মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড় #পর্ব_২৪

0
248

#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_২৪
Tahrim Muntahana

নতুন ভোরের আগমন! সূর্যটা একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে বিশাল আকাশের বুকে। আকাশের বুকে সূর্যের গাঢ়তা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে চারদিক তত সতেজ হয়ে উঠছে। পাতায় পাতায় বৃষ্টি কণা গুলো শুকিয়ে পাতাগুলোর নিস্তেজভাব টা কেটে যাচ্ছে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে আদর। রাতটুকু প্রায় না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। মাথায় এত এত চিন্তা ঘুরলে ঘুম আসে! ঘুম থেকে উঠেই চৌধুরী বাড়ির বাগানে উপস্থিত হয়েছে সে। কিছু ফুল গাছ এখনো সতেজ। সেগুলোয় ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হয় জবাফুল গাছটার নিচে। তখনি মনে পড়ে যায় কাল রাতের সেই অবয়বের কথা। চারপাশ টা ভালো করে দেখতে লাগলো। কিছু টা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো মালির ঘর। দৃষ্টি আপনাআপনিই তীক্ষ্ম হয়ে গেলো আদরের। সে যেটা ভাবছে সেটা যদি সত‍্যি হয় তাহলে কিছু জট খুব তাড়াতাড়িই খুলে যাবে। সরাসরি মালির ঘরে ঢুকে পড়লো আদর। সকালে কাজ সেরে হালকা বিশ্রাম নিচ্ছিলো মালি। নিজের ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেতেই ধপ করে উঠে বসে। বয়স ৫৫-৫৮ এর মধ‍্যে হবে। আদর মুখটা হাসি হাসি করে সামনে রাখা টুল টাতে বসে পড়ে। মালির মুখে কিঞ্চিত ভয় দেখতে পাচ্ছে আদর। সন্দেহ টা আরো গাঢ় হলো। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

কালকে ফলো করছিলেন আমাকে?

মালির ভয়টা দ্বিগুন হয়ে গেলো। হালকা কাঁপতে লাগলো সে। আদর এবার নিজের মধ‍্যেই কিছু ছক কষলো। মালির ভয় ই বলে দিচ্ছে সে ভুল পথে যাচ্ছে না। ঠিক পথেই এগোচ্ছে। হঠাৎ করেই মালি কেঁদে দিলো। আদর চমকে উঠলো। সে কাঁদার মতো কি বলেছে? দোষী না হলে ভয় পাবে কেন? হঠাৎ করেই মালি বলে উঠলো,

আমি তোমাদের সবাইকেই ফলো করছিলাম আসার পর থেকেই। শুধু তোমাদের না এই বাড়িতে যারা নতুন আসে তাদের কেই গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করি। ইটস মাই ডিউটি!

মালির মুখে এত ভালো ইংরেজি শুনে আদরের অবাকতা দ্বিগুন হারে বেড়ে। গেলো। মালি মনে হয় আদরের মনোভাব বুঝলো। বলে উঠলো,

আমার পেশা এটা নয়; আমি সিআইডি সিক্রেট এজেন্ট মতিউর উল্লাহ! নাবিল চৌধুরীর ছেলে হৃদান চৌধুরী তাইতো? আমি সব খবরই রাখি। আর তুমি জার্নালিস্ট রাতাফ আহমেদের মেয়ে। রিয়া চৌধুরী হলো আহনাফ চৌধুরী মেয়ে।‍ তোমরা এখানে রহস‍্য উদঘাটন করতে এসেছো। ভাবছো এতসব জানি কেমন করে? যখন তোমাকে আহনাফের মেয়ে হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলো তখন থেকেই তোমাদের সবার উপর নজর রাখছে আমার টিম। আমাকে আহনাফ ই রেখেছিলো নাসির চৌধুরীকে প্রটেক্ট করার জন‍্য। হঠাৎ ই আহনাফের নিখোঁজ। এরপর থেকে মালির কাজ করেই নাসির চৌধুরীকে প্রটেক্ট করছি আর আসল কালপ্রিট কে খুঁজছি। আমি অনেক সূত্রও জোগাড় করেছি কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারছি না।

আদরের দৃষ্টি শান্ত! তার কাছে এখন সবটা ক্লিয়ার। নাসির চৌধুরী কে দোষী বানানো হচ্ছে তাদের চোখে। লোকটি নিজের আইডি কার্ড বের করে দেখালো। আদর এবার বলে উঠলো,

আপনি কি কি তথ‍্য জোগাড় করেছেন আমাকে হ‍্যান্ড ওভার করুন। বাকিটা আমার দায়িত্ব। নিরাশ করবো না আপনাকে। জার্নালিজম নিয়ে পড়ছি। স্বপ্ন তো বাবার মতোই জার্নালিস্ট হওয়া।

লোকটি নিজের ব‍্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে আদরের হাতে দিলো। আদর নিজের উড়নার নিচে ফাইলটা লুকিয়ে বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। খুব একটা সকাল হয়নি তাই তেমন ভাবে কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। নিজের ঘরে না গিয়ে হৃদানের ঘরে নক করলো আদর। নক করার সাথে সাথেই দরজা খুলে গেলো।

ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হতে যাচ্ছিলো আতইয়াব। বোন আর বউ য়ের একটু খুঁজ নেওয়া যাক। তার আগেই আদর কে দেখে হালকা বিচলিত হলো সে। সমস‍্যা হয়নি তো! আদর তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে ফাইল টা বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেললো। আতইয়াবকে পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করতে বলে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। হৃদান ওয়াশরুমে ছিলো বলে কিছুই জানতে পারলো না।

পাঁচ মিনিট পরেই আদর এসে উপস্থিত হলো। সাথে রিয়া-হিমেল, সুবাহ-ফালাহ, রোহানি-পান্চু। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এত মানুষ দেখে অবাক হলো হৃদান। কিছু বলার সুযোগ দিলো না আদর। হৃদানের ফোন টা নিয়ে পিয়াসের নম্বরে ডায়াল করলো। ফোনে লক দেওয়া নেই! আরামের ঘুম হারাম করে পিয়াস এদিকওদিক ঘুরছিলো। তথ‍্য খুঁজার চেষ্টায় আছে। এত সকালে হৃদানের ফোন পেয়ে ভয় হলো তার। সে তো তার বন্ধুর রাগ সম্পর্কে জানে। ঝটপট ফোন রিসিব করে কানে ধরতেই আদর বলে উঠলো,

ভাইয়ু আমি আদর। নাবিল আংকেল মারা যাওয়ার পর কোনো কেইস ফাইল হয়েছে কিনা চেইক করো। সব থানাতেই খুঁজ নিবা। আজ সন্ধ‍্যায় রেজাল্ট চাই।

খট করে কল কেটে দিলো। পিয়াস এবার ফোন করতে লাগলো তার লোকদের। একা একা সম্ভব না। সবাই প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে। হৃদান বলে উঠলো,

কেইস হবে কি করে? কেউ কেইস করার ছিলো না আদর। খুঁজ নিতে বললে কেন?

আদর মুচকি হাসলো। সব কথা শোনার পর হৃদান কি করবে তাই ভাবছে! খুশি হবে কি? কিছু বললো না আগেই; ফাইলটা দেখতে লাগলো। ফাইলে নতুন কিছু নেই। তারা যা জানে তার অর্ধেক এখানে। তাই হয়তো এতদিনেও একটা কেইস সলভ করতে পারেনি। আদর রিয়ার কাছে গিয়ে বলল,

পেনড্রাইফ তিনটা দাও! আবার দেখতে হবে। তারু নাহারের ল‍্যাপটপ আছে যা নিয়ে আয়। ফাস্ট!

রিয়া নিজের জন‍্য বরাদ্দকৃত ঘরে চলে গেলো। কিছুঙ্গণ পর আবার ব‍্যাক করলো। হাতে তিনটা পেনড্রাইভ। তারিম নিজেও ল‍্যাপটপ নিয়ে হাজির। প্রথমে দেখলো নাবিল চৌধুরীর খুনের ভিডিও। নাহ সেখানে নাসির চৌধুরীর কোনো অস্তিত্ব নেই। তৃতীয়টা ওপেন করলো আদর। আহনাফ চৌধুরী নাসির চৌধুরীকে নিয়ে তথ‍্য দিয়েছে। হঠাৎ করেই চমকে উঠলো আদর! আগের ভিডিওয়ের সাথে এই ভিডিওয়ের মিল নেই। চেহারায় হালকা অমিল। আবার দেখলো ভিডিও। আদরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। পেনড‍্রাইভ তিনটাও ভালো করে দেখলো। এবার আদরের মুখের হাসি চওড়া হলো। ল‍্যাপটপ টা পাশে রেখে পায়চারি করতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ ভেবেই সবাই কে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠলো,

আমরা ভুল পথে এসে সঠিক পথ পেয়েছি। কালকে রাতে আমি আর আধা টাকু পান্চু কাকু নিচতলার শেষ করিডরের ঘরগুলোর দিকে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই অনেক তথ‍্য পাই।

কথা গুলো বলেই ফোনের রেকর্ড শুনালো। রেকর্ড শুনেই সবাই এবার বুঝতে পারলো কেইসের রেকর্ড কেন বের করতে চায়ছে আদর। হৃদান ততক্ষণে ধপ করে বসে পড়েছ। আদর কালকের এবং সকালের মালির সব কথা খুলে বলল। সবাই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। আদর আবার বলে উঠলো,

পেনড্রাইভ একটু পুরোনো আর দুটো একদম নতুন। এই দেখো ছোট কাগজ টা এখনো উঠানো হয়নি। আর দুই ভিডিও এর মধ‍্যে আহনাফ আংকেল আলাদা ছিলো। খেয়াল করলে দেখতে পারবা এক ভিডিও তে ইয়াং লাগছিলো আরেক ভিডিও তে দেখো। উপরের চুল গুলো আগের মতো করতে পারলেও কানের পাশের চুলগুলো সাদা। মানে কেউ বুদ্ধি করে আমাদের সকল প্ল‍্যান জেনে নতুন করে পরের ভিডিও টা করিয়েছে আংকেল কে দিয়ে। যাতে আমরা নাসির আংকেল কে দোষী ভেবে শাস্তি দিই। তার কথা বেমালুম ভুলে যাই। কিন্তু একটা কথা হচ্ছে রিয়া আপুই একমাত্র জানতো সিক্রেট ঘরের কথা। তারপর আমরা। শত্রু পক্ষ কিভাবে জানলো? আর পেনড্রাইভ রাখলই বা কি করে! আর রাখবে ঠিকাছে কিন্তু নাবিল আংকেল কে মারা পেনড্রাইভ টা কেন সরালো না। আমি নিশ্চিত যে এই কাজ টা করেছে সে চায়ছে হিয়ান খান শাস্তি পাক, সাথে নাসির চৌধুরী। আর এই দুইজন কে শাস্তি দিতে পারলেই আমরা ভাববো সব দোষী ধরা পড়েছে। আর কিছু খুঁজে বের করবো না! আরেকটা কিন্তু থেকে যায়। লোকটি কি জানতো না আমরা জানি আহনাফ আংকেল বেঁচে আছে আর তাকে আমরা খুঁজছি। যখন দুজনের মধ‍্যে কেউ ই বলতে পারবে না আহনাফ আংকেল কোথায় তখন আপনাআপনিই সন্দেহের তীর অন‍্য দিকে ঘুরবে? লোকটা টি জেনে শুনেই আমাদের বোকা বানাচ্ছে!

আদরের কথা শুনে সবার সবটা ক্লিয়ার হলো। হৃদান আতইয়াব তো আদরের বুদ্ধি দেখে হতবাক। কতটা ভেবেছে আদর! সবটাই প্রায় জেনে গেলো ওরা। ওদের চাহনী দেখে আদর একটু ভাব নিয়ে বলে উঠলো,

জার্নালিস্ট রাতাফ আহমেদের মেয়ে আমি; এরকম বুদ্ধি তো আমার রক্তে মিশে আছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আদরের কথায় মুচকি হাসলো সবাই। হৃদান এগিয়ে গেলো হিমেলের দিকে। তার সন্দেহ হিমেলের দিকেই যাচ্ছে। চিন্তিত মুখে বসে ছিলো হিমেল। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না! হৃদান কে হঠাৎ তার সামনে দেখে ভড়কালো। হৃদান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

তুমি ছলনা করছো না তো আমাদের সাথে? পরিণতি কিন্তু খুব খারাপ হবে!

চমকালো হিমেলে। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাবার কর্মের জন‍্য তাকে কেন সবসময় সাফার করতে হয়।রিয়ার দিকে করুণ চোখে তাকালো। রিয়া এগিয়ে এসে বলল,

ভাইয়া হিমেল কে অযথা ব্লেইম করছো! হিমেল তার বাবার সাথে নেই!

হৃদান সরে আসলো। সবকিছু আবার জট পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে তারিম বলে উঠলো,

আচ্ছা আমরা তো সব আলোচনা ড্রয়িং রুমে করেছিলাম। আমার মনে হয় ড্রয়িং রুমের প্রত‍্যেকটা কোণা খুঁজে দেখা উচিত। একবার যেহেতু আমাদের সিকিউরিটি ভেঙ্গে শত্রুপক্ষের চ‍্যালারা বাড়ির ভেতর আসতে পেরেছিলো, ড্রয়িং রুমে চিপ রাখা ব‍্যাপার না!

সবার টনক নড়লো। পান্চু গার্ডদের ফোন দিয়ে খুঁজতে বলল। তারিমের কথায় আতইয়াব ইমপ্রেস। বউয়ের বুদ্ধিও তো বিশাল। হৃদান একপলক বোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারিম ও আদরের মতো ভাব নিয়ে বলে উঠলো,

হৃদান চৌধুরীর বোন আমি! তার উপর জার্নালিজম নিয়ে পড়ছি। এমন বুদ্ধি ব‍্যাপার না!

চিন্তা বাদ দিয়ে হাসলো সবাই। সবসময় এত এত চিন্তা নিয়ে ঘুরলে জীবন চলে নাকি। হাসতে হয়। বাঁচতে হলে হাঁসতে হয়! আদর এবার হৃদান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

হৃদ রেজাল্ট দেওয়ার পর যদি আপনার চাচা নির্দোষ হয় তার সাথে কথা বলবেন। সে গুমরে গুমরে মৃত‍্যর দিকে যাচ্ছে।

হৃদান মাথা নাড়ালো। তার ও তো খুব ইচ্ছে করে আপনজনদের সাথে থাকতে। বাবার মতো চাচা আছে জেনে তার ছায়াতলে থাকার স্বাদ কি তার হয় না! সবকিছু তো সবার ভাগ‍্যে থাকে না। রোহানি বলে উঠলো,

এবার নিচে চলো তো। ভালো লাগছে না আর। খিদে পেয়ে গেছে আমার।

আদর হাসলো। তার বোনটা যে পেটুক সে জানে। সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। কিন্তু আদর পারলো না। হৃদান তার গ্রাউনের নিচের অংশ পা দিয়ে ধরে আছে। আতইয়াব দরজা পযর্ন্ত গিয়ে পেছনে ফিরলো। দুইজন কে একসাথে দেখে বাঁকা হাসলো সে। এহহ এখন প্রেম করবে? আর আমাকে বউ ছাড়া থাকতে হলো। দাড়া বড়শালা তোর প্রেম ছুটাচ্ছি। হৃদানের দিকে তাকিয়ে ডেবিল হাসি দিলো আতইয়াব। হৃদান কটমট চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই জ্বালিয়ে দিবে। আতইয়াব আদর কে ডেকে উঠলো,

এখানে আসো আদর। দরকার ছিলো তোমার সাথে।

আদর ভাইয়ের কথায় করুণ চোখে হৃদানের দিকে তাকালো। পা সরিয়ে নিলো সে। আদর ছুটে আসলো ভাইয়ের কাছে। আতইয়াব হৃদানের দিকে তাকিয় গা জ্বালানো হাসি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আহ শান্তি লাগছে! এবার দেখ কেমন লাগে? হৃদান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দরজার দিকে তাকালো। এর শোধ তো সে নিবে! কড়ায় কড়ায় শোধ নিবে। বোনকে একবারের জন‍্যও কাছ ছাড়া করবে না! ভেবেই একপ্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। তার অনুপস্থিতিতে না জানি আবার চিপকে থাকে তার বোনের সাথে!

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here