এখানে বেলি ফুলের মালা-১৭
—————————
১৫ই ভাদ্র, সাল ১৯৯০
সময়টা বিকেলের। ভাদ্র মাসের তাল পাকা গরমে বাতাবরণ যেন সিদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুর জানালার ফাঁক ঠিকরে শোবার ঘরে শাহিদা খাতুনের ফর্সা,চামড়া কুচকে যাওয়া পা দুটোয় এসে পড়ছে। ফর্সা পায়ে রোদ্দুরের আলো যেন ঝলমলিয়ে উঠেছে। শাহিদা নাকে নেমে আসা চশমাখানা ঠিক করে আবারও সুপারী কাটায় মন দিলেন।
চাবির ঝনঝন শব্দ শাহিদা খাতুনের মনযোগ নষ্ট হলো। তিনি মুখ তুলে দেখলেন বিনী এগিয়ে আসছে। তার আঁচলে চাবির গোছা বাঁধা। বিনীকে দেখতে ঠিক যেন মনে হচ্ছে মৃন্ময়ী। শাহিদা খাতুন চোখ দুটো বুজে নিলেন। বিনীর পায়ে থাকা নূপুরের রুমঝুম শব্দ তার কানে আসছে। বুক থেকে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। আজ মৃন্ময়ীর কথা খুব মনে পড়ছে।
মৃন্ময়ী সম্পর্কের শাহিদা খাতুনের ছোটবেলার সখী ছিল। সেই দুই বছর থেকে চৌদ্দ বছর অব্দি দুজনের একসঙ্গেই বেড়ে উঠা। তারপর শাহিদা খাতুনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দুজনের বন্ধুত্বে কখনও চিড় ধরেনি। বিয়ের পরও হাজার বাধা বিপদ থাকা সত্ত্বেও শাহিদা মৃন্ময়ীর সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যান।
এরই মাঝে মৃন্ময়ীরও বিয়ে হয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার গর্ভে আসে আনিস। একদিকে মৃন্ময়ীর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছিল আরেক দিকে প্রিয় সখীর সংসারে ভাঙন ধরে। শাহিদা খাতুনের তিন বছরের সংসার কাচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায় কারণ তিনি পারেননি হাজার মারধর সহ্য করেও সংসার করে যেতে। একসময় স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে চলে আসেন বাপের বাড়ি।
সেই থেকে শাহিদা খাতুনের উপর নেমে আসে অমানসিক অত্যাচার। সবকিছু সহ্য করে তবুও ভাই ভাবির সংসারে বোঝার মতো পড়ে থাকেন। যেখানে ভাই আপন হলো না সেখানে ভাবি, পরের মেয়ে আপন হবে এই আশা করাই বোকামি।
অন্যদিকে মৃন্ময়ী জন্ম দিল এই পুত্র সন্তানের। কিন্তু অল্প বয়সে গর্ভ ধারণ করায় বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেনি। আনিসের যখন এক মাস ঠিক সেই রাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। আজাদ সাহেব যেন স্ত্রীর প্রয়াতে ভেঙে পড়লেন। ছেলে সামলাবেন না নিজেকে। বাধ্য হয়ে শাহিদাই এগিয়ে এলেন নিজের সখীর শেষ স্মৃতিকে আগলে নিতে।
এইদিকে এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন শাহিদার ভাই,ভাবি। তারা সুযোগ বুঝে আনিসের বাহানা দিয়ে আজাদ সাহেবের সঙ্গে শাহিদা খাতুনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। আজাদ সাহেবও ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃন্ময়ীর শেষ কথা রাখতে বিয়ের পিড়িতে বসে পড়লেন কিন্তু শাহিদা খাতুনকে স্ত্রী বিনা প্রেয়সী রুপে কোনওদিন মেনে নিতে পারলেন না।
স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছুদিন পরই ছেলের আরেক বিয়েটা মেনে নিতে পড়লেন আজাদ সাহেবের মা। তিনি শুরু করলেন শাহিদার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার। তবে এসব অভ্যস্ত শাহিদা বুঝতে পারলেন তার শাশুড়ি মা ছেলের প্রথম স্ত্রীয়ের মৃত্যু আর ছেলের বিয়ে কোনোটাই মেনে নিতে পারেননি। কারণ দিনশেষে ভালোবেসে তো মৃন্ময়ীকেই ছেলের বউ করে এনেছিলেন তিনি। সেই থেকে তিনি সবটা সহ্য করেই চলেছেন। আজাদ সাহেব তাকে প্রেয়সী রূপে মানতে না পারলেও স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। তাই হয়তো মায়ের অমন দুর্ব্যবহারে শাহিদার হয়ে কথা বলতেন।
সেসবের পর আজ অনেক বছর কেটেছে। আজাদ সাহেবের মা মারা গেছেন মৃন্ময়ীকে মনে রেখেই। শাহিদাকে কোনওদিন তিনি তার ছেলের বউ রুপে মেনে নেননি। কিন্তু শাহিদার তাতে কোনো আপত্তি নেই। আজাদ সাহেবের বাবা যিনি মৃন্ময়ীকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন তিনি মৃন্ময়ীর সখী অর্থাৎ ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রীকেও সমান ভালোবেসেছেন। মৃণ্ময়ী আর শাহিদা দুজনেই ছিলেন তার খুব আদরের।
শাহিদা যেমন আজাদ সাহেবের স্ত্রী হয়ে অনেক ভালোবাসা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য পেয়েছেন তেমনই মৃন্ময়ীকে হারানোর যন্ত্রণাও সহ্য করেছেন। যেই সখীর সঙ্গে তিনি ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছেন, যার ছেলেকে নিজ হাতে পেলে বড় করেছেন তাকে সঙ্গে নিয়ে এই সুন্দর স্মৃতিগুলো সাজাতে না পারার যন্ত্রণাও সহ্য করেছেন তিনি। মৃন্ময়ী ছিল তার কাছে স্বার্থপর পৃথিবীর স্বার্থহীন একজন। তাকে ভোলা আদো জীবনে সম্ভব না শাহিদার পক্ষে।
যেই মৃন্ময়ীকে সেই শেষবার তার মৃত্যুর আগে দেখেছিলেন শাহিদা তাকেই কেন আজ আবারও দেখলেন, ঠিক বিনীর রুপে। সেই একই রকম করে শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা বেধে চঞ্চল পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। চির প্রিয় সখীকে বিনীর মাঝে পেয়ে মুগ্ধ হয়ে ছে রইলেন তিনি।
শাহিদা খাতুনকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিনী এগিয়ে এলো। শাহিদা খাতুনের হাত থেকে সুপারী কাটা নিয়ে নিজেই সুপারী কাটতে শুরু করলো। বিনীর হাতের স্পর্শে শাহিদা খাতুনের ঘোর ভাঙলো। অবাক হয়ে বললেন ‘ তুমি এই সময় এখানে কিল্লেগা ? সারাদিন কাম সাইরা ঘরে শুইবাই না। তুমি ঘরে না শুইয়া এইখানে কি করো ? ‘
বিনী সুপারী কাটতে কাটতে বললো ‘ এমনই, ইচ্ছে করলো শুতে। ভাবলাম আপনার কাছে এসে দেখি আপনি কি করেন। আচ্ছা আম্মা আমরা যাকে ভালবাসি তাকে কেন পাইনা আর যাকে কখনও ভালোবাসিনি তাকে কেন অবলীলায় পেয়ে যাই ? ‘
শাহিদা খাতুনকে এই প্রথম যেন হাসতে দেখলো বিনী। তিনি হাসছেন, হ্যাঁ তিনি হাসছেন বিনীর কথায়। বিনীর কথায় হাসতে হাসতেই বললেন ‘ কে বলেছে আমরা যাকে ভালবাসি তাকে পাই না। ভালোবাসা ভাগ্যের লিখন। আর ভাগ্য নির্ণয় হয় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে। আমাদের উচিত যারা আসলেই আমাদের সঙ্গী তাদের ভালোবাসা।
কিন্তু মানুষ হলো এমন এক জাতি যার নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই টান আর কৌতূহল,ভালো লাগা বেশি। তাই আমরা যে আমাদের সঙ্গী তাকে ভালোবাসতে পারিনা আর যে আমাদের জন্য নয় তাকেই ভালোবাসি। কথাটা এমন যে যেই মানুষটা আমাদের নয় আমরা তাকেই নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলি, তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে আমাদের মনে আর যে প্রকৃত পক্ষে আমাদের তাকে আমরা ভালবাসিনা, তাকে পাওয়ার কোনো ইচ্ছা রাখিনা। তাই আমাদের মনে হয় আমরা যাকে ভালবাসি তাকে পাইনা আর যাকে ভালবাসি না তাকে পেয়ে যাই। বুঝলে ?’
বিনী মাথা নেড়ে সায় দিল। মনে মনে বললো ‘ যে আমার নয়, যাকে পাওয়ার আমার কোনো অধিকার নেই দিন শেষে আমি তাকেই ভালোবেসেছি। এই কি ভাগ্যের পরিহাস ? অথচ যার আমার উপর সবথেকে বেশি অধিকার তাকে এখন পর্যন্ত তার প্রাপ্য দিতে পারিনি। ‘
—-
একলা ঘরে হলদে বাতির টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আছেন আজাদ সাহেব। শরীরটা ইদানিং তার ভালো লাগছে না। অল্পতেই ঘেমে উঠছেন। কে জানে কেন এমন হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাপারে কিছু জানিয়ে পরিবারের সবাইকে বিপদে ফেলে দিতে চাচ্ছেন না তিনি। তাই আপাতত এই ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।
কানে আসছে নূপুরের রুমঝুম শব্দ। আজাদ সাহেব মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনছেন সেই সুর। সুর যেন তাকে কাছ ডাকছে। অনুভব করছেন সুরের মুগ্ধতা নিস্তব্ধ এই প্রহরে। টেবিলের উপর থাকা রেডিওতে বাজছে হেমন্ত কুমার খ্যাত ‘ এই রাত তোমার আমার ‘ গানের সুর। আজাদ সাহেব সেই সুরও শুনছেন সঙ্গে উপভোগ করছেন নূপুর নৃত্য।
‘ আজাদ ‘
নারী কন্ঠের ডাকে চোখ দুটো খুললেন আজাদ সাহেব। আবছা চোখে দেখলেন সামনে দাড়িয়ে আছে এক নারী অবয়ব। হলদে বাতির আলোয় চোখে সয়ে আসতেই সামনে দাড়িয়ে থাকা নারী অবয়ব পরিষ্কার হয়ে এলো। সামনে দাড়িয়ে আছে চায়ের কাপ হাতে মৃন্ময়ী। আজাদ সাহেব মৃন্ময়ীকে দেখে হাসলেন। দাড়িয়ে থাকা মানুষটা আদৌ সত্য নাকি শুধুই দৃষ্টির ভ্রম বোঝার উপায় নেই।
দুই চোখ ভরে মৃন্ময়ীকে দেখেই যাচ্ছেন আজাদ সাহেব। তাকে দেখতে দেখতেই আজাদ সাহেবের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। দূর্বল হাতে চোখ দুটো মুছে নিলেন তিনি। মৃন্ময়ী এখনও কোমল হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজাদ সাহেব রাগ হলেন। শক্ত কণ্ঠে সুধালেন ‘ কেন এসেছ তুমি ? ‘
আজাদ সাহেবের শক্ত কণ্ঠে শুনে মৃন্ময়ীর মুখভঙ্গি অসহায় হলো। সে কাতর চোখে আজাদ সাহেবের দিকে তাকালো। কোমল গলায় বললো ‘ তোমাকে নিতে এসেছি। ‘
‘ বেশি দেরি করে ফেললে না ? ‘
‘ কিছু কিছু মানুষদের সঙ্গে আমাদের দূরত্বই এত বেশি থাকে যে সেই দূরত্ব মিটিয়ে কাছে আসতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। তোমার আর আমার মধ্যে দূরত্ব ওই সুদূর আকাশের সমান। দিনের আলো পেরিয়ে রাত নামতে যত সময় লাগলে আমাদের মধ্যে দূরত্ব পেরিয়ে কাছে তারও বেশি সময় লাগে। ‘
মৃন্ময়ীর কথায় আজাদ সাহেব কিছু বললেন না। তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ এভাবেই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রেখে একসময় আজাদ সাহেব পাশ ফিরলেন। দেখলেন মৃন্ময়ী তার পাশেই এক চেয়ারে বসে আছে। তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়েও আছে। আজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন ‘ এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে জানতে পারি ? ‘
মৃন্ময়ী হাসলো। আরামে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে বললো ‘ আপনাকে দেখার তৃষ্ণা মিটাই। ‘
আজাদ সাহেবও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। মৃন্ময়ীর হাতে হাত রাখলেন। মৃন্ময়ী বললো ‘ এই হাত কোনওদিন ছুটবে না। ‘ আজাদ হাসলেন। চোখ বুজে সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। আজ যেন পাষাণ হৃদয়ের ভার নেমে গেছে। মনটা হালকা লাগছে। চোখ জুড়ে ঘুম নেমেছে। ইচ্ছে করছে একটু ঘুমোতে। শান্তির ঘুম ঘুমোতে চান তিনি। যেই ঘুম ভেংগে মৃন্ময়ীকে হারানোর কোনো ভয় নেই। মৃদু গলায় শেষবার তার মৃন্ময়ীকে ডেকে চোখ দুটো বুজলেন।
” মৃন্ময়ী তোমার জন্য লিখিব
হাজার বিরহের গান,
যখন কলা পাতায়
বাঁধিবো মোর পরান।। ”
—-
রুনার মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার খবরে দোকান ফেলে ছুটছে সরাব। চিন্তায় তার মাথাটা ভার হয়ে এসেছে। রুনার হঠাৎ কি হলো যে এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো ? খাওয়া দাওয়া কি করে না ঠিক মতো ? কিন্তু রুনা তো রোজ তার সামনে বসেই খায় আর সে নিজেই তো ওকে বেশি করে ভাত দেয়। তাহলে ? কোনো রোগ বাঁধিয়ে বসলো নাতো রুনার শরীরে।
চিন্তায় পুরোটা রাস্তা এক প্রকার ছুটে এলো সরাব । ছুটতে ছুটতে বাড়ির কাছে এসে দাড়িয়ে পড়লো। হাঁটুতে হাত রেখে হাপাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে নিজের অনিয়ন্ত্রিত নিশ্বাস নিয়ন্ত্রণে আনলো। তারপর এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। কিন্তু বাড়ির দরজার সামনে এসে দাড়াতেই পাশের বাড়ির রুমা খালার মা আর নূরজাহানের দেখা পেলো সে।
রুমা খালার মা সরাবকে দেখে বললেন ‘ মিষ্টি খাওয়াও ছেলে। এত বড় একটা সুখবর, মিষ্টি না খেয়ে তো আমি যাচ্ছি না। পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিলানো দরকার। আমার বিশ্বাসই হয় না এই ছেলেরে নাকি কালই বাচ্চা দেখছিলাম আর আজ আরেক বাচ্চার বাপ হয়ে গেলো। ‘
মহিলার কথার মানে কিছুই বুঝল না সরাব। অবাক গলায় সে জিজ্ঞেস করলো ‘ মানে ? আরেক বাচ্চার বাবা কে ? ‘
‘ ওই দেখো, ছেলে বলে কি। আরে বাবা বিয়া যখন করছো তখন বাচ্চার বাপ তো হইবাই। তোমার বউ তো পোয়াতি। ‘
রুনার খবর পেয়ে সরাব চমকালো না। সে স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে দেখলো রুনা মন মরা হয়ে উঠান থেকে তুলে আনা কাপড় গুছাচ্ছে। রুনাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। রুনা কাজেকর্মে থেকে লক্ষ্য করেনি সরাবের আগমন। সে আপন মনে কাজ করছে।
রাত তখন এগারোটা। বাহিরে চলছে মৃদু হাওয়ার তোড়। রুনা হারিকেন নিভিয়ে কুপি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছে সরাবের জন্য। ঠিক অপেক্ষাও যে করছে তানা। সে তার সময় কাটাচ্ছে রসায়ন পড়ে। অপেক্ষার প্রহর তার দীর্ঘ সময়ের। নূরজাহান খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছেন।
সরাব যখন ফিরলো তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। সে ফিরেই দেখলো রুনা রান্নাঘরে তরকারি জাল করছে। তাই সে আর রুনাকে কিছু বললো না। সোজা হাতে থাকা পলিথিনখানা রুনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে জামা কাপড় বদলাতে গেলো। রুনা খানিকটা অবাক হলো সরাব হঠাৎ কি আনলো এই ভেবে। তাই সে কৌতুহল মেটাতে পলিথিনখানা খুললো।
পলিথিন খুলতেই রুনার চোখ দুটো খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সরাব ততক্ষণে জামা কাপড় বদলে এসে হাজির হয়েছে। রুনাকে হাসতে দেখে বললো ‘ মন ভালো হয়েছে তোর ? ‘
রুনা খুশি হয়ে বললো ‘ তুমি কি করে জানলে আমার তেতুঁল খেতে ইচ্ছা করছিলো ? ‘
‘ আমি এমন অনেক কিছুই জানি যা তুই জানিস না। ‘ বলতে বলতে সরাব মুখে ভাতের লোকমা তুললো।
‘ আচ্ছা তুমি খুশি তো ? ‘
‘ কিসের জন্য ? ‘
‘ এইযে আমরা মা বাবা হচ্ছি। তুমি নিশ্চই ভাবতে পারনি আমরা এত তাড়াতাড়ি মা বাবা হবো। তুমি কি রেগে আছো ? যে এখন আমি আর পড়াশোনা করবো না ঠিক মতো। বিশ্বাস করো আমি মোটেই পড়াশোনায় ঢিলেমি করবো না। তুমি যা বলবে তাই করবো। ‘
রুনার কথায় কি বলবে বা কি বলা উচিত বুঝতে পড়লো না সরাব। মুখ তুলে রুনার দিকে চেয়ে খানিকটা অপ্রস্তুত গলায় বলল ‘ না মানে আমার কি বলা উচিত আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় প্রথমবার বলেই এরকম ভাষাহীন অনুভূতি হচ্ছে। কোনো ব্যাপার না। সেকেন্ড টাইম অভ্যস্ত হয়ে গেলে তখন জানাবো আমার কেমন লাগছে। ‘
সরাবের কথায় বড় বড় চোখ করে তাকালেন রুনা। সে সরাবের দিকে তাকিয়ে পাতে ভাত নিচ্ছিল। সরাবের কথা শুনে তার হাত থেকে ভাত পড়ে গেছে। সে ভাত তুলতে তুলতে সরাব বললো ‘ কিন্তু আমার মনে হয় জিনিসটা সুন্দর। আমি বাবা হবো, তুই মা হবি। আমাদের একটা মেয়ে হবে। আচ্ছা মেয়ের নাম কি রাখবো ? রুসা ? ভালো নাম, তোর আর আমার নাম মিলিয়ে। ‘
সরাবের কথায় মুখ তুলে তাকালো রুনা। তার অধর কোণে টুকরো হাসি। সরাব স্মিত হেসে রুনার দিকে ওর হাতটা এগিয়ে দিল। আলতো ছুঁয়ে ভাতের দানা সরিয়ে নিলো রুনার ঠোঁটের কোণ থেকে। রুনা খিলখিল করে হেসে উঠলো। ওকে হাসতে দেখে সরাব মুগ্ধ হলো। বিড়বিড় করে বললো ‘ পেরেছি, আমি পেরেছি রুনা। তোকে আমি ভালোবাসতে পেরেছি। ‘
—-
সেলাই মেশিনে শাড়ির ব্লাউজ সিলাই করছেন জাহানারা। নতুন একটা শাড়ি পেয়েছেন শাহরিয়ারের কাছ থেকে। গত পরশুদিন এসে শাহরিয়া নিজ হাতে বাড়ির সবার জন্য নতুন জামা কাপড় দিয়ে গেছে। সঙ্গে জাবিয়া আসেনি। জাহানারা প্রথমে ব্যাপারটা আমলে না নিলেও এখন উনি বেশ বুঝতে পারছেন মেয়ে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
একজন মায়ের কাছে সন্তানের অবহেলা যে ঠিক কতটা হৃদয় বিদারক সেটা শুধু যেই মা অবহেলা পেয়েছে সেই জানে। জাবিয়া তার অনেক আদরের সন্তান। ভেবেছিলেন প্রথম প্রথম এরকম করলেও বিয়ের পরে আস্তে আস্তে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তার ধারণা পুরোটাই ভুল। জাবিয়ার বিয়ের ইতিমধ্যে চার মাস পেরিয়েছে কিন্তু বিয়ের পর এই পর্যন্ত একদিনও মেয়ে তাকে নিজ থেকে ফোন করে কোনো খোঁজ নেয়নি।
বিয়ের পরে জাবিয়া শাহরিয়ারের সঙ্গে নিয়ম রক্ষার্থে একদিন অবশ্য এসেছিল। কিন্তু একদিন পার হতেই সে আজমল সাহেবকে একা ওই বাড়িতে রেখে ভালো লাগছে না অজুহাতে ফিরে গেছে। জাহানারা ভেবেছিলেন মেয়ে হয়তো মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বুঝেননি মেয়ে আসলে মানিয়ে নেয়নি, তার কাছ থেকে দিনে দিনে দূরে সরে গিয়েছে।
জাহানারা বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে জাবিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। তবে জাবিয়া প্রতিবারই দুই মিনিট কথা বলেই কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোনটা আজমল সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এড়িয়ে গেছে জাহানারাকে। জাবিয়ার এই মৌনতা, কথা বলতে চেয়েও কথা না বলা জাহানারাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে। এতটাই কষ্ট দিচ্ছে যে বলে বোঝানো যাবে না।
মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই অজান্তে আঙ্গুলের উপর দিয়ে সেলাই মেশিন চালিয়ে দিলেন জাহানারা। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ। আঙ্গুল দ্রুত সরিয়ে নিলেন। আঙ্গুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আঙ্গুলটা মুখে চেপে ধরলেন জাহানারা। তার চোখে ভিড় করেছে অশ্রুরা। মনে পড়ছে আদরের মেয়ের কথা।
বিয়ের আগে দিয়ে জাবিয়া পাগলের মত জাহানারার পা ধরে কেঁদেছিল যেন তাকে শাহরিয়ারের সঙ্গে বিয়ে না দেয়। কিন্তু জাহানারা স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দিয়েছিলেন উনি কখনোই তুষারকে মেনে নিবেন না। বাধ্য হয়েই অভিমানী মন নিয়েই বিয়ে করে পাড়ি জমিয়েছে শশুর বাড়িতে।
যেদিন জাবিয়ার বিয়ে হলো সেদিন শুধু জাবিয়ার সঙ্গে জাহানারার সম্পর্ক খারাপ হয়নি, সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে তিন তিনটে জীবন। শাহরিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। ঘরে জাবিয়া বিছানা করে শুয়ে পড়েছে। জাবিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো তারা সংসারও করছে কিন্তু তাদের মধ্যে মনের মিলটা আর হয়নি। তাদের দেখলে সকলে বাহবা করে কিন্তু বাহিরে দিয়ে তাদের সম্পর্ক যতটা সুন্দর ভিতর দিয়ে ঠিক ততটাই ফাঁকা।
~চলবে ইনশাল্লাহ্….