#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ৬,০৭
লিখা- Sidratul Muntaz
০৬
কফি খাওয়ার পাঁচ থেকে দশমিনিট পরেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল জিসান। রাইসা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে বাহিরে থেকে দরজা লক করে দিল। কমপক্ষে সাত-আট ঘণ্টার আগে জিসানের ঘুম ভাঙার কথা নয়। রাইসা দৃঢ় পায়ে রত্নার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতে ধারালো একটি ছুরি তার। রত্না এতোক্ষণ বিছানায় মনখারাপ করে বসেছিল। জিসানের জন্য চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। হঠাৎ রাইসাকে ছুরি হাতে রুমে ঢুকতে দেখে তার আত্মা সহসাই কেঁপে উঠল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে নড়বড়ে হয়ে বুকে থুতু দিয়ে নিল। সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। রাইসা এগিয়ে আসছে ভয়ংকর দৃষ্টিতে। ওই মুহূর্তে রাইসাকে কোনো মানবী মনে হচ্ছিল না। অশরীরী, অতৃপ্ত কোনো দানবী মনে হচ্ছিল। যেকোনো সাধারণ মানুষ এই অবস্থা দেখলে মূর্ছা যাবে। কিন্তু রত্না অভ্যস্ত। তবুও তার আতঙ্ক আর অস্থির লাগছে। সুযোগ বুঝে রত্না সাইড কেটে দৌড়ে পালিয়ে যেতে নিল। কিন্তু রাইসা পেছন থেকে শক্তভাবে তার হাতটা ধরে ফেলল। শুরু হলো ধস্তাধস্তি। রত্না কেঁদে ফেলল। চিৎকার করে গলা ফাটাতে মন চাইছে। তাদের বাড়িটা এমন জায়গায় যেখানে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে কেউ মারা গেলেও শোনার মানুষ নেই। তবে রত্না চিৎকার করবে জিসানকে শোনানোর জন্য। জিসান কি শুনবে? বেশিরভাগ সময় সে শুনেও আসে না। রত্না যদি তার নাম ধরে ডাকে, তাহলে নিশ্চয়ই আসবে! রত্না গলা ফাটিয়ে ডাকল,” ভাইজান, ও ভাইজান!”
রত্নার তীব্র চিৎকারের উত্তর দিতেই তীব্র হাসিতে ঢলে পড়ল রাইসা। মুখে হাত দিয়ে হাসতেই লাগল থেমে থেমে। ওই হাসির শব্দে শরীরের রক্ত আরও হীম হয়ে আসে। রত্না ক্রমশ পিছিয়ে যেতে লাগল। রাইসা কটমটে দৃষ্টিতে বলল,” ডাক, আরও বেশি করে ডাক। ও আসবে না। তোকে বাঁচাতে ও আর আসবে না। ও এখন নিবিড় ঘুমে তলিয়ে আছে। ওর এই ঘুম ভাঙবে রাতে। এখন থেকে আরও সাত-আটঘণ্টা পর। এইটুকু সময় তোকে মে’রে ফেলার জন্য যথেষ্ট! তোকে মে’রেই আজ আমি লা’শ গুম করে দিবো। জিসান জানতেও পারবে না কোনোদিন তোর কথা। আমি ওকে বলবো, তুই আমার ভয়ে এখান থেকে পালিয়ে গেছিস। শেষ! ”
রাইসা খিলখিল করে হাসছে। রত্না ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মুখে হাত ঠেকাল। এ কি সর্বনাশের কথা শুনছে সে! কফিতে তাহলে ঘুমের ঔষধ মেশানো ছিল? হায় সর্বনাশ! রত্না এমনটা কখনও কল্পনা করেনি।ছোটবেলা থেকেই রাইসার এমন ভয়ংকর রূপ দেখে অভ্যস্ত সে। কত সাইক্রিয়াটিস্ট, ডক্টর, কবিরাজ দেখানো হয়েছিল। কবিরাজের দেওয়া তাবিজ দিয়ে রাইসার শরীর আবৃত ছিল। কিন্তু কিছুই কাজে লাগেনি। কেউই কোনো সমাধান বের করতে পারেনি। তাকে সুস্থ করা যায় না তবে কিছুসময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাঝে মাঝে তাকে অবচেতন করে রাখা হয়। কিন্তু প্রত্যেকবারই হুশ ফেরার পর সে আরও হিংস্র রূপ ধারণ করে। তাই বলে রত্নাকে কখনও মে’রে ফেলার চেষ্টা করেনি সে। তবে আজ কি হলো? রত্না কাঁদছে অসহায়ের মতো।
চোখেমুখে তীব্র মৃত্যুভয়। রাইসা কাছে এসে রত্নার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরল। জিজ্ঞেস করল,” বাঁচতে চাস? বল, বাঁচতে চাস তুই?”
রত্না চোয়ালে তীব্র ব্যথা নিয়ে কথা বলতে পারল না। শুধু মাথা উপর-নিচ করে উত্তর দিল। সে অবশ্যই বাঁচতে চায়। এবার রাইসা বলল,” তাহলে আমার আর জিসানের জীবন থেকে চিরজীবনের মতো চলে যাবি। তোর ভাগের যত সম্পত্তি আর টাকা-পয়সা আছে সব নিয়ে যা। প্রয়োজনে আমার ভাগের জিনিসও নিয়ে যা। শুধু জিসানকে ছেড়ে দে। একমাত্র জিসান আর এই নীরব বাড়িটা ছাড়া আমার অন্য কিচ্ছু লাগবে না। আমি আর জিসান সারাজীবন এই বাড়িতে কাটিয়ে দিতে পারবো। তুই না থাকলেই আমাদের জীবন সুখের হবে। তুই চলে যা এখান থেকে রত্না। যদি বেঁচে থাকতে চাস তাহলে এক্ষুণি, এই মুহূর্তে চলে যা!”
রত্নার চেহারা থেকে ভয় সরে গেল। কাঠিন্য ভর করল চোখে। হঠাৎ ফোঁস করে জ্বলে ওঠা বিস্ফোরণের মতো বলল,” আমি কখনোই যাবো না। গেলে তুমি যাবে এখান থেকে। আমার যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তুমি ভাইজানের জীবনটা শেষ করে দিচ্ছো। আমি এখান থেকে চলে গেলে সে তো ম’রেই যাবে। তাকে এই ভয়ংকর পরিবেশে একা ফেলে আমি চলে যেতে পারবো না। প্রয়োজনে মে’রে ফেলো আমাকে। তাও আমি জিসান ভাইকে রেখে কোথাও যাবো না। কক্ষনো না।”
রাইসা ঠাস করে চড় মারল রত্নার গালে। চড়ের ধাক্কা এতো বেশি ছিল যে রত্না ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেছে। রাইসা নিচু হয়ে তার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল। হিংস্র গলায় বলতে লাগল,” আমি জানতাম, জানতাম! তোর সব লোভ জিসানের প্রতি। ছোটবেলা থেকেই আমার সব প্রিয় জিনিসে তোর নজর থাকে। অধিকার না থাকা সত্ত্বেও তুই কেড়ে নিয়েছিস। আমার সবকিছু ছিনিয়ে আমাকে নিঃস্ব বানিয়েছিস। তোর কারণেই আমি এতো খারাপ হয়ে গেছি। আমাকে নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করেছিস তুই। অথচ কেউ সেটা বুঝল না। তোর কষ্টটাই সবাই দেখল কেবল। কিন্তু তুই যে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে কষ্ট দিস এটা তো কেউ দেখল না! মা-বাবা, দাদু কেউই আমাকে বোঝেনি। সবাই তোর জন্য কষ্ট পেয়েছে। এমনকি জিসানও আমার কষ্ট বুঝতে পারছে না। সেও শুধু তোর জন্যই কষ্ট পাচ্ছে! আমি এটা মানতে পারবো না। আর মানতে পারবো না। আমার জিসান শুধু আমাকে ভালোবাসবে। ও শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা করবে। ওর একমাত্র জীবনে, একমাত্র মানুষ হয়ে শুধু আমিই থাকবো। আর কেউ থাকতে পারবে না, একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত না! শুনতে পাচ্ছিস রত্না? জিসান আর আমার মাঝখানে আমি একটা পিঁপড়েকেও সহ্য করবো না। আর তুই তো রক্তে-মাংসে গড়া আস্তো একটা মানুষ! তোকে কিভাবে সহ্য করি? তুই ম’র। আজকে তোকে ম’রতেই হবে।”
রাইসা শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে ছুরিটা গেঁথে দিতে চাইল রত্নার পেটে। রত্না তার চেয়েও দিগুণ শক্তি প্রয়োগ করে রাইসার হাত চেপে ধরল। ছুরি রত্নার পেট স্পর্শ করতে পারল না। রাইসা আরও রাগে চিড়বিড় করে ধাক্কা মারল রত্নাকে। রত্না মেঝেতে ছিটকে পড়ে গেল। রাইসা তার উপর উঠে আসতে নিলেই রত্না পা দিয়ে ল্যাং মেরে ফেলে দিল তাকে। রাইসা মেঝেতে চিৎ হয়ে গেল। খুব জোরে ধাম শব্দ হলো। রাইসার মাথা ফেটে সম্ভবত রক্ত বের হচ্ছে। রত্না এই সুযোগে নিজের এতোদিনের সব রাগ মেটাতে ইচ্ছেমতো রাইসার গালে, পিঠে,পেটে অনেকগুলো চড়, ঘুষি মারল। মুখে খামচালো। কিড়মিড় করে বলল,” তুই একটা সাইকো। তোর মতো পাগলের থেকে জিসান শুধু মুক্তি চায়। সারাজীবন থাকা তো দূর, তোকে এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারছে না ও। তোকে মে’রে ফেলতে চায়। ও এখন শুধু আমাকে ভালোবাসে। এই রত্নাকে! তোর মৃত্যুর অপেক্ষায় আছি আমরা। তুই মা’রা যাওয়ার পর আমি আর জিসান সুখের সংসার করবো।”
রত্না এই কথা বলে পৈশাচিক হাসি হাসল। তারপর উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। রাইসা শেষ কথাটা সহ্য করতে পারেনি। ওই অবস্থাতেই রত্নার দিকে ছুরিটা ছুড়ে মারল। রত্না নিজেকে সামলানোর আগেই তার বাহুর একসাইড কে’টে র’ক্ত বের হয়ে গেল। এদিকে রাইসা মাথার অতিরিক্ত যন্ত্রণার কারণে মূর্ছা গেছে। কিন্তু রাইসার অচেতন অবস্থা দেখে রত্নার ঠোঁটে হাসি ফুটল। স্বস্তির হাসি। সে ভাবল রাইসা বুঝি মা’রা গেছে! পথের কাঁটা সরে গেছে!
হসপিটালের করিডোরে পায়চারী করছে জিসান৷ তাকে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত আর অস্থির দেখাচ্ছে। রাইসা আইসিইউতে। হেড ইনজুরির কারণে তার মাথার খুলি ফেটে গেছে। মস্তিষ্কের চারপাশের স্তরগুলি থেকে রক্তপাত হচ্ছে। খুবই শোচনীয় অবস্থা। তবে জিসান মনে-প্রাণে চাইছে রাইসা সুস্থ হয়ে উঠুক। অথচ গতকালও রাইসাকে মে’রে ফেলতে চাইছিল সে। কিন্তু আজ চাইছে রাইসা যেকোনো মূল্যে বেঁচে থাকুক। কি অদ্ভুত মানুষের মন! কি অদ্ভুত!
রত্না দ্রুত এসে বলল,” ভাইজান, আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
মেয়েটা কেঁদে-কেটে বেসামাল। চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। জিসান তাকে বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুঁয়ে আসতে বলেছিল। সে গিয়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। রত্না কেন এতো ভেঙে পড়ছে? রাইসার জন্য? অথচ জিসান ভেবেছিল রাইসাকে রত্নাও খুব ঘৃণা করে। তবে এখন মনে হচ্ছে সেও জিসানের মতোই অদ্ভুত। যেমন জিসান আজ রাইসার এই বিপদেই বুঝতে পারছে ঘৃণা নয়, ভালোবাসা এখনও বেঁচে আছে।
রত্না উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাত ধরে টেনে জিসানকে নিয়ে এলো নির্জন জায়গায়। জিসান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে রত্না? তুমি এমন করছো কেন?”
রত্না আশেপাশে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,” আপামণির বাঁচার সম্ভাবনা কি আছে?”
” আমি এখনও জানি না। ওকে আইসিউ থেকে বের করার পর জানা যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। আমার মনে হচ্ছে রাইসা সুস্থ হয়ে যাবে। বাহ্যিক রক্তপাত তো বেশি হয়নি। তবে মাথার ভেতরে কতটা ক্ষতি হয়েছে সেটা নিয়েই টেনশন।”
রত্না বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল,” আমি আপামণির সুস্থতা নিয়ে একটুও চিন্তা করছি না। আমি তো চিন্তা করছি আমাদেরকে নিয়ে। সে সুস্থ হলে আমাদের জীবন জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বে৷ তার তো ম’রে যাওয়াই উচিৎ। কেন তাকে হসপিটালে আনলেন?”
” কি বলছো এসব রত্না? তাই বলে ম’রে যাবে?”
” অবশ্যই ম’রে যাবে। তার মতো মানুষ ম’রে গেলে দুনিয়ার কোনো ক্ষতি নেই। বরং আমরা কিছুদিন নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকতে পারবো।”
জিসান মাথা নিচু করে রইল। রত্নার কথাগুলো শুনতে তার কেন যেন খারাপ লাগছে। রত্না জিসানের হাত ধরে বলল,” জিসান ভাই, চলেন একটা কাজ করি। আপা এইখানে থাকুক। আমরা পালিয়ে যাই।”
জিসান বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” আমরা পালাবো কেন? আমরা তো ওর কোনো ক্ষতি করিনি। এটা সিম্পল একটা এক্সিডেন্ট রত্না।”
রত্না ভ্রু কুচকে বলল,” কিন্তু সে বেঁচে উঠলে যে আমাদের ক্ষতি করবে!”
জিসান দুইহাতে মুখে মালিশ করে নিল। তারপর বলল,” আগে বেঁচে উঠুক, দেখা যাবে।”
জিসান চলে যেতে নিচ্ছিল। রত্না আবার হাত ধরে বলল,” আপনাকে আমার অনেক কথা বলার আছে জিসান ভাই। আপনি কিছুই জানেন না। এমনকি আমার পরিচয়টাও জানেন না৷ আমার সাথে রাইসা আপার সম্পর্ক এমন সাপে-নেউলের মতো কেন হলো সেই ইতিহাস আজ আপনাকে শোনাবো। কিন্তু তার আগে আপনাকে কথা দিতে হবে। আপনি আমাকে সাপোর্ট করবেন। সবসময় আমার পাশে থাকবেন।”
জিসানের এই মুহূর্তে কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। তবুও অনিচ্ছাকৃত বলল,” ঠিকাছে শুনবো৷ আর আমি তোমাকে নিশ্চয়ই সাপোর্ট করি রত্না। সবসময় সাপোর্ট করি।”
রত্না তরল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” ভালোবাসেন?”
জিসান চমকে উঠল। প্রশ্ন করল,” ভালোবাসা মানে?”
রত্না উতলা হয়ে বলল,” যতটা ভালোবাসা থাকলে সবকিছু ছেড়ে আপনি আমার সাথে চলে যেতে পারবেন। ততটাই ভালোবাসেন তো? বলেন না!”
জিসান হতভম্ব! সাথে সাথে রত্নার হাত ছেড়ে বলল,” আবোল-তাবোল কি বলছো এসব?”
রত্না নাছোড়বান্দার মতো দৃঢ় কণ্ঠে আওড়ে গেল,” লুকিয়ে লাভ নেই। আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন। অবশ্যই ভালোবাসেন। না হলে আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতেন না। আমার এতো খেয়ালও রাখতেন না। অনেকবার আপার হাত থেকে আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আপাকে আপনি মে’রে ফেলতে চান কেন? যেন আমাকে নিয়ে ভালো থাকতে পারেন তাই তো! কিন্তু আমি কাজের মেয়ে বলে আমাকে আপনি সরাসরি কখনও এসব বলেননি। তবুও আমি বুঝি। তাই আজ আপনাকে সত্যি কথাটা জানানো খুব দরকার। রাইসা আপার সামনে এটা কোনোদিন বলা সম্ভব ছিল না। আমি কিন্তু কাজের মেয়ে না। আমি আইনত রাইসা আপার বোন হই। আসাদ খানের মেয়ের হিসেবে রাইসা আপার যতটুকু অধিকার আমারও ততটুকুই অধিকার!”
জিসানের কেমন যেন সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সে আসাদ আঙ্কেলের থেকে শুনেছিল, তিনি নাকি এতিমখানা থেকে একটা অসহায় মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু রাইসার যন্ত্রণায় তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই মেয়েই কি তাহলে রত্না? এতোবড় সত্যি রাইসা কেন গোপন করল তার কাছে! রত্না আবার বলল,” আমি মিথ্যে বলছি না ভাইজান। আমার কথা বিশ্বাস করুন। আমার নামে ব্যাংকে বাবা অনেক অনেক টাকা রেখে গেছেন৷ ফ্ল্যাটও লিখে দিয়েছেন। এসব নিয়ে আমরা অনেক সুখের জীবন কাটাতে পারবো। আপনি রাইসা আপাকে ছেড়ে চলে আসুন।”
জিসান নিজেকে শান্ত রেখে বলল,” রত্না, তোমার অনেক বড় একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। আমি কখনও তোমার জন্য কিছু ফীল করিনি। ইউ আর লাইক মাই লিটল সিস্টার। জেসি! জেসিকে যখন আমি শেষবার দেখেছিলাম ওর বয়সটা তখন তোমার মতোই ছিল। তাই তোমার প্রতি আমার একটা সফট ফিলিংস কাজ করেছে। আই লাইক ইউ বাট এজ আ সিস্টার। তুমি এটা ভুল দিকে নিয়ে যাচ্ছো। আর অনেক কিছু ভেবে ফেলছো। কিন্তু আমি এর জন্য কোনোভাবেই রেসপন্সিবল না।”
জিসান এসব কথা বলে রত্নাকে স্তব্ধ করে দিল। রত্না নিস্তরঙ্গ দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দেখল, জিসান চলে যাচ্ছে। রাইসাকে নিয়ে ভীষণ উদগ্রীব সে! রত্নার কথা ভালো করে শোনার সময়টুকুও নেই। তাহলে এতোদিন ধরে রত্নার ধারণা কি ভুল ছিল? তার স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা সবই কি ভুল ছিল? এভাবে কিভাবে সব ভুল হতে পারে? রত্নার নিজেকে আজ সবচেয়ে অসহায় মনে হচ্ছে। মাথায় হাত রেখে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,” আমার সাথে কেন এমন হলো?”
চলবে
#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ৭
লিখা- Sidratul Muntaz
ডক্টর সিফাতের কথা শুনে জিসানের মাথাখারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। সে যেই আশঙ্কা করেছিল অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ। সিফাত খুব স্বাভাবিক ভাষায় বলে যাচ্ছেন কথাগুলো। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু জিসানের মনে হচ্ছে অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে!
“প্রাথমিক অবস্থায় মিসেস রাইসার আঘাতকে কনকাশন মনে করা হলেও সিটিস্ক্যানের পর নিশ্চিত বোঝা গেছে এটা ‘ট্রোম্যাটিক ব্রেইন ইনজুরি’র তৃতীয় পর্যায়। মাথায় আঘাত পাওয়ার পর সাধারণত পনেরো মিনিট অচেতন অবস্থাকে বলা হয় দ্বিতীয় পর্যায়। রোগী কতক্ষণ অচেতন থেকেছে সেই সময় দিয়েই পর্যায়গুলো নির্ধারিত। দ্বিতীয় পর্যায়ের আঘাতের ক্ষেত্রে রোগীর সুস্থ হতে চার সপ্তাহের বেশি সময় লেগে যায়। আর সুস্থ হওয়ার পরেও মাঝে মাঝে মাথাব্যথা, আচরণে পরিবর্তন, অন্যমনস্কতা পরিলক্ষিত হতে পারে। কয়েক বছর পর্যন্ত এই সমস্যা স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু তৃতীয় পর্যায়টা সবচেয়ে ক্ষতিকর।রোগী মাথায় আঘাত লাগার পর এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অচেতন থাকেন তাহলে তাঁর ‘টিবিআই’ এর মাত্রা তৃতীয় পর্যায়ের বিবেচনা করা হয়৷ আর রোগীর উপর এ ধরনের আঘাতের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে৷ বিশেষ করে তাঁর শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষতি হতে পারে৷ এক্ষেত্রে রোগীর হৃদযন্ত্রের কর্মকাণ্ডেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন, এমনকি তাঁর ব্যক্তিত্বেও অনেক পরিবর্তন ঘটতে পারে৷ তৃতীয় পর্যায়ের ক্ষতিগুলো সাধারণত অপূরণীয় হয়৷”
জিসান হতাশ কণ্ঠে কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু চিন্তা করল কি হবে? রাইসা একঘণ্টার চেয়েও অনেক বেশি সময় ধরে অচেতন ছিল। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। ইমারজেন্সী ব্লাডও লেগেছে। জিসান ডোনারের ব্যবস্থা করেছে দিশেহারার মতো। রাইসা আর রত্নার ঝগড়ার সময় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল সে। কিভাবে যে ওইসময় তার এতো ঘুম পাচ্ছিল কে জানে? কফিতে রাইসা কিছু মিশিয়েছিল তা নিশ্চিত। সে জিসানকে ঘুম পাড়িয়ে রত্নাকে হ’ত্যা করতে চেয়েছিল। কি ভয়াবহ ব্যাপার! রত্না শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে। যার ফলশ্রুতিতে রাইসার এই অবস্থা। এটাকে এক্সিডেন্টই বলা যায়। তবে জিসানের মনে হচ্ছে, রত্না বেশি দেরিতে জিসানকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিল। যদি আরও আগে জাগাতো তাহলে এতোবড় ক্ষতিটা হতো না। আফসোস হচ্ছে, বিশাল আফসোস। জিসানের শুধু মনে হচ্ছে রাইসার সাথে তার আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকার দরকার ছিল। আরও কিছু কথা তাকে বলার ছিল। তাদের একসাথে পথচলার সময়টা এতো স্বল্প কেন? ইশ, জিসান যদি আগে এই স্বল্পতার কথা জানতো তাহলে না হওয়া অনেক কথা সে রাইসাকে বলতো। যে কথাগুলো গত একবছর যাবৎ নিজের মনে জমিয়ে রেখেছিল। ডক্টর সিফাত বললেন,” আর ইউ ওকে মিস্টার জিসান? আমার কথা বুঝতে পারছেন?”
জিসান অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল,” হয়তো পারছি। আমার স্ত্রী বেঁচে থাকবে তো স্যার?”
” বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। কিন্তু বেঁচে ওঠার পর তিনি আগের মতো থাকবেন কি-না সেই গ্যারান্টি দিতে পারছি না।”
জিসান কোনো কথা বলল না। ছন্নছাড়ার মতো বেরিয়ে এলো ইমারজেন্সী ইউনিট থেকে। করিডোরে এসেই একটি আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন হলো। ডক্টর নোভা আর ফারিহা দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের দৃষ্টিতে ক্রোধ। এমনভাবে জিসানকে তারা দেখছে যেন জিসান কোনো অপরাধী!
জিসান স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় কুশলাদি জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছেন মিস নোভা?”
নোভা উত্তর দিল না। ফারিহার দিকে তাকাল বাঁকা চোখে। ফারিহাও হাত ভাজ করে চেয়ে আছে কিভাবে যেন। জিসান আবার প্রশ্ন করল,” আপনারা কি রাইসার এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে এখানে এসেছেন? কে জানালো আপনাদের?”
নোভা কিছু বলল না। তবে ফারিহা বলল,” এক্সিডেন্ট! এতোবড় ঘটনাকে এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দিচ্ছেন মিস্টার জিসান? আপনার কি লজ্জা করে না?”
জিসান হকচকিয়ে গেল। নোভা বলল,” লজ্জা কেন করবে? আটমাস ধরে তো তিনি এই পরিকল্পনাই করছিলেন। অবশ্য সফলও হয়েছেন। বলতেই হয় ব্রিলিয়ান্ট! ঠান্ডায় মাথায় জটিল সমস্যার একদম সহজ সমাধান।”
জিসান ভ্রু কুচকে বলল,” মানে? আপনাদের কথা আমি বুঝতে পারছি না।”
নোভা কাছে এসে বলল,” সব বুঝতে পারবেন। আগে থানায় চলুন।”
” থানায় কেন?”
ফারিহা জবাব দিল,” এটেন্ড টু মার্ডার কেইসে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে মিস্টার জিসান। আমাদের সঙ্গে আছেন ইন্সপেক্টর শরাফত উল্লাহ। ”
জিসান সামনে তাকাতেই পুলিশ ও একজন সহকারীকে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পেল। জিসানের টনক নড়ে উঠল৷ এতোক্ষণে সে বুঝতে পারল মিস নোভার চেম্বারে গিয়ে সেদিন রাইসাকে মে’রে ফেলার ব্যাপারে যা কিছু বলেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতেই এসব হচ্ছে। রাইসার এই ভয়ংকর এক্সিডেন্টকে মার্ডার ভাবা হচ্ছে। আর এর পেছনেও জিসানকে দায়ী মনে করা হচ্ছে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন তো থেকেই যায়। মিস নোভা রাইসার এক্সিডেন্টের কথা জানলেন কি করে? তাকে কে খবর দিল? জিসানকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই পুলিশ ও তার সহকর্মী হাতকড়া বেঁধে গাড়িতে তুললেন। সাহায্য করল নোভা আর ফারিহা। তাদের কাছে নাকি জিসানের স্টেটমেন্ট রেকর্ডেড আছে। আরেকজন বিশেষ মানুষ জিসানের নামে অভিযোগ করেছে। তার স্টেটমেন্টও রেকর্ডেড আছে। সবকিছুর ভিত্তিতে জিসানকে ক্রিমিনাল ভাবা হচ্ছে। অথচ একমাত্র জিসান জানে, সে তার উনত্রিশ বছরের জীবনে কখনোই কোনো অন্যায় করেনি! তার সবকিছু দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিল। এই দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাইসার জেগে ওঠা খুব জরুরী। একমাত্র রাইসা সুস্থ হলেই সবাই জানবে যে জিসান নিরপরাধ। এমনিতে জিসানের মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু যদি রাইসা ম’রে যায় তাহলে জিসানেরও বাঁচার পথ থাকবে না। তার ফাঁসি হবে! পুলিশের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। জিসান জানালা ভেদ করে হসপিটালের বাহিরের একটি দৃশ্য দেখতে পেল। রত্না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁদছে। নোভা আর ফারিহা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। সম্ভবত তাকে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে। জিসান এই দৃশ্যটি দেখেই সমস্ত হিসাব বুঝে নিল। কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। রত্না এতোবড় প্রতারণা কেন করল!
চলবে