#বেদনার_রঙ_নীল
পঞ্চদশ পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
প্রায় দশকেজির মতো মিষ্টি, বিভিন্ন ফল-ফলাদি, মাছ, মাংস, বাসমতি চাল, মেয়েদের কসমেটিক্স, জামা-কাপর, এক কথায় পুরো সুপার শপ নিয়ে বাড়িতে ঢুকল সামির। সূচি এসব দেখে বোকা বনে গেলেন। সামির একা সব বহন করতে পারেনি তাই দুইটা কিশোর ছেলেকেও সাথে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা একের পর এক শপিং ব্যাগ ভেতরে আনছে।
সূচি বললেন,” কাঁচাবাজারগুলো কষ্ট করে রান্নাঘরে রেখে এসো। ড্রয়িংরুম নোংরা হচ্ছে।”
সামির সতর্ক গলায় বলল,” হ্যাঁ, হ্যাঁ জলদি নিয়ে যাও।”
ছেলে দু’টো রান্নাঘরে যেতেই সামির বিনীত কণ্ঠে বলল,” আপা, রান্না হলে ছেলে দু’টোকেও একটু খাইয়ে দিয়েন। আমার সাথে ওরা আজকে অনেক কাজ করেছে। বেচারা!”
সামিরের মুখে আপা ডাক শুনে সূচি বিব্রত হলেন। রাইফা চোখ বড় করে হাসতে লাগল। সূচি বললেন,” আমি রাইফার মা। আমাকে তুমি আন্টি বলে ডাকতে পারো।”
সামির গাঢ় হাসি নিয়ে প্রশ্ন করল,” রাইফা মানে কি তুলির বান্ধুবি যে?”
তারপর মহা উৎসাহে আরও যোগ করল,” তাহলে তো আপনি আমার শালিকার মা। আর শালিকার মা মানে দূর সম্পর্কের শাশুড়ীর মা। আরে, আপনাকে দেখে একদম বয়স বোঝা যায় না। আমি কি আপনাকে সালাম করতে পারি?”
সূচি একটু ভীত হয়ে বললেন,” পায়ে ধরে সালাম করবে নাকি?”
” না, না, এমনি সালাম করি। আসসালামু আলাইকুম। ”
সূচি খুব কষ্টে সৌজন্যতার হাসি হেসে চলে গেলেন।
রাইফা আর তন্বি ঘরের ভেতর থেকেই মজা নিচ্ছে এসব দেখে। কিন্তু তুলির গা জ্বলে যাচ্ছে! সূচি মেয়েদের কাছে এসে বললেন,” এতো বাজার গোছানোর মানুষ তো নেই। বুয়া আসবে না তিনদিন। মেয়েরা, কাজে লেগে পড়ো। যে মাছ কাটতে পারো সে মাছ কেটে দাও। যে মাংস রাঁধতে পারো সে মাংস রান্না করো। এভাবে কাজ ভাগ করে নাও। আমি কলেজে যাচ্ছি।”
এমন আদেশ শুনে সবাই আৎকে উঠল। রাইফা বিহ্বল হয়ে বলল,” আমরা এতো কাজ কিভাবে করবো আম্মু? এইটা কোনো কথা হলো?তার চেয়ে বরং রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করি। আর বাজার সব ফ্রিজে রেখে দাও।”
” এটা যে বাজার এনেছে তাকে গিয়ে বলো!” সূচি গম্ভীর কণ্ঠে এই কথা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাইফা মলিন মুখে বলল,” এইবার কি হবে? এই তোরা কেউ মাছ-টাছ কাটতে জানিস? আমি শুধু রান্না করতে পারবো। কাটাকুটিতে নেই।”
তন্বি বলল,” আমি সব জানি।”
তুলি পিঠ দেখিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল। আগুন ঝরা কণ্ঠে বলল,” সব তন্বিই করবে। সে নিজেই ঝামেলা ঘাড়ে করে বয়ে এনেছে। তাই ঝামেলা সামলাবেও সে। আমি তো আজকে ঘর থেকেই বের হবো না। আর খবরদার, উনি যেন ভুলেও এই ঘরে না আসে।”
তুলির কথা শেষ হতে না হতেই সামির একগাদা ব্যাগ নিয়ে ঢুকল। তুলিকে দেখেই উল্লাসে প্রায় চেঁচিয়ে বলল,” তুলি, কেমন আছো বউ? তোমাকে কতদিন দেখি না!”
সামির দুই হাত বাড়িয়ে কাছে আসছিল। ভাবটা এমন, যেন এখনি তুলিকে জড়িয়ে ধরবে! তুলি ড্রেসিংটেবিল থেকে ভারী পারফিউমের বোতলটা উঠিয়ে নিল। যেন কাছে এলেই ছুঁড়ে মারবে! তন্বি দ্রুত সেটা তুলির হাত থেকে কেঁড়ে নিয়ে যেখানে ছিল সেখানেই সাজিয়ে রাখল। রাইফা ঠাট্টার সুরে বলল,” ও যে ঢাকায় এসেছে এখনও দশদিন হয়নি সামির ভাই। আর আপনি ওকে কতদিন দেখেন না?”
সামিরের দৃষ্টি অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো। চোখ মুছতে মুছতে বলল,” এই দশদিন আমার কাছে দশ মাসের মতো মনে হয়েছে। তুলি, তুমি কেন বললে না যে লেখাপড়া করতে চাও? নিজে লেখাপড়া বেশি করতে পারিনি বলে কি তোমাকেও পড়তে দিবো না? এতো হিংসুটে মনে হয় আমাকে? তুমি যত খুশি পড়ো তুলি। আমার কোনো আপত্তি নেই। শুধু মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে ফোনে একটু কথা বোলো। নাহলে আমার খুব ব্যথা লাগবে।”
রাইফা প্রশ্ন করল,” কোথায় ব্যথা লাগবে সামির ভাই?”
সামির কাতর কণ্ঠে বলল,” কেন? বুকে! এইযে এখনও ব্যথা করছেরে! তুলি তুমি কথা বলছো না কেন? দেখো, কেমন করে তাকিয়ে আছে! একটু কথা বলো নাগো!”
তন্বি ফিসফিসিয়ে বলল,” কথা বল না! বেচারা তো বুকের ব্যথায় মরে যাচ্ছে। মার্ডার করে দিবি নাকি?”
তুলি দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” মরুক।”
সামির শুনতে পেল না। আগ্রহ নিয়ে বলল,” কি বললে? তন্বি, তুলি কি বলল?”
তন্বি হাসিমুখে জানাল,” আপনাকে হ্যালো বলেছে, সামির ভাই।”
সামির আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,” সত্যি? হ্যালো তুলি, ভালো আছো তুমি?”
তুলি বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে বলল,” আপনি এখানে কেন এসেছেন সামির ভাই?”
সামিরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শুকনো গলায় উত্তর দিল,” কেন? তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি৷ তুমি খুশি হওনি?”
তুলি স্পষ্টভাবে বলল,” না। আপনি চলে যান প্লিজ। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না৷ এটা কি আপনি এতোদিনেও বুঝতে পারেননি?”
সামিরের মুখটা এবার পুরো চুপসে গেল। আমতা আমতা করে বলল,” বিয়ে করতে তো আসিনি। বিয়ের কথা আমি কখন বললাম? ”
তারপর হাসার ভঙ্গি করে বলল,” তন্বি আমাকে সব বুঝিয়ে বলেছে৷ তুমি তো অনেক দিন পরে বিয়ে করবে। কি যেন..তেরো তম মাসের…”
রাইফা মনে করিয়ে দিল,” বত্রিশতম দিন!”
” হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক। ওইদিন আসতে তো অনেক দেরি। আমি অপেক্ষা করতে পারবো। কোনো সমস্যা নেই।”
তুলি খিটমিট করে বলল,” আপনি কি আঁতেল? তেরোতম মাস বলতে যে কিছু হয় না সেটাও কি বোঝেন না আপনি?”
সে খুব রেগে যাচ্ছিল। তন্বি তার কাঁধে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,” রিল্যাক্স তুলি! এমন করছিস কেন? ভালোভাবেও তো কথা বলা যায়।”
রাগে তুলির চোখে পানি এসে গেছে। সে কিভাবে ভালো করে কথা বলবে? সামির বিভ্রান্ত হয়ে কড় গুণতে শুরু করল,” বৈশাখ,জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ,ফাল্গুন, চৈত্র.. এই যা! মাসই তো বারোটা। তাহলে তেরোতম মাস কি করে এলো?”
সামির প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রাইফা অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল,” তেরোতম মাস যেমন কখনও হয় না তেমন তুলির সাথে আপনার বিয়েও কখনও হবে না সামির ভাই৷ এই সিম্পল বিষয়টা বুঝতে পারছেন না?”
সামির এবার আশাহত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল তন্বির দিকে। তন্বির মনটা ফট করে খারাপ হয়ে গেল। সামির মলিন কণ্ঠে বলল,” ও বুঝেছি। তন্বি তাহলে আমার সাথে মশকরা করেছিলে ওইদিন?”
তন্বি কোনো জবাব দিতে পারল না। সামির আহত কণ্ঠে বলল,” আসলে আমি না মানুষের কথা খুব সহজে বিশ্বাস করে নেই৷ এজন্য মানুষ প্রায়ই মজা করে আমাকে মিথ্যা বলে। কিন্তু তন্বিও যে এই বিষয় নিয়ে মশকরা করবে এটা আমার মাথাতেও আসেনি। ওকে তো আমি ছোটবোনের মতো দেখতাম।”
তন্বি তড়িঘড়ি করে বলল,” একদম মজা করিনি সামির ভাই। আপনি সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? রাইফা আপনার সঙ্গে মজা করছে। তুলির লেখাপড়াটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বিয়ে নিশ্চয়ই হবে।”
তুলি কটমট করে তাকাল তন্বির দিকে। তন্বি মিনমিন করে বলল,” পরিস্থিতি সামলাতে দে আগে। উনি গ্রামে গিয়ে যদি কোনো ঝামেলা পাকায়? বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে বোকা মানুষ বেশি বিপজ্জনক। ”
তুলি নিশ্চুপ হয়ে গেল। সামির আবারও আশা জাগানিয়া কণ্ঠে বলল,” তোমরা সত্যি কথা বলছো নাকি এখনও মজা করছো? তুলি, তুমি কি আমাকে পছন্দ করো না?”
তন্বি চোখের ইশারায় অনুরোধ করল যেন তুলি শান্ত থাকে। তুলি মাথা নিচু করে বলল,” না সামির ভাই। আপনি ভালো একজন মানুষ। কিন্তু আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”
সামিরের চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেল। নিষ্প্রাণ গলায় বলল,” ও। এজন্যই বুঝি বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছিলে?”
তুলি উত্তর দিল না। কিন্তু নীরবতাই যে সম্মতি, সেটুকু বোঝা গেল। তন্বি বলল,” আমাকে মাফ করবেন সামির ভাই। আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম।”
সামির ভারী কণ্ঠে বলল,” না, না, আমি আবার কি মনে করবো? আসলেই আমি বুঝতে পারিনি। মামা যেদিন বলল তুলির সাথে আমার বিয়ে হবে সেদিন কথাটা বিশ্বাস করাই আমার অন্যায় হয়েছিল। বোকার মতো স্বপ্ন দেখতে লেগেছিলাম৷ তুলির মতো মেয়ে আমাকে কেন বিয়ে করবে? আমার কি যোগ্যতা আছে তুলিকে বিয়ে করার?”
তন্বি সিক্ত দৃষ্টিতে বলল,” সামির ভাই, এভাবে বলবেন না। আপনি খুবই ভালো মানুষ। ”
” ধন্যবাদ তন্বি। আর তুলি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার এই রকম চিন্তা করাই উচিৎ হয়নি। তোমার মামা না বললে আমি কখনও বিয়ের কথা ভাবতাম না। ”
সবাই নিশ্চুপ। সামির ইতস্তত করে আরও বলল,” তুমি যদি বিয়ের আগে আমাকে বুঝিয়ে বলতে তাহলে এমনিই আমি বিয়ে আটকে দিতাম৷ তোমার পালানোর দরকারই হতো না।”
তুলি এবারও কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর সামির হাতের ব্যাগগুলো বাড়িয়ে বলল,” তোমার জন্য এনেছি তুলি। দেখোতো পছন্দ হয় কি-না? মেয়েদের জিনিস তো আমি ভালোমতো চিনি না।”
তুলি নিরস কণ্ঠে বলল,” আমি এসব কিভাবে নিতে পারি সামির ভাই? আমার লাগবে না।”
” আরে নাও, নাও। বিয়ে করবে না বলে কি উপহারও নিবে না? বড়ভাই ভেবে নিয়ে নাও।”
তুলি এই কথা শোনার পর আর না নিয়ে পারল না। হাত বাড়িয়ে ব্যাগগুলো নিতে নিতে বলল,” আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
রাইফা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে একটু মজা করতে বলল,” শুধু কি তুলির জন্যই? আমাদের জন্য কিছু আনেননি?”
সামির হাসি-খুশি কণ্ঠে বলল,” এনেছি তো। সবার জন্য এনেছি৷ খুলে দেখো না!”
রাইফা আর তন্বি আগ্রহ নিয়ে ব্যাগগুলো দেখতে লাগল।
সামির ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সে চলে যেতেই রাইফা বলল,” বেশি বেশি হয়ে গেল নাকি? বেচারা মনে হয় কষ্ট পেয়েছে।”
তুলি শান্ত কণ্ঠে বলল,” ভুল তো হয়েছেই। বিয়ে থেকে পালানোর আগে সামির ভাইয়ের সাথে একবার কথা বলে নিলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম৷ মামা যেভাবে রূপ বদলে ফেললেন, তাতে কাউকেই আর বিশ্বাস হচ্ছিল না।”
তন্বি বিরস কণ্ঠে বলল,” সামির ভাইকে আমি অনেকবার কাঁদতে দেখেছি। এজন্যই বার বার বলছিলাম একটু ভালো করে কথা বল।”
রাইফা মিনমিন করে বলল,” আমি তো উনাকে ওই আজমীর বদমাইশটার মতোই ভেবেছিলাম৷ এজন্য প্রথমে ফান করছিলাম৷ কিন্তু এখন খারাপ লাগছে।”
রাইফা আর তন্বি তুলির দিকে চেয়ে কথাগুলো বলছিল। তুলি হঠাৎ করেই রেগে বলল,” এখন কি আমার সব দোষ? বিয়ে থেকে পালিয়ে কি আমি অন্যায় করে ফেলেছি?”
তন্বি বোঝানোর জন্য বলল,” আরে না, আমরা তোকে তো কিছু বলছি না।”
” তোরা কি বলছিস সেটা তোদের কথাতেই বোঝা যাচ্ছে। ঠিকাছে, আমি যদি ভুল করে থাকি তাহলে ক্ষমাও চাইবো।”
তুলি ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রাইফা আর তন্বিও তড়িঘড়ি করে তার পিছু নিল। সামিরকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। গেস্টরুম, বাথরুম, কোথাও সে নেই। ড্রয়িংরুমে বাচ্চা ছেলে দু’টো বসে আছে। তুলি প্রশ্ন করল,” সামির ভাইকে দেখেছো?”
ছেলেটা না’সূচক মাথা নাড়ল৷ তুলি চিন্তিত হয়ে পড়ল। সামির আবার চলে গেল নাকি? তখন রাইফা বলল,” তুলি রান্নাঘরে আয়। দেখে যা।”
দুপুরের রান্না-বান্না সামির নিজেই করবে। সে মেঝেতে বসে বটি দিয়ে মাছ কাটতে লাগল। রাইফা এই দৃশ্য দেখেই সবাইকে ডাকল। তন্বি এসে বিস্ময় নিয়ে বলল,” এসব কি করছেন সামির ভাই?”
সামির হাসিমুখে বলল,” কাজ করছি। এতো জিনিস এনে মনে হয় তোমাদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম।”
তন্বি কাছে এসে বলল,” লাগবে না। আপনি উঠুন। আমি কেটে দিচ্ছি মাছ।”
” না, না, আমিই আজকে রান্না করে তোমাদের খাওয়াবো।”
তন্বি রাইফার দিকে তাকাল৷ রাইফা গোমরা মুখে বলল,” আপনি মেহমান মানুষ না? আপনি কেন রাঁধবেন? ছেড়ে দিন।”
” তুলির জন্য রাঁধবো। শখ ছিল বিয়ের পর বউকে রেঁধে খাওয়াবো৷ তুলির সাথে তো আর বিয়ে হবে না৷ তাই ভাবলাম এখনি রেঁধে খাওয়াই।”
রাইফা একটু মজা করে বলল,” সো সুইট!”
তুলি কোমল গলায় বলল,” আই এম স্যরি সামির ভাই। পারলে আমাকে মাফ করে দিবেন। আপনার সাথে আমি যেটা করেছি সেটা ঠিক হয়নি।”
” আরে ধূর, মাফ চেয়ো না। আমি একটুও রাগ করিনি।”
” আপনি খুব ভালো মানুষ। ”
” থ্যাঙ্কিউ। ”
দুপুরে সামির একাই অনেক কিছু রান্না করে ফেলল। মেয়েরাও তাকে সাহায্য করেছিল। সূচি বাড়ি ফিরে খেতে বসে অবাক! একটা ছেলে মানুষের রান্না কি করে এতো ভালো হয়? তিনি মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন,” গ্রেইট! অনেক ভালো রান্না হয়েছে তো।”
রাইফা ফিসফিসিয়ে বলল, ” তুই কিন্তু ঠকে গেলি তুলি। আমি হলে এতো ভালো রান্না জানা জামাই কখনও হাত ছাড়া করতাম না।”
তুলি কটমট করে বলল,” এই বিষয়ে বার বার ফান করবি না। আমার একদম ভালো লাগে না।”
সূচি নিজে থেকেই বললেন,” ছেলেটা পাত্র হিসেবে ভালোই ছিল। একটু লেখাপড়া জানা থাকলে আমি নিজেই মেয়ের জামাই বানিয়ে ফেলতাম।”
রাইফা চোখ বড় করে বলল,” আম্মু সিরিয়াসলি?”
তন্বি হাসতে লাগল৷ তুলি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলল,”লেখাপড়া কি কোনো ফ্যাক্ট হলো আন্টি? মানুষ তো বুড়ো বয়সেও লেখাপড়া করে। সামির ভাই না হয় নতুন করে কলেজে ভর্তি হয়ে যাবে৷ আবার তাদের অবস্থাও অনেক ভালো। সম্বন্ধটা খারাপ হবে না।”
রাইফা রেগে আগুন। সূচি উৎসাহী কণ্ঠে বললেন,” ভেবে বলছো তো?আমারও ভালো মনে হচ্ছে। রাইফা, তুই কি বলিস?”
” ইম্পসিবল। আমি এই বুড়া বেটাকে বিয়ে করবো না।”
সামির রান্নাঘরে গিয়েছিল সালাদ কেটে আনতে। সে ফিরে আসতেই সবাই চুপ হয়ে গেল। সামির হাসিমুখে বলল,” কি ব্যাপার? রান্না ভালো হয়নি?”
তন্বি জবাব দিল,” খুব ভালো হয়েছে সামির ভাই।”
” তোমার কেমন লেগেছে তুলি?”
তুলি স্মিত হেসে বলল,” চমৎকার রান্না। ”
সন্ধ্যায় সামির সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। তুলিও সামিরের সঙ্গে বের হলো। সে যাবে টিউশনে আর সামির যাবে বাসস্ট্যান্ডে। তুলি বলল,” চলুন সামির ভাই, আপনাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দেই।”
” আরে, অসুবিধা নেই। তোমার দেরি হয়ে যাবে।”
” একটু দেরি হলে কিছু হবে না।”
সামির ইতস্তত করে বলল,” একটু পরে এখানে আজমীর আসবে।”
” আজমীর ভাই? কিন্তু কেন?”
” এমনি। আমি ঢাকায় এসেছি তাই দেখা করতে আসবে। আমিও বললাম আয়। ”
” ও আচ্ছা। তাহলে বরং আমি চলেই যাই।”
” আজমীরের সঙ্গে দেখা করে যাও?”
” না, না, প্রয়োজন নেই।”
” ওইতো, ওইতো, ওটাই মনে হয় আজমীরের গাড়ি। সে বলেছিল বন্ধুর সাথে গাড়ি নিয়ে আসবে।”
তুলি গাড়িটা দেখে থামল। কারণ গতরাতে যখন প্রণয়ের সঙ্গে বারান্দায় দেখা হয়েছিল তখন প্রণয় এই গাড়িতেই ছিল। তুলি স্ব- ইচ্ছায় দাঁড়িয়ে রইল। গাড়ি থেকে প্রণয়ই নামছে৷ তার পাশে আজমীর। তুলিকে দেখেই সে অবাক হয়ে বলল,” ভাইয়া, তুলি তোমার সাথে কি করছে?”
সামির অকপটে বলল,” তুলি আমাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এসেছিল। তারপর আমি বললাম তুই আসবি তাই তোর সঙ্গে দেখা করতে দাঁড়ালো। তুই কেমন আছিস আজমীর?”
প্রণয় এদিকে মুচকি হেসে তুলিকে ‘হায়’ জানাল। তুলিও বিনিময়ে লাজুক হাসি উপহার দিল। আজমীর ঈর্ষান্বিত কণ্ঠে বলল,” তুমি কি এখনও তুলিকে বিয়ে করার কথা ভাবছো নাকি? ভুলেও এসব চিন্তা কোরো না। তুলি কেন বিয়ে থেকে পালিয়েছে জানো? কারণ ওর সাথে আমার সম্পর্ক। ”
সামির এই কথা শুনে হকচকিয়ে গেল। তুলিও হতভম্ব। প্রণয় একটু রেগে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” ওই, কি আবোল-তাবোল বলিস?”
আজমীর ফিসফিসিয়ে বলল,” আরে, তুলিকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। আমার বাবাকে তুই চিনিস না। আবার যদি তুলিকে ধরে নিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়? কেইসও তো তোলা হয়ে গেছে। পরে কিছু করারই থাকবে না৷ তাই এখনি রাস্তা ক্লিয়ার করতে হবে।”
আজমীর হৃদয়ভঙ্গ দৃষ্টি নিয়ে তুলির দিকে চেয়ে আছে। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল,” তাহলে এই ব্যাপার? আমাকে তোমার পছন্দ না কারণ আমার ছোটভাইকে তুমি পছন্দ করো? ”
তুলি কি বলবে খুঁজে পেল না। আপাতত আজমীরের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। সামির দিশেহারার মতো বলল,” তোরা আমাকে এসব আগে জানালি না কেন? তাহলে কি আমি জোর করে তুলিকে বিয়ে করতাম?”
আজমীর অভিযোগের স্বরে বলল,” বাবা তো আমার থেকে তোমাকে বেশি ভালোবাসে। তোমার বিয়ে না দিয়ে আমার বিয়ে কিছুতেই দিবে না। আমি আগেই বাবাকে সব বলে দিয়েছিলাম৷ বাবা আমাকে একটা থাপ্পড় মেরে বলেছে, এখন থেকে তুলিকে ভাবীর নজরে দেখতে।”
সামির কঠিন গলায় বলল,” তুই বাবাকে এসব জানাতে গেলি কেন? আমাকে বলতে পারতি!”
” তোমাকে বলে কি করবো? তোমার কোনো ক্ষমতা আছে নাকি কিছু করার? শুধু বাবার কথায় উঠো আর বসো। মেরুদন্ডহীনের মতো!”
অপমানে সামিরের চেহারা থমথমে হয়ে গেল। তুলি আর প্রণয় এতোক্ষণ ছিল দুইভাইয়ের বিবাদের নীরব দর্শক। কিন্তু এবার আর কেউ নীরব থাকতে পারল না। প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে আজমীরকে শাসন করল,” বড়ভাইয়ের সাথে কথা বলার এটা কেমন ধরণ আজমীর?”
তুলিও সাথে সাথেই বলল,” আপনি বেশি বলছেন আজমীর ভাই। এখনি ক্ষমা চান।”
আজমীর কথাই বলল না। গরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সামির বলল,” থাক, তোমরা ওকে কিছু বোলো না। ও ঠিকই বলেছে। বড়ভাইরা ছোটভাইয়ের জন্য কত কি করে! সেই তুলনায় তো আমি ওর জন্য কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু এবার করবো। শোন ভাই, আমার জন্য তোর তুলিকে ভাবী ডাকতে হবে না। আমি নিজে বাবার সঙ্গে কথা বলে তোর আর তুলির বিয়ের ব্যবস্থা করবো৷ তুই ভাবিস না। খুশি?”
এই কথা শুনে তুলি আর প্রণয়ের মাথায় যেন বাজ পড়ল। আজমীর ঝলমলে দৃষ্টিতে বলল,” শিউর তুমি? সত্যি বলছো তো?”
” একদম সত্যি!”
আজমীর উল্লাসে চিৎকার করল,” ইয়েস! থ্যাংকিউ ভাইয়া। তুমিই আমার ভাই৷ তুমি আমাকে এইভাবে বুঝবে জানলে সবার আগে তোমার কাছেই আসতাম।”
প্রণয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। সে কি আজমীরকে একটা লাথি মারবে এখন? লাথি মারার প্রয়োজন হলো না। এর আগেই তুলি বজ্র কণ্ঠে চেঁচালো,” খবরদার! সামির ভাই আপনি এমন কিছুই করবেন না। আমি মরে গেলেও আজমীর ভাইকে বিয়ে করবো না ”
আজমীর হতভম্ব হয়ে তাকাল। সামির অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কেন?”
তুলি নিরুপায় হয়ে বলল,” কারণ আমার এখন বিয়ের কোনো প্ল্যান নেই।”
সামির হেসে বলল,” ঠিকাছে, তাহলে অন্তত বাবাকে জানিয়ে রাখি। বিয়ে ঠিক হয়ে থাকল। আজমীরও লেখাপড়া শেষ করুক। তারপরে বিয়ে হবে!”
আজমীর বলল,” গুড আইডিয়া। ভাইয়া কে বলেছে তোমার বুদ্ধি নেই? আমার ভাই দুনিয়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। ”
সামির আজমীরকে বুকে জড়িয়ে ধরল৷ দুই ভাইয়ের আহ্লাদ দেখে গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তুলির। সে না পারতে বলল ” আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।”
এই কথা বলেই সে প্রণয়ের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে ফেলল। তারপর নরম সুরে বলল,” আই লভ হিম।”
তুলির আচরণে বাকরুদ্ধ হলো প্রণয়৷ খুশিতে ঝুমঝুমিয়ে উঠল তার মন। ঠোঁটে ফুটল শিশিরকণার মতো ক্ষুদ্র তবে তৃপ্ত হাসি! কিন্তু সামির যেন দ্বিতীয়বারের মতো শক খেল। আজমীরের হতভম্ব ভাব কাটার আগেই সে আরও একবার হতভম্ব হয়ে গেল।
চলবে