ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল #পর্ব_২১,২২

0
324

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_২১,২২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
২১

বুকের মধ্যে নিমিষেই এক তুফান শুরু হয়ে যায় বেলীর । আসলেই কি সুখের মিলন হতে দেয়া যায় ? অসলেই কি একটু সুখের মিলন হলে খুব বেশি ক্ষতি হবে ? তবুও কেন যেন কোথাও একটা বাঁধা কাজ করে বেলীর মাঝে । আবার নাও করতে পারে না , যতই হোক স্বামী তো তার । বিয়ের পর বাবা মায়ের পর স্ত্রীর উপর তার স্বামীর অধিকার থাকে বেশি । কিন্তু বেলীর ভেতরটা হু হু করে কেঁদে ওঠে তখন যখন ইরফানের করা সমস্ত খারাপ আচরণ গুলো মনে পড়ে যায় । যখন মারধরের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে । বেলী তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না ।
আজও ব্যাতিক্রম কিছু ঘটে নি তার সাথে । সুখের মিলনের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেইসব বিষাদের দিন গুলো মনে পড়ে যায় বেলীর । ইরফানের হাতের স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথে অন্তরখানা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তার । নিজের ভেতরে উথালপাতাল শুরু হয়ে গেছে বেলীর । কেন যেনো মানতে পারে না সেও । এতটা কষ্ট কি তার পাওনা ছিল ? নিজের কাছে এইসব জিনিস গুলো লজ্জাজনক লাগে বেলীর কাছে ।
বেলী আর সহ্য করতে পারেনি । পিছন ফিরেই ঝাপটে ধরে ইরফানকে । বেলীর এইভাবে ঝাপটে ধরা দেখে একটু হতভম্ব হয়ে যায় ইরফান । বেলী শব্দ করেই কেঁদে দেয় ইরফানের বুকে । দুইহাতে নিজের মুখ ঢেকে ইরফানের বুকে হাতে আবদ্ধ সেই মুখটি লুকিয়ে রেখে কেঁদে ওঠে বেলী । এক সময় ইরফান বেলীর পিঠটা নিজের হাত দিয়ে আগলে ধরতে যাবে তখনই বেলী ধুপ করে কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ে । একে তো শরীর খারাপ তার উপর এইভাবে কান্না করাটা তার শরীরের পক্ষে খারাপ হতে পারে । মুহুর্তের মাঝে ইরফান চমকে যায় , বেলীর কান্না আরেকটু জোর শব্দে পরিণত হয় । ফ্লোরে বসে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে মেয়েটা । ইরফান হাটু গেড়ে নিচে বসে পড়ে বেলীর কাছে । হাতটা দিয়ে বেলীর মাথায় রাখে ।

– কি হলো ? এইভাবে কাঁদছো কেন ?
-…………….
– এই বেলী এইভাবে কাঁদছো কেন ?
-………………

কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে মেয়েটার । ইরফান বেলীর কান্না থামানোর জন্যে গ্লাসে এনে পানি দেয় তাকে খাওয়ার জন্যে । কিন্তু বেলী খায়নি । তারপর কেন জানি নিজ থেকেই ইরফানের হাতটা টেনে নিজের কাছে বসায় সে । কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করে দেয় বেলী ।

– আপনি আমায় অনেক মারছেন । আপনি জানেন আমি কত ব্যাথা পাইতাম তখন ? আমার অনেক ব্যাথা লাগতো আমি তবুও কিছু বলতাম না আপনাকে । আরে ভালো না বাসতেন তাই বলে এইভাবে মারবেন ? আপনার এক একটা লাথি এক একটা ঘুষি অনেক ব্যাথা দিত আমার এই শরীরটাকে । আপনি জানতেন না আমি কত রাত ব্যাথার যন্ত্রণায় ঘুমাইতে পারি নাই । সেইবার শলার ঝাড়ু দিয়ে পর্যন্ত মারছেন । এমন ভাবে মারছেন যে শলা পর্যন্ত ঢুকে গেছে শরীরে । এইভাবে বুঝি কেউ কাউকে মারে , হ্যাঁ ।
এই দেখেন৷, এইদিকে দেখেন , আমার এই শরীরটা যখন স্বামীর ছোয়া পেতো তখন এই শরীরটা স্বামীর মাইর পাইছে । এই ইরফান সাহেব , আমাকে এত মারছেন কেন ? আমাকে বললেই হইতো আমি চলে যেতাম । বা ভাতের সাথে বিষ দিয়ে দিতেন খেয়ে মরে যেতাম । তবুও না মারতেন । এইদিকে দেখেন , এই যে দেখেন আমার পিঠটায় কত দাগ এখনও আছে । সেইবার বেল্ট দিয়ে মারছেন । আচ্ছা একটুও মায়া হয় নাই , তাই না ? বেলীকে যে এইভাবে মারি ওর শরীরটা কি এত মাইর নিতে পারে ? একবার জানতে চান নাই , তাই না ? ওইদিন চা দিতে একটু
দেরি হয়ে গেছিলো বলে এইভাবে মারছিলেন । আপনি আমায় মেরে কেন ফেলান নাই ? হ্যাঁ , কেন মেরে ফেলান নাই আমাকে আপনি ? শুনেন না , এইদিকে তাকান আমার দিকে , আমি কিন্তু অনেক ব্যাথা পাইতাম যখন মারতেন , কিন্তু শব্দ করতাম না । বলেন করতাম কিনা , বলেন না , আমি কি মারার সময় কোন শব্দ করতাম ?

বেলী নিজের মাঝে তখন ছিল না , সে অনেকটা উন্মাদ হয়ে গেছে মনে হচ্ছিলো । চোখের পানি নাকের পানি এমনকি লালা চলে আসছে মুখ দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে । হয় অনেক সময় এমন । মানুষ যখন অতি শোকে পাথর থাকে তারপর সেই পাথর গলে গেলে তখন যেই পতিক্রিয়া হয় এখম সেই প্রতিক্রিয়াটা হচ্ছে বেলীর । ইরফানের ভেতরের কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে বেলীর এমন পাগলামি দেখে । সে একদম নিশ্চুপ হয়ে ফ্লোরে বেলীর সামনে বসে আছে । বেলী হাত ধরে জোড়াজুড়ি করছিল উত্তর জানার জন্যে । তখন বাধ্য হয়েই ইরফান জবাব দেয় ৷

– উহু কোন শব্দ করতে না ।

তখন বেলী আবারও কেঁদে দেয় । এইবার ইরফানের দুই হাত ধরে নিজের কাছে আনে বেলী । তারপর আবার বলা শুরু করে সে ,

– যখন দেখতেন আমি শব্দ করতাম না তখনও কি মায়া হতো না আমার উপরে । খালি মেরেই গেছেন মেরেই গেছেন । আমি কি ব্যাথা পাই না বলেন ? আমিও ব্যাথা পাই ।
– হু , আমি তো অমানুষ , আমি বুঝতেই পারি নাই এটা যে একটা ফুল । যেই ফুলটা একদম নিষ্পাপ , সেই ফুলটাকেই এত অবহেলা করে বসলাম ।
– আমি কি করছিলাম হ্যাঁ , কি করছিলাম , আপনি আমায় একটুও দেখতে পারেন নাই , বলেন । আমি কি বলছিলাম যে আমাকে বিয়ে করেন , তখন তো আমার বাবা আর আপনার বাবা বললেন আমি কি করতাম । বাপ আমার মরে গেল , তখনও আপনার বাবা বিয়ের কথা বলে গেছে আমার মাকে । আমার কি অপরাধ ছিল । আমি একদিন নামাজ পড়তেছিলাম সাড়া দিতে পারি নাই বলে জুতা নিয়ে আসছেন আমাকে মারার জন্যে । আমার তখন কি অন্যায় ছিল , বলেন তো ?
– অন্যায় তোমার না , অন্যায় ছিল আমার । আমিই খারাপ মানুষ , আমিই কষ্ট দিলাম তোমাকে ।
– আমার বাপ মা আমায় মারে নাই , আমি তাদের কাছে ফুল ছিলাম তাদের শখের বেলীফুল , আর সেই ফুলটারেই আপনি ছিড়ে ফেললেন এইভাবে ? এর থেকে ভালো ছিল আমায় বিষ দিয়ে মেরে দিতে । আমি টু-শব্দটাও করতাম না ।

ইরফানের আর সহ্য হয়নি । এক টানে বেলীকে নিজের বুকে এনে ফালায় সে । তারপর বসা অবস্থাতেই শক্ত করে ধরে রাখে বেলীকে । ইরফান আজ কাঁদছে , ছেলেরা কম কষ্টে কাঁদে না । তাদের তেমন কষ্ট হলেই তারা কাঁদে । ইরফান আজ নিরবে কাঁদছে । বেলীকে নিজের কলিজায় ঢুকিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছে তার । এইটুকুন একটা মেয়ে সে অথচ এই বয়সে সে কি কি সহ্য করে গেছে , তবুও মুখ খুলে নি । বেলী তখন ইরফানের বুকে থেকেই বলতে শুরু করে ,

– বুঝবেন বুঝবেন একদিন ঠিক বুঝবেন , আমি যেদিন থাকবো না সেদিন খুব করে বুঝবেন । আমি তখন আকাশের তারা হয়ে যাবো , আমি আর আমার বাবা তখন উপর থেকে দেখবো আপনি কিভাবে কান্না করেন । হারিয়ে যাবো আমি আপনার জীবন থেকে , তখন বুঝবেন , হ্যাঁ , দেইখেন তখন বুঝবেন ।

বেলীর কথা শুনে ইরফান বেলীকে আরও শক্ত করে ধরে রাখে আর বলে ,

– চুপ , একদম চুপ । তোকে হারাতে দিলে তো হারাবি ।
– বেলীফুল ঝরে যাবে ।
– কখনো না ,
– হ্যাঁ , দেইখেন আপনি বেলীফুল ঝরে যাবে । সেইদিন বেলীফুলের কবরের পাশে বসে শুধু চেয়ে দেখবেন আপনি আর বেলীফুল তখন মিশে থাকবে মাটির সাথে ।

বেলীর কথা শুনে ইরফান আবারও ধমক দিয়ে থামায় বেলীকে ।

– থামবি তুই , না হয় আবার মারবো কিন্তু ,
– মারেন , আরও মারেন ।
– হ্যাঁ মারবোই তো এইবার সত্যি সত্যি মারবো ।
– মারেন ,
– এখন কিন্তু মার খাবি বলে দিলাম ,
– হ্যাঁ মারেন , মেরেই ফেলেন আমাকে ।

ইরফান এইবার বেলীকে ছেড়ে দেয় । নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় বেলীকে । তারপর উঠে দাঁড়ায় সেইস্থান থেকে । বেলী তখনও বসা অবস্থাতেই আছে । ইরফান বেলীকে সেইভাবেই কোলে তুলে নেয় । কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয় বেলীকে । অঅন্ধকার রুমে ড্রীম লাইটের আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাই-ই অনেক । পাশে থাকা টাওয়ালটা দিয়ে বেলীর চোখের পানি নাকের পানি সব মুছে মুখটা পরিষ্কার করে দেয় ইরফান
। তখন বেলী চুপ করে থাকে আর ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে । ইরফান বেলীর মাথায় হাত রাখে ,

– ঘুমাও , আর একটা কথা না । কাল সব শুনবো আমি ।
-………………
– আর হ্যাঁ আমি আসলেই খারাপ মানুষ , কি করার আল্লাহ পাক তোমার ভাগ্যে এই খারাপ মানুষটাকে রাখছে । তাই কিছুই করার নাই । কাঁদবা না একদম , চুপচাপ ঘুমাবা ।

বেলী একদম চুপ করে শুয়ে আছে । চোখে তার ঘুমের নেশা । চোখ গুলো টিপ টিপ করছে আর বুজে আসছে । ইরফানের বেলীর মাথায় হাত বুলানোটা কাজে এসেছে । ইরফানের ডান হাতটা ধরে আছে বেলী । তারপর একটা সময় বেলী আস্তে করে ঘুমের রাজ্যে চলে যায় ।
বেলীর ঘুমন্ত চেহারার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ইরফান । বেলীর আজকের কথাগুলো ইরফানের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে । বেলী ঘুমানোর পর ইরফান বেলীকে রেখে নিজের রুমে যায় ।

ইরফান কখনো বাসায় স্মোক করে না । তবে আজ সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্মোক করছে । ঘড়িতে প্রায় ২ টা বাজে । রাত গুলো হয়তো এমনভাবেই কাটবে তার । এমন নির্ঘুম আর নিস্ত নিস্তব্ধ । বেলীর কথাগুলো বার বার কানে বাজতে থাকে ইরফানের , বেলীর কষ্ট গুলো বার বার বেলীকে মনে করিয়ে দেয় তার প্রতি ইরফানের করা পৈশাচিকতা গুলো । যা সে ভুলতে ভুলতেও ভুলে নি । হয়তো ভুলতেও পারবে না ।

একদিকে রুবি অন্যদিকে বেলী । রুবিকে সে ছাড়তে পারবে না যদি না রুবি চায় আর বেলী চাইলেও বেলীকে সে ছাড়তে পারবে না । এক সাথে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না । তেমনি দুই বউ নিয়ে চলা যায় না । হয়তো চলা যায় তবে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । সেইজন্যেই হয়তো বলে সবাই ,

” ভাবিয়া করিও কাজ , করিয়া ভাবিও না ”

হাতে থাকা সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে আগুন নিভিয়ে নিচে ফেলে দেয় ইরফান । বেলীর সাথে করা সমস্ত অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তাকে । অনেক সময় লস হয়ে গেছে । আর সময় নষ্ট করা যাবে না । পর মুহুর্তে বেলীর বলা কথাটা মনে পড়ে যায় ইরফানের ,

” দেইখেন আপনি বেলীফুল ঝরে যাবে । সেইদিন বেলীফুলের কবরের পাশে বসে শুধু চেয়ে দেখবেন আপনি আর বেলীফুল তখন মিশে থাকবে মাটির সাথে ”

বেলীর কথাটা অন্তরে দাগ কেটে গেছে । সে বেলীকে এইভাবে ঝরে যেতে দেবে না । আগলে রাখবে নিজের বুকের সাথে অতি যতনে ।

– বেলী আমি তোকে চলে যেতে দিবো না । মন পিঞ্জরে যতন করে আটকে রাখবো তোকে । তুই দেখে নিস এই ইরফান তোকে সেই সব খুশি দিবে যা তোর প্রাপ্য । আমার মনের মধ্যে রাখা পুরো জমিনেই তোর রাজত্য চলবে । দেখে নিস তুই ।

বিছানায় শুয়ে এইসব ভাবতে কখন যেনো ঘুম চলে আসে তার চোখে । মনের ভুলে বেলীর রুমেও যেতে ভুলে গেছে সে । নিজের রুমেই ঘুমিয়ে যায় সে নতুন এক ভোরের আশায় সেই সাথে নতুন করে সব ঠিক করার আশায় । যা আদৌ সম্ভব কিনা জানা নেই কারো ।

.
.

চলবে……………………..

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_২২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল থেকে বিকেল অবদি বেলী আর মিনু একা বাসায় । আজ ইরফান একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেছে । বেলী ঘুম থেকে উঠে ইরফানকে দেখতে পারে নাই । শরীর দুর্বল হওয়ার কারণে ঘুম আসলে আর সজাগ হতে পারে না সে । আজ দুই দিন ধরে নামাজ বাদ পড়ছে বলে আক্ষেপের শেষ নেই তার । আজ শরীরটা ভালো লাগায় নিজেই আস্তে আস্তে মিনুর সাথে মিলে সব কাজ করেছে । বিকেলের দিকে আসর নামাজ পড়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গতকাল রাতের কথা মনে করে বেলী ।

– গতকাল রাতে কি একটু বেশিই বলছিলান তাকে ? জানি না কেন জানি নিজের কাছেই লজ্জা লাগতেছে এখন । মানুষটা যেমনই করুক এখন তো আর খারাপ আচরণ করে না আমার সাথে । আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখে সে , তাহলে কিভাবে এত কিছু বললাম আমি । আজ দেখাও করে গেলো না আমার সাথে ।

নিজেই একা একা এইসব বলছে আ আফসোস করছে । এমন সময় ,

– দেখা কইরা যায় নাই তো কি হইছে ? কইয়া তো গেছে ।

মিনুর কথায় বেলী পিছনে ফিরে তাকায় । দেখে মিনু দাঁড়িয়ে আছে মাজায় হাত দিয়ে । মিনু মেয়েটা অতি ভালো , তবে চঞ্চল । মুখে সারাদিন হাসিই থাকে , মানুষের বাসায় কাজ করে খায় তবুও নিজের উপর পুরো আস্থা আর বিশ্বাস আছে তার । মিনুকে দেখে বেলীর মনে একটা কথা-ই আসে , ” মিনু না থাকলে আমি হয়তো কবেই শেষ হয়ে যেতাম ”
মিনু লাফিয়ে লাফিয়ে বেলীর কাছে আসে ,

– আহহহ মিনু !
– কিচ্ছে ?
– এইভাবে লাফাও কেন , নিচের ভাড়াটিয়াদের সমস্যা হবে তো ?
– হেতেগো সমিস্যা হইলে আমার কি আসে যায় । বাদ দে তো হেগো কতা । কার কতা আপনে এইহানে খাড়াইয়া খাড়াইয়া ?
– কই ?
– উহু , আমি তো হুনছি ।
– আমি যে কেন আজ দেরি করে উঠলাম ?
– তয় কি অইছে ?
– উনি কি নাস্তা করে গেছে ?
– হ এক পিচ বেরেড আর এক গেলাস পানি খাইছে ।
– ব্যাস এইটুকুই ?
– হ
– ইদানীং সে তেমন কিছুই খায় না ?
– আপনে মনে হয় কত খান ?
– কিছু বলে গেছিলো ?
– কইছিল বেলীর দিকে খেয়াল রাখিস । ভাইয়ে ভালাবাসে আপনারে ।
– জানি নাগো ।
– দেইখেন , তার মন আপনারেই চায় ।
– কিন্তু রুবি আপু ?
– হেই অসিভ্য মাতারি গুল্লি মারা খাউক ।
– ছিহ কি সব বলো মানুষ সম্পর্কে ?
– কম তো জ্বালায় নাই আপনারে ।
– সে করছে বলে তো আর আমি করতে পারবো না তাই না ।
– তয় যান , গিয়া আদর কইরা সতীন লইয়া আসেন । হুনেন ভাবী , আপনে বাঁচলে বাপের নাম বুজ্জেন । আমি যদি না বাঁচি বাপরে লইয়া ভাবুম কোন সময় ।
বহুত অইছে , এহন নিজের কতা ভাবেন ।
– ভাবতেই চাই কিন্তু পারি না যে ?
– অন্তরডার মইধ্যে অনেক কষ্ট , কেন ?
– যন্ত্রণায় বুকটা ব্যাথা করে , কলিজাটা ফেটে যায় । একবার যদি তাকে আপন করে পেতাম ।
– পাইবেন ভাবী , পাইবেন ৷ আল্লাহ পাক আপনের জন্যে অনেক ভালা কিছু রাখছে , পাইবেন আপনে ।

মিনুর কথায় একটু হলেও সাহস পায় বেলী । জীবনের গল্পটা হয়তো এক এক সময় এক এক রকম মোড় নেয় । নতুন মোড়ে গিয়ে জীবন নতুন কিছু শিখতে পারে ।

অন্যদিকে অফিসে কাজের ফাঁকে ইরফান একবার রুবিকে ফোন করে । ভেবেছিল রুবির সাথে কথা বলা প্রয়োজন । তাই ফোন দিয়েছি রুবিকে । দুই থেকে তিনবার ফোন যাওয়ার পর রুবি ফোন রিসিভ করে ।

– কি হয়েছে ?
– ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিতে হয় রুবি ?
– ধুর , এত সালাম দেয়ার সময় নাই আমার , হয়েছে কি তাই বলো ।
– বাড়ি ফিরবে না ?
– কেন , তোমার সো কলড বড় বউয়ের সেবা যত্ন করতে হবে নাকি ?
– এইভাবে কেন কথা বলো রুবি ?
– এই শুনো শুনো আমার সাথে একদম নাটক করবা না , ওকে ? হয় ওই মেয়েকে তাড়াও নয়তো আমি এখানেই থাকবো ।
– আমরা স্বামী স্ত্রী রুবি ।
– তো কি হয়েছে এখন ? স্বামী স্ত্রী বলে কি আমি তোমার ওই বউয়ের সাথে থাকবো নাকি ? এটা তো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ।
– আগে কিভাবে ছিলা ?
– আগের সিচুয়েশান অন্য ছিল আর এখনকারটা অন্য ।
– উহু , সিচুয়েশান একই আছে । তুমি পালটে গেছো । আগে বেলীকে মারধর করতাম বলে আমি ভালো ছিলাম । রোজ আমায় নিয়ে ও-কে দেখিয়ে দেখিয়ে অনেক কথা বলতে পারছো তাই ভালো লাগছে এখন আমি তাকে মারধর করি না আর তার কাছে আমায় নিয়ে বাড়তি কিছু বলতেও পারো না তাই এখন আমি খারাপ সিচুয়েশানটাও অন্য রকম হয়ে গেছে । তাই না রুবি ?
– অনেকটা সেই রকমই , হয় বেলী নয় রুবি । বাকিটা তোমার ডিসিশন ।
– আমি যদি বলি বেলীকে ছাড়া সম্ভব না তখন কি করবা তুমি ?
– হা হা আমি তোমায় ছেড়ে দিবো ।
– রুবি,,,,,,,,,?
– কি হলো , অবাক হলা নাকি ?
– অবাক না , শিহরিত হলাম সাথে উল্লাসিতও ।
– হওয়া ভালো ।
– এই ভালোবাসলা আমায় , জানো তো রুবি , বেলী কিন্তু তুমি থাকার পরেও আমায় ছেড়ে যায় নি ।
– ওইটা দেখে অশিক্ষিত বর্বর গাইয়া ভূত , আমি কি ওর মত নাকি , আজ রাস্তায় দাড়ালে হাজার ছেলের লাইন লাগবে , আমার বাবার অঢেল আছে । তখন কেউ দেখবে না আমার বিয়ে একটা হয়েছিল নাকি দশটা হয়েছিল ।
– ছিহ রুবি ? এইভাবে বলতে পারলা তুমি ?
– পারলামই তো , আগেই তো বললাম হয় আমি নয় ওই মেয়েটা ।
– আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম অন্যকিছু ভেবে , কিন্তু তুমি যা বললা তাতে আমি খুব খুশি হলাম ।
– বেশ , ডিসিশন জানিয়ে দিও । আমি ওইভাবেই আগাবো ,
– কিভাবে ?
– আইনিভাবে , রাখছি ।

রুবি লাইনটা কেটে দেয় । আইনিভাবে এগুবে তার মানে ও ডির্ভোসের দিকে যাবে । ভাবতেই হালকা হাসি দেয় ইরফান । আজ নিজেকে পৃথিবীর সেরা গর্দভ মনে হচ্ছে তার । এ কাকে বিয়ে করেছিল সে , যে নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পা নড়ে না ।

– জীবনে মাকে দেখি নি । তবে নারী দেখলান , দু’রকমের নারী । এক রকম নারী হয় যারা নিজেকে উজাড় করে দেয় অন্যের ভালোবাসার কাছে । অন্যকে ভালোবেসে নিজের সব দিয়ে দেয় । অন্যের কাছ থেকে কিছু না আশা করেই বিলীন করে দেয় নিজেকে । আর আরেক নারী দেখলাম , যে শুধু নিজেরটাই বুঝে । নিজের ভালো থাকা নিজের মন্দ থাকা নিজের সৌখিনতা সবটাই বুঝবে । যে নিজের ইগো’র জন্য আমায় ছাড়তে রাজি , সে কি আদৌ আমার স্ত্রী ? আজ মুক্ত কন্ঠে বলতে ইচ্ছে করে হ্যাঁ , আসলেই আমি একজন খারাপ মানুষ । যে কিনা এক মহীয়সী নারীকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছি । আল্লাহ পাক হয়তো এর শাস্তি আমায় রুবিকে দিয়ে দেখালেন । আর বেলীর নিরবতা আমার বন্ধ চোখকে খুলে দিয়েছে ।

নিজের কেবিনে বসে ভুল গুলো স্মৃতিচারণ করে নেয় ইরফান । আসলেই তার হয়তো এইবার চোখ খুলে গেছে । ডেস্ক থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে গ্যালারিতে যায় সে । সেখানে গ্রামের বাড়িতে বেলীর কিছু ছবি ছিল । ছবিতে নিজের নজর রাখে সে ।

– তুই বেলী একটাই রে । আমি ধন্য তোকে পেয়ে । তুই-ই সেই নারী যে কিনা আমায় নিয়ে বেহেস্ত পর্যন্ত যেতে পারবি । তুই বেলী হাজারে একটাই হোস । ভালোবাসিরে অনেক ভালোবাসি । তোকে যতটা না ভালোবাসি ততটাই নিজেকে ঘেন্না করি না । ছোট হয়ে গেলাম নিজের কাছে নিজে ।

চোখ জোড়া মুছে নেয় ইরফান । আজ কেন যেন নিজের চোখ দিয়ে ক্রমশ পানি বের হচ্ছে তার । কিসের জন্যে বুঝতে পারছে না । তবে এই পানি হয়তো দুঃখের নয়তো সুখের । হয়তো রুবির করা স্বার্থপরতা অথবা বেইমানির জন্যে নয়তো বেলীর উজাড় করা ভালোবাসার জন্যে ।

সময় এসে গেছে সব ঠিক করার । এরপর হয়তো আর সময় নাও থাকতে পারে । ভুল গুলো শুধরে নিতে হবে । না হয় যে

” সময় গেলে আর সাধন হবে না ”

.
.

চলবে…………………

[ বিঃদ্রঃ রুবির বলা কথা গুলো সেইসব পর্যায়ের যে পর্যায়ে মানুষ একদম স্বার্থপর হয়ে যায় । হ্যাঁ , একজন নারীর একাধিক রুপ হয় । যখন সে ভালো তো ভালো , যখন সে খারাপ তো খুব খারাপ । তবে রুবির মত এমন অনেকেই আছেন আমাদের সমাজে আর আমার চোখের দেখাতেও যে কিনা অন্য মেয়ের সুখ সহ্য করতে পারে না । নিজের নিজের নিজের সব সময় নিজের জন্যই ভাবা । হ্যাঁ , নিজের জন্য ভাবা ভালো তবে সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে নয় । কখনো কখনো সেক্রিফাইজ জিনিসটাও প্রয়োজন । সেক্রিফাইজ করতে পারে হয়তো বেলীর মত মেয়েরা । একটা পয়সার দুটো দিক তেমনি সমাজের সব নারী আবার সব পুরুষ এক নয় । ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষ হয় । রুবিকে দেখেই বোঝা যায় নারীজাত কেমন হয় আবার অন্যদিকে বেলীকে দেখেও বোঝা যায় নারীজাত কতটা নরম হয় । যে কিনা সারাজীবন মুক্ত হস্তে নিজের সুখ শান্তি বিলীন করে দিয়ে সবাইকে ভালোই রেখে যায় । হয়তো কোন এক সময় পারি দেয় পরপারে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here