মায়ারণ্যে #লেখিকা-মেহরুমা নূর #পর্ব-১১

0
304

#মায়ারণ্যে
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-১১

★মেহেদীর পর্ব শেষে সব ইয়াংস্টার রা মিলে ছাঁদে আড্ডা দেওয়ার আয়োজন করেছে। ছাঁদে গদি পেড়ে বসার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। মিউজিক, খাওয়া দাওয়া সবকিছুরই ব্যাবস্থা আছে। সবাই ধীরে ধীরে এসে আসন গ্রহণ করছে। রাইসার দুই হাত জুড়ে মেহেদী লাগানো। তাই সে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে বসে আছে। আর তার পাশে সারা আর মায়া বসে আছে। বাকিরাও সবাই গোল হয়ে বসলো। তবে রিয়া এখানে নেই। তার মতে এসব ফালতু আড্ডার জন্য সে তার ঘুম নষ্ট করবে না। তাই সে তার রুমে ঘুমাচ্ছে।

মায়াও আসতে চাইছিল না কিন্তু সারা থাকতে কি তা হওয়ার উপায় আছে। অগত্যা আসতে হলো মায়াকে। মায়া ওর শাড়ী চেঞ্জ করে সেলোয়ার-কামিজ পরে এসেছে। মায়ার এই সাধারণ রুপেও যেন অরণ্য মুগ্ধ। তার চোখের আয়নায় শুধু মায়ারই প্রতিচ্ছবি।

সবাই বসে নানান কথা আর হাসির ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে। তখনই সাহিল বলে উঠলো।
–চলনা একটা গেম খেলা যাক। তাহলে আড্ডা জমবে ভালো।
সবাই সাহিলের কথায় সায় জানালো। ইহান বলে উঠলো।
–ওকে, কিন্তু কি গেম?

সাহিলের বলার আগেই সারা মাঝখান থেকে বলে উঠলো।
–আমরা ডামশারাজ খেলবো। মানে ইশারায় কোন ছবি বা গানের নাম বুঝানো।

সাহিল তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–এইখানে নার্সারি বাচ্চাদের গেম খেলা হচ্ছে না চশমিশ। এইসব বাচ্চা খেলা আমরা খেলি না।

সারা তেজী সুরে বললো।
–ওহ তো আপনি বুঝি এখানে আমেনার মায়ের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে বসেছেন তাইনা? এটা মোটেও বাচ্চাদের গেম না। এটা অনেক হাই লেভেলের ইন্টেলিজেন্সি গেম। আসল কথা হলো আপনি পারবেন না তো তাই এসব বাহানা দিচ্ছেন। যান যান গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকুন। আপ সে না হো পায়েগা।

–আচ্ছা তাই? দ্যা গ্রেট সাহিল কে চ্যালেঞ্জ করা? ওকে ফাইন গেম লক। এখন তোকে যদি হারানো বনে না পাঠিয়েছি তাহলে আমার নামও সাহিল না।

–তাহলে বাদাম ওয়ালা নাম কেমন হবে?

সাহিল রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই ইহান বলে উঠলো।
–ওকে ওকে ফাইন ঝগড়ার দরকার নেই। তাহলে আমরা এই গেমই খেলবো। এক দলে ছেলেরা আরেক দলে মেয়েরা ওকে।

সাহিল বললো।
–ওকে, বাট গেমের কিছু রুলস আছে। ১. গেমে শুধু বাংলা ছবি বা গান থাকবে। নো ভারতীয় বা ইংলিশ। ২.মুখে কিছু বলা যাবে না। ৩. আর শেষে যে দল হারবে তাকে শাস্তি স্বরূপ যা করতে বলা হবে তাই করতে হবে ওকে?

সবাই রাজি হয়ে গেল। মেয়েরা একপাশে আর ছেলেরা আরেক পাশে দুই দল হয়ে বসলো। একটা বোলের মাঝে ছবি বা গানের নাম লেখা চিট আছে। সেখান থেকে চিট তুলে চিটে যা থাকবে সেটা নিজের দলকে ইশারায় বুঝাতে হবে। তো সবার প্রথমে সারা চিট তুললো। ওর চিটে এসেছে গান ডানা কাটা পরি। সারাতো সেই খুশি। ওর কাছে তো এটা বা হাতের খেল। সারা উঠে দাঁড়িয়ে চুলগুলো একটু ভালোভাবে ছড়িয়ে নিলো। লেহাঙ্গার ওড়নাটা ভালোভাবে ছড়িয়ে পরীর ডানার মতো বানিয়ে দুই হাত পাখা ঝাপটানোর মতো উপর নিচে করতে লাগলো। ইহান সেটা দেখে দুষ্টুমি করে বললো।
–সারা তোমার কি রাতোরাত পাখা গজিয়ে গেল নাকি? নাকি নিজেকে পাখি ভেবে ওড়ার চেষ্টা করছ?

কথাটা বলে ইহান হাসতে লাগলো। ওর সাথে সাহিলও যোগ দিয়ে বললো।
–এই তুই উড়ে যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে দশ টাকা নিয়ে যাস। ওই কেরামতের চায়ের দোকানে দশ টাকা পাবে তো। যাওয়ার সময় ঠোঁটে করে দিয়ে যাস। তোর দ্বারা কিছুতো উপকার হবে।
কথাটা বলে সাহিলও হাসতে লাগলো।

সারার রাগ হলেও সেটাকে আপাতত পাত্তা না নিয়ে ওর এক্ট চালু রাখলো। ও বাম হাত টা ছড়িয়ে ডান হাতটা দিয়ে বাম হাতের শোল্ডারের ওপর কোপ দিয়ে কাটার মতো দেখাচ্ছে। ইরিন বলে উঠলো।
–কি করছিস সারা কিছুই তো বুঝতে পারছিনা। আরেকটু ভালো করে বোঝা।

এদিকে ছেলেদের দল হেসেই যাচ্ছে। তখনই সারা হঠাৎ চেহারার ভাবভঙ্গি পাল্টে, চেহারায় আবেদনময়ী ভঙ্গি আনলো। যা দেখে বেচারা সাহিলের হাসি মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেল। হা করে তাকিয়ে রইলো সারার দিকে। সারা এবার নেচে নেচে ডানা কাটা পরী গানের স্টেপস করতে লাগলো। রাইসা এবার উৎসাহী কন্ঠে বললো।
— আরে এটাতো ডানা কাটা পরী।
সারা খুশি হয়ে বললো।
–ইয়েস এটাই।
ওরা খুশিতে তালি বাজাতে লাগলো। সারা নিজের আসনে যেতে যেতে সাহিলের দিকে তাকিয়ে চুল ঝটকা মেরে একটা এটিটিউট লুক দিয়ে দিল। সাহিল শুধু মনে মনে হাসলো।

এবার চিট তুললো সাহিল।ওর চিটে কোপা শামসু গানের নাম এসেছে। এমন উদ্ভট নাম দেখে সাহিলের ভ্রু কুঁচকে এলো।এসব আবার কি? এমনও আবার গান আছে নাকি? থাকতেও পারে। এই পাগল গুলোর মাথায় শুধু আজগুবি জিনিসই আসে। সাহিল বেচারা দাঁড়িয়ে আগে ভাবতে লাগলো এটা বুঝাবে কিভাবে। কিছুক্ষণ ভাবার পর সাহিল দুই হাত একসাথে করে নিচের দিকে বারবার কোপানোর মতো ইশারা করতে লাগলো। কিন্তু ছেলেরা ওর ইশারা কিছুই বুঝতে পারছে না। ইহান বলে উঠলো।
–এইগুলা কি করছিস? কোন আগা মাথাই বুঝতে ছি না।

অন্যদিকে মেয়েরা হেঁসে যাচ্ছে আর মুখ দিয়ে শব্দ করছে।
–উউউউউ

সাহিল এবার চিৎ হয়ে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করার এক্টিং করতে লাগলো। মানে সে বোঝাতে চাচ্ছে তাকে কেও কোপাচ্ছে। সাহিলের কান্ড দেখে ছেলেদের কপাল কুঁচকে এলো। ইহান হঠাৎ সাহিলের কাছে গিয়ে পায়ের জুতা খুলে সাহিলের নাকের কাছে ধরলো। সাহিল চোখ মুখ সিটকে নিয়ে উঠে বললো।
–ইয়াক্, কি করছিস এগুলো? জুতা নাকে ধরছিস কেন?

–আরে আমিতো ভেবেছি তোর বোধহয় মির্গী জেগেছে। তাইতো জুতা শুকাচ্ছিলাম। আমি শুনেছি জুতা শুকালে নাকি মির্গী ঠিক হয়ে যায়। দেখলি তুইও ফট করে ঠিক হয়ে গেলি।

–শাট আপ ইডিয়ট। কে বলেছে তোকে আমার মির্গী জেগেছে। আরে আমিতো এক্টিং করছিলাম। কোপা শামসু গানের এক্টিং।

–কস কি মামা? এইয়া এক্টিং ছেলে? আগে কবি তো। হুদাই পেরেশান হইলাম।

এদের কান্ড দেখে মেয়েরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মায়াও নিজের হাসি আটকাতে না পেরে হেঁসে দিল। অরণ্য সাহিলদের দিকেই তাকিয়ে ছিল। মায়ার হাসির শব্দে মায়ার দিকে তাকালো অরণ্য। মায়ার রিনিঝিনি হাসির সুর যেন অরণ্যের মনে শান্তির দোলা দিয়ে যাচ্ছে। মায়াকে এই প্রথম এতো মন খুলে হাসতে দেখছে অরণ্য। হাসিতে মেয়েটাকে কত সুন্দর লাগে।

এবার চিট তুললো ইরিন।ওর চিটে আম্মাজান ছবির নাম এসেছে। ইরিন কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে তারপর ওর দলকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। ইরিন পেট টা একটু সামনের দিকে নিয়ে প্রেগন্যান্ট মহিলার মতো বুঝাতে চাইছে। তখন সারা বলে উঠলো।
–ওয়াও আপু তোমার পেটে বেবি হয়েছে?

ইহান বেচারা মাত্রই পেপসি মুখে দিয়েছিল। সারার এমন মারাত্মক বাণী শুনে বেচারার পেপসি নাকে মুখে উঠে কাশতে শুরু করে দিলো। ইরিন তখন সারাকে ধমকেঁর সুরে বললো।
–এই পাগলী কি বলছিস? কথা বলার আগে একটু ভেবেচিন্তে তো বলবি।

–বারে আমি কি বললাম? তুমি যা দেখালে তাইতো বললাম।

–আরে ওটাতো আমি আম্মাজান ছবির অভিনয় করছিলাম।

ইরিনের কথায় বেচারা ইহানের জানে পানি এলো। অল্পের জন্যে সে হার্ট অ্যাটাক করেনি।

এবার চিট তুললো ইহান। ইহানের চিটে এসেছে প্রেমের জ্বালা ছবির নাম। ইহান কিছুক্ষণ ভেবে এক্টিং করতে শুরু করলো। নানান ভঙ্গিতে বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ওরা কিছুই বুঝতে পারছে না। ইহান কপালে হাত দিয়ে চেহারায় দুঃখী ভাব এনে জ্বালা বুঝাতে চাইছে। সেটা দেখে সাহিল বললো।
–কি হইছে মামা? তোর না হওয়া বউ মইরা গেলো নি?

ইহান দাত কিড়মিড় করে বললো।
— হালা মরবো তোর বউ। আমার বউ মরবো কিসের দুঃখে।

–তাইলে এমন আবাল মার্কা জনম দুঃখিনী লুক দিতাছস ক্যা?

— আরে আমিতো প্রেমের জ্বালা বুঝাবার চাইতাছি।

এদের কান্ড দেখে আবারও সবাই হাসতে লাগলো। এবার চিট তুললো অরণ্য।ওর চিটে এসেছে তুমি আমার স্বামী ছবির নাম । অরণ্য ভাবতে লাগলো এটা আবার কেমন নাম। এটা কিভাবে করবে। অরণ্য কিছুক্ষণ ভেবে হাত দিয়ে ইশারা করে বউকে মালা পড়িয়ে, বিয়ে করার মতো এক্টিং করতে লাগলো। কিন্তু ছেলেদের দল ওর ইশারা বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ ট্রাই করার পরও ওরা ধরতে পারছে। তবে মায়া অরণ্যের ইশারা বুঝতে পেরে ফট করে বলে উঠলো।
–তুমি আমার স্বামী।

মায়ার কথায় অরণ্য কেমন চমকে তাকালো মায়ার দিকে। মায়ার মুখে মুখে তুমি আমার স্বামী কথাটা অরণ্যের ভেতরে কেমন অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করলো। অজানা কারনেই কেন জানি বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো। অন্যদিকে মায়াও হঠাৎ করে কথাটা বলে নিজেই থতমত খেয়ে গেল। নিজেকে এখন ওর তিন গজ মাটির নিচে গেড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
তখন সারা বললো।
–আরে আপু তুমিতো আমাদের দলে। তাহলে অপজিশন পার্টিকে সাপোর্ট করছো কেন? এটা কিন্তু দূর্নীতি।

সারার কথায় সবাই আবারও সবাই হেঁসে দিল। এবং এভাবেই ওদের গেম শেষ হলো। আর ছেলেরাই হেরে গেল। আর শর্ত অনুযায়ী মেয়েরা যা বলবে তাই মানতে হবে। আর মেয়েরা শাস্তি হিসেবে ওদের সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াতে বললো। সাহিল আর ইহান নানান তালবাহানা দিয়ে না যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু মেয়েরাও হার মানার পাত্রী না। ওরা শুধু আইসক্রিম আইসক্রিম বলে চিল্লিয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ ওদের শান্ত করার জন্য অরণ্য বলে উঠলো।
–ওকে ফাইন। আমি আনছি সবার জন্য আইসক্রিম। কিন্তু আমার সাথে তোদের কাওকে যেতে হবে। কারণ কার কোন ফ্লেভার পছন্দ সেটা আমি জানি না। তাই পরে কোন ক্যাচাল করতে পারবিনা।

সারা বললো।
–আমার মেহেদী তো এখনো ভালো করে শুকাইনি তাই আমি যেতে পারবোনা।

ইরিন বললো
–আর আমিও যেতে পারবোনা। আমার একটু কাজ আছে।

সারা কিছুক্ষণ ভেবে বললো।
–ভাইয়া তুমি এক কাজ করো। তুমি মায়া আপুকে নিয়ে যাও। উনি তোমার সাথে যাবে। তাইনা আপু?

মায়া চমকে উঠে বললো।
–আ আমি?

–হ্যাঁ আপু। যাওনা প্লিজ। আজ কতদিন পর আইসক্রিম ট্রিট পাচ্ছি। প্লিজ আমার কিউটি আপুটা যাওনা একটু।

মায়া পড়ে গেল দ্বিধায়। কি করবে বুঝতে পারছে না।সারার সাথে রাইসা আর ইরিনও মায়াকে যেতে বললো। অগত্যা মায়া যেতে রাজি হয়ে গেল। আর অরণ্যের মনে যেন একরাশি খুশির জলোচ্ছ্বাস উপসে পড়ছে। মায়া ওর সাথে একা থাকবে। কিছু সময় ওকে একান্ত নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। ভাবতেই যেন চারিদিকে ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ছে। একটু পরেই দুজন বেরিয়ে গেল আইসক্রিম আনার উদ্দেশ্যে।

আইসক্রিম না আসা পর্যন্ত সবাই বসে নানান কথা বার্তা বলছে। সাহিল ওর ফোন টা বের করে একটু ফেসবুক স্ক্রোল করছিল। হঠাৎ একটা পোস্ট দেখে ওর ভ্রু কুঁচকে এলো। পোস্টের চেয়ে বেশি রাগ হলো ওর পোস্টের কমেন্ট দেখে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর। চোখ হয়ে উঠলো লালবর্ণ। সাহিল উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের এককোনার দিকে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই গম্ভীর কন্ঠে সারাকে ডাকলো। দুবার ডাকার পর সারা ডাক শুনে সাহিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো।
–কি হয়েছে ডাকছেন কেন?

সাহিল রাগী তবে শান্ত কন্ঠে বললো।
–ফোনটা দে তোর।

সারা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কেন? আমার ফোন দিয়ে কি করবেন?

সাহিল চোয়াল চিবিয়ে বললো।
–তোকে দিতে বললাম, দে।বেশি কথা আমার একদম ভালো লাগে না।

সাহিলের ভাবভঙ্গি খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। তাই সারা আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা দিয়ে দিল। সাহিল ফোনটা হাতে নিয়ে কিছু একটা করলো তারপর আবার সারাকে ফোন ফেরত দিয়ে দিল। সারা ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চেক করার পর দেখলো ওর ফেসবুক একাউন্ট শহীদ হয়ে গেছে। সারার মাথার উপর টিভি সিরিয়ালের মতো আকাশ পাতাল, সমুদ্র সব ভেঙে পড়লো। বেচারি হতবিহ্বল হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর এতো সাদের একাউন্ট টা কি দোষ করেছিল? ওর খুন করার মানে কি? সারা সাহিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কি সুন্দর ভাবলেশহীন ভাবে তার ফোন টিপে যাচ্ছে। যেন এখানে কিছুই হয়নি। সারার খুব কান্না পাচ্ছে। সারা রাগী কন্ঠে বললো।
–আপনি আমার ফেসবুক একাউন্ট ডিএক্টিভেট করেছেন কেন? সে আপনার কি ক্ষতি করেছিল হ্যাঁ?

সাহিল সারার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–ক্ষতি সে করেনি। ক্ষতি করেছে একাউন্টের মালিক। শোকর মানা যে তুই নিজে এখনো সহিসালামত আছে। তোর সাহস কি করে হলো ফেসবুকে ছবি ছাড়ার? মানুষের সামনে নিজের রুপের প্রদর্শন করতে চাস হ্যাঁ? যাতে সবার কাছ থেকে নীল পরী লাল পরী এসব শুনতে পারিস তাইনা?

সারার রাগে দুঃখে শরীর রি রি করছে। এই বদ লোকটাকে ছাঁদ থেকে ফেলে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছেও জাগছে। অতিরিক্ত রাগে সারা কথাও বলতে পারছে না। সারা আর একমুহূর্তও সাহিলের সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে ওখান থেকে চলে গেল। মনে মনে সাহিলের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চরম কিছু প্লান করছে। তার একাউন্ট হত্যার বদলা তো সে নিয়েই ছাড়বে।
______

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। নিঝুম রাতের বেলায় পাশে হৃদয়ের রাণীকে নিয়ে ড্রাইভ করার অনুভুতিটাই অন্যরকম। এটা অরণ্যের কাছে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আর এই মুহূর্ত টাকে একটু বেশি করে করে এনজয় করার জন্য অরণ্য আইসক্রিম কিনে আইসক্রিম পার্লারের এক ছেলেকে দিয়েই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। মায়া জিজ্ঞেস করলে বলেছে ওরা আইসক্রিম আইস বক্সে করে নিয়ে যাবে। তাহলে আর আইসক্রিম গলবে না। তাই মায়াও আর কিছু বলেনি।

অরণ্য গাড়ি ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে শুধু মায়াকেই দেখে যাচ্ছে। মায়া জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। বাতাসে ওর দীঘল কালো চুলগুলো অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। মায়া ওড়না দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করলেও তাতে খুব একটা সফল হচ্ছে না। অরণ্যের খুব বলতে ইচ্ছে করছে, থাকনা চুলগুলো একটু মুক্ত করে দাওনা। হয়তো এই চুলের আঁধারেই রাত আরও জেগে উঠবে।কিন্তু আপসোস সেটা বলার অধিকার অরণ্যের নেই। তবে ওড়নার ফাঁকেই মায়ার চুলগুলো উড়ে এসে অরণ্যের মুখে বাড়ি খাচ্ছে। অরণ্য চোখ বন্ধ করে মায়ার চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে। এক মোহময় মাতাল করা ঘ্রাণ। অরণ্যের এই মুহূর্তটা, এই সময় টাকে এখানেই আটকে রাখতে ইচ্ছে করছে। অরণ্য একটু সাহস করে বললো।
–মায়া তোমার না রাত পছন্দ? তো আজকে কি রাতের সওয়ারী হবে? রাতের শহর দেখবে?

মায়া না বললেও ওর নিজেরও অরণ্যের সাথে এই মুহূর্ত টা অনেক ভালো লাগছে। তাই কেন যেন অরণ্যের কথায় মানা করতে পারলো না মায়া। লোকটার ওপর কেন যেন ও অনেক ভরসা পায়। মায়া মাথা হালকা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো। অরণ্যের খুশি আর দেখে কে। প্রফুল্ল মনে গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলো। আর মায়া আবারও বাইরে তাকিয়ে রইলো। আজকের রাতটা যেন অন্যরকম লাগছে ওর কাছে। অন্য সব রাতের মতো একাকী আর বিষন্ন মনে হচ্ছে না। মনের মাঝে এক সুখানুভূতি হচ্ছে।

অরণ্য ড্রাইভ করতে করতে একটা নির্জন নদীর কিনারায় এসে গাড়ি থামালো। গাড়ি থেকে নেমে মায়ার পাশে এসে দরজা খুলে মায়াকে নেমে আসার ইশারা করলো। মায়া একবার অরণ্যের দিকে তাকালো, তারপর আস্তে করে নিচে নেমে দাঁড়াল। নেমে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেল মায়া। সামনে বহমান নদী। নদীর কিনারায় কাশফুলের বন। জোছনার আলোয় কাশফুল গুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে মায়ার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মায়া আনমনেই সামনের দিকে পা বাড়ালো। এগিয়ে গিয়ে কাশফুল গুলো ছুঁয়ে দিল। শীতল বাতাসে মায়ার ভেতরে যেন এক অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাতের এমন সৌন্দর্য এর আগে কখনো দেখেনি মায়া। এ যেন এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি।

আর অরণ্য মুগ্ধ হচ্ছে তার মায়াপরী কে দেখে। সে ভিজছে মায়ার জোছনায়। জোসনা রাতের এই কাশফুলের মাঝে মায়াকে যেন আরও মায়াময়ী হৃদহরণী লাগছে। সে যে সত্যিই অরণ্যের হৃদহরনণী। অরণ্যের মনের রাণী। ওর সন্ধ্যামালতী। অরণ্য ওর ফোনটা বের করে মায়ার অজান্তেই মায়ার এই সুন্দর মুহুর্তের একটা ছবি তুলে নিল। অরণ্য মায়ার কাছে এগিয়ে গেলে মায়া মুচকি হেসে বললো।
–ধন্যবাদ আপনাকে আমাকে এতো সুন্দর একটা জায়গায় আনার জন্য। সত্যিই আজকের মতো সুন্দর রাত আমি কখনোই দেখিনি।

অরণ্য মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–আমিও না।

ওরা আরও কিছুক্ষণ থেকে আবারও বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। অরণ্য মুহূর্ত টা আরও সুন্দর করতে গাড়ির মিউজিক প্লেয়ার চালু করলো। মিউজিক প্লেয়ার চালু করতেই গান বেজে উঠলো।
♬ রাগ রাগ মে ইস তারহা তু সামা নে লাগা
♬ জেই সে মুঝিকো মুঝ সে চুরা নে লাগা
♬ দিল মেরা লে গায়া লুটকে
♬ চোরি চোরি, চুপকে চুপকে
♬ চোরি চোরি, চুপকে চুপকে
♬ চোরি চোরি, চুপকে চুপকে

অরণ্য সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছিল হঠাৎ ওর কাঁধে ভারি কিছু অনুভব করলো সে। অরণ্য মাথা ঘুরিয়ে দেখলো মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঘুমের ভেতরেই মায়ার মাথাটা অরণ্যের কাঁধে হেলে পড়েছে। এটা দেখে মুহুর্তেই যেন অরণ্যের শিরদাঁড়া দিয়ে এক শীতল বাতাস বয়ে গেল। এই প্রথম মায়া ওর এতো কাছে এসেছে। হয়তো অজান্তেই, তবুও তো এসেছে। অরণ্য গাড়ি সাইড করে থামিয়ে মায়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঘুমন্ত মায়ার মুখে যেন পৃথিবীর সব মায়া ঢলে পড়েছে। অরণ্যের খুব ইচ্ছে করছে ওর সন্ধ্যামালতীকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিতে। মায়াকে বুকে জড়িয়ে তার বুকের দহন মিটিয়ে নিতে। মায়ার ললাটে ভালোবাসার চিহ্ন একে দিতে। কিন্তু সে অধিকার যে তার নেই। অরণ্য ওর হাতটা উঠিয়ে আলতো করে মায়ার গালে রাখলো। মায়ার দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বললো।
–আমি যে আর পারছিনা সন্ধ্যামালতী। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন যে দুর্বিষহ হয়ে গেছে। আজ এতো কাছে পেয়েও তোমাকে বুকে আগলে নিতে পারছিনা। এই না পাওয়ার জ্বালা যে আমাকে কুড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। রাইসার বিয়ের পর তুমি আবারও চলে যাবে। আর দেখতে পাবো না তোমাকে। এটা ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মন চায় তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যেতে। যেখানে শুধু তুমি আর আমি থাকবো আর কেউ থাকবে না। কিন্তু চাইলেও যে তা পারা যায় না। আমার উপরেও যে কিছু দায়িত্ব আছে। যা আমি এরিয়ে যেতে পারি না। আপুর জন্য বাবার আগেও একবার মানুষের সামনে ছোট হতে হয়েছে। এখন যদি আমার জন্যেও আবার এমনটা হয় তাহলে কি হবে? কিন্তু তোমাকে ছাড়াও যে আমার চলবে না। তা আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। এভাবে আমি বাঁচতে পারবোনা। একবার রাইসার বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর কিছু একটা করতেই হবে আমাকে। হ্যাঁ আমি অবশ্যই কিছু করবো। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না সন্ধ্যামালতী। কিছুতেই না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here