বেদনার_রঙ_নীল,২৪,২৫

0
369

#বেদনার_রঙ_নীল,২৪,২৫
চব্বিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রণয়কে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে বিকালে। বাড়িতে গিয়ে দুইদিন বেডরেস্টে থাকতে হবে। এই মুহূর্তে রিসব আর প্রণয়ের মাঝখানে প্রিয়ন্তী বসে আছে। তিনজন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মাঝে তুলি আর রাইফা যেন নীরব দর্শক। ভোঁতামুখে বসা তারা দু’জন। শান পাশেই একটা চেয়ারে বসে আইপ্যাডে গেইমস খেলছে। মিষ্টি এখানে নেই। ফোনে কথা বলার জন্য সে বাইরে গেছে।

প্রিয়ন্তী কারণে-অকারণে প্রণয়ের কাঁধ চেপে ধরছে। সেই দৃশ্যই তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে তুলি। একবার তো প্রণয়ের কাঁধে মাথা রেখে শুয়েই পড়ল সে। তুলি এই দৃশ্য দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। প্রিয়ন্তী তাকে দাঁড়াতে দেখে বলল,” কি ব্যাপার তুলি? কোনো প্রবলেম?”

তুলি মাথা নেড়ে বলল,” না।”

” তাহলে দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”

” মশা কামড়াচ্ছে পায়ে।”

” এইখানে তো কোনো মশাই নেই।”

তুলি অসহায় চোখে তাকালো রাইফার দিকে। প্রণয় অস্বস্তিবোধ করছিল। আলগোছে সে প্রিয়ন্তীর মাথা সরিয়ে বলল,” গায়ের সাথে লাগবি না, সর! সুযোগ পেলেই খালি সাপটা-সাপটি!”

প্রিয়ন্তীর মুখ থমথমে হয়ে গেল। রাইফা কাটা ঘাঁয়ে নূনের ছিঁটা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হো হো করে হাসতে লাগল। তুলিও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল। প্রিয়ন্তী অবাক হওয়ার ভাণ ধরে বলল,” এভাবে বলতে পারলি প্রণয়? গতবছর কানাডা ট্যুরে যাওয়ার সময় তুই পুরো ফ্লাইটে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলি। তখন কি আমি কিছু বলেছিলাম?”

এই কথা শুনেই তুলির মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। প্রিয়ন্তী তুলির দিকে চেয়েই কথাটা বলছিল। যাতে তুলির জ্বলে। প্রণয় বিব্রত কণ্ঠে বলল,” কবে? আমার তো মনে নেই!”

” তোর মনে থাকবেও না। অকৃতজ্ঞ একটা।”

” সিরিয়াসলি মনে পড়ছে না। তুই তো আমার সঙ্গে বসিসওনি।”

” মাঝরাতে সিট চেঞ্জ করে আমি তোর কাছে এসেছিলাম৷ ”

” কেন?”

” তুই ম্যাসেজ করেছিলি।”

প্রণয় কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে রইল,” কি আবোল-তাবোল বলছিস? ফ্লাইটে কি নেটওয়ার্ক থাকে? আমি তোকে ম্যাসেজ কিভাবে করবো?”

তুলি ফোঁড়ন কেটে বলল, ” আমার মনে হয় প্রিয়ন্তী আপু স্বপ্নে দেখেছিল।”

রাইফা এই কথায় অনেক জোরে হেসে উঠল। প্রিয়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিসবের দিকে চেয়ে বলল,” তোর ট্রেনিং কবে দোস্ত?”

রিসবের আবার এদিকে খেয়াল নেই। সে একটা নন-ফিকশন পিডিএফ পড়ছিল। প্রিয়ন্তীর কথায় তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলে সে ভ্রু কুচকে বলল,” এইতো, নেক্সট মান্থ। তোকে বললাম না একবার!”

প্রিয়ন্তী বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী আবদার করল,” আমিও তোর সঙ্গে যাবো।”

এবার রাইফার মুখের হাসি উধাও। দৃষ্টি কটমট।

” তুই কেন যাবি?” রিসব হাসার চেষ্টা করল। প্রিয়ন্তী বলল,” তোর সঙ্গে পাহাড় ভ্রমণ করবো। প্রণয়কেও নিয়ে যাই? আমরা তিনজন একসঙ্গে যাই। কি বলিস প্রণয়?”

প্রণয় অবজ্ঞার স্বরে উত্তর দিল,” মাথাখারাপ!”

” প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!” এই বলে একহাতে প্রণয়ের চুল ঘেঁটে দিতে লাগল প্রিয়ন্তী। এবার তো আর সহ্য হয় না! তুলি রাইফার দিকে তাকাল চোখমুখ কুচকে। যার অর্থ- ” প্লিজ কিছু কর!”

রিসব হাসিমুখে বলল,” পাহাড় ভ্রমণের জিনিস না ষ্টুপিড। আরোহণ করতে হয়। তোর দ্বারা হবে না। প্রণয় চাইলে কিন্তু যেতে পারিস।”

প্রণয় বালিশে হেলে চোখ বন্ধ রেখে বলল,” নেভার।”

প্রিয়ন্তী কোমরে হাত গুঁজে বলল,” আমার দ্বারা হবে না কেন রিসব?”

রিসব সকৌতুকে বলল,” তোর সোনাবরণ গায়ের রঙ ঝলসে যাবে না?”

প্রিয়ন্তী আহ্লাদে আটখানা হয়ে রিসবের গাল টেনে ধরল।

” সো সুইট! কিন্তু আমাকে নিয়ে এতো চিন্তার কিছু নেই। তুই পারলে আমিও পারবো।”

প্রিয়ন্তী চোখ মারল। রিসব হাসছে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে।রাইফা তড়াক করে দাঁড়িয়ে তুলির দিকে চেয়ে বলল,” এদিকে আয়।”

এই কথা বলেই সে বের হয়ে গেল। তুলি উঠে তার পেছন পেছন এলো। রাইফা কেবিন থেকে বের হয়েই রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য খুব জোরে শ্বাস নিল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে স্বগতোক্তি করল,” ডাকিনী একটা! তোর মুখের হাসি গায়েব করতে না পারলে আমার শান্তি হবে না।”

” কিন্তু করবিটা কি?” তুলি প্রশ্ন করল ফিসফিসিয়ে। রাইফা তুলির হাত শক্ত করে ধরে জানতে চাইল,” তুই কি আমার সাথেই আছিস?”

তুলি নির্দ্বিধায় বলল,” অবশ্যই আছি। কি করতে চাস সেটা বল খালি।”

” আমি একটা ভয়ংকর কান্ড ঘটাবো আজ। তুই কিন্তু সবক্ষেত্রে আমাকে সাপোর্ট করবি। বল রাজি?”

রাইফার চোখে ক্রোধানল জ্বলছে। তুলি মাথা নেড়ে বলল,” হুম। তুই যেটাই করবি আমি সেটাতেই রাজি।”

” ঠিকাছে। চল তাহলে।”

হসপিটালের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে ‘কিডস ওয়ার্ল্ড।’ সেখানে বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র পাওয়া যায়। এছাড়া বড়দের কিছু টপস, ল্যাগিংস, ওরনাও বিক্রি হয়৷ রাইফা তুলিকে নিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে শপে ঢুকল। তারপর দু’টো ওরনা, দু’টো মাস্ক আর দু’টো সানগ্লাস কিনে ফেলল। তুলি তাকে এসব নিতে দেখে হাসতে হাসতে বলল,” আমার কিন্তু খুব কিউরিওসিটি হচ্ছে রাফু। তুই কি করতে চাইছিস প্রিয়ন্তীর সাথে?”

” শশশ! চুপচাপ দেখে যা। তোকে উপযুক্ত সময়ে সবকিছু বলা হবে।”

রাইফা চোখ টিপল। তারপর কি ভেবে যেন দু’টো টপস আর ল্যাগিংসও কিনে নিল।

” আমাদের এখন ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে তুলু।” শপ থেকে বের হয়েই রাইফা এই কথাটি বলল। তুলির চোখ মার্বেলের মতো বড় হয়ে গেল তা শুনে। তবে পরবর্তীতে কি হবে সেটা নিয়েও খুব রোমাঞ্চবোধ করছিল সে। তাই উচ্চবাচ্য না করে রাইফার কথামতো কাজ করল।

প্রণয় ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয়ন্তী তার পাশে বসে গুণগুণিয়ে গান গাইছে। একজন নার্স এসে প্রিয়ন্তীকে ডাকল,” ম্যাম, কথা শুনে যান।”

” আমাকে বলছেন? প্রিয়ন্তী ভ্রু কুচকে বেরিয়ে এলো। নার্স বললেন,” মিষ্টি আপু আপনাকে ডেকেছে।”

” কোথায় মিষ্টি আপু?”

” আমার সাথে চলুন।”

নার্সের হাতে ঔষধের শিশির মতো কিছু একটা ছিল। জিনিসটির মুখ খোলা। ভেতরে তরল পদার্থ। নার্স ইচ্ছাকৃতই হোঁচট খেয়ে সেই তরল ফেলে দিল প্রিয়ন্তীর গায়ে। তারপর দুঃখিত গলায় বলল,” ওপসস, স্যরি ম্যাম!”

প্রিয়ন্তী চেহারা বিকৃত করে জানতে চাইল,” এটার মধ্যে কি ছিল?”

নার্স অপরাধী গলায় জবাব দিল,” একজনের ইউরিন ছিল।”

প্রিয়ন্তি প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,” ওহ নো, ওহ গড! কি করলে এটা?”

নার্স বলল,” এক্সট্রিমলি স্যরি। চলুন আপনাকে বাথরুমে নিয়ে ওয়াশ করে দিচ্ছি।”

প্রিয়ন্তী দৌড়ে বাথরুমে ছুটতে লাগল। নার্স বাঁধা দিয়ে বলল,” ওদিকে যাবেন না ম্যাম। ওখানে ভীড় বেশি। যেখানে ভীড় কম সেখানে নিয়ে যাচ্ছি চলুন।”

প্রিয়ন্তী পড়িমরি করে বলল,” হ্যাঁ চলো। দ্রুত।”

ওয়াশরুমে এসে দরজা আটকে দিয়ে চলে গেল নার্স। তার কাজ এখানেই শেষ। প্রিয়ন্তী অবশ্য দরজা আটকানোর ব্যাপারটি খেয়াল করল না। তার পুরো শরীর গিনগিন করছিল। বমি আসছিল। সে কোনোমতে কল ছেড়ে নিজের জামা পরিষ্কার করতে লাগল। ঠিক তখনি পেছন থেকে কেউ মুখ চেপে ধরল তার। আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো। প্রিয়ন্তী কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ধুমধাম মারতে শুরু করল চারটি হাত। কে বা কারা এমন করছে, প্রিয়ন্তী জানে না! সে মূর্ছা গেল। রাইফা আর তুলি ভয়ে ছেড়ে দিল। তুলির অবশ্য মন চাইছিল তখনও মারতে। তার রাগ কমেনি একফোঁটাও। রাইফা তো তুলির আচরণ দেখে নিজেই হতবাক। তুলির মতো শান্ত মেয়েও যে কাউকে এইভাবে মারতে পারে সেটা তার ধারণাতেই ছিল না। সে সতর্ক গলায় বলল,” এইটা কি করলি তুলি? এইবার কি হবে?”

তুলি প্রশ্ন করল,” মরে গেছে নাকি?”

” না। এইটুকু মারে কেউ মরে না। তবে ভয় পেয়ে বেহুশ হয়ে গেছে মনে হয়।”

তুলি উত্তেজিত গলায় বলল,” তাহলে হুশ ফেরার আগে আরও কয়েকটা দেই।”

রাইফা তড়িঘড়ি করে তুলিকে থামাল,” এই না, না, থাক! বেচারির যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। চল আমরা চলে যাই।”

” এটাকে এভাবেই রেখে চলে যাবো?”

” তো আর কি করবো? জ্ঞান ফিরলে সে নিজেই উঠে আসবে।”

” ও আমাদের চিনতে পারেনি তো?”

” কিভাবে চিনবে? আমরা নিজেরাই নিজেদের চিনতে পারছি না!”

বাথরুম থেকে বের হয়েই সানগ্লাস আর মাস্ক খুলে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করল রাইফা। তুলি ইতস্তত করে বলল,” আমরা কি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম?”

প্রশ্নটা করে সামনে তাকাতেই আত্মা ছলাৎ করে উঠল তার। তুলিকে থতমত খেতে দেখে রাইফাও সামনে তাকাল। রিসব দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। তাকে দেখে আৎকে উঠে মুখ চেপে ধরল রাইফা। তুলির গলা শুকিয়ে গেল। রিসব জেনেছে মানে প্রণয়ও জানবে এবার!

চলবে

#বেদনার_রঙ_নীল
পঁচিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

তুলি ঢোক গিলতে গিলতে রাইফার দিকে তাকালো একবার৷ সে এখনও মুখ থেকে মাস্ক আর সানগ্লাস খুলেনি। ওরনা দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেওয়া তার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে রিসব তাকে চিনবে না৷ তুলি যেহেতু রাইফার সাথে দাঁড়িয়ে আছে সেহেতু রিসব নিশ্চিত বুঝতে পেরেছে সব। তবে রাইফার মনে অন্য ধারণা তৈরী হলো। রিসবের চেহারায় কোনো রাগ নেই। কেবলই কৌতুহল। সে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাই বলা যায় সে কিছু বোঝেনি। রাইফা চেষ্টা করলেই ব্যাপারটা কাটিয়ে দিতে পারে। তবে রিসব যদি কিছু বুঝেও থাকে তাহলে রাইফা মিথ্যা বললে সে ধরে ফেলবে। রাইফা নিজেকে রিসবের সামনে মিথ্যুক প্রমাণ করতে চায় না৷ তাই আগেই কিছু না বলে সে সময় নিল। রিসব এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,” কি হচ্ছে এখানে?”

রাইফা পাল্টা প্রশ্ন করল,” আপনি এখানে কি করছেন? এটা তো লেডিস ওয়াশরুম।”

রিসব একবার সামনে তাকিয়ে কৈফিয়ৎ দেওয়ার জন্যে বলল,” স্যরি আমি খেয়াল করিনি। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম। কিন্তু তোমরা কি করছিলে?”

রাইফা সহজভাবে হেসে বলল,” আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে কিছু শপিং করেছিলাম। সেগুলোই ট্রায়াল দেওয়ার জন্য এখানে এসেছি। বাইরে তো অনেক পল্যুশন। আর আজকে খুব রোদও উঠেছে। এজন্যই মাস্ক আর সানগ্লাস।”

রিসব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। যেন কথাটা তার হজম হচ্ছে না। রাইফাও মনে মনে বিব্রতবোধ করতে লাগল। সে কি খুব বেমানান কিছু বলে ফেলেছে? রিসব একটু পর হেসে বলল,”আমি তো তোমাদের এখানে এইভাবে দেখে ভয়ই পেয়ে গেছিলাম।”

তুলি প্রশ্ন করল আতঙ্কে, ” কেন ভয় পেয়েছেন?”

রাইফা সাথে সাথেই তুলির হাত খামচে ধরল। সেই ব্যাপারটা আবার রিসব লক্ষ্য করতেই রাইফা হাত ছেড়ে দিল ঝটিতে। রিসব হাসল অকারণেই। তার হাসি দেখে রাইফা আর তুলিও হেসে দিল। রিসব বলল,” খুবই অদ্ভুত দেখাচ্ছে তোমাদের। কিছুটা ফিমেইল গ্যাংস্টারের মতো। ”

তুলি এই কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। কিন্তু রাইফা স্বাভাবিক রইল। খুশি হওয়ার অভিনয় করে বলল,” এটা কি কমপ্লিমেন্ট ছিল?”

রিসব উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল। তুলির তখনও ভয় লাগছে। এই বুঝি প্রিয়ন্তী বাথরুম থেকে বের হয়ে যাবে। কিংবা রিসব আচমকাই বাথরুমে ঢুকে পড়বে। আর সব ফাঁস হয়ে যাবে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এমন কিছু হলো না। এই যাত্রায় রাইফা-তুলি বেঁচে গেল।

জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর প্রিয়ন্তীর সে কি কান্না! যে নার্সটি প্রিয়ন্তীকে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে গেছিল সে বার-বার বোঝানোর চেষ্টা করল,” আপু, আপনি হয়তো দূর্বল ছিলেন। কিংবা ইউরিন দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। কেউ আপনাকে মারেনি। আমি তো পাশেই ছিলাম। আপনাকে মারলে আমি কই থাকতাম বলেন?”

প্রিয়ন্তী প্রণয়ের হাত ধরে বলল,” বিশ্বাস কর দোস্ত, আমার স্পষ্ট মনে আছে কেউ পেছন থেকে আমার চুল ধরে এক আছাড়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছিল। তারপর ঠাস ঠাস করে আমার গালে থাপড়াচ্ছিল। আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছিলাম। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারছিলাম না। বোবা ধরলে যেমন হয় ঠিক তেমন। ”

প্রণয় পাশ কাটানো গলায় বলল,” তোর মনে হয় হ্যালুসিনেশন হয়েছিল।”

” মানে? আমার হঠাৎ হ্যালুসিনেশন কেন হবে?”

” সেটা তো সাইক্রিয়াটিস্ট ভালো বলতে পারবে।”

” তুই কি আমাকে পাগল প্রমাণ করতে চাইছিস?”

প্রণয় হেসে ফেলল। প্রিয়ন্তী চোখ বড় বড় করে বলল,” তুই হাসছিস কেন? মানে আমার কথা কি তোর বিশ্বাস হয়নি? ফাজলামি মনে হচ্ছে?”

” তোর গায়ে কোনো ইনজ্যুরি, স্ক্র্যাচ কিছুই নেই। কি দেখে বিশ্বাস করি বল?”

” চড়, থাপ্পড়, লাথিতে কি ইনজ্যুরি হয়? ”

” বাথরুমে নিয়ে তোকে চড়, থাপ্পড়, লাথি কে মারবে?”

শান বলল,” আমার মনে হয় জম্বি মেরেছে।”

সবাই হাসতে লাগল। কেউই ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। প্রিয়ন্তী হতাশ, তীব্র মনখারাপ নিয়ে বসে রইল। মিষ্টি হাসি রোধ করে বলল,” এইরকম মাঝে মাঝে হয় প্রিয়ন্তী। তুমি সারারাত ধরে জেগে ছিলে। তোমার শরীর টায়ার্ড ছিল। এমন হওয়া স্বাভাবিক। তুমি বেহুশ হয়ে গেছিলে অথচ তোমার মনে হচ্ছে কেউ তোমাকে মেরেছে। এটা আসলে তোমার অবচেতন মনের কল্পনা।”

প্রিয়ন্তী তার গালে হাত রেখে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,” আমার এখনও চাপার দাঁতে ব্যথা লাগছে আপু। এটাও কি কল্পনা?”

রাইফা আর তুলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছে কেবল। অন্যদের মতো ভয় পাওয়ার খুব চেষ্টাও করছে। কিন্তু তাদের ভয় লাগছে না মোটেও। হাসি চেপে রাখার একটি দুঃসাধ্য চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে খুব কষ্টে।

প্রিয়ন্তী হঠাৎ বলল,” আচ্ছা মিষ্টি আপু, তুমি কি আমাকে ডেকেছিলে?”

মিষ্টি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,” কখন?”

” আমি বাথরুমে অজ্ঞান হওয়ার আগে?”

” হ্যাঁ ডেকেছিলাম তো।”

” তুমি কি ওকে পাঠিয়েছিলে আমাকে নেওয়ার জন্য?”

প্রিয়ন্তী নার্সের দিকে ইশারা করল। মিষ্টি মাথা নেড়ে বলল,” হুম।”

প্রিয়ন্তী এবার সম্পূর্ণ আশাহত হয়ে পড়ল। তার মনের সন্দেহ রাইফা আর তুলির উপর। কিন্তু মিষ্টির স্বীকারোক্তি শোনার পর তার বিরক্ত লাগছে। সে নিশ্চিত তাকে কেউ মেরেছে। একজন তাকে ধরে রেখেছিল। অন্যজন তাকে মারছিল। এরা রাইফা আর তুলি ছাড়া কেউ হতেই পারে না। কিন্তু এই ব্যাপারটা প্রিয়ন্তী প্রমাণ করবে কিভাবে? সে চোখ কুটি করে তাকিয়ে রইল দরজার সামনে। যেখানে রাইফা আর তুলি দাঁড়িয়ে আছে। তারা দু’জনই নিশ্চিন্তবোধ করছে এখন। মিষ্টি নার্সকে পাঠিয়েছিল প্রিয়ন্তীকে ডেকে আনার জন্য। সেই নার্স যখন এখানে আসছিল তখনি রাইফা তাকে টাকা দিয়ে নিজের পরিকল্পনায় টেনেছে। রিসব এতোক্ষণ একদম চুপচাপ বসে ছিল। নার্স রুম থেকে বের হওয়ার একটু পরেই রাইফা আর তুলিও বের হয়ে গেল। এই ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করল।

তুলি বাইরে এসেই বুকে হাত চেপে ধরে বলল,” অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম আমি।”

রাইফা হাসছে। তার হাসি যেন থামেই না। তুলি বিরক্তিসূচক শব্দ টেনে বলল,” থামবি তুই? এভাবে তোকে কেউ হাসতে দেখলে খবর আছে। সব বুঝে ফেলবে।”

” আমি কি করবো? হাসি আটকাতে পারছি না তো! ডাইনিটার চেহারা দেখেছিস?আমাদের দিকে কিভাবে তাকিয়েছিল! নিশ্চিত বুঝেছে। বেচারি! না পারছে সইতে আর না পারছে কাউকে বলতে।”

তুলির গলা শুকিয়ে গেল। আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল,” সত্যি বুঝেছে নাকি? হায় আল্লাহ, এখন যদি প্রণয়কে বলে দেয়? কি হবে?”

” বলবে না। প্রণয় গাঁধা না যে তার কথা বিশ্বাস করবে। আর সেও গাঁধী না যে প্রণয়কে এই কথা বলে বাঁশ খাবে।”

তুলি মনে মনে দরুদ শরীফ পড়তে লাগল। প্রণয় এসব জানলে মান-সম্মান বলে আর কিছু থাকবে না তার। রাগের মাথায় ভুলটা করে ফেলেছিল। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে কাজটা ঠিক হয়নি।

দুপুরে সবাই ক্যান্টিনে লাঞ্চ করার জন্য গেল। রাইফা সূচির সঙ্গে কথা বলার জন্য বাইরে এসে দাঁড়ালো। সূচি প্রণয়ের খোঁজ-খবর জানতে চাইলেন। রাইফা বলল,” প্রণয় ভালো আছে, আম্মু। তুমি টেনশন কোরো না। আমরা সন্ধ্যার মধ্যে বাড়িতে চলে আসবো।”

” আমি কি হাসপাতালে এসে তোদের নিয়ে যাবো?”

” দরকার নেই।”

” প্রণয়কে একবার দেখতেও আসবো না?”

” আমরা তো কিছুক্ষণ পরেই বের হয়ে যাবো। তুমি এসেই বা কি করবে? একেবারে বাড়িতে গিয়েই দেখে এসো! হাসপাতালে আর আসার দরকার নেই।”

” ঠিকাছে। বাড়িতে অজান্তা আপা একা আছে না? আমি তাহলে সেখানেই যাচ্ছি। দেখা হবে। ”

” ওকে আম্মু। বাই।”

রাইফা ফোন রেখে পেছনে ঘুরতেই দেখল রিসব।পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে মুচকি হাসি। রাইফা লাজুক দৃষ্টিতে বলল,” আরে,আপনি এখানে কি করছেন? মানে কিছু কি বলবেন?”

” চলো ওইদিকে যাই।”

রিসব কোমলভাবে রাইফার হাতের বাহু টেনে ধরল।রাইফার মন খুশিতে বাক-বাকুম করছে। সে যেন আর এই দুনিয়ায় নেই। স্বপ্নে হারিয়ে গেছে।একটা নীরব জায়গায় এসে থামল তারা। রিসব তাকে নিয়ে আড়ালে এলো কেন? সে কি বিশেষ কিছু বলবে আজ? রাইফার মনে অধীর আগ্রহ, কৌতুহল আর অপেক্ষা। সব মিটিয়ে রিসব গম্ভীর গলায় বলল,” এটা কেন করলে তোমরা?”

রাইফা অনেক হকচকিয়ে গেল এমন প্রশ্নে। প্রথমেই বুঝল না কিছু। অবাক হয়ে বলল,” মানে?”

রিসব রাগী কণ্ঠে বলল,” আমি কোন বিষয়ে কথা বলছি সেটা তুমি জানো!”

রাইফা এতোক্ষণে বুঝতে পারল। তার প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। বুক কাঁপতে লাগল দুরুদুরু। সে চলে যেতে নিলেই রিসব হাত ঠেকিয়ে বাঁধা দিল। রাইফা খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ভয়ও পেল। রিসব সরাসরি বলল,” কাজটা ঠিক হয়নি। প্রিয়ন্তীর কাছে তোমরা দু’জনই ক্ষমা চাইবে।”

রাইফা আড়ষ্ট গলায় বলল,” স্যরি।”

” আমাকে স্যরি বলে লাভ নেই। যাকে বলা উচিৎ তাকে বলবে।”

রাইফা মাথা নিচু করল। লজ্জায় সে তাকাতেও পারল না রিসবের চোখের দিকে। রাইফাকে এই অবস্থায় রেখেই রিসব চলে যাচ্ছিল। তখন রাইফা পিছু ডাকল,” ভাইয়া।”

রিসব থামল কিন্তু পেছনে তাকাল না। রাইফাও মাথা নিচু রেখেই বলল,”এই কথাটা আর কেউ জানলে খুব খারাপ লাগবে।”

রিসব এবার তাকিয়ে বলল,” এমন কাজ কখনও কোরো না যেটার জন্য মাথা নিচু করে থাকতে হয়। আবার কাউকে বলতেও লজ্জা হয়।”

রাইফার বাম চোখ থেকে সরলরেখার মতো জল গড়িয়ে পড়ল। রিসব অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,” কেউ জানবে না৷”

আজ তন্বিও এসেছিল প্রণয়কে দেখতে তাদের বাড়িতে। এতোদিন শুধু রাইফা আর তুলির কাছে গল্প শুনেছে সে। শানকেও দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তার। তন্বি শানের কপালে হাত রেখে বলল,” তুমি নাকি অনেক দুষ্টুমি করো?”

শান জবাব দিল না। তন্বি তার গাল টেনে বলল,” দুষ্টু ছেলে, কথা বলছো না কেন?”

শান এবারও জবাব দিল না। তন্বি অনেক ধরণের প্রশ্ন করল। একটারও জবাব সে পেল না। তন্বি অবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল,” তুলি, তুই না বলেছিলি ও সাইক্লোন? কোথায়? এটা তো দেখছি শান্ত পুকুর! টু শব্দটিও করে না।”

তুলি হেসে বলল,” তাহলে মনে হয় তোকে পছন্দ করেনি। পছন্দ করলে কথা বলতো।”

তন্বি অপ্রসন্ন মুখে বলল,” সত্যি? আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি শান?”

শান মৃদু হেসে বলল,” একটা ম্যাজিক দেখবেন?”

” ওরে বাবা, তুমি আবার ম্যাজিকও জানো? তুমি কি ম্যাজিশিয়ান?”

” ম্যাজিক দেখবেন কি-না সেটা বলেন।”

” ওকে দেখবো।”

শান তাকে ঘরে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিল। তারপর একটা আলোর রশ্মি তার সামনে ধরল। তন্বি প্রশ্ন করল,” এটা কি?”

” ম্যাজিক। ছুঁয়ে দেখুন।”

তন্বি হাত দিয়ে ধরতেই তার পুরো হাত র-ক্তে রঙিন হয়ে গেল। আল্লাহই জানে কিভাবে কি হলো! তন্বির গা শিরশির করতে লাগল। সে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে দ্রুত বাথরুমে এসে হাত ধোঁয়ার সময় উপলব্ধি করল, তার হাতে যেটা লেগে আছে সেটা টমেটো সস। “কি বিচ্ছু! ” বিড়বিড়িয়ে বলল তন্বি।

বাড়ি ফিরে এই গল্পটা তুলি আর রাইফাকে শোনাচ্ছিল তন্বি। সে খুব হাসছে। বাচ্চাটা অদ্ভুত। রাইফা হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেল। সন্ধ্যা থেকে তার মন খারাপ। না হাসছে আর না কথা বলছে। তুলি চিন্তিত হয়ে উঠল। তন্বি বলল,” এর আবার কি হয়েছে?”

তুলি জবাবে বলল,” দেখে আসছি।”

সে উঠে বারান্দায় এলো। তুলিকে দেখেই ত্বরিতে চোখ মুছে নিল রাইফা। তুলি সিরিয়াস কণ্ঠে বলল,” এই তোর কি হয়েছেরে?”

” কিছু না।”

” বল? তুই কাঁদছিস!”

তুলি কান্নাটা দেখে ফেলায় সে আরও জোরে কাঁদতে লাগল। তুলি এবার অস্থির হয়ে গেল। রাইফা বলল,” রিসব সব বুঝে ফেলেছে।”

” কি বুঝেছে?”

” প্রিয়ন্তীর ব্যাপারটা।”

” ওহ মাই গড! সিরিয়াসলি? কি করে বুঝলো?”

” জানি না। হয়তো নার্সের সাথে কথা বলেছে!”

তুলির মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। এখন কি হবে চিন্তা করতেও দম আটকে এলো তার। প্রণয়ও কি জানবে? ভয়ে চুপসে গেল সে। রাইফা ব্যথিত কণ্ঠে বলল,” সে আমাকে প্রিয়ন্তীর কাছে স্যরি বলতে বলেছিল।”

” সে কি তোকে ধমকেছে?”

” না। কিন্তু কিভাবে যেন কথা বলেছে, রুডলি। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যে…আমি এক্সপ্লেইন করতে পারবো না। ”

” তুই কি প্রিয়ন্তীকে স্যরি বলেছিস?”

” না। সে বলেছে কেউ কিছু জানবে না। স্যরি বলতে গেলে তো প্রিয়ন্তীকে সব জানাতে হতো। আর তখন সবাই সব এমনিই জেনে ফেলতো। প্রিয়ন্তী না বলে থাকতো না। তাই রিসব স্যরি বলার জন্য ফোর্স করেনি। কিন্তু এরপর সে আমার সাথে আর একবারও কথা বলেনি। আমার খুব গিল্টি ফীল হচ্ছে তুলি। আমি সব নষ্ট করে দিয়েছি।”

” তুই কাঁদিস না প্লিজ। আচ্ছা, রিসবকে যে তুই এতো পছন্দ করিস এটা তো আগে কখনও বলিসনি?”

রাইফা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,” এজন্যই বলিনি। কারণ আমি নিজেই নিশ্চিত ছিলাম না সে আমাকে পছন্দ করে কি-না! আর এখন আমার মনে হচ্ছে, সে আমাকে একদমই পছন্দ করে না।”

” এইটা তোর ভুল ধারণা।”

রাইফা দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” এটাই ঠিক।”

” দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দেখাই।”

তুলি তার ব্যাগ থেকে রঙিন ওরনা বের করল। ওরনাটি সে রাইফার দিকে বাড়িয়ে হাস্যজ্বল মুখে বলল,” চিনিস নাকি দেখতো?”

রাইফা চোখমুখ কুচকে তাকিয়ে রইল৷ তারপর ঝটিতে ওরনাটি কেঁড়ে নিয়ে বলল,” আরে, এটা তো আমারই ওরনা। হারিয়ে গেছিল।”

” হুম। এটা আমি কোথায় পেয়েছি জানিস?”

” কোথায়?”

” শানের কাছে।”

রাইফা তুমুল আগ্রহে প্রশ্ন করল,” আর শান কোথায় পেয়েছে?”

তুলি জবাব না দিয়ে মিষ্টি করে হাসল। রাইফা রেগে বলল,” একদম রহস্য করবি না। বল!”

” শান পেয়েছে তার ভাইয়ার আলমারিতে। এবার বলতো ভাইয়াটা কে?”

রাইফা গাঢ় হাসি দিয়ে বলল,” রিসব?”

তুলি মাথা নাড়ল। রাইফা ইনিয়ে-বিনিয়ে দেখতে লাগল ওরনাটা। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না৷ এই ওরনা রিসবের কাছে কিভাবে গেল সেটা মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। তুলি তখন বলল,” ফার্স্টে আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া মানে প্রণয়।”

রাইফা নিরাশ দৃষ্টিতে তাকাল,” ও। এজন্যই তাহলে এতোদিন ড্রামাগুলো করেছিস তাই না? ”

তুলি আফসোসে ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ল। রাইফা বলল, ” বলদি তুই।”

তুলি হেসে দিল। তার খুব ভালো লাগছিল রাইফার জন্য। খুশিতে টইটম্বুর রাইফার চেহারা। রাতে ভাতও খেল না সে। তুলি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখল রাইফা তখনও বারান্দায় বসে আছে। হাতে ওরনা।

( আজকের পর্বে প্রণয়- তুলির অংশ ছিল না। তবে আগামী পর্বটা হবে শুধু প্রণয়-তুলিময়।)

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here