ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল #সূচনা_পর্ব

0
873

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকা : আফরোজা আক্তার

ব্যাথাযুক্ত ক্লান্ত শরীরটা ফ্লোরে পড়ে আছে বেলীর । আজকেও মার খেয়েছে সে ইরফানের হাতে । তবে আজকের মা’রের পরিমাণটা বেশিই ছিলো । আজ বেলীর অপরাধ ছিলো সে রুবির বেড-টি দিতে দেরি করে ফেলেছে । রুবি বেলীর সতীন । বেলীর স্বামী ইফরানের দ্বিতীয় পক্ষ সে । বড়লোক ঘরের মেয়ে রুবি । ভালোবেসে বিয়ে করেছে ইরফানকে । এটা জানা সত্ত্বেও যে ইরফান বিবাহিত । রুবি এমন একজন নারী যে কিনা কোন পয়েন্ট বাদ রাখে না যেই পয়েন্ট অনুযায়ী ইরফান বেলীকে মারতে পারে । প্রতি পদে পদে নানা রকম মিথ্যা কথা বলে বলে বেলীকে মা’র খাওয়ায় রুবি । বেলী সবটাই মুখ বুজে মেনে নেয় । বেলীর প্রতিবাদ করার মত সেই শক্তি আর সাহস নেই । রুমের ফ্লোরে শুয়ে থেকে ব্যাথায় ছটফট করতে থাকা বেলীকে দেখার মত কেউই নেই এই বাড়িতে । তবে কাজের মেয়ে মিনু এক একবার এসে ধরে উঠায় যখন ইরফান বেলীকে এইভাবে মেরে রেখে যায় । আজকেও ব্যাতিক্রম কিছু ঘটেনি । ইরফান রুবিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর মিনু দৌড়ে গিয়ে এসে রুমে ঢোকে । গায়ের ওড়নাটা সাইডে পড়ে আছে । হলুদ সুতির জামার উপরে রক্তের হালকা ছোপ ছোপ দাগ হয়ে গেছে । পুরো শরীর ধরে কুচকে শুয়ে থাকা বেলীকে দেখে মিনুর চোখেও পানি চলে আসে । এদিক সেদিক তাকিয়ে মিনু বেলীকে তুলে খাটে নিয়ে বসায় । বেলীর ফর্সা গাল গুলোতে ইরফানের হাতের ৫ আঙুলের ছাপ পড়ে আছে । নাক মুখ দিয়ে লালা চলে আসছে । পুরো মুখটা ফুলে আছে তার । কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনো এভাবে বউ পেটায় না তার উপর হয় যদি উচ্চ শিক্ষিত । মিনু বেলীর চোখ মুখ মুছে দেয় ।

– ভাবী , জামাটা খুলেন ।
– উহু
– রক্ত গুলি মুইছা দেই , দিয়া সেভলন লাগাইয়া দিমু ।
– লাগবে না মিনু , চলো রান্না ঘরে যাই । ওনারা এসে খাবেন তো ।
– আপনার কি মাতায় সমিস্যা , এই শরীর নিয়া রান্না ঘরে যাইবেন আর তারা আজকে বাহিরে খাইবো এত অস্থির হইয়েন না ।
– ওহ ,
– আপনে জামা খুলেন , আমি গরম পানি নিয়া আসি ।

মিনু গরম পানি আনতে গেলে বেলী ঢুকরে কেঁদে দেয় । কি বেলী কি হয়ে গেলো ? বাবা ভালোবেসে বেলীফুল ডাকতো , আর আজ সেই বাবার আদরের মেয়েটা স্বামীর ঘরে এসে সতীন নিয়ে সংসার করে । আর প্রতিদিন নির্মমতা সহ্য করে । বেলীর মুখ দিয়ে তখন একটা কথাই বেরিয়ে আসে ,
” বাবা আমাকেও নিয়ে যাইতা তোমার সাথে ”
এরই মাঝে মিনু গরম পানি নিয়ে চলে আসে । দেখে বেলী সেইভাবেই বসে আছে । মিনু কাছে গিয়ে বসে ।

– ভাবী ও ভাবী ,
– হুউউ ,
– কি ভাবেন , দেহি জামাটা খুলেন ।

মিনুর কথায় জামাটা খুলে বেলী । বুকের উপরে জামাটা দিয়ে ঢেকে রাখে সে । মিনু পিছনে গিয়ে ব্রা এর হুক খুলে দেয় । হুক খুলতে গিয়ে আৎকে উঠে সে । এইভাবে বুঝি কেউ কাউকে মারে । আজকে মারছে বেল্ট দিয়ে । মিনু ক্ষতস্থানে হাত দিতেই বেলী নড়ে ওঠে । মিনু বুঝে যায় যে , তার ভাবীর ব্যাথা করছে । গরম পানি দিয়ে হালকা চেপে চেপে পুরো ক্ষতস্থান থেকে রক্ত সরিয়ে দেয় আর তারপর ওয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেয় সে ।

– মিনু ফ্যানটা চালাও , পুরো পিঠ টা জ্বলে আমার ।
– ফাটা জায়গা তো তাই জ্বলে ভাবী আপনে জামা পইরেন না ।
– হু ,
– ভাবী একটু শুইয়া থাকেন । আইজকার রান্না আমি কইরা নিমু ।
– নাহ মিনু , জানতে পারলে আবার মারবে আমাকে ।
– আহারে ভাবী ,
– কি করবো বলো , মারধর যা-ই করে খেতে তো দেয় , এইটাই অনেক ।
– কোন দিন দেখমু মইরা রইছেন ।
– আচ্ছা বাদ দাও এইদিকে আসো , আমার ব্রায়ের হুকটা লাগাও হাতে অনেক ব্যাথা পিছন অবদি যায় না ।
– আইচ্ছা ।

অনেক কষ্টে জামা পরে রান্না ঘরে যায় বেলী । দিনে না খাক , তার বর আর তার বরের বউ রাতে এসে তো খাবে । সেই ভেবেই রান্না করা । পুটি মাছের ঝোল , কাকড়োল ভাজি আর ভাত করেছে তার আর মিনুর জন্যে । ইরফান আর রুবির জন্যে বাসমতি চালের ভাত আর চিকেন করে রেখেছে ।
রান্না শেষ করে উঠতে উঠতে আজান পড়ে যায় । মিনুকে বলে সে রুমে যায় । গোসল করে নামাজ পড়ে নিবে বেলী । বেলী ইসলাম সাইড টা বেশি মানে । যত যাই হোক না কেন নামাজ , কোরআন শরীফ পড়বে সে । রুমে এসে গোসল করে নামাজের জায়নামাজে দাঁড়ায় বেলী ওইদিকে মিনু সব গুছিয়ে নিয়ে ঘর টাও মুছে ফেলে ।
১২ রাকাত নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে দোয়া দুরূদ পাঠ করে বেলী । তারই মাঝে মনে পড়ে যায় এক বছর আগের কথা গুলো । কত সুন্দর একটা পরিবার ছিল বেলীর । বাবা মা আর সে । অভাবে থাকলেও দিন চলতো বেশ ।
কামরাঙ্গীরচর এলাকায় সুখে শান্তিতে বড্ড ভালোই ছিল মেয়েটা । বেলীর বাবা জব্বার মিয়া ছিলেন কাঠমিস্ত্রী , আর বেলীর মা রাবেয়া বেগম রান্নার কাজ করতেন , রান্নার কাজ বলতে ব্যাচেলর্স মেয়ে ছেলেদের মেস গুলোতে রান্না করে দিতেন । বেলী ছিল জব্বার আর রাবেয়ার একমাত্র সন্তান । টানাটানির সংসারে বেলীকে ইন্টার অবদি পড়াতে পেরেছিলেন তারা তার মাঝে আবার ইন্টার পরীক্ষাটাও দিতে পারি নি টাকার অভাবে । তারপর আর পড়াশোনা করে নি বেলী । সারাদিন পর জব্বার ঘরে ফিরে মেয়ের হাসি মাখা মুখ টা দেখলেই খুশি হয়ে যেতেন । নাম রেখেছিল ভালোবেসে বেলী , আর আদর করে ডাকতেন বেলীফুল বলে । বাড়ির উঠানে এসেই ডাক দিতেন বেলীফুল বলে , আর বাবার কথার আওয়াজ পেয়ে বেলীও দৌড়ে চলে আসতো বাবার কাছে । বাপ-মেয়ের আহ্লাদিপণা দেখে মা রাবেয়া বেগমও খুশি হতেন ।
একদিন দুপুরের খাবার দিতে বেলী তার বাবা দোকানে যায় আর সেখানেই রহমান আলী বেলীকে দেখে । রহমান আলী অনেক ভালো মানুষ ছিলেন । সেই এলাকায় তার বহুল পরিচিতি । বেলীকে দেখে মনে ধরেছিল তার । এমন ছয়-ছোট্ট মেয়েই তার ছেলের সাথে যায় । তাই তিনি জব্বারকে ডেকে নিয়ে সব বিস্তারিত কথা বলে পাকা করে নেন । সেদিন রাবেয়া মানে বেলীর মাও অনেক খুশি হয়েছিলেন । গরীবের মেয়ে যদি তার মা-হারা ছেলের জীবনে আসে তাহলে তার ছেলের ভালোই হবে এটা ভেবেই ভদ্রলোক বিয়ে ঠিক করেন । কিন্তু প্রকৃতির বর্বরতার কাছে হার মানতে হয় কিছু কিছু স্বপ্নকে । বিয়ে ঠিক হওয়ার পর একদিন বিকেলে কাজ থেকে আসার সময় ট্রাকের নিচে চাপা পড়েন জব্বার । সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে । শোকার্ত বেলী আর রাবেয়া বেগম পাথর হয়ে যায় ।
অন্যদিকে , রহমান আলীর এক কথা । কথায় তার নড়চড় হবে না । বিয়ে এই মেয়ের সাথেই দিবেন তিনি তার ছেলের । জব্বারের মৃত্যুর পর রহমান আলী বেলীর মাকে ভরসা দেন । আর ছেলেকে খবর দিয়ে গ্রামে আনান । ছেলে যখন শুনে তার বিয়ে একটা অজপাড়া গায়ের মেয়ের সাথে তখন ছেলে সরাসরি না করে দেয় । কিন্তু রহমান আলীও কম জেদি না । তিনিও জোর করেই যাচ্ছেন ।

– দেখুন বাবা , আপনার কথা রাখতে গিয়ে আমি এমন একটা মেয়েকে বিয় করতে পারি না ।
– বেলী অনেক ভালো মেয়ে ।
– সে ভালো নাকি খারাপ আমি জনতেও চাই না । আর তাছাড়া আমি গ্রেজুয়েট ছেলে ভালো চাকরিও করছি আমারও পছন্দ থাকতে পারে ?
– তোমার পছন্দ যে আমার পছন্দ হবে তেমন টাও কথা না ।
– তাহলে আপনার পছন্দ কি করে আমার পছন্দ হবে বাবা , বুঝার চেষ্টা করেন আমি পারবো না বিয়ে করতে ।
– দেখো ওর বাবা মারা যাওয়ার আগে আমি কথা দিয়ে রাখছি এখন ওর বাবা নেই , আমি কথার বরখেলাপ করতে পারবো না ।
– বাবা বিয়ে যদি হয়েও যায় ওই মেয়ে শান্তি পাবে না কিন্তু ।
– পড়াশোনা শিখে ভালো চাকরি করে কি এতই লায়েক হয়ে গেছো নাকি । মা মরা ছেলেকে মানুষ করতে কি আমার কষ্ট হয়নি ।
– দেখুন বাবা আমি আর তর্ক চাই না ।
– বিয়ে এই মেয়েকেই করতে হবে , এটা মনে রাখো ।

রহমান আলী এক রকম জোর করেই ছেলের সাথে বেলীর বিয়ের সব আয়োজন করেন । আর ছেলেও ক্ষোভে ক্ষুব্ধ হয়ে বিয়ের পিড়িতে বসেছিল । শুক্রবার জুমার নামাজ এর পর বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয় । বিয়েতে সব খরচ রহমান আলী নিজে করেন । বাশের বেড়ার এক পাশে একটা ব্যানার টাঙানো হয় যাতে লিখা ছিল ” আজ বেলী ও ইরফানের শুভ বিবাহ ” । বেলীর বাবা মারা যাওয়ার দুই মাসের মাথাতেই ইরফানের সাথে বেলীর বিয়ে হয় । বিয়ের পর রাতে যখন বেলীকে ইরফানের রুমে রাখা হয়েছিলো ,,,,,,। আজও মনে পড়লে দুচোখ ভিজে যায় বেলীর ।
এরই মাঝে দরজায় টোকা পড়ে । ধ্যান ভেঙে দরজার দিকে তাকায় বেলী । মিনু দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে ।

– কিছু বলবা মিনু ?
– ২ টা ৩০ বাজে , নামাজ এহনও হয় নাই আপনের ?
– হ্যাঁ হইছে ।
– তাইলে আসেন ভাত বাড়ছি আমি ।
– আসতেছি ।

মিনু মেয়েটা যথেষ্ট ভালো আর ভদ্র । রুবিকে সে একদম দেখতে পারে না । কারণ ইরফানের অবর্তমানে রুবি বেলীর সাথে যা যা করে সব কিছু স্বাক্ষী এই মিনু । মিনু কয়েকবার বলতেও চেয়েছিল কিন্তু বেলীর নিষেধে সে আর মুখ খুলে নি ।
নামাজের মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বেলী । পুরো শরীরটা ব্যাথা হয়ে আছে তার । কয়টা ভাত খেয়ে নিয়ে নাপা টেবলেট খেয়ে নিবে ।
আস্তে আস্তে হেটে ডাইনিং রুমে যায় বেলী । আজকে বাসায় কেউ না থাকায় টেবিলে বসেই ভাত খায় বেলী আর মিনু । ইদানীং ভাত খেতে গেলে গলার মাঝখানটায় ভাত আটকে থাকে বেলীর । ইরফান মারার সময় প্রায়ই গলায় চাপ দেয় না হয় গায়ের ওড়না দিয়ে ফাঁস দেয় । গলার ব্যাথায় ঠিক মত খাবারও গিলতে পারে না বেলী ।
ভাত খেতে বসে গলার অসহ্য যন্ত্রনায় চোখের পানি ছেড়ে দেয় বেলী । বেলীর কান্না দেখে মিনুরও খানা বন্ধ হয়ে যায় ।

– আর কাইন্দেন না তো ভাবী । কতদিন কইলাম যান গা যান গা , হুনেন নাই আমার কথা । আবার আমারেও কিছু কইতে দেন না ভাইয়েরে । তাইলে হুদ্দাই কান্দেন কিত্তে । কাইন্দেন না ,

মিনুর কথায় অশ্রুসজল চোখে তাকায় বেলী ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here