#বেদনার_রঙ_নীল
ষষ্ঠ পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
শান আর সহ্য করতে না পেরে কাতর গলায় বলেই উঠল,” ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আর কতক্ষণ?”
প্রণয় ডার্ট বোর্ডে অ্যারো ছুঁড়তে ছুঁড়তে শানের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল,” যতক্ষন পর্যন্ত না আমি ফোকাস পয়েন্ট টাচ করতে পারছি, ততক্ষণ তুই এভাবেই ঝুলে থাকবি।”
শান মনোযোগ নিয়ে তাকাল কালো ডার্ট বোর্ডের দিকে। রঙিন বলয়ে আবৃত এলাকার একদম মাঝখানে প্রধান ফোকাস। লাল রঙের বিন্দুটি স্পর্শ করতে হলে সোজাভাবে অ্যারো ছুঁড়তে হবে। কিন্তু প্রণয় সেটা করছে না৷ সে নিজের ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে অ্যারো ছুঁড়ছে। তার এই কাজ ইচ্ছাকৃত। শানকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য। শান সেটা বুঝেও অনেকক্ষণ চুপ রইল। কিন্তু প্রণয়ের তামাশা থামছেই না।
শান অসহ্য হয়ে একসময় দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠল,” ওই রেডলাইট, ওইটা ফোকাস পয়েন্টে লাগবে কি করে? একবার উপর থেকে মারছিস, একবার নিচের থেকে মারছিস। ডান দিক থেকে মারছিস আবার বাম দিক থেকে মারছিস। সোজা হয়ে কেন মারছিস না তুই? ”
প্রণয় গরম চোখে তাকাল। একটা অ্যারো নিয়ে তুমুল শক্তিতে শানের মাথায় ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “আমি কিভাবে মারব সেটা কি তুই আমায় শিখিয়ে দিবি? গ্রীনলাইটের বাচ্চা!”
শানের মাথায় টনটনে ব্যথা হলো। সে হাত দিয়ে স্পর্শও করতে পারছে না ব্যথার জায়গাটা। প্রণয় আবার ঘুরে অ্যারো নিক্ষেপে মনোযোগ দিল। দুই সেকেন্ড পর শান শব্দ করল,” বোতল টা অন্তত নামিয়ে রাখি? প্লিজ!”
প্রণয় দায়সারা কণ্ঠে বলল,” নামা। তোকে নিষেধ করেছে কেউ?”
শান হার মেনে বলল,” ভাই, কান ধরছি আর জীবনে হবে না। রোদে হালুয়া টাইপ অবস্থা হয়ে যাচ্ছে আমার। প্লিজ অফ যাহ এবার!”
প্রণয় শানের কাছে এসে এক হাত দিয়ে তার গাল চেপে ধরে প্রশ্ন করল গম্ভীরভাবে,” পিসির পাসওয়ার্ড কোথায় পেয়েছিস বল।”
সূর্যের তাপ চোখে এসে পীড়া দিচ্ছে। শান চোখমুখ কুচকে উত্তর দিল,” পিসি ওপেন ছিল।”
” কানের নিচে দিবো মিথ্যা কথা বললে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি শাট ডাউন করেছিলাম। বল পিসি কিভাবে ওপেন করেছিস?”
শান নিশ্চুপ। প্রণয় রেগে ধমকালো,” কথা বল!”
তার কণ্ঠ শোনালো ভারী বজ্রপাতের মতো। শান দ্রুত ঠোঁট নাড়ল,”প্রি।”
“প্রিয়ন্তি?”
শান মাথা নাড়ল আলতো করে। ভীষণ ক্লান্ত সে। এবার যদি একটু ছাড় পায়! প্রণয় আর কিছু না বলে ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে গেল। টেলিফোনটা তুলে প্রিয়ন্তির নাম্বার ডায়াল করল।
নরম বিছানায় আরাম করে শান্তির ঘুমে ডুবে ছিল প্রিয়ন্তি। ফোনের তীক্ষ্ণ শব্দে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিতে চাইছিল। তখনি দেখল প্রণয়দের বাড়ির ল্যান্ড লাইনের নাম্বার। ধপ করে উঠে বসল সে। ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগিয়েই বলে উঠল,” হ্যালো, গুড মর্নিং। প্রণয়?”
ওই পাশ থেকে প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” তুই কি গ্রীনলাইটকে পিসির পাসওয়ার্ড দিয়েছিস?”
প্রিয়ন্তি সরাসরি এই প্রশ্নে অপ্রস্তুত হলো বটে। বলল,” হ্যাঁ। আচ্ছা আন্টির কি অবস্থা? তিনি কি হসপিটালে?”
প্রণয় উচ্চস্বরে বলল,” আমার কথার উত্তর দে আগে। কেন দিয়েছিস?”
প্রিয়ন্তি করুণ কণ্ঠে বলল,” তুই এতো রাগছিস কেন? আমার কিন্তু দোষ নেই। তুই তো তোর ফোন আজমীরের কাছেই ফেলে গিয়েছিলি। এর মধ্যে মিষ্টি আপু কম করে হলেও দুইশো বার ফোন করেছে। তারপর শানও ফোন করল। তোর পিসিতে নাকি কোন ওয়েবসাইটের লিংক সেইভ আছে। ইমারজেন্সী কল করে এ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। তার কথা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল সব।এমনভাবে আমাকে ট্র্যাপে ফেলেছে যে আমিও বলে দিয়েছি পাসওয়ার্ড। ”
” ডাফ্ফার। তুই একটা ডাফফার। এজন্যই আমি হেইট করি তোদের। মেয়েরা এতো গাঁধা হয় কেন? বাচ্চা ছেলে পর্যন্ত তোদের বোকা বানিয়ে চলে যায়!”
” শানের জায়গায় অন্যকেউ হলে আমাকে কখনও বোকা বানাতে পারতো না। কিন্তু শান তো শানই!”
” শাট আপ। আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। জানিস আমার সব কিছু যে হ্যাক করে রেখেছে বিচ্ছুটা?”
” স্যরি প্রণয়। আচ্ছা, তোকে তো বলাই হয়নি। জানিস কি হয়েছে? কালরাতে তো বিয়ে বাড়ি থেকে বউ উধাও। তুই চলে যাওয়ার পাঁচমিনিট পরেই এই ঘটনা। মেয়ের মামা আবার সন্দেহ করছিল তোকে। কি একটা অবস্থা বল তো?”
প্রণয় চুপ করে গেল। প্রিয়ন্তি বলে যেতে লাগল,” পরে কি হলো জানিস? জামাই বসে কান্নাকাটি শুরু করল। বউ পালানোর পর জামাইয়ের কান্না এই প্রথম দেখলাম। আজমীরের বড়ভাই বোকা শুনেছিলাম। তাই বলে যে এতো সহজ-সরল এটা বুঝিনি। আরও কি হলো জানিস? ইকবাল আঙ্কেল তো মেয়ের মামার কথা শুনে আমাকে এসে জেরা করেছিল। তোর ফোন নম্বর, ঠিকানা এসব জানতে চাইছিল। আর আমি যখন বললাম যে তুই ফোন টা ফেলে গেছিস ওই মামা তখন কি বলে জানিস? এইটাও নাকি আমাদের একটা প্ল্যান। মেজাজটা কেমন লাগে বল তো?”
প্রণয় আশঙ্কা নিয়ে জানতে চাইল,” তুই কি ঠিকানা দিয়েছিস?”
” না। তবে শুধু এইটুকু বলেছি যে তুই ধানমন্ডি থাকিস।”
” এটাই বা কেনো বলতে গেলি ইডিয়েট?”
প্রণয় প্রচন্ড রেগে গেল। প্রিয়ন্তি হকচকিয়ে বলল,” তো কি হয়েছে? তুই তো আর সত্যি সত্যি বউ নিয়ে পালাসনি তাই না? পুরো ঠিকানা বলে দিলেও প্রবলেম কি?”
প্রণয় কোনো উত্তর দিল না। প্রিয়ন্তি হাই তুলে বলল,” কাল অনেক ঝামেলা হয়েছে। সারারাত এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি। ভোর পাঁচটায় বাসায় এসে পৌঁছেছি। তবে সবমিলিয়ে সামির ভাইয়ের জন্য আমার খারাপই লাগছে। বেচারার এতো শখের বিয়েটা ভেঙে গেল। আর তুই জানিস আজমীর কত ফাজিল? বিয়ে ভাঙায় সে খুশি।”
প্রণয় ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,” আমি এখন রাখছি প্রিয়ু। পরে কথা বলব।”
” ওকে। বাই। টেইক কেয়ার।”
ফোন রাখার আগে প্রিয়ন্তি মিষ্টি সুরে বিদায় জানায়।কিন্তু প্রণয় এসব শোনে না। খুঁট করে সে লাইন কেটে দেয়। এবারেও সে তাই করল।
ব্যালকনি থেকে শানের বিকট চিৎকার ভেসে আসছে। প্রণয় বলল ” তোর পানিশমেন্ট এখনও শেষ হয়নি। আমার ল্যাপটপ ভেঙেছিস, তারপর উকুলেলে, তারপর কিবোর্ড। এতো সহজে ছেড়ে দিবো না।”
প্রণয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল শানকে ঝুলন্ত অবস্থাতে রেখেই৷
মিষ্টি দরজা খুলে বাসায় ঢুকে হতবাক। পুরো হুলুস্থুল অবস্থা হয়ে আছে। অবশ্য এসব তার জন্য নতুন নয়। সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তবে ক্লান্ত লাগে খুব। শান কে বাসায় একা রেখে যাওয়ার পর সেই বাসার সুস্থতা কামনা করা আকাশ কুসুম কল্পনার মতো।
মিষ্টি এসেছিল ছোটমায়ের জন্য খাবার রান্না করতে। হাসপাতালের ক্যান্টিনের খাবার তিনি মুখে তুলতে পারছেন না। তবে এই মুহূর্তে মিষ্টির প্রথম কাজ ঘর গুছানো। সারারাত জেগে থেকে এখন ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে তার যখন নাস্তানাবুদ অবস্থা ঠিক তখনই বেজে উঠল কলিংবেল।
মিষ্টি দরজা খুলে দেখতে পেল দুটি অল্পবয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে। একজন সাদা সেলোয়ার কামিজ পরা, মাথায় লম্বা কালো চুল। গায়ের রং ফরসা। খুব ফুটফুটে। আরেকজনের চুল তুলনামূলক ছোট আর একটু লালচে। মেয়েটি শ্যামলা কিন্তু চেহারা সুন্দর।সে জিন্স-কুর্তি পরা। এই মেয়েটিকে মিষ্টি চেনে। সে মুচকি হেসে দু’জনকে আমন্ত্রণ জানাল,” ভেতরে এসো। তোমরা হঠাৎ এই সময় কি মনে করে?”
রাইফা রহস্যময় কণ্ঠে বলল,” একটা সারপ্রাইজ এনেছি আন্টির জন্য। আন্টি বাসায় আছে?”
মিষ্টি মুখ কালো করে বলল,” না। হসপিটালে।”
” ওহহো! শান কি আবারও কিছু করেছে?”
তুলি এই কথা শুনে ভয়ে প্রায় আৎকে উঠল। যেই ছেলে মাকে পর্যন্ত জন্য হসপিটালে পাঠিয়ে দেয় সেই ছেলেকে তুলি কিভাবে সামলাবে? না জানি তাকেও কয়বার হসপিটালে যেতে হয়!
মিষ্টি মিষ্টি করে হেসে বলল,” না। এবার শানের কোনো দোষ ছিল না। ছোটমায়ের শরীরটা খারাপ হয়েছিল।”
রাইফা আর মিষ্টি কথা বলছে। কিন্তু তুলি চমকানো দৃষ্টিতে দেখছে ঘরের অবস্থা। দশ থেকে এগারো বার ভূমিকম্প হলেও ঘরের এমন হাল হবে না৷ এটা কি আসলেই ঘর নাকি কোনো ধ্বংসস্তূপ?
হঠাৎ ভুবন কাঁপানো শব্দে কেঁপে উঠল সবাই। তিনজনই আশেপাশে চেয়ে খুঁজতে লাগল সেই শব্দের উৎস। শব্দটা যে প্রণয়ের ঘর থেকেই আসছে সেটা নিমেষেই আন্দাজ করে ফেলল মিষ্টি।
তুলি ভয় পেয়ে রাইফাকে খামচে ধরে বলল,” এইটা কি বাসা না অন্যকিছু রাফু? ঘরের এই ভাঙচুর অবস্থা, তার উপর উদ্ভট সব আওয়াজ! প্লিজ এখান থেকে চল। আমার টিউশনি করার সাধ মিটে গেছে।”
রাইফা বলল,” এতো দ্রুত সাধ মিটে গেল? এখনও তো শানের সঙ্গে দেখাই হলো না।”
মিষ্টি দৌড়ে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে৷ রাইফাও তার পেছনে ছুটে গিয়ে বলল,” আপু কিসের আওয়াজ হচ্ছে এটা?”
মিষ্টি যেতে যেতে বলল,” জানিনা। দেখতে হবে।”
তুলি আর রাইফা চোখাচোখি করল। তারপর তারা মিষ্টিকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিল।
তিনজনই ঘটনাস্থলে পৌঁছে শানকে উল্টোভাবে ঝুলে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করল। তার হাতে দুই লিটারের একটা বরফ শীতল ঠান্ডা পানির বোতল। বোতল টা এমন ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে যে এইটা ছাঁড়তে নিলেই বিরাট একটা পাথর চতুর্দিকের দেয়ালে শব্দ করতে করতে শানের মাথার সাথে বারি খাবে। শানের অবস্থা খুবই খারাপ। চোখ মুখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। কথাও বলতে পারছে না ঠিক করে।
মিষ্টি চটজলদি একটা চেয়ার এনে উপরে উঠে শানের বেঁধে রাখা পা খুলে দিল। শান মাটিতে হেলে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল সাথে সাথে। মিষ্টি শানের হাত-পা মালিশ করে দিতে লাগল। তুলি আর রাইফা ভয়ে আর বিস্ময়ে বিচলিত হলেও মিষ্টিকে একদম বিচলিত দেখাচ্ছে না। সে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলল,” শান, তুই ঠিকাছিস? ওঠ।”
শান অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করল,” পানি।”
মিষ্টি রাইফাকে উদ্দেশ্য করে বলল,” এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো না প্লিজ!”
রাইফা দৌড়ে গিয়ে পানি এনে দিল। শান পানিটা খেয়েই উঠে বসল। যেন একদম স্বাভাবিক হয়ে গেছে সে।
মিষ্টি শান কে ধরে বলল,”তোর এই অবস্থা কখন থেকে?”
শান চোখ দু’টো নিচের দিকে আবদ্ধ রেখে রাগান্বিত স্বরে বলল,” রেডলাইট।”
তুলি এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শানের মুখে রেডলাইট কথাটা শুনে সে রাইফাকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,” রেডলাইট আবার কি?”
মিষ্টি তুলির প্রশ্ন শুনতে পেয়ে হাসল৷ তারপর উত্তর দিল সে নিজেই,” রেডলাইট হল আমার ভাই বড়জন। আমরা ওর নাম দিয়েছি রেডলাইট। আর শানের নাম গ্রীনলাইট।”
রাইফা বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” এইরকম নামকরণের কারণ কি আপু?”
মিষ্টি বলল,” আমাদের বাড়ির অবস্থা তো আজকে দেখলেই। সবসময় এমন ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকে। শানের নাম গ্রীনলাইট কারণ ওকে কখনও থামানো যায় না। আর বড়জনের নাম রেডলাইট কারণ সে এলেই শান থেমে যায়। ঠিক রেডলাইট জ্বলে উঠলে যেমন গ্রীনলাইট নিভে যায়। ব্যাপারটা ঠিক তেমন না? এজন্যই এমন নাম।”
মিষ্টির কথা শুনে তুলি হাঁ হয়ে গেল। তারপর অতি সন্তপর্ণে রাইফাকে বলল,” কোথায় নিয়ে এলি এটা? রেডলাইট আর গ্রীনলাইটের চক্করে মনে হচ্ছে এক্সিডেন্ট করে ফেলবো। ”
রাইফা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,” এখনি এতো ভয় পেলে চলবে? মাত্র তো শুরু।”
তুলি হঠাৎ খেয়াল করল শান তার দিকে খুব কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি এসে গলাটা চেপে ধরবে। তুলি কিছুটা ভয় পেয়ে ঢোক গিলে রাইফার পেছনে লুকিয়ে পড়ল। শান এবার উঠে দাঁড়াল। তুলি উঁকি মেরে শানের দিকে তাকাতেই দেখল শান এখনও ওইভাবেই তাকে দেখছে৷ তুলি ভয়ে ভয়ে শানকে দেখতে লাগল। শান একইভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ তুলিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে সে তুলির কাছে এসে হাতের কনুই উঁচু করে ধরল। এতেই তুলি আতঙ্কিত হয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠল। রাইফা এই কান্ড দেখে হেসে দিল।মিষ্টিও হাসতে লাগল। তুলির খুব বোকা লাগছিল নিজেকে। এইটা ছেলে না অন্যকিছু? রাইফা গুণগুণ করে গান গাইল,” পোলা তো নয় যেন আগুনেরও গোলা…”
তুলি খুব ক্ষেপে বলল,” তোর কথায় সকালের ঘুম নষ্ট করে এখানে এসেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আমার আর কখনও ঘুমই হবে না।”
” ঘুম হবে না কেন?”
” এমন টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুমানো যায়? আচ্ছা, এই বাড়ির মানুষ ঘুমায় কিভাবে এমন জীবন্ত একটা সাইক্লোন ঘরে রেখে?”
রাইফা মিষ্টির দিকে তাকাল। মিষ্টি তাদের কথা এতো মনোযোগ দিয়ে শুনছে যে তুলি লজ্জা পেয়ে গেল। রাইফা বলল,” আন্টি আমাকে বলেছিল শানের জন্য নতুন টিউটর খুঁজতে। আমি ওকে নিয়ে এসেছি।”
মিষ্টি খুব ভয় আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বলল,” ও? কিন্তু ও কিভাবে শানকে পড়াবে?”
” ও আমার বেস্টফ্রেন্ড তুলি। খুবই ভালো স্টুডেন্ট। বোর্ডে আঠারোতম হয়েছে।”
” লেখাপড়া বিষয় না৷ শানকে হ্যান্ডেল করার জন্য শক্তি আর বুদ্ধি লাগবে। তুলি মনে হয় সেটা পারবে না। ও তো প্রথম দিনেই ভয় পেয়ে গেছে। এসব কান্ড কিন্তু আমাদের ঘরে রোজ হয়। তোমাকে অভ্যস্ত হতে হবে তুলি।”
তুলি ক্রমশ ঘামতে লাগল। মিষ্টি বলল,” চলো নিচে গিয়ে কথা বলি।”
বাসার অবস্থা কোনোমতে ঠিকঠাক করে রাইফা আর তুলিকে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসতে দিল মিষ্টি। সেন্টার টেবিলে নাস্তা সাজাল। চা, সন্দেশ, চকলেট পেস্ট্রি, আর নাগেটস।
কিন্তু রাইফা আর তুলি কিছুই খাচ্ছে না। রাইফা শুধু চায়ের কাপ হাতে নিয়েই বসে আছে। কিন্তু একবারও চুমুক দেয়নি। তুলি খুব শান্ত হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে শুধু। জীবনের প্রথম টিউশনিতে এসেই যে তার এতো ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে এটা সে কল্পনাও করেনি । আর যাই হোক এইরকম একটা বাদর ছেলেকে সামলানো তার কাজ না। প্রথম সাক্ষাৎ-এই সে সাইরেন্ডার করছে।
মিষ্টি মুচকি হেসে বলল,”তুলি, তুমি কিছু খাচ্ছো না কেনো? খাবার পছন্দ হয়নি?”
” না। অবশ্যই পছন্দ হয়েছে।”
তুলি সৌজন্যতার খাতিরে চায়ের কাপ হাতে নিল। তখনি একটা শব্দ হলো। তুলি একবার কেঁপে উঠে একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। দূর থেকে কেউ গুলতি মেরে তার চায়ের কাপ ফাঁটিয়ে দিয়েছে। চা পড়ে তুলির সাদা জামায় নকশা হয়ে গেছে। মিষ্টি আর রাইফা চমকে উঠে আশেপাশে খুঁজতে লাগল। মিষ্টি কড়া গলায় বলল,” শান, এসব কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না। তুই যেখানেই থাকিস সামনে আয়।”
তুলি ভয়ে ভয়ে আশেপাশে চোখ ঘুরালো। ভাগিস চা অনেকটাই ঠান্ডা হয়ে গেছিল। নাহলে গরম চায়ে উরু জ্বলে যেতো। মিষ্টি তুলিকে মোছার জন্য টিস্যু নিয়ে এলো। তুলি কিছু বলছে না। সে আপাতত বাকরুদ্ধ। ঠিক পাঁচ সেকেন্ড পরেই দ্বিতীয় শব্দটা হলো। হিরোসীমা নাগাসাকির থেকেও ভয়ংকর এই বিস্ফোরণ। প্রচন্ড শব্দে সেন্টার টেবিলটা ভেঙে শান একলাফে সিঁড়ির গোঁড়ায় পৌঁছে গেল। তারপর তার নাগাল আর কেউ পেল না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব লন্ড-ভন্ড। মিষ্টি দুইহাতে মাথা চেপে ধরে প্রশ্ন করল,” তোমরা ঠিকাছো তো? মাথায় হাত দিয়ে বসো। আবার কিছু হতে পারে।”
রাইফা মেঝেতে উল্টে পড়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” আবার মানে? আরও কি হবে?”
মিষ্টি অবাক হয়ে বলল,” আচ্ছা, তুলি কোথায়?”
রাইফা দ্রুত উঠে বসল। তুলিকে দেখা যাচ্ছে না। একটু পর তাকে বড় সোফার নিচে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেল। রাইফা জোরে চিৎকার দিতে নিচ্ছিল। এর আগেই মিষ্টি হাঁফ ছেড়ে বলল,” আলহামদুলিল্লাহ, তুলি ঠিকাছে।”
রাইফা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল। এটাকে ঠিক থাকা বলে? তাহলে ঠিক না থাকা কি?
চলবে