#মায়ারণ্যে
#পর্ব-৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★ এরইমধ্যে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। সবকিছু ঠিক থেকেও অনেক কিছুই বেঠিক। প্রতিটা অতিবাহিত দিনের সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অরণ্যের বিষাদের জ্বালা। অরণ্য ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না। বেশির ভাগ সময় অফিসেই পড়ে থাকে। বাসায়ও আসে অনেক লেট করে। অরণ্য অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক করার। সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করার। রিয়াকে মেনে নেওয়ারও চেষ্টা করছে। কারণ ওর মতে রিয়ার তো কোন দোষ নেই। তাই রিয়াকে একটা চান্স দিতে চায় ও। কিন্তু চাইলেই কি সব সম্ভব হয়? যেমনটা সম্ভব হচ্ছে অরণ্যের কাছে। অরণ্য চেয়েও মায়াকে ভুলতে পারছে না। আর না পারছে রিয়াকে মেনে নিতে। রিয়ার সামনে গেলেই ওর কেমন বিরক্তিকর লাগে। ছোঁয়া তো দূরের কথা, কথা বলতেই অস্বস্তি লাগে। বরং দিন দিন মায়ার প্রতি টান যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে ওর। না চাইতেও অরণ্যের অবাধ্য মনটা বারবার শুধু মায়াকেই দেখতে চায়। তাইতো রোজই অরণ্য মায়ার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দূর থেকেই মায়াকে দেখে। অরণ্য জানে ও যা করছে তা ঠিক না। কিন্তু এছাড়া যে আর কোন উপায় নেই ওর কাছে। এই অশান্ত মনটা যে মায়াকে দেখেই একটু শান্ত হয়। ওই একটুখানি সময়ই যেন সারাদিনের শান্তি এনে দেয় অরণ্যের মনপ্রাণ জুড়ে। নাহলে যে ও দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে।
অরণ্যের পরিবর্তন বাসার লোকজনও কিছুটা খেয়াল করেছে। বিশেষ করে ইরিন। ইরিন কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে অরণ্যকে কিছু হয়েছে কিনা। কিন্তু অরণ্য বলেছে কিছুই হয়নি। ইহানও ব্যাপার টা খেয়াল করেছে। সেও কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে। তাকেও কিছু বলেনি। আসলে অরণ্য খুব চাপা স্বভাবের। নিজের সমস্যার কথা সহজে কাওকে বলে না। নিজের জন্য অন্যকে পেরেশান করতে চায়না। আর এই ব্যাপার টা তো এমনিতেও অনেক সেনসেটিভ। চাইলেও সবাইকে বলা যায় না।
রিয়া এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অরণ্যকে তার মোহে ডুবানোর। তবে সে প্রতিবারই বিফল হচ্ছে। অরণ্যকে ছোঁয়া তো দূরের কথা অরণ্য ওর সাথে দিনে দুটো কথা বলে কিনা সন্দেহ। অরণ্যের এমন বিহেভিয়ারের কারণ কিছুই বুঝতে পারছে না রিয়া। অরণ্যকে পটিয়ে বিয়ের কথা বলবে সেই সুযোগ টাও পাচ্ছে না ও। অন্যদিকে অরণ্যের বাড়ির এতো ঝামেলায় চরম বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে ও। এই বাড়িতে এতো মানুষ। সকাল সকাল উঠে এদের জন্য নাস্তা বানাতে হয়। আরও কতো কাজ করতে হয়। যদিও বেশির ভাগ কাজ কাজের লোকই করে তবুও এতো মানুষের ঝামেলায় তিক্ত হয়ে উঠছে রিয়া। ও ভেবে পায়না এই যুগেও এতো বড়ো জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকার মানেটা কি। অসহ্যকর। রিয়া শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছে। একবার অরণ্যকে পটাতে পারলেই ওকে নিয়ে আলাদা হয়ে থাকবে। এতো মানুষের ভিড়ে থাকতে পারবে না ও।
মায়ার জীবন সেই একই গতীতেই চলছে। কোন পরিবর্তন না হয়েও যেন আবার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। অরণ্য চলে যাওয়ার পর থেকেই কেন যেন অজান্তেই অরণ্যের কথা বারবার মনে উঁকি দেয়। নিঝুম একাকী রাতে হঠাৎই তার কথা মনে পড়ে বুকের ভেতর কেমন ধুকধুক করে ওঠে। কেন এমন হয় তা জানা নেই মায়ার। তবে কি ওরা স্বামী স্ত্রী বলে এমনটা হয়? পাশের বাড়ির দাদীর কাছ থেকে শুনেছিল। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি আলৌকিক এক পবিত্র সম্পর্ক। এই সম্পর্কে নাকি আপনাআপনিই একজন আরেকজনের প্রতি মায়ার সৃষ্টি হয়। তাহলে সেইজন্যই কি আমার এমন লাগে? আচ্ছা উনারও কি আমার জন্য কোন টান অনুভব হয়? কথাটা ভেবে মনে মনে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, তুইও না মায়া কিসব ভাবিস। তার কাছে রিয়ার মতো সুন্দরী বউ থাকতে তোর মতো কুৎসিত মেয়েকে কেন মনে করতে যাবে? তাই এসব ফালতু চিন্তা ভাবনা করে নিজেকে বোকা বানাস না।
মায়া আরেক টা জিনিস খেয়াল করেছে। ভার্সিটিতে কেন যেন মনে হয় ওকে কেও দেখছে। কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পায়না ও। আরও একটা ব্যাপার হচ্ছে। আজকাল প্রায়ই একটা ব্লাঙ্ক কল আসে। ফোন রিসিভ করে হ্যালো হ্যালো বলে যায় কিন্তু ওপাস থেকে কোন জবাবই আসে না। শুধু মাঝে মধ্যে ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আর সেই শব্দেই কেন যেন মায়ার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। শেষে না পেরে মায়া ফোন কেটে দিয়ে নাম্বার টা ব্লক করে দেয়। কিন্তু পরে আবারও অন্য একটা নাম্বারে সেই একই ফোন আসে। মায়া তখন রেগে গিয়ে অনেক কিছুই বলে। তবুও ওপাস থেকে কোন প্রতিত্তর আসে না।
মায়ার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো। মায়া বিরক্ত হয়ে ভাবলো ওই লোকটাই হবে। তবে ফোন সামনে নিয়ে দেখলো এটা সারার কল। সারা ভিডিও কল করেছে। মায়ার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। মেয়ে দুটো সত্যিই অনেক মিষ্টি। এখান থেকে যাওয়ার পর থেকেই প্রায়ই ওকে ফোন দিয়ে কথা বলে। মায়ারও অনেক ভালো লাগে ওদের সাথে কথা বলে। মায়া মুচকি হেসে ফোনটা রিসিভ করে সামনে ধরলো । ওপাশে সারা আর রাইসা ক্যামেরার সামনে বসে আছে। সারা হাত নেড়ে হাসিমুখে বললো।
–হায় মায়া আপু কেমন আছ?
–ভালো আছি। তোমরা কেমন আছ?
–আমরাও অনেক ভালো আছি। জানো আজকে না একটা গুড নিউজ আছে শুনবে?
–কি গুড নিউজ?
–আজ না রাইসা আপুর বয়ফ্রেন্ড নিশান জিজু তার পরিবার নিয়ে আসছে বিয়ের কথা পাকা করতে।
–তাই নাকি? এটাতো সত্যিই অনেক ভালো খবর। কংগ্রাচুলেশনস রাইসা।
রাইসা বলে উঠলো।
–থ্যাংক ইউ আপু।তবে শুধু মুখে মুখে বললে চলবে না। বিয়েতে কিন্তু তোমাকে আসতে হবে বুঝেছ?
সারাও বলে উঠলো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ আপু তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে। অনেক মজা হবে। তোমার দাওয়াত সবার আগে। তুমি সাতদিন আগেই চলে আসবে।
মায়া আপাতত ওদের মন রাখার জন্য বললো।
–আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাবে।
অরণ্য অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে। সারা আর রাইসা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে মায়ার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিল। মায়া ফোনের ক্যামেরায় সারা রাইসার পেছনে অরণ্যকে সিড়িতে দেখতে পেল। হঠাৎ অরণ্যকে দেখে মায়ার বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। অরণ্য সেদিকে খেয়াল না করেই চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ সারার মুখে মায়া আপু নাম শুনে অরণ্যের কদম আটকে গেল। অরণ্য পাশে তাকিয়ে দেখলো সারা আর রাইসা ফোনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। তাহলে কি ওরা মায়ার সাথে কথা বলছে? কথাটা ভেবে অরণ্য আগানো কদম ধীরে ধীরে পিছিয়ে নিল। ইতস্তত ভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে সারা আর রাইসার পেছনে এসে দাঁড়াল। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মায়ার মায়াবী মুখটা দেখতে পেল অরণ্য। মুহূর্তেই যেন এক প্রশান্তির বাতাস ছুয়ে দিল মনের কুটিরে। ঘরের ভেতর থাকায় মায়ার মাথায় ঘোমটা নেই। তাই মায়ার খোলা ঘনকালো চুলগুলোও দেখা যাচ্ছে। অরণ্য সব ভুলে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
অরণ্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া হঠাৎ করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।কেমন যেন লজ্জা ঘিরে ধরলো ওকে। মায়া সামনের দিকে তাকাতে পারছে না। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সারা অরণ্যকে দেখে বলে উঠলো।
–আরে ভাইয়া তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু লাগবে তোমার?
সারার কোথায় অরণ্যের ঘোর কাটলো। ছোটবোনদের সামনে থতমত খেয়ে গেল সে। কোনমতে গলা খাঁকারি দিয়ে অপ্রস্তুত ভাবে বলে উঠলো ।
–আরে আমিতো মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মা কি জেন বলবে আমাকে তাই দাঁড়িয়ে আছি। তা তোরা কি করছিস?
সারা বললো।
–আমরা? আমরাতো মায়া আপুর সাথে কথা বলছিলাম।আজ রাইসা আপুর বিয়ে ঠিক হবে সেটাই বলছিলাম। তুমিও কথা বলোনা আপুর সাথে। আফটার অল তোমার একমাত্র শালিকা বলে কথা।
সারার শালিকা কথাটায় অরণ্যের কেমন অসহ্যকর লাগলো। তবুও জোরপূর্বক হেসে ফোনে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো।
–হায় মায়া কেমন আছ?
মায়াও জোরপূর্বক হেসে বললো।
–জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
–এইতো আছি।
এরপর আর কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না ওরা। যদিও মায়ার আরও কথা বলার ইচ্ছে করছে অরণ্যের। তবুও ছোটবোনদের সামনে এভাবে অনেক ইতস্তত লাগছিল অরণ্যের। তাই বাই বলে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে গেল অরণ্য। সারা আর রাইসা আর কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলো। মায়াকে ওদের অনেক ভালো লাগে। মায়া এতো ভালো, অথচ রিয়া ওদের ভাবি হয়েও এখানো ওদের সাথে ভালোকরে মিশতে পারে নি। ওরা যখনি রিয়ার সাথে কথা বলতে যায় তখনি কেমন যেন বিরক্তির ছাপ দেখতে পায় রিয়ার মুখে। তাই ওরাও আর তেমন রিয়ার কাছে যায় না।
শুধু ওরা না। বাড়ির বাকি সবাইও রিয়ার প্রতি তেমন একটা খুশি না। রিয়ার ভাবসাব কেমন যেন অন্য রকম।যেন সে এই পরিবারের ওপর বিরক্ত। মাঝে মধ্যে রিয়ার কথাবার্তায়ও সেটা দেখা যায়। তবে নতুন বউ দেখে কেউ কিছু বলে না। কারণ সবাই চায় রিয়া এবাড়িতে কম্ফোর্টেবল হোক। বাকি সবার মতো সেও মিলেমিশে থাকুক। বউকে কটু কথা শোনানোর মতো শাশুড়ী তনিমা বেগম না। তিনি খুবই নরম মনের মানুষ।
____
সন্ধ্যা ৭ টা
রাইসার বয়ফ্রেন্ড নিশান তার পরিবার নিয়ে চলে এসেছে অরণ্য দের বাড়িতে। সবাই মেহমান দের খাতির দারি করছে। রাইসাকে নিয়ে এসে সামনের সোফায় বসানো হয়েছে। যদিও এটা শুধুই ফর্মালিটি। নিশান আর রাইসার সম্পর্কের কথা অনেক আগে থেকেই দুই পরিবারের সবাই জানে। আজ শুধু ফর্মালিটির জন্য বউ দেখানো হচ্ছে।
সাহিল দুষ্টুমি করে বলে উঠলো।
— আজকে আমাদের কপালে কি খাবার জুটবে নাকি?
রাইসা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কেন ভাইয়া এভাবে বলছিস কেন?
–না মানে বাসার সব আটা,ময়দা তো তুই নিজের মুখেই লাগিয়েছিস। তাই ভাবছি আজ বোধহয় না খেয়েই থাকতে হবে।
সাহিলের কথায় সবাই হেঁসে দিল। রাইসা দাঁত কটমট করে বললো।
–ভাইয়াআআ,,
সাহিল নিশানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–ভাই এখনো সময় আছে। ভেবে দেখ এতো আটা ময়দা কি আমদানি করতে পারবা? শেষে না আবার তোমাদেরও না খেয়ে থাকতে হয়।
ইহান এবার বলে উঠলো।
–চুপ করতো সাহিল শুধু শুধু বেচারিকে জ্বালাচ্ছিস কেন? নাহয় বস্তাখানিক আাটাই মেখেছে। এক বস্তার উপরে তো আর যায়নি। নিশান তুমি এতটুকু তো এফোর্ট করতেই পারবে তাইনা?
ইহানের কথায় আরও একদফা হাসির রোল পড়লো। রাইসা অভিমানী সুরে বললো।
–ইহান ভাইয়া তুমিও?
এদের কথা শুনে নিশান বলে উঠলো।
–চিন্তা করবেন না ভাইয়া আমি আগে থেকেই আটা,ময়দার ফ্যাক্টরি কিনে রেখেছি। তাই আপনার বোনের কম পরবেনা আশা করি।
সাহিল বলে উঠলো।
–বাহ এই না হলে আদর্শ স্বামী। “মুগাম্বো খুশ হুয়া”। যাও আমার বোন আজ থেকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। যাও জিলো আপনি জিন্দেগী।
এভাবে হাসি আনন্দের মাঝেই দেখাদেখির পর্ব শেষ হলো। এক সপ্তাহ পর বিয়ের ডেট ফিক্স করা হলো। কথাবার্তা শেষে এলিসা বেগম সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন।
— কথাবার্তা তো অনেক হলো। এবার গবর(খাবার) খেয়ে নিন। আজকের সব গবর রাইসা নিজের হাতে রান্না করেছে। গবর অনেক গাঁজা( মজা) হয়েছে। আপনারা গবর খেয়ে নিজেদের আঙুল চাটবেন।
এলিসা বেগমের মহান বানি শুনে নিশানের পরিবারের বমি করে দেওয়ার উপক্রম। তারা অনেক কষ্টে ওখানে বসে আছে। ব্যাপার টা বুঝতে পেরে সাহিল বলে উঠলো।
–আরে মামীর কথায় কিছু মনে করবেন না। উনি খাবার খাওয়ার কথা বলছেন। আসলে উনি আমাদের ফিরাঙ্গি মামী তো, তাই একটু ভুলভাল
বাংলা বলে ফেলেন।
সাহিলের কথায় ওরা একটু সস্তি পেল। বেচারারা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। শেষমেষ ওদের সত্যি সত্যিই গবর না খেতে হয়।
খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। সাহিল খেয়াল করলো নিশানের ছোট ভাইটা বারবার শুধু সারার দিকেই তাকাচ্ছে। নানান বাহানায় সারার সাথে কথাও বলার চেষ্টা করছে। আর সারা গাধীটাও কি সুন্দর ছেলেটার সাথে হেঁসে কথা বলে যাচ্ছে। যেন পুরানো বন্ধু ফিরে পেয়েছে। রাগে শরীর রি রি করছে সাহিলের। কিন্তু লোকজনের সামনে কিছু বলতেও পারছে না। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
ছেলেটা হঠাৎ নিজের প্লেট থেকে এক পিচ কাবাব সারার প্লেটে তুলে দিয়ে ন্যাকামি করে বললো।
— এটা তুমি খাও। একটু বেশি বেশি খেয়ে শরীরে শক্তি বানাও।
কথাটা বলে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো।
ব্যাস সাহিলের মাথা গরম করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। এমনিতেই সাহিল একটু শর্ট টেম্পার্ট। অল্পতেই রেগে যায়। আর এই দৃশ্য দেখে তো ওর রাগ এবার চরম পর্যায়ে উঠে গেছে। সাহিল চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে সারার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
–অনেক খেয়েছিস। আর খেতে হবে না। যা রুমে যা।
সারা সাহিলের কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো।
–কেন? এখুনি কেন যাবো? আমার খাওয়া শেষ হয়নি।
সাহিল এবার একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–বললাম না রুমে যা। কত খেতে হয় তোর হ্যাঁ? এখন কি অন্যের টাও খাওয়া শুরু করবি নাকি?
সবার সামনে এভাবে কথা বলায় সারার প্রচুর অপমান বোধ হলো। চোখ দুটো ছলছল হয়ে এলো। লোকটা এতো খারাপ কেন? এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে বলতে পারলো উনি? আর কখনো খাবোই না আমি। সারা প্রচন্ড অভিমান করে কাঁদো কাঁদো চোখে ওখান থেকে দ্রুত পায়ে চলে গেল।
তনিমা বেগম একটু শাসনের সুরে বলে উঠলো।
— এই সাহিল তুই মেয়েটার সাথে এমন করলি কেন? সবার সামনে এভাবে কেউ বলে? শুধু শুধু মেয়েটার মন খারাপ করে দিলি। এতো রাগ আসে কোথাথেকে তোদের?
সাহিল কিছু না বলে সে নিজেও ওখান থেকে উঠে চলে গেল। সবার সামনে যে সারাকে এভাবে বলা ঠিক হয়নি তা নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে ও। কিন্তু ওইসময় এতো পরিমাণ রাগ উঠে গিয়েছিল। তাইতো নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি।
রাত ১২ টা
নিঃশব্দে দরজা খুলে নিরব পায়ে অন্ধকার রুমে ঢুকলো সাহিল। একটুখানি এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল ওর পিচ্চি পরিটা ঘুমিয়ে আছে। সারার মাথার কাছে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলো সাহিল। মায়া ভরা চোখে তাকালো পরিটার দিকে। কান্নার দাগ এখনো লেগে আছে সারার গালে। নাকের ডগাটা এখনো লাল হয়ে আছে। সারা যে কান্না করতে করতেই ঘুমিয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই সাহিলের। বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো।
আস্তে করে হাতটা উঠিয়ে সারার মাথায় পরম আদরে বুলিয়ে দিতে লাগলো। তুই এতো ছোট কেন হলি পরি? আরেকটু বড়ো কেন হলিনা? কেন এতো অবুঝ তুই? কবে একটু বুঝবি আমায়? আমি যে আর পারছিনা। আর ছোটই যখন হলি, এই আমাকে কেন নিজের মায়ায় আটকালি? আমি যে তোর মায়া থেকে নিজেকে কিছুতেই দূরে রাখতে পারি না। চেষ্টা তো কম করিনি। অরণ্য ভাইয়ার সাথে নিউইয়র্ক চলে গেলাম শুধুমাত্র তোর মায়া কাটানোর জন্য। তবুও কাজের কাজ কিছুই হলোনা। সময়ের ব্যবধানে সেই তুই আরও বেশি করে আমার মন মস্তিষ্ক জুড়ে ভর করে নিলি। এখন তো আমি বলতে আমার মাঝে আর কিছুই নেই। সবটা জুড়েই শুধু তুই আছিস।
সাহিল আরও কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে সারাকে দেখতে লাগলো। তারপর সারার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে উঠে এলো। যাওয়ার আগে সারার বালিশের পাশে এক বক্স চকলেট রেখে যেতে ভুললো না। সাহিল জানে চকলেট দেখলে সারার সব মন খারাপ গায়েব হয়ে যাবে।
______
ব্যালকনির গ্রিলের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে মায়া। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের বিশাল চাঁদ টার দিকে। বিছানায় শুয়ে ওর ঘুম আসছিল না। আজকাল কেন যেন মাঝেমধ্যেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। তখন আর ঘুম আসে না ওর। মনটা কেমন অশান্ত হয়ে ওঠে। তাই ফ্রেশ এয়ার নেওয়ার জন্য ব্যালকনিতে এসে বসে আছে। মনের মাঝে নানান অবান্তর খেয়াল ঘুরপাক খাচ্ছে। যেসব নিয়ে ও ভাবতে চায়না সেসব খেয়ালই ঘুরেফিরে ওর মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে। যেমন আজকাল হঠাৎ করেই অরণ্যের কথা মনে পড়ে যায়। আর তখন বুকের ভেতর টা কেমন অস্থির হয়ে যায়। যদিও মায়া এসব একদমই ভাবতে চায়না। কেনই বা চাইবে সেতো জানে ওসব শুধুই মিথ্যে মোহ ছাড়া আর কিছুই না। বাস্তবতা বড়ই কঠিন। তাই সেটাকে মনে রেখে চলায় শ্রেয়।
মায়া জানেও না এক জোড়া চোখ তাকে দেখেই মনের খোরাক মেটাচ্ছে। অরণ্য রাস্তায় গাড়ির ভেতর থেকে মায়াকেই দেখে যাচ্ছে। রাত দশটার থেকে এখানে গাড়ি নিয়ে বসেছিল অরণ্য। আজ মায়া ভার্সিটিতে যায়নি। তাই অরণ্য ভার্সিটিতে মায়াকে দেখতে পায়নি। মনটা প্রচুর অস্থির হয়ে ছিল। তাই অফিস থেকে সোজা এখানেই চলে এসেছে। তবে ভেতরে যায়নি। এতরাতে ভেতরে ঢুকলে সবাই নানান প্রশ্ন করবে তাই আর ভেতরে ঢুকেনি। তখন থেকে এখানেই বসে আছে। মায়াকে একনজর দেখার আশায়। অনেকক্ষণ পরেও মায়াকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে অরণ্য ফিরে যাচ্ছিল। তখনই মায়া ব্যালকনিতে এলো। আর অরণ্যের অশান্ত মনটা আবারও তার প্রশান্তি খুঁজে পেল।
জোছনার স্নিগ্ধ আলোয় মায়াকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও। মায়ার দিঘল কালো চুলগুলো বাতাসে ঢেউ খেলছে। চাঁদের আলোয় মায়াকে আরও মায়াবী লাগছে। এ যেন এক অনাবিল সুখশান্তির প্রচ্ছায়া। অরণ্যের মনে হচ্ছে সময় টা এখানেই থমকে যাক। ও যেন মায়াকে এভাবেই দেখে যেতে পারে।
তবে বাস্তবতার কঠিন মুখটা অরণ্যকে সেই খুশিটা বেশিক্ষণ পেতে দিলোনা। মায়া একটু পরে উঠে রুমে চলে গেল। আর অরণ্যও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসার দিকে গাড়ি ঘুরালো। এভাবে যে কতদিন চলবে তা জানা নেই অরণ্যের। তবে আপাতত ওর হাতে কিছুই নেই। মায়াকে একনজর দেখাটাই যে ওর নিঃশ্বাসের খোরাক। নাহলে হয়তো ও দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবে।
_____
তনিমা বেগম আর সারা বসে আছেন রিয়াদের বাসায়। সামনেই বসে আছেন রিয়ার মা। তনিমা বেগম রাইসার বিয়ের জন্য দাওয়াত দিতে এসেছেন। আর মায়াকে নিয়ে যেতে এসেছেন। আসলে সারা কাল থেকে অনেক জিদ করছিল, সে মায়াকে বিয়ের জন্য ও বাড়িতে নিয়ে যাবে। তাই সারা আর রাইসার আবদার রাখতেই তনিমা বেগম এসেছেন মায়াকে নিতে। আর রিয়ার মাকেও সেইকথা বলেছেন উনি।
কথাটা শুনে রিয়ার মা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। মায়াকে ও বাড়িতে পাঠানোর ইচ্ছে তার মোটেও নেই। সে কোন রিস্ক নিতে চায়না। যদি কিছু হয়ে যায় তখন? মায়া যদি কাওকে কিছু বলে দেয় তখন? কিন্তু এনাদের তো আর সেটা বলা যাচ্ছে না। আর মেয়ের শশুর বাড়ির লোককে মানাও করতে পারছে না। এতো বারবার করে রিকুয়েষ্ট করছে। মানা করলে খারাপ দেখাবে। শিউলি বেগম কোন একটা বাহানা দিয়ে রুমের ভেতরে এসে রিয়াকে ফোন করলো। ফোন রিসিভ করলে শিউলি বেগম বলে উঠলো।
–রিয়া এখন আমি কি করি বলতো?তোর শাশুড়ি তো তোর ননদের বিয়ে উপলক্ষে মায়াকে নিয়ে যাওয়ার বেগ ধরে বসে আছে।
রিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বললো।
–আরে পাঠিয়ে দাও। এতো টেনশনের কি আছে?
–টেনশনের কি আছে মানে? তুই জানিস না টেনশনের কি আছে? যদি ওই মেয়ে একবার মুখ খুলে দেয় তাহলে কি হবে তুই জানিস?
–আরে মা কিছুই হবে না। আমিতো আছিই। ওই আশ্রিতার এতো সাহস নেই কাওকে কিছু বলার। কারণ ও জানে ওর মতো কালিকে কেউই মেনে নিবে না। বরং ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
শিউলি বেগম মনে মনে বললো, আরে গাধি তুইতো আর জানিস না ওই কালিকেই অরণ্যের মনে ধরেছিল। আর বিয়েটাও সে ওকেই করতে চেয়েছিল। যদি মায়া সেটা জানতে পারে তখন কি হবে?
শিউলি বেগমের ভাবনার মাঝেই রিয়া আবার বলে উঠলো।
–আরে মা এতো ভাবার দরকার নেই। কিছুই হবে না। বরং আমার জন্য একটু ভালো হবে। ওকে দিয়ে আমার সব কাজগুলো করিয়ে নিতে পারবো। এই বাড়িতে এমনেই অনেক কাজ থাকে। তারওপর এরা আবার বিয়ের আয়োজন করে নিয়েছে। এখন তো আরও কাজের ঝামেলা থাকবে। তাই মায়া আসলে একদিক থেকে আমার সুবিধাই হবে। আমার তখন অতো কাজ করতে হবে না। সব ওকে দিয়ে করিয়ে নিবো।
–ঠিক আছে তুই যখন বলছিস তাহলে পাঠিয়ে দিলাম। তবে তুই ওর ওপর নজর রাখিস। কোনো চালাকি যেন না করতে পারে।
–ঠিক আছে তুমি চিন্তা করোনা।
সারা সেই কখন থেকে মায়ার রুমে এসে মায়াকে তাড়া দিচ্ছে রেডি হওয়ার জন্য। মায়া কতবার বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সারা কোন কোথায় কানে নেওয়ার পাত্রী না। মায়া রেডি হচ্ছে না দেখে সারা নিজেই মায়ার ব্যাগ বের করে মায়ার কাপড়চোপড় বের করে ব্যাগে ঢুকাতে লাগলো। মায়া কোনমতেই সারাকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না। তখনই শিউলি বেগম মায়ার রুমে এলো। সারার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।
–সারা মা তুমি একটু বাইরে গিয়ে বসো কেমন? তোমার মায়া আপু একটু পরেই আসছে।
সারা মাথা ঝাকিয়ে চলে গেল। শিউলি বেগম মায়ার সামনে এসে বললো।
–রিয়ার শাশুড়ী অনেক জিদ করছে। তাই মানা করতে পারছিনা। তুই যা ওদের সাথে। তবে হ্যাঁ কোনরকম চালাকি করার চেষ্টা করবি না। কাওকে কিছু বলবি না খবরদার। ওরা সত্যি জানতে পারলে কিন্তু তোর মামাকে জেলে ভরবে মনে রাখিস।
মায়া কিছু না বলে শুধু মাথা ঝাকালো। সে এমনিতেও কিছু বলতো না। বললেই বা কি হবে? শুধু নিজেরই তামশা হবে। মায়ার তো ও বাড়িতে যাওয়ারও কোনো ইচ্ছে নেই। ও বাড়িতে গেলে ওকে অরণ্যের মুখোমুখি হতে হবে। যেটা সে চায়না। কিন্তু সারাকে মানা করলেও মেয়েটা কষ্ট পাবে। তাই সারা আর রাইসার মন রাখার জন্য মায়ার না চাইতেও যেতে হচ্ছে।
একটু পরে মায়া রেডি হয়ে বাইরে তনিমা বেগম আর সারার কাছে এলো। সারার খুশী আর দেখে কে। খুশিতে লাফাচ্ছে ও। মায়া তনিমা বেগমের সামনে এসে সালাম দিল। তনিমা বেগমও মুচকি হেসে সালামের উত্তর নিল। আজই প্রথম তনিমা বেগম মায়াকে দেখলো। মেয়েটার চেহারায় এক অদ্ভুত মায়া আছে। মেয়েটা যে সরল মনটা সেটা দেখেই বুঝতে পারলেন তিনি। এজন্যই বুঝি সারা আর রাইসার মায়াকে এতো পছন্দ।
একটু পরে সবাই রওয়ানা হলো। মায়া জানে না ও বাড়িতে যাওয়া টা ঠিক হচ্ছে কিনা। তবে এখন আর ভেবেও লাভ নেই। ভাগ্যের লিখনে যা লিখা আছে তাই হবে।
চলবে…….