#চন্দ্ররাতের_মায়া
#সূচনা_পর্ব
#জয়ন্ত_কুমার_জয়
– আমার পেটের বেবিটা মনে হয় আর বেঁচে নেই তীব্র।
মাঝরাতে শরীর ঝাকিয়ে ডেকে তুলে আমার স্ত্রী নন্দিতা কথাটি বললো।আমার ঘুমঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে অনেকটা রেগে গিয়েই বললাম
– এসব কি কথা বলছো নন্দিতা?
– আমি সত্যিই বলছি।বেবিটা নড়াচড়া করছে না গতকাল থেকে।
এবার আমি একটু অবাক হলাম।বিছানায় বসে চশমাটা চোখে দিলাম।নন্দিতা কাঁদো কাঁদো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি পর পেটে কিছুক্ষণ হাত দিয়ে দিয়ে রাখলাম।মুহুর্তেই আমার শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকলো।নন্দিতা ঠিকই বলছে।পেটের বেবি টা সত্যি’ই নড়াচড়া করছে না।নন্দিতা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো
– ওরা আবার আমার বেবিটাকে মেরে ফেলেছে তীব্র,ওরা আবার আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছে
বলেই আমায় জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম।আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না।নন্দিতার কান্নার শব্দে সারা বাড়ির লোকজন জেগে গেলো।বাবা,মা,বড় ভাই,ভাবী সবাই আমার রুমে আসলো।ভাবী এসে নন্দিতাকে ধরে বললো
ভাবী- কি হয়েছে নন্দিতা? কাঁদছিস কেনো?এই অবস্থায় কাঁদা তো ঠিক না,এতে বেবির সমস্যা হবে তো বোন
মা- কি হয়েছে বৌ মা? এতোরাতে কাঁদছো কেনো? বলো আমাদের? তীব্র কিছু বলেছে?
বাবা- তীব্র কি হয়েছে রে? বৌমাকে কিছু বলেছিস নাকি?
সবার প্রশ্ন যেনো আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এখন আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।ভয়ে আমার শরীর হিম হয়ে আসছে।নিজের সন্তানকে এভাবে প্রত্যকবার হারানো একটা বাবার কাছে যে কতোটা কষ্টদায়ক সেটা একজন বাবাই জানেন।নন্দিতা ভাবীকে উদ্দেশ্য করে কান্না করতে করতে বললো-
– ভাবী,আমাদের বেবি আর বেঁচে নেই,
কথাটা শুনে মা,বাবা,ভাইয়া,ভাবী সবাই চমকে উঠলো।মা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললেন-
– কি বললে বৌ মা? আমার দাদুভাই আর নেই মানে, কি অলক্ষুণে কথা বললে তুমি?
ভাবী- নন্দিতা শান্ত হয়ে বোস তো। কিভাবে বুঝলি বেবিটা বেঁচে নেই?
নন্দিতা- ও নড়াচড়া করছে না ভাবী।কাল সকাল থেকে ও নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিয়েছে।আমি ভেবেছিলাম পরে ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু এখন”
নন্দিতার কথা শুনে ভাবী নন্দিতার পেটে কিছুক্ষণ হাত রাখলেন।রেখেই চোখ সংকুচিত করে ভাইয়ার দিকে তাকালেন।এর অর্থ নন্দিতা যা বলছে সেটা সত্যি।
ভাইয়া বলে উঠলেন-
– ওসব চিন্তা ভাবনা বাদ দাও,ওই রকম কিছুই হয় নি। তোমরা মিছেই চিন্তা করছো।আমি এমবুলেন্স কে ফোন করছি।মেডিকেলে পরিক্ষা করলেই বুঝা যাবে আসল সত্যি কি। কিরে তীব্র তুই কিছু বল?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম
– হ্যা,?হ্যা হসপিটালে নিয়ে গিয়ে পরিক্ষা করলেই সব বুঝা যাবে।
ভাইয়া এম্বুলেন্স কে ফোন করলো।আমি নন্দিতার মাথায় হাত বুলাচ্ছি আর ওকে শান্তনা দিচ্ছি।ভেতরে ভেতরে আমার আবারো সেই অজানা ভয় কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।মা দরজার কাছে গিয়ে কান্না করছে আর বলছে
– সব এই অপয়া মেয়েটার দোষ।ও আমার ছেলেটার জীবনে একটা খুশির সংবাদ এনে দিতে পারলো না।অলক্ষুণে মেয়ে।বিয়ের সময় বার বার বলেঋিলাম এই মেয়েকে বিয়ে করিস না,একে দেখে আমার সুবিধার ঠেকছে না।এখন হলো তো? সর্বনাশের কিছু বাকি রইলো? এক বার নয় দুই বার নয়,,তিন তিন বার।এই নিয়ে তিনবার হলো বাচ্চা নষ্ট হওয়ার।এই সব এই কুলাঙ্গার মেয়ের দোষ।
মাকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললেন-
– তুমি চুপ করবে? এখন এসব কথা না বললেই কি নয়?একে দেখছোই এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে কিসের কি তুমি শান্তনা দিবে তা না করে উল্টো পাল্টা বকে যাচ্ছো।
– তুমি চুপ থাকো।ওই অপয়া মেয়ের দিকে হয়ে কথা বলবে না একদম।ওই মেয়েকে আমি আর বাড়িতে রাখবে না।আমার ওমন সুন্দর একটা ছেলের জীবন এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হতে দিবো না। আমি তীব্র কে আবার বিয়ে করাবো।
– ইউ ব্লাডি ও-ম্যান,
কথাটি বলেই বাবা মায়ের দিকে তেড়ে গেলো।ভাইয়া তখন বাবাকে থামিয়ে দিয়ে মা কে বললো “মা তুমি প্লিজ এখন চুপ করো।এসব কথা এখন বলার মানে হয় না”। বাইরে সাইরেন বাজার শব্দ হচ্ছে।নন্দিতাকে এম্বুলেন্সে তুলে আমি ভাইয়া আর ভাবী গেলাম সাথে। বেডে আধশোয়া হয়ে আছপ নন্দিতা।তার পাশেই বসে আছি আমি।ও অনবরত কেদেই চলেছে।আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে বসে আছি।নন্দিতা আমার দিকে করুন দৃষ্টি নিয়ে বললো
– তীব্র, আমি তোমায় কখনো বাবর সুখ দিতে পারবো না।তুমি আবার বিয়ে করে নাও প্লিজ।আমার জন্য তোমার কষ্ট আমি মেনে নিতে পারছি না।
– প্লিজ নন্দিতা চুপ করো তুমি। ডাক্তাররা এখনি চলে আসবে।রিপোর্ট আসলে দেখা যাবে আমরা যেমন ভাবছি তেমন কিছুই হয় নি।তুমি মনে সাহস রাখো।
– কিছুই ঠিক হবে না তীব্র। আমি জানি
– কি জানো তুমি?
– আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম গত পরশুদিন
– কি স্বপ্ন? আগে তো বলোনি
– আগে বলিনি কারন তোমার মন খারাপ হবে এজন্য বলিনি
– এখন বলো,কি দেখে ছিলে স্বপ্নে তুমি?
– আমি দেখলাম একটা বাচ্চা মেয়ে আমার চার দিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মেয়েটার পরনে শাদা ধবধবে একটা ফ্রগ ছিলো।চোখ দুটি নীল।কি সুন্দর চুল। একটা প্রজাপতির পেছন পেছন ছুটে বেড়াচ্ছে।
– আর কি?
– আর মেয়েটা হঠাৎ হঠাৎ আমার দিকে তাকাচ্ছে আর মা,মা বলে ডাকছে।আর আমি প্রত্যেকবার তার মা ডাকে চমকে উঠছি,।তখনই
নন্দিতা থেমে গেলো।হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললো কিছুনা,বাদ দাও।আমি জোর করে বলতে বললাম-
-তখনই? তখনই কি নন্দিতা?
– তখন কোথা থেকে যেনো তুমি এলে।মেয়লটা তোমায় দেখে বলতে লাগলো মা, আমায় বাঁচাও মা,মা ওই লোকটা আমায় নিয়ে যেতে এসেছে মা।প্রত্যেকবার এই লোকটাই আমায় মেরে ফেলে মা।আমার তুমি বাঁচাও।
– আমায় দেখে মেয়েটা এরকম বললো?
– হুম
– তারপর?
– তুমি এসে মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছো।আমি শত চেষ্টার পরেও আটকাতে পারছি না।তোমার পা ধরে ওকে ভিক্ষা চাইলাম, তুমি আমায় লাথি মেরে ওই মেয়েটাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছো।আমি মাটিতে পড়ে কাঁদতে লাগলাম।তুমি তখন মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছো বর বলছো,” আমি থাকতে তোর কোনো সন্তান হতে দিবো না আমি।এবারেও মেরে ফেললাম।বলেই একটা বিকট হাসি দিলে”
নন্দিতা এবার বলা শেষ করে আমায় জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কেনো নন্দিতা এরকম স্বপ্ন দেখলো।আর কেনোই বা আমায় সেখানে এরুপ পাষানের মতো কাজ করতে দেখলো।আমিই কি না প্রত্যেকবার নিজের সন্তানকে মেরে ফেলি?।ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ডাক্তার আসলো।তারা নন্দিতাকে নিয়ে গেলো এক্স রে করাতে।নিয়ে যাওয়ার সময় নন্দিতা আমায় দেখে আনেক কাদলো।আমি শুধু তাকে অভয় দিলাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে” কথাটা বলে।আমি আর ভাইয়া বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মনে মনে ভাবলাম পুরনো সেসব কথা। আমাদের বিবাহের সাত বছর অতিবাহিত হয়েছে।এই নিয়ে তিনবার নন্দিতা সন্তানসম্ভবা হলো।কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো ভাবে আমাদের সন্তানটা নষ্ট হয়ে যায়।প্রথমবার সে একটা মৃত শিশু জন্ম দিলো।এরপর জন্মের পর কাছে গিয়ে দোলনায় দেখলাম কোনো সন্তান নেই। আর এখন!!
এর ব্যাখ্যা আমাদের কাছে আজো নেই।
ডাক্তাররা রিপোর্ট দেখতে গিয়ে মনে হলো চরম আতঙ্কে পড়ে গেলেন।তারাও হাতের পিঠ দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে নন্দিতার দিকে ভীতু নজরে তাকালো।
এরপর আমায় সাইডে এনে বললেন-
– মিঃতীব্র,আপনার স্ত্রীর পেটে কোনো সন্তান নেই।কখনো ছিলোও না।
চলবে