ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_২৪,২৫

0
328

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_২৪,২৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
২৪

বেলীর চাওয়া জিনিস গুলো বড় অদ্ভুত লাগছিল ইরফানের কাছে । ইরফান ভেবেই পাচ্ছিলো না বেলী কেন এইসব চেয়ে বসলো । আবার পরে ভাবে দেখে সবারই তো পছন্দের রঙ আছে । হয়তো বেলীরও পছন্দের রঙ সাদা । আর নিজের নাম বেলী তাই হয়তো ফুলের মাঝে বেলীফুলটাই তার বেশি পছন্দের । কিন্তু পরক্ষনেই তার আবার মন অন্য কিছু ভাবতে থাকে । বেলীর কাছে যাওয়াটা , বেলীকে খুব কাছ থেকে ছোয়া , বেলীর চুপচাপ থাকাটা বড্ড বেশি তাকে টানে । এ যেনো এক ধরনের অন্যরকম টান । বেলীর মায়াভরা চাহনিটা তাকে বার বার ঘায়েল করে দিচ্ছে । মন চায় বেলীকে ঘিরেই থাকতে সারাক্ষণ । ইরফানের সারারাত কেটে যায় বেলীকে ভেবে ভেবে ।

সকালের দিকে ইরফান অফিস যাওয়ার আগে বেলীর সাথে দেখা করার জন্যে তার রুমে যায় । বেলী তখন জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । আকাশের বুকে হাজারো সাদা মেঘের ছোটাছুটি দেখে নিজের ঠোঁটের কোণায় এক টুকরো মিষ্টি হাসি আসে তার । মাঝে মাঝে এই অকারণের হাসি গুলোও তার ভালো লাগে অনেক । ইরফান পিছন থেকে বেলীর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকাটা দেখছিল । বেলী বড্ড উদাসীন থাকে । ইরফান নিজের মনে মনে ভাবে , কাল তো শুক্রবার অফডে । বেলীকে নিয়ে বের হবে কাল সে । এতে বেলীর মন মানষিকতাও ঠিক হবে কিছুটা । তারপর কি যেনো ভেবে বেলীকে কিছু না বলেই চলে গেলো সে । বেলীর রুম থেকে বেরিয়ে অফিস চলে যায় সে ।

অন্যদিকে , বেলী আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশের রঙ বদল দেখছিল । সবার থেকে হয়তো ওই আকাশটাই ভালো আছে । আকাশ সবার জন্যে ভাবে । আকাশের মনটা বড্ড বেশি বিশাল । সে তার এক বক্ষে কত কিছু ধারণ করে রেখেছে । এক বুকেই সূর্য , এক বুকে চন্দ্র , আবার এক গ্রুপেই গ্রহ নক্ষত্র । আর যখন মন খারাপ থাকে তখন নিজে কেঁদে অন্যদের সুখ দেয় । সব মিলিয়ে দিন শেষে আকাশটাই হয়তো অনেক বেশি ভালো থাকে । হঠাৎ করেই চারপাশ থেকে একটা ঘ্রাণ আসতে থাকে । ঘ্রাণটা বেলীর নাকে আসতেই এক অন্যরকম অনুভূতি জাগে তার মনে । বেলী চারপাশে খুজেও ঘ্রাণের সন্ধ্যান পায় না । ঘ্রানটার পরিধি এতই প্রখর ছিল যে নাক থেকে সরছেই না । বেলী ড্রইংরুমে এসে দেখে ড্রইংরুমেও ঘ্রাণটা । পুরো বাসা মনে হচ্ছিলো ঘ্রাণে মম করছে । সে মিনুকে ডেকে দেয় ,

– মিনু,,,,,,,,,,,,?
– জ্বে ভাবী ,
– মিনু , ঘ্রাণ পাচ্ছো ?
– কই , কিয়ের ঘেরান আবার ?
– হ্যাঁ , একটা ঘ্রাণ আসছে , আমি পাচ্ছি তো ।
– কি জানি ভাবী আমি তো পাই না , তয় আমার আবার নাক বন্ধ , এল্লাই মনে হয় আমি পাই না ।
– তোমার ভাই কি চলে গেছে ?
– হ , গেছে গা । ভাবী দুফুরে কি রানবেন কইয়া দেন , আমি ব্যবস্থা করি ।
– আমিই আসতেছি তুমি বরং প্লেটবাটি ধুয়ে দাও ।
– আইচ্ছা ভাবী ,
– হু ,

মিনু চলে যাওয়ার পর বেলী একবার ইরফানের রুমে যায় । ঘ্রাণটা সেইখান থেকেই আসছিল । রুমের মধ্যে ঢুকে এদিক ওদিক তাকায় বেলী । ইরফানের রুমের ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা পারফিউম এর বোতলের দিকে বেলীর নজর যায় । বেলী তখন পারফিউম এর বোতল থেকে নিজের হাতে একটু পারফিউম মেখে নাকের কাছে নেয় । হ্যাঁ এটা সেই ঘ্রাণটা যা এতক্ষন বেলীর নাকে লাগছিল । তার মানে এটা ইরফান দিয়ে গেছে ।
তার পর পরই তার মাথায় আসে এই ঘ্রাণ তাহলে তার রুমে গেল কিভাবে । বেলী নিজে নিজেই বলতে থাকে ,

– তার মানে কি তিনি আমার রুমে গেছিলেন ? গিয়ে থাকলে কথা বললেন না কেন ? আর কখন গেল আমি যে দেখলাম না ?

এইসব ভেবে ভেবে বেলীর মনটা উদ্বিগ্ন হয়ে যায় । তার মনটা এখন এই মুহুর্তে ইরফানের সাথে কথা বলতে চাইছে । ইরফানের গলার স্বরটা একবার নিজ কানে শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে তার । তার অন্তরটা একবার হলেও এই মুহুর্তে ইরফানের সাথে কথা বলতে চাইছে । কিন্তু কথা কিভাবে বলবে তার কাছে তো ফোন নেই । আর ইরফানের নাম্বারও তো জানা নেই তার । কিন্তু সব কিছুর কথা বাদ দিয়েও তার এখন ইরফানের সাথে কথা বলতে মন চাইছে ।

হঠাৎ করেই কোথাও থেকে একটা মোবাইলের আওয়াজ বেলীর কানে আসতে থাকে । রুমের এদিক সেদিক বেলী তার নজর ঘুরায় । কিন্তু কোথাও মোবাইল দেখতে পায় না সে । তাই মোবাইল খুজতে ড্রইংরুমে যায় সে । বেলী চারদিকে চোখ ঘুরাচ্ছে কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছে না । মিনুও মোবাইলের আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘর থেকে চলে আসে ।

– ভাবী , মোবাইলের আওয়াজ আইয়ে কইত্তে ?
– বুঝতেছিনা তো ,
– ভাইয়ে কি মোবাইল রাইখা গেছে নাকি ?
– কি জানি হতেও পারে কিন্তু মোবাইলটাই তো দেখছি না ।
– ও ভাবী ,
– হু বলো ,
– মোবাইলের আওয়াজ দেহি আপনের রুমেরতে আইয়ে ।
– কি বলছো ?
– হ ভাবী , কান পাতেন , তাইলেই বুঝবার পারবেন ।

মিনুর কথায় কিছুক্ষন চুপ থাকার পর বেলী বুঝতে পারে মোবাইলের আওয়াজ তার ঘর থেকেই আসছে । তাড়াতাড়ি দৌড়ে নিজের ঘরে যায় সে , মিনুও তার পিছন পিছন যায় । সেখানে আশেপাশে তাকানোর পর ড্রেসিং টেবিলের এক কোণায় সাদা কাগজে মোড়া একটা ছোট প্যাকেট দেখতে পায় তারা ।

– ভাবী এইডার থিকাই আওয়াজ আইতাছে , খুইলা দেহেন তো ।

বেলী তখন কাগজে মোড়ানো প্যাকেট টা খুলে । আর খুলেই চরমভাবে অবাক হয় সে , সাথে মিনুও । একটা মোবাইল আর যার ফোন বাজছে তার নাম টাও সেভ করা আছে । বেলী মোবাইলের স্ক্রিনে ইরফান নামটা অতি সহজেই ধরে ফেলে ।

– ও মাগো মা , ভাইয়ের মোবাইল এইদিকে নি থুইয়া গেছে ।

কিন্তু বেলী জানে যে এটা ইরফানের মোবাইল না । সে ইরফানের মোবাইল দেখেছে আর এই মোবাইলটা ইরফানের মোবাইল না । এটা একদম নতুন , বেলী মিনুকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দেয় । তখন দরজাটা হালকা টেনে দিয়ে সে মোবাইলটা রিসিভ করে । বেলীর পড়াশোনা যদিও কম কিন্তু সে একেবারেই মূর্খ নয় যে ফোন রিসিভ করতে পারবে না । আর ইংলিশ মোটামুটি যা পারে তা যথেষ্ট তার জন্যে । তাই ইরফানের নামটা ধরতে তার সময় বেশি লাগে নি । মোবাইলে তখনও রিং হচ্ছে । বেলী ফোন রিসিভ করে নেয় ।

– আসসালামু আলাইকুম ,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , অবশেষে খুজে পেয়েছো ?
– হু ,
– এইজন্যই আমি বার বার ফোন দিচ্ছিলাম যাতে আওয়াজ পেয়ে অন্তত খুজে পাও ফোনটা ।
– হু পাইছি , কিন্তু এইটা কার ফোন আর এই রুমে এইভাবে রেখে গেছেন যে ?
– ফোনটা তোমার জন্যে , গতকাল রাতেই কিনেছিলাম আজ দিলাম । সব কিছু সেভ করা আছে । এখন যখন ইচ্ছে তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে পারবে ।
– এইটা আমার ফোন ?
– হু ,
– আমার রুমে এসে আমার সাথে দেখা না করে চলে গেলেন সে ?
– ওইটা তো তোমার রুম যেদিন থেকে ওইটা আমাদের রুম হবে সেইদিন থেকে আমি তোমার সামনে থেকেই বিদায় নিবো ।

ইরফানের কথার ধাচ বুঝতে বেলীর সময় লাগে নি । সে বুঝে যায় ইরফান কি বোঝাতে চেয়েছে তাকে । তবে বেলী আর সেই কথা না বাড়িয়ে ইরফানকে আবারও সাদা শাড়ি আর বেলীফুলের মালার কথা মনে করিয়ে দেয় ।

– আজকে আসার সময় নিয়ে আসবেন তো ?
– কি ?
– সাদা শাড়ি আর বেলীফুলের মালা ।
– আচ্ছা নিয়ে আসবো ।
– কি করেন এখন ?
– এইতো কেবিনেই বসে আছি ।
– ওহ ,
– আমায় এত ভালোবাসো অথচ কাছে আসতে দেও না কেন বেলী ?

ইরফানের কথায় বেলী একদম চুপ হয়ে যায় । কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে লাইন কেটে দেয় । ইরফান বুঝে যায় তার কথার জন্যে বেলী লাইন কেটে দিছে । ইরফান আবারও ফোন দেয় । এইবারও ফোন রিসিভ করে সে ।

– ফোন কেটে দিয়ে কি হলো ?
– কিছু না ,
– বেলীফুলকে ভালোবাসার মাঝে আলাদা মজা আছে । এর কারণ কি জানো ?
– কি ?
বেলীর ঘ্রাণে মাতাল হয়ে গিয়ে
সেই মাতালের মাঝে নিজেকে
বিলীন করে তোমায় আঁকড়ে ধরে
নিজের শরীরের ছাপ ফেলে দিবো

এর মাঝে অন্যরকম মজা আছে কিন্তু । এইবার বেলীর লজ্জা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায় ।

– এইসব কঠিন শব্দ আমি বুঝি না আল্লাহ হাফেজ ।

এটা বলেই লাইন কেটে দেয় বেলী । ইরফানের রোমান্টিক কথাগুলো তার উপর প্রভাব ফেলে দিচ্ছিল তাই সে লাইন কেটে দেয় ।
আর অন্যদিকে বেলীর কথা ভেবেই ইরফান মুচকি হাসি দেয় ।

সারাদিন পরে সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর ইরফান বাসায় আসে । এখনও সে আলাদা রুমেই থাকে । বেলীর কাছে যেতে অনেক ইচ্ছে করে তার কিন্তু বেলী রেসপন্স করে না তাই আর যেতে ততটা ভালো লাগে না । অফিস থেকে আসার সময় বেলীর জন্যে সাদা শাড়ি কিনে আনে ইরফান । সেই শাড়িটা দিতেই কেবল বেলীর রুমে যায় সে ।

– বেলী,,,,,,,,,,,,?
– জ্বি ,
– এই নাও তোমার শাড়ি ,
– আর মালা ?
– সেটা কাল এনে দিবো ,
– ওহ ,

বেলী ইরফানের সামনেই শাড়ির প্যাকেটটা ড্রয়ারে দেখে দেয় ।

– খুলে দেখলে না ?
– উহু , তার দরকার পড়বে না ।
– তোমার না-ও পছন্দ হতে পারে ।
– আপনি এনেছেন তো , শাড়িটা বেশ সুন্দরই হবে ।
– কাল শাড়িটা পরবে ?
– কাল ?
– হু , কাল বিকেলে তোমায় নিয়ে বের হবো ।

কিন্তু বেলী যে ভেবেছিল শাড়িটা আজকে পরবে সে । আর এখন ইরফান চাইছে কাল পরতে । বেলীও না ভেবে বলে দিয়েছে ,

– আচ্ছা কাল পরবো ।
– বের হওয়ার আগে তোমার বেলীফুলের মালা পেয়ে যাবে তুমি ।
– আচ্ছা ।

ইরফান বের হতে নিলে বেলী আবার ডেকে দেয় তাকে ,

– কোথায় যান ?
– রুমে , চেঞ্জ করবো ।
– এখানেই করে নেন ?
– জামা কাপড় ওই রুমে ,
– জামা কাপড় সব এখানেই রাখা আছে ,
– মানে ?
– মানে আজ থেকে এটা আমাদের রুম ।

এটা বলে বেলী রুম থেকে বের হতে নেয় আর ওমনি ইরফান বেলীর হাতটা ধরে নেয় । তারপর একদম নিজের কাছে নিয়ে আসে সে বেলীকে । নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে বেলীকে ইরফান । বেলীকে তখন অনেকটা পুতুলের মত লাগছিল । মাথায় ওড়নাটা দুই পেচ করে পরা তার ।

– এইদিকে তাকাও আমার দিকে ,,,

ইরফানের কথায় মাথা তুলে তাকায় বেলী । ইরফানকে বেশ সুন্দর লাগছিল । একদম সুদর্শন পুরুষের মত । বেলীর চোখে ঘোর লেগে যায় । বেলীর চোখের ভাষার মাঝে হারিয়ে যায় ইরফানের দৃষ্টি ।
নিরবতা ভেঙে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেলীকে প্রশ্ন করে সে ,

– আমাদের রুম মানে ?
– হ্যাঁ , এটা আজ থেকে আমাদের রুম । এই রুমে আজ থেকে আমি আর আপনি এক সাথে থাকবো ।
– ভেবে বলছো তো ?
– হু ,
– সহ্য করতে পারবে তো ?
– কি ?
– আমার ভালোবাসার যন্ত্রণা গুলো সহ্য করতে পারবে ?
– আপনার মা’রের যন্ত্রণা গুলো সহ্য করে গেলাম তো , এখন না হয় এই যন্ত্রণাটাও সহ্য করে দেখি ।
– এই যন্ত্রণার ব্যাথা আরও প্রখর , ভেবে দেখো আরেকবার ।
– ভাবা শেষ , এখন শুধু,,,,,,,,,,
– কি ?
– ধরা দেবার পালা ।

বেলীর কথায় ইরফানের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় মনে হচ্ছিল । ইরফানের মাথায় তখন অন্য কিছুই আসে নি । বেলীর দু’গালে ইরফান তার দু’হাত দিয়ে ধরে বেলীর আরও কাছে চলে যায় । ঠিক তখনই বেলী আবার সেই ঘ্রাণটা পায় । যা ইরফানের শার্ট থেকে আসছিল । ঘ্রাণটার মাদকতা এতই তীব্র ছিল যে , বেলীর ভেতরের সব কিছু নড়বড়ে করে দিচ্ছে । বেলীর চিকন ঠোঁট জোড়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া ইরফান তখন যেন সব কিছু ভুলে গেছে । দু’জোড়া ঠোঁটের মাঝে হয়তো সর্বোচ্চ এক ইঞ্চি ফারাক ছিল । আর ঠিক তখনই ,

– ভাবীইইইই , ও ভাবীইইইই , আইজ্জা কি রুমের ভিত্রেই থাকবেন নি । মাগো মা , ভাইয়ের লাই কফি বানাইতেন না ?

মিনুর এমন চিল্লানিতে বেলী আর ইরফান উভয়েরই হুশ আসে । বেলী তখনই ইরফান থেকে একটু সরে আসে ,

– আপনি হাত মুখ ধুয়ে নেন , আমি কফি বানিয়ে আনছি ।
– ভয়ে দূরে সরে যাচ্ছো ?
– উহু ভালোবাসার মাঝে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরার জন্য এই সরে যাওয়া । আর হ্যাঁ পারফিউমের ঘ্রাণটা অনেক সুন্দর , অনেক বেশিই সুন্দর ।

বেলী এইটা বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায় । এর ইরফান তখন সেখানেই দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে দেয় ।

– ভিষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছে রে বেলী ,
ভিষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছে আমার । প্রেম করতে ইচ্ছে হয় তোর সাথে । বেলীফুলের সাথে নতুন প্রেমের অধ্যায় টা এইবার না হয়ে যাক

চলবে,,,,,,,,,,,,

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_২৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রাতের খাওয়ার পর ইরফান ড্রইংরুমে বসে কাজ করছিল ল্যাপটপে । বেলী সব গুছিয়ে নিজের রুমে যায় । আজকে বাহিরের আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর । চারপাশে ঝিঝি পোকা ডাকছে । রাত বাড়ার সাথে সাথে পরিবেশটা অনেক শান্ত হয়ে যায় । এই শান্ত পরিবেশের মাঝে বিলীন করেও শান্তি পাওয়া যায় । জানালার পাশে এসে বেলী শান্ত আকাশে নিজের দৃষ্টি রেখেছে । এরই মাঝে মিনু রুমে আসে ,

– ভাবী ,,,,,,,
– হু ,
– আইয়েন লুড্ডু খেলি ,
– এখন ?
– হ , আইয়েন ।
– কোথায় পাইলা এইটা ?
– বাইত্তে নিয়া আইছি হিহি , আইজ্জা বাইর করছি আইয়েন খেলি ।
– চলো ,
– হুনেন আগেই কই , আমার গুডি খাইবেন না , মনে করেন আপনেত কানা ফড়লো , কিন্তু কানায় আমার গুটি যাইবো , খাইয়েন না কইলাম ।
– গুটি না কাটলে মজা লাগবে না তো ,
– যা হইয়া যাক , আপনে আমার গুডি খাইবেন না ,
– আচ্ছা ,

মিনুর এই দুষ্টুমিপণা গুলো বেলীকে বেশ আনন্দ দেয় । দুজনে বসে যায় লুডুর ঘর নিয়ে । মিনুর ঘেনর ঘেনর এখনও চলছে ,

– ভাবী আমার গুডি খাইবেন না কইয়া দিলাম ।
– আচ্ছা , শুরু করো ।

দুজনে মিলে প্রায় অনেক্ষন যাবত লুডু খেলেছে । এক পর্যায়ে ইরফানের ডাকে তাদের হুশ আসে । ইরফান তাদের লুডু খেলা দেখছিল অনেক্ষণ যাবত । খেলার শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইরফান বেলীকে আর মিনুকে ডাক দেয় ।

– মিনু,,,,,,,,,,,,,,,,?
– জ্বে ,
– খেলা হয়েছে ?
– হ ভাই , যা ঘুমাতে যা ,
– আইচ্ছা
– এই দাঁড়া , এটা রেখে যা ।
– আপনেও কি খেলবেন নি ভাই ,
– তুই রেখে যা ।
– আইচ্ছা ।

মিনু চলে গেলে ইরফান দরজা লাগিয়ে দেয় । বতারপর বেলীর সামনে এসে বসে সে । তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । বেলী তখন চুপ করে নিচে তাকিয়ে আছে ।

– তুমি লুডুও খেলতে পারো ?
– না পারার কি আছে , পারি তো ।
– তাহলে আমার সাথে এক গেইম খেলো ,
– আচ্ছা ,
– আগে ডিল ফাইনাল হোক ,
– কিসের ডিল ?
– আমি যদি জিতে যাই তুমি কি কি করবা আর তুমি জিতে গেলে আমি কি কি করবো ।
– এইগুলা সব ভাওতাবাজি ,
– কিহহহ !!!
– নাহ মানে এইসব করার কি দরকার ?
– আছে বলেই বলছি ,
– আচ্ছা বলেন তাহলে ,
– ওকে , যদি আমি জিতে যাই তাহলে তুমি গুনে গুনে ১৫ টা চুমা দিবা আমাকে ।

ইরফানের মুখ থেকে এই কথা শুনে বেলীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা । এইটা সে কি বললো ? এইসব কি আদৌ সম্ভব ।

– কি সব বলেন আন্দাজে ?
– হ্যাঁ ,
– আমি খেলবো না ,
– আমি কিন্তু না-ও জিততে পারি ।

পরে দিয়ে বেলী আবার ভাবে , হ্যাঁ সে তো না-ও জিততে পারে । সে একাই যে জিতবে এর কি গ্যারান্টি আছে ? বেলীর ভাবনার মাঝে ইরফান আবারও ডাক দেয় তাকে ,

– এইযে ,,,,,,,?
– হু ,
– কি ভাবেন ?
– কিছু না ,
– তো রাজি কিনা তাই বলো ,
– আচ্ছা রাজি , আর আমি জিতলে ,
– তোমায় জিততে দিলে তো (গুনগুন করে)
– কি বলেন , কাচুমাচু করে ,
– নাহ মানে তুমি জিতলে আমায় ভালোবেসে জড়িয়ে ধরবা । ব্যাস
– একই তো হলো ,
– কি ,
– এইযে , জিতলেও আপনার লাভ আর আমি জিতলেও আমার লস ,
– এটায় লস পাইলা কই ?
– শুরু করেন ।

ইরফান আর বেলী খেলতে বসে যায় । কেন জানি প্রথম শুরুতেই ইরফানের দুই ছক্কা পড়ে । আর তার পর পর ছক্কার উপর ছক্কা তার উপর ছক্কা তার উপর ছক্কা । আর ইরফান ইচ্ছে করে বেলী বেচারির সব গুটি কেটে দিচ্ছে । বহু কষ্ট করে পুরো ঘর ঘুরে যেই পাকাবে তখনই কেটে দেয় । রাগে দুঃখে বেলীর চোখে পানি এসে গেছে । বার বার গুটি কেটে দিচ্ছে । আর সহ্য করতে পারে নি সে ।
ধুম করে এক ধমক দিয়ে ওঠে ইরফানকে ,

– খেলবো নায়ায়ায়া ,
– কেন ?
– আপনার সাথে আমার কোন জন্মের শত্রুতা , এইভাবে গুটি গুলা কাটতেছেন ।
– তো সামনে পড়লে কাটবো না ?
– তাই বলে এইভাবে ? আপনি তিন টা গুটি পাকিয়ে ফেলছেন , আর আমার এখনও দুইটা গুটি কাচা । এইসব কি ?
– তো তোমার ছক্কা না পড়লে আমি কি করবো ?
– খেলবো না আমি ,
– আরে কি আজব , আচ্ছা আর কাটবো না , কথা দিলাম ।
– এখন আর কথা দিয়া কি হবে , সব গুলা গুটি কেটে রেখে দিছেন ।
– বাপ্রে বাপ নিমজ্জিত বেলীফুল হঠাৎ ফাল মেরে উঠলো কেন ?

ইরফানের কথায় বেলী আবার চুপ হয়ে যায় । মাথা নিচু করে বেলী মনে মনেই বলা শুরু করে দেয় ,

– রাগের চোটে ওনার সাথে এইভাবে চেঁচিয়ে ওঠার মানে কি হলো ? ইসসসস , কি ভাববে উনি ।

তারপর কিছুক্ষণ নিরবতার মাঝেই খেলা চলতে থাকে । আর তারপর , খেলার সমাপ্তি হয়ে যায় । বেচারি বেলীটা তিন গুটিয়ে গেইম হেরে যায় ইরফানের সাথে । ইরফান জিতে গিয়ে রাজ্য জয় করা হাসি দেয় । আর বেলীর ভেতরটা রাগে ফেটে যাচ্ছে । বেলী উঠে যেতে নিলে ইরফান তার হাতটা ধরে ফেলে । তারপর টান মেরে নিজের কাছে বসিয়ে নেয় ।

– কিছু বলবেন ?
– হু ,
– বলেন ,
– আমার ১৫ টা চুমা বাকি রয়ে গেছে তো ,
– আপনি ইচ্ছা করে এইভাবে আমার গুটি গুলা কেটেছেন ।
– খেলার কথা বাদ । খেলার আগে যেই ডিল হয়েছে তা পূরণ করার ব্যবস্থা করো ।
– আপনি দুই নাম্বারি করেছেন , মিনু আপনার থেকে অনেক ভালো খেলে ।
– তো এখন কি চুমা মিনুকে দিবা ?
– ধুর , ছাড়েন ।
– আমার ১৫ টা চুমা দিয়ে দেও । আমিও ছেড়ে দেই ।

বেলী কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছে না । এইদিক দিয়ে ইরফানের ডিলেও সে রাজি হয়েছিল । এখন কথা যখন দিয়েছে রাখতে তো হবেই । কিন্তু বেলীর চোখে মুখে সংকোচনের আভা দেখা দিয়েছে । ইরফান বেলীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে । লজ্জায় মেয়েটা তাকাতে পারছে না । ইরফান বার বার বেলীর চোখ মুখের দিকে তাকাচ্ছে ।

এইবার ইরফান বেলীর একদম কাছে চলে যায় । বেলীর মাথা থেকে দুই পেচ এর ওড়নাটা খুলে দেয় সে । ইরফান তার ওড়না খোলার সময় ভেতরে তার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল । গলা থেকে কলিজা অবদি তার সবটা শুকিয়ে যাচ্ছে বেলীর । কিছুই বলে নাই সে । ইরফান বেলীর শরীর থেকে পুরো ওড়নাটা সরিয়ে নেয় । ইরফান তখন আরও কাছে চলে আসে বেলীর । বেলীর চুলের খোঁপার কাটা টা ইরফান খুলে দেয় । লম্বা চুলগুলো তখন খাটে গিয়ে পড়ে । ইরফান যেন ঘোরে আছে , আর তার ঘোরের মাঝেই আটকাতে চাচ্ছে বেলীর ঘোরের বাঁধন । বেলীর বাম গালে তার ডান হাত রেখে বেলীর মুখ নিজের মুখ বরাবর রাখে ইরফান ।

– আমার দিকে তাকাও ,
-,,,,,,,,,,,,,
– আমার চোখের দিকে তাকাও ,
-,,,,,,,,,,,,,,,
– তাকাবা না ?

তখন বেলী বন্ধ মুখে শান্ত নয়নে ইরফানের দৃষ্টিতে তার দৃষ্টি রাখে । ইরফানের চোখ জোড়া কেমন যেনো লাল হয়ে আছে আর চোখের মাঝ বরাবর হাল্কা পানি চিল চিক করছে । ইরফান বেলীর কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলতে শুরু করে ,

– শুরু করো ,
-,,,,,,,,,,,
– কি হলো , এই প্রথম কিছু চেয়েছি তোমার কাছে আমি , দিবে না ?

এমতাবস্থায় বেলী কি করবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না । ইরফানের চাওয়ার মাঝে নোংরামিপণাটা ছিল না । সহ বধ রেখেই সে তার চাওয়া জিনিসটা উপস্থাপন করেছে । এখন শুধু বেলীর এক ধাপ এগুনোর পালা । বেলী তখন সমস্ত লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে ইরফানের কাছে এগিয়ে যায় । বেলী আর ইরফানের চোখের দিকে তাকাতে পারে নি । নিজের চোখ বন্ধ করে প্রথম চুমুটা ইরফানের কপালে বসায় বেলী । বেলীর ঠোঁটের আলতো স্পর্শে ইরফানের পুরো শরীর নড়ে ওঠে । কপাল থেকে বেলীর ঠোঁট তখন ইরফানের গাল বরাবর । ইরফানের ডান গালে আরেকটা চুমু দেয় সে । আর পারেনি সে , লজ্জায় আর এগুতে পারে নি সামনে । বেলী হুরমুড়িয়ে উঠে যেতে নেয় নিলে ইরফান এইবার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বেলীকে । ইরফানের এরকম এক ঝটকায় উঠে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরায় সে অনেকটা ফ্রিজড হয়ে যায় । ইরফান বেলীর মাঝে এক চিলতে ফারাকও ছিল না তখন । বেলীর কাঁধে নিজের থুতনি লাগিয়ে বেলীর কানে কানে বলে ,

– আরও ১৩ টা বাকি কিন্তু ,
– রাত অনেক হয়েছে ঘুমিয়ে যান ।
– হুসসসস , আগে আমাকে দেয়া কথার মান রাখো ।
– এমন কেন করতেছেন ।
– বললাম আমায় দেয়া কথাটা রাখো ।

বেলীর তখন পুরো শরীরটা অসার হয়ে যাচ্ছিল । আর পারছিল না সে । ইরফান ঠিকই বলেছিল সকাল বেলা ।

– আপনি ঠিকই বলেছেন , এর যন্ত্রণা মা’রের যন্ত্রণা থেকেও বেশি ।

ইরফান তখন আরও শক্ত করে ধরে বেলীকে । আর কোন কথা হয় নি তাদের মাঝে । ইরফান বেলীকে তার দিকে ফিরিয়ে নেয় । তারপর কোলে তুলে নেয় , ইরফানের কোলে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার চড়লো সে ।

– আপ,,,,,,,,
– হুসসসস , চুপ কিছু বলো না ।
-,,,,,,,,,,,,,

ইরফান বেলীকে বিছানায় শুইয়ে দেয় । বিছানায় থাকা লুডুর ঘর সমেত গুটি গুলো নিচে ফেলে দেয় ইরফান । লাইট অফ করে দেয় সে । বেলী তখনও নিশ্চুপ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে ইরফানকে । ইরফানও বেলীর পাশে শুয়ে এক হাত দিয়ে নিজের মাথা ঠেকিয়ে বেলীকে দেখতে থাকে । বেলীর গাল গুলোকে আলতো করে ছুয়ে দেয় সে । ইরফানের ছোয়ায় বেলীর পুরো শরীরটা শীতল হয়ে যায় । শরীরের লোমগুলো শির শির করছে বেলীর । বেলী তখন হুট করেই ইরফানকে প্রশ্ন করে বসে ,

– পুরুষের ছোয়া কি এমনই হয় ?

বেলীর এমন প্রশ্নে ইরফানের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি আসে ।

– এ ছোয়া অনেক মারাত্মক , এই ছোয়া একদম সোজা কলিজায় গিয়ে আঘাত করে ।
– আমার নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে যাবে হয়তো ।
– বন্ধ হওয়া এত সহজ না ,
– আমায় ছুয়েন না ,
– তাহলে ভালো থাকবে তো ?
– জানি না ।
– তাহলে আরেকটু ছুয়ে দেই ,

ইরফান তার হাতটা বেলীর গাল থেকে নামিয়ে বেলীর গলায় নেয় । তখনই বেলীর চোখের কোণ দিয়ে এক ফোঁটা পানি পড়ে যায় । ইরফান সেই পানি দেখে বেলীর একদম কাছে এসে বেলীর কপালে আলতো করে এক চুমু দিয়ে দেয় । ইরফান বেলীর নাকের মাঝ বরাবর আরেকটা চুমু দেয় । ইরফান তখন বেলীর হাতের আঙুলের ভাজে নিজের আঙুলগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরে বেলীকে । বেলীর মন তখন একটা কথাই বলছিল ,

– সময়টা থেমে থাক , মুহুর্তটা থমকে যাক । আমার আর তার মাঝে ভালোবাসার বাঁধনটা এভাবেই আটকে থাক ।

.
.

চলবে…………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here