#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#পর্ব_১৫
লেখনীতে #পুষ্পিতা_প্রিমা
একটা মাঝারি সাইজের সাদা কাগজের বিরিয়ানির প্যাকেট এনে ঘরের টেবিলের উপর রেখে বারান্দায় গিয়ে রমিজ মিয়া দেখলেন, কনকনে শীতের ভেতর তানজীব বসে রয়েছে চেয়ারে গা এলিয়ে। তার চোখজোড়া বন্ধ। মাথাটা হেলানো। পাশের বিল্ডিংয়ে কবির চেয়ারম্যান স্বপরিবার নিয়ে উঠেছে সেটা একবার বাবুকে বলবে কি? না থাক, এখন মাথা গরম। কালই তো চলে যাবে। বলার কি দরকার?
উনার পায়ের আওয়াজের শব্দ কানে পৌঁছেছে তানজীবের। দুচোখের মধ্যবর্তী স্থানে আঙুল চেপে নড়েচড়ে বসে বলল
খেয়েছেন কাকা?
খায়নাই বাবু। তোমার লাগি বিরিয়ানি আনছি। খাইয়্যা ঘুমায় পড়ো। না খায় থাকলে তো শরীর খারাপ করবো বাবু।
আপনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। কোন ঘরে থাকবেন?
রমিজ মিয়া মাথা নিচু করে রাখলেন।
মাডিত পাডি বিছায় থাকুম বাবু। তোমার সমস্যা হইবো?
না। পাটি লাগবে না । আপনি খাটে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার সমস্যা হবে না।
না না আল্লাহ ইটা হয়না।
কেন হয় না? আচ্ছা আপনার যেমন ইচ্ছা। এ নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। যান খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
তুমিও আসো বাবু। একসাথে খাইলে ভালো লাগবো।
আপনি যান। আমি আসছি।
আইচ্ছা।
মাথা দুলিয়ে তিনি চলে গেলেন।
রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় সময় হঠাৎ অধীরের ফোন। সে কেন ফোন করলো? ফোন তোলার পর অধীর জানালো বড় জেঠুকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। বুকের ব্যাথা বেড়েছে। বাড়ির সবাই ওখানে। অধীরও যাচ্ছে।
তানজীবের আর ঘুমানো হলো না। অবস্থা খুবই গুরুতর না হলেও তানজীবের যাওয়া উচিত। সম্পর্কের খাতিরে, আত্মার টানে, এতগুলো বছর আগলে রাখর দরুন। একটা দায়িত্ব তো থেকেই যায়। তার জন্য কি এই অবস্থা জেঠুর?
হসপিটালে পৌঁছুতে তার দেরী হয়নি। বাড়ির সবাই তাকে দেখে চুপ করে ছিল। মিনা আর সানজু এককোণায় দাঁড়িয়েছিল। তানজীবকে দেখে মিনা দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরলো। বলল
তুমি জেঠুকে কষ্ট দিলে কেন?
হ্যা,এখন সব আমার দোষ।
সানজু ঘনঘন চোখ মুছছিল। আর রাগে দুঃখে কেঁদে কেঁদে উঠছিল তখন। ছোট থেকেই যাকে ভাই ডেকে এসেছে। ভাই বলে চিনে এসেছে তাকে নিয়ে সবার মাথায় এই চিন্তা ছিল?
লজ্জায়,কুন্ঠায় তার মাটি ছিঁড়ে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে।
রাহান এসে জানালো অবস্থা তেমন গুরুতর নয়। বাসায় নিয়ে যেতে পারবে। টেনশনের কারণে এমনটা হয়েছে। তবে টেনশনের মধ্যে থাকলে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। তানজীবকে দেখে জিজ্ঞেস করলো
তুই আব্বার সাথে দেখা করবি? নাকি চলে যাবি?
তানজীব উত্তর না দিয়ে গেল দেখা করতে। সেলিম সাহেবের মুখ অন্যদিকে ফেরানো ছিল। তানজীব ঢুকতেই তিনি গলা ফিরালেন। চোখের কোণায় জ্বলজ্বলে জলকণা।
তুই কি বিয়েটা করবি না?
নাহ।
ঠিক আছে।
ভালো থেকো। ভালো কোনো ছেলে পেলে সানজুকে বিয়ে দিয়ে দিও। নইলো পড়ুক। ওর বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়নি।
ওর চিন্তা করার অনেক মানুষ আছে। নিজের চিন্তা কর।
নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা বাদ দিয়েছি। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। ১০ তারিখ আমার ফ্লাইট। আসি।
তানজীব দরজার কাছে যেতেই সেলিম সাহেবের প্রশ্নে দাঁড়িয়ে পড়লো
কোথায় যাচ্ছিস?
ইউএস।
ফিরে আয়।
তানজীব বেরিয়ে পড়লো।
মনোয়ারা বেগম পথ আটকে বললেন
বাড়ি যাবিনা বাবা?
নাহ। আমাকে নিয়ে অত ভেবোনা। জেঠুকে দেখো। আর মিনিকে। আমার বোনের মত ছেলের বউ তুমি কোথাও পেতে না। দোষ করলে শিখিয়ে পড়িয়ে দিও, তোমাদের তো দিয়েই দিলাম। একেবারে।
বোরকার ওড়নায় মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন তিনি। মিনার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তানজীব। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল
ভালো থাকিস হ্যা? নিজের যত্ন নিস। টেনশন করলে তোর বাচ্চার ক্ষতি হবে। কোনো চিন্তা নয়, কোনো কান্না নয়। আসি।
তারপর সানজুকে মাথায় হাত চেপে চেপে বলল
এদের একটু জ্ঞান দিস। তোর আপাকে দেখে রাখিস।
তুমি আমার উপর রেগে আছ?
আমি কারো উপর রেগে নেই। বরঞ্চ সবাই আমার উপর রেগে আছে। মন দিয়ে পড়। অনেক বড় হ। আসি। মণি সবাইকে দেখে রেখো।
খানসা বেগম গাল মুছতে মুছতে বলল
কবে ফিরবি তুই?
জানিনা।
সবাইকে একপলক দেখে তিনতলা থেকে নেমে রাস্তায় চলে এল সে।
ফোন কানে এদিকওদিক তাকাতেই অতর্কিতে হাসপাতালের কোয়ার্টারের ছাদ থেকে কোনো নারীর অবয়ব দেখে চমকে গেল সে।
সন্ধ্যার পরে জাহানারা বেগমকে রিলিজ দেওয়ার কথা ছিল। মাগরিবের কিছু পরেই আশরাফের সাথে হসপিটালে এসেছে রাহা। অধীরও আসায় জানতে পারলো মিনার বড় জেঠুকেও এখানে এডমিট করা হয়েছে। সবার অগোচরে কেবিনটা খুঁজছিল সে। যদি মিনার সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে মেজরের কন্ট্রাক্ট নাম্বারটা চেয়ে নেবে সে। কিন্তু সরাসরি মেজরের সাথে দেখা হয়ে যাবে এটা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি সে। পা জোড়া ঠকঠক করে কেঁপে উঠেছে অনেকটা দূরের সেই বহুলপরিচিত লোকটার চোখে চোখ পড়ায়। অতদূর পৌঁছুতে পৌঁছুতে উনি কি চলে যাবেন?
এমনিতেই মেজাজ খারাপ ছিল তানজীবের। তারউপর এই মেয়েকে দেখে মাথা তিনগুণ খারাপ হলো। সব নিমকহারাম জুটে তার সাথে। তাকে বুঝার মতো একটা মানুষও কি এই গোটা পৃথিবীতে নেই? স্বার্থপর দুনিয়া। দুনিয়ার মানুষ। তার আর কাউকে লাগবে না। এখন নিজের নিজেকেই বেশি দরকার।
গাড়িতে উঠে হন্যি হয়ে ছুটলো সে। রাহা নেমে আসতে আসতে গাড়ি ততক্ষণে পগারপার। ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সর্বশক্তি দিয়ে সরবহীন তর্জন-গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠলো রাহা। ওড়না দিয়ে চেপে ধরে রাখলো মুখ। হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠতেই কাঁপলো তার সারা তনু। দূর থেকে অধীর অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রাহার দিকে। নোরাহও অধীরের পেছন পেছন এসে দাঁড়িয়েছিল তখন।
____________________
জাহানারা বেগম সুস্থ বোধ করায় আমজাদ কবির ভাবলেন গ্রামে ফেরা যাক। অন্যদিকে রোস্তমের বাড়ির লোকজনও তাড়া দিচ্ছে উনাদের সিদ্ধান্ত জানাতে। মেয়ে ছেলে পছন্দ হওয়ার ব্যাপারটা যেহেতু মিটলো বাকি কথা সেড়ে নেওয়া যাক ধীরেধীরে। কিন্তু বাসা ছেড়ে দেওয়ার আগের দিন খবর এল রোস্তমের বড় বোন রাহাকে দেখবে। তারপর বাকি কথা। ভাইয়ের কেমন মেয়ে পছন্দ হয়েছে সেটা বোন সামনাসামনি এসে দেখে যেতে চান। বড় ভাইও পছন্দ করে বিয়ে করেছে । এখন
কি হলো? মহাবজ্জাত, একগুঁয়ে মেয়ে। ছোট ভাইকে উনি দেখেশুনে ভালো মেয়ে বিয়ে করাবেন।
রাহা নোরার শ্বশুরবাড়িতে ছিল তখন। মা ফোন করে ওসব বলায় সে নোরার সাথে রাগারাগি করলো। নোরাহ শেষমেশ বুঝিয়ে শান্ত করালো। অধীর বলেছে এখন যাইহোক মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে তাকে।
রাহাকে শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে গুঁজিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে নোরাহ এমন কথা ছিল। রোহিনীও সাহায্য করলো তাদের। রাহার ওসব পছন্দ হলো না। সবুজ শাড়িটা পড়ে বরাবরের মতো শক্ত মজবুত করে বেণী করে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে রইলো সে।
নোরাহ ছোট ছোট সাদা দুল পড়িয়ে দিল কানে। হাতে শাড়ির সাথে মিলে চুড়ি পড়িয়ে দিল। রাহার চেঁচানোর কারণে মুখে প্রসাধনীটুকু মাখতে পারলো না সে। মেয়েটা আজকাল ভারী পাজি হয়েছে। ছোটবেলায় সাজিয়ে দিলে আয়না দেখে দেখে জিজ্ঞেস করতো দেখতো আপা সুন্দর লাগছে কিনা। আর এখন….
চোখ থেকে টুপটাপ পানি গড়াতে গড়াতে নাকমুখ লাল করে ফেলল রাহা । সে ভাবতেও পারেনা রোস্তম শিকদার তার স্বামী। জীবন সাথী হবে। পরিণত হওয়ার পর থেকে সে তো শুধু ভেবে এসেছে একজনকে। কি করে ভুলা সম্ভব? এ হয় না। হতে পারেনা।
সে যে “তার” না হওয়া বউ!!
নোরার অকারণেই হাসি পেল। তার মিটমিট হাসি দেখে অধীরও হাসলো ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে।
রাহা ওদের হাসি দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। কাঁধের কাছ থেকে শাড়ির পিন ছাড়িয়ে নিয়ে হাতে গেঁথে দিল জোরে।
নোরাহ পিনটা কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল
কি করলি? আমরা তোর ভালো করতে যাচ্ছিলাম। কি কাজ বাড়িয়ে দিলি? এখন মেজর আমাদের জেলে ঢুকাবে।
জ্বালা যন্ত্রণায় রাহা কেঁদে উঠলো ঠোঁট চেপে। অধীর বলল
এত রাগ বাবা! সো স্যাড ফর মেজর!
_______________
নাইট ভিশন গগলস,ব্যালিস্টিকহেলমেট,বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিহিত সেনা অফিসারের সামনে বিশ পঁচিশজনের মতো তরুণ সৈনিক। পা ঠুকে হাত কপালের একপাশে ঠেকিয়ে অফিসারের দেয়া পরামর্শ আর উপদেশ মেনে একসাথে সবাই সশব্দে মেতে উঠলো
ইয়েস স্যার। উ’ইল রিমেম্বার।
সেনা অফিসারের হাতে বিশালাকৃতির রাইফেল। হেলমেট পরিহিত থাকায় উনার জ্বলন্ত ক্ষুরধার চোখদুটো স্পষ্ট। যেখানে গা ছমছমে নির্মমতা,কাঠিন্যেতা। যে চোখের চাহনিতে বুকের রক্ত হিম করে দেওয়ার মতো বুকে কম্পন ধরে সৈনিকদের।
রাত দশটা। সন্ধ্যে সন্ধ্যে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বড় ধরণের একটি অস্ত্রপাচারকারীদের বিছিয়ে রাখা চক্রজালে ধ্বংসলীলা চালিয়ে এসেছে তারা। খুবই ভয়ংকর হলেও একজন প্যারা স্পেশাল ফোর্সের অধিনায়কের কাছে এমন একটি মিশন খুবই নগন্য। যেখানে শান্তিরক্ষা মিশনে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন মেজর। সেখানে এই ছোটখাটো মিশনে উনার উপস্থিতি আর সঙ্গ পেয়ে খুবই চতুরতার সাথে শত্রুপক্ষকে হারিয়ে দেওয়ার বিষয়টি থেকে নবীন সৈনিক যা অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল তাতে তারা বুঝেছিল শত্রুপক্ষ যতই নগন্য হোক না কেন, তাদের দুর্বল ভাবা যাবে না।
যেমন বলা যেতে পারে, শার্প শুটার দক্ষ অফিসারদের কাছে ছোট্ট পিস্তলটি যেমন খেলনার বস্তু তেমনি অন্যদিকে সেটি জীবননাশক যন্ত্র।
কুয়াশায় ততক্ষণে ঢাকা পড়েছে দূরের উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো। বন্য হিংস্র জন্তু আর খেঁকশিয়ালের ডাকে, গর্জন-তর্জনে পরিবেশ ভয়ানক, ত্রাসজনক। নত হয়ে থাকা তাবুগুলোতে মিটমিট করে আলো জ্বলছে। টহলরত সৈনিকরা এত ভারী পোশাক গায়েও কাঁপছে ঠকঠক করে। জমে যাচ্ছে তাদের দাঁতে দাঁত । যত রাত বাড়ছে ততই শীত বাড়ছে।
গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য কর্নেলের সাথে দেখা করতে চট্টগ্রাম ক্যাম্পে এসেছিল মেজর। সেখানে আরও একটি অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। সবার থেকে দূরের শিশিরভেজা উঁচু ঢিবিতে গিয়ে বসলেন তিনি। গায়ের ভারী পোশাকের কারণে ভেতরে উষ্ণতাও উনাকে স্বস্তি দিচ্ছে না।
সিগারেটের নেশা চড়েছে মাথায়। গগলস খুলে দূরের আকাশে তাকিয়ে যেই না হেলমেট খুলতে যাবেন ঠিক তখনি সৈনিকদের জলপাইরঙা ট্রাক এসে থামলো। সারি সারি সৈনিক নামতে লাগলো ঝুপঝাপ।
মেজর! মেজর!
নিজের পদবী নিয়ে হাঁক-ডাক হৈ হুল্লোড় শুনতেই ঘাড় ঘুরালেন তিনি। সিগারেটের নেশায় বুদ হয়ে থাকা মেজর বিরক্তিকর দৃষ্টিতে পেছনে তাকাতেই দেখলেন এই কুয়াশামাখা পাহাড়ের বুকে আবছা রাতের আঁধারে সবুজ শাড়ি পরিহিতা এক নারী অবয়ব দ্বিধাহীন এগিয়ে আসছে তার দিকে। ছুটছে শ্বাস না ফেলে। গা থেকে কালো কারুকাজের শীতের চাদর খসে পড়ে গেল। পায়ের একপাটি জুতো অন্যদিকে ছুটে গেল। মেয়েটি এই উঁচুনিচু পাহাড়ি মাটিতে হোঁচট খেয়ে পড়লো আবার উঠে দাঁড়ালো।
তিমিরাচ্ছন্ন মেজরের মনে একফালি রৌদ্দুরের দেখা মিললো যেন। এ যেন বিশ্বাস হওয়ার নয়।
জেগে জেগে কি স্বপ্ন দেখছেন উনি? এ অসম্ভব। পরক্ষণে ভেতরের শক্ত কঠোর অভিমানী মানবটির
ভেতরে হনহন করে জ্বলে উঠলো ক্ষোভের আগুন। দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো ভেতরটা। ঠান্ডায় জমে যাওয়া নারী শরীরটি ততক্ষণে তার খুবই কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কেঁদে উঠে, কেঁপে উঠে ভয়ে ভয়ে শীর্ণ গলায় কোমলমতি নারী নরম হাত রাখলো ভেস্ট পরিহিত মেজরের বুকের বাম পাশটাই। মোটা বুলেটপ্রুভ ভেস্ট চাপিয়ে সেই কোমল হাতের উষ্ণতা যেন গিয়ে ছুঁলো মেজরের বরফকঠিন হৃদয়।
কেঁপে উঠলেন কি তিনি মানবীর ডুকরে উঠা জিজ্ঞাসিত প্রশ্নে?
আপনি আমার মেজর?
যদিও ওদুচোখ ভীষণ চেনা মানবীর। তারপরও গলার আওয়াজ শোনার দরুণ এই প্রশ্ন। ব্যালিস্টিক হেলমেট খুলে নিতেই মানবীর সামনে উদ্ভাসিত হলো সুকুমার মুখখানা। ডহর চোখদুটো এখন আরও স্পষ্ট। কত মায়া সেখানে প্রাণোর প্রতি। ওই ভাষা না বুঝার কিছু নেই।
তারপর আর দেরী হয়নি। কোমলমতি নারী ঝাপটে ধরলো দুহাত বাড়িয়ে সেনা অফিসারের কঠিন বুক। পেছনে আঙুল তাক করে বিড়বিড়িয়ে কেঁদে উঠে বলল
ওরা আপনার কাছে আসতে দিচ্ছিলো না। ওদের চলে যেতে বলুন।
বন্দুক তাক করে ছুটে এসেছিল নবীন সৈনিকরা। কে এই অপরিচিতা নারী?
গুরুগম্ভীর মেজরের বুকে নারী উপস্থিতিতে তারা যতটা না অবাক হলো ততটা অবাক হয়েছে মেজরের নীরব থাকা, আর ডান হাতটি নারীশরীরকে আগলে ধরে ঢাল হতে দেখে । তারপর চোখের ইশারায় সকলকে নিশ্চিত করলো….
“সে” অপরিচিতা নয়। সে তার জন্মজন্মান্তরের আজন্ম প্রণয়িনী।
সকলে নিশ্চিত হয়ে কূর্নিশ জানিয়ে সরে গেল।
রাশভারি গুরুগম্ভীর মেজর স্যারের এমন দুঃসাহসিক প্রণয়িনী আছে জেনে ভারী বিস্ময়ে সবাই নীরবে একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করছিল।
একজন টহলকারী সৈনিক ফিসফিস করে জানালো, মেয়েটিকে একটি তরুণ যুবকের সাথে আসতে দেখা গেছে। কিভাবে এসেছে এতদূর তা নিশ্চয়ই মেয়েটি মেজরকে বলবে।
____________
ওদেরকে চলে যেতে বলেন।
এক হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে আবার মিনমিন করে মানবী বলে উঠলো কথাটি।
চলে গেছে।
রাহা এবার মাথা তুললো। শুকনো ঢোক গিলে চোখ উপরে তুলতেই বুকের রক্ত জমে গেল যেন। শ্বাস নিতে ভুলে গেল সে। এমা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সে আবার কি করলো? কত কষ্টে সে এসেছে তারজন্য থ্যাংকস পাওনা তার। থ্যাংকস নেইনা বলে, দেইও না নাকি?
এই অবেলায়?
অবিচল, স্থির, অচঞ্চল ভারী কন্ঠস্বর। রাহা আবার ও কেঁপে উঠে বুকের কাছের মোটা পোশাক আঁকড়ে ধরলো। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে সে। অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,
আমাকে চেনেন?
না তো। …..…কে…….তুমি?
পলকহীন তাকিয়ে প্রশ্নটি সাথে সাথে ছুঁড়লেন তিনি।
মেজর তাহমিদকে চেনেন?
অবশ্যই।
রাহা কান্নার চোটে ফুঁপিয়ে উঠলো।
আমি তার……
তার?
আমি তার না হওয়া বউ। বউ রেখে উনি এখানে সেখানে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান। সবাইকে ভয় দেখান অস্ত্র দেখিয়ে, চোখ রাঙিয়ে। অথচ বউকে দেখলেই পালায় পালায় করেন।
বলেই চিকন বাঁশির সুরের মতো আওয়াজ করে আবারও কেঁদে উঠে থুঁতনি ঠেকালো সে বুকে।
এমন কথা শুনে মেজরের কি হাসি পেল? উনি চোখ ঘুরিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন কেন?
আমি পালিয়ে পালিয়ে থাকি?
রাহা নাক টেনে বলল,,
হ্যা।
প্রাণো!
কত সুমধুর এই ডাক! রাহা যেন বহুকাল পর এই ডাক শুনেছে।
কেন এসেছ প্রাণো?
রাহা নাক টানতে টানতে রক্তাক্ত চোখ তুলে তাকালো।
বিয়ের দাওয়াত দিতে…..
কোমল হয়ে আসা চোখ আবারও ধিকিধিকি করে জ্বলে উঠলো। চোয়ালের হাড়, গলার রগ ফুলে উঠলো মেজরের। কালচে ঠোঁট ফুঁড়ে বেরুলো….
কে সে?
রাহা হাতের মুঠো শক্ত করে তার পোশাক আঁকড়ে ধরলো। হেঁচকা টান দিয়ে কাছে এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল
আপনার চিঠির ডাকপিয়ন।
মেজরের শরীরের রক্ত গরম হয়ে টগবগ করে যেন ফুটতে লাগলো এই কনকনে শীতের রাতে।
ধপ করে মাথা ঠেকালো রাহা পাথর কঠিন বুকের বাঁ পাশে। নিভিয়ে আসা গলায় হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল
আমি চিঠি পাইনি মেজর। আপনার চিঠি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
দাঁতে দাঁত লেগে কটমট শব্দ হলো মেজরের। হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলে উঠলো চোখের তারা।
বিশ্বাসঘাতক রোস্তম….
পরক্ষণে মনে হলো নারীশরীরটি হেলে পড়েছে তার দিকে। সরাতেই ধপ করে হেলে পড়লো তার হাতের উপর। ঠান্ডায় বরফ হয়ে গেছে হাত, পা। পাঁজাখোলা করে তুলে তাবুর দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর। সংজ্ঞা হারানো মানবীর অচৈতন্য মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ভাবলেন
সে একটু ছুঁতেই এই মেয়ে জ্ঞান হারায় কেন? তখন কি হবে?
চলবে…..