#প্রেমমানিশা-২০,২১
(২০)
‘ আপনি আগে কখনও সিলেট আসেননি তাইনা ? ‘ গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখেই কথাটা বললো ফারহান।
তারা এখন বর্তমানে ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছে। ধরণীতে আঁধার নেমে এসেছে অনেক আগেই। আজ পুরোটা সময়ই কাটিয়েছে সিলেটের বিভিন্ন দর্শনার্থী স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে। কথা ছিলো শুধু মাধবপুর লেকে আর নীলকন্ঠ টি কেবিনে যাবে। কিন্তু সেই কথা ভেঙে তারা সিলেট টি স্টেট এও গিয়েছিল। আজ এই প্রথম দুজনে অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই তারা শুধু রাতের আঁধারেই একে ওপরের কাছে কথাবার্তা আদান প্রদান করেছে। তবে আজ তারা দিনের আলোতেও একে অপরের সান্নিধ্য পেয়েছে।
‘ উহু, সিলেট আগেও অনেকবার এসেছি। ‘ সানাহ্ ফোনে সোসিয়াল মিডিয়া স্ক্রল করতে করতে বলল ।
‘ তাহলে মাধবপুর লেক, নীলকন্ঠ টি কেবিন, সিলেট টি স্টেট, রাতারগুল, বিছানাকান্দি একটাও চিনেন না কেন ? ‘ ফারহান ড্রাইভিং করতে করতেই অবাক হয়ে বললো।
‘ এখানে আগে মামনি আর বাবাইয়ের সঙ্গে আসতাম। তারা মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েকবার মা আর বাবার সঙ্গেও এসেছি। এখানে আমার বড় ফুপির বাড়ি। একটা সময় তার বাড়িতে বছরে তিন চারবার আসতাম যেখানে আমি ঘর ছেড়ে বেরই হই না। ‘ সানাহ্ এবার ফোন রেখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে উৎসুক চোখে বললো।
‘ ওহ আই সি,তারমানে আপনার ফুপিই আপনাকে হেল্প করেছে সিলেটে বসতি গড়তে ? আপনার একার পক্ষে তো কখনোই সম্ভব না একলা একা এই শহরে এতকিছু অ্যারেঞ্জ করা। তারমানে উনিই সাহায্য করছিলেন। ভদ্র মহিলা দেখি আমার নয়া সংসার হওয়ার আগেই ভেঙে দিচ্ছিলেন। ‘ ফারহান সরু চোখে সানার দিকে তাকিয়ে বললো ।
‘ এভাবে বলছেন কেন ? বড় ফুপি কিছু করেনি, আমি জাপান ভাইয়ের থেকে হেল্প নিয়েছিলাম ‘ সানাহ্ ভ্রু কুচকে বললো।
‘ এখন এই জাপান ভাই কে ? নাম এত অদ্ভুত কেন ? এই নাম কে রেখেছে ? ‘ ফারহান বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে বললো। সানার মুখে অন্য কোনো ছেলের নাম তার শুনতে একদমই ভালো লাগছেনা। কে এই জাপান ভাই যার কাছ থেকে প্রখর আত্মসম্মান সম্পন্ন সানাহ্ও হেল্প নিলো ?
‘ জাপান ভাই আমার বড় ফুপির ছোটো ছেলে। তারা দুই ভাই। বড় ভাইয়া হলো আরাব ভাই আর জাপান ভাই হলো ছোটো। জাপান ভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ মিল কিন্তু আরাব ভাই আমার সঙ্গে দেখা হলেই ঝগড়া করেন তাও ইচ্ছা করে। অবশ্য এসব এখন কমেছে কারণ এক তো তার বিয়ে হয়ে গেছে আর দ্বিতীয়ত আমি আর ফুপির বাড়ি যাই না। প্রথম প্রথম বিয়ের পরেও ঝগড়া করতো কিন্তু এখন আর করে না। ‘ সানাহ্ বেশ উৎসুক হয়ে বললো। ফারহানকে তার পরিবারের ব্যাপারে বলতে তার বেশ ভালই লাগছে। সানাহ্ কখনোই আত্মীয় স্বজন নিয়ে এতটা সিরিয়াস ছিলনা কিন্তু ফারহানের সঙ্গে কথা বলতে হলেও তো তার একটা যুতসই বিষয় দরকার।
সানাহ্ কথাগুলা যত উৎসাহ নিয়ে বললো ফারহান তার অর্ধেক উৎসাহ নিয়েও কিছু বললো না। শুধু মলিন গলায় ‘ ওহ্ ভালো ‘ বলে কথা কাটিয়ে গেলো। বস্তুত সানার কাছ থেকে তার চিন জাপান ভাইয়ের কথা শুনতে একদমই ইচ্ছা করছে না। ভেবেছিল দুজনে সারাদিন একসঙ্গে সময় কাটাবে,নিজেদের ফিউচার প্ল্যানিং করবে কিন্তু বালাইশাট। সানার তো সেই দিকে নজরই নেই। সানাহ্ ব্যস্ত তার চিন জাপান ভাইয়ের গুণগান গাইতে।
সানাহ্ যেরকম গম্ভীর আর আনসোসিয়াল টাইপের মেয়ে তাতে তার বন্ধু হওয়া তো দূরে থাক কেউ তার সঙ্গে কথাই বলে না। সেখানে তার সাথে তার জাপান ভাইয়ের রীতিমত বন্ধুত্ত্ব ফারহানের ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে ওই চিন জাপান সানাহ্কে নিজের দিকে টানতে চাইছে। কী আছে কি ওই চিন জাপানের মধ্যে ?
ফারহানের কাছ থেকে কোনো যুতসই উত্তর না পেরে সানাহ্ আর কথা বাড়ালো না। বুঝলো ফারহান কোনোকিছু নিয়ে চিন্তায় আছে বলেই তার কথার উত্তর দিচ্ছে না ঠিক মত। এই সময় ফারহানকে আর কিছু বলে লাভ নেই। সে হয়তো কানেই তুলবে না। এসব ভেবে সানাহ্ চুপ করে গেলেও ফারহান নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করলো। সবকিছুই তার জাপান ভাইকে নিয়ে আর সানাহ্ও খুশি মনে উত্তর দিল। তার আর জানা হলো না ফারহান কেন জাপানকে নিয়ে এত প্রশ্ন করছে আর ফারহানেরও জানা হলো না জাপান অলরেডি এনগেজড।
বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো। বাড়ি ফিরতে সময় ফারহানের সঙ্গে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছিল বলে বাড়ি ফিরে আর খাওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না সানাহ্। বাড়ি ফিরে এতটাই ক্লান্ত ছিল যে ফারহানকে ঠিক মত বিদায়ও জানালো না। উল্টো কোনমতে ঢুলতে ঢুলতে ঘরে গিয়ে ঢুকলো। অবশ্য মিসেস কায়নাত মেয়ের এহেন ব্যবহারে লজ্জিত। মেয়েটা জামাইকে একটু বিদায়ও জানালো না।
ফারহান কাল রাতেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা আজ ফিরে আসছে। ফারহানের কথা শোনামাত্রই সকলেই সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলেন যার কারণে দুপুর হতেই তারা বাড়ি পৌঁছে গেলেন। মিসেস কায়নাত ভেবেছিলেন মেয়ে ফিরে এলে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে খাবেন তাই বান্ধবী কাম হবু বেয়াইনকে আজ রাতটা থেকে যেতে বলেছিলেন। বান্ধবীর অনুরোধ ফেলতে না পেরে আর অনেকদিন পর সানার সঙ্গে দেখা হবে এই ভেবে মিসেস আশাও রাজি হয়ে গেছিলেন। কিন্তু কেউ ভাবেনি সানাহ্ বাড়ি ফিরে কারোর চেহারা না দেখে সোজা নিজের ঘরেই ঢুকবে। এমন কি একবারের জন্য ফারহানের দিকে পর্যন্ত তাকায়নি।
সানাহ্ রুমে ঢুকে ঘুম ঢুলতে ঢুলতে কোনমতে হট শাওয়ার নিলো। শীতকাল হওয়ায় হট শাওয়ার নেওয়ায় আরাম লাগছে। গোসল সেরে জামা কাপড় বদলে কোনমতে চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়েই গা এলিয়ে দিল বিছানায়। বেড সাইড ল্যাম্প অফ করে গায়ে নরম কম্বল টেনে দিল। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। সিলেট থাকাকালীন এতদিন এরকম আরামে থাকেনি। বিছানায় শুয়েছে ঠিকই কিন্তু নিজের বিছানার মত আরাম পায়নি। উল্টো ওখানে শীত বেশি হওয়ায় শীতে কেপেছে।
মেয়েকে এভাবে উপরে চলে যেতে দেখে লজ্জিত মিসেস কায়নাত নতমুখে বললেন ‘ তুমি কিছু মনে করোনা বাবা। আমি বুঝতে পারিনি ও বাড়ি ফিরেই কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে যাবে। জানলে ওকে আটকে দিতাম। মেয়েটা যে কিভাবে আনসোস্যাল হলো গড নোজ। আশা তুই কিছু মনে করিস না বোন। ‘
‘ আমি কিছু মনে করিনি আন্টি। সানাহ্ আসলে আনসোস্যাল নয়। সে বড্ড মিশুকে কিন্তু মানুষ বুঝে সঙ্গ দেয়। এতদিন সেরকম কাউকে পায়নি তাই মিশতে পারেনি। তবে ওর এরকম ব্যবহারের পিছনে আমি দায়ী। আজ সারাদিনে ওকে অনেক খাইয়েছি। আসার সময়ও ডিনার করে এসেছি দুজনে। আজ সানাহ্ তার ডায়েট চার্ট আর হেলদি লাইফ স্টাইল ভুলে অনেক কিছু খেয়েছে যার ইফেক্ট পড়ছে এখন। ডিনার করে যখন আমরা ফিরছিলাম তখনই ঘুমে ঢুলছিল। আসলে সারাদিন জার্নি করলো তার উপর অভ্যাসের বাইরে খাওয়া দাওয়া তো তাই। ‘ ফারহান তার মা আর মিসেস কায়নাতের উদ্দেশ্যে বললো।
‘ এসব তুই কি বলছিস কায়নাত ? তোর আমাকে সেরকম মানুষ মনে হয় ? মনে রাখিস আমি সানাহ্কে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাকে আমার মেয়ে হিসেবে আমার বাড়িতে তুলবো, ছেলের বউ হিসেবে নয়। আমার দুটো ছেলে। একটাও মেয়ে নেই। ফারহানের বাবা আর আমার অনেক ইচ্ছা ছিল একটা মেয়ে হবে। কিন্তু সেটা তো পুরন হয়নি। কিন্তু সানার মাধ্যমে আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হবে। আপসোস এটাই যে ফারহানের বাবা মেয়েকে দেখে যেতে পারলেন না। ‘ মলিন গলায় বললেন মিসেস আশা।
মায়ের কথার ধরণে ফারহানের বুঝতে দেরি হলো না যে ওর মা ওর বাবার কথা মনে করে মন খারাপ করছে। বস্তুত ফারহান তার মায়ের মন খারাপ মোটেই দেখতে পারেনা। মাকে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখলেই তার বুক চিড়ে ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু এখন মায়ের মন খারাপ ভাব সরাতে হলে তার মাইন্ড ডাইভার্ট করতে হবে। ফারহান মিসেস আশার মাইন্ড ডাইভার্ট করতে বললো ‘ তাহলে আন্টি এবার উঠি..… বাড়িতে কিছু কাজ আছে। সেগুলো করা দরকার। তাছাড়া কাল সকালে বেরোতে হবে। অনেকদিন তো ভার্সিটি যাইনা। ‘
‘ সেকি তুমি চলে গেলে কি করে হবে ? আমি যে ভাবলাম কাল সকালে সবাইকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো। ‘ মিসেস কায়নাত বললেন।
‘ সরি আন্টি আপনার কথা রাখতে পারলাম না। আরেকদিন সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া হবে। আজ থাক। অনেকদিন ভার্সিটি যাইনি তাই কাল থেকে রেগুলার হতে হবে। এত মিস দিলে বিয়ের সময় ছুটি নিয়ে প্রবলেম হবে। ‘ ফারহান একান্তই মিসেস কায়নাতের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল কারণ এমনিতেই অনেকদিন ছুটি কাটিয়ে এসেছে। এখন আর ছুটি কাটানো যাবে না ।
ফারহানের কথা শুনে হতাশ হলেন মিসেস কায়নাত। অসহায় গলায় বললেন ‘ এত করে যখন বলছো তখন আর কি করবো। তুমি নাহয় চলে যেও কিন্তু আশাকে রেখে যাও। ও বেচারি সানার সঙ্গে এখনও কথাই বলেনি। ‘
‘ আচ্ছা ঠিকাছে কিন্তু আন্টি কাল সকালে সানাহ্ যখন ঘুম থেকে উঠবে তখন বলবেন পরীক্ষার আগে যতদিন আছে ততদিন যেন ক্লাসটা রেগুলার করে। এমনিতেই অনেক দিন গ্যাপ গিয়েছে। এখন বেশি গ্যাপ দিলে সমস্যা হবে। আর দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না ও এতদিন কোথায় ছিল, কি করেছে আর বাড়ি ছেড়েই বা কেন গেছে। আমি চাইনা আপনি এসব জিজ্ঞেস করুন। ব্যাপারটা একেবারেই আমাদের ব্যক্তিগত। ‘
ফারহানের বিনীত গলায় করা অনুরোধ মিসেস কায়নাতের মন ছুঁয়ে দিলো। উনি সাত পাঁচ না ভেবেই বললেন ‘ আচ্ছা ঠিকাছে তুমি যেটা বলেছ সেটাই হবে। আমরা কেউ ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবো না। তুমি নিশ্চিন্তে যাও। তোমার হবু বউয়ের সর্বোচ্চ যত্নআত্তি করবো আমরা । ‘
ফারহান যেন মিসেস কায়নাতের কথায় সস্তির নিশ্বাস ফেলল। মুচকি হেসে বলল ‘ ধন্যবাদ আমার কথার মান রাখার জন্য। আমি তাহলে আসি আন্টি। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। মা ভাল থেকো। আমি আসছি তাহলে। আল্লাহ্ হাফেজ…. ‘
—-
সকাল হতেই সানাহ্ তার বই খাতা গোছানো শুরু করে দিলো। দুই একদিন কি ছিলনা এর মধ্যেই পুরো ঘর ময়লা হতে বসেছে। আজ সময় নেই বিধায় আর সেসব নজর দিলো না। কোনোমতে ব্যাগ গুছিয়ে, নিজে রেডি হয়ে ব্যাগ কাধে সিড়ি দিয়ে নেমে এলো।
মিসেস কায়নাত খাবার ঘরেই ছিলেন। বান্ধবী আশার সঙ্গে মিলে সকালের নাস্তার বন্দোবস্ত করছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে সানাহ্কে ধুপধাপ নামতে দেখে বললেন ‘ তুই এসে গেছিস ? আয় চেয়ারে বসে খেয়ে যা। তোর আশা আন্টি তোর সঙ্গে কথা বলবে। ‘
মিসেস কায়নাতের কথায় দ্বিরুক্তি করলো না সানাহ্। সে তার কাধের ব্যাগটা সোফায় রেখে খাবার টেবিলে এসে বসলো। মিসেস কায়নাত সানাহ্কে জিজ্ঞেস করলেন ‘ এখন এত সকালে কি খাবি ? ‘
‘ দুধ দিয়ে ওটস দাও…. আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছো তুমি ? ‘
‘ আমি ভালো আছি। তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে ? ইজ এভরিথিং ফাইন ? ‘
‘ অল ইজ ওয়েল অ্যান্ড ফাইন। তুমি খাবে না ? ফারহান কি কাল রাতেই চলে গেছেন ? আসলে কাল আমি এত টায়ার্ড ছিলাম যে চোখই খুলে রাখতে পারিনি। হুট করে আজ মনে পড়লো ফারহানকে কাল বিদায়ও জানাইনি। ‘
‘ হুম চলে গেছে আর যেতে যেতে তোমাকে বলে গেছে যেন এখন থেকে ভার্সিটির ক্লাসটা তুমি রেগুলার করো। অনেকদিন তো গ্যাপ গেলো..… এখন নাহয় মন দিয়ে পড়। তোমাদের বিয়ের পরপরই তো তোমার পরীক্ষা। এটা তো ফাইনাল তাই না ? ‘
‘ হ্যাঁ এটা ফাইনাল ‘
‘ তারমানে এরপর তুমি অনার্স পাস করে যাবে। তাহলে তো আরও মন দিয়ে পড়তে হয়। আমি চাই সবাই বলুক আমি উমুকের শাশুড়ী। তোমার ইচ্ছা থাকলে তুমি বিয়ের পর চাকরিও করবে। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। করবে চাকরি ? ‘
আশার কথায় চওড়া হাসি দিল সানাহ্। তার এই বিস্তৃত হাসি তার গালে টোল ফেলল। সানাহ্ মৃদু গলায় বললো ‘ এখনই বলতে পারছি না আন্টি। দেখা যাক কি করি..… সেটা বিয়ের পর ভাবা যাবে। ‘
‘ কী হলো কি ? শাশুড়ী বউয়েতে কি কথা হচ্ছে ? আমার বদনাম করা হচ্ছে ? ‘ মিসেস কায়নাত এতক্ষণ রান্নাঘরে রুটি সেকছিলেন। রুটি সেকা শেষে রুটিগুলো নিয়ে খাবার ঘরে এসে ঢুকতে ঢুকতে বললেন।
‘ তোমার কেন মনে হয় আমরা সবসময় তোমাকে নিয়েই ডিসকাস করি মা ? আমাদের কি আর কাজ নেই যে তোমাকে নিয়ে ডিসকাস করবো। তুমি কখনোই আমাদের ডিসকাশনের টপিক ছিলে না। ইউ ওয়ের অলওয়েজ এপার্ট ফ্রম মি ‘ গম্ভীর গলায় বললো সানাহ্।
‘ আঃ এসব কি বলছো সানাহ্ ? কায়নাত তোমার মা..… ‘ মিসেস আশা অবাক হয়ে বললেন। আশা কখনও সানাহ্কে এভাবে কথা বলতে দেখেননি। সানাহ্ বরাবরই তার মাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে এটাই তার জানা। তাই চিরচেনা সানার অন্য রূপ দেখে কিছুটা রুঢ় হলেন। মায়ের সঙ্গে সানার এরকম ব্যবহার উনার ভালো লাগেনি।
‘ শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না আন্টি। আত্মার সম্পর্ক থাকা লাগে। আই থিঙ্ক সেই সম্পর্ক একমাত্র মামণির সঙ্গেই ছিল আমার। আসলে কথায় আছে মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি। মায়ের এই এক্সট্রা ইন্সিকিউরিটি আর তার আমাকে নিয়ে সবসময় টেনশন করা আমাকে সিক বানাচ্ছে। এসবের জন্যই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফারহান আমাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলেন বলে উনাকে ফিরিয়ে দেইনি। তার সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক হতে যাচ্ছে…… তাকে ফিরিয়ে দেওয়া মানে নিজেকে অপমান করা। ‘
কথাগুলো এক নিশ্বাস বলে ধুপধাপ পা ফেলে আর কোনদিকে চোখ না দিয়ে কাধে ব্যাগ তুলে বেরিয়ে গেলো সানাহ্। তার এখন এই পরিস্থিতিতে মোটেই খাওয়ার ইচ্ছা নেই। সকাল সকাল মুডটাই খারাপ করে দিয়েছে।
মিসেস কায়নাত বিমূর্ষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন সানার যাওয়ার দিকে। এমনটা অস্বাভাবিক নয়। এরকম প্রায়ই ঘটে থাকে যখন সানাহ্ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় আর তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। সবার উপর তৈরি হওয়া ফ্রাস্ট্রেশন সানাহ্ তার উপর ফেলে।
তবে আজ মিসেস কায়নাত এটাও জেনে গেলেন সানার জীবনে সে আজও মায়ের জায়গা তৈরি করতে পারেনি যেটা তার ব্যর্থতা। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ‘ আশা তুই কিছু মনে করিস না। আসলে এখন সবকিছুর চাপ সবদিক দিয়ে আসছে তাই হুট করেই সানার মাথা গরম হয়ে গেছে। এমনিতে ও খুব ঠান্ডা মেয়ে। দেখিস না তোর সঙ্গে কি সুন্দর করে কথা বলে ? ‘
মিসেস কায়নাতের কথা শুনে মিসেস আশা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মৃদু গলায় বললেন ‘ হুম ‘
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্……
#প্রেমমানিশা(২১)
সবেমাত্র সানার ক্লাস শেষ হয়েছে। অনেকদিন পর আবার ক্লাস করতে পেরে আনন্দিত সানাহ্। পড়াশুনায় সে বরাবরই ভালো। স্কুল জীবনে ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিল। তবে এখন সময়ের প্রভাবে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার তীব্র চাপে টপ করাটা আর হয় না। ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া তো কম কঠিন নয়। পড়তে পড়তে আর মুখস্ত করতে করতেই দিন পেরিয়ে যায়। ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া আর আর্টসের ইতিহাস বিষয়ের সাল মুখস্ত করার মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পায় না সানাহ্।
যদিও অনার্স লেভেলে পড়া খানিকটা কঠিন হয়ে উঠে তবে সানাহ্ এখনও তার বুদ্ধিবলে সেরা স্টুডেন্ট। টপ করতে না পারুক, তার নাম সবসময় টপ থ্রিয়ের মধ্যে থাকবেই। এটা তার চিরাচরিত গন্তব্য। অবশ্য এর জন্য ভার্সিটি মহলে সে বেশ ঈর্ষণীয় বটে।
সানার অতি মাত্রায় সুন্দর রুপ আর তার ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের জন্য কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে ভার্সিটি লাইফের সফর অব্দি তার পাওয়া প্রপোজালের শেষ নেই। প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে প্রপোজাল আসে কিন্তু ভার্সিটি মহলে সকলেই তার ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তার নির্লিপ্ত গলায় রসকষহীন ভাবে ‘ সরি, আই ক্যান্ট একসেপ্ট ইট ‘ বলার জন্য সকলেই তাকে আড়ালে এক অন্য রকমের উপাধি দিয়েছে। খুবই বিশেষ সেই উপাধি ‘ callous ‘ ।
যেই মেয়ে মেয়ে হয়েও তার মাঝে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বিন্দু মাত্র কোনো আকর্ষণ নেই সে নিঃসন্দেহে ক্যালেস ছাড়া কিছু নয়। সানাহ্কে যারা ভার্সিটির লাইফের প্রথম থেকে শেষ অব্দি দেখেছে তারা নিজেরাই অবাক। একটা মেয়ে কি পরিমান ক্যালেস হলে এতগুলো ছেলের আকর্ষণীয় প্রস্তাব নিষ্ঠুরভাবে ফিরিয়ে দিতে পারে।
সানার স্বভাব সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। সানাহ্ যে যেকোনো ধরনের সম্পর্কের প্রতিই উদাসীন সেটা তার বন্ধু মহল দেখলেই বোঝা যায়। ভার্সিটি লাইফে আজ পর্যন্ত কোনো বন্ধুই সে জুটাতে পারেনি কিংবা চেষ্টা করেনি। ভার্সিটি লাইফে যেখানে বন্ধু বানানো ডান হাতের খেলা সেখানে সানার একটাও বন্ধু না থাকা সবাইকেই অবাক করেছে। সাথে সবাই এটাও বুঝেছে যে সানার কোনো বন্ধু আদো জীবনে সম্ভব না।
বন্ধু না থাকার দরুন সানাহ্ বরাবরই বাড়ি থেকে ভার্সিটি আর ভার্সিটি থেকে বাড়ি একাই আসা যাওয়া করে। তার যাতায়াতের মাধ্যম হলো রিক্সা। বিকেলের মেঘলা পরিবেশে ভার্সিটি থেকে ফিরতে সময় হালকা রোদ গায়ে মেখে একলা ফিরে আসাই যেন সানার জন্য পরম আনন্দের ব্যাপার। এই আনন্দ সে কারোর সঙ্গে ভাগ করতে রাজি নয়।
সানাহ্ তখন সবে ক্লাস করে বের হচ্ছিল। হঠাৎ নজরে পড়লো বিল্ডিংয়ের করিডোরের শেষ মাথায় ফারহান ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। একবার মনে হলো চিৎকার দিয়ে ডাকলে হয়তো ফারহান শুনতে পাবে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এমনটা করলে সবাই ওদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এছাড়াও কাজটা তার এথিক্সের বাইরে হয়ে যাবে। তাই সানাহ্ নিঃশব্দেই পথ চলতে লাগলো। উদ্দেশ্য হুট করে ফারহানের সামনে গিয়ে তাকে চমকে দিবে।
তবে সানার আর চমকে দেওয়া হলো না। তার দৃঢ় পদক্ষেপ থেমে গেছে। ফারহানকে ফোন রেখে ম্যাডাম রিয়াশার সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। রিয়াশার সঙ্গে বেশ হেসে হেসেই কথা বলছে ফারহান। কী সুন্দর তার হাসি। বাহ্ দুজনকে কি সুন্দর মানিয়েছে ? আচ্ছা কার সঙ্গে ফারহানকে বেশি মানায় ? সানার সঙ্গে নাকি রিয়াশার সঙ্গে। রিয়াশার সঙ্গেই ভালো মানানোর কথা কারণ তারা একসময় কলেজ লাইফের বন্ধু ছিল আবার দুজন তো সমানে সমানে।
এতকিছু ভেবে সানার আর ফারহানের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করলো না। ফারহানের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ভার্সিটি গেটের দিকে হাঁটা ধরলো। উদ্দেশ্য ভার্সিটির সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে সোজা বাড়ি যাবে। বিকেলের মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে বাড়ি যাওয়ার মজাই আলাদা। যেই ভাবা সেই কাজ।
সানাহ্ ধীর পায়ে হেঁটে ভার্সিটির বাইরে চলে এলো। বাইরে আসতেই চোখের সামনে ধরা পড়লো অগণিত খালি রিকশা। এর মধ্যে একটা রিক্সা বেছে নিয়ে বললো ‘ ধানমন্ডি লেক ‘ । সানার কথা শুনে রিক্সাওয়ালাও প্যাডেল চালালো। প্রথমে ভেবেছিল বাড়ি যাবে কিন্তু হঠাৎ মনে হলো একটু একা একা কোথাও ঘুরে আসা যাক। নিজের সঙ্গে নিজের সময় কাটানোও হবে আবার লেকের স্বচ্ছ ধারাও দেখা হবে।
রিক্সা ধানমন্ডি লেকে এসে থামতেই সানাহ্ রিক্সা ভাড়া দিয়ে রিকশাওয়ালাকে মুক্ত করে দিলো। টাকা হাতে নিয়ে রিকশাওয়ালা পান খাওয়া ৩২ পাটি দাত দেখিয়ে হেসে চলে গেলো। সানাহ্ সেই দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার গন্তব্যে হাঁটা ধরলো।
ধানমন্ডির এক অন্যতম টুরিস্ট স্পট হলো ধানমন্ডি লেক। ধানমন্ডি লেক আসলেই চারদিকে শুধু মানুষদের আনাগোনা চোখে পড়ে। সবাই যে যার যার মতো ব্যস্ত। কেউ নিজের পরিবার নিয়ে তো কেউ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত। আবার কিছু কিছু হিন্দু দম্পতিও এসেছেন একটু ঘুরে বেড়ানোর। সকলের মুখেই কত সুন্দর হাসি।
মাঝে মাঝে নিজের আশেপাশে এত হাসতে থাকা মানুষদের দেখে সানার মনে হয় এই পৃথিবীতে একমাত্র সেই অসুখী। কিন্তু সত্য তো এটাই অনেকেই মুখোশের আড়ালে নিজেদের দুঃখকে লুকিয়ে রেখে মুখে ফুটিয়ে তুলে নকল হাসি। প্রত্যেকটা মানুষেরই দিনশেষে কোনো না কোনো দুঃখ থাকে।
এই জগতে সকলেই একা সে তার যতই আপনজন থাকুক। সারাদিন ঘর, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা, স্বামী নিয়ে ব্যস্ত থাকা স্ত্রীও দিনশেষে একসময় একা। মানুষ যেমন একলা পৃথিবীতে আসে তেমনি একলা জীবন কাটিয়ে আবার একলাই ফিরে যায়। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও একলা থাকাটাই মানব জাতি। কেউ কেউ কাছের মানুষ থেকেও একলা আবার কেউ কেউ না থেকেই একলা।
যাহ এরকম ইমোশনাল কথাবার্তা সানার ভাবতে ইচ্ছা করছে না। মাইন্ড ডাইভার্ট করা দরকার। সানাহ্ মাথা থেকে সব আজাইরা চিন্তা ভাবনা ছেড়ে সেতুর দিকে এগিয়ে গেলো। ধানমন্ডি লেকে একটা সেতু আছে। সেই সেতুতে দাড়িয়ে ধানমন্ডি লেক দেখতে আরও চমৎকার লাগে। সেখানকার দৃশ্য আসলেই চমৎকার।
সানার মনে হচ্ছে সে আস্তে আস্তে তার মামণির মতো হয়ে যাচ্ছে। তার মামণিও এরকম নীরবে নিভৃতে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করত। যখনই সুযোগ পেত একলা ঘুরতে চলে যেত। অবশ্য কখনও কখনও ছোটো সানাহ্কে নিয়েও যেত। তার মামণি সুযোগ পেলেই প্রকৃতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করত। আজ সেসব অতীত।
আজ অনেকদিন পর রাস্তার ধারে যেখানে বাচ্চাগুলোকে শেষবারের মত দেখে গিয়েছিল সেখানেই এসেছে অতসী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অলি গলি চিপা চুপা খোজার পরও তাদের খোঁজ মিলেনি। চিন্তায় অতসীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এতগুলো বাচ্চা একসঙ্গে কোথায় গেলো ? এতগুলো আস্ত মানুষ কি করে কর্পূরের মত উবে গেলো ?
অতসীর অনেক চিন্তা হচ্ছে কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। কথাগুলো কি দাদুকে জানাবে ? নাহ্ দাদুকে জানালে যে দাদু চিন্তায় পড়ে যাবে। উফফ অতসী ভাবতে পারছে না। ওর মাথা কাজ করছেনা এতগুলো বাচ্চা একসঙ্গে কোথায় গেলো। এসব ভাবতে ভাবতেই অতসী ফুটপাতের উপর থাকা চেয়ারে মাথা চেপে বসে পড়লো। সকালে রোদ পড়ায় মাথা ধরেছে।
হঠাৎ অতসী খেয়াল করলো রাস্তার ওই পাড়ে বিল্টু দাড়িয়ে আছে। সাথে সাথে অতসী লাফিয়ে উঠে বিল্টুকে ইশারা করলো সে ওখানেই আসছে বিল্টু যেন দাড়ায়। বিল্টু অতসীর ইশারা বুঝলো কিনা কে জানে তবে ওখানেই দাড়িয়ে রইলো। অতসী কোনোমতে রাস্তা পার করে বিল্টুর কাছে গেলো। হাপাতে হাপাতে বিল্টুর কাধে হাত রেখে বলল ‘ তোরা সবাই কোথায় উধাও হয়েছিস ? ‘
‘ আমাদেরকে ঐযে একটা ভাইয়া আছে না যে রোজ আসতো সে একটা আশ্রমে নিয়ে গেছে। তোমরা কি যেন বলো ওটাকে ? হুম এনজিও… ওখানে। ওখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। ‘ বিল্টু বললো।
‘ কিহ, উনি বললেন আর তোরাও রাজি হয়ে গেলি ? তোদের না আমি বলেছি আমাকে না বলে কিছু করবি না ? তাহলে তোরা কেন রাজি হয়েছিস ? ‘ অতসী রেগে গিয়ে বললো। একটা স্বল্প পরিচিত দুই দিনের মানুষ এসে তার কাছের মানুষদের এভাবে করুণা দেখিয়ে নিজের দিকে টেনে নিবে সেটা কিছুতেই মেনে নিবে না অতসী। মানুষটার সঙ্গে অতসীর অনেক খাতির থাকলেও অতসীর কাছে বিল্টু,ময়না, সন্ধ্যা ওদের থেকে কেউ বেশি না।
‘ রেগে যাচ্ছ কেন দিদি ? কী করে বলতাম তোমাকে বলো ? এতদিন তো আমরা আর ভাইয়া তোমার জন্য কত অপেক্ষা করলাম কিন্তু তুমি এলেই না। ভাইয়া রোজ এসে জিজ্ঞেস করতো তুমি এসেছো নাকি ? কিন্তু শেষে যখন তোমার কোনো খোঁজ নেই তখন পরশুদিন ভাইয়া আমাদের ওই এনজিওতে নিয়ে গেলো আর বললো প্রত্যেকদিন তুমি যেই সময় আসো সেই সময়ে এসে যেন দেখে যাই তুমি এসেছ কিনা। দেখা হলে এই চিরকুটটা দিতে বলেছে। ‘ বলে বিল্টু অতসীর দিকে একটা কালো খাম এগিয়ে দিল।
অতসী বিনা বাক্য ব্যয়ে খামটা হাতে দিল। আসলেই তো সে কাউকে না জানিয়েই আসা এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছিলো। তাই ওই মানুষটাকেও দোষ দেওয়া যায় না। এখন চিরকুটে কি লিখেছে সেটা পড়তে পারলে শান্তি। অতসী চিরকুট খুলে দেখল আবারও একই ভাবে কালো কাগজে শুভ্র রঙে রঙ্গিন কালি দিয়ে লিখা ‘ এতদিন আসোনি কেন ? আমি আর ময়না,বিল্টু ওরা তোমার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। ভাবলাম একবার খোঁজ নিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করি। কিন্তু তারপরই মনে হলো থাক না কাগজের সম্পর্কগুলো কাগজেই সীমাবদ্ধ। দরকার কি তাকে টেনে হিচড়ে বের করে আনার। যখন সময় হবে তখন আপনিতেই বেরিয়ে আসবে।
তুমি আসছ না বলে আমি নিজেই বিল্টু, ময়না ওদের থাকার একটা পার্মানেন্ট জায়গা ঠিক করে দিলাম। বাচ্চাগুলোকে একা এভাবে রাস্তায় থাকতে দেওয়াটা সেফ না। তার থেকে আমি যেখানে ওদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করেছি সেটা ওদের থাকার জন্য পারফেক্ট। তোমার দেখতে ইচ্ছা করলে বিল্টুকে বলো। বিল্টু তোমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে এনজিও দেখিয়ে আনবে। আবারও কথা হবে…. ‘
চিরকুটটা পড়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে চিরকুটটা নাকের কাছে নিয়ে চিরকুটের গন্ধ নিলো অতসী। মনে হচ্ছে চিরকুটের গায়ে মানুষটার গন্ধ লেগে আছে। হয়তো মানুষটা নিজের সঙ্গে সঙ্গে চিরকুটকেও পারফিউম দিয়েছিলো। এবার নিজের গন্ধ নেওয়ার কাজে ইস্তফা লাগিয়ে বিল্টুকে বললো ‘ তোদের ভাইয়া তো বললো তোকে বলতে । তুই নাকি এনজিওর রাস্তা চিনিস ? ‘
অতসীর কথা শুনে মুখে হাত চেপে হাসলো বিল্টু। কথা তার ভাইয়া ঠিকই বলেছে। বিল্টু আসলেই জায়গাটা চিনে। বিল্টু মানুষ হিসেবে খুবই প্রখর জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন। যা একবার দেখে তাই মনে রাখে। বিল্টু বললো ‘ হ্যাঁ চিনি তো,তুমি আমার সঙ্গে চলো। ‘
বিল্টু আর অতসী হাঁটছে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে কৌতূহল বশত অতসী বললো ‘ তোরা এতদিন যেখানে ছিলি সেখান থেকে এনজিও যেতে কতক্ষন সময় লাগে ? ‘
‘ এই তো পাঁচ মিনিটের রাস্তা, এই যে এসে গেছি ‘ বলে বিল্টু আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিল অতসীকে। বিল্টুর ইশারা অনুসরণ করে সামনের দিকে চোখ দিতেই অতসীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। অস্ফুটে বলে উঠলো ‘ এটা তো দাদুর এনজিও ‘
বিল্টু অতসীর কথা পুরোপুরি শুনতে না পারলেও শেষের কয়েকটা কথা তার কানে ঠিকই পৌঁছেছে। বিল্টু সেটা শুনে বললো ‘ হ্যাঁ দাদুর তো, এই এনজিও নাকি ভাইয়ার দাদুর। প্রণয় ভাইয়া নিজে বলেছে, ‘
এবার আর অতসীর বুঝতে বাকি রইলো না সেই চিরকুট দেওয়া মানুষটা প্রণয় নিজেই। অথচ অতসী এতদিন বুঝতেই করেনি মানুষটা প্রণয়। প্রণয় নিজেও হয়তো জানেনা যাকে সে চিরকুট দেয় সে তারই স্টুডেন্ট অতসী। কিন্তু অতসী ভেবে পাচ্ছে না পৃথিবীটা কি এতই ছোট ? সেই ঘুরে ফিরে প্রণয়ের সঙ্গেই সে প্রণয় বাঁধালো। নাকি এটা তাদের টক ঝাল মিষ্টি প্রতিশোধের শুরু মাত্র ?
‘ দিদি ভিতরে যাবে না ? ‘ বিল্টু অতসীর হাত টেনে বললো।
‘ হুম চল ‘ বলে অন্যমনস্ক হয়ে এনজিওতে ঢুকলো। এনজিওতে ঢুকতেই তার দেখা হলো লিজার সঙ্গে। লিজা হলো এনজিওর অ্যাকাউন্ট্যান্ট। জালাল সাহেবের তৈরি করা এই এনজিও হাজার হাজার বাচ্চার ভরণপোষণের দায়িত্বে আছে বলে এর অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলোও নেহাৎ বড় নয়। সেই কারণেই মূলত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে যতগুলো পোস্টে কাজ হয়ে থাকে সেগুলো এই এনজিওর মধ্যেও হয়ে থাকে।
একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী আর জনকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার কারণে জালাল সাহেবকে সরকার একটা মোটা অংকের টাকা দেয় যেটা জালাল সাহেব এনজিওর কাজেই লাগান। অতসী কয়েক বছর ধরেই এই এনজিওর সঙ্গে যুক্ত তাই লিজার সঙ্গে তার ভালই সখ্যতা। অবশ্য লিজা তার বড় কিন্তু দুজনকে একসঙ্গে দেখলে কেউ তা ধরতেই পারবে না।
লিজা তো অতসীকে দেখে বেশ খুশি। দৌড়ে এসে অতসীকে জড়িয়ে ধরে বললো ‘ কতদিন পর এলে অতসী ? আমার কথা মনে পড়ে না ? জানো আমি তোমাকে কত মিস করেছি ? ‘
অতসী লিজাকে জড়িয়ে ধরে লিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ‘ অনেক পেরা দিয়ে গেলাম এতদিন। এই কয়দিনে কত ঝড় যে গেলো তুমি ভাবতেও পারবে না। ‘
অতসীর কথা শুনে লিজা ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো ‘ আচ্ছা তাহলে তুমি আমার কেবিনে গিয়ে বসো। ওখানেই কথা বলবো। ‘
লিজার কথা শুনে অতসী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বিল্টুকে বললো ‘ তুই এখন যা…. আমি একটু পড়ে এসে তোদের সঙ্গে দেখা করবো। এখনই কাউকে বলিস না যে আমি এসেছি ‘
বিল্টু অতসীর কথা শুনে “ আচ্ছা দিদি ‘ বলে চলে গেলো।
অতসী লিজার সঙ্গে লিজার কেবিনে এসে লিজাকে বললো ‘ লিজা দরজাটা একটু লাগিয়ে দাও। ‘
লিজা অতসীর কথা মতো দরজা লাগিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো আর অতসী ওর মুখোমুখি ডেস্কের সামনে থাকা চেয়ারে বসলো।
‘ চেহারার একি অবস্থা করেছ ? এরকম হলো কি করে ? আর এতদিন এলে না কেন ? ‘ অতসীর দিকে তাকিয়ে বললো।
‘ আর বলো না। প্রথম কতদিন সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষা গেলো। এরপর তো আমার আপাইয়ের বিয়ে ঠিক হল। বিয়ের ঠিক হওয়ার পরপরই আপাই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লো। আর অসুস্থ হলে তো জানোই সে কি করে । ‘ অতসী মলিন গলায় বললো ।
অতসীর কথা শুনে লিজা অবাক হয়ে বললো ‘ উনি কি আবার পালিয়ে গেছেন ? এবার কে ফিরিয়ে এনেছে উনাকে ? নাকি নিজেই ফিরে এসেছেন ? এর আগেরবার তো নিজেই ফিরে এলেন। ‘
‘ হুম পালিয়ে গেছিলো, তবে এবার দুলাভাই ফিরিয়ে এনেছে। নাহ নিজে ফিরেনি। ওর যে জেদ.. দুলাভাই জোর খাটিয়ে ফিরিয়ে এনেছে। ওর জন্য ভাইয়া এক সপ্তাহ চাকরি বাকরি ছেড়ে শুধু ওকেই খুঁজেছে। ‘
‘ বাহ তোমার আপু তো দেখি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। বিয়ের আগেই বর সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে ফিরিয়ে আনলো। মনে হয় তোমার আপুর বিবাহিত জীবন সুন্দর হবে। তা তোমার আপুর হবু শাশুড়ি রেগে যাননি ? না মানে তার ছেলেকে দিয়ে তার হবু ছেলের বউ এত কষ্ট করালো। ‘ লিজা হাসতে হাসতে বললো। অতসীর বোন অবশেষে সুখী হতে চলেছে জেনে তার খুব ভালো লাগছে। ওই মানুষটা তার কাছেই বড়ই চমৎকার। একটু পাগলাটে কিন্তু তার কথাগুলো ওর ভালো লাগে অবশ্য সে কখনো সানাহ্কে সরাসরি দেখেনি। শুধু অতসীর কাছেই শুনেছে।
‘ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালে কি হবে ? নিজের ভালো তো একেবারেই বুঝে না। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে আর আপাই বুঝে না। এটা ঠিক যে আপাইয়ের কপাল ভালো যে ফারহান ভাইকে পাচ্ছে। নাহলে আপাইয়ের যা স্বভাব তাতে ওর কপালে বর জুটত না। আন্টি কিছু বলেননি। উনি তো দিদিকে অনেক ভালোবাসেন। আসলে আন্টি আমার মায়ের বন্ধু। ‘ অতসী বললো।
‘ যাক তাহলে তো ভালই। ‘
‘ লিজা আমাকে একটা হেল্প করবে ? তোমার হেল্প আমার দরকার। ‘ অতসী অনুরোধের সুরে বলল।
‘ কি হেল্প ? এভাবে বলছো কেন ? তুমি বললে কি আমি হেল্প করবো না ? ‘ লিজা ভ্রু কুচকে বললো।
‘ বিল্টু,ময়না ওদের যেই মানুষটা নিয়ে এসেছিল আমি চাইনা সে জানুক আমি কে। আমি চাইনা সে জানুক আমিই বিল্টুর অতস দি। মোট কথা আমি উনার কাছ থেকে আমার পরিচয় লুকাতে চাই। আমি চাই না সে আমাকে জানুক,চিনুক। এর জন্য আমার তোমার হেল্প লাগবে। তুমি প্লিজ সবাইকে বলে দাও যেন কাইন্ডলি কেউ আমার নাম বা পরিচয় উনার সামনে না নেয়। প্লিজ ডু ফর মি.. ‘ অতসী অসহায় হয়ে বললো।
‘ ঠিকাছে সেটা তো বলবো কিন্তু তুমি কেন চাচ্ছো তোমার পরিচয় লুকাতে ? ওই মানুষটা কে যে তুমি তার কাছ থেকে তোমার পরিচয় লুকাতে চাও ? আমি যতটুকু জানি উনি জালাল স্যারের নাতি তবে আমি উনাকে দেখিনি। আমি পরশু একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ‘ লিজা অবাক হয়ে বললো।
‘ সরি লিজা কিন্তু আমি তোমাকে আসল সত্যিটা বলতে পারবো না। প্লিজ তুমি জানতে চেওনা। তুমি শুধু একজন বন্ধু হিসেবে আমাকে সাহায্য করো। এর জন্য আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো। ‘ অতসী আবারও অনুরোধ করে বললো।
‘ আচ্ছা আচ্ছা আমি জানতে চাইব না। আমি সবাইকে বলে দিবো যেন কেউ তোমার কথা না বলে। ‘ বলে অতসীকে সান্ত্বনা দিলো লিজা।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….