বেদনার_রঙ_নীল,৩০,৩১

0
368

#বেদনার_রঙ_নীল,৩০,৩১
ত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রণয় বাড়ি ফিরে দেখল রাইফা বসে আছে তার ঘরে। দুইহাত মুখে ঠেকিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছে মেয়েটা। প্রণয় ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে রাইফা?”

রাইফা রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রাগে কড়মড় করে বলল,” আই হেইট ইউর ভাইয়া।”

প্রণয় হেসে ফেলল। হাতঘড়ি খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে পরামর্শ দিল,” এটা রিসবের কাছে গিয়ে বলো। আমাকে শুনিয়ে লাভ কি?”

” হুম। বলবো। এই কথা শুনলে তো সে খুশিই হবে। সে আমাকে সহ্যই করতে পারে না। আর তোমরা কি-না আমার সাথে তার বিয়ের কথা ভাবছো?”

প্রণয় একটু চিন্তিত হয়ে কপাল কুচকাল। রাইফার পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে ফেলল,” আবার কিছু হয়েছে নাকি?”

” আমি আর তুলি মিলে প্রিয়ন্তীকে উদুম কেলানি দিয়েছিলাম। হসপিটালের বাথরুমে। সেই ঘটনা তোমার ভাইয়া জানতে পেরে এখন আমার সাথে গম্ভীর হয়ে কথা বলে। রাগ দেখায়। তার কাছে প্রিয়ন্তী কেন এতো ইম্পোর্ট্যান্ট?”

প্রণয় হাসতে লাগল। রাইফা বিচলিত গলায় বলল,” তুমি প্রিয়ন্তীর কথা শুনে অবাক হলে না?”

” তুলি আজকেই আমাকে বলেছে ঘটনা। আমার খুব হাসি পেয়েছে। তোমরা কি করলে এটা? সো সিলি!”

” শাটআপ৷ একদম ঠিক করেছি। প্রিয়ন্তীর জন্য এটাই ঠিক আছে। ও তোমার ভাইয়ার নাক ধরে টানছিল। আমি কখনও পারবো? যেটা আমি পারবো না সেটা অন্যকেউ আমার চোখের সামনে করে বেড়াবে আর আমি সহ্য করবো? ওকে যে আমি মার্ডার করে দেইনি এটাই ওর সৌভাগ্য!”

” ওরে বাপরে! এতো রাগ? তুলিও কি এমন রেগেছিল?”

রাইফা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” তুলি ওকে এমনভাবে মারছিল যা দেখে আমিই ভয় পেয়ে গেছি।”

প্রণয়ের মুখে স্বস্তির হাসি। চোখ দু’টি চিকচিক করছে। একটা অদ্ভুত গৌরব অনুভব হচ্ছে। তুলি তার ব্যাপারে সেন্সিটিভ, এই বিষয়টা প্রণয় খুব শান্তি দিচ্ছে। রাইফা খুঁচিয়ে প্রশ্ন করল,” তুমি এতোক্ষণ তুলির সাথে ছিলে নাকি?”

” হুম।”

” ওয়াও, তারপর কি হলো আজ?”

প্রণয় খানিকটা রাগ আর খানিকটা হতাশা নিয়ে বলল,” তোমার বেস্টফ্রেন্ড আমাকে পাগল না বানিয়ে থামবে না রাইফা!”

“তোমার ভাইয়াও আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে বাই দ্যা ওয়ে। আবার কি করেছে তুলি?”

” এখন সে বড়লোক হতে চায়।”

প্রণয় এই কথা বলেই বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। যেন খুব ক্লান্ত সে। রাইফা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রণয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” সে বড়লোক হতে চাইলে তোমার প্রবলেম কি? এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার!”

প্রণয় কাতর গলায় বলল,” ব্যক্তিগত ব্যাপার হলে ভালোই ছিল। কিন্তু সে আমার জীবন নিয়ে টানা-টানি করছে। ভবিষ্যতে আমি বেঁচে থাকবো কি-না, বিয়ে করতে পারবো কি-না, বাচ্চার বাপ হতে পারবো কি-না সব ডিপেন্ড করছে তুলির বড়লোক হওয়ার উপর৷ আমি ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছি। দেখা যাবে তুলি বড়লোক হতে হতে আমি ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে হাসপাতালে গড়াগড়ি করছি।”

রাইফা পুনরায় বিছানায় বসে গোমরা মুখে বলল,” বুঝিয়ে কথা বলো৷ মাথায় কিছু ঢুকছে না।”

প্রণয় ফট উঠে বসে বলল,” আমারও মাথায় কিছু ঢুকছে না। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি কি বলতে পারো?”

” লটারী!”

প্রণয়ের মুখে চওড়া হাসি ফুটল। উৎফুল্ল কণ্ঠে উচ্চারণ করল সে,” গুড আইডিয়া! আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। কিন্তু তোমার হেল্প লাগবে রাইফা।”

রাইফা গালে হাত রেখে বলল,” ঠিকাছে হেল্প করবো। কিন্তু আমাকেও হেল্প করতে হবে।”

” ভাইয়ার ব্যাপারে? আচ্ছা, হেল্প করবো।”

” ওকে, ডিল ফাইনাল। আমরা দু’জনই দু’জনকে হেল্প করবো।”

______
সূচি বাড়ি ফিরে সামিরকে দেখে খুশিই হলেন। কিছুক্ষণ তাদের মাঝে কুশল বিনিময় হলো। আজমীরের ব্যাপারেও কথা হলো। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে আসছিল। রাইফা তখনও ফেরেনি। সূচি মোবাইল হাতে নিল রাইফাকে ফোন করতে তখনি কলিংবেল বাজল। রাইফা চলে এসেছে। সূচি জিজ্ঞেস করলেন,” কোথায় ছিলে? তুলি বলল তুমি নাকি কোচিং-এ যাওনি?”

রাইফা হাই তুলে উত্তর দিল,” না৷ শরীর ভালো লাগছিল না। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম।”

তন্বি ফিসফিসিয়ে বলল,” ডাক্তারের নাম কি মিস্টার রিসব? পাহাড় থেকে পিএইচডি করে এসেছে যে?”

রাইফা চোখ বড় করে তাকাল। সূচি কথাটা পুরোপুরি শুনতে পেলেন না। কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করলেন,” তন্বি, কি বললে?”

তন্বি পাশ কাটানো গলায় বলল,” কিছু না আন্টি। এমনি পড়াশুনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলাম৷ কোন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করা ভালো হবে?”

” এখন এডমিশনের প্রিপারেশন নাও। পিএইচডি অনেক দেরি আছে।”

তন্বি এবার রাইফার দিকে তাকিয়ে বলল,” বুঝেছিস? পিএইচডি অনেক দেরি। আপাতত এডমিশনের প্রিপারেশন নে।”

রাইফা রাগান্বিত গলায় বলল,” তোকে রিসবের ব্যাপারে কে বলেছে? তুলি?”

তন্বি উত্তর না দিয়ে ফিচেল হাসি দিল। রাইফা তার পিঠে চাপড় মারল। দুপুরে সবাই একসঙ্গে লাঞ্চ করছিল। তখন তন্বি বলল,” সামির ভাই প্রণয়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। প্রণয় যদি কেইসটা তুলে নেয় তাহলে আজমীর ভাইকে ছাড়ানো সহজ হবে।”

তুলি উত্তর দিল না। গম্ভীর হয়ে ভাত খেতে লাগল। সূচি তুলির দিকে চেয়ে বললেন,” আজকে তুমি টিউশনে যাবে না তুলি? তখন সামিরকেও নিয়ে যেও।”

তুলি দ্রুত খাওয়া শেষ করে বলল,” আমি কোথাও যাবো না আজকে। আমার শরীর ভালো নেই। তাই আমি ঘুমাবো। এক্সকিউজ মি।”

সে ঘরে চলে গেল। সামির বুঝতে পারল তুলি তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে ইচ্ছুক না৷ কিন্তু তন্বি বলল,” আমি আপনাকে সন্ধ্যায় নিয়ে যাবো। তখন প্রণয় ভাই বাসায়ই থাকে। নয়তো ফোন করে যাবো।”

সামির নরম হেসে বলল,” থ্যাঙ্কিউ তন্বি।”

রাইফা খেয়াল করল, তুলির আজ ভীষণ মনখারাপ৷ সামির এখানে এসেছে এই জন্য নাকি প্রণয়ের জন্য? বিকালে রাইফা তুলিকে শপিং-এ যাওয়ার প্রস্তাব দিল,” তুলতুলি, চল ঘুরে আসি।”

” কোথায় যাবো?”

” শপিং-এ। যমুনা ফিউচার পার্কে যাই চল।”

” না। আমার ভালো লাগছে না।”
” তুই এমন রোবটের মতো কথা বলছিস কেন আজকে? তোর গলার আওয়াজ কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে। মনে হচ্ছে তুই এখনি কেঁদে ফেলবি।”

তুলি শোয়া থেকে উঠে বসল। রাইফার কাছে প্রকাশ করল তার মনের কষ্ট, ” আমি আজ প্রণয়কে আমার এইম লাইফের কথা বলে দিয়েছি রাফু।”

রাইফা মুচকি হাসল। সে তো আগেই জানে। প্রণয়ের থেকে সব শুনেই এসেছে। তবুও জিজ্ঞেস করল,” প্রণয় কি বলেছে? সে কি অপেক্ষা করবে?”

তুলি টলমল চোখে বলল,” জানি না। আমার মনে হয় অপেক্ষা করবে না। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমি আমার লক্ষ্য পূরণ করবোই। একদিন দেখবি আমার অনেক টাকা হবে। আমি টাকার বিছানায় শুয়ে থাকবো। সবাই আমাকে সমীহ করবে। কেউ আঙুল তুলে কথা বলার সাহস করবে না কারণ আঙুল ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকবে তাদের।”

তুলির চোখ অশ্রুপূর্ণ হলেও কণ্ঠ তেজস্বী। রাইফা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” তোর স্বপ্ন নিশ্চয়ই সত্যি হবে।”

______

সন্ধ্যায় তন্বি সামিরকে নিয়ে চলে গেল প্রণয়দের বাড়িতে। আর রাইফা-তুলি গেল শপিং-এ। যমুনা ফিউচার পার্কে ঢুকে তারা সর্বপ্রথম আইসক্রিম খেল৷ তারপর কিছুক্ষণ ছবি তোলাতুলি হলো। পরে তারা চলে গেল আড়ং-এর আউটলেটে। অনেক লেটেস্ট ডিজাইনের জামা-কাপর ঘুরে-ফিরে দেখছিল তুলি। যদিও এগুলো কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু একদিন সে সব কিনে ফেলবে এমন কল্পনা করেই দেখা। রাইফা অনেকগুলো জামা নিয়ে ট্রায়ালরুমে ঢুকেছে। সে কমপক্ষে চার-পাঁচটা কিনবেই। তুলির দৃষ্টি আটকে গেল একটি দৃষ্টিনন্দন পোশাকে। কামিজটি এতো এলিগ্যান্ট আর চমৎকার যে তুলির চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। সে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে সরে যেতে নিলেই একজন সেলস গার্ল বলল,” ম্যাম, ড্রেসটা ট্রায়াল দিয়ে দেখবেন? আমাদের এক্সক্লুসিভ কালেকশন এটা। মাত্র পাঁচ পিস আছে।”

তুলি ইতস্তত হাসি দিয়ে বলল,” একদম না। এই ড্রেসের প্রাইজ নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। আমার এতো টাকা নেই।”

মুখ মলিন করে কথাটা জানিয়ে তুলি চলে যেতে নিলেই সেলসগার্ল তার হাত চেপে ধরল৷ তুলি একটু অবাক হলো। বিব্রতবোধ করল। সেলসগার্ল উৎসাহী কণ্ঠে বলল,” আপনি চাইলেই এটা নিতে পারেন ম্যাম। আমাদের এখানে ‘লাক হান্টিং’ সেশন চলছে। এই এক্সক্লুসিভ পাঁচটি ড্রেসের মধ্যে একটা কিনলেই পেয়ে যেতে পারেন চল্লিশ লক্ষ টাকা।”

তুলি হকচকিয়ে বলল,” কি? চল্লিশ লক্ষ?”

তার গলা শুকিয়ে গেল। এতোটাকার কথা শুনতেও কেমন যেন লাগে। তবে শরীরে জোশ চলে আসে। তুলি একটু সাহস করে বলল,” ড্রেসটার দাম কত?”

সেলসগার্ল প্রাইজট্যাগ বের করে দেখালো। তুলির কিঞ্চিৎ উৎসাহটুকু সাথে সাথেই নিভে গেল দাম দেখে। হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে সে বলল,” বিয়াল্লিশ হাজার টাকা! এটা অনেক দামী। আমার উপযুক্ত নয়। আপনাদের এই ‘লাক হান্টিং’ সেশন বড়লোকদের জন্য। যে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা ড্রেস কিনতে পারে তার কাছে তো চল্লিশ লক্ষ টাকা কোনো ব্যাপারই না।”

” ম্যাম, আপনি ট্রাই করে দেখুন। আপনার ভাগ্যে থাকতেও পারে! ”

” কিন্তু আমার কাছে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা নেই!”

” ম্যাম আপনি যদি চল্লিশ লক্ষ টাকা জিতে যান তাহলে সেখান থেকে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে বিল পেমেন্ট করে দিবেন। আর বাকি টাকা আপনার! তাহলেই হয়ে গেল। দারুণ সুযোগ কিন্তু।”

তুলি তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল,” আর যদি আমি টাকা না জিতি?”

সেলসগার্ল বিভ্রান্ত হয়ে তাকাল। তুলি আর কিছু না বলে চলে এলো। তখন রাইফা তার হাত টেনে বলল,” এই গাধী, অফারটা মিস করলি কেন? তোর না বড়লোক হওয়ার খুব শখ? একবার চেষ্টা করে দেখলেই তো পারিস!”

তুলি মনখারাপ নিয়ে বলল,” কিন্তু আমি টাকা না জিতলে পরে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা কিভাবে দিবো? পুলিশ এসে আমাকে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে যাবে।”

” কেউ তোকে থানায় নিবে না। তুই না জিতলে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা আমি দিয়ে দিবো। প্রয়োজনে আম্মুর কাছে চাইবো।”

তুলি মুখ শক্ত করে বলল,” আমি তোর টাকা কেন নিবো?”

” তোর নিতে হবে না। তুই লটারী না জিতলে এই ড্রেস আমাকে দিয়ে দিস। আমি পরবো। তাহলেই হয়ে গেল।”

” দরকার নেই রাইফা। আমি জানি এসবে কিছু হবে না। আমার মতো অভাগীর আবার লটারীতে ভাগ্য লাগবে? ইম্পসিবল!”

” নাথিং ইজ ইম্পসিবল!”

রাইফার জোরাজুরিতে অবশেষে তুলি জামাটা কিনতে রাজি হলো। তারপর তাদের রিসেপশনে ডাকা হলো। একটা স্ক্র্যাচ কার্ড লাগানো ছিল জামার সঙ্গে। সেই স্ক্র্যাচ কার্ড ঘঁষে নাম্বারটা মিলাতে হবে সাইনবোর্ডে দেওয়া নাম্বারের সাথে। আউটলেটে যত মানুষ ছিল, সবাই ভীড় জমিয়ে দাঁড়ালো। মুহূর্তেই একটি চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। তুলির দেখাদেখি আরও অনেকেই ড্রেসটা কিনল। পাঁচ পিস অনায়াসে বিক্রি হয়ে গেল। কিন্তু দূর্ভাগারা কেউ জানল না, এই লটারী কেবল নির্দিষ্ট একজনের জন্যেই বরাদ্দ ছিল৷ যে মেয়েটি তার ভাবনার চেয়েও অধিক ভাগ্যবতী ছিল।

_____

চলবে

#বেদনার_রঙ_নীল
একত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

রিকশায় আটসাঁট হয়ে বসে আছে সামির-তন্বি। সামির খুব স্বাস্থ্যবান হওয়ায় বসার জন্য তার জায়গা বেশি প্রয়োজন। তন্বি সেই তুলনায় শুকনো কাঠির মতো। তার অর্ধেকেরও কম জায়গা লাগে বসতে। ব্যালেন্স হয়ে যাওয়ার কথা। তবুও তন্বির মনে হচ্ছে, বেশি চাপাচাপি। সামিরের উরুর সাথে তার উরু ঘঁষা খাচ্ছে। কি বিশ্রী ব্যাপার! তন্বি অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল,” আস্তে চালান, মামা।”

সামির ভ্রু কুচকে বলল,” জোরেই চলুক। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আজমীর হারা*মজাদাকে জুতাপেটা করতে পারলে ভালো লাগতো।”

তন্বি আহত কণ্ঠে বলল,” আপনি শান্ত হোন, প্লিজ।”

সামির স্বগতোক্তির মতো বলতে লাগল,” প্রণয় ছেলেটা ভদ্র। এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও বলছে মামলা তুলবে। অন্যকেউ হলে ঝামেলা করতো। আজমীর এইরকম ঘটনা আরও কতবার ঘটিয়েছে, জানো? এমন না যে এইটাই প্রথম। তার মানুষ মে/রে ফেলার খুব শখ। দিন দিন জানোয়ার হয়ে যাচ্ছে। বাবা তো এখন ওর পেছনে একটা পয়সাও খরচ করতে রাজি না। আমি এতোদূর থেকে কষ্ট করে এসেছিলাম ওকে বাঁচানোর জন্য। অথচ সে কি করল আমার সাথে দেখলে? বেইমান!”

তন্বির চোখ টলমল করছে। সামির খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাগুলো বললেও তার বুকভরা ব্যথা উপলব্ধি করা যাচ্ছে। তন্বির কষ্ট হচ্ছে।

আজ প্রণয়ের সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়িতে গিয়েছিল সামির আর তন্বি। তাদের সঙ্গে উকিলও ছিল। প্রণয় বলেছে সে আজমীরের বিরুদ্ধে মামলা উঠিয়ে নিবে। প্রিয়ন্তীকেও ডাকা হলো। এক্সিডেন্টের সময় প্রিয়ন্তীও সেখানে ছিল। তার কারণেই প্রণয় বেঁচে আছে। সে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। তারপর প্রণয়কে নিয়েই থানায় গিয়েছিল সবাই। অথচ আজমীরকে জেল থেকে বের করার পর সে আবার প্রণয়কে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো। তার এহেন দুঃসাহস দেখে সামির চড় মেরে দিল। আজমীর ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ধাক্কা মেরে সামিরের মাথা ফাঁটিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করল না। তন্বি এসব দেখে কয়েক মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। বাজে একটা হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রণয় যখন প্রথমে বলেছিল,” তোকে আমি মাফ করে দিয়েছি। ”

তখনি আজমীর তেড়ে এসেছিল তার দিকে। দুই-তিনজন কন্সটেবল তাকে থামাল। সে বাতাসে লাথি মেরে বলল,” তোর মাফের কোনো পরোয়া করি না আমি। তুলির থেকে দূরে থাকবি। খবরদার যদি ওর আশেপাশে যাওয়ার চেষ্টা করিস তাহলে জানে মেরে ফেলবো। এবার তোকে আমি অবশ্যই মারবো।”

প্রণয় চোখ গরম করে বলল,” তুলির নাম মুখেও আনবি না তুই। এমন ব্যবস্থা করবো যে সারাজীবন কারাগারে পঁচে মরবি।”

আজমীর অদ্ভুতভাবে হাসতে হাসতে বলল,” দেখি আমার কি করতে পারিস তুই।”

সামির আর তন্বি থানা থেকে বের হয়ে এলো। সামিরের শরীরটা ভালো লাগছিল না। জ্বর আসবে মনে হয় তার। তন্বি রিকশায় ওঠার পর ভাবল একবার সামিরের কপালে হাত দিয়ে দেখবে জ্বর আছে কি-নেই!

প্রণয় রুক্ষ মেজাজ নিয়ে থানা থেকে বের হলো। আজমীরকে সে চিনতে অনেক বড় ভুল করেছে। বন্ধু নির্বাচনে এতোবড় ভুল প্রণয়ের কখনও হয়নি। ওইদিন রাতে যখন সে আজমীরের আহ্বানে কার রেইসিং চ্যালেঞ্জে ছুটে গিয়েছিল তখন তার মাথায় চিন্তা ছিল আজমীর হয়তো তার সঙ্গে লড়তে চায়। কিন্তু তার ক্ষতি করতে চায় না। তারা কিছুক্ষণ যুদ্ধ করবে, ঝগড়া করবে, মারামারি করবে, তারপর একপর্যায় সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা হাসবে। তাদের মধ্যকার সকল ভুল বুঝাবুঝি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজমীর যে তার জন্য মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রাখবে সেটা কল্পনাও করেনি প্রণয়। মানুষ নিজে যেমন, অন্যকাউকে ভাবেও তেমন। আজমীরের জায়গায় প্রণয় থাকলে কখনও এমন করতে পারতো না। তাই সে আজমীরের থেকেও এমন ভয়ানক বিশ্বাসঘাতকতা আশা করেনি। তবুও সামিরকে দেখে প্রণয়ের মায়া হয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আজমীরকে ক্ষমা করবে। কিন্তু আজমীর তো ক্ষমারও অযোগ্য!

” আমি আগেই বলেছিলাম৷ আজমীরকে দয়া দেখানোর প্রয়োজন নেই। সে ভালো মানুষ না। তুই কখনও আমার কথা বিশ্বাস করিস না প্রণয়। আর সবসময় বিপদে পড়িস।”

প্রণয় দায়সারা কণ্ঠে বলল,” এখান থেকে আমি চলে যেতে চাই।”

প্রিয়ন্তী প্রণয়ের কাঁধে হাত রাখল। মৃদু সুরে প্রস্তাব দিল,” চল আমরা কোথাও গিয়ে বসি। একটু গল্প করি? ভালো লাগবে তোর। আর আমারও ভালো লাগবে।”

প্রণয়ের ফোন বাজল তখনি। রাইফার নাম্বার দেখে তার ঠোঁটে হাসি এলো। প্রিয়ন্তীর থেকে একটু দূরে গিয়েই ফোন রিসিভ করল সে।

” হ্যালো রাইফা!”

” গুড নিউজ প্রণয়। জানো কি হয়েছে?”

” ওয়েট, তুমি কি লাউড স্পিকারে কথা বলছো?”

” না। কিন্তু তুলি এই মুহূর্তে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে চল্লিশ লক্ষ টাকার লটারী জিতে গেছে! তুমি কি চিন্তা করতে পারছো? চল্লিশ লক্ষ টাকা!”

প্রণয় ঝলমলে দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে হাসল। রাইফা উল্লাসে চিৎকার দিয়ে বলল,” ইয়াহু! আমি তো অনেক হ্যাপি। আজকে তুলি বলেছে আমাকে ট্রিট দিবে। তুমিও চলে আসো। আমরা যমুনা ফিউচার পার্কে আছি। এড্রেস তোমাকে টেক্সট করছি। আসবে তো?”

প্রণয় তীব্র আনন্দ নিয়ে বলল,” কেন আসবো না? এমন একটা গুড নিউজ পাওয়ার পরেও কি না এসে থাকা যায়?”

” হুম, হুম, জলদি এসো। তুলি এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু। বোকার মতো তাকিয়ে আছে আমার দিকে।”

প্রণয়ের খুব ইচ্ছে করছে তুলির মুখ দেখতে। সে প্রশান্তিময় নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” আসছি আমি।”

ফোন রাখতেই পেছন থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল প্রিয়ন্তী,” কিসের গুড নিউজের কথা বলছিস তুই?”

প্রণয় হাসি মাখা কণ্ঠে জানাল,” তুলি লটারীতে চল্লিশ লাখ টাকা জিতেছে।”

” হোয়াট?” প্রিয়ন্তী যেন বিশ্বাসই করতে পারল না। হঠাৎ কিভাবে সম্ভব? কিসের লটারী?
____
তুলিকে সবাই অভিবাদন জানাচ্ছে। তুলির মুখে হাসি নেই। তবে চোখ ছলছল করছে। সে জড়ানো কণ্ঠে সবাইকে উত্তর দিচ্ছে, “ধন্যবাদ।”

কোঁকড়ানো চুলের একটি মেয়ে বলল,” আপনার ড্রেসটা কিন্তু আমি প্রথমে নিতে চেয়েছিলাম। আপুটা আমাকে নিতে দেয়নি। কারণ আপনি নাকি আগেই বুক করে ফেলেছিলেন। ইশ, যদি আরেকটু আগে আসতাম তাহলে হয়তো লটারী আমিই পেয়ে যেতাম। যাইহোক, শুভকামনা আপনার জন্য। ভালো থাকবেন। কংগ্রেটস!”

” থ্যাঙ্কিউ। ” তুলির সেই মুহূর্তে মাথায় ব্যাপারটা এলো না। সে তো ড্রেস বুক করেনি। সেলস গার্ল তার হাতে যেটা তুলে দিয়েছে সেটাই সে নিয়েছে। এই মুহূর্তে তুলির মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে চোখে ঝাপসা দেখছে আর সবার কথা আবছা শুনতে পাচ্ছে। রাইফা তার সামনে এসে চঞ্চল গলায় বলল,” এই তুলি, ড্রেসটা কি ট্রায়াল দিবি? এইটা তোর লাকি ড্রেস। সবাই বলছে এই ড্রেস পরে তোকে ছবি তুলতে হবে। সেই ছবি ব্যানারে টাঙানো হবে। আয়, আয়!”

তুলি ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিল৷ রাইফা তাকে হাত ধরে টেনে ট্রায়াল রুমে নিয়ে এলো। তুলি আয়নায় নিজেকে দেখে থমকালো। তারপর এক ধ্যানে তাকিয়েই রইল। এখনও সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার। এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে না তো? রাইফা জামাটা তুলির গায়ের উপর মেলে ধরল। অবাক বিস্ময়ে বলল,” ওয়াও, তোকে পরীর মতো লাগছে একদম!”

তুলি মৃদু হাসল। সাথে সাথেই বাম চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা জল। রাইফা তার চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বলল,” উফ, কাঁদার কি হলো? আগে সেলিব্রেশন। পরে কান্নাকাটি। জোরে একটা চিৎকার দে তো! বল ইয়াহু!”

তুলি ভাঙা কণ্ঠে বলল,” রাইফা তুই এখান থেকে একটু যা প্লিজ।”

রাইফা থামল। ক্ষণকাল নীরব থেকে সহজ গলায় বলল,” আচ্ছা যাচ্ছি। তুই কিন্তু ড্রেসটা পরেই বের হবি।”

সে বাইরে যেতেই তুলি দরজা আটকে দিল৷ তারপর আস্তে করে বসে পড়ল মেঝেতে। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে মুখ টিপে ধরল। বেরিয়ে এলো বহুদিনের জমানো সেই কান্না!

ঈদের আগের রাত। তুলির সৎ ভাই-বোনেরা হৈ-হুল্লায় ব্যস্ত। তারা সবাই নিজেদের পছন্দমতো জামা কিনেছে। তাই নিয়েই গল্প হচ্ছে৷ হাসি-আনন্দে মেতে উঠেছে সন্ধ্যা। এতো হাসাহাসির কি আছে ছোট্ট তুলি বুঝতে পারে না। ঈদ বলে কথা! ঈদের আগে বাবার হাত ধরে মার্কেটে গিয়ে নতুন জামা কেনার খুশি তুলি কি করে বুঝবে? তুলির বাবা নেই। তবে একজন আছে, সৎ ভাই-বোনেরা তাকে ‘বাবা’ বলেই ডাকে। তুলি তাকে কখনও ‘বাবা’ ডাকার সুযোগ পায়নি। কেন পায়নি তা সে বুঝতো না। মা রান্নাঘরে মুখে আঁচল চেপে বসে থাকতো। তুলি ভাবতো, মায়ের শরীর ভালো নেই। শরীর খারাপ লাগলেই মুখে আঁচল চেপে রাখে মা। কিন্তু আসলে শরীর খারাপ নয়। মনখারাপ হলেই মা মুখে আঁচল চেপে রাখে। এটা মায়ের কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা ছিল। যা এখন তুলি বুঝতে পারে। তখন বুঝতো না। সবার আনন্দ দেখে তুলি যখন প্রশ্ন করল মাকে,” ওরা কি নিয়ে এতো খুশি মা?” তখন মা বলেছিল,” কাল ঈদ। তাই সবাই আনন্দ করে, মা।”

তুলি আগ্রহী কণ্ঠে জানতে চাইল,” আমাদের ঈদ নেই?”

” না। নেই।”

” কেন নেই?”

” আমাদের ঈদ মরে গেছে।”

তুলি তখন বুঝেনি, ঈদ মরে যাওয়া মানে কি? তবে এখন তুলি জানে, ঈদ মানে খুশি। আর তাদের ঈদ মরে গেছিল মানে তাদের খুশিগুলোই মরে গিয়েছিল!

দরজায় করাঘাতের শব্দ হলো হঠাৎ। রাইফা ফিসফিসানো গলায় বলল,” এতোক্ষণ ধরে কি করছিস তুলি? দ্রুত বের হো না!”

তুলি দুই হাতে চোখ মুছল। আরে, সে কি করছে এসব? তার খুশিগুলো সে আবার মরে যেতে দিবে না। আজ সে অনেক খুশি থাকবে। কারণ আজ তার খুশি হওয়ারই তো দিন! তুলি উঠে দাঁড়ালো। উপরে তাকিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু আকাশ তো দেখা যাচ্ছে না! আচ্ছা, মা কি তাকে দেখতে পাচ্ছে? মা তাকে দেখতে পেলেই হলো। তুলি চোখ বুঁজে নরম কণ্ঠে আওড়ালো,” আমাকে কি তুমি দেখছো মা? আমি ভালো আছি। অনেক ভালো আছি! আমি বিজয়ের পথে হাঁটছি। আমার স্বপ্নগুলো পূরণ হয়ে যাচ্ছে মা। কিন্তু তুমি আমার পাশে কেন নেই? আমার খুব আফসোস হয়। কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার চেয়েও বেশি কষ্ট এই আফসোসে!”

সেলসগার্ল প্রণয়কে দেখেই ছুটে এলো। দুইহাত একত্র করে প্রফুল্লচিত্তে জানাল,” স্যার, আপনার আইডিয়াটা আমাদের অনেক ভালো লেগেছে। আমরা আপনাদের দু’জনের ছবি তুলে ওয়েবসাইটে পোস্ট করতে চাই।”

প্রিয়ন্তীও প্রণয়ের পাশে ছিল। সে এইসব কথার মানে বুঝতে পারছিল না। প্রণয় কঠিন গলায় বলল,” একদম না। আপনারা এই বিষয় নিয়ে কিছুই করবেন না। ব্যাপারটা এখানেই শেষ। তুলি… মানে লটারী বিজয়ী মেয়েটা যেন কখনও কিছু বুঝতে না পারে।”

প্রিয়ন্তী প্রশ্ন করল,” কোন ব্যাপার?”

সেলস গার্ল দমে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” স্যরি স্যার। আসলে এভাবে প্রিয়জনকে সারপ্রাইজ দেওয়ার আইডিয়াটা খুব ইউনিক। তাই আমরা শেয়ার করতে চেয়েছিলাম।”

প্রণয় অনুরোধ করল,” এটা কোনো সারপ্রাইজ না। এটা সিকরেট। আপনাকে আগেও বলেছিলাম। গোপন রাখতে হবে। প্লিজ সবকিছু গোপন রাখুন! আমার নাম যেন কোনোভাবেই প্রকাশ না হয়।”

” ওকে স্যার। স্যরি এগেইন।”

প্রণয় হেসে আন্তরিকভাবে বলল,” বাই দ্যা ওয়ে আপনারা আমাকে অনেক হেল্প করেছেন এজন্য থ্যাংকস। আমি খুবই কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। গ্র্যাটিটিউড!”

” আমাদেরও এতে যথেষ্ট লাভ হয়েছে। আপনার জন্য বেস্ট অফ লাক। দোয়া করি আপনার সাথে ম্যামের দ্রুত বিয়ে হোক।”

প্রণয় খুশি হয়ে বলল,” ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস।”

প্রিয়ন্তীর মাথা ভনভন করছে। সে বিষমচিত্তে বলল,” প্রণয় তুই এটা কি করলি? মানে ফাজলামি নাকি? চল্লিশ লাখ টাকা!

” তুলির সামনে এসব উচ্চারণ করবি না, প্লিজ।”

প্রিয়ন্তী রাগে গজগজ করে অন্যদিকে তাকালো। তার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। এসব কি ধরণের পাগলামি? ভালোবাসা ভালো কথা তাই বলে এমন ন্যাকামো করতে হবে? চল্লিশ লাখ টাকার লটারী জিতিয়ে দিতে হবে!

গোলাপি আভার মিষ্টি রঙা জামাটিতে তুলিকে ঐশ্বরিক আভিজাত্যপূর্ণ কোনো রাজকন্যা মনে হচ্ছে। তার দেহের রঙের সাথে জামার রঙটা অসম্ভব মানিয়ে গেছে। প্রণয়ের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা বিরাজ করছে। সে ভাবেওনি এই জামায় তুলিকে এতো ভালো লাগবে। তুলির চোখেমুখে খুশির জৌলুস। বিজয়ীনির মতো হাসি। এজন্যই কি তুলিকে অন্যদিনের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে আজ? প্রণয়ের তো ইচ্ছে করছে পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে তুলিকে নিয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে৷ তারপর সারাক্ষণ একান্তে বসে তুলিকে দেখতে থাকবে সে।

” এহেম, এহেম, একটু এদিকেও তাকাও। মেন্যুবুকটা দেখো মিস্টার প্রণয়!”

প্রণয় চমকে তাকাল। রাইফা তার কথা শেষ করেই হাসছে। পাশে প্রিয়ন্তী গোমরা মুখে বসে আছে৷ প্রণয়ের মনোযোগ এতোক্ষণ তুলির দিকে ছিল। সে সামান্য বিব্রতবোধ করল। তারা যমুনার ফুডকোর্টে এসে বসেছে। তুলি মেন্যুবুক হাতে নিয়ে উল্লাসভরা কণ্ঠে বলল,” আজকে কোনো লিমিট নেই। যে যত ইচ্ছা অর্ডার করো। প্রয়োজনে পুরো ফুডকোর্ট কিনে ফেলবো। সব আমাদের!”

প্রিয়ন্তী ফিসফিস করে বলল,” ন্যাকা!”

তুলি কথাটা খেয়াল করেই ভ্রু কুচকে তাকাল। প্রণয় পাশ কাটানো গলায় বলল,” হ্যাঁ অবশ্যই। আজকে আমি সব আইটেম ট্রাই করে দেখবো। কিছু বেঁচে গেলে পার্সেল নিয়ে যাবো।”

তুলি হাসল। সে আজ অকারণেই হাসছে। মুখ থেকে হাসি সরছেই না৷ এতো সুন্দর কিভাবে হলো এই দিনটা? প্রিয়ন্তী উঠে বলল,” তোমরা খাওয়া-দাওয়া করো। আমি নিচে ওয়েট করছি।”

তুলি অবাক হয়ে জানতে চাইল,” কেন? তুমি আমাদের সাথে খাবে না আপু?”

” আমার ক্ষিদে নেই, কাজ আছে। তোমরা ইঞ্জয় করো।”

তুলি আর কিছু বলল না। প্রিয়ন্তী না থাকলেই ভালো। এভাবে সব অপছন্দের জিনিস চলে যাক। আজকের এই সুন্দর দিনটি শুধু তার! প্রিয়ন্তী চলে যেতেই প্রণয়ও উঠে দাঁড়ালো। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সেও কোথায় যেন চলে গেল। তুলি রাইফার হাত চেপে ধরে বলল,” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না রাফু। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুই!”

রাইফা নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল। তুলির খুশি দেখে সেও খুশিতে টইটম্বুর হয়ে যাচ্ছে আজ। প্রণয়কে ধন্যবাদ! এতো দারুণ একটা কাজ করার জন্য তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!

প্রিয়ন্তী লিফটে উঠে যাচ্ছিল। প্রণয় হাত দিয়ে থামালো তাকে। দরাজ গলায় বলল,

” দাঁড়া প্রিয়ু, তোর সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে।”

প্রিয়ন্তী গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল,” কি কথা?”

” তুই তুলির সামনে এমন মুখ ভার করে বসেছিলি কেন? আর এভাবে উঠে চলে এলি কেন? সে কি ভাববে?”

” তো আমার এখন কি করা উচিৎ? যাই গিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে নাচি?”

” অন্তত হাসি-খুশি ভাবে কথা বলতে পারতি ওর সাথে! একটা ভালো ঘটনা ঘটেছে। আর তুই এমন ভাব করছিস যেন ঈর্ষা করছিস।”

প্রিয়ন্তী হাসল। হাত ভাঁজ করে বলল,” এতোক্ষণে তুই লাইনে এসেছিস।”

” তোর প্রবলেমটা কি? এমন করছিস কেন?”

” কারণ তুই যেটা করেছিস সেটা একটা ধোঁকা। তোর কি মনে হয় খুব মহান কাজ করে ফেলেছিস?”

প্রণয় মৃদু হেসে বলল,” একটু ধোঁকার আশ্রয় নিয়ে যদি তুলিকে এতোখানি খুশি করা যায় তাহলে এমন ধোঁকা আমি সবসময় দিতে প্রস্তুত।”

প্রিয়ন্তী এবার তাচ্ছিল্য হাসল। ধারালো ছুরির ন্যায় আঘাত করা কণ্ঠে বলল,” কিন্তু দিনশেষে তুই হবি একটা ধোঁকাবাজ। যার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে চাইছিস তাকে মিথ্যা বলতে লজ্জা করে না? আমি তুলির জায়গায় হলে তোকে কোনোদিন মাফ করতাম না। ছি!”

প্রিয়ন্তী লিফটের বাটন চেপে ধরল। ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ প্রণয় তাকিয়ে রইল স্তব্ধ দৃষ্টিতে। অবাক চোখে। ঠিক এই সময় তুলির কণ্ঠ ভেসে এলো,” প্রিয়ন্তী আপু!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here