#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫৯
সময় এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের জীবনও এগিয়ে চলে। দূর বহুদূর। রুদ্র, হৈমী, মাহের, সূচনা। ওদের জীবনও এগিয়ে গেছে বেশ। সূচনা এখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। হৈমীর কাছে খবর এলো, তার মেয়ে বেবি হবে। খবরটা শুনে সে বেজায় খুশি। রুদ্র বাড়িতে নেই। সাতসকালে ঢাকা চলে গেছে সে। সপ্তাহে দু’দিন অফিস যাচ্ছে। কাজ থেকে দীর্ঘদিন বিরতি চলার পর এবার ধীরেধীরে কাজে ফিরছে। সেই সঙ্গে সংসারীও হচ্ছে। বেচারা বউ, বাচ্চা ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারে না। অফিসে কাজের ফাঁকে বাচ্চাদের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলে। দু’টো বাচ্চা সামলে হৈমীর অবস্থা নাস্তানাবুদ। ছেলেটা খুব বেশি দুষ্টু। সবে বসতে শিখেছে। হাত, পায়ে একটুও স্বস্তি নেই। মেয়েটা একেবারে শান্ত। হৈমীর ধারণা রুদবা বাবার স্বভাব পেয়েছে। আর ছেলেটা বুঝি তার স্বভাব পেয়ে গেল! মাঝেমধ্যে এই নিয়ে অবশ্য রুদ্রর সঙ্গে তার তর্ক চলে। রুদ্র বেশ কৌতুক করেই বলে,
-” সারাজীবন তো আমার শাশুড়িকে জ্বালিয়েছ। এবার তোমার জ্বলার পালা। ”
হৈমী তখন চোখ, মুখ শক্ত করে মেয়ে কোলে রুদ্রর চোখের সামনে থেকে চলো যায়। ছেলেটাকে রেখে যায় রুদ্রর মাথা খেতে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কীভাবে যেন রুদ্র ম্যানেজ করে নেয় সবটা। রুদ্রিকও বাবার কোলে খুব একটা বাড়াবাড়ি করে না। হৈমী তখন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে ছেলেকে শাসন করতে আসে। রুদ্র তখন নিজেকে বাহবা দিয়ে বলে,
-” যে ছেলের মা’কে কন্ট্রোল করতে জানে সে ছেলেকেও কন্ট্রোল করতে জানে। তুমি জানো না এটা তোমার ব্যর্থতা। ”
এভাবে প্রায়ই তাদের খুনসুটি চলে। সবসময় রুদ্রিক ফুল এনার্জিতে থাকে। আর রুদবা জন্ম থেকেই দুর্বল প্রকৃতির। তার প্রতি বিশেষ যত্ন সব সময় নেয়া হয়। রুদ্র হৈমীর তুলনায় কম চিন্তা করে রুদবাকে নিয়ে। সে পুরোপুরি নিশ্চিত মেয়েটা তার মতো গম্ভীর প্রকৃতিরই হবে। আর ছেলেটা হবে মায়ের মতোন। হাই লেভেলের দুষ্টু।
.
.
রাতে এসে বোনের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলল রুদ্র। এ বাড়িতে সে আসতে চাইলেও শাশুড়ির জন্য আসতে পারে না। এতে অবশ্য মন খারাপ হয়নি। বাবা, ভাইকে বুঝিয়ে বলেছে শাশুড়ি মা তার যত্ন করতে চায় বলেই যেতে দেবে না। এরপর থেকেই প্রতিমাসে দু’বার করে মেয়েকে দেখে আসেন রিদওয়ান শেখ। মনকে দেখার জন্য রুদ্রর মনটাও ভীষণ ছটফট করছিল। তাই বলল, আগামীকাল হৈমী আর বাচ্চাদের নিয়ে সে আসছে। রুদ্রর এহেন কথা শুনে হৈমী, সূচনা দু’জনই বিস্মিত হলো। বাচ্চা হওয়ার পর একবারো বাপের বাড়ি যায়নি হৈমী৷ রুদ্র যেতে দেয়নি৷ কত রাত চোখের পানি ফেলেছে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেছে। রাগ হয়েছে, কথা বলা বন্ধ করেছে। লাভ হয়নি। অথচ আজ নিজে থেকেই নিয়ে যেতে চাইছে। প্রথমে মনে হলো, পুরোটাই সূচনার জন্য। সূচনাকে দেখতে মন চেয়েছে বলেই। কিন্তু পরে ভাবল, তাহলে রুদ্র একাই গিয়ে দেখে আসতে পারত। বাচ্চাদের সহ তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই যেত না?
পরেরদিন সত্যি সত্যি নিজের বাড়ি এলো হৈমী। নাতি, নাতনি কাছে পেয়ে হামিদার খুশি যেন ধরেই না। মাহেরও ভাগ্না,ভাগ্নিকে নিয়ে বাড়ি জুড়ে ঘুরে বেড়াল৷ সূচনা ওদের কোলে নিতে পারল না বলে তার খুব মন খারাপ হলো। মাহের রুদবাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেদের ঘরেই শুইয়ে দিল। রুদ্রিক তখন মায়ের কোলে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। হৈমী অতিষ্ঠ মুখে বিছানার এক কোনে গিয়ে বসল। বসাতে যেন দ্বিগুণ রেগে গেল ছেলেটা। সে তার ফোকলা দাঁতে মায়ের গলায় কামড়াতে শুরু করল! দন্তহীন কামড় তবুও ব্যথায় ‘ আহ ‘ সূচকে শব্দ করল হৈমী। মাহের দ্রুত এসে ভাগ্নাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করল। তবুও কান্না থামানো গেল না। হামিদা শুরু করল,হায় হুতাশ। দোয়া, দরূদ পড়ে ফুঁ দিতে লাগল নাতির সারা গায়ে। সূচনা ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলল,
-” ওর বোধ হয় এখানের পরিবেশ ভালো লাগছে না।”
রুদ্র কিছু সময়ের জন্য বাইরে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর হৈমীকে কাঁদতে দেখল। মাহেরের কোলে ছেলে কাঁদছে। বিছানায় বউ কাঁদছে। বোন এসে চিন্তিত মুখে স্বামীর কোলে রুদ্রিকের দিকে তাকিয়ে। হামিদা দোয়া দরূদ পড়ে সমানে ফুঁ দিচ্ছে রুদ্রিককে। এমন শোচনীয় অবস্থা দেখে অধর কামড়ে এগিয়ে এলো সে। মাহেরে থেকে রুদ্রিককে নিয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আকাশের চাঁদ, তাঁরা দেখিয়ে দীর্ঘক্ষণ ছুটোছুটি করে শান্ত করল ছেলেকে। ছয়মাসের একটা বাচ্চা সামলাতে গিয়ে সবার কী বেহাল দশা হলো! আর রুদ্র জাস্ট ছয় মিনিটেই শান্ত করে ফেলল। রুম থেকে ছেলের শান্ত ভাব টের পেয়ে হৈমীর কান্নার বেগ বাড়ল। মায়ের দিকে তাকিয়ে নালিশ জানালো,
-” দেখেছ ঠিক বাবার মতো হয়েছে। বাবা ছাড়া কিছু বুঝে না। আমাকেও চিনে না। ”
হামিদা চিন্তিত মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” রুদ্রিক তোর মতো হয়েছে রে। তুইও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেই এমন করতিস। তোর জন্মের পর পাঁচ বছর বাবার বাড়ি গিয়ে রাত কাটাতে পারিনি। ঠিক এই দৃশ্যটাই তখন হতো। তিনবার এমন হওয়ার পর তোর বাবা বলেই দিল মেয়ে বড়ো, বুঝদার না হলে বাপের বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই! ”
দূর্ভাগ্যবশত হামিদার উক্ত কথাটি শুনে ফেলল রুদ্র। ঘুমন্ত ছেলেকে হৈমীর দিকে বাড়িয়ে ধরে গম্ভীর মুখে বলল,
-” সিদ্ধান্ত নিয়েছি সামনের মাসে ওদের নিয়ে ঢাকা চলে যাব। এখান থেকে অফিস করতে সমস্যা হচ্ছে। রুদ্রিক, রুদবাকে ছেড়ে দূরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই এ মাসটা হৈমী এখানেই থাকবে। ”
রুদ্রর কথা শুনে হৈমী অবাক হয়ে গেল। হামিদা আঁতকানো সুরে বলল,
-” কী বলছ বাবা! ছোটো দু’টো বাচ্চা নিয়ে কীভাবে একা থাকবে ওখানে? ”
হৈমী রুদ্রিককে বুকে আগলে আশ্চর্য মুখে তাকিয়ে রইল। রুদ্র হৈমীর দিকে গম্ভীর চাহনি ছুঁড়ে শাশুড়িকে জবাব দিল,
-” সমস্যা হবে না। ”
-” তুমি বুঝতে পারছ না। জমজ বাচ্চা নিয়ে এভাবে থাকা যায় না। তাছাড়া হৈমীর পড়াশোনা। ওখানে একা বাচ্চা, সংসার সামলে পড়াশোনা হবে কী করে? তুমি কি ওর পড়াশোনাও বন্ধ করতে চাইছ? ”
রুদ্র শাশুড়ির চোখে দৃঢ়তার সঙ্গে দৃষ্টি মেলালো। বলল,
-” বাসায় পড়বে। পরীক্ষার সময় এখানে এসে পরীক্ষা দেবে। আমি পড়াব ওকে। ”
হামিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-” এভাবে হয় না। ”
হৈমী বলল,
-” আপনি আমাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেন? ”
সহসা রুদ্র শীতল চাহনি ছুঁড়ল। হৈমীর বুকটা ধক করে ওঠল তৎক্ষনাৎ। হামিদা আর কথা না বাড়িয়ে মেয়ে জামাইয়ের জন্য খাবার বাড়তে গেল। রুমে এখন হৈমী, রুদ্র আর ঘুমন্ত রুদ্রিক। হৈমী রুদ্রিককে বিছানায় শুইয়ে দিল যত্ন করে। এরপর রুদ্রর সঙ্গে সরাসরি কথা বলল,
-” আপনি কী চাইছেন? ”
রুদ্র ভণিতা ছাড়াই বলল,
-” শান্তিতে সংসার করতে চাইছি। ”
-” আর আমার চাওয়া? ”
ভ্রু কুঁচকে গেল রুদ্রর। বলল,
-” তোমার কী চাওয়া? ”
হৈমী এক মুহুর্ত ভাবল। সত্যিই তো তার চাওয়াটা কী? অনেক ভেবেও পেল না কিছু। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী কোনোকালেই ছিল না সে। তাই ওটা বাদই দিল। আর তখনি মনে পড়ল টিশার দেওয়া সেই বুদ্ধিটার কথা। এছাড়া রুদ্রকে আরেকটু জব্দ করতেও ইচ্ছে করল। তাই বলল,
-” আপনার কথা পূরণ করা। ”
-” মানে! ”
আচমকা ওঠে রুদ্রর সামনে দাঁড়াল হৈমী। মুখোমুখি হয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” বাচ্চাদের নিয়ে একাই চলে যান ঢাকা। কথা তো এটাই ছিল৷ ওদের জন্ম দিলেই আমার দায়িত্ব শেষ। আমি সে কথা পূর্ণ করতে চাই৷ এতদিন সময় দিয়েছিলাম ওরা একটু বড়ো হওয়ার। ”
-” হৈমী! ”
চাপা ধমকে শিরদাঁড়া সোজা হলো হৈমী৷ মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে নিল একদফা। ওড়নার কোণা ধরে নাচাতে নাচাতে বলল,
-” আপনার চাওয়া পূর্ণ করাই একমাত্র চাওয়া আমার। ”
রুদ্র নিজেকে শান্ত করতে চেয়েও পারল না। সহসা হৈমীর বাহু টেনে নিজের কাছে আনল। মুখশ্রীতে কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,
-” তুমি এখন বাচ্চা নেই হৈমী৷ তোমার দু’টো বাচ্চা আছে, একটা স্বামী আছে। ”
-” ওহ। ”
-” কী ওহ তুমি জানো না তোমার দু’টো বাচ্চা আছে? ”
-” তা জানি কিন্তু স্বামী তো একটাই। ”
চোখ কটমট করে দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্র বলল,
-” বাজে বকছ। ”
শব্দ করে হেসে ফেলল হৈমী। রুদ্র আচমকা ওর ঠোঁটে হাত চেপে নিচু গলায় বলল,
-” রুদ্রিক ওঠে যাবে। ”
সচেতন হয়ে ছেলের দিকে একবার তাকাল হৈমী। এরপর রুদ্রর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। রুদ্র কিয়ৎকাল থম ধরে বসে থেকে বলল,
-” এখন আর পাগলামি করার বয়স নেই হৈমী। আমরা এখন দু’টো শিশুর বাবা, মা। যা হয়েছে সব ভুলে যাও ওদের জন্য আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে থাকতে হবে। ”
ভ্রু বাঁকিয়ে হৈমী বলল,
-” শুধুই ওদের জন্য? ”
রুদ্র এক মুহুর্ত নিশ্চুপ রইল। হৈমীর দিকে তাকিয়ে রইল প্রগাঢ় চোখে। কীভাবে কী বোঝাবে? আজো তো এই মেয়েটাকে মনের কথা সোজাসাপটা বলতে পারল না। তার দু’টো বাচ্চার মা’কে সে কতখানি ভালোবাসে আর কবে বলতে পারবে? দোনোমোনো করে খোলা দরজার পানে তাকাল রুদ্র। ধীরেসুস্থে ওঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল হৈমীর কাছে এলো। হৈমী কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সে সামনাসামনি এসে ঠাঁই দাঁড়িয়ে বলল,
-” আজ এগারো মাস হৈমী। তোমার আমার মাঝে স্বামী-স্ত্রীর সেই সম্পর্কটা নেই। যেই সম্পর্কটা না থাকলে পুরুষ বাধ্য হয় পরনারীতে আসক্ত হতে। গত কয়েকমাসে তুমি নিজে থেকেই অসংখ্যবার আবদার করেছ। এটা তোমার অধিকার। আমি ফিরিয়ে দিয়েছি কেন জানো? সেই রাতে তুমি বলেছিলে আমি নাকি তোমার শরীরটাকে ভালোবাসি। যেদিন এই শরীরটা না থাকবে সেদিন তোমার প্রতিও আমার কোনো মোহ থাকবে না। বাবু হওয়ার আগে পরের সময়টুকু আমি শুধু বাবুদের জন্য সেক্রিফাইস করছি। ব্যস। তুমি হয়তো ঠাট্টা করে এসব বলেছিলে। কিন্তু কথাগুলো আমার লেগেছিল ভীষণ ভাবে৷ সেই লাগা থেকেই এখন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমি অন্তরঙ্গ হইনি। আর হ্যাঁ বৈধভাবে পাইনি বলে অবৈধভাবে পাওয়ার বাসনাও জাগেনি মনে। আমি তোমাকে বোঝাতে পারলাম কি না জানি না৷ তুমি বুঝেছ কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না। শুধু বলব, রুদ্র নিজেকে অসংখ্যবার ভেঙেছে, অসংখ্যবার গড়েছে৷ এই রুদ্র হৈমীর কাছে শুধু মানসিক সুখ চায়। সেদিন হসপিটালে আমি বাবুদের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, শুধু তোমার জন্য৷ আজ যদি তুমি বলছ, ওদের আমাকে দিয়ে তুমি চলে যাবে। তাহলে বলব, ওদের দিয়ে নয় বরং নিয়েই আমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে যাও। ”
চমকে ওঠল হৈমী। সহসা রুদ্রর ঠোঁটজোড়ায় হাত রাখল। হতভম্ব স্বরে বলল,
-” আপনি চুপ করুন। অনেক বলেছেন আর কিছু শুনতে চাই না আমি। ”
আলগোছে হৈমীর হাতটা সরিয়ে দিল রুদ্র। দু-হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে দায়সারা ভাবে বলল,
-” আমি চুপই রইলাম। আছি তো চুপ। তোমার কাছে কিছু চাওয়ার নেই৷ শুধু বাচ্চাদের দায়িত্ব নাও, আমার কাছে থেকে যাও। ”
হৈমীর চোখদুটো টলমল করছিল। চট করে সে রুদ্রর বুকে কয়েকটা কিল বসাল। অভিমানের স্বরে বলল,
-” এমন করে বলছেন যে আমি ওদের মা নই৷ পর কেউ। আরে আশ্চর্য! আমার সন্তান ওরা। আমার আদুরে বাচ্চা, কলিজার টুকরো। ওদের দায়িত্ব নিতে আপনার বলতে হবে কেন। আপনার থেকে ওদের জন্য আমার দরদ বেশি বুঝলেন। ”
রুদ্র চোয়াল শক্ত করে দৃষ্টি আড়াল করল। নিজের ভয়াবহ শৈশব মনে পড়ছে তার। হৈমীর তখনকার কথা শুনে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠেছে। যে ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেছে। যে পরিস্থিতি সে মোকাবিলা করেছে। তা যেন তার সন্তানরা না করে। হৈমী যদি বাচ্চাদের ছেড়ে চলে যায় তাহলে রুদ্রিক, রুদবাও যে তার মতো মাতৃহীন বড়ো হবে। যেই কষ্ট সে ভোগ করেছে তা তার সন্তানরাও করবে এটা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র। হৈমী পেছন থেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল রুদ্রকে। পিঠে মাথা রেখে চোখ বুজে বলল,
-” ভয় পাচ্ছেন ? ”
রুদ্র কিছু বলতে উদ্যত হতেই হামিদার ডাক পড়ল,
-” হৈমী জামাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেতে আয়। মাহের অপেক্ষা করছে। ”
________________________
দাদিনের সাথে রুদ্রর সম্পর্কের কোনো উন্নতি নেই। দিনকে দিন অবনতি হয়েই চলেছে। এরই মধ্যে দাদিন গোপনে সুরভির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। পাশাপাশি শেখ বাড়ির অর্ধেক অংশ রিমনের নামে লিখে দেয়ার বন্দোবস্তও করেছে। মায়ের দ্বারা এমন কিছু হতে পারে কল্পনাতীত ছিল রিদওয়ানের। মানুষ যা কল্পনা করতে পারে না তা ঘটে যায় অনায়াসে। আবার যা কল্পনা করে তা কখনোই ঘটবার নয়। রিদওয়ান মায়ের এই কর্মের জন্য সরাসরি এক রাতে প্রশ্ন করে। রাগারাগি করে, শেষে অভিমান করে মধ্যরাতেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনাটা সম্পূর্ণ গোপন থাকত। যদি না ছোটো কাকি রিনা দরজার আড়ালে থেকে সব কথা না শুনত। রিনা কাকি সব কথা শুনে রুদ্রর কানে লাগিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে দাদিনের প্রতি ঘৃণাটা তীব্র হয় রুদ্রর। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যতদ্রুত সম্ভব এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তার বিশ্বাস বাবাও আর এ বাড়ি মুখো হবেন না৷ হওয়ার কথাও নয়৷ প্রাক্তন স্ত্রী বড়ো ভাইয়ের বউ হয়ে তার সন্তানের মা হয়ে এ বাড়িতে অধিকার আদায় করবে। চোখের সামনে এসব দেখে কি স্থির থাকা সম্ভব? নাহ সারাজীবনের জন্য এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকানোর সময় এসেছে। রাদিফ, বড়ো চাচিরাও হয়তো একই কাজ করবে৷ বাকি রইল ছোটো চাচা। তার পরিবার আর আর দিলওয়ার শেখের পরকীয়ার বউ বাচ্চাই হয়তো এ বাড়িতে রাজত্ব করবে বাকি জীবন। মানতে কষ্ট হলেও মানতে হবে। জীবন তো এটাই…
.
.
কিছুদিন পর,
মধ্যরাত। সূচনার পেইন ওঠে আচমকা। মাহের মাকে সঙ্গে করে সূচনাকে নিয়ে সরাসরি হসপিটাল চলে যায়। পথেই ফোন করে দেয় সূচনার বাবা আর রুদ্রকে। রুদ্র আসার পর পরই নার্স জানায় সূচনার ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান হয়েছে। এর পরমুহূর্তেই ভেতর থেকে সাদা তয়ালে পেঁচানো ধবধবে সাদা মুখের টকটকে লাল ছোট্ট গোল ঠোঁট, মাথা ভর্তি কুচকুচে ঘন চুলের বাচ্চাটিকে নিয়ে আসে। সদ্য দাদি হওয়া হামিদার কোলে তুলে দেয় উল্লসিত মুখে। দু’হাতে মুখের সমস্ত ঘাম মুছে নেয় মাহের৷ মুগ্ধ চোখে সদ্য জন্মানো নিজের অংশটুকুতে তাকিয়ে রয়। নার্সের উদ্দেশ্যে কাতর স্বরে প্রশ্ন তুলে,
-” ওর মা, ওর মা ঠিক আছে? আমার বউ। ”
নার্স প্রশস্ত হেসে জানায়,
-” একদম ঠিক আছে। কোনো চিন্তা করবেন না। ”
সূচনার বাবা, রুদ্রর চিন্তিত মুখে এক চিলতে হাসির দেখা মেলে। রুদ্র ঝটপট হৈমীকে ভিডিয়ো কল দেয়। দেখায় সূচনা, মাহেরের মেয়েকে। নিজের ছোটো বাচ্চা দু’টোর জন্যই হৈমী আসতে পারল না। ফোনেই বাচ্চা দেখল। খুশিতে গদগদ হয়ে মাহেরকে বলল,
-” এই ভাইয়া ওকে তো আমার ছোটোবেলার মতো লাগছে। ”
মাহের তৃপ্তি ভরে হাসল। বলল,
-” ফুপির মতো হবে এটাই তো স্বাভাবিক। ”
রুদ্র ঘোর বিরোধিতা জানালো,
-” না ঘুমানোর ফলে তোমার চোখে সমস্যা হচ্ছে হৈমী। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সূচনার ছোটোবেলার মুখ। বাবা, তুমি দেখছ তো? ”
রিদওয়ান শেখ নাতনির মুখের দিকে মমতা ভরে তাকিয়ে ছিলেন। রুদ্রর কথায় মাথা নাড়লেন। হৈমী নাক ফুলালো। রুদ্রর চোখে দুষ্টু হাসি। যা দেখে হৈমী ফুঁসে ওঠল। ভাইকে বলল,
-” ভাইয়া সত্যিটা তুমি বলো। ”
মাহের বলল,
-” কার মতো হলে তুমি খুশি? ”
হৈমী একটুক্ষণ ভেবে বলল,
-” তোমার আর ভাবির মতো। ”
মাহের আলতো হেসে বলল,
-” আমাদের মতোই হয়েছে হৈমী। তোমার, আমার মুখের আদল তো একই। বাবা, ফুপির আদলটাই পেয়েছে। ”
হামিদা ঠোঁট টিপে হাসলেন। আমাদের মানুষদের মাঝে এটা খুবই পরিচিত চিত্র। যখন কোনো নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসে। তার আপনজনেরা হুড়মুড়িয়ে লেগে পড়ে কার সঙ্গে তার ঠিক কী কী মিল রয়েছে। সদ্য জন্মানো শিশুটি ঠিক কার মতো হয়েছে? এই উত্তর মেলানো পরিবারের লোকদের জন্য যেন বাধ্যতামূলক।
চলবে…