#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ৩
লিখা- Sidratul Muntaz
রাইসা কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদা ট্রে ভরা কফির কাপ নিয়ে রুমে ঢুকল। পাতলা ঠোঁটে তার মায়াবী হাসি। সেন্টার টেবিলে ট্রে রাখার পর নির্দিষ্ট একটি কফির মগ তুলে জিসানের হাতে দিতে দিতে বলল,” এই নাও তোমার ব্ল্যাক কফি। নো সুগার, নো ক্রিম। একদম তোমার স্টাইলে।”
জিসান ভীতদৃষ্টিতে কফির কাপ হাতে নিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কফি নয় বিষ নিচ্ছে। রাইসা প্রফুল্ল হেসে নোভার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,” তুমি কয় কিউব স্যুগার খাও?”
নোভা উত্তর দিল ক্ষীণ কণ্ঠে, ” ওয়ান কিউব।”
রাইসা চটপট করে বলল,” স্যরি, স্যরি, তুমি করে বলে ফেললাম। আমি আসলে মানুষকে একটু আপন ভাবলেই তুমি করে বলতে শুরু করি। কিছু মনে করবেন না আপু!”
রাইসা মুখে গাঢ় হাসি নিয়ে নোভার হাতে কফির মগ ধরিয়ে দিল। ফারিহাকেও দিল। দু’জন এতো অদ্ভুতভাবে রাইসার দিকে তাকাচ্ছে যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ধরণের কিছু দেখছে। তাদের কফি খেতেও অনীহা লাগছে। রাইসা নিজের কাপ নিয়ে সোফায় বসতেই নোভা বলল,” কোনো প্রবলেম নেই। আমাকে ‘তুমি’ করে ডাকতেই পারেন ভাবী। আমি তো আপনার সম্পর্কে ননদ হবো। দূর সম্পর্কের ননদ হলেও কিন্তু ননদ।”
কথাটা শুনে জিসান কেশে উঠল। রাইসা বলল,” আমি আপনার চেয়ে বয়সে ছোট হবো। তাই ‘তুমি’ ডাকতে লজ্জা লাগছিল। তবে অনুমতি যখন দিচ্ছেন তখন ডাকাই যায়। কিন্তু শর্ত হলো, আমাকে ভাবী ডাকা যাবে না। নাম ধরে ডাকতে হবে কিন্তু। আসলে ভাবী ডাক শুনলে নিজেকে বয়স্ক বয়স্ক লাগে।”
নোভা হেসে বলল,” ঠিকাছে নাম ধরেই ডাকবো।”
চিন্তিত মুখে কেউ হাসলে সেই হাসির ধরণ অন্যরকম হয়। রাইসার সাথে কথা বলার সময় নোভার হাসির ধরণ একেবারেই অন্যরকম লাগছিল। এই অন্যরকমের পেছনে আছে ভয়, শংকা, অবিশ্বাস, সন্দেহ! জিসানের সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না।
ডিনারে রাইসা অল্প সময়েই অনেক আয়োজন করে ফেলল। নোভা চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রাইসা ডিনার ছাড়া কোনোভাবেই যেতে দিবে না। কি আর করার? থাকতেই হলো। খাওয়া-দাওয়ার সময়ও জিসানকে আলাদাভাবে যত্ন করছিল রাইসা। জিসান ছোটমাছের মাথা খেতে পারে না। শুধু বডি খায়। রাইসা জিসানকে মাছ দেওয়ার সময় আগে নিজের পাতে নিয়ে মাথা ছাড়িয়ে তারপর দিচ্ছিল। রত্নার থেকে জানা গেল মুরগীর একটা স্পেশাল লেগপিস প্রতিদিন জিসানের জন্য রাখা হয়। জিসান ওই পিস ছাড়া মুরগীর অন্যকোনো পিস খায় না। রাইসা যত্ন করে সেই পিস জিসানের প্লেটে দিল। জিসান পানি ঢালার সময় রাইসা জগ কেড়ে নিয়ে বলল,” আমাকে বললেই তো হয়। তুমি তো ফেলে দিবে আবার। সেদিন কি করেছিলে মনে নেই? জানো নোভা আপু, পানি পর্যন্ত ঢালতে পারে না। সারাক্ষণ যে কোন ধ্যানে থাকে! তাকে পানি ঢালতে দেওয়া হলে সে জগ উল্টো করে ধরেই রাখবে। গ্লাস ভরে পানি উপচে পড়তে থাকবে কিন্তু তার হুশ ফিরবে না। অদ্ভুত মানুষ একটা!”
রাইসা এই কথা বলেই আবার হাসল। যেন জিসানের এমন অদ্ভুত হওয়াটা খুব কিউট ব্যাপার। অথচ রাইসার এতো মধুর আচরণেও জিসানকে কেমন ভীত ভীত দেখাচ্ছিল। নোভা আর ফারিহা ক্ষণে ক্ষণেই বিভ্রান্ত হতে লাগল।
সদ্য খাওয়া শেষ করে সবাই টেবিল ছেড়ে উঠেছে। তখন রত্না আর রাইসা রান্নাঘরে। ফারিহা হাত ধুঁতে গেছে। ডাইনিং টেবিলে শুধু বসে আছে জিসান আর নোভা। জিসান খানিক কাছে এসে বলল,” আপনি নিশ্চয়ই আমার স্ত্রীর কোমল আচরণের কারণ বুঝতে পেরেছেন? এইটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি তো আপনার থাকা উচিৎ। ”
নোভা পানির গ্লাসে চুমুক দিল। একটু ভেবে বলল,” জ্বী আমি বুঝতে পেরেছি। যেহেতু আমি আপনার রিলেটিভ হিসেবে এই বাড়িতে এসেছি তাই আপনার স্ত্রী আমাকে দেখেই আপনার সাথে এতো ভালো ব্যবহার করছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আপনার প্রতি তার ব্যবহার এতো সুন্দর নয়। এখন যা হচ্ছে তার সবকিছুই আসলে একটা ভাণ। লোক দেখানো ভাণ। ঠিক না?”
জিসান স্বস্তিভরা মুখে হাসল,” একদম ঠিক। আপনি বুদ্ধিমতী। থ্যাংকস বোঝার জন্য।”
নোভা শব্দ করে হাসতে লাগল। জিসানের কুচকানো ভ্রু আরও কুচকে গেল। বিব্রত গলায় জানতে চাইল,” কেন হাসছেন?”
নোভা একটু থেমে বলল,
” হাসছি আপনার ভয় পাওয়া দেখে। এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? যদি আপনি সত্যি বলে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনার কথা আমি বিশ্বাস করবো। তাই না?”
” হুম। নিজের প্রতি আমার আস্থা আছে। কিন্তু আপনাকে আমি ঠিক ভরসা করতে পারছি না। মনে হচ্ছে অন্য সবার মতো আপনিও আমার স্ত্রীর মিষ্টি কথার ফ্যান হয়ে গেছেন।”
নোভা আবারও হাসল। জিসান রাগী গলায় বলল,” দেখুন হাসবেন না। আপনার হাসি আমাকে আরও বেশি বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। সত্যি করে বলুন তো, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন নাকি করেননি? রাইসাকেই কি আপনার সঠিক মনে হচ্ছে?”
” শুনুন, আপনার এখানে রিলেটিভ সেজে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে। আমি যদি আমার আসল পরিচয়ে আসতাম তাহলে রাইসা আমার সামনে এই ভাণটা করতো না। সে নিজের সঠিক জবানবন্দীই আমাকে জানাতো। আর আমি যে প্রশ্নগুলো করতে চেয়েছিলাম সেগুলোও নির্দ্বিধায় করা যেতো।”
” এর মানে আপনি কি বলতে চাইছেন? আপনি রাইসাকে বলে দিবেন যে আপনি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট? আমি চিকিৎসার জন্য আপনার কাছে এসেছিলাম? আর আমি যে ওকে খু’ন করতে চাইছি এটাও কি বলে দিবেন?”
রীতিমতো গলা শুকিয়ে এলো জিসানের। ত্রাসিত মুখটা চুপসে গেল। নোভা বলল,” কাম ডাউন। আমি কিছুই বলবো না। শুধু আমার মনে হচ্ছে এইভাবে এসে কোনো লাভ হয়নি। উল্টো আপনার প্রতি আমার সন্দেহ তৈরী হচ্ছে।”
জিসান খুব রেগে গেল।
“আমার প্রতি সন্দেহ! উল্টো আমার প্রতিই!”
কিড়মিড় করতে লাগলো জিসান৷ তার ইচ্ছে হলো টেবিলে যত জিনিস আছে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। বিশাল একটা থাবা বসিয়ে মিস নোভার হুশ উড়িয়ে দিতে। নিজের ক্রোধকে ঠান্ডা করতে তৎক্ষণাৎ জিসান নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল। নোভা বিস্ময় নিয়ে অবজার্ভ করছিল লোকটিকে। উজ্জ্বল মুখ রাগের কারণে গোলাপী হয়ে গেছে। চোখ দু’টো টকটকে লাল। যেন হিংস্র কোনো জন্তু সে। জিসান একটু পর নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে বলল,” আমি এতোক্ষণ ধরেও যেটা করতে চাইনি এখন মনে হচ্ছে সেটাই করতে হবে। নয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না।”
নোভা ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইল,” কি করবেন?”
জিসান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” এদিকে আসুন।”
নোভা জিসানের সাথে একটু সামনে গেল। তারা দু’জন ঠিক রান্নাঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো। জিসান রাইসার দিকে নজর রেখে বলল,” আপনি আমার সাথে একটু ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়ান তো। আমার কাঁধে হাত রাখুন।”
নোভা ক্ষিপ্ত গলায় বলল,” মানে? কি বলছেন এসব?”
জিসান করুণ স্বরে অনুরোধ করল,” প্লিজ, এটা ছাড়া অন্যকোনো উপায় নেই। আপনি রাইসার আসল রূপ দেখতে চান না? একবার শুধু আমার কথামতো কাজটি করুন তারপর নিজেই দেখবেন একটা মেয়ে ঠিক কি পরিমাণে হিংস্র হতে পারে! তার আচরণ কত নিষ্ঠুর, ভয়ংকর!”
নোভার মন সায় দিচ্ছে না। তবুও সে কাজটি করল। রাইসা কেমন তা আসলেই জানা দরকার। নোভা আলতো করে জিসানের কাঁধে হাত রাখল। জিসান বলল,” এইভাবে না। আরও কাছে আসতে হবে।”
নোভার খুব অদ্ভুত লাগছে। অস্বস্তিতে চোখ-মুখ কুচকে যাচ্ছে। তবুও সে জিসানের আরও কাছে এলো। জিসান খপ করে জড়িয়ে ধরল নোভার পিঠ। নোভা চমকে উঠল। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে পারল না। কারণ তখনি দেখল রাইসা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নোভা ভ্যাবাচেকা খেল, স্তব্ধ হয়ে রইল। তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল ভূমিকম্পের মতো। মনে হচ্ছে এখন ভূমিকম্পের চেয়েও ভয়ংকর কিছু হবে। কিন্তু জিসান আর নোভাকে সম্পূর্ণ বিস্মিত করে দিয়ে রাইসা তাদের কাছে এসে হাসিমুখে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল,” ভাই-বোন কোণায় দাঁড়িয়ে কি করছো? বুঝেছি, আমার নামে বিচার দেওয়া হচ্ছে বোনের কাছে তাই না? আপু, তুমি কিন্তু ওর একটা কথাও বিশ্বাস করবে না। ও একটা দুনিয়ার মিথ্যুক! নিজে বেপরোয়ার মতো চলবে অথচ আমাকে বলবে আমি শাসন করি। আমি নাকি ওকে স্বাধীনতাই দেই না। আচ্ছা তুমিই বলো ওর মতো মানুষকে যদি স্বাধীনতা দেই তাহলে তো ও পুরো দুনিয়া লণ্ড-ভণ্ড করে ফেলবে!”
নোভা আর জিসানের থমথমে চেহারার সামনে রাইসা খিলখিলিয়ে হাসছে। জিসান সাথে সাথে নোভাকে ছেড়ে দিল। নোভাও একটু দূরে সরে দাঁড়াল। রাইসা চঞ্চল গলায় বলল,” আপু তুমি আইসক্রিম খাবে? আমি কাল তিনটি ফ্লেভারের আইসক্রিম বানিয়েছিলাম। ফ্রীজে রেখে দিয়েছি। জিসান তো খেলই না। দাঁড়াও তোমাকে দেই। টেস্ট করে বলবে কোন ফ্লেভারটা বেশি ভালো হয়েছে। ”
রাইসা আইসক্রিম আনতে চলে গেল। নোভা তাকালো জিসানের দিকে। জিসান ইতস্তত হয়ে বলল,” মেয়েটা এতো নাটকবাজি কেন করছে আমি বুঝতে পারছি না। এই প্রথম ওকে এমন নাটক করতে দেখছি। কিন্তু এসব ও কেন করবে? আপনাকে নিশ্চয়ই ও ভয় পাচ্ছে না! ইন ফ্যাক্ট ও কাউকেই ভয় পায় না। তাহলে?”
নোভা উত্তরে কিছু বলল না। জিসান একটু কাছে এসে বলল,” আপনার মনে যদি তবুও সন্দেহ থাকে তাহলে আমি বলবো রত্নার সঙ্গে কথা বলুন। সবকিছুর সাক্ষী হলো রত্না। আমার প্রতি রাইসা ঠিক কতটা নির্দয় তা রত্নাই ভালো বলতে পারবে। তাছাড়া রত্নাকে নিয়েও তো রাইসা অনেক নোংরা কাহিনী করেছে। সেসব যদি এখন বলি তাহলে আপনি লজ্জায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। আর আমিও এই ধরণের কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারবো না। একটা মেয়ের মাথায় কি করে এমন অসুস্থ চিন্তা-ভাবনা আসতে পারে? ছি, জঘন্য!”
নোভা নরম কণ্ঠে বলল,” আমি যাচ্ছি।”
জিসান গমগমে স্বরে বলল,” থামুন। আগে শুনে যান।”
জিসান বড় করে একটা শ্বাস নিল প্রথমে। তারপর অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়েই বলতে লাগল ” রাইসার ধারণা হলো রত্নার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কি ধরণের সম্পর্ক? অথচ ওকে আমি বোনের নজরে দেখি। একদিন রত্নার ফুড পয়জনিং হলো। সে খুব বমি করছিল। রাইসার ধারণা হলো রত্না প্রেগন্যান্ট। আর ও সন্দেহ করল আমাকে। কোনোকিছু যাচাই-বাছাই ছাড়াই ও ছুরি দিয়ে দশটা আঁচড় কে’টেছিল আমার পিঠে। ”
নোভা বিমূঢ় মূর্তি বনে গেল কথাগুলো শুনে। জিসান স্বাভাবিক গলায় বলল,” এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। যে মেয়ে সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে নোংরা দুঃস্বপ্ন দেখে তার পক্ষে এমন সন্দেহ করাই স্বাভাবিক। কেবল দুঃস্বপ্নের উপর ভিত্তি করেই সে আমার আর রত্নার উপর অনেক অত্যাচার করেছে। কথাগুলো অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। আর সেদিনের সেই আঘাতের চিহ্ন এখনও আমার পিঠে আছে। আপনি দেখতে চাইলে আমি আপনাকে টি-শার্ট খুলে দেখাবো।”
জিসান সত্যি খুলতে যাচ্ছিল। নোভা বিব্রত হয়ে বলল,” টি-শার্ট খোলার দরকার নেই। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করেছি।”
” থ্যাংকস।”
নোভা দুইহাতে মুখ মালিশ করল। কি একটা ভেবে নিয়ে বলল,” রত্নাকে ডাকুন। আমি ওর সাথে আলাদা কথা বলবো।”
রাইসা ফারিহাকে আইসক্রিম দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল,” নোভা আপু কোথায় গেল?”
জিসান শান্ত গলায় জবাব দিল,” ওয়াশরুমে গেছে।”
” আর রত্না কোথায়?”
” রত্না নোভাকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিতে গেছে।”
রাইসা ভ্রু কুচকে বলল,” অদ্ভুত! নোভা আপু কি অন্ধ যে ওয়াশরুম একদম দেখিয়ে দিতে হবে?”
এ কথা বলেই হাসতে শুরু করল রাইসা। ফারিহা খুব মুগ্ধ হয়ে দেখছে। কথায় কথায় এভাবে যে হাসতে পারে তার মন অবশ্যই সরল।
নোভা আর রত্নার কথা-বার্তা শেষ হওয়ার পর তারা দরজা খুলে রুম থেকে বের হলো। তখন ফারিহা রাইসার সঙ্গে ডাইনিংরুমে বসে গল্প করছিল। জিসান রত্নাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,” আপনাদের আলোচনা হয়েছে?”
নোভা হেসে বলল,” হুম। সব আলোচনা হয়ে গেছে। এভ্রিথিং ইজ ক্লিয়ার নাউ।”
নোভার বলার ধরণটা কেমন রূঢ় শোনাচ্ছে। জিসান নিশ্চিত হতে আলাদাভাবে রত্নাকেও জিজ্ঞেস করল,” সব সত্যি বলেছো তো?”
রত্না বলল,” জ্বী ভাইজান। আজকে সব সত্যি বলছি।”
নোভা হাসিমুখে রত্নার কাঁধে হাত রেখে বলল,” গুড। তুমি খুব সাহসী মেয়ে।”
জিসান খুব নিশ্চিন্তবোধ করছিল। এবার মনে হয় তার কাজটা সফল হবে।
বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সিতে ওঠার পর ফারিহা সবসময়ের মতো নোভাকে জিজ্ঞেস করল,” কি বুঝলেন ম্যাম? এখানে আসল কালপ্রিট কে? মিসেস রাইসা নাকি মিস্টার জিসান?”
নোভা চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,” মিস্টার জিসানই হচ্ছেন আসল কালপ্রিট।”
ফারিহা প্রত্যাশিত উত্তর পেয়ে সন্তোষজনক হাসি দিল। ঘাড় নেড়ে বলল,” একদম ঠিক ধরেছেন আপনি। আমারও এটাই মনে হয়েছে। আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন ম্যাম?”
” এখন আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমার সব হিসাব মিলে গেছে ফারিহা।”
” কিভাবে মিলল?”
” রত্নার সাথে আমার আলাদা কথা হয়েছে। ভাগ্যিস আলাদা কথা বলার বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল। নাহলে এতোকিছু বোঝাই হতো না। রত্নার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী মিস্টার জিসান একজন ঘৃণ্য চরিত্রের মানুষ। রত্নার সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক চলছে আটমাস ধরে। মিসেস রাইসা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর নিয়মিত জিসান রত্নার ঘরে যাতায়াত করে।”
” কি বলছেন!”
” শুধু তাই না, রাইসাকে খু’ন করার সমস্ত পরিকল্পনা রত্নাকে জানিয়ে রেখেছেন মিস্টার জিসান। কিন্তু রত্না বাঁধা দিয়েছে। যে কারণে ও এখন ব্লেকমেইলের স্বীকার। মিস্টার জিসান রত্নাকে হুমকি দিয়েছিলেন যাতে আমার কাছে সত্যিটা না বলে। কিন্তু রত্না আমাকে সত্যি বলে দিয়েছে। আরেকটা ব্যাপারে রত্না কি বলেছে জানো?”
” কি ম্যাম?”
” আসাদ সাহেব মা’রা যাননি। তাকে খু’ন করা হয়েছে। আর খু’নটা করেছেন জিসান। এটা সবার ধারণা। এখনও কিন্তু প্রমাণ হয়নি। তবে আমি এই ব্যাপারে নিশ্চিত। মিস্টার জিসানের সাথে আমি কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলাম যে কাজটা তিনিই করেছেন।”
” ডেঞ্জারাস কেইস ম্যাম। ইটস হরিবল! কিন্তু মিস্টার জিসান আপনার কাছে কেন এসেছেন? তিনি কেন নিজের ট্রিটমেন্ট করাতে চাইছেন? এসবের মানে কি?”
” এর মানেটাও আমি বের করে ফেলেছি ফারিহা। জিসান একজন সিরিয়াল কিলার। আমার মনে হয় মিসেস রাইসাকে খু’ন করার পর উনি রত্নাকেও খু’ন করবেন। উনি এখন আমার কাছে এসেছেন যাস্ট একটা প্রুফ রাখার জন্য। যখন এইসব খু’ন-খারাবীতে তিনি ফেঁসে যাবেন তখন কাজে লাগবে আমার দেওয়া রিপোর্টগুলো। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি কাউকে খু’ন করলে আইন তার শক্ত বিচার করতে পারবে না। হয়তো এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছেন মিস্টার জিসান। প্রথমে তিনি নিজেকে সাইকো প্রমাণ করবেন। তারপর একটার পর একটা খু’ন করবেন। কেউ কিছু বলতে আসবে না!”
ফারিহা বিস্ময়ে হতভম্ব বনে গিয়ে বলল,” ওহ মাই গড, ওহ মাই গড! কত চালাক মানুষ উনি! হোয়াট আ মাস্টারপ্ল্যান! ম্যাম, আপনার অনেক বুদ্ধি। আপনি কত সুন্দরভাবে সবটা বুঝে ফেললেন। এখন কি করবেন ম্যাম? আমার খুব খারাপ লাগছে মিসেস রাইসার জন্য। আহারে সহজ-সরল মেয়েটা!”
নোভারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই রাইসা ধারালো কাটাচামচের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করতে লাগল জিসানের ডানহাত। রক্ত ছিটকে বের হচ্ছিল। এহেন নৃশংসতা দেখেই মুখ চেপে কেঁদে ফেলল রত্না। জিসানের আর্তনাদ তার সহ্য হচ্ছে না! তাকে এমন শাস্তি দেওয়ার কারণ, ডানহাত দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই সে এক যুবতী নারীর পিঠ স্পর্শ করেছে!
চলবে