ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল #পর্ব_৪

0
349

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

ইদানীং অফিসে কাজের এত প্রেশার বেড়েছে যে বেচারা ইরফান এর রাত দিন এক করে কাজ করা লাগে । হাউজ বিল্ডিং এর প্রজেক্ট টা নিয়ে আজকে একটা সপ্তাহ ইরফান দৌড়াদৌড়ির মাঝে আছে । অন্যদিকে রুবি উরাধুরা টাকা উড়াচ্ছে ।
সন্ধ্যায় বাসায় এসে চেঁচামেচি শুরু করে ইরফান । বহুত মেজাজ খারাপ তার । বাসায় এসে সরাসরি রুবির উপরে রাগারাগি করা শুরু করে সে । বেলী আজ নিজের ঘরেই আছে । ওযু করে এসে জায়নামাজে দাঁড়িয়েছে মাত্র । এশার নামাজ পড়বে বলে । আর ওই রুমে চিল্লাপাল্লা চলছে ।

– রুবি তুমি টাকা তুলছো ?
– কিসের টাকা ?
– কিসের টাকা মানে ? আমার এ.টি.এম কার্ড দিয়ে টাকা তুলো নাই তুমি ? পুরো ২৫ হাজার টাকা উইড্রো করা হয়েছে আজকে ।
– কি জানি আমি তো তুলি নি ?
– কার্ড কোথায় ?
– ড্রয়ারেই তো আছে ।
– টাকা তুলবে কে তাহলে ।

রুবি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলা শুরু করে ,

– আমি যখন ওয়াসরুমে ঢুকেছিলাম বেলী রুমে আসছিল । পরে দেখলাম বেলী বাহিরে গেছে , তারপর আমি ঘুমিয়ে গেছি , তাহলে এর মিনিং কি দাঁড়ায় ইরফান ?
– তার মানে বেলী ??
– হতেই পারে , অসম্ভবের কিছু না ।
– কিন্তু ও পিন নাম্বার জানবে কিভাবে ?
– আরে আজব তো , আমরা তো কতবারই জোরে জোরে বলেছি ।
– এত দিন সুযোগ পায় নি আজ কাজে লাগিয়ে ফেলছে ।

রুবি জানতো ইরফানের মেজাজ খারাপ থাকলে সে সব কথা বিনা বাছবিচার না করেই হুটহাট সিদ্ধান্তে উপনীত হয় । তাই সে শুকনো পাতায় আগুনের চিঙ্গাড়ি দিয়েছে মাত্র । আর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু হয়ে গেছে । ইরফান টাই টা খুলে সোজা বেলীর রুমে যায় । বেলী তখন রুকু ছেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ওমনি বেলীকে টেনে নিয়ে সামনে দাড় করায় ।

– আমার রুমে গেছিলি আজকে ?
– হু , ঝাড়ু দিতে ,
– বাহিরে গেছিলি কেন ?
– এমনি গেছিলাম ।
– এমনি , এমনি গেছস তুই ?
– হু

হু বলার সাথে সাথে বেলীর গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় ইরফান । বেলী থাপ্পড়টা খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় । ইরফান এইবার এলোপাথাড়ি শুলার ঝাড়ু দিয়ে ইচ্ছামত বারি দিচ্ছে বেলীকে । বেলী বুঝতেই পারছে না কোন অপরাধের জন্যে তাকে মারা হচ্ছে । মাগো মাগো করে চাপা স্বরে আর্তনাদ করছে মেয়েটা ।

– তোর সাহস হয় কিভাবে ?
– মাগো ,
– চুপ একদম চুপ , তুই কোন সাহসে আমার এ.টি.এম কার্ডে হাত দিছস ।
– আমি জানি না কিছু , কসম আল্লাহর আমি জানি না কিছু ।
– টাকা তুলে কি করছিস বল , বল টাকা কাকে দিছিস ।
– কিসের টাকা , এইসব কি বলেন ?
– চুপ খবরদার মিথ্যা বলবি না । একদম মেরে ফেলে রাখবো । তোকে আমিই তো সব কিনে এনে দিলাম তুই কোন সাহসে আমার রুমে ঢুকলি । চোর কোথাকার , যেই ঘরে খাস ওই ঘরেই চুরি করস ।
– খোদার কসম আমি এইসব করি নাই আপনি শুনেন , আমি কিছুই করি নাই ।
– আজকে তোকে মেরেই ফেলবো আমি , মেরেই ফেলবো ।

এই বলে এলোপাথাড়ি লাথি শুরু করে দেই ইরফান । ধাক্কা দেয়ায় খাটের কোণা গিয়ে মাথায় লাগে বেলীর । হাল্কা ফেটে রক্তও বেরিয়ে আসে কপাল থেকে । শলার ঝাড়ু দিয়ে মারাতে হাতে আর গলার নিচে কয়েকটা শলা ভেঙে ঢুকে যায় । বেলী তখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে ।
সেই সময়ই মিনু দৌড়ে আসে । ইরফানের মারার মাঝে দিয়েই বেলীকে জড়িয়ে ধরে মিনু ।

– ভাই কি করতাছেন , ভাই থামেন থামেন ।
– ওই তুই সর , সর রখান থেকে । আজকে ও-কে মেরেই ফেলবো ।
– কেন ভাবী কিয়াচ্ছে ?
– চুরি করছে , আমার খেয়ে আমার পরে আমার ঘরেই চুরি করে ওয় ।
– ভাই এইসব কি কন আপনে ?
– সর তুই , না হয় তোকেও বের করে দিব বাসা থেকে ।
– ভাই থামেন আগে । আর আমার থাকার ইচ্ছাও নাই ।
– ওয় চোর , আমার রুম থেকে চুরি করছে , এত টাকা দিয়ে করছে কি ওয় ?
– ভাই আপনে এইসব কি কন , ভাবী টাকা পাইবো কই থাইকা ?
– এ.টি.এম কার্ড দিয়ে ২৫ হাজার টাকা তুলছে ।
– আপনের মাতায় সমিস্যা ?
– এক থাপ্পড়ে গালের দাত ফালিয়ে দিবো বেয়াদব । কাজের মেয়ে কাজের মেয়ের মত থাক ।
– ভাই আমি কামের মাইয়া আমি জানি , আপনে তো তার থাইকাও খারাপ ।
– মিনু,,,,,,,,?

অনেক তর্কবিতর্ক করে মিনু ইরফানের সাথে । তারপর মিনু অনেক রেগে যায় । বেলী ফ্লোরেই শুয়ে আছে ।

– বেলী ভাবীরে ছোট ভাবী ডাইকা ঘরে নিয়া পা টিপাইছে । পরে ভাবী আইসা পরছে । পরে ঘর ঝাড়ু দিতে গেছিলো । আমিই বেলী ভাবীরে নিয়া বাহিরে গেছিলাম , বেশি দূরে যাই নাই । তাও ভাবী বাসার নিচেই ছিল আমি গিয়ে ভাবীর জামা কাপড় গুলা আনছি টেইলার্সের দোকান থাইকা । হেরফরে ছোট ভাবী বাহিরে গেছে গা ফিরছে সন্ধ্যার আগে দিয়া । আসার সময় হাতে অনেকডি ব্যাগ আছিলো । এইবার তারে গিয়া জিগান সে মিছা কতা কিলিগা কইছে বেলী ভাবীর নামে । হেতিও তো বেলী ভাবীরে অনেক গালমন্দ করে থাপ্পড় মারে তখন কিছু দেহেন নি আপনে । হেতির কতায় আইয়া নির্দোষ মাইয়াডারে এমনে ফিডাইলেন । যাইয়া দেহেন ছোট ভাবী ঘরে বইয়া বইয়া তার মায়েরে এইসব কয় আর হাসে । হুনেন ভাই৷, আমি রত খাইটা খাই আমার কামের অভাব পড়তো না তয় আল্লাহ একজন আছে উপরে । এইডা মনে রাইখেন ।

মিনুর কথা গুলো শুনে ইরফানের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । এইসব কি বললো মিনু । এত দ্রুত এতগুলা কথা কিভাবে বলে দিলো মিনু । ইরফান ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে । ওই দিক মুখ করে পরে আছে বেলী । মিনু মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর নিরবে কাঁদছে । এতটা নির্মম ভাবে কেউ কাউকে মারতে পারে তা জানা ছিল না মিনুর ।
ইরফান নিজের রুমের দরজার কাছে যায় । রুবি তখন রিলেক্স মুডে ম্যাগাজিন পড়ছে । রুবির ধারণা ইরফান হয়তো আজ বেলীকে জনমকার মা’র মারছে । রুবি অনেক খুশি এতে । ইরফান রুমের মধ্যে এসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রুবির দিকে । রুবির মুখে দারুণ খুশির ছাপ ।
এখন ইরফান বলা শুরু করে ।

– তুমি যে এত ভালো মিথ্যা বলতে পারো জানা ছিল না তো ।

ইরফানের কথা চোখ বড় করে তাকায় রুবি । ইরফানের মুখ থেকে এমন কথা আশা করেনি সে ।

– মানে ?
– টাকা খরচ করলা তুমি , নাম দিলা বেলীর , কেন ?
– কি সব বলো উলটাপালটা , কার্ড তো বেলী নিয়েছে ।
– তুমি বাসা থেকে বের হও নাই ?
– একদমই না ।
– তুমি কি আমাকে আর কত হিপোক্রিয়েট বানিয়ে রাখতে চাও ?
– দেখো ইরফান অতিরিক্ত কথা আমার পছন্দ না ।
– দুপুরে বাসা থেকে বের হলে তুমি , ফূর্তি করলা তুমি , শপিং করলা তুমি , আর আমাকে একটা বানোয়াট গল্প শুনিয়েছো যে বেলী টাকা উইড্রো করছে ।
– আমার নামে কান ভারী করে ওই মেয়ে , ওর সাহস কত বড় ? আজ ওর খবর করে ছাড়বো আমি ।
– খবরদার রুবি , খবরদার ওই রুমে যাবা না । ব্লাডি মিথ্যাবাদী , ওই বেচারি তো মা’র খেয়ে চুপ করে পড়ে আছে মাটিতে তবুও তোমার নামে একটা কথাও বলেনি , আর তুমি রুবি তো খুব ভালো করেই বেলীকে আমি সহ্য করতে পারি না তাই তুমি ইচ্ছা করে ও-কে আমার হাতে মাইর খাওয়াও , তাই না রুবি ।
– স্যাট আপ , স্যাট আপ ইউ ফুল !

ইরফানের আর সহ্য হয়নি । রুবিকে খাট থেকে নামিয়ে ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দেয় ।

– বেয়াদব , অনেক সহ্য করেছি । আর না , আমার টাকা পয়সা গুলো তুষের মত উড়িয়ে আরেকজনের ঘাড়ে দোষ চাপাও , কেমন মেয়ে মানুষ তুমি ।
– তুমি আমার গায়ে হাত তুললা ?
– হ্যাঁ তুললাম , তুললাম আমি হাত । কি করবা এখন ? তোমাকে তো একটা চড় দিয়েছি মাত্র আর তোমার কান কথা শুনে আমি গর্দভ যে ইচ্ছামত দিনের পর দিন বেলীকে টর্চার করেছি তার বেলায় কিছু না , তাই না ?
– মিষ্টার ইরফান আহমেদ তোমাকে যদি আমি জেলের ভাত না খাওয়াইছি আমি এক বাপের মেয়ে না ।
– তোমার মত মেয়ে মানুষ এর থেকে কি আর করতে পারে । যাও তোমার ধনী বাপের কাছে গিয়ে নালিশ করো আর আমার নামের বিচারসভার আয়োজন করো । যাও ,
– অবশ্যই যাবো , তোমার আর ওই থার্ড ক্লাস মেয়ের রাতের ঘুম যদি আমি না হারাম করি আমার নাম রুবি না ।

[ বিঃদ্রঃ আমাদের সমাজে এমন অনেক মেয়েই আছে যারা এইভাবে স্বামীর আয়ের উৎস গুলো এইভাবেই শেষ করে । নিজেদের ইগো আর নিজেদের গাম্ভীর্য্যতা বজায় রাখার জন্যে স্বামীর কি আছে না আছে তা না দেখেই টাকা পয়সা উড়াতে থাকে । এইসব নারীদের জন্যেই কিছু কিছু পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় । সতীন যে সতীনের শুত্রু হয় উক্ত বাক্যটি একদম মিথ্যা নয় । এইভাবেই কান ভারী করে এক বউ অন্য বউকে তার স্বামীর চোখের বালি বানিয়ে দেয় । আর স্বামীরা যদি হয় ইরফান টাইপ তাহলে এইভাবেই মা’র খেতে হয় হাজারো বেলীকে । আজকের পর্বে উল্লেখিত বিষয় দুটো বাস্তবসম্মত । একদম নিজ চোখে দেখা , তাই গল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে একটু চেষ্টা করলাম মাত্র ]

এইসব বলে রুবি বাসা থেকে বের হয়ে যায় । রাত প্রায় ১০ টা ৩০ বাজে । এত রাতে একা একা বের হয়ে যায় রুবি । গন্তব্যস্থল বাপের বাড়ি । আজ এই প্রথম ইরফান তার কথা আমলে নেয় নি , উল্টো তাকে চড় মেরেছে । এইটা তার সহ্য হয় নি । ইরফান অনেক বদমেজাজি ছেলে । তার অল্পতেই মেজাজ বিগড়ে যায় । খাটের উপরে বসে পড়ে ইরফান । মাথা পুরো হ্যাং হয়ে আছে তার । সেলারি যা পায় তার বেশি অর্ধেকটাই রুবি খরচ করে । সেভিংস হতে হতেও হয় না । আজ এক সাথে ২৫ হাজার টাকা তোলায় তার মাথা গরম হয়ে গেছে । হুট করেই বেলীর কথা মনে পড়ে । সেইদিন রাতে বলেছিল গা হাত পা ব্যাথা করে তার কিন্তু আজ এলোপাথাড়ি লাথি গুলো মেরেছে ইরফান । তার জানা নেই মেয়েটা কি অবস্থায় আছে এখন । অফিস থেকে এসে চেঞ্জও করে নি সে । স্থির হরে বসে থাকতে না পেরে বেলীর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । মিনু তখন হাত পা টিপে দিচ্ছিলো বেলীর আর কাঁদছে ।

– ভাবী , ও ভাবী
-…………
– ভাবী গো , কতা কন না কা ? ও ভাবী
-…………
– ভাবী এইদিকে ফিরেন শলার মাতাডি বাইর কইরা দেই , ছাই এইদিকে ফিরেন ভাবী ।
-…………

মিনু ঘুরিয়ে দেয় বেলীকে । উল্টাপাল্টা লাথি দেয়ায় পুরো শরীর নিথর হয়ে আছে বেলীর । হয়তো শরীরের যন্ত্রণার জন্যেই চুপ করে চোখ বন্ধ করে আছে বেলী । মিনু হু হু করে দেয় আবারও ।

– কেমন কইরা ফিডাইলো ? আরে শলাডি কেমনে ঢুইক্কা গেছে । ভাবী ও ভাবী …..
-…………

পরে মিনু আস্তে আস্তে করে হাত আর গলা থেকে শলার মাথা গুলো বের করে দেয় । বের করার সময় ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে বেলী । ইরফান তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল । বেলীর কঁকিয়ে উঠার আওয়াজে পর্দার কাপড় গুলো মুষ্ঠিবদ্ধ করে নেয় ইরফান৷। মেয়েটা কতটা কষ্টে আর ব্যাথার পরে এইভাবে আর্তনাদ করে উঠতে পারে । ইরফান যে ততটা মনুষ্যবিহীন পুরুষ সে এখন উপলব্ধি করতে পারছে ।
মিনু গরম পানি আনতে যাবে বলে দরজার কাছে যায় । তখনই ইরফানকে দেখে ।

– এমনে কেউ কাউরে ফিডায় নি ভাই , ভাবী কাউরে কিছুই কয় না , ঘরের একটা কোণার মইধ্যে ফইড়া থাহে , হেরফরেও এমনে ফিডান তারে । মইরা গেলে একদিন বুঝবেন ভাই । দেইখেন আমি কইলাম তো বুঝবেন একদিন আপনে ।

এইটা বলে মিনু রান্নাঘরে চলে যায় । আর ইরফান দরজা থেকেই বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । হাতের কয়েক জায়গা থেকে ফোটা ফোটা রক্ত , কপালটাও ফুলে রক্তগুলোও শুকিয়ে আছে । বেলী তখনও চুপ করে দম খিটে শুয়ে আছে ।

.
.

চলবে……………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here