মায়ারণ্যে #পর্ব-৬

0
313

#মায়ারণ্যে
#পর্ব-৬
#লেখিকা- মেহরুমা নূর

★ অরণ্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ওতো ভেবেছিল অরণ্যরা হয়তো চলে গেছে। তাইতো সে এখন বের হয়েছিল। কারন মায়া অরণ্যের সামনে পড়তে চাচ্ছিল না। লোকটার সামনে আসলে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয় ওর। আর মায়া নিজেকে কোন মিথ্যে মোহে জড়াতে চায়না। তাইতো যতটা পারে অরণ্যের থেকে দূরে থাকতে চায় ও। কিন্তু অরণ্যকে এভাবে হঠাৎ সামনে আসতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ও। আর অরণ্যের এভাবে তাকিয়ে থাকাটাও কেমন যেন লাগছে ওর কাছে। ওই চোখের চাহুনি যেন অন্য কিছু বলছে।
যাইহোক মায়া নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আস্তে করে অরণ্যের পাশ কেটে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে গেল।

আর অরণ্য মায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে এখনো ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু যেন থমকে গেছে ওর জন্য। গলা শুঁকিয়ে আসছে ওর। হৃদপিন্ডের অশান্ত আহাজারি ওর সমস্ত শরীর টাকে অসার করে দিচ্ছে। চোখের সামনে যা দেখছে তা মন মেনে নিতে চাইছে না। অরণ্য দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে অশান্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। না না এটা হতে পারে না। আমার নিশ্চয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার বিশ্বাস এভাবে হেরে যেতে পারে না। হতে পারে ওই বোরখা টা রিয়ারই ছিল। আজ হয়তো মায়া পড়েছে। ওরা যেহেতু কাজিন তাই একজন আরেকজনের টা পড়তেই পারে। তাই এতো তাড়াতাড়ি কোন পরিনামে আসা ঠিক হবে না।

নিজের অশান্ত মনকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে শান্ত করতে চাইলেও তাতে সফল হচ্ছে না অরণ্য। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে অরণ্য তাড়াতাড়ি করে বাইরে এসে রিয়া আর সারাদের উদ্দেশ্যে বললো।
–শোন আমার একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তাই আমি এখন তোদের সাথে যেতে পারবোনা। তোরা ড্রাইভারের সাথে চলে যা। আমি কাজ শেষ করে বাসায় চলে আসবো।

সবাই অরণ্যের কথামতো গাড়িতে উঠে চলে গেল। আর অরণ্য দ্রুত গিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে বসলো। সিএনজি কিছুদূর যেতেই মায়াকে রাস্তার পাশে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলো। অরণ্য সিএনজি চালককে এবার আস্তে আস্তে চালাতে বললো। যাতে ও মায়াকে ফলো করতে পারে। আর সেই ভাবনা মতেই অরণ্য সিএনজিতে বসে মায়াকে ফলো করতে লাগলো।

কিছুদূর যেতেই অরণ্য দেখলো সেদিনের সেই শিশুটা রাস্তার পাশে বসে আছে। মায়া শিশুটির কাছে এগিয়ে গিয়ে শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে দিল। তারপর যেতে যেতে আরও কিছু মানুষের সাহায্য করছে মায়া। এসব দেখে অরণ্যের সব সন্দেহ ক্লিয়ার হয়ে গেল। ওর মন মস্তিষ্ক দুটোই এবার মানতে রাজি হয়ে গেল যে মায়াই ওর সেই সন্ধ্যামালতী। তাহলে রিয়া কে? তারমানে আমি ভুল কাওকে আমার জীবন সঙ্গী করেছি? কথাটা ভাবতেই অরণ্যের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এ এটা আমি কি করলাম? আমার সাথে এমন কেন হলো? আমিতো আমার সন্ধ্যামালতীকে চেয়েছিলাম। তাহলে অন্য কেউ কেন এলো আমার জীবনে? এখন কি করবো আমি? আর ভাবতে পারছে না অরণ্য। মাথাটা পুরো হ্যাং হয়ে যাচ্ছে ওর। শরীরের সব স্নায়ুতন্ত্র অকার্য হয়ে পড়ছে। অরণ্য দেখলো মায়া একটা বাসে উঠে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে চলে গেল। অরণ্য দিশেহারার মতো সিএনজি চালককে কোন এক জায়গায় যাওয়ার কথা বললো।

নির্জন নদীর কিনারায় মাথা চেপে ধরে বসে আছে অরণ্য। নিজের ওপর প্রচন্ড পরিমাণ রাগ হচ্ছে। পারলে যেন নিজেকেই মেরে ফেলে ও। আজ ওর একটা ভুলের জন্য সন্ধ্যামালতীকে পেলনা ও। ও যদি নিজে দেখতে আসতো তাহলে হয়তো এই ভুলটা হতো না। ওর তো পুরো বিশ্বাস ছিল যে সন্ধ্যামালতীই ওর জীবন সঙ্গী হবে। তাহলে ওর বিশ্বাস এভাবে কেন হেরে গেল? কিন্তু আমিতো সেদিন আপুর কাছে সন্ধ্যামালতীর ছবি দিয়েছিলাম। আর রিয়ার মা নাকি বলেছিল ছবির মেয়েটাই নাকি রিয়া। তাহলে এসব কিভাবে হলো? উনি কি তাহলে মিথ্যা বলেছিলেন? নাকি সেও কনফিউশনে বলে দিয়েছে?

যেভাবেই হোক না কেন ক্ষতিটা তো আমারই হয়েছে। আর এই ক্ষতির কোন ক্ষতিপূরণও নেই। এইজন্যই বুঝি বিয়ের প্রথম রাত থেকেই আমার এমন লাগছিল। কিছু একটা খালি খালি লাগছিল। সেই খালির কারণ টা যে মায়া ছিল। আর এজন্যই মায়াকে প্রথম দেখেই ওর প্রতি অজানা টান অনুভব করেছিলাম। কারণ মায়াই যে আমার স্বপ্নকণ্যা, আমার সন্ধ্যামালতী,আমার হৃদয়ের রাণী। কিন্তু এখন আমি কি করবো? আমি যে আমার স্বপ্নকন্যাকে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম। এখন এই অপূর্ণ জীবনের বোঝা কিভাবে বয়ে বেড়াবো আমি? সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া জীবনের বাকিপথ কিভাবে চলবো? যাকে আমি চাই না তার সাথে কিভাবে জীবন কাটাবো আমি? রিয়াকে কিভাবে নিজের স্ত্রী বলে মেনে নিব আমি? সন্ধ্যামালতী ছাড়া অন্য কাওকে যে কিছুতেই এই মনে জায়গা দিতে পারবোনা আমি। চাইলেও সেটা সম্ভব না আমার দ্বারা। কিন্তু এখন আমি এসব ঠিক করবো কিভাবে? চাইলেই যে রিয়াকে এতো সহজে আমার জীবন থেকে সরানোও যায়না। এখানে যে দুটো ফ্যামিলি ইনভলভ আছে। পরিবারের মানসম্মান জুড়ে আছে। আমি ইচ্ছে করলেই যা খুশি তাই করতে পারি না। যেখানে আমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। সেখানে বিয়ের পরদিনই কিভাবে বলবো যে এই বিয়ে আমি মানি না? আপুর জন্য বাবার আগেও একবার সমাজে মাথা হেট হয়েছে। এখন যদি আমিও এমনটা করি তাহলে হয়তো বাবা আরও ভেঙে পরবেন। আর ছেলে হয়ে আমি কিভাবে সেটা হতে দিতে পারি? এখন যে আমার চারপাশে অথই সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। না পারছি ডুবে মরতে, না পারছি বের হতে। জীবন এ কোন মোড়ে নিয়ে এলো আমায়?
____

বাসায় এসে গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সারা। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো।
–এই চশমিশ,

সারার এতক্ষণের ফুরফুরে মেজাজ টাই বিগড়ে গেল। ও জানে এটা ওই বিরক্তিকর লোকটা ছাড়া আর কেউই না। নেহাৎ বয়সে আর সম্পর্কে বড় দেখে ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলেনা সারা। নাহলে এই লোকাটাকে আচ্ছা মতো কিছু শুনিয়ে দিতো সারা। অসহ্যকর লোক একটা।

–কিরে চোখের সাথে সাথে কি কানের পাওয়ারও কমিয়ে ফেললি নাকি? ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?

সারা দাঁতে দাঁত চেপে পেছনে ফিরে দেখলো সাহিল পুল সাইডে ছাতা বিশিষ্ট চেয়ারে বসে আছে। সারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিকে এগিয়ে গেল। সাহিলের সামনে এসে দেখলো সাহিলের চোখমুখ কেমন লাল হয়ে আছে। যেন কোন কারণে অতিরিক্ত রেগে আছে সে। কিন্তু কিসের রাগ এতো তার? কে আবার তার পাকা ধানে মই দিলো? যাগ্গে যার খুশী তার ওপর করুগ্গে রাগ তাতে আমার কি। সারা অন্য দিকে তাকিয়ে দায়সারা ভাবে বললো।
–বলুন কি বলবেন?

–নিজের বাড়ির খাওয়া বুঝি তোর জন্য কম পরে যাচ্ছে, তাইজন্য অন্যের বাড়ির খাবার খেতে চলে গিয়েছিলি তাইনা?

সারা এবার সাহিলের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–কি বলছেন এসব? আমি কার বাড়ি খাবার খেতে গেলাম?

–কেন কাল থেকে অরণ্য ভাইয়ার শশুর বাড়ি পড়ে আছিস তো খাওয়ার লোভেই তাইনা? নাকি ওখানে কোন ছেলের সাথে টাংকি মারতে গেছিস হ্যাঁ?

সারা এবার রাগের সাথে সাথে একটু কনফিউজও হলো। আসলে ও বুঝতে পারছে না টাংকি মারা মানে কি। কিন্তু সেটাতো আর এই লোকটাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। প্রেস্টিজের ব্যাপার স্যাপার বলে কথা। ভাববে যে আমি এইটুকু জিনিসও জানিনা। তাই উপরে উপরে অতি কনফিডেন্স দেখিয়ে বললো।
–হ্যাঁ টাংকি মারতেই গিয়েছি। আমার টাংকি মারা অনেক ভালো লাগে। আমার টাংকি আমি মারবো। সকাল, দুপুর, রাতে মারবো তাতে আপনার কি হ্যাঁ?

সারার কথা শেষ হতে না হতেই সাহিল হাওয়ার বেগে উঠে দাঁড়িয়ে সারার হাতের বাহু চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–তুই আগে বল কে সে ? তারপর দেখ আমার কি? তোর সাহস আজকাল অনেক বেড়ে গেছে না? বড়োদের মুখে মুখে তর্ক করা হচ্ছে? এখন বল ছেলেটা কে? কি হলো বল?

সারা কথা বলবে কি। ভয়ে আর হাতের ব্যাথায় পরাণ যায় যায় অবস্থা। সারা ভীতু স্বরে বললো। –কা কার কথা বলছেন সাহিল ভাইয়া? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

–আচ্ছা এখন বুঝতে পারছিস না তাইনা? এতক্ষণ ধরে বলছিস টাংকি মারছিস আর কোন ছেলে জিজ্ঞেস করতেই বুঝতে পারছিস না? মজা হচ্ছে আমার সাথে হ্যাঁ?

–ও ওটাতো আমি এমনিই বলেছি। আসলে আমি না টাংকি মানে বুঝতে পারছিলাম না। তাই এমনি এমনি ওসব বলে দিয়েছি।

সাহিল ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট??

সারা ইনোসেন্ট ফেস করে বললো।
–স সত্যি বলছি।

সাহিল কি রিয়্যাকশন দিবে ভেবে পাচ্ছে না। সারার হাত ছেড়ে দিয়ে তিন আঙুল দিয়ে সারার কপালে হালকা টোকা দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–তুই আসলেই একটা রাম গাধা। গাধার কম্পিটিশনে একদম ফাস্ট প্রাইজ পাবি তুই। যা এখন ভেতরে যা।

সাহিলের বলতে দেরি, সারার গায়েব হতে দেরি লাগলো না। বেচারি ছু মন্তর হয়ে গেল ওখান থেকে। সারার বোকামির কথা ভেবে সাহিল ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসলো। কাল থেকে ওকে না দেখে যে রাগে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল সেটা যেন মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গিয়েছে। মেয়েটাকে রাগাতে ওর খুব ভালো লাগে। তাইতো ইচ্ছে করেই ওকে রাগায়। ও রাগে যখন মুখটা গোমড়া করে ফেলে তখন, ওর ফর্সা গাল আর নাকের ডগা লাল হয়ে যায়। একদম পাকা টমেটোর মতো লাগে। দেখতে এত্তো কিউট লাগে। মন চায় একদম খেয়ে ফেলি। কিন্তু পাগলিটা এখনো অনেক ছোট। তাইতো মনের অব্যক্ত অনুভূতি গুলো ওকে বলতে পারিনা। তবে ও যখন রাগ করে দূরে দূরে থাকে তখন ভীষণ রাগ হয়। তাইতো সেই রাগে ওকে তখন আরও রাগাই। জানি না পাগলিটা কবে একটু বড়ো হবে। আর আমাকে একটু বুঝতে পারবে।
___

রাত ১০ টার দিকে অরণ্য বাসায় ফেরে। চোখে মুখে ক্লান্তি আর বিষন্নতার ছাপ। কোন মহামূল্যবান কিছু হারানোর হতাশায় চেহারায় বিষাদের ছাপ ভেসে উঠেছে। জীবন টা যেন হঠাৎ করেই অগোছলো হয়ে গেল। কিভাবে সব গোছাবে সেটাও জানা নেই ওর। ভার্সিটি ছুটির সময় অরণ্য আবারও মায়ার ভার্সিটির সামনে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল তার উত্তর জানা নেই ওর। শুধু মনে হচ্ছিল মায়াকে দেখতে পারলে হয়তো ওর অশান্ত মনটা শান্ত হবে। আর সত্যি সত্যিই দূর থেকে মায়াকে দেখে ওর অশান্ত মনে এক প্রশান্তির বাতাস ছুয়ে গিয়েছিল। তবে মায়া চলে যেতেই আবারও কঠিন বাস্তবতা ঘিরে ধরে অরণ্যকে। যে বাস্তবতা অরণ্য না মানতে পারছে, না ফেলতে পারছে। অশান্ত মনে সারাদিন ছন্নছাড়া পথিকের মতো এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়েছে। বাসায় মোটেও আসতে ইচ্ছে করছিল না ওর। কারণ বাসায় আসলেই সেই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে ওর। তাইতো বাসায় আসতে চাইছিল না। একবার ভেবেছিল ইহানের বাসায় চলে যাবে। আবার ভাবলো এতে করে সবাই চিন্তায় পড়ে যাবে। বিশেষ করে ওর মা। তাই ওর মায়ের কথা ভেবেই অগত্যা বাসায় চলে এলো অরণ্য।

রুমে ঢুকে দেখলো রিয়া বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপছে। রিয়াকে দেখে অরণ্যের মনটা আরও বিষাদ হয়ে উঠলো। এই বাড়ি,এই রুমে ওর সন্ধ্যামালতীকে আনতে চেয়েছিল। তার জায়গায় অন্য কাওকে দেখে অরণ্যের বুকের ভেতর কেমন হাহাকার শুরু হয়ে গেল।

অরণ্যকে দেখে রিয়া তড়িঘড়ি করে উঠে অরণ্যের কাছে এগিয়ে এলো। অরণ্যের সামনে এসে হাসিমুখে হেলেদুলে বললো।
–তুমি এসে গেছ? সারাদিন কোথায় ছিলে? জানো বাড়ির সবাই বারবার শুধু তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল?
কথা বলতে বলতে রিয়া অরণ্যের দিকে হাত বাড়াতে নিলেই, অরণ্য ছিটকে সরে যায়। অরণ্যের কাছে প্রচুর অস্বস্তি আর বিরক্তিকর লাগছে রিয়াকে। প্রথমে ব্যাপার টা বুঝতে না পারলেও এখন অরণ্য বুঝতে পারছে কেন রিয়ার সামনে ওর এতো অস্বস্তি লাগে। কারণ এযে ওর সন্ধ্যামালতী না।

অরণ্য অপ্রস্তুত ভাবে ওখান থেকে সরে গেল। অরণ্যের এমন বিহেভিয়ারে রিয়াও অনেক টা অবাক হলো। লোকটার হাবভাব কিছু বুঝতে পারছে না ও। সেতো ওকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে তাহলে এমন দূরে দূরে থাকে কেন? আমার মতো সুন্দরী বউকে রেখে উনি কিভাবে থাকেন? এমন হলে উনাকে বিয়ের জন্য মানাবো কিভাবে? বাবা মা বারবার বলে দিয়েছে আমি যেন তাড়াতাড়িই কোন বাহানায় অরণ্যকে বিয়ের জন্য মানিয়ে নেই। কিন্তু সেতো ধরাই দেয়না। বেচারা মনে হয় একটু বেশিই লাজুক টাইপের। ব্যাপার না, আমি নিজেই সব ঠিক করে দিবো। আমার জালওয়া থেকে কেউই বেশিক্ষণ দূরে থাকতে পারে না।

অরণ্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে ঘড়ি খুলছে। রিয়া বাঁকা হেসে অরণ্যের পেছনে গিয়ে ওর পেছন থেকে অরণ্যের ব্লেজার টা খুলতে নিলেই অরণ্য নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো।
–আমি নিজেই করতে পারবো। তোমার হেল্প লাগবে না।
কথাটা বলেই অরণ্য কাবার্ড থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। রিয়া শুধু বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্য। দেয়ালে দুই হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শাওয়ারের পানি ওর শরীর কে ঠান্ডা করতে পারলেও, ওর মনে যে ঝড় বইছে, হৃদপিণ্ডে যে অগ্নিশিখা দাও দাও করে জ্বলছে তা কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কেঁদে মনের ধাপ বের করতে। কিন্তু সেটাও যে ও পারবে না। বাবা বলেছে ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। তাইতো সে মন খুলে কাঁদতেও পারছেনা। তবে তার চোখ দিয়ে নিরব জলরাশি ঠিকই গড়িয়ে পড়ছে। যা শাওয়ারের পানির সাথে মিশে যাচ্ছে।

ত্রিশ মিনিট পর অরণ্য শাওয়ার থেকে বের হলো। রিয়া এখনো বসে মোবাইল টিপছে। অরণ্য সেদিকে একবারও তাকালো না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে অরণ্য রিয়ার কাছে এগিয়ে গেল। রিয়ার সামনে বসে নিজের ফোন থেকে মায়ার সেই ছবিটা বের করে রিয়ার সামনে ধরে বললো।
–আচ্ছা তুমি কি এই ছবির মেয়েটাকে চিনো?

রিয়া কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর একটু চিন্তা করার মতো করে ভাবতে লাগলো। অরণ্য এখনো মনে মনে আশা করছে ও যা যেনেছে তা যেন সত্যি না হয়। তাই শেষ আশানুযায়ী রিয়াকে ছবিটা দেখাচ্ছে। মনে মনে চাইছে রিয়া যেন নিজের কথাই বলে। তবে অরণ্যের শেষ আশাকেও ডুবিয়ে দিয়ে রিয়া বলে উঠলো।
–আরে এটাতো আমাদের আশ্রিতা। মানে ওই মায়া।

অরণ্য বিস্মিত চোখে রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো।
–তুমি এতো শিওর কিভাবে হলে?

–আরে শিওর না হওয়ার কি আছে? এই বাবা আদমের যুগের বোরখা শুধু ওর ছাড়া আর কারোরই নেই। আর ওর আবার এইসব রাস্তার লোকজনের সাথে খুব খাতের। সবসময় এসবই করে ও। নিজের কোন ওয়েটই নেই ওর। নিজে আশ্রিতা তো তাই ওর মতো বাকি লোকেদের প্রতি ওর একটু দরদ বেশি।

রিয়ার কথায় অরণ্যের চরম রাগ হলো। তবুও চোয়াল চিবিয়ে রাগ দমিয়ে নিয়ে বললো।
–কিন্তু তোমার মাতো বলেছে এটা নাকি তুমি?

–কবে বলেছে?

–যেদিন তোমাকে আমাদের বাড়ি থেকে দেখতে গিয়েছিল।

অরণ্যের কথায় রিয়ার কপাল কুঁচকে এলো। মা এটা কেন বলেছে? নিশ্চয় মা কোন ঘাপলা করেছে। আর মা যখন বলেছে তখন নিশ্চয় কিছু একটা ভেবেই বলেছে। তাই আমাকে কথাটা সেরে নিতে হবে। এসব ভেবে রিয়া জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলো।
–আরে এই বোরখা টা প্রথমে আমার ছিল। পুরনো হয়ে যাওয়ায় আমি ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম। তাই হয়তো মা ভেবেছে এটা আমি।

রিয়ার কথা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হলোনা অরণ্যের কাছে। তবুও এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে অরণ্য উঠে চলে যেতে নিলেই রিয়া বলে উঠলো।
–বায়দা ওয়ে তুমি এই ছবি কোথায় পেলে? আর মাকে কিসের জন্য দেখিয়ে ছিল।

অরণ্য অন্য দিকে তাকিয়ে বললো।
–পেয়েছি কোথাও তোমার জানার দরকার নেই। শুয়ে পড়ো।

অরণ্য আবারও চলে যেতে নিলে রিয়া আবারও বলে উঠলো।
–কোথায় যাচ্ছো? খাবার খাবে না?

–এখন ক্ষুদা নেই। সময় হলে আমি খেয়ে নিবো।তোমার চিন্তা করতে হবে না।
কথাটা বলেই আদিত্য দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল।

রিয়া বিড়বিড় করে বললো।
–যা খুশি তাই করুক। শুধু শুধু আমার বিউটি স্লিপ নষ্ট করতে পারবোনা।
রিয়া নিশ্চিন্তমনে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
অরণ্য রুম থেকে বেড়িয়ে ছাঁদে চলে এলো। ওই রুমে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সত্যিটা জানার পরে রিয়ার সাথে একরুমে থাকতে আরও বেশি অস্বস্তিকর লাগছে ওর কাছে।। ছাঁদে এসে একটা বেতের হেলানো চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো অরণ্য। আজ ওর জীবন টা এ কোন মোড়ে এসে দাঁড়াল? এখান থেকে বের হওয়ার যে কোন পথই পাচ্ছে না ও। অরণ্য ফোনটা বের করে মায়ার ছবিটা দেখতে দেখতে মনে মনে বললো। এমনটা কেন হলো সন্ধ্যামালতী? তোমাকে পেয়েও কেন হারিয়ে ফেললাম আমি? এখন তোমাকে ছাড়া এই আমি যে শুধুই প্রাণহীন দেহ। তোমাকে কি কখনোই পাবোনা আমি?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here