প্রেমমানিশা(৩১)

0
177

#প্রেমমানিশা(৩১)

[পর্ব: কনফেশন]

‘ আমি তো বুঝতেই পারছি না কোনটাতে আমাকে ভালো লাগে। এই যে মিস্টার কবি আর জাপান ভাই তোমরা যদি আমাকে চুস করতে হেলপ করতেই না পারো তাহলে এসেছ কেন ? আন্টি আর মাকে পাঠিয়ে দিলেই পারতে। এই বলো না কোনটাতে ভালো লাগে। ‘ সানাহ্ অধৈর্য্য হয়ে বললো।

অসীম ধৈর্য্য নিয়ে ঘন্টা দুয়েক ঘাটাঘাটি করার পর অবশেষে যখন সানার শাড়ি পছন্দ হলো তখনও সে দ্বিধায় পড়লো। এতগুলো শাড়ির মধ্যে তার দুটো পছন্দ হয়েছে আর দুটোই সেরা। কিন্তু কোনটা নিবে সেটাই বুঝতে পারছে না কারণ দুই শাড়িরই কালার কম্বিনেশন আর ডিজাইন মারাত্মক নজর কাড়া। কোনটা রেখে কোনটা নিবে সেটাই বোঝার উপায় নেই।

এমনিতেই বিয়েতে যাওয়া নিয়ে অনেক গড়িমসি করেছে। এখন যদি কোনো শাড়ি নিয়ে যেতে না পারে তাহলে ওর মায়ের ওকে মাঝ রাতে বাড়ি থেকে বের করে দিতে দুই মুহূর্ত সময় লাগবে না। কিন্তু তাই বলে তো আর বিয়ে বাড়িতে দুটো শাড়ি পড়ে যাওয়া যায় না।
সানার কথায় ফারহানের ভাবনার ছন্দপতন ঘটল। সে মুখ তুলে দেখলো সানাহ্ চিন্তিত ভঙ্গিতে দুটো শাড়ি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সানার কথায় জাপানও তার স্পেশাল কল রেখে দিল। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে এখন সানাহ্কে হেল্প না করে ফোনে কথা বললে সানাহ্ আর তার সঙ্গে কথাই বলবে না তাই সে ফোন রেখে সানার কথায় মন দিল।

– ‘ বাঙ্গি কালারেরটা তোমাকে ভালো মানাবে ‘

– ‘ হোয়াইটের মধ্যে ম্যাজেন্ডা পাড়ের শাড়িতে তোকে জোস লাগবে ‘

কথাগুলো বলেই যেন চমকে উঠলো ফারহান আর জাপান। দুজনেই একসঙ্গে ভিন্ন ধর্মী রং বলে সানাহ্কে বিপদে ফেলে দিয়েছে। ফারহানের বাঙ্গি কালারের পাকিস্তানি শিফন জর্জেট শাড়ি পছন্দ আর জাপানের হোয়াইটের মধ্যে ম্যাজেন্ডা পাড়ের ইন্ডিয়ান রাজগুরু পছন্দ। সানাহ্ পড়বে তো পড়বে কোনটা ? এক অনুষ্ঠানে দুটো শাড়ি পড়া তো সম্ভব না।

‘ যাহ বাবা দুজনে তো দুই শাড়ি বললে… এখন কি করা যায় ? এক কাজ করি…. দুটো শাড়িই নিয়ে ফেলি। জাপান ভাইয়েরটা মায়ের বান্ধবীর বিয়েতে পড়বো আর ফারহানেরটা আমাদের এনগেজমেন্টে পড়বো। এটাই ভালো হবে। ভাইয়া আপনি এগুলো প্যাকেট করেন আর সঙ্গে কিছু ডার্ক কালারের সুতির শাড়ি দেখান। ‘ বলে সানাহ্ শাড়িগুলো সেলসম্যানের দিকে এগিয়ে দিল।

সানার কথা শুনে ফারহানের রাগ হলো। সানাহ্ কেন তার জাপান ভাইয়ের পছন্দ করা শাড়ি বিয়েতে পড়বে ? ফারহানের পছন্দ করা শাড়ি পড়লে কি সমস্যা ? ফারহানের মনে হচ্ছে জেনেশুনে এখানে এসে তার কপাল পুড়িয়েছে সে। সে যদি জানত এখানে এসে এসব দেখতে হবে তাহলে কখনোই এখানে আসতে রাজি হতো না।

সানাহ্ তার মায়ের কথা মতোই বিয়েতে আর তাদের এনগেজমেন্টে পড়ার জন্য শাড়ির সঙ্গে সঙ্গে কিছু ডার্ক কালারের সুতির শাড়ি নিলো যাতে বিয়ের পর সেগুলো পড়তে পারে। এখন হয়তো যুগ বদলেছে। অনেক মেয়েরাই বিয়ের পর সেলোয়ার কামিজ পড়ে কিন্তু সানাহ্ শাড়িতেই বিবাহিত হওয়ার আনন্দ খুঁজে পায়।

সব শাড়ি কেনাকাটা শেষে এবার ওরা তিনজনে ওয়েডিং কালেকশন সাইটে ছুটলো। আনুষঙ্গিক সব তো কেনাকাটা শেষ। এখন শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য লেহেঙ্গা আর গয়না কেনা বাকি। এই দুটো জিনিস কেনা হয়ে গেলেই ওরা বাড়ি ফিরতে পারবে।

যথারীতি ওরা গিয়ে লেহেঙ্গা সিলেকশনে মন দিল। সেলসম্যান একের পর এক সব নজরকাড়া লেহেঙ্গা দেখাচ্ছে কিন্তু কোনোটাই সানার মনঃপুত হচ্ছে না। সবই ওর ভাষ্য মতে ক্যাটক্যাটে। অবশেষে জাপান এবার শ খানেক লেহেঙ্গা দেখার পর বিরক্তির চরম পর্যায়ে গিয়ে সানাহ্কে ধমক দিয়ে বললো ‘ তোর সমস্যা কি বলতো ? একটাও ভালো লাগছে না কেন ? এরকম করলে কি করে হবে ? এভাবে চললে তো বিয়ের লেহেঙ্গাই কিনা হবে না। ‘

‘ তাই বলে কি যেটা ইচ্ছা সেটা উঠিয়ে নিয়ে যাবো ? আমার দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র বিয়ে। এই বিয়েতে কি আমি নিজের পছন্দমত লেহেঙ্গা পড়তে পারবো না ? আজব কথা বলো তুমি ভাইয়া…. এই এই ওয়ান সেকেন্ড। এই যে ভাই ঐ মেরুন কালারের লেহেঙ্গা বের করুন। ওটা খুলে দেখান আমাকে ‘ জাপানের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ই সানার চোখে পড়লো একটা মেরুন কালারের লেহেঙ্গা।

লেহেঙ্গাটা সিম্পল আর গর্জিয়াসের মাঝামাঝি পর্যায়ে এবং বেশ নজরকাড়া। অনুষ্ঠানে সানার ক্যারি করতে বেশি প্রবলেম হবে না এর অল্প কারুকার্যের কারণে। ফুল লেহেঙ্গা মেরুন হলেও দুপাট্টা কিছুটা জবা ফুলের মত রঙিন। রঙের নামটা সানার ঠিক জানা নেই তবে এই লেহেঙ্গা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ওর মামনির শখ ছিল মেয়েকে বিয়েতে মেরুন কালারের লেহেঙ্গা দিয়ে নিজ হাতে সাজাবেন কিন্তু আপসোস সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না।

অবশেষে বিয়ের লেহেঙ্গা, গয়নাগাটিসহ যাবতীয় যত ধরনের কেনাকাটি ছিল সব মিটিয়ে ওরা একটা ক্যাফেতে ঢুকলো। এর মাঝেই ফারহানের বৌভাতের সুটও কিনে ফেলা হয়েছে। সব কেনাকাটা করতে করতেই বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। পৃথিবী নিজেকে মুড়িয়েছে তমসার অন্ধকারাচ্ছন্ন চাদর গায়ে। চারপাশে নেমে এসেছে এক গভীর অন্ধকার।

‘ এই তোরা কে কোনটা খাবি বল আমি অর্ডার করছি ‘ জাপান ক্যাফের মেনু কার্ড দেখতে দেখতে বললো।

‘ আমার জন্য শুধু রাইস বোল হলেই চলবে। বাড়ি ফিরে রাতে না খেয়ে শুলে প্রবলেম আছে। ‘ সানাহ্ ওর ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে বলল।

‘ ভাইয়া আপনি কিছু নিবেন না ? ‘ সানাহ্ অর্ডার দিয়েছে কিন্তু ফারহান কিছুই বললো না দেখে জাপান ফারহানকে জিজ্ঞেস করলো।

‘ ওয়ান ক্যাপাচিনো… ‘ গম্ভির মুখে বললো ফারহান।
জাপান খানিকটা অপ্রস্তুত হলো ফারহানের ব্যবহারে। ফারহানের ব্যবহার সেই শুরু থেকেই তার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। তবে সে কথা বাড়ালো না। ওয়েটারকে ডেকে সবার অর্ডার বলে দিলো। ওয়েটার যেতেই জাপানকে জরুরি কল অ্যাটেন্ড করতে হবে বলে সে ফোন নিয়ে ক্যাফের বাইরে চলে গেলো।

‘ আপনার কি মন খারাপ কবি সাহেব ? ‘

সানাহ্ সেই প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছে ফারহানকে আজ অন্য দিনের তুলনায় বেশি মনমরা আর গম্ভীর মনে হচ্ছে। কিন্তু সময়াভাবে আর জাপান সামনে থাকায় কিছু বলার সুযোগ পায়নি। ব্যাপারটা যতটা সম্ভব না দেখার ভান করেছে কিন্তু ফারহানের এরকম থমথমে মুখ দেখতে তার মোটেই ভালো লাগছে না। কি হয়েছে কি লোকটার ?

‘ কার ? আমার ? আমার আবার মন খারাপ হয় নাকি ? আমি কি মানুষ ? আমার মন খারাপ হওয়ার কথাই না ‘ ফারহান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো।

ফারহানের কথার ধরণেই সানার বুঝতে বাকি রইলো না ফারহান কোনো কারণে তার উপর রেগে আছে। তাই সে রাগান্বিত ফারহানকে শান্ত করার জন্য ফারহানের হাতে হাত রাখলো। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। ফারহান তো শান্ত হলোই না উল্টো রাগে ঝটকা মেরে সানার কাছ থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে দাতে দাত চেপে বললো ‘ ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু টাচ মি। ইউ ডোন্ট হ্যাভ দা রাইট। ইউ হ্যাভ লস্ট ইট। একচুয়ালি তোমার আমাকে বিয়ে না করে তোমার জাপান ভাইকে বিয়ে করা উচিত। সেই তোমার জন্য পারফেক্ট। ইউ বোথ আর মেইড ফর ইচ আদার ‘

কথাগুলো বলে ফারহান এক মুহুর্ত আর সেখানে দাড়ালো না। এখন তার মাথা গরম তাই এখানে থাকলে আরও বেশি উল্টাপাল্টা কথা বলবে তাই এখান থেকে চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যেই ভাবা সেই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো ফারহান।

সানাহ্ শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফারহানের যাওয়ার পথে। ফারহান আর সানার মাঝে হওয়া বাক বিতন্ডা অল্প বিস্তর অনেকের কানেই গেছে বলে তারা নিজেদের খাওয়া দাওয়া, আড্ডা ছেড়ে সানার দিকে তাকিয়ে আছে। সানাহ্ একবার ঝাপসা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো। চোখ দুটোর কার্নিশে জমা হওয়া অশ্রু মুছে চেয়ারের গাঁয়ে হেলান দিয়ে কপাল হাত ঠেকিয়ে বসে রইলো।

‘ একি ফারহান ভাই কোথায় ? ‘

ইমার্জেন্সী কল অ্যাটেন্ড করে ফিরতেই জাপান লক্ষ্য করলো ফারহানের জায়গাটা শুন্য অথচ দশ মিনিট আগেও এখানে ফারহান ছিল। কিন্তু এই দশ মিনিটে যে কি ঘটেছে তার তো কিছুই জানা নেই জাপানের। জাপানের কথা শুনে সোজা হয়ে বসলো সানাহ্। স্বাভাবিক গলায় বললো ‘ উনার একটা ইমার্জেন্সী কাজ পড়ে গেছে। তাই আমাকে বলেই চলে গেলেন। তোমাকে জানিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই বলেছি আমি জানিয়ে দিবো তোমাকে। ‘

জাপান আর কথা বাড়ালো না। অতঃপর ওরা দুজনে খাওয়া দাওয়া করে বাড়ির পথে রওনা দিলো। জাপান এবার বেশ অবাক হলো সানার ব্যবহারে। আসতে সময় সানাহ্ তার সঙ্গে যত কথা বলেছিল তার একশো ভাগের এক ভাগও ফিরতে পথে বলেনি। কিছু কি হয়েছে ? জাপানের জানা নেই।

বাড়ি ফিরে শপিংয়ের ব্যাগগুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সানাহ্ সোজা উপরে নিজের ঘরে চলে গেল। সকলে বেশ অবাক হলো সানার ব্যবহারে। সানাহ্কে দেখতে মিসেস আশা এসেছিলাম কিন্তু যার সঙ্গে দেখা করতে এলেন সেই তার দিকে ফিরে তাকালো না। হয়তো সারাদিন দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত হয়ে গেছে তাই কেউ আর ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দিল না।

ঘরে ফিরেই কাধের ব্যাগটা তার জায়গামতো রেখে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো সানাহ্। তার মাথা প্রচন্ড ধরেছে। মনে হচ্ছে এক মুহূর্তও সে দাড়াতে পারবে না। মাইগ্রেনের ইফেক্ট। সানাহ্ কোনোমতে গোসল সেরে বেরিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ঘুমের ওষুধ নিয়ে খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ওষুধের প্রভাবে সানার চোখ জুড়িয়ে আসছে। একবার মনে হলো দরজার লক লাগিয়েছে কিনা। কিন্তু ঘুমের ওষুধের প্রভাবে উঠে গিয়ে লক লাগানোর মতো শক্তি সানার নেই।

ঘুম ভেঙে নিজেকে অন্ধকার ঘরেই আবিষ্কার করলো। প্রথমে মিনিট দুয়েক কোথায় এসে বুঝতে সময় লাগলো। কিছুক্ষণ পরই টের পেলো ও ওর ঘরেই আছে আর ভোরের আলো এখনও ফুটেনি। কিন্তু কি অদ্ভুত… ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরও সানার ঘুম এত তাড়াতাড়ি ভেঙে গেলো ? এটা কি আদৌ সম্ভব ? সানাহ্ জানেনা তবে কাল রাতে বেকায়দায় ঘুমানোর কারণে গা গতর সব ব্যথায় টনটন করছে। মাথাটাও বেশ ভার ভার লাগছে।

শরীরে শক্তি নেই তবুও কোনোমতে নিজেকে সামলে উঠে বসলো সানাহ্। পা দুটো টেনে নিয়ে করিডোরের সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। ড্রয়িং রুমে শূন্যতা বিরাজ করছে। এত সকালে কেউই থাকার কথা না। সানাহ্ ধীরে ধীরে রান্নাঘরে গেলো। এক কাপ স্ট্রং ব্ল্যাক কফি বানিয়ে বাড়ির বাইরে বাগানে এসে দাঁড়ালো।

কফির কাপে চুমুক দিতেই শরীরটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠলো।। সানার এখন এক মুহূর্তের জন্য কফি খেয়ে মনে হচ্ছে এই কফি ওর শরীর এবং মস্তিষ্ক দুটোই চাঙ্গা করেছে। মস্তিষ্কের সকল জট খুলে গেছে। কালকে রাতের লম্বা ঘুম আর আজকে সকালের স্ট্রং কফি দুইই তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছে ফারহানের সঙ্গে ঝামেলা মিটানোর। সে জানে তাকে কি করতে হবে। সানাহ্ বাঁকা হেসে কফির কাপে আরেক চুমুক বসালো। মেজাজটা তার এখন ফুরফুরে।

ব্যালকনিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আদা কুচি দিয়ে চা খাচ্ছে ফারহান। কাল সারারাত ঘুম হয়নি তার। এই একরাত না ঘুমিয়েই তার এই অবস্থা আর সানাহ্ যে প্রায়ই ঘুমাতে পারেনা তখন তার কি অবস্থা হয় গড নোজ। সকাল সকাল চা খেতে তার বেশ ভালই লাগছে। মেজাজটা তো ফুরফুরে লাগছেই সেই সঙ্গে কালকে নিজের করা ভুলের প্রতি অনুতাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কাল ওভাবে রিয়েক্ট না করলেই পারতো।

হঠাৎ মনে হলো ঘরে ফারহানের ফোন বাজছে। ফারহান হাতের কফি মগটা রেলিংয়ের কিনারে রেখে ঘরে দৌড় দিল। ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে ফোন একবার কেটে গেলেও আবার কলদাতা ফোন দিল। ফারহান ফোন হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে সানার নাম জ্বলজ্বল করছে। স্ক্রিনে সানার এক হাস্যোজ্জ্বল ছবি যেটা তারা সিলেটে মাধবপুর লেকে তুলেছিল। ফারহান যেন এক মুহূর্তের জন্য তার হার্টবিট মিস করলো।

কিয়ৎকাল পরে নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করলো। ফোন কানে দিতে না দিতেই ওই পাশ থেকে গম্ভীর স্বরে সানাহ্ বলে উঠলো ‘ সময় তিরিশ মিনিট। সিলেটগামী ট্রেন সাড়ে আটটায় ছাড়বে আর এখন বাজে আটটা। চাইলে শেষবারের মতো দেখা করতে পারেন। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো। ‘

কথাটা বলে এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না সানাহ্। ফোন হুট করে কেটে দিল আর ফারহানকে কিছুই বলার সুযোগ দিলো না। ফারহান মিনিট কয়েক থম মেরে রইলো। পরিস্থিতি তার অর্থ বোঝাতেই ফারহান ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল ঘরের বাইরে ।

ফারহানের গাড়িটা দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে স্টেশনের দিকে। স্টেশন বাড়ি থেকে প্রায় তিরিশ মিনিটের দূরত্বে কিন্তু এই তিরিশ মিনিটও ফারহানের কাছে পাহাড় সমান দূরত্ব মনে হচ্ছে। তিরিশ মিনিটের আগে পৌঁছতে না পারলে ফারহান তার সানাহ্কে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে কিন্তু সে যে চেয়েছিল সানাহ্কে সবসময়ের জন্য নিজের করতে। তার সেই ইচ্ছার কি হবে ?

ফারহান ড্রাইভ করছে আর বারবার ঘড়ি দেখছে। ঘড়িতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি কিন্তু তার মন বারবার বলছে সানাহ্ কিছুতেই তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। তবে কি সানাহ্ তার সঙ্গে মজা করছে ? মজা করে থাকলে এটা খুব খারাপ ধরনের মজা। সবকিছু নিয়ে মজা করা যায় না। অন্তত ফারহানের মন নিয়ে তো একেবারেই নয়।

স্টেশনে পৌঁছতেই গাড়ি ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল ফারহান। দৌড়ে ঢুকলো জনলোক পূর্ণ স্টেশনে। সকাল সাড়ে আটটার সময়টা অন্যদের জন্য অনেক সকাল হলেও স্টেশনের জন্য এই সময়টা দুপুরের মতোই ব্যস্ততা পূর্ণ সময়। লোকজন আসছে যাচ্ছে আর কেউ কেউ ট্রেনের অপেক্ষা বসে আছে। ফারহান দৌড়ে টিকেট কাউন্টারের সামনে গেলো। টিকেট কাউন্টারে বসে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো ‘ সিলেটের ট্রেন কি বেরিয়ে গেছে ? ‘

লোকটা ফারহানের কথা শুনে নিজের হাতে থাকা ঘড়িতে চোখ বুলালো। এরপর ফারহানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে সামনের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললো ‘ ওই তো যাচ্ছে তো ‘। ফারহান লোকটার ইশারা অনুসরণ করে সামনের দিকে নজর দিল। ওহ মাই গুডনেস…. একি ট্রেন তো বেরিয়ে যাচ্ছে। ফারহান দৌড়তে লাগলো ট্রেনের পিছু পিছু কিন্তু ধীর গতির ট্রেন যেন আজ তার অদৃশ্য গতি পেয়েছে, ছুটছে বুলেটের মত।

ফারহানকে দৌড়তে দেখে আশেপাশে থাকা সকলেই নিজেদের কাজ থামিয়ে ওর দিকে নজর দিল। ট্রেনে যারা ছিল তারাও একে একে মাথা বের করে ফারহানকে দেখতে লাগলো। মেয়েরা তো ফারহানকে দেখেই উত্তেজনায় বেহুঁশ হওয়ার জোগাড়।

ফারহান যার জন্য এত রাস্তা ছুটে এলো সেই অপেক্ষা করলো না তার জন্য অথচ সে বলেছিল অপেক্ষা করবে। আপসোস ট্রেন বেরিয়ে গেছে। ফারহান যেন হাঁটার শক্তি হারিয়েছে। সে ধপ করে পাশে থাকা বেঞ্চে বসে পড়লো। ওর পুরো শরীর অসার হয়ে আসছে। হাত পা কাপছে মৃদুমন্দ।

‘ আমি তো ভেবেছিলাম আপনার বুঝি আমার উপর থেকে মন উঠে গেছে তাই আপনি আসবেন না। কিন্তু আপনি আমাকে ভুল প্রমাণ করলেন। আপনি এখনও আগের মতই আছে। চঞ্চল আর অস্থির ধরনের মানুষ। ‘

হঠাৎ মনে হলো ফারহানের শরীর তীব্র ঝাকুনি দিয়ে উঠলো। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আগের বলা কথাগুলোর মালিককে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর তাকে পেয়েও গেলো। অবিশ্বাস্য হলেও সানাহ্ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার তৃপ্তির হাসি যেন কতদিন পর হাসছে। ফারহানের মনে হলো সে আবার সানার হাসির প্রেমে পরে গেছে। কেমন এক দম্বন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে। তবে কি এটাই তার প্রেমে পড়ার লক্ষণ ? প্রেমে পড়ে তার পতন হচ্ছে বলেই একে প্রেমে পড়া বলে। তবে সে এই দমবন্ধকর অনুভূতিকে আপন করতে চায় সানার প্রেমে পড়ে।

সানাহ্ হাসছে তার ঠোঁট বাঁকিয়ে। কি অকৃত্রিম সেই হাসি অথচ ফারহানের গা জ্বালা করছে, দম বন্ধ লাগছে। ইচ্ছা করছে দৌড়ে গিয়ে বদমাশ মেয়েটাকে দুটো কষিয়ে মারতে। এতক্ষণ ওকে পাগলের মতো ছুটিয়ে এখন হাসা হচ্ছে ? তবে ফারহান অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলো। এতজন মানুষের সামনে ভুলভাল কিছু করে ভালোবাসার মানুষটার অসম্মান সে করবে না। এমনিতেই কাল কম কিছু হয়নি।

উপায়ান্তর না পেয়ে ফারহান তার রাগ প্রশমিত করতে সানাহ্কে ফেলেই হাঁটা শুরু করলো। ফারহানকে চলে যেতে দেখে সানাহ্ দ্রুত ফারহানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলো। ফারহানকে বললো ‘ এই এই আপনি আমাকে ফেলে যাচ্ছেন কেন ? আমাকে নিতে এলেন অথচ আমাকে ফেলেই চলে যাচ্ছেন ? আমার দোষটা তো বলে যান… ‘

‘ আমি বুঝিনা তোমার এত সবাইকে চমকে দিতে হবে কেন ? এক আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহ কি তোমাকেই সবাইকে চমকে দেওয়ার কাজ দিয়েছে ? তুমি ছাড়া আর কেউ কি চমকে দিতে পারে না ? তোমারই কেন সবসময় চমকে দিতে হবে ? হোয়াই ? হোয়াই ? ‘ ফারহান সানার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো।

‘ আরে ধুর এবার আমি আপনাকে চমকে দিলাম কোথায় ? উল্টো আপনি আমাকে কাল চমকে দিলেন। রেগে চলে গেলেন শুধু কারণে। গেলেন তো গেলেন এটা বলে গেলেন যেন আমি জাপান ভাইকে বিয়ে করে নেই। না মানে এটার কোনো মানে হলো ? আমি কোন দুঃখে ভাইয়াকে বিয়ে করবো ? আর কিভাবেই বা বিয়ে করবো ? একে তো আমি কখনও ওকে বড় ভাই ছাড়া অন্য কোনো চোখে দেখিনি। দ্বিতীয়ত ও তো অলরেডি এনগেজড। ওর এনগেজমেন্ট আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই হয়ে গেছে। ওর ফিয়ন্সে কে আমি চিনি। ভীষণ মিষ্টি মেয়ে তবে আমার চাইতেও ছোট এই যা। ‘ সানাহ্ ঠোঁট উল্টিয়ে ফারহানের পিছু পিছু হাটতে হাটতে বললো।

এবার যেন সানার কথা শুনে ফারহান বড়সর এক ৪৪০ ভোল্টের শক খেলো। যেই ছেলের সঙ্গে সানাহ্কে দেখে সে রেগে ফায়ার সেই ছেলে এনগেজড!! এত বড় একটা ভুল ফারহান কি করে করলো। মানুষ চিনতে ভুল করলো ? সানাহ্ আর জাপানের মধ্যে থাকা সম্পর্ক চিনতে ভুল করলো ? ভাগ্যিস রাগের মাথায় সানাহ্কে উল্টাপাল্টা আর কিছু বলেনি নাহলে আজ আর তার মুখ দেখতে হতো না। মেয়েটা ওর রাগ ভাঙাতে না এসে উল্টো ওকেই সাড়াশি নিয়ে তাড়া করতো।

ফারহানকে চুপ করে যেতে দেখে পা চালিয়ে এগিয়ে এলো সানাহ্। ফারহানের ডান হাতের ভাজে নিজের বাম হাত পুড়ে দিয়ে বললো ‘ এই যে আজ এই হাতটা ধরলাম…. এই হাত জীবনের কোনো মুহূর্তে ছাড়বো না কারণ আমি জানি আপনি আমার। আমাদের মধ্যে রাগ হবে, ঝগড়া হবে, মারামারিও হবে কিন্তু বিচ্ছেদ হবে না। ‘

ফারহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সানার দিকে। আজ সানাহ্কে তার অদ্ভুত ঠেকছে। এই সানাহ্কে সে চিনে না। যেই সানাহ্ তার দিকে ফিরে একটা শব্দ খরচ করতো না আজ সেই সানাহ্ই তাকে এতকিছু বলছে। ফারহানের বিশ্বাস হচ্ছে না। ফারহান নিজেকে সামলে সানার দিকে ঝুঁকে এলো। সানাহ্ শুধু চুপচাপ ওর কার্যকলাপ দেখছে।

ফারহান খানিকটা ঝুঁকে সানার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো ‘ এই জীবনে মনে হয় ভালোবাসার মতো অঘটন ঘটিয়েই ফেলেছি সানাহ্। অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসেছি, তোমার বিরহে পুড়েছি এবং তোমাকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়েছি। কজ আই অ্যাম ইন অ্যাকসিডেন্টলি লাভ উইথ ইউ। আমি তোমার কথার প্রেমে পড়েছি… তোমাতেই আমার সর্বনাশ দেখেছি। আজ এই আমি, ফারহান ইমতিয়াজ মরে গেলেও জানবে এই ফারহান তার সবটা দিয়ে এক নারীকেই ভালোবেসেছে। সে এক নারীতেই আসক্ত। আই অ্যাম এ ওয়ান ওমেন ম্যান ডিয়ার। ‘

সানাহ্ এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। ফারহানের বলা প্রত্যেকটা কথার মর্ম বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না ফারহান তাকে এই কথাগুলো বলেছে। সানাহ্ যেন বরফের মতো জমে গেছে। ওর পা দুটো তাদের জায়গাতেই আটকে গেছে। শরীরে মৃদু মন্দ বাতাস বইছে আর কেমন শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। কিসের এই অনুভূতি ? প্রিয়জনের কাছ থেকে প্রিয় কথা শোনার অনুভূতি ?

ফারহান মুচকি এসে সানার হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো। মিনিট কয়েক যাওয়ার পর মুচকি এসে সানাহ্ও পা চালিয়ে এসে আবার ফারহানের ডান হাতের ভাজে নিজের বাম হাত পুরে দিল। এই যে আজ থেকে শুরু এই পথ চলা। এই পথ চলতে থাকবে তাদের মৃত্যুর আগ অব্দি।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here