শ্যামাঙ্গণা-১৩,১৪

0
224

শ্যামাঙ্গণা-১৩,১৪

১৩
————-

খাওয়া দাওয়া শেষে ঘরে এসে এসি ছেড়ে বসেছে শাওমি। পেটটা এখন অনেকটা শান্ত আগের থেকে। এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার সময় ট্রাফিক জ্যামে পড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। কাজেই রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ আপ হতে হতে সন্ধ্যা কাবার। মালিনী বেগম নিজের হাতে কোরিয়ান কিম্বাপ তৈরি করে পাঠিয়েছেন শাওমির জন্য। যদিও এই হাতে তৈরি কিম্বাপে কোরিয়ান সব ইনগ্রেডিয়েন্টস নেই কারণ এটা বাংলাদেশ কিন্তু কোরিয়ান স্বাদ ঠিকই আছে। কাজেই শাওমির খেতে কষ্ট হয়নি। এছাড়া কিম্বাপের সঙ্গে রামেনও খেয়েছে সে, যেটা সুপার শপ থেকে আনানো হয়েছে।

এসি বন্ধ করে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে ফ্যানের নিচে দাড়ালো শাওমি। চুল এখনও ভেজা। আজ হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকোতে মন চাচ্ছে না তাই ফ্যানের নিচে দাড়িয়েই শুকিয়ে নিচ্ছে। শাওমি যখন ফ্যানের নিচে দাড়িয়ে চুল শুকাতে ব্যস্ত তখনই হেয়ার ড্রায়ার হাতে ঘরে ঢুকলো ঝুমুর। শাওমিকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে চুল শুকাতে দেখে এগিয়ে গেলো ঝুমুর। শাওমিকে বিছানায় বসিয়ে আলতো হাতে চুলে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করছে সে।

ঝুমুর যখন নিজের কাজে ব্যাস্ত তখনই শাওমি বললো ‘ এই তোর বয়ফ্রেন্ড আছে ঝুমুর ? ‘

শাওমির কথা শোনা মাত্র আতকে উঠল ঝুমুর। সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বুলালো। ঘরের দরজা খোলা কিন্তু রুমের বাইরে আশেপাশে কেউ নেই। ঝুমুর দ্রুত উঠে গিয়ে ঘরের দরজা দিলো। তারপর তড়িৎ গতিতে শাওমির কাছে এসে শাওমির কয়েক গাছি চুল টেনে ধরলো। হতবাক শাওমি বললো ‘ কি এমন বললাম যে চুল টানছিস ? ‘

ঝুমুর ফিসফিস গলায় বললো ‘ বলার আগে দেখে শুনে নিবি তো আশেপাশে কেউ আছে কিনা। এরকম কথা কেউ পাবলিকলি বলে ? ‘
ঝুমুরের হাবভাব আর দুই চোখের লুকোচুরি দেখে শাওমি চোখ দুটো বড় বড় করে হেসে দিলো। বাঁকা হেসে বললো ‘ তারমানে আমি যা ধারণা করেছি তা আসলেই সত্যি। তোর আসলেই বয়ফ্রেন্ড আছে। ‘

ঝুমুর শাওমির কথায় অসস্তিতে কাদা হলো। তার শ্যাম বর্ণা গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। ফুলোফুলো গালে সে লজ্জায় রাঙা হয়ে বললো ‘ ধরে নে তেমনই কিছু একটা। কিন্তু উনি আমার বয়ফ্রেন্ড নন। প্রেমিক হন উনি… ‘

‘ প্রেমিক ‘

শব্দটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেও এর অর্থ শাওমি ঠিকই ধরতে পেরেছে। ও ভ্রু কুচকে বললো ‘ তাহলে দুটোর মধ্যে পার্থক্য কি ? ‘
শাওমির কথা শুনে ওর মুখোমুখি বসলো ঝুমুর। নিজের লজ্জা নত মুখটা স্বাভাবিকভাবে গুরুগম্ভীর করে তুলে বললো ‘ দুটোতেই অনেক পার্থক্য আছে। আমার কাছে বয়ফ্রেন্ড শব্দটা সম্পূর্ণ আবেগহীন একটা শব্দ যেখানে প্রেমিক শব্দটা জুড়ে আবেগ, মায়া,দায়িত্ব,অধিকার সবই আছে। ‘

‘ বুঝেছি… বুঝেছি, আর বলতে হবে না। এসব কথা ছাড়। আগে এটা বল তোর ওই প্রেমিকটা কে ? ‘

শাওমির কথায় ঝুমুর মাথা নেড়ে না বোধক ইশারায় বললো ‘ উহু… ‘
ঝুমুরের আপত্তি দেখে শাওমি চোখ দুটো গোল গোল করে বললো ‘ উহু মানে ? তুই কি আমাকে বলবি না কে সেই ছেলে ? আমাকে ? আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ? ‘
ঝুমুর মাথা নেড়ে বললো ‘ প্রিয় বান্ধবী বটে কিন্তু দুঃখিত সখি। আমি চাহিয়াও বলিতে পারছিনা আপনাকে। যখন সময় হবে তখন এমনিতেই জানতে পারবি। ‘

ঝুমুরের কথায় শাওমি আর কিছু বললো না। এমনিতেই ও জানে ঝুমুরকে জোর করে লাভ নেই। ঝুমুরের যতক্ষণ মন না হবে ততক্ষণ সে মুখ ফুটে কিছুই বলবে না। কাজেই ও চুপ করে গেলো। তবে ঝুমুর ওর চুলগুলো ড্রাই করে দিতেই ও বিছানা ছেড়ে ঘরের এক কোণায় থাকা লাগেজের কাছে গেলো। লাগেজ থেকে জামা কাপড় আগেই নামিয়ে ঝুমুরের আলমারিতে রেখেছে। এখন শুধু কিছু জরুরি জিনিস বের করা বাকি।

শাওমি লাগেজ থেকে ওর ল্যাপটপসহ যাবতীয় জিনিস বের করে এবার একটা মাঝারি আকারের বক্স বের করলো। তারপর লাগেজের চেইন লাগিয়ে সেটা আলমারির পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে ঝুমুরের পাশে এসে বসলো। ঝুমুর এক মনে শাওমির হাবভাব দেখছে। ঝুমুরের দিকে বক্সটা এগিয়ে দিল শাওমি।

বক্সটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুচকে শাওমির দিকে তাকিয়ে আছে ঝুমুর। বক্সটা তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে অথচ মনে পড়ছে না। ঝুমুরের কুঞ্চিত দৃষ্টি দেখে শাওমি বললো ‘ খুলে দেখলেই বুঝবি কি আছে ওটাতে। ‘
ঝুমুর ছোট থেকেই বরাবর কৌতূহলী। অজানাকে জানার ইচ্ছা এবং অচেনাকে চেনার তৃষ্ণা তার বরাবরই বেশি। কাজেই বক্সের ভিতরে কি আছে দেখার কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না। ও ধীর হাতে বক্সটা খুললো।

অ্যান্ড দা থিং ইজ ঝুমুর ওয়াজ শকড। বক্সটা খুলতেই চমকে গেছে ও। ঝুমুরের চমকিত দৃষ্টি দেখে শাওমি নিঃশব্দে হাসলো। বক্স থেকে রিবন ব্রোচটা তুলে নিলো শাওমি। তারপর নিজের ট্রাউজারের পকেট থেকে একই রকমের আরেকটা ব্রোচ বের করলো। তফাৎ শুধু একটাই। ঝুমুরের হাতে যেই ব্রোচ ছিল সেটা সিলভার আর শাওমিরটা গোল্ডেন কালার।

‘ এটা তুই কোথায় পেলি ? আমি না কোরিয়া থেকে আসার সময় হারিয়ে ফেলেছিলাম ?’

ঝুমুরের অবাক গলায় বলা কথা শুনে শাওমি হাসলো। বললো ‘ হুম হারিয়ে ফেলেছিলি কিন্তু লাকিলি আমি পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম দিয়ে দিবো কিন্তু আর দিতে ইচ্ছা করলো না। তাসনুবা চাচী আমাদের দুজনকে দিয়েছিলেন এটা। এটা ছাড়া তোর আর কোনো স্মৃতি ছিল না আমার কাছে। তাই ভেবেছিলাম রেখে দেই। পরে মনে হলো যার জিনিস তাকেই ফেরত দেওয়া উচিত। হয়তো চাচীর স্মৃতি বলে আজও তুই কাদছিস এটার জন্য। ‘

শাওমির কথা শুনে ঝুমুরের চোখে পানি এলো। তবে ও কাদলো না। চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো ‘ স্মৃতি তো তার হয় যাকে ভোলা যায়। আমি ভুলিনি অমনিকে। তাই ওর জন্য আমি কাদিও না। তুই ভুল ভাবছিস। তবে এটা পেয়ে আমি সত্যিই খুশি। তোকে ধন্যবাদ। ‘

শাওমি কিছু বললো না। ঝুমুর ওর শুকিয়ে যাওয়া চুলগুলোতে আলগোছে হালকা করে বেণী করে বেধে দিল যাতে ঘুমনোর সময় বালিশে গড়াগড়ি খেয়ে চুল নষ্ট না হয়। ঝুমুরকে মালিনী বেগম বলতেন রাতের বেলা চুল বেধে না শুলে নাকি চুল নষ্ট হয়ে যায়। তারপর চুল বাঁধা শেষে ঝুমুর তার চুলেও বেণী করে মশারী করে শুয়ে পড়লো। শুয়ে থেকে একসময় গল্প করতে করতে দুজনেই নিদ্রার দেশে তলিয়ে গেলো।

—-

ভোরবেলা নগ্ম পায়ে বাগানের কাছে এসে দাড়িয়েছে ঝুমুর। ওর পিছন পিছন শাওমিও এসেছে। ক্যাচক্যাচ শব্দে বাগানের বেড়া দেওয়া দরজাটা খুলে ফেললো ঝুমুর। তারপর খালি পায়েই কঠিন শিলা মাড়িয়ে ভোরের স্নিগ্ধ আসমানের নিচে ভেজা মাটিতে গিয়ে দাড়ালো। বাগানে পা রাখতেই রঙিন ফুলের সমারোহে শাওমির চোখ জুড়িয়ে গেলো। ও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আশপাশটা।

দুই বছর আগে এমন অনেক গাছই ছিল না যা ঝুমুর বর্তমানে লাগিয়েছে। অলকানন্দা,নয়নতারা, এসব নতুন গাছ। নতুন করে জারুল গাছও লাগিয়েছে। বেশ কয়েক মাসেই অনেকটা বেড়ে উঠেছে সেই জারুল গাছ। গ্রীষ্ম আসন্ন বলেই হয়তো জারুল গাছটাতে নতুন সবুজ পাতা জন্মেছে। গ্রীষ্মের আগমনে হয়তো ফুলও ফুটবে।

রোজকার মতোই ঝুমুর ব্যস্ত হয়ে বই পড়ছে। দিনের শুরুটা ভোরবেলা বাগানে বই হাতে না কাটালে তার পুরোটা দিন অসীম যন্ত্রণায় কাটে। তাই এই সময়টাতে সে কখনো ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় সময় কাটানোর সুযোগ মিস করে না। তবে ঝুমুরের এরকম নগ্ন পায়ে বাগানে হাঁটার ব্যাপারটা শাওমির মোটেই পছন্দ নয়। বাগানে কতকিছু থাকে। হুট করে যদি কিছু একটাতে পা লেগে যায় তখন কষ্টটা তো ঝুমুরই পাবে।

‘ যেই কাজটা তুই খালি পায়ে করছিস সেই একই কাজ তুই জুতো পরেও করতে পারবি। স্লিপারটা পড়লে কি সমস্যা তোর ? পায়ে কিছু লাগলে তো ব্যথা তোরই করবে। ‘

শাওমির কথায় ঝুমুরের মনযোগ বিচ্ছিন্ন হলো তার বই থেকে। বইয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঝুমুর খানিকটা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে তাকালো শাওমির দিকে। অতঃপর বললো ‘ এটা আমার নিত্য দিনের অভ্যাস। হুট করে এই অভ্যাস বদলানো সম্ভব না। তাছাড়া আমি রোজই এভাবে হাটি। এতদিন যখন হয়নি কিছু তখন এখনও হবে না। ‘

ঝুমুরের কথায় বিরক্তিতে ছেয়ে গেল শাওমির ফর্সা মুখখানা। বাধ্য হয়েই ওর এই অবাধ্য সখীর মুখও দর্শন করবে না এই প্রতিজ্ঞায় সে গিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসলো। আনমনে গাছের নিচে ঝড়ে পড়া ফুলগুলো দেখছিল হঠাৎই কি মনে করে মুখ তুলে ছাদের দিকে তাকালো আর তখনই নজরে পড়লো ফর্সাটে ধরনের একটা ছেলে ঝুমুরদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে হাত পা নাড়া চাড়া করছে। শাওমি ভাবলো হয়তো ব্যায়াম করছে।

শাওমি কোরিয়ান হিসেবে ফর্সা। তার সঙ্গে সাধারণ বাঙালিদের মোটেই যায় না। তবে কোরিয়ান হয়েও সে কখনো নিজের রূপ নিয়ে অহংকার করেনি। বরং যেই দেশের মানুষরাও ঝুমুরের মতো শ্যামলা বর্ণের এবং বড় মনের অধিকারী তাদের প্রতি ভালো লাগাটা শাওমির একটু বেশি।

ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা ফর্সাটে ওই ছেলের মায়া জড়ানো ফর্সা নিটোল মুখখানা যেন শাওমির মনে ধরলো। স্নিগ্ধ সকালের দীপ্তিময় সূর্যের আলোক দ্যুতি আছড়ে পড়ছে ছেলেটার সর্বাঙ্গে। সেই দ্যুতি ছড়ানো মায়াবী চেহারা দেখে শাওমির মনে হলো তার হৃদ স্পন্দন যেন স্বাভাবিক নিয়ম থেকেও দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। মায়াবী চেহারার পুরুষকে দেখা মাত্রই তার চোখে মুখে স্নিগ্ধ হাসি এবং বুকের ভিতরটায় চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে।

শাওমি উঠে গিয়ে ঝুমুরের কাছাকাছি দাড়িয়ে ঝুমুরের বইয়ে উকি দিল যাতে ঝুমুর এখন কোন লাইনে আছে বুঝতে পেরে ঝুমুরের পড়া শেষে জরুরি কথা জিজ্ঞেস করতে পারে। নিজের বইয়ে শাওমিকে তাকাঝাকি করতে দেখে বেশ খানিকটা বিরক্ত হলো ঝুমুর। ও ওর বইটা বন্ধ করে দিয়ে বিরক্তি মিশানো গলায় বললো ‘ এভাবে উকি মারা কি ঠিক ? তুই জানিস না এমন উকিঝুকি আমি পছন্দ করিনা ? ‘

ঝুমুরের কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না শাওমি। চোখের ইশারায় ছাদের দিকে ইশারা করে বললো ‘ এই ওই লোকটা কে রে ? ‘
শাওমির ইশারা অনুসরণ করে ছাদের দিকে তাকাতেই ঝুমুরের ভ্রু কুচকে গেলো। মুখে বললো ‘ আমাদের ভাড়াটিয়া, আমার ইংলিশ টিউটর আর সর্বোপরি ছোট মামার বন্ধু। তুই হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস কেন বলতো ?’

শাওমি যেন ঝুমুরের কথায় আশার আলো খুঁজে পেলো। চমকে গিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো ‘ তোর টিচার উনি ? তারমানে উনার সঙ্গে তো ভালই কথাবার্তা হয় তোর। এই তুই আমার সঙ্গে উনার একটা সুযোগ করে দে। আই প্রমিজ আর কোনো হেল্প চাইবো না। এটাই লাস্ট ‘

শাওমির কথাবার্তার ধরনে ঝুমুর প্রথমেই টের পেয়েছিল শাওমি ফাহমানের প্রতি ইন্টারেস্টেড। কিন্তু কথাটা যে শাওমি সরাসরি বলবে সেই আশা করেনি সে। তবে হতবিহ্বল ঝুমুর নিজেকে সামলে বললো ‘ লিসেন শাওমি হি ইজ মাই টিউটর। তাছাড়া উনি প্রেম, ভালোবাসা এসব নিয়ে মাতামাতি করেন না। করলেই বা কি ? আমি স্টুডেন্ট হয়ে উনার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলবো নাকি ? ‘

ঝুমুরের কথায় শাওমির মুখের হাসি মিটলো না। ও হাত নেড়ে নেড়ে বললো ‘ তোর কিছুই বলতে হবে না। তুই শুধু পড়তে গেলে উনার সঙ্গে আমার পরিচয়টা করিয়ে দিবি। তারপর বাকি আমি দেখে নিবো। ‘

‘ আশ্চর্য তো। তুই কোরিয়ান হয়ে বাঙালি ছেলের পিছনে পড়লি কেন ? কোরিয়াতে কি ছেলের অভাব পড়েছে ? ‘ বিরক্ত ভরা কণ্ঠে বললো ঝুমুর।

‘ কোরিয়াতে ছেলের অভাব নেই ঠিক কিন্তু ওই মায়াবী পুরুষের মতো মায়া ভরা মুখ কারোর নেই। উনাকে আমার মনে ধরেছে রে ঝুমুর। আমার মনে হচ্ছে আমার হার্টটা ফাস্টেস্ট স্পিডে লাফাচ্ছে। ‘ বুকে হাত রেখে কথাটা বললো শাওমি।

শাওমির কথায় মনটা বিষিয়ে গেলো ঝুমুরের। তার হয়েছে এক জ্বালা। যাবে কোথায় সে ? এক দিকে ভালোবাসার মানুষ আর আরেক দিকে ছোটবেলার সখি। একজনকে খুশি করতে গেলে যে আরেকজনকে কষ্ট দিতে হবে। কিন্তু তার পক্ষে যে কাউকেই কষ্ট দেওয়া সম্ভব নয়। ঝুমুর করবে তো করবে টা কি ?

চলবে….
মিফতা তিমু

শ্যামাঙ্গণা-১৪
————-

পোড়া রোদ্দুরে নগ্ন পায়ে বাগানে পায়চারি করছে ঝুমুর। সকালের মতো তার হাতে এখন আর বই নেই। বই পড়ে আছে অবহেলায় জারুল গাছের নিচে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে শাওমির কথাগুলো শুনে মন এতটাই বিষিয়ে গেছে যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসাও সে অনুভব করতে পারছে না। সবকিছুর প্রতিই বিষ বিষ অনুভূতি হচ্ছে।

বিরক্তিতে ঝুমুর অনবরত পায়চারি করছে। শাওমি তাকে রেখে বাসায় ঢুকেছিল কিন্তু সে যখন ফিরছে না দেখলো না তখন তাকে ডাকতেও এসেছিল। কিন্তু ঝুমুরের গমগমে গলায় ‘ লিভ মি এলোন ‘ কথাটা শুনে আর সাহস করতে পারেনি কিছু বলার। বাধ্য হয়ে সে মনোয়ারা বেগমকেই ডেকেছিল কিন্তু তিনিও হাজার বলে নাতনীকে ঘরে ফেরাতে পারেননি। উপরন্তু ঝুমুর বিরক্তিতে ঠাসা মুখে বলেছে ‘ আমার সময় হলে আমি আসবো ‘

পড়ালেখার প্রতিও মন বসছে না ঝুমুরের। অথচ পড়তে বসা দরকার। পড়াশোনাকে অবহেলা করলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সে তার অমনির তাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। এসব জানে ঝুমুর তবুও মনকে তো আর মানানো যায় না। মন তো ঘুরে ফিরে ভালোবাসা নামক বিশ্রী অনুভূতিটার জন্যই কাদে।

স্কার্টের পকেটে দশ টাকা ছিল। ঝুমুর ঠিক করলো কিছু একটা খেয়ে আসা যাক দোকান থেকে। ঝুমুর বাগান ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বিল্ডিংয়ে ঢুকে জুতো পড়ে আবার বেরোলো। গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এলো। কিছুদূর হাঁটার পরই পরিচিত,চেনা জানা দোকানটা চোখে পড়লো। ঝুমুর এগিয়ে গেলো সেইদিকে।

ঝুমুরকে এহেন অবেলায় দোকানে দেখে হাসলেন নাফিসা বেগম। পান খাওয়া মুখে বললেন ‘ কেমন আছো ঝুমুর ? হঠাৎ এই সময় ? মন খারাপ নাকি ? ‘
মহিলার কোনো প্রশ্নের উত্তরই দিলো না ঝুমুর। আপাতত উত্তর দেওয়ার চেয়েও খাওয়ার জন্য কিছু একটা খুঁজে বের করা দরকার। ঝুমুর কিছুক্ষণ আশপাশ চোখ বুলিয়ে দেখলো ম্যাংগো বার আছে। ও হাত বাড়িয়ে সেদিকে ইশারা করে বললো ‘ ওটা দিন ‘

নাফিসা বেগম ঝুমুরের ভাব গতি লক্ষ্য করছেন। মেয়েটা উনার মেয়ের সাথেই ইন্টার ফাইনাল ইয়ারে পড়ে তবে উনার মেয়ে আঁখি প্রাইভেট কলেজে আর ঝুমুর পাবলিকে। আঁখি আর ঝুমুর একই ক্লাসে হলেও আঁখির থেকে ঝুমুর অনেকাংশে বুদ্ধিমতী এবং গুণী। মেয়েটার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা হলে কি হবে ? গুণ তো তার ঠিকই আছে যার কোনোটাই নাফিসা বেগমের মেয়ে আঁখির নেই।

ঝুমুরের কথা শুনে নাফিসা বেগম ম্যাংগো বার বের করে বললেন ‘ এটা পনেরো টাকা ‘
ঝুমুর একবার হাতে থাকা দশ টাকার নোটের দিকে তাকালো আরেকবার নাফিসা বেগমের হাতে থাকা ম্যাংগো বারের দিকে। যদি পারতো দশ টাকার নোটকে জাদুবলে পনেরো টাকা করে দিতে তাহলে কতই না ভালো হতো। ঝুমুর চাইলেই বাকিতে নিতে পারে কিন্তু সেটা তার এথিক্সের বাইরে।

জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে সবাইকেই কিছু নিয়ম নীতির বেড়াজালে আটকে বাঁচতে হয়। এসব বেড়াজালে আটকে থাকতে থাকতে একসময় তারা হাপিয়ে যায় কিন্তু জীবিকা নির্বাহের তাড়নায় কিংবা সুষ্ঠু জীবনে বেচেঁ থাকার জন্যই তাদের এসব মেনে নিতে হয়।

ঝুমুর তার ক্ষণস্থায়ী জীবনে সাধারণ কিছু এথিকসের উপর নির্ভর করে চলে। এসবের মাঝেই কারোর কাছ থেকে ধারে কিছু না নেওয়া তার অন্যতম এথিক্স। ধারে কোনোকিছু নেওয়াতে ঝুমুরের বিবেক এবং রুচি উভয়তেই বাধে। তাই ঝুমুর ঠিক করলো সে নিবে না। ঝুমুর নাফিসা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো ‘ তাহলে থাক রেখে দেন। পরে এসে নিয়ে যাবো। ‘

ঝুমুরের কথায় নাফিসা বেগম মুখটা বেজার করে ম্যাংগো বার ঢুকিয়ে রাখলেন কারণ উনি জানেন ঝুমুর মরে গেলেও ধার করে উনার থেকে জিনিসটা নিবে না। ঝুমুরকে উনি বিগত দশ বছর যাবত দেখছেন। এই দশ বছরে উনি অন্তত এতটুকু টের পেয়েছেন ঝুমুর আর সব মেয়েদের থেকে আলাদা। তার মধ্যে প্রচন্ড দায়িত্ব জ্ঞান বোধ এবং আত্ম সম্মান আছে যা তাকে কখনোই মাথা নুয়াতে দেয় না।

‘ আন্টি আপনি ওকে ওটা দিয়ে দিন। টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। ‘

ঝুমুর খালি হাতেই বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পিছন ফিরলো। ফাহমানকে দোকানের সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কপালে ভাঁজ পড়ল। ওর সকালের রাগ এবং মন খারাপ ভাবটা আবারও ফিরে এলো। কি দরকার ছিল মানুষটার এখন তার সামনেই আসার ? লোকটার কি কোনো টাইম সেন্স নেই ? যখন তখন যার তার সামনে চলে আসে। প্রথমে তার সামনে আসলো এরপর তার প্রিয় সখীর সামনেও এলো।

আর যতবারই আসে ততবারই মারকাটারি এক লুক নিয়ে সামনে আসে যা দেখে যে কোনো মেয়েই মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। বেশভূষা, চাল চলন, আচার ব্যবহার সব সাধারণ। অথচ ব্যক্তিত্বটা এতই ধারালো যে যেকোনো মেয়েকে দুই মিনিটের মধ্যে নিজের দিকে আকর্ষিত করতে পারে। হাসিটা মারাত্মক রকমের অসভ্যও বটে। এই হাসির প্রেমেই তো পরেছিল ঝুমুর।

তবে আজ ফাহমানের অসভ্য মার্কা হাসি এবং ধারালো ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ল না ঝুমুর। ফাহমানের সামনের কালো চুলগুলো কপালে হুটোপুটি খাচ্ছে। তার নাকে মুখে পড়ন্ত দুপুরের সূর্যও আছড়ে পড়ছে। কিন্তু ফাহমানের এই সৌন্দর্যে ঝুমুরের ইস্পাতের মতো শক্ত কঠিন মন এবার আর গললো না। সে পুনরায় নিজের ফেরার পথে পা বাড়ালো।

ফাহমান শসা কেনার কাজে বেরিয়েছিল। আজ আবার তার অফ ডে বলা যায়। শসা কিনেই সে বাড়ি ফিরছিল কিন্তু ঝুমুরকে দোকানে দেখে থেমে গেলো। দ্রুত পা চালিয়ে দোকানের কাছে আসতেই সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝে ফেললো। কিন্তু তাকে দেখার পরও ঝুমুরের এরকম প্রত্যাখ্যান করে এড়িয়ে যাওয়ায় সে অবাক। নাফিসা বেগমকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে ম্যাংগো বার নিয়ে ঝুমুরের পিছু পিছু ছুটলো।

‘ আরে…আরে আমাকে ফেলে কোথায় যাও ?’

ফাহমান দ্রুত পা চালিয়ে ঝুমুরের দিকে এগিয়ে গেলো। ঝুমুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতেই লক্ষ্য করলো ঝুমুরের মুখের ভাব গম্ভীর। ঝুমুরের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ ধরতে অপারগ সে। তাও জিজ্ঞেস করলো ‘ কি ব্যাপার ? মহারানী কি রেগে নাকি ?’

ফাহমানের কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না ঝুমুর। সে নিরবে পথ চলতে ব্যস্ত। তার এই নিরবতা ফাহমানের মনে হয় মনে ধরলো না। সে হতাশা ভরা গলায় বলল ‘ তুমি কি রেগে অঙ্গণা ? রেগে থাকলে সরাসরি বল আমার অপরাধ কি ? তুমি তো জানো আমি তোমার রাগ করে থাকা সহ্য করতে পারিনা। আর যাই হোক তোমার নিরবতা আমায় বড্ড পোড়ায়। ‘

ফাহমানের কথায় মনে হয় ঝুমুরের লোহার ন্যায় শক্ত মনের বরফ একটু হলেও গললো। ঝুমুর অভিমানী গলায় বললো ‘ অপরাধ আপনার না আমার। এমন একজনকে পছন্দ করলাম যাকে যেই দেখে সেই প্রেমে পরে যায়। আমারই কপালের দোষ সব নাহলে আমার ছোটবেলার সখী যে মনে প্রাণে কোরিয়ান সে নাকি আমার বাঙালি প্রেমিককে দেখে প্রেমে পড়ে গেছে এটা সম্ভব ? ‘

ঝুমুরের কথা মন দিয়ে শুনলো ফাহমান। এবার সে ধরতে পারলো কেন ঝুমুর রেগে অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রেখেছিল। ও আলতো হেসে বললো ‘ কোরিয়ান, চাইনিজ, ইউরোপিয়ান কিংবা বাঙালি যেই প্রেমে পড়ুক না কেন দিনশেষে কিন্তু এই ডাক্তার সাহেব আপনারই প্রেমে মত্ত ডাক্তার সাহেবা। ‘
ঝুমুর যেন এবার আরও খানিকটা শান্ত হলো। তার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে আলতো হেসে মাথা নেড়ে বললো ‘ এমন হলে আমি চাই এই ডাক্তার সাহেব সবসময় তার ডাক্তার সাহেবার প্রেমেই মশগুল থাকুক। ‘

ফাহমানও ঝুমুরের কথার জবাবে হেসে দিল। ঝুমুরের দিকে ম্যাংগো বার এগিয়ে দিয়ে বললো ‘ এবার আমার থেকে এটা নিতে কোনো আপত্তি নেই তো ? ‘
ঝুমুর অবশ্য আর আপত্তি করলো না। সে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা নিলো। রাতের কামড়ে প্যাকেট খুলে তাতে কামড় বসালো। ঝুমুরের ছোট ছোট কামড়ে খাওয়া দেখে ফাহমান মনে মনে বললো ‘ অথচ আপনি যদি জানতেন এই ডাক্তার সাহেব সবসময় আপনাকেই ভালোবেসে এসেছে তাহলে আর এই কথা বলতেন না। ‘

—-

শর্ট নোটিসে ঝুমুর জানতে পেরেছে আজ তাদের উত্তরার সি শেলে যেতে হবে কারণ একটা ওয়েডিং ইনভাইটেশন আছে তাদের। বিয়েটা মনোয়ারা বেগমের জায়ের বোনের মেয়ের বিয়ে। পাত্রীর মা সপরিবারের ঝুমুরদের নিমন্ত্রণ করে গেছেন কয়েক দিন আগেই। কাজের চাপে এই দাওয়াতের কথা বলতে ভুল গিয়েছিলেন মনোয়ারা বেগম। অন্যদেরও কারোর মনে ছিল না তাই ঝুমুরের আর জানা হয়নি।

কথাটা শোনামাত্র ঝুমুর বিরক্ত হলেও তার বিরক্ত ঠেলে অপ্রকাশিত রেখে নিঃশব্দে পুরোটা মেনে নিলো। সপরিবারে যেহেতু যেতে বলেছে তাই শাওমিও যাবে ওদের সাথে। যদিও শাওমিকে দেখে ঝুমুরের সকালের কথাটা মনে পড়ে গেলো কিন্তু নিজের সখিকে কি আর এড়িয়ে যাওয়া যায় ? তাই সে এড়িয়ে না গিয়ে শাওমিকে সঙ্গে করে বিয়েতে পড়ে যাওয়ার জন্য শাড়ি বেছে নেওয়ার কাজে মন দিল।

হালকা পিয়াজি রংয়ের মধ্যে গাঢ় পিয়াজী রংয়ের পাড় দেওয়া সুতি শাড়ি পড়েছে ঝুমুর। হাতে সিলভার ব্রেসলেট এবং কানে ঝুমকা। লম্বা চুলগুলো পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া। ঠোঁটে হালকা নিউড লিপস্টিকও লাগিয়েছে সে। সবশেষে চোখের কোণে গাঢ় করে কাজল টেনে নিল ঝুমুর। এবার যেন সাজটা সম্পূর্ণ লাগছে। আলমারির নিচের ড্রয়ারটা খুলে লাইট পিংক ফ্ল্যাট হিলের জুতো নামিয়ে নিলো ঝুমুর।

ঝুমুর জুতো পড়তে পড়তেই লক্ষ্য করলো শাওমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। শাওমির পরনে হাঁটু অব্দি ফুল স্লিভ ব্ল্যাক টপস সঙ্গে ব্লু জিন্স। গলায় ছোট রেড স্টোনের লকেট আর হাতে গোল্ডেন ওয়াচ। শাওমির চুলগুলো স্ট্রেট করে ছেড়ে দেওয়া। শাওমি নিজেকে আয়নায় দেখে নিতে ব্যস্ত আর ঝুমুর জুতো পড়তে।

মনোয়ারা বেগম ফোন হাতে ঘরে ঢুকলেন। ঝুমুরের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ‘ তোর মামণি ফোন করেছে। তোর সঙ্গে কথা বলবে ? কথা শেষ হলে ফোন দিয়ে যাস। ‘

তানিয়া শাহজাহান ফোন করেছে শুনে ঝুমুর দ্রুত ফোনটা কানে ধরলো। ফোনের ওপার থেকে তানিয়া শাহজাহান বললেন ‘ আজ কোন শাড়িটা পড়েছিস রে বুড়ি ? তোর সাজটাও বল। দুজনে একই রকম সাজবো। দেখিস আজ কেউ আমাদের দেখে চিনতেই পারবে না। তোর আপিই তো টাস্কি খেয়ে যাবে। ‘

ঝুমুর হাসলো তানিয়া শাহজাহানের কথায়। বললো ‘ তুমি যে পিয়াজি রংয়ের সুতি শাড়ি দিয়েছিলে ওটা। চুলগুলো ছাড়া আর চোখের নিচে কাজল দিয়েছি। কানে ঝুমকা আর হাতে সিলভার ওয়াচ। এবার শান্তি ? এখন দেখি তুমি কত ভালো সাজতে পারো আমার মত। ‘

‘ বুড়ি একটা ছবি পাঠা তো। ‘

তানিয়া শাহজাহানের কথায় ফোন কেটে ঝুমুর ছবি তুললো তারপর ছবিটা তানিয়া শাহজাহানকে সেন্ড করে দিলো। সবশেষে আরেকবার আয়নায় নিজেদের দেখে দুই সখি বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

চলবে….
মিফতা তিমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here