#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৩৫,৩৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
৩৫
সকালের দিকে রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছিলো বেলী । মিনু খেয়াল করছে বেলী নাকে কাপড় দিয়ে রান্না করছে । বেলীর চোখ মুখের অবস্থা ভালো না । তার কিছুক্ষণ পরেই সে মিনুকে বলে ,
– মিনু ,,,
– জ্বে ভাবী ,
– ডিমটা পোস করো তো ,
– আপনেই করেন ভাবী , আমার ডিম পোস সুন্দর অয় না । পরে ভাইয়ে রাগারাগি করে ।
– আরে করো তো , আমার ভালো লাগছে না ।
– আপনে এমন নাকে কাপড় দিয়া থুইছেন কিত্তে ?
– গন্ধ আসতেছে ,
– ও মা এডি কয় কি হেতি ? কই গন্ধ , কিয়ের গন্ধ । ভাবী কি সব কন আপনে ?
– তুমি ডিম টা পোস করবা কিনা ?
বেলীকে রাগতে দেখে মিনু তাড়াহুড়ো করে ডিম ভেজে টেবিলে দিয়ে আসে । মিনুর কেমন কেমন জানি লাগছে , বেলী এইভাবে আছে কেন ? এরই মাঝে বেলী দুপুরের খাবার রান্নার জন্যে পেঁয়াজ কাটতে থাকে । ওমনি বেলী চেঁচিয়ে ওঠে ।
– মিনু , করো কি ?
– আবার কিয়াচ্ছি ,
– পেঁয়াজ সরাও আমার সামনে থেকে ,
– আল্লাহ গো কি কইতাছেন এইসব আপনে ?
– গন্ধ লাগে সরাও এইগুলা ,
এই কথাটা বলতে দেরি আছে কিন্তু বেলীর বমি করতে দেরি নাই । রান্নাঘরের বেসিন এর মধ্যে গর গর করে বমি করে দেয় সে । মিনু বেলীর বমি করা দেখে তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসে । বেলী চোখে মুখে পানি দিয়ে মিনুর দেয়া পানি খেয়ে নেয় । মিনুর সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে যায় ।
এরই মাঝে রুম থেকে ইরফানের ডাক পড়ে । পানির গ্লাস রেখে চোখ মুখ মুছে বেলী রুমে যায় । ইরফানের ফরমায়েশ , বেলীকে টাই বেঁধে দিতে হবে । বেলী আর কথা না বাড়িয়ে টাই বেঁধে দেয় ইরফানের । ইরফান বেশ বুঝতে পারছে বেলীর হয়তো শরীর ভালো নেই । তাই নিজেই বেলীকে জড়িয়ে নেয় আর বলে ,
– শরীর কি বেশি খারাপ লাগে ?
– হ্যাঁ , অনেক খারাপ লাগতেছে ।
– আজকে তো অফিসে যেতে হবে , কাল দেখি ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো ।
– আরে ধুর , লাগবে না । এমনিই ঠিক হয়ে যাবে । আপনি আসেন খেয়ে নিন ।
– চলো ।
নাস্তার টেবিলে আরেক কাহিনী । ইরফান নাস্তা করছে আর বেলী নাকে হাত দিয়ে বসে আছে । ইরফান নাক দিয়ে কয়েকবার স্মেল নেয় পরে বেলীকে জিজ্ঞেস করে ,
– তুমি নাকে হাত দিয়ে বসে আছো যে ?
– গন্ধ আসে ,
– কই থেকে গন্ধ আসে । আমি তো এমন কিছুই পাচ্ছি না ।
– আমি পাইতেছি , আপনি খেয়ে নেন । আমি রুমে যাই ,
– কি রুমে যাই , তুমি খাবা না ।
– উহু ইচ্ছা করতেছে না ।
– আরে শুনো ,,,,,,, এই বেলী
ইরফানের কথায় পাত্তা না দিয়ে বেলী রুমে গিয়ে শুয়ে থাকে । রান্নাঘর থেকে মিনু সবটাই খেয়াল করে । ইরফান নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যায় । পুরো টেবিল গুছিয়ে মিনু বেলীর কাছে যায় । রুমে গিয়ে দেখে বেলী তখন মোবাইলে তার মায়ের সাথে কথা বলছে । তাই মিনু রান্নাঘরে এসে বাকি কাজ গুলো সেড়ে নেয় । অন্যদিকে বেলী তার মায়ের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ,
– হ্যাঁ মা বলো ,
– কথা দেখি এমনে কইতাছস ,
– মা শরীরটা ভালো না ,
– কি হইছে ,
– কি জানি মা , বুঝতেছি না তো । মাথা ঘুরাচ্ছে , বমি আসে ।
– তেতুল খা , পেশার লো মনে হয় ।
– হু , আচ্ছা মা রাখি ।
– জামাই কই ?
– অফিসে চলে গেছে ।
– আইচ্ছা রাখ ,
মায়ের সাথে কথা বলে বেলী আবারও শুয়ে থাকে । শান্তি পাচ্ছে না সে শরীরে । কেমন জানি লাগছে তার কাছে ।
কিছুক্ষণ পর আবারও বেলীর মায়ের ফোন আসে । বেলী ফোন রিসিভ করে কানে নেয় ।
– হ্যালো , কি গো মা , আবার ফোন দিলা যে ?
-……………………
– কি দব বলো মা , আরে নাহ এমন কিছুই না মা ।
-…………………
– মা এইসব কিচ্ছুই না । রাখি আল্লাহ হাফেজ , নিজের যত্ন নিও ।
বেলী ভ্রু গুলো কুচকে ফোনটা কেটে দেয় । তার পর পরই মিনুকে ডাক দেয় সে , তার ডাকে মিনু বেচারিও দৌড়ে চলে আসে ,
– জ্বে ভাবী ডাকছিলেন ,
– মিনু , শুনো না একটু ,
– জ্বে ভাবী কন কি কইবেন ।
– সোনা পাখি আজকে একটু নিজে রান্না করো না । আমার খুব খারাপ লাগতেছে । ভিষন মাথা ঘুরাচ্ছে , মনে হয় উঠে দাঁড়ালেই পড়ে যাবো ।
– আইচ্ছা ভাবী আমিই রান্না কইরা ফালামু , আপনে শুইয়া থাকেন ।
– ঠিকাছে রে পাখি । আর শুনো ,
– জ্বে ,
– দরজাটা আটকে দিও , আর রান্নাঘরের দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে তুমি রান্না করো যাতে গন্ধ এই রুম অবদি না আসে ।
মিনুর কাছে কেমন কেমন জানি লাগছে বেলীর কথাটা । এতদিন পর এই প্রথম বেলী এমন সব কথা বলছে । মিনু চুপ করে বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলী আবারও মিনুকে ডাক দেয় ।
– মিনু , এই মিনু ,,,,,,,
– জ্বে ভাবী ,
– কি বললাম বুঝছো ?
– আইচ্ছা ,
– তাহলে দরজাটা আটকাও ,
– আইচ্ছা ।
বেলীর রুমের দরজা আটকে দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে মিনু রান্নাঘরে যায় । তারপর নিজে নিজেই বলতে থাকে ,
– আমাগো বাইত এক ভাবীরে দেখছিলাম এমন কত্তে । হেতির সব কিছুর ভিত্রেই গন্ধ লাগতো । বমি করতো কতক্ষণ পরে পরে । খাইতো না এমন কি রানতোও না । এহন দেহি বেলী ভাবীরও এই রোগে পাইছে ।
প্লেট বাটি মাজতে মাজতে মিনুর একটা কথা মনে পড়ে যায় ।
– ওরে ওরে , হের মাসখানেক পরেই তো মনায় অইলো । ও আল্লাহ তাইলে কি বেলী ভাবীর বাচ্চা অইবো ?
মিনু প্লেট বাটি বেসিনের উপরে রেখেই দৌড় দেয় বেলীর রুমে । বেলী তখন বিছানায় এক পাশ হয়ে শুয়ে আছে । মিনু গিয়ে বেলীর সামনের দিকে নিচে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে । তারপর বেলীকে ডাক দেয় সে ।
– ভাবী , ও ভাবী ,,,,,,,
মিনুর ডাকে বেলী চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে মিনুর দিকে তাকায় । বেলী বুঝতে পারে মিনু হয়তো তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে । কারণ মিনুর চোখে মুখে কেমন যেনো অনেক আগ্রহ দেখা যাচ্ছিলো তখন । বেলী মিনুর গালে হাত দিয়ে হালকা হেসে বলে ,
– কিছু বলবা মিনু ?
– একখান কতা কইতাম চাই ,
– বলো , আমি শুনতেছি ।
বেলীর কথায় মিনু নড়ে চড়ে বসে । বেলীর হাতটায় নিজের হাত রাখে মিনু । তারপর বলে ,
– কতা ডা হইলো গিয়া আমাগো বাইত এক ভাবী আছিল , হেতিও আপনের মতই করতো ।
– কি করতো ?
– এইযে আপনি এহন যা করতাছেন ?
– আমি কি করলাম আবার ?
– এইযে এইসব কিছু ,
– কি বলছো , কিছুই বুঝতেছি না আমি ।
– মানে হইলো গিয়া ভাবী , আমাগো বাইত যেই ভাবী আছিলো হেতিও আপনার মত গন্ধ গন্ধ করতো , খাইতো না আবার রানতোও না । হের মাস খানেক পরেই মনায় অইছে ।
– কে হইছে , মনা কে ?
– মানে বাচ্চা আরকি আমি আদর কইরা মনা কই ।
– এটা আমায় বলে কি লাভ হলো তোমার , ভাবী গো ভাবী , নিশ্চয়ই আমনেরও বাচ্চা অইবো ।
বেলী মিনুর কথা শুনার পর কতক্ষণ মিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপরে কি যেনো চিন্তা করে । আর তারপর অত্যন্ত শান্ত গলায় মিনুকে বলে ,
– তুমি গিয়ে রান্না করো , এই সব বিষয়ে পরে কথা বলবো । কেমন ?
– ভাইয়েরে কইয়েন ডাক্তারের কাছে নিয়া যাইতে ।
– আচ্ছা বলবো , তুমি গিয়ে রান্না করো ।
– কি রানতাম ,
– যা মন চায় , তবে তোমার ভাইয়ের জন্যে রুই মাছ ভুনা করে রাখিও ।
– আচ্ছা ,
– দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাও ,
– আইচ্ছা ভাবী ,
বেলী কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে মিনুর কথা গুলো অনুধাবন করতে থাকে । কিছুক্ষণ আগেও বেলীর মা ফোনে ঠিক কথাই গুলো-ই বলে ছিলেন । কিন্তু বেলী তখন কথা গুলো আমলে নেয় নি । কি করবে না করবে সে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না । চিন্তাটা মাথার মধ্যে চেপে বসে আছে । বেলী উচ্চ শিক্ষিত না বলেও একেবারে মূর্খও নয় । তাই ইউটিউবে সার্চ করে অনেক কিছুই দেখে নেয় । তখন তার খেয়াল হয় , তার এই মাসে মান্থ মিস হয়ে গেছে । এইসব চিন্তায় তার শরীর আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে । কাকে বলবে কার কাছ থেকে পরামর্শ নিবে কিছুই জানে না সে । না নিজে বের হয় বাসা থেকে না পরিচিত কেউ আছে । যা করতে হয় ইরফানই করে দেয় । এখন শুধু অপেক্ষা রাতের । ইরফান আসলে তাকে সবটা খুলে বলবে বেলী ।
রাত প্রায় ৯ টা নাগাদ ইরফান বাসায় আসে । আজ কেন যেনো অনেক খুশি সে । বেলীর জন্যে ফুচকা নিয়ে আসছে আজকে ইরফান । ইরফানকে খুশি দেখে বেলী তার কারণ জানতে চায় ,
– আজ এত খুশি কেন ?
– আমি যাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না বেলী ।
– কি হয়েছে ,
– ৬ মাসের মাথায় আরেকটা প্রমোশন ।
– সত্যিইই ,,,,,,
– সত্যি , আজকেই স্যার কেবিনে ডেকে নিলেন , আর আজকেই সব বললেন ।
– যাক আলহামদুলিল্লাহ , আল্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া ।
– এইসবই তোমার নামাজ আর দোয়ার ফল ।
– আপনারে বলছে , শুনেন আল্লাহ পাকের কাছে চাওয়াও লাগে আবার নিজের প্রচেষ্টাও লাগে । আমি চেয়েছি তা ঠিক আর এতে আপনারও প্রচেষ্টা ছিল তাই আপনার ভাগ্যে তা এসেছে ।
বেলীর কথার যথার্থতা বুঝতে পারে ইরফান । বেলীর দিকে এক নজরে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মনে মনেই বলতে শুরু করে দেয় সে ,
– এই নারীর আমলেই আল্লাহ পাক আজ আমার ঘরে এবং আমার কর্মজীবনে এত সাফল্য এনে দিয়েছেন । আল্লাহ পাক আমার ভাগের সমস্ত হায়াত তুমি এই নারীর ভাগে দিয়ে দিও ।
অপরদিকে বেলীও মনে মনে বলতে থাকে ,
– আল্লাহ পাক তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই । তুমি এইভাবেই আমার সংসার স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখো এবং আমার চুল এর অধিক হায়াত তুমি আমার স্বামীকে দান করো ।
তারপর বেলীকে ফুচকা খেতে বলে ইরফান ওয়াসরুমে ঢুকে যায় । কিন্তু এইসব কথার মাঝে বেলী ইরফানকে আসল কথাই বলতে ভুলে যায় । তার যে কিছু কথা বলার ছিল ইরফানকে ।
রাতে খাবার পরে ইরফান শুয়ে আছে । কিছু একটা ভাবছে সে । বেলীর কি হয়েছে ? রাতের খাবার সময়েও একই কাহিনী করেছে বেলী । কোন তরকারি নেয় নি সে । শেষে পানি দিয়ে ভাত মেখে খেয়েছে । বেলী তখম ও-পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে । বেলীর মনেও খচ খচ করছে কিভাবে বলবে ইরফানকে । কিন্তু না বলেও উপায় নেই তার । কারণ এখানে ইরফান ছাড়া তার পরিচিত আর কেউই নেই তার । মিনু এইসব কিছুই বুঝে না কারণ সে অবিবাহিতা । তবুও যতটুকু জ্ঞানে এসেছে তাই বলেছিল মেয়েটা দুপুরে ।
বার বার ইরফানকে বলতে চাইছে সে কিন্তু লজ্জার কারণে বলতেও পারছে না কিছু । ওইদিকে ইরফানের মনে বেলীকে নিয়ে হাজারটা চিন্তা হচ্ছে । আজকে সকালে এমন করলো , মিনুর থেকে শুনেছে দুপুর বেলা রান্নাও সে করে নাই আর এখনও খাবার খেতে গিয়ে এমন করলো । তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বেলীকে ডাকে ইরফান ।
– বেলী , এই বেলী
বেলী তখনও সজাগ ছিল । ইরফানের ডাকে হু বলে সাড়া দেয় সে ।
– এইদিকে ফিরো তো ।
তখন সে ইরফানের কথায় ইরফানের দিকে ঘুরে যায় ।
– কি হয়েছে তোমার , আমায় বলবা একটু ?
– কই কি হয়েছে ?
– আজকে দুপুরে রান্না করো নাই , খাবারও খাও নাই , এখনও এমন করলা । কি হয়েছে ?
ইরফানের কথায় বেলী সাহস পায় । তখন সে বলা শুরু করে ,
– আমার না কেমন কেমন জানি লাগে , সব কিছু থেকে গন্ধ আসে ।
– কিসের গন্ধ , বাসা তো কত পরিষ্কার ।
– জানি না , তবে আমার একটা কথা আছে ।
– হ্যাঁ বলো ,
– এইদিকে আসেন ,
– আর কত আসবো ,
– আরও কাছে আসেন ,
– কি ব্যাপার , আজকে এত কাছে ডাকছো যে , খুন করার প্ল্যান আছে নাকি ?
– উফফফ , এখানে আসেন ,
– আচ্ছা বলো ,
তারপর ইরফানের কানের কাছে গিয়ে বেলী তার মান্থ মিসের কথা জানিয়ে দেয় । সাথে বেলীর সব অসুবিধার কথাও বলে দেয় এবং দুপুরে মিনুর বলা কথাগুলোও বলে দেয় । এইসব শুনে ইরফান সোজা শোয়া থেকে উঠে বসে যায় । ইরফানকে এইভাবে বসতে দেখে বেলীও বসে যায় ।
– কি হলো ,
– সত্যিই কি মিস হয়ে গেছে ?
বেলী তখন মাথা নিচু করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে । তখন ইরফান মুচকি হেসে বেলীকে জড়িয়ে ধরে আর বলে ,
– কাল সকালেই মেডিকেল নিয়ে যাবো , কেমন ?
– হু ,
– এখন ঘুমিয়ে যাও ।
ইরফান বেলীর কপালে চুমু দিয়ে বেলীকে শুইয়ে দেয় । আর বেলীও শুয়ে যায় ।
অপেক্ষা কাল সকালের । মেডিকেল গিয়ে কি হবে বাকিটা আল্লাহর হাতে ।
.
.
চলবে…………..
#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৩৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
মেডিকেলে বসে আছে বেলী আর ইরফান । অফিসের এক কলিগকে বলে দুই ঘন্টার ছুটি নিয়েছে বেচারা । ইদানীং অফিসে প্রচুর কাজের চাপ বেড়ে গেছে তার । প্রমোশন হওয়া মানেই কাজের চাপও বেড়ে যাওয়া । ইরফান বেলীর পাশে বসে আছে । বার বার বেলীর দিকে চোখ যাচ্ছে তার । হিজাব পরে ভালোই লাগে বেলীকে । তবে মুখটা অনেক শুকনা লাগছে বেলীর । অবশ্য না লাগার-ই কথা , আজকে তিনটা দিন খাওয়া কি জিনিস সে ভুলেই গেছে । বেলী এমন এক নারী যার দিকে নজর দিলে চোখ সহ পুরো শরীর শান্ত হতে বাধ্য ।
ইরফানের মাথায় বেলীর বলা কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে ।
– মান্থ মিস হয়ে গেছে , তার মানে কি ওর বাবু হবে ?
মনে মনে বলতে থাকা কথাগুলো বার বার ইরফানের মনকে অস্থির করে দিচ্ছিলো ।
আবারও সে ভাবনার মাঝে ডুব দেয় ।
– সাহেব ভাইয়ের ওয়াইফের বাবু হলো কয়েকমাস আগে ৷ বেচারা অনেক চিন্তিত থাকতো দেখতাম । অবশ্য তার ওয়াইফকে দেখার মানুষের অভাব নেই কিন্তু ও-কে কে দেখবে । ওর তো আমি ছাড়া কেউ নেই এইখানে ।
ইরফান চুপ করে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে । অপেক্ষা ইউরিন টেস্ট এর রেজাল্টের । মেডিকেলে আসার পরেই গাইনিকোলোজিস্ট ডক্টর বললেন আগে ইউরিন টেস্ট করানোর জন্যে । তাই ডক্টরের কথা মত আগে টেস্ট করিয়েছে বেলী । রিপোর্ট সরাসরি ডক্টরের কেবিনেই দেয়া হয় । আর এইখানে বেলী আর ইরফানকে কেবিনে যেতে বলে এক নার্স । নার্সের কথায় বেলী আর ইরফান পা রাখে ডক্টরের কেবিনে । ডক্টর দুজনকে সামনে বসিয়ে রেখে সব কথা ক্লিয়ার করে নেয় ।
– ডেট মিস হয়েছে কবে নাগাদ ?
ডক্টরের প্রশ্নে অনেকটাই সংকোচবোধ করছিলো বেলী সাথে ইরফানও । ইরফান টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীও চুপচাপ । তখন ডক্টর আবার বলেন ,
– দেখুন এইভাবে চুপ থাকলে কিভাবে হবে ? কথা তো বলতে হবে কারণ আমি প্রশ্ন করবোই , আর উত্তর না দিলে আমি বুঝবো না কিংবা বুঝাতে পারবো না । তাই চুপ করে না থেকে কথা বলতে হবে , কেমন ?
অতঃপর বেলী আর ইরফান ডক্টরের কথাতে অনেকটা সংকোচ মুক্ত হয় । ডক্টর নাসিমা পারভীন আবারও প্রশ্ন করেন বেলীকে ,
– ডেট মিস হয়েছে কবে নাগাদ ?
তখন বেলীই উত্তর দেয় ,
– এই মাসেই ।
– কিন্তু আপনি তো কনসিভ করেছেন প্রায় এক মাস হবে । মানে প্রায় এক মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে ।
ডক্টরের কথায় বেলী ইরফান দুজনেই অবাক । ইরফানের মনে কিসের যেন এক শীতল বাতাস বয়ে গেলো । সে বাবা হবে , তারও বাবু হবে । বেলী যে তাকে এত ভালো খবর দেবে সে ভাবে নি । তখন বেলী আবার বলে ওঠে ,
– কিন্তু আমি তো গত মাসেও,,,,,,,,,,,,,,,,
– হ্যাঁ হয় অনেক সময় এমন , এটা ব্যাপার না । এখন বলুন কি সমস্যা হয় আপনার ?
তখন বেলী তার সমস্ত সমস্যার কথা বলতে শুরু করে দেয় ,
– আমি খেতে পারি না , গন্ধ লাগে শুধু , এমন কি যেই রান্না আমি করতাম সেই রান্নাও এখন আর করতে পারি না । শুধু গন্ধ লাগে সব কিছুতে ।
– বমি কেমন হয় ?
তখনই ইরফান বলে ওঠে ,
– আসার সময়ও বমি করে আসছে । খাবার তো মুখেই তুলতে পারে না । পানি ঢেলে ভাত খায় তাও যদি পেটে থাকে । খেয়েই ফেলে দেয় সব ।
– আসলে প্রেগন্যান্সির সিমটমই এইসব । সমস্যা নেই আমি মেডিসিন দিয়ে দিবো , খাওয়াতে থাকুন আর ওনার শরীর তো অনেক দুর্বল । এইভাবে থাকলে তো পরে ব্লাড দিতে হবে । ওনার ব্লাডের প্লাটিলেটও কম ।
– কি করতে হবে এখন ?
– মেডিসিন দিয়ে দিবো , আর বেশি বেশি খেতে হবে । বমি হবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু খেতে হবে ।
বেলী চুপ করে না থেকে নিজেই আবার বলতে শুরু করে ,
– আমার তো সব কিছু থেকে গন্ধ আসে । আমি তো খাবারের কাছেই যেতে পারি না ।
– এটা বললে তো হবে না । খেতে হবে না হয় বাবু ভালো থাকবে না ।
ডক্টরের সাথে কথা বলে বেলীর জন্যে ওষুধ কিনে দুজনে মিলে রিক্সায় উঠে যায় । রিক্সায় উঠা মাত্রই ইরফান রিক্সাওয়ালাকে সাবধানে রিক্সা চালাতে বলে দিয়েছে । বেলী চুপ করে আছে । মনের মধ্যে এক অস্থিরতা কাজ করছে । সে মা হবে , তার ভেতর আরেকটা জীবন । আরেকটা শরীর একটু একটু করে বেড়ে উঠবে । এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি । অন্যদিকে ইরফান কি করবে না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না । এটা রাস্তা না হলে সে লাফাতো । সে বাবা হবে , ভাবতেই প্রাণ তার জুড়িয়ে যাচ্ছে । এমন সময় বেলীর হাতে হাত রাখে ইরফান । ইরফানের হাতের স্পর্শ পেয়ে বেলী ইরফানের দিকে তাকায় । ইরফান চাপা হাসি দিয়ে বেলীকে দুই চোখ টিপ দেয় । ইরফানের এই আচরণে বেলীও মুচকি হাসি দেয় । বেলীর হাসিয়ে যেন হাজারো প্রশান্তি বিরাজ করে । ইরফান তখনই মোবাইলে তার বসের কাছে মেইল করে দেয় সে আজ অফিসে আসতে পারবে না কারণ তার ওয়াইফ অসুস্থ । ইরফান খবরটা শুনার পর একদম অন্যরকম হয়ে গেছে । সে আজ অফিসে যাবে না , তার ইচ্ছে করছে না অফিস যেতে । আজ সারাদিন সে বাসাতে থাকবে । বেলীর কাছে থাকবে । ৫ মিনিট পর ইরফানের মেইলের উত্তর আসে । বস ছুটি দিয়ে দিয়েছে । এখন শুধু বাসায় যাওয়ার অপেক্ষা । বেলীকে চুপ থাকতে দেখে ইরফান বলে উঠে ,
– কি হলো চুপচাপ যে ?
– এমনি ,
– কিছু খাবা ?
– উহু ,
– হায়রে , তোমার খাবারে কি সমস্যা । ডক্টর কি বলছে শুনছো তুমি ?
– আমার ভালো লাগছে না ।
– বেলী,,,,,,,,,,,?
– হু ,
– আমার না কেমন জানি লাগছে ?
– কেন কি হয়েছে আপনার আবার ,
– কিছু না ,
– শরীর খারাপ আমার , কেমন জানি লাগে আপনার , এটা কোন কথা ?
ইরফান চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীও তখন চুপ হয়ে যায় । বেলী তখন আবারও বলতে শুরু করে ,
– আমি ভাবছি মিনুর কথা ,
– কেন , ও আবার কি করলো ?
– পুরা বাসা মাথায় তুলবে ,
– হা হা হা ।
বাসায় এসে ইরফান আর বেলী দুজনেই রুমে চলে যায় । মিনু তখন কাজে ব্যস্ত ছিল তাই তেমন কিছু বলে নি । বেলী ভেবেছে ইরফান হয়তো আবার কিছুক্ষণ পরেই আবার বেরিয়ে যাবে । কিন্তু বেলী তো জানে না যে ইরফান ছুটি নিয়ে নিয়েছে আজকে । বেলী রুমে গিয়ে হিজাব খুলে ফ্যানটা ছেড়ে একটু ফ্যানের নিচে দাঁড়ায় । ইরফান তখনই দরজাটা আস্তে করে লাগিয়ে দেয় । তারপর বেলীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে । এইভাবে ইরফানকে জড়িয়ে ধরতে দেখে বেলীও অবাক হয়ে যায় । বেলী সেখানে চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান বেলীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকে টেনে নেয় । বেলীর মাথায় চুমু দিয়ে আরও নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরে তার বেলীফুলকে । বেলীও তখন পরম যত্নে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে । বেলীকে খাটে বসিয়ে দেয় ইরফান । ঠোঁটে দুজনেরই হাসির চিহ্ন । ইরফান তখন বেলীর পেটে হালকা করে ছুয়ে দেয় আর বলে ,
– বেলী এখানে আমাদের বাবু আছে ?
– হু ,
– আমি বাবা হবো ,
– হু ,
– কেউ আমায় বাবা / আব্বু এইসব বলে ডাকবে ,
– হু ,
– বেলী তুমি কি জানো তুমি আমায় কতটা সুখ দিয়েছো । সত্যিই নিজেকে আজকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ মনে হচ্ছে । আমার মত মানুষের কপালে এত সুখ আছে ।
– কেন থাকবে না , আর আপনি অফিসে যাবেন না ?
– বেলী , আর ভালো লাগে না আপনি আজ্ঞে । এইবার বন্ধ করো । যার তার সামনে আপনি আপনি বললে কেমন শুনায় ।
– তো কি বলতাম ,
– কেন তুমি বলা যায় না ?
বেলী তখন নিজের মাথাটা নিচু করে রাখে । তখন ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে বলে ,
” আজকে তোমার মুখ থেকে তুমি বের করেই ছাড়বো আমি ”
যেইভাবা সেই কাজ , ইরফান চেপে ধরে বেলীকে । খাটে শুইয়ে দেয় সে বেলীকে । আর নিজেও সাইড থেকে বেলীর উপর উপুর হয়ে শুয়ে যায় । বেলীর দিকে আপন মনে চেয়ে আছে সে । বেলীর নজরও ইরফানের দিকে ।
– তুমি করে বলো ,
ইরফানের কথায় বেলী অন্যদিকে ফিরে তাকায় । ইরফান তখন বেলীর গালে ধরে বেলীকে তার দিকে ফিরায় ।
– তুমি করে বলতে বলছি ,
– তুমি তো মুখ দিয়ে আসে না ।
– বললেই আসবে , বলো ।
– আসে না তো ,
– আজকে কিন্তু এইভাবেই আটকে রাখবো ,
– এহহহহহহ ,
– হু , তুমি বলো ।
– আমি আপনি করেই বলি ,
– নাহ , তুমিই বলতে হবে ।
– আমি তুমি করে বলতে পারি না তো ।
– বাবুর মা যদি এত ত্যাড়া হয় তাহলে আমার বাবুটার কি হবে , সেও ত্যাড়া হবে ।
– এহহহহ , আমার বাবু লক্ষী হবে ।
– তাহলে তুমি করে বলো ।
ইরফানের অনেক জোড়াজুড়ির পর বেলী বাধ্য হয় ইরফানকে তুমি করে বলতে । অবশেষে তার মুখ থেকে তুমি বের করে আনে ইরফান । এরই মাঝে দুজন কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টাও করে নেয় । ইরফান হঠাৎ করেই ইমোশনাল হয়ে যায় । সে বেলীর গালে তার এক হাত দিয়ে স্পর্শ করে । ইরফান তখন হঠাৎই কিছু কথা বলা শুরু করে । বেলী এক ধ্যানে ইরফানের কথা গুলো শুনতে থাকে ।
– বেলী জানো , আমি না জন্মের পর মাকে দেখি নাই । বাবার কাছে শুনেছিলাম আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মা মারা গেছেন । আমি ধরতে গেলে অনেকটাই মা হারা ছিলাম । সেই আমার সন্তান হবে ।
কথা গুলো বলার সময় ইরফানের চোখ বেয়ে পানি পড়ে যায় । ইরফানের চোখের পানি দেখে বেলীর কলিজায় কামড় পড়ে যায় । বেলী আলতো করে ইরফানের গালে ধরে । শান্তনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার ।
– আমাদের সন্তান মা বাবা দুজনকেই পাবে ইনশাআল্লাহ ।
বেলীর কথায় ভরসা পায় ইরফান । চোখের পানি গুলো মুছে বেলীকে জড়িয়ে ধরে ইরফান আর নিজের মনের মধ্যে জমাট বাঁধা কিছু কথা বলতে থাকে সে ,
– আচ্ছা মেয়ে বাবু হবে নাকি ছেলে বাবু হবে ?
– আমি কি করে বলবো ,
– তোমার কি বাবু চাই ?
– আল্লাহ পাক যা দিবে তাতেই খুশি । আপনার কি চাই ?
– আবারও আপনি ??
– আচ্ছা , ঠিকাছে তুমি । তোমার কি চাই ?
– একটা মেয়ে বাবু ঠিক তোমার মত ।
– যদি ছেলে বাবু হয় ?
– তাহলেও ক্ষতি নেই । আল্লাহ পাক যা দিবেন তাতেই খুশি ।
– ওহ ,
– আচ্ছা বাবুর ছোট ছোট হাত পা হবে আর ও অনেক নরম তুলতুলে হবে তাই না ।
– আগে তাকে আসতে দেও ভালো ভাবে । সে আসুক আগে ।
ইরফানকে হাসি মুখে কথা গুলো বলে বেলী । এমন সময় বেলী আবার বলে উঠে ,
– অফিস যাবা না ?
– ছুটি নিয়ে নিছি , আজকে তোমার সাথে কাটাবো ।
– আমি তো ভালো আছি ।
– বেলী প্লিজ নিয়ম করে মেডিসিন গুলো নিতে হবে ।
– হ্যাঁ খাবো ।
এমন সময় মিনু বাহির থেকে চিৎকার করতে থাকে ,
– বাইরের তেন আইয়াই ভিত্রে ঢুইক্কা গেছে , না বুঝি মিনুরেও কই মিনুর কি চিন্তা অয় না ? থাউক গিয়া আমি কিডা , আমি তো কামের মাইয়া ।
বেলী আর ইরফান ভেতর থেকে মিনুর কথায় খিল খিল করে হাসে । তারপর ইরফান উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয় । মিনু তখন সোফা গুছাচ্ছে । ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে জগ থেকে পানি ঢালতে ঢালতে মিনুকে উদ্দেশ্য করে ইরফান বলে ,
– মিনু তোর মনা আসবে রে , মিষ্টি খাওয়া তোর ভাই ভাবীকে ।
এমন কথায় মিনু চোখ বড় বড় করে তাকায় ।
.
.
চলবে…………………….