাও পিছিয়ে নেই। শুধু থাকতে পারেনি নিপা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। ওহ, বলতে ভুলে গেছি সাগরের হবু বউটা সন্ধ্যায়ই নাকি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে বয়ফ্রেন্ড এর সাথে। সাগরকে নাকি তার খুব পছন্দ হয়েছে কিন্তু তার বয়ফ্রেন্ড টাকার কুমির তাই সাগরের চার্মও তাকে আটকাতে পারেনি।

মাহিকে নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো সাগরের ঘরে। তিথিকে খুব বুঝিয়ে রেখে তবেই সাগর এসেছে নিজের ঘরে কিন্তু ঘরে এসে সাগর থ বউ পালিয়েছে। তন্ন তন্ন করে সবাই পুরো বাড়ি খুঁজেও মাহির দেখা পায় নি। প্রায় আধঘন্টা পর মাহিকে দেখা গেল ছাঁদ থেকে নামতে। জিজ্ঞেস করতেই বলল, আমার ঘরে একটু কাজ ছিলে। তাই ছাঁদ দিয়েই গিয়েছিলাম।” হাওয়া বেগম চোখ দু’টো রসগোল্লার মত করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ” রেলিং টপকাইয়া গেছিলি?”

–” হ্যা”। সাগর আরেক দফা চমকালো। শাড়ি পড়ে এই মেয়ে রেলিং টপকে ও বাড়ি গিয়েছিলো! এরপর আর কেউ কোন প্রশ্ন করেনি৷ চুপচাপ ঘরে গিয়েছিলো সাগর পিছু পিছু মাহিও। ঘরে ঢুকে দরজা দিতে খেয়াল ছিলো না সাগর আর মাহির। সাগর গম্ভীর মুখে বসেছিলো চেয়ারে। মাহি খাটের উপর পা উঠিয়ে বসতে বসতেই বলল, ” জোর করে বিয়েটা করেই ফেললেন!”

–” হ্যা ” সাগর ছোট্ট করে জবাব দিলো।

–” আজ না আপনার হলুদ ছিলো কাজটা কি ঠিক করলেন?”

— ” আমি কোন কাজটা ঠিক করবো কোনটা ভুল করবো তার কৈফিয়ত তোমাকে দেবো না।”

–” বললেই হলো! আমি আপনার বউ না?”

–” তো!”

–” আচ্ছা আজ তো আমাদের বাসর রাত আমার গিফট কোথায়?” মাহি বেশ উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলো।

–” কিসের গিফট?” সাগর ভ্রু কুঁচকালো।

–” বাসর রাতে বউকে গিফট দিতে হয় জানে না?”

–” আমি কোন গিফট দিবো না। রাত অনেক হয়েছে চুপচাপ ঘুমাও।”

–” হায় আল্লাহ কি কিপটা স্বামী কপালে জুটলো গো একটা গিফটও দিবো না।” একটু উচ্চস্বরেই বলল মাহি। সাগর যারপরনাই হতাশ হয়ে বসা থেকে উঠে মাহির কাছে আসলো।

–” এই কি করছো মাহিয়া। এভাবে চেঁচালে সবাই কি ভাববে। আমার কাছে কিছু মেই এই মুহুর্তে কাল এনে দেবো গিফট।” মাহি মানলো না সে আবারো চেঁচানোর সুরেই বিলাপ জুড়লো তার গিফট লাগবে। সাগর না পেরে বলল, ” আমার ঘরে এই মুহুর্তে নতুন দু’টো সেন্ট এর বোতল আছে আর একটা শার্ট আছে। তোমার তো শার্ট লাগবে না সেন্ট এর বোতল দু’টোই রাখো। মাহি বলল না তা চলবে না। এরপর নিজেই আবার একটু ঢঙ করে বলল, ” আচ্ছা শুনুন না আপনার ঘরে আরো একটা জিনিস আছে।” সাগর বিষ্ময়ে তাকালো, ” আমার ঘরে গিফট দেওয়ার মত আর কি আছে?”

–” খুব সুন্দর একটা জিনিস যা ঠিক আপনার মতোই সুন্দর। ”

–” কি সেটা?”

–” একটা গোলাপি রঙের,,, ” আর কিছু বলার আগেই সাগর আতঙ্কিত হলো। মাহি কি তবে সেই গোলাপি ডায়েরিটা চাইছে। তার স্বপ্নকুমারীর ডায়েরিটা! সাগরের এক অজানা অনুভূতিতে ঘেরা সেই ডায়েরি। মাহিকে সে ভুল করেও সেটা দিবে না।

–” আমার কাছে কিছুই নেই তেমন। ” ফট করে কথাটা বলেই সাগর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো। মাহি আটকে দিলো তাকে। হাতটা আলতো করে ধরে খুব কাছে এলো সাগরের। লম্বায় তার কাঁধ অব্ধি যেতে না পারলেও বুকের খুব কাছে মুখটা এনে খামচে ধরলো সাগরের শার্ট আর ধীর স্বরে বলল, ” কত আকাঙ্খিত রাত এটা আমার তা কি আমার সাদা টি-শার্ট ভাইয়া জানে?” মাহির বলা ফিসফিসানি সুর সাগরকে হঠাৎ মাতাল করে তুলল।এক মোহনীয় আবেশ ছড়িয়ে পড়লো যেন চারপাশে। কি সুন্দর মাতাল করা ঘ্রাণ পাচ্ছে সে মাহির শরীর থেকে৷ এ কেমন অনুভূতি হচ্ছে যা তার ভেতরে শিহরণ জাগাচ্ছে। মুহুর্তেই নিজের সকল শক্তি হারিয়ে নিজেকে অসাড় লাগছে তার। মাহি আরো একটু এগিয়ে এসে তার বুকে শার্টের উপর দিয়েই ঠোট ছোঁয়ালো। সাগরের মনে হলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাচ্চাটির এসব কর্মকান্ডে সে নিজের হুঁশ হারাবে। মাহি আবার বলল, ” দিন না সেই গোলাপি,, এবার যেন সাগরের হুঁশ ফিরে এলো। মাহি তাকে উন্মাদ করার চেষ্টা চালাচ্ছে সেই ডায়েরিটার জন্যই।

–” ছাড়ো আমায়। তোমার ষড়যন্ত্রে আমি পা দেবো না।”

–” তওবা তওবা স্বামী আপনি এগুলো কি বলছেন। হায় আল্লাহ আমি কি এসব শোনার জন্যই এই লোকটাকে এত ভালেবেসেছিলাম! পোড়া কপাল আমার আল্লাহ তুলে নাও আমায় আমি আর বাঁচতে চাই না”। আবার আর্তনাদের ঝড় তুলল মাহি। সাগর বেশ বুঝতে পারছে মাহি সেই ডায়েরিটার জন্যই নাটক করছে। সন্ধ্যে পর্যন্ত যে মেয়ে তার বিরহে পাগলপারা এই মধ্য রাতেই সেই মেয়ে তাকে বোকা বানানোর পায়তারা করছে তা ভেবে সাগর বলল,
“শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবে না, ভেজা কথা বলে মুড়ি ভেজানোর চেষ্টা কেন করছো?”

–“এই শুনুন, আগে ঠিক করুন প্রবাদ কি বলবেন? খালি মুখে চিড়ে ভিজে না এমন হবে কথাটা”।

“ইশ রে আমার বরের মাথাটা এই মেয়ে খেয়েই ফেলবে গো আল্লাহ “। কপালে হাত রেখে তিথি বলতেই দু’জনের চোখ কপালে। কি বলে এই সাত বছরের পুচকি মেয়ে! সাগর – মাহি দু’জনেরই এবার খেয়াল হলো এতক্ষণ ধরে তারা দরজা খোলা রেখেই তর্কবিতর্ক চালাচ্ছিলো। বাইরে থেকে খিলখিলিয়ে হাসির শব্দও আসছে। সাগর তিথিকে খপ করে ধরে বলল, ” বউ তুই তো ঘুমাচ্ছিলি এখানে কি করে এলি?”

–” ইশ, আমি ঘুমাই নি মাহিপু নাকি এখানে থাকবে আমিও থাকবো।” তিথির কথা শুনে মাহির সেকি হাসি৷ সাগর কটমট করে তাকাচ্ছিলো তার দিকে। বাহির থেকে হাসির শব্দ একটু বেশিই আসছিলো বলে সাগর তিথিকে কোলে উঠিয়ে বাহির হতেই থমকে গেল। দরজার সামনে নিরব, সমুদ্র,সাথী,দোলা,শিলা এমনকি সৈকতও দাড়িয়ে আছে। সাগরের খুব রাগ হলো ভাবী আর সমুদ্র ছিলো তো ছিলো শেষে কিনা সৈকত ভাইয়া আর নিরবও তাদের বাসর ঘরে কান পেতেছে!

–” ছিহ, বড় ভাই হয়ে ছোটদের বাসর ঘরে উঁকি মারছো তোমরা লজ্জা করে না”! সাগরের কথায় সৈকত মুখটা পানসে করে চলে যেতে উদ্যত হলো কিন্তু নিরব মুখ ফসকে বলে ফেলল, ” কি করবো কথা ছিলো এ মাসে বিয়ে করে বউ নিয়ে আমি রোম্যান্স করবো সেখানে কিনা আমি এখনো কুমার রয়ে গেলাম আর পিচ্চি বোনকে বিয়ে দিয়ে তাদের বাসরঘর সাজাই তাই! আর সাগর ভাই আপনার কি কপাল হলুদ লাগাতে বসে বাসরে চলে এসেছেন৷ হলুদ সন্ধ্যা করে সোজা বাসর রাত! দিস ইজ নট ফেয়ার।” কথাটা বলেই দাতে জ্বিভ কাটলো।ছিহ, ছোটো বোনের জামাইকে জোশের ঠেলায় কি থেকে কি বলে ফেলল।শিলা কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, ” তিথি আসো তোমাকে চাচী কখন থেকে খুঁজছে কই গো নাও তিথিকে আমি গেলাম” কথাটা সৈকতকে উদ্দেশ্য করে বলেই শিলা পগারপার। সমুদ্র আর সাথী ততক্ষণে চুপচাপ জায়াগা ছেড়ে পালিয়েছে। সৈকত তিথিকে নিয়ে যেতেই নিরবও গেল। সাগর আশপাশ ভালো করে দেখে আবার ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। মাহি তখন সাগরের আলামরি তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজছে।আলমারির সকল কাপড় এলোমেলো করে ফেলেছে।
–” কি খুঁজছো”
–” আপনার সেই গেলাপি ধন।”
–” কেন চাইছো সেটা”?
–” আগে দিন তারপর বলবো।” সাগরের কেন যেন মনে হলো আজ আর তার স্বপ্নকুমারীকে লুকিয়ে রাখার দরকার নেই তার চঞ্চল হরিণীটাই তার জীবনে অমূল্যরতন। তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে খাটের ওপরে ওয়ালে থাকা তার ছবির নিচ থেকে চাবিটা বের করে আলমারিতে থাকা ছোট্র ড্রয়ারটি খুলল। খুব সযত্নে রাখা সেই গোলাপি ডায়েরিটা বের করে চুপচাপ এগিয়ে দিলো মাহির দিকে৷ প্রায় দু’বছর আগে পাওয়া এই ডায়েরিটি কখনও খোলার চেষ্টা করেনি সে। মনে প্রাণে চেয়েছিলো এই ডায়েরিতে থাকা আধ চেহারার ছবির মালিকটিকে যেন খুঁজে পায় সে। কিন্তু তাকে আর পাওয়া হবে না ভেবে লকটি ইচ্ছে করেই খোলেনি৷ মাহির মোহে আটকে সাগর প্রায়ই ভাবতো ডায়েরিটি ফেলে দিবে সেখানে যেখান থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে কেন জানি ফেলে দেওয়াও হয়ে উঠেনি৷ আজ মাহির হাতে ডায়েরিটা দিতে গিয়ে বুকের ভেতর কোথায় নিঃশ্বাস আটকে আসছিলো তার৷ এ কেমন অনুভূতি নিঃশ্বাস কখনো মাহি তো কখনো এই মেয়েটিতেই কেন আটকায়। মাহি সাগরের হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে খাটে এসে বসলো৷ সাগর অপলকে তাকিয়ে দেখছে ডায়েরিসমেত মাহিয়াকে। হুট করেই মাহি নিজের ডান হাতটা আঁচল সরিয়ে তার বুকের ভেতর রাখলো। সাগর চমকে গিয়ে চোখ দু’টো বন্ধ করে নিয়েছে। পাগল নাকি মেয়েটা এসব কি কান্ড। পরক্ষণেই ভাবলো এই মেয়েটা এখন তারই বিয়ে করা বউ। চোখ দু’টো আবার সহসাই খুলে ফেলল সাগর মাহির হাতে ছোট্ট একটি চাবি৷ এটা বের করতেই ওভাবে,,, সাগর অবাক হয়ে দেখছে মাহির কান্ড৷ চাবিটা মাহি ডায়েরির ছোট্ট লকটিতে লাগাতেই খুলে গেল সেটি৷ অবাক সাগর এবার বাকরুদ্ধও হয়ে গেল। মাহি ডায়েরিটা খুলেই সাগরের দিকে এগিয়ে দিলো। সাগর চুপচাপ সেটা হাতে নিয়ে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টালো। এটা কোন ডায়েরি নয় একটা ফটো এলবাম৷ প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বাচ্চার ছবি যার এক পাশে লেখা “মাহিয়া নুর এনি”। এর পরের পৃষ্ঠায় আরেকটা ছবি৷ একে একে সবক’টা ছবি মাহির। একেক বয়সের ছবি তার। সাগর কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না তার স্বপ্নকুমারী তার মাহিয়া দু’জনই একজন! আল্লাহ কি তবে তার দোয়াগুলো এভাবেই কবুল করেছেন। মন থেকে কখনো চাইতো স্বপ্ন কুমারীকে আবার কখনো চাইতো মাহিয়াকে৷ হয়তো তাই আল্লাহ দু’রুপের চাওয়া পুরন করতেই এমনটা করেছেন৷ সাগর খুশিতে পাগলপ্রায় মাহিকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে৷ অসংখ্য চুমু খেলো তার কপালে। মনে মনে সহস্র শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে৷সাগরের উষ্ণ স্পর্শে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে৷ একটু আগেও যেন মনে হচ্ছিলো না সে তার সাদা টিশার্ট ভাইয়াকে পেয়ে গেছে৷ এখন অনুভব হতে লাগলো এই এলোমেলো চুলের মানুষটা সত্যিই তার। পাগলামোভরা ভালোবাসায় সিক্ত চাওয়া আজ পূর্ণ হয়ে গেছে তার ভাবতেই দেহমন জুড়ে এক অন্যরকম শিহরণ টের পাচ্ছে মাহি৷ চোখ বেয়ে আবারও ঝরছে জল তবে এ বড় সুখের কান্না । #শব্দহীন_বৃষ্টি ঝরছে আজ মাহির চোখে আর #শব্দহীন তোলপাড় সাগরের বুকে।
(আর আগে না যাই অন্যের বাসর ঘরে?)

____________সমাপ্ত_____________
(পাঠকদের কাছে একটা অভিযোগ না করে পারছি না। আপনারা গল্পটা ভালো লাগে বা মন্দ লাগে কখনও বলেন না হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া।এতে করে খুবই হতাশ হই। কথা ছিলো #সিগারেট গল্পের পর আরহাম সিজন তিন দিবো সেটা দেই নাই এটা দিছি কিন্তু এতে পাঠকদের সাড়া পাইনি তেমন৷ হতে পারে সেজন্যই লেখাটা খুবই বাজে পর্যায়ে চলে যাচ্ছিলো। তাই ইতি টানা জরুরি মনে হলো। যাই ভুল-ত্রুটি আছে সবটার জন্য ক্ষমা করবেন। ভালো থাকবেন সবাই । করোনায় দেশের পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাচ্ছে নিজে সাবধান থাকবেন কাছের মানুষদের প্রতি খেয়াল রাখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here