#বেদনার_রঙ_নীল
অষ্টম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
তুলির পরনের জামাটা সাদা রঙের উপর লাল ফুলের নকশা তোলা। ওরনাটা টকটকে লাল। চুলগুলো পেছনে ছেঁড়ে দিয়ে সামনের একপাশে সিঁথি করে নিয়েছে। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক দিয়ে সে এখন একদম তৈরি টিউশনে যাওয়ার জন্য। এর মাঝে মিষ্টি ফোন করে বলল,” তুলি, বাড়িতে কেউ নেই। আমার বড়ভাই ছিল কিন্তু তার একটা আর্জেন্সী হওয়ায় সে বের হয়ে গেছে। তুমি ভয় পেয়ো না, ওকে? শান কিন্তু প্রথমদিন একদম দুষ্টমি করে না। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।”
তুলির ইতোমধ্যে গলা শুঁকিয়ে গেছে ভয়ে। রাইফার আকুতি-মিনতির কাছে হার মেনে সে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখন তার একদম যেতে ইচ্ছে করছে না সেখানে।
রাইফা বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল তুলি পায়চারী করছে। সে অবাক হয়ে বলল,” কিরে, এখনও যাসনি? বিকাল পাঁচটায় যাওয়ার কথা ছিল৷ এখন অলরেডি মাগরিবের আযান দিয়ে ফেলবে। দ্রুত যা!”
তুলি অস্থির গলায় বলল,” আচ্ছা রাইফা, আমি তোর কি ক্ষতি করেছিলাম? তুই কিভাবে আমার সাথে এই দুশমনিটা করলি? এর চেয়ে যদি আমার দুই গালে দু’টো জুতা দিয়ে বারি দিতি তাও ভালো ছিল।”
” এভাবে বলছিস কেন তুলি?”
” তো বলবো না? মিষ্টি আপু ফোন করেছিল। বাড়িতে নাকি শান ছাড়া কেউ নেই।”
রাইফা ভ্রু কুচকে বলল,” তার বড়ভাইও নেই?”
” না।”
” আচ্ছা, টেনশন করিস না। আমি তোকে নিতে আসবো।”
” কিন্তু এখন তো আমাকে একাই যেতে হবে।”
” যা, কিছুই হবে না। অযথা ভয় পাচ্ছিস।”
রাইফা হাসল। কিন্তু তুলির মন চাইছিল হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে।
বর্তমানে তুলি দাঁড়িয়ে আছে শানের ঘর থেকে একটু দূরে। ভিতরে ঢুকতে ভয় লাগছে তার। বাড়িতেও কেউ নেই।
এই বিশাল বাড়িটায় শুধু সে আর শান। এই কথাটা ভেবে তুলির বুকের ভিতর মোচড় দিল। কপালে আজকে কি আছে আল্লাহ মালুম! পৃথিবীতে হয়তো সে-ই একমাত্র টিচার যে কি-না নিজের স্টুডেন্টকে ভয় পাচ্ছে। ভয়ে তুলির ঘাম ঝরে যাচ্ছে। ওরনা দিয়ে কপালের জমে থাকা ঘাম মুছে শানের ঘরের দিকে পা বাড়াল সে। অকারণেই পা টিপিয়ে টিপিয়ে হাঁটল। ভিতরে ঢুকেই কিছুটা চমকাতে হলো। শানের ঘর টা খুবই পরিষ্কার আর গোছানো! বিছানার চাদর সম্পূর্ণটা খুব টান টান ভাবে বিছানো। একটুও ভাজ নেই। দেখতে খুবই ভালো লাগছে। বিছানার পাশের লাগোয়া দেয়ালটা নীল রঙের। সেই দেয়ালে অসংখ্য অ্যানিমেশন মুভির ক্যারেক্টদের স্টিকার। রঙিন কাগজের কিছু নকশাও দেখা গেল। আর আশেপাশের দেয়ালগুলোতে কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত ছবি আঁকা। মনে হচ্ছে এগুলো শানই এঁকেছে। কিছু কিছু ছবি নজরকাঁড়া হলেও বেশির ভাগ ছবি খুবই বিদঘুটে লাগল। এমন না যে ছবি গুলো আঁকা সুন্দর হয়নি, আসলে ছবিগুলো দেখতে ভয়ংকর। ঠিক শানের মতো। এগুলো কিসের ছবি তুলি বুঝল না। তবে সে খুব অবাক হচ্ছে। যেই ছেলে সারা বাড়ির অবস্থা লন্ড-ভন্ড করে দেয় তার নিজের ঘর এতো ছিমছাম হয় কিভাবে? একেই বলে জাতে মাতাল তালে ঠিক!
শানের পড়ার টেবিলটা ব্যালকনির কাছে। ব্যালকনিতে অনেক ফুলের গাছ দেখা গেল। কি সুন্দর সুঘ্রাণ আসছে! ব্যালকনি থেকে চাঁদটাও খুব ভালো করে দেখা যাচ্ছে।
চাঁদের আলো পড়ার টেবিলের উপর এসে পড়েছে। টেবিলের বই খাতা সব পাশ করে গোছানো। আর খালি জায়গাটায় কিছু জিনিসপত্র রাখা। কাচি, সুতা, কাগজ,পানি,রঙ আর মেশিনের মতো যান্ত্রিক কিছু জিনিস। মনে হচ্ছে শান কিছুক্ষণ আগে এইখানে বসে কোন কাজ করছিল। কিন্তু এখন শান কোথায়? তাকেই কেন দেখা যাচ্ছে না?
পেছন থেকে শানের গলা শোনা গেল।
“আসসালামু আলাইকুম।”
তুলি বিমুগ্ধ হলো। তারপর পেছনে ফিরে শানকে দেখে কিছুটা বিস্মিতও হলো। ছেলেটাকে খুব কিউট লাগছে আজ। গাঢ় নীল রঙের টি-শার্টের সাথে সাদা প্যান্ট পরেছে। চুলগুলো স্পাইক করা। সানগ্লাস গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। এই সন্ধ্যা বেলা সানগ্লাস নিয়ে ঘোরার ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না তুলি।
সালামের উত্তর নিয়ে সে শানকে বসতে বলল। শান চোখমুখ কঠিন করে দাঁড়িয়ে আছে। বসছে না।
তুলি ভয় নিয়ে আবার বলল তাকে পড়ার টেবিলে বসতে। শান শান্ত কণ্ঠে বলল,” আমি আজকে পড়বো না। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। তাই আমি বের হচ্ছি। আপনি কাল আসবেন।”
উত্তরের অপেক্ষা না করেই উল্টো দিকে ঘুরে হেঁটে চলে যাচ্ছে শান। তুলি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। কারণ আতঙ্কে গলা ধরে আসছে। কেনো এতো ভয় লাগছে? রাইফা বলেছিল ছেলেটাকে ধমকের উপর রাখতে হবে। কিন্তু ধমক তো দূর, তুলি উঁচু কণ্ঠে শব্দই করতে পারছে না। কিন্তু এভাবে চললে তো হবে না। ছেলেটা দিন দিন আরও তার মাথায় চড়ে বসবে। প্রথম দিনেই সে বলবে পড়বে না আর তুলিও সেটা মেনে নিয়ে বাড়ি চলে যাবে তা হয় না। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে শানকে ডাকল তুলি,
“আবরার শাদীদ, কোথাও যাবে না আজকে তুমি। আমি তোমাকে পড়াতে এসেছি না? তুমি আমার কাছে পড়তে বসো। পড়া শেষ হলে যেখানে খুশি যেও।”
শান ঘুরে তাকাল। চোখেমুখে তার বিরক্তি স্পষ্ট।
তুলি ভেতরে মিইয়ে গেলেও উপরে কাঠিন্য ধরে রাখল। কঠিন গলায় আবারও বলল,” তোমার আপুর সাথে কথা বলেই আমি এসেছি। কই, সে তো বলেনি যে তুমি কোথাও যাবে! বললে তো আমি আসতাম না। তোমাকে আজকে আটটা পর্যন্ত পড়ানোর কথা। তাই আটটার এক মিনিট আগেও তোমাকে ছাড়বো না। আমি এই বিষয়ে অনেক স্ট্রিক্ট। বসো তুমি।”
শান গম্ভীর হয়ে বলল,” আজকে আমার ফ্রেন্ড এর বার্থডে। ওর বাসায় পার্টি আছে। আমার এমনিই অনেক লেইট হয়ে গেছে। আমাকে যেতে দিন।”
তুলি ধমক দিল,” বললাম না আটটার আগে কোথাও যাওয়া চলবে না? পার্টি হোক আর যেটাই হোক। পড়াশুনার থেকে কোনোকিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। চুপচাপ টেবিলে বসো।”
“ঠিকাছে। ” ভদ্র কণ্ঠে কথাটা বলে টেবিলে বসল শান। তুলি তো অবাক! এই ছেলেটা এতো সহজে মেনে গেল? বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মানে কি তুলির ধমকে কাজ হয়েছে? মনে মনে নিজেকে নিয়ে গর্ব হলো তুলির। সে পারবে, বাদর পিটিয়ে মানুষ বানাতে নিশ্চয়ই পারবে।
শান তার ম্যাথ বইটা বের করে তুলির দিকে বাড়িয়ে দিল। তুলি মৃদু হেসে বইটা খুলে সূচিপত্র দেখছিল।ঠিক সেই সময় পায়ে কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করল। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে নিচে তাকাতেই দেখল বিরাট একটা মাঁকড়সা। তুলি ভুবন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের উপর পা তুলে কুঁজো হয়ে বসল।
শান প্রশ্ন করল,”কি হয়েছে আপু? এ্যানি প্রবলেম?”
তুলি মাঁকড়সাটার দিকে আবার তাকাল। কিন্তু এখন আর মাঁকড়সা পাওয়া গেল না। তুলি চোখ বড় করে মাঁকড়সা খুঁজতে ব্যস্ত হলো।
শান বলল,” আপু আপনি পানি খাবেন?”
সত্যিই তুলির ভয়ে পানির তৃষ্ণা পেয়ে গেছে। সে মাথা নাড়ল। শান উঠে গেল পানি আনতে। তুলি তখনও জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারের উপর পা তুলে বসে রইল। মাঁকড়সাটা সামনে থাকলেও এতো ভয় লাগতো না। কিন্তু মাঁকড়সাটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই তার ভয়টা বেশি লাগছে। সে মাঁকড়সা ভয় পায়। আর ওই মাঁকড়সা অস্বাভাবিক বড়। চিন্তা করলেই গা শিরশির করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি হুট করে কোথা থেকে এসে গায়ের উপর পড়ে যাবে।
শানের ডাকে তুলি চমকালো।
” আপু, পানি।”
তুলি দ্রুত পানির গ্লাসটা নিতে গিয়ে আরেকবার চেঁচিয়ে উঠল। কারণ মাঁকড়সাটা এখন গ্লাসের ভেতরে! যেন সাতার কাটছে। কি বিদঘুটে! কি জঘন্য! তুলি চোখ বন্ধ করে দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেলল।
শান আবার বলল,” কি হয়েছে আপু?”
তুলি আতঙ্কিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” গ্লাসটা সরাও প্লিজ। গ্লাসের ভেতর মাঁকড়সা!”
” কোথায় মাঁকড়সা? কিছুই নেই। সী!”
তুলি মাথা তুলে তাকাল। এবার সত্যি মাঁকড়সা নেই। তুলি রাগী দৃষ্টিতে বলল,” তুমি আমার সাথে এসব না করলেও পারতে। ছি!”
” আপু আপনার কি হ্যালুসিলেশন হয়? আপনি এতো ঘামছেন কেনো?”
তুলি কিছু বলল না। মাঁকড়সার কল্পনা এখনও মাথা থেকে যায়নি। পুরোটা নীল রঙের। জীবনে কোনোদিন এমন নীল মাঁকড়সা দেখেছে বলে মনে পড়েনা।
” আপু আপনি তো প্রচন্ড ঘামছেন। এসি ছাড়ব?”
” না। আমি এখন চলে যাবো। তুমি আমার সাথে কাজটা ঠিক করোনি।”
শান বিনীত কণ্ঠে বলল,” আই সুয়্যার, আমি কিছুই করিনি। আই থিংক আপনারই হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।”
” শাট আপ! আমাকে বোকা মনে হয়?”
শান পানির গ্লাসটা টেবিলে রেখে চলে গেল। তুলি এখনও একইভাবে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না তার কেনো এতো ভয় লাগছে। মাঁকড়সাটা এখনও তার চোখে ভাসছে। হঠাৎ করে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। পুরো বাড়ি অন্ধকারে আচ্ছন্ন। তুলি ভীষণ চমকে গিয়ে শানের নাম ধরে চিৎকার করল। কিন্তু শান এখানে নেই। শান আসলে বাড়ির কোথাও নেই। সে চলে গিয়েছে। যাওয়ার সময় সার্কিট অফ করে দিয়ে গেছে। নিজের আর্টিফিসিয়াল মাঁকড়সা টাও সাথে নিয়ে গেছে।
বাড়ি থেকে বের হয়েই মাঁকড়সাটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো শান। এই সুন্দর জিনিসটা কেউ এতো ভয় পেতে পারে? শান মাঁকড়সার গায়ে চুমু দিল।
তুলির মাথা থেকে এখনো সেই মাকড়সার ভয় যায়নি। তার উপর সবকিছু অন্ধকার! বাড়িতে কেউ নেই। ভয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে লাগল তুলি। সে কি করবে কোথায় যাবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।
প্রণয় বাড়ির মূল দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে মাত্র। সবকিছু অন্ধকার দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল সে। লোড শেডিং হলেও তো এইরকম অন্ধকার হওয়ার কথা না। জেনারেটর কি চলছে না? নাকি সার্কিটে কোনো প্রবলেম! গ্রীনলাইট কিছু করেনি তো? প্রণয় সার্কিটের সমস্যা দেখার জন্য বের হতে নিবে, তখনি পেছন থেকে কেউ এসে তাকে জাপটে ধরল। প্রণয় বিস্মাভিভূত হয়ে প্রশ্ন করল,” কে?”
তুলি চোখমুখ খিঁচে বলল,” আমি খুব বিপদে আছি। প্লিজ হেল্প মি আউট!”
চলবে