#তোমায়_চেয়েছি_পুরোটাই
#পার্টঃ২৭,২৮
#জয়ন্ত_কুমার_জয়
২৭
হোস্টেলে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া খু’নের পর সেখানে যেসব মেয়ে ছিলো তারা সবাই হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছে।এইসব রেশ বেশিদিন থাকে না,তাই পুনরায় হোস্টেলে মেয়েরা আসতে শুরু করেছে।মিষ্টি অনেক রিকুয়েষ্ট করার পর হোস্টেলের মালকিন তাকে হোস্টেলে তুলেন।মালকিনের কথা হলো যারা চলে গিয়েছে তাদের আর তুলবেন না,কিন্তু মিষ্টির ক্ষেত্রে বিষয়টা তিনি নড়চড় করলেন।মিষ্টি তার আগের রুমটাতেই উঠেছে।পুরনো রুমে মায়া জমে থাকে,সেটা কাটানো খুব মুশকিল। মিষ্টি রুমমেট ছিলো তিশা।কিন্তু তিশা এখন বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করছে।মিষ্টি রুমে একা।শুনেছে আজকে একটা মেয়েকে তার রুমে তোলা হবে।মেয়েটা জুনিয়র। মিষ্টি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে মেয়েটার জন্য।
কাল রাতে ঘুম হয়নি।মিষ্টি জানালার পর্দা নেমে শুয়ে পড়লো।ঘুম ভাঙ্গলো দরজার টকটক শব্দে।ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলেই একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখলো।মেয়েটা বললো
” আপু আপনার নাম কি মিষ্টি? ”
” হ্যা ”
” আমার নাম মেঘ।এই হোস্টেলে আজকেই উঠেছি,এইখানে মনে হয় আমার থাকার কথা ছিলো ”
” হ্যা আন্টি বলেছে আমাকে,আপনি ভেতরে আসুন ”
” ধন্যবাদ আপু ”
মিষ্টি চুপচাপ বিছানায় পা তুলে বসে আছে।মেঘ নামের মেয়েটা পুরো রুমটা চোখ বুলাচ্ছে।মিষ্টি একটু অবাক হলো মেয়েটাকে দেখে।মেয়েটা রুপবতী,শুধুই রুপবতী নয়,বেশ রুপবতী, কথা এমন আন্তরিক ভঙ্গিতে বলে যে মনে হয় কত যুগ ধরে তাদের পরিচয়।
” আপু আমি ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি।তুমি কিসে পড়ো? ”
” আমি অনার্সে, দ্বিতীয় বর্ষ ”
” তোমার চুলগুলা কি স্ট্রেইট করা? ”
কথাটা বলতে বলতে মেঘ মিষ্টির চুলে হাত রেখে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।মিষ্টি হেসে বললো ” না,ন্যাচালারি এরকম “।
মেঘকে মিষ্টির খুব পছন্দ হলো।কিছুক্ষণ গল্প করেই বুঝতে পারলো মেঘ একটা চমৎকার মেয়ে।কিছু কিছু মেয়ে থাকে,যারা যেকোনো বয়সের কারো সঙ্গে অনায়াসে বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারে,এরা সিনিয়র জুনিয়র সবার সাথেই একইতালে চলতে পারে।এমন সময় একটা ফোন এলো।মিষ্টি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো বিষন্ন ফোন করেছে।মিষ্টি ফোন রিসিভ করে ছাঁদে চলে গেলো।
” ওই তের ফোন বন্ধ কেন?কাল রাত থেকে ফোন দিচ্ছি ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে, এদিকে আমার কত্তো চিন্তা হচ্ছে ”
” আচ্ছা? তা মহারানির আমাকে নিয়ে কি কি চিন্তা হচ্ছে? বলুন একটু শুনি ”
” আগে বল ফোন বন্ধ কেন,”
” চার্জ ছিলো না।চার্জে রেখে কথা বলছি ”
” সকালে খাইছিস? ”
” হ্যা।শুনো,এক্ষুনি চটপট সাজুগুজু করে ফেলো ”
” কেনো? ”
” আলাদা কিছু সময় পার করবো।আচ্ছা হালকা আকাশি রঙ্গের কোনো শাড়ি আছে তোমার?”
” হু ”
” শাড়ি পড়ে হোস্টেলের নিচে এসো,আমি আসছি ”
বলেই বিষন্ন ফোন কেটে দিলো।মিষ্টি ফোনটা বু’কে চেপে ধরে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো।এই মুহুর্তে নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েদের মধ্যে সে একজন।সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে।মিষ্টি ভেবে পাচ্ছে না সে বিষন্নকে এতোটা ভালোবেসে ফেলবে।
মেঘ খুব যত্ন করে মিষ্টিকে সাজিয়ে দিলো।মিষ্টি চেয়েছিলো কালো ব্লাউজ পড়তে,কিন্তু মেঘের জোড়াজুড়িতে শেষে সাদা ব্লাউজটা পড়তে হলো,সাথে হালকা আকাশি রঙ্গের সুতির শাড়ি,শাড়ির পাড়ের কাছে সাদা সুতোর হালকা কাজ।কানে ঝুমকো,কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ।মিষ্টি আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই খুব লজ্জা পেলো।মেঘ মিষ্টির ঘাড়ে ভর করে দাড়িয়ে বললো
” আপু,কি সুন্দর লাগছে তোমায় “।মিষ্টি লজ্জায় নিচে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।মেঘ বললো
” ভাইয়া কি নিচে আসবে তোমায় নিতে? ”
” বলেছে তো আসবে ”
” ভাইয়াকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে,ইচ্ছে করছে তোমার সাথে নিচে যেতে,কিন্তু আজ যাবো না”
মেঘের না যাওয়ার কথাটায় মিষ্টির মনে হলো বু’কের ওপর থেকে পাথর সরে গেলো।যখন মেঘ বললো যে ওর সাথে নিচে যাবে তখন মিষ্টির বু’ক ভারী হয়ে আসছিলো।মিষ্টি চায় যখন বিষন্ন মিষ্টিকে দেখবে তখম শুধু তাকেই দেখবে আর কাউকে না।না বললেই নয়,এজন্য মেঘকে বললো
” কেন চলো,নিচে গেলেই দেখতে পাবে ”
” না আপু,আজ দেখবো না।দেখছো না আমায় কেমন ফকিন্নির মতো লাগছে।এভাবে সামনে যাওয়া যায় নাকি? ”
মিষ্টি আর কিছু বললো না।হোস্টেলের নিচে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন বিষন্ন আসবে।কিছুক্ষণের মধ্যে বিষন্নকে দেখা গেলো রিক্সায় করে আসছে।মিষ্টির একটু খারাপ লাগলো বিষন্নকে রিক্সায় দেখে।এই ছেলেটা রিক্সায় কেনো উঠবে,যার বাবার টাকার কোনো অভাব নেই,এইতো পরশু অব্দিও গাড়িতে ঘুরছিলো,ফিরছিলো।আর আজকে সেই ছেলে রিক্সায়! এইসব কিছুর কারন হিসেবে মিষ্টি নিজেকেই দায়ি করে।বিষন্ন ওর সামনে রিক্সা দাড় করিয়ে মিষ্টিকে উঠতে বললে মিষ্টি উঠলো।মিষ্টিকে চুপচাপ দেখে বিষন্ন বললো
” কি হয়েছে? চুপ কেনো? ”
” আমার জন্য এসব হচ্ছে, তোর সাথে আঙ্কেল,আন্টির সম্পর্কটা এলোমেলো হয়ে গেলো ”
” এইসব বলে এতো সুন্দর বিকেলটাকে নষ্ট করতে চাও তাইতো, ওকে সমস্যা নাই করো,”
” এই না না।সরি,এত্তোগুলা সরি,আর বলবো না।আমি চাই তোর সাথে কাটানো সব মুহুর্তগুলো যেন অনেক অনেক অনেক সুন্দর কাটে।আচ্ছা কোথায় যাচ্ছি এখন আমরা? ”
” জানিনা।আপাতত বিকেলটা রিক্সাতেই ঘুরবো।যখন আলো-আধারি নামবে তখন যে যায়গাটা ভালোলাগবে সেখানে নামবো।কি?এমনে তাকায় আছো কেন? ”
” তোকে দেখছি,তোর চিন্তাভাবনাগুলিকে অনুভব করছি ”
হঠাৎ বিষন্ন “এই মামা রিক্সা থামান” বলে রিক্সা থামাতে বললো। মিষ্টি বুঝতে পারলো না কেনো রিক্সা থামানো হচ্ছে। রিক্সা থামতেই বিষন্ন লাফ দিয়ে নেমে রাস্তায় বসে থাকা দুইটা মেয়ের থেকে ফুল কিনে আনলো।ফুলগুলো দেখে একটু অবাক হলো মিষ্টি।রাস্তায় যারা ফুল বিক্রি করে তারা কখনোই কদম ফুল বিক্রি করে না,করলেও মিষ্টি কখনো দেখেনি।অথচ আজকের মেয়ে দুইটার হাতে কদম ফুল।বিষন্ন বেশ কিছুক্ষণ ওদের সাথে গল্প করে ফুল হাতে রাস্তা পার হচ্ছে। মিষ্টি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে।একটা কুচকানো সাদা টি-শার্ট,কালো জিন্স,পায়ে স্যান্ডেল।এতো সাধারণ ভাবেই ছেলেটাকে কি অপূর্ব লাগছে,কতটা স্নিগ্ধতা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।রিক্সায় উঠে বিষন্ন ফুলগুলা মিষ্টির হাতে দিলো।একটা ফুল ছিঁড়ে মিষ্টির খোলা চুলে ছড়িয়ে দিলো।কালো চুলের মধ্যে চিকন,লম্বা,সাদা সাদা ফুল।মনে হচ্ছে চুলগুলি ঘাস,যেখানে সাদাসাদা ফুলের কলি ফুটে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধা হয়ে আসবে।রিক্সা থেকে নেমে দুজন এখন হাটছে রাস্তার ধারের ফুটপাত দিয়ে।ফুটপাত ভর্তি কাঠবাদাম গাছের লাল লাল পাতায় ভরে আছে।পা দেওয়া মাত্রই করমড় শব্দ হচ্ছে।বিষন্ন বললো
” চা খাবে? ”
” হু ”
” চলো,রাস্তার ওই পাড়ের দোকানটার চা অনেক সুন্দর, ”
” মানে কি? তু রাস্তার পাশের দোকানের চা খেয়েছিলি? ”
” রোজ’ই তো খাই,”
মিষ্টি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।রাস্তার পাশের দোকানের চা বিষন্ন খাচ্ছে,এটা ভাবতেই মিষ্টির কেমন কেমন যেন লাগছে।মিষ্টি বারবার মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে বিষন্নর এসব সাধারণ কার্যকলাপে।তবে একটা বিষয় সে বুঝতে পারছে না,বিষন্নর এইসব তুচ্ছ বিষয় তার কাছে এতোটা গুরুত্ব পাচ্ছে কেন?এর আগে তো কখনো এরকম হয়নি।ভালোবাসার মানুষটার তুচ্ছ বিষয়গুলিও কি অমূল্য হয়ে যায়?
দু’জন দুইটা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। অসাধারণ! এতো সুন্দর চা মিষ্টি খুব কম খেয়েছে।চা খাওয়ার মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে বিষন্নের দিকে একটু একটু তাকাচ্ছে। বিষন্ন গভীর মনোযোগে ফোনে কিছু একটা দেখে চলেছে।মিষ্টির একটু মন খারাপ হলো।শাড়ি পড়াতে তাকে কেমন লাগছে সেটা বিষন্ন এখনে বলেনি।কেন বলেনি? ইচ্ছে করেই বলছে না এরকম কিছু কি? নাকি আমায় শাড়িতে সুন্দর লাগছে না,তাই কিছু বলছে না।
চা খাওা শেষে বিষন্ন বললো ” চায়ের দামটা দাও,আমি এক্ষুনি আসছি ”
মিষ্টি চায়ের দাম দিয়ে দাড়িয়ে আছে।বিষন্ন সারা মুখ ধোঁয়ায় ভড়িয়ে মিষ্টির সামনে দাড়ালো।মিষ্টি নাক কুচকে বললো
” ছি,তুই আবারো সিগারেট মুখে দিয়েছিস ”
” খাইনা তো,মাঝেমধ্যে একটা খাই ”
” আমার সাথে থাকলে নো সিগারেট, ফেল এক্ষুনি ”
” কিনে এনে ফেলে দিবো? ”
” হ্যা ফেলবি,আর ফেললে কষ্ট হলে আমায় দে আমিও একটু খাই ”
” তুমি ভুল জানো, এটা খাওয়া যায় না,ধোঁয়াটা ভিতরে নিতে হয়,ফ্লেভারটা মজার। ট্রাই করে দেখতে পারো ”
মিষ্টি ইচ্ছে করেই সিগারেটটা ঠোঁ’টে দিলো,তার ধারণা ছিলো বিষন্ন তাকে আটকাবে।কিন্তু বিষন্ন আটকালো না,সে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে মিষ্টির দিকে।যেন সে খুব মজা পাচ্ছে,এমন মজার ঘটনা সে আগে কখনো দেখেনি।রেগে গিয়ে মিষ্টি সিগারেটে একটা টান দিতেই তা’মাক পাতার আত্মারা মিষ্টির গলা অব্দি ঢু’কে গেলো।মিষ্টি সিগারেট ফেলে গলায় হাত রেখে খুকখুক করে কাশতে লাগলো।বিষন্ন বললো
” প্রথম প্রথম এরকম হয়, আরেকবার ট্রাই করবে? ”
এরুপ কথায় মিষ্টি চোখ বড়বড় করে তাকালো।বিষন্ন আর কিছু বললো না,ইশারায় রিকশা থামিয়ে দুজনেই রিকশায় বসলো।কিছুদুর যাওয়ার পর মিষ্টির মনে পড়লো ফুলগুলো চায়ের দোকানের টংটায় ফেলে এসছে।উত্তেজিত স্বরে বিষন্নকে বললো
” এই শোন না ”
” বলো ”
” ফুলগুলা দোকানে রেখে এসছি ভুলে ”
” তাতে কি,”
” তাতে কি মানে? তুই দিয়েছিস আর সেটা ফেলে এলাম এটা কি কম কিছু? ”
” বাদ দাও,আমাকে তো ফেলে আসোনি,এটাই অনেক ”
এরপর দুজন অনেক্ক্ষণ চুপ করে থাকলো।মিষ্টির মনে হলো বিষন্নর মন খারাপ।কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে।কি হয়েছে ওর? মিষ্টি নরম স্বরে বললো
” কি হয়েছে তোর? মন খারাপ? ”
” না, মন খারাপ কেন হবে”
” চুপচাপ হয়ে আছিস যে,”
” আসলে তোমর একটা বিষয় আমার ভালোলাগছে না ”
বিষন্নের মুখে এরুপ কথা মিষ্টির বু’কে গিয়ে বাঁধলো।ভালোলাগছে না মানে কি? শুনেছি ভালোবাসা প্রকাশ পেলে গেলে প্রেমিকার নানান ভূল প্রেমিকের চোখে পড়ে।প্রথম প্রথম দুই একটা পড়ে, তারপর সবকিছুতেই শুধু ভুল দেখতে পায়।অতঃপর বিচ্ছেদ। এসব ভাবতেই মিষ্টির চোখে জল চলে এলো।বিষন্নকে সে কোনো মূল্যতেই হারাতে চায় না।প্রয়োজন হলে ওর জন্য মিষ্টি নিজেকে পুরোটাই পরিবর্তন করবে,ওর যা ভালোলাগবে,যা করতে বলবে সব করবে।মিষ্টি চোখের জল আড়াল করে বললো
” কি বিষয় ভালোলাগছে না? ”
চলবে?
#তোমায়_চেয়েছি_পুরোটাই
#পার্টঃ২৮
#জয়ন্ত_কুমার_জয়
নীলু হন্তদন্ত হয়ে বাবার ঘরে এসে কিছুটা শক্ত গলায় বললো ” বাবা, তুমি নাকি বিষন্নকে বাড়ি থেকে বেড় করে দিয়েছো? ”
তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন ” তোর মা দিয়েছে ”
নীলু রাগি দৃষ্টিতে তাকালো তার মায়ের দিকে।মায়ের দিকে তাকিয়ে আগের মতো শক্তভাবে বললো ” মা তুমি বিষন্নকে বেড় করে দিয়েছো? ”
” হ্যা ”
” কিন্তু কেন,ও বাচ্চা ছেলে, একটু আধটু ভূল করতেই পারে সেজন্য এরকম একটা কাজ তোমারা কিকরে করতে পারলে? ”
” তুই এতো কথা বলতেছিস কেন? আমার কি এখন তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে ”
” অবশ্যই দিতে হবে।ওর তিনদিন বাদে পরিক্ষা।কি এমন করেছে যে বাড়ি থেকে বেড় করে দিতে হবে।দেখো,আমি কিচ্ছু জানিনা,কাল সকালের মধ্যে যদি বিষন্নকে বাড়িতে না দেখি তাহলে দেখে নিও আমি কি করি ”
এটুকু বলেই নীলু ঘর থেকে টলমলে চোখে বেড় হয়ে গেলো।নিজের রুমে ঢুকেই দরজা ঠাস করে বন্ধ করতেই ফোনের রিং বেজে উঠলো।সমুদ্র ফোন করেছে।নীলু ফোমটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো
” আপনি হঠাৎ এত তাড়াহুড়ো করে গেলেন,আমি কিছু বুঝতেই পারলাম না।একটু বলবেন কি হয়েছে ”
” দেখুন মিঃসমুদ্র,আমার মেজাজ এখন খুব খারাপ,দয়া করে ফোন দিবেন না, ”
” আহা বলুন না,শুনতে ইচ্ছে করছে ”
” ধূর ”
নীলুর এতোটাই রাগ হচ্ছিল যে ফোনটা কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিলো বিছানায়।
___________________
বিষন্নকে বারবার জিগ্যেস করা সত্বেও মিষ্টির কোন বিষয়টা বিষন্নর খারাপ লাগছে সেটা বিষন্ন বললো না।জিগ্যেস করলেই গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্য দিকে।মিষ্টি একটা বিষয় লক্ষ করলো,সেটা হলো বিষন্নের গালে কচি দাড়ি।রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বিষন্নের গালে কচি কচি দাড়ি দেখে মিষ্টি লজ্জা পেলো।মনে মনে ভাবলো ” বাহ, ছেলেটা তাহলে সত্যি সত্যিই বড় হয়ে গেছে।এখন যদি এই বড় ছেলেটার হাত ধরি তাহলে কি খুব বড় অন্যায় হয়ে যাবে? না অন্যায় হবে না “।মিষ্টি বিষন্নের হাতে হাত রাখলো।বিষন্ন মুচকি হেসে তাকালো মিষ্টির দিকে।এ হাসির অর্থ এতোক্ষণ সে এটাই চেয়েছিলো যেন মিষ্টি নিজে তার হাতে হাত রাখে।বিষন্ন অপর হাত মিষ্টির ঘাড় বেয়ে পেছনে রাখলো।নরম স্বরে বললো
” শাড়িতে তোমায় খুব সুন্দর লাগছে,”
” হইছে থাক, এতোক্ষণে বলতেছে শাড়িতে সুন্দর লাগে,হুহ ”
বিষন্ন কেমন যেন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মিষ্টি বুঝতে পারলো বিষন্ন লজ্জা পাচ্ছে।এটা কি সত্যি?বিষন্ন কি সত্যিই লজ্জা পাচ্ছে? মিষ্টি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো
” তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস? ”
ব্যাস!শুধু এটুকু বলতেই বিষন্নর নাক,কাল লাল হয়ে গেলো।মুখ অন্যদিকে করে লুকিয়ে আছে।মিষ্টি হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না।এই ছেলেটা হঠাৎ এতো লজ্জা কেন পাচ্ছে?বিষন্নের লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি দেখে মিষ্টি হাসি আটকে রাখতে পারলো না।হেসে হেসে বললো
” সত্যি? তুই সত্যিই লজ্জা পাচ্ছিস? কি আজব লজ্জা পাওয়ার মতো কি হলো? ”
বিষন্ন নীচু স্বরে মিনমিন করে বললো ” তুমি শাড়ি পড়েছো ”
” তো?শাড়ি পড়েছি আমি,এতে তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন?! ”
” না মানে, মনে হচ্ছে আমরা বর বউ,আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে,তোমায় নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি,এসব ভাবতেই কেমন লজ্জা লাগছে আমি কি করবো ”
শ্বশুর বাড়ি কথাটা শুনতেই মিষ্টির মন খারাপ হয়ে গেলো।তার কি দোষ ছিলো?কেন ছোট থেকে বাবা মায়ের আদর যত্ন হতে সে বঞ্চিত?এসব ভাবলে মিষ্টির খুব কান্না পায়,মন বিষন্নতায় ভরে যায়।সেই বিষন্নতা থাকে দীর্ঘদিন।মিষ্টির চুপচাপ হয়ে যাওয়াতে বিষন্ন বললো
” তোমার আবার কি হলো ”
” আমার কি দোষ ছিলো বলতে পারবি? জন্মের পর থেকে বাবা মা কি জিনিস আমি জানিনা।আমার কি ইচ্ছে করেনা মায়ের আদর পেতে? মা আদর করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, বাবাকে রোজ চকলেট আনতে বলবো।এইসব কি খুব বেশি চাওয়া? ”
বিষন্ন কিছু বলতে পারলো না।বাবা মাকে হারানোর এই বিষন্নতা কাটানোর সাধ্য এই মহাবিশ্বে নেই।মিষ্টি কাঁদছে,চোখের জল গাল গড়িয়ে নিচে পড়ছে।বিষন্ন জানেনা এই মন খারাপ কিভাবে ভালো করবে।তবে তাকে কিছু একটা করতেই হবে।
রিক্সা ভাড়া দিয়ে দু’জন নামলো।মিষ্টি একটু অবাক হয়ে তাকালো আশেপাশে। চোখের জল মুছে বিষন্নকে বললো
” আমরা এখানে কেনো? ”
” উহু,আর কথা নয়।দৌড়াতে পারো তো? ”
” কি বলছিস,আমরা কি দৌড়াবো নাকি? ”
” হু,ট্রেন ছেড়ে দিছে,জুতাটা খুলে হাতে নাও জলদি,সময় নেই ”
বিষন্ন মিষ্টির হাত ধরে ছুটছে সদ্য স্টেশন থেকে ছাড়া চলন্ত ট্রেনের সাথে।ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে বাড়ছে।বিষন্ন, মিষ্টি দু’জনি প্রাণপনে ছুটছে।তাদের দুজনের হাতে জুতো।মিষ্টি এক হাতে জুতা আর শাড়ির সামনটা ধরে,আরেক হাত বিষন্নের হাতে রেখে ছুটছে। এইতো আর একটু।
ট্রেনে উঠে দুজনই বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকলো।মিষ্টি বড়বড় শ্বাস নিতে নিতে বললো
” জীবনের প্রথম চলন্ত ট্রেনে উঠলাম,উফফ বাবা ”
” কেমন লাগছে? ”
” অসাধারণ একটা অনুভূতি,আচ্ছা ট্রেনে কেন আমরা? কোথায় যাবো? ”
” জানিনা ”
” জানিনা মানে? ”
” সবকিছুর মানে থাকে না।গন্তব্যহীন যাত্রা।”
মিষ্টি হা করে তাকিয়ে রইলো।বিষন্ন নির্বিকার ভঙ্গিতে ভেতরে গেলো।পেছন পেছন মিষ্টিও যাচ্ছে। জানালার পাশে মিষ্টি বসলো।তার মুখোমুখি বসে আছে বিষন্ন। মিষ্টি জানালা খুলে দিলো। ঠান্ডা বাতাসে শরীরে শিহরণ জাগছে।মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।মিষ্টি জানালা থেকে কিছুটা মুখ বেড় করে রাখলো।ঝিকঝিক শব্দে একটা সুন্দর তাল সৃষ্টি হচ্ছে। মুহুর্তেই ঝমঝম করে বৃষ্টি আরম্ভ হলো।বিষন্ন বললো
” বৃষ্টিতে ভিজবে? ”
” কিভাবে? ”
” ট্রেনের ছাঁদে উঠবো ”
” পাগল হয়ে গেছিস নাকি? ”
” একবার চলই না,দেখবে মনপ হবে জীবনে কোনো কষ্ট নেই,সব নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে ”
” আমার ভয় করে,তার থেকে চল দরজার ওখান থেকে ভিজি ”
মিষ্টি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করছে।সবটা কেমন যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।এমনকি মিষ্টির মনের সেই গাঢ় বিষন্নতাও এখন আর নেই।কি আশ্চর্য! কখনোই এতে দ্রুত এই বিষন্নতা কাটে না,অথচ আজ নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।বিষন্ন বললো
” বৃষ্টিতে বেশিক্ষণ কিন্তু ভেজা যাবে না,জ্বর হবে ,”
” হলেই বা কি,তুই আছিস তো,তখন তোকে আরো কাছে পাবো। আর তোকে এত্তেএত্তে থ্যাংকস।আমার মন ভালো করে দেওয়ার জন্য। আর এভাবেই প্লিজ সারাজীবন আমার কাছে থেকে যা ”
” আচ্ছা থেকে গেলাম ”
” এই বিষন্ন, কি মতলব কি তোর, হ্যা ”
” কিচ্ছু না,বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগছে,একটু উষ্ণতা কোথায় যে পাই,খুজতেছি। কই পাবে বলো তো ”
” আমি কি জানি,আমার কাছে কেন আসছিস!”
” একটু উষ্ণতা নিতে, ”
” তাই না? ”
” হু,”
বৃষ্টির বড়বড় বোল এসে পড়ছে একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকার শরীরে।যাদের শরীর এখন উত্তপ্ত লাভার ন্যায় টগবগ করছে।দুজনে মিলেমিশে হয়ে গেছে একজন।বৃষ্টিতে মিষ্টির শরীরে চিপকে থাকা শাড়ির আঁচলটা বিষন্নের ছোঁয়ায় নিচে পড়ে গেলো।এই বড়বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো তারাও পরম সুখে ঝড়ে পড়ে যাচ্ছে।
চলবে?