অন্তরীক্ষে_অন্ধকার পর্ব ১১

0
230

#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ১১
লিখা- Sidratul Muntaz

ঈদের বাকি ছুটির দিনগুলোতে জিসান তার মফস্বলে ফিরে গেল। কিছুদিন মা-বোনের সাথে থাকা। মা’কে জিসান রাইসার কথাও জানালো। জেসি আগ্রহ নিয়ে রাইসার ছবি দেখলো। তার ভীষণ পছন্দ হলো। রাইসার সাথে কথা বলার জন্য সে খুব অস্থিরতা দেখাল। কিন্তু জিসান বলল,” এখন কথা বলা যাবে না। আর ফোনে কথা বলে লাভ কি? একদম ফেইস টু ফেইস কথা বলবি। একদিন বাড়ি নিয়ে আসবো।”
জেসি আনন্দে ঢলে পড়ল।
” সত্যি ভাইয়া? ভাবী আমাদের বাড়ি আসবে? কবে আসবে?”
এখন থেকে জেসি ভাবী ডাকা শুরু করেছে। জিসানের খুব অস্বস্তি লাগল। জেসমিন বেশি খুশি হলেন না। কিন্তু ছেলেকে এই বিষয়ে তিনি কিছু বলতেও পারলেন না। শহুরে মেয়ে তাও আবার বড়লোক। কেমন না কেমন হয়! তাছাড়া ছেলে বিয়ে করাতে হয় নিচুঘর দেখে। নিজেদের চেয়ে উঁচুঘরের মেয়ে আনলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। বাপের আদরের মেয়ে হিসেবে এরা হয় চরম অবাধ্য। বিয়ের পর খুব ভোগান্তি হবে সংসার নিয়ে। কিন্তু জিসানের মাথায় কি এসব ঢুকবে? দেখে তো মনে হচ্ছে এই মেয়েকে বিয়ে করতে সে খুব আগ্রহী। জেসমিন তাই মুখ ফুটে মনের কথাগুলো বলতে পারলেন না। জিসান নরম গলায় প্রশ্ন করল,” মা, তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”
জেসমিন সরাসরি হ্যাঁ অথবা না বললেন না। তবে বললেন,” মেয়ে তো বেশি সুন্দর। এতো সুন্দর ভালো না।”
” ভালো না মানে?”
” গরীব ঘরের মেয়ে হলে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু অত বড়লোকের মেয়ে তার উপর এতো সুন্দর। চরিত্র ভালো হবে তো?”
” চরিত্র ভালো হবে না কেন? কি যে আজব কথা তুমি বলো মা! রাইসা ভালো মেয়ে।”
” উপরে উপরে তো সবাই ভালো। ভেতরে কি আছে কে জানে?”
জিসান কোনো কথা বলল না। মা যে রাইসাকে পছন্দ করেননি সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অপছন্দ করার কি আছে? জিসান চিন্তা করল একবার রাইসাকে বাড়ি এনে মায়ের সাথে দেখা করালেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সামনা-সামনি রাইসাকে দেখলে মায়ের সন্দেহ মুছে যাবে।
জিসান এক সপ্তাহ পর ঢাকায় ফিরে এলো। ফ্ল্যাটে এসেই সে একটা বড় চমক পেল। রাইসা নাকি সকাল থেকে এসে বসে আছে। খুব সাজগোজ করে এসেছে। গাঢ় রঙের শাড়ি, ঝকমকে জুয়েলারি, মুখভর্তি মেকাপ, তাকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ির মেহমান। জিসানকে দেখে লাজুক মুখে হাসল রাইসা। জিসানের তখন সর্বপ্রথম যে কথাটি মনে হলো তা হচ্ছে, আসাদ আঙ্কেল রাইসাকে বিয়ের কথা বলে দিয়েছেন। জিসানের ধারণাই সঠিক। সত্যিই বলে দিয়েছেন। রাইসা কাছে এসে বলল,” আপনার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষা করছি। এতো দেরি লাগলো কেন?”
” রাস্তায় জ্যাম ছিল।”
” আচ্ছা৷ ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন। আপনার জন্য রান্না করে এনেছি। সব আপনার ফেভারিট আইটেম।”
জিসান কথা বাড়াল না। ফ্রেশ হতে চলে গেল। গোসল সেরে এসে দেখল রাইসা তার ছোট্ট টেবিলে স্টাডি টেবিলটা খাবার দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। বই-খাতা বিছানায় তুলে রেখেছে। রাইসা জিসানকে চেয়ার টেনে দিয়ে বলল,” বসুন। আসলে খাবার কোথায় রাখবো বুঝতে পারছিলাম না। ডাইনিং টেবিল তো নেই। তাই এই টেবিলেই ব্যবস্থা করলাম। অসুবিধা নেই। আমি আবার সব গুছিয়ে জায়গামতো রেখে দিবো।”
জিসানের বিয়ে বিয়ে অনুভূতি হচ্ছিল। রাইসা যেন তার বিয়ে করা বউ৷ সবকিছু এতো আজব লাগছে! চেয়ারে বসে জিসান শুধু একটা প্রশ্নই করল,” এই সব খাবার কি আপনি রেঁধেছেন?”
” অবশ্যই৷ আপনার কি ধারণা? আমি রান্না পারি না?”
রাইসার কণ্ঠে তেজ। সামান্য প্রশ্নে এতো রেগে যাওয়ার কি হলো জিসান বুঝতে পারছে না। তার পরবর্তী উত্তর ছিল,” আপনাকে দেখলে একদম মনে হয় না যে আপনি রান্না জানেন।” কিন্তু জিসান এই কথা মনে মনেই রাখল, বলল না। রাইসা আরও রেগে যেতে পারে। জিসান চুপচাপ খাচ্ছিল৷ রাইসা গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,” খাবার কেমন হয়েছে?”
জিসান জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” আচ্ছা একটা কথা বলি?”
” একটা কেন? একশোটা বলুন।”
জিসান ইতস্তত করে বলল,” আমাকে আপনার কি দেখে এতো পছন্দ হলো?”
রাইসা এই প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে বলল,” খাওয়া শেষ করুন৷ বলবো।”
খাওয়া শেষ হওয়ার পর রাইসা দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল,” একটা সত্যি কথা বলুন তো। আমাকে আপনার পছন্দ নাকি শুধু বাবার মন রাখতে রাজি হয়েছেন?”
” হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?”
” জানি না। আপনি উত্তর দিন।”
জিসান কি জবাব দিবে বুঝতে পারল না। রাইসা উত্তরের আশায় কয়েক মিনিট তাঁকিয়ে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষণ্ণচিত্তে বলল,” বুঝেছি। আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না৷ এই বিয়ে ভেঙে যাবে।”
” ভেঙে যাবে কেন?”
” কারণ বিয়েতে আপনার মত নেই। ভাববেন না এজন্য আমি মনখারাপ করছি। আমার মন এতো সহজে খারাপ হয় না।”
রাইসা এই কথা বলে সুন্দর করে হাসল। জিসান চাপা স্বরে বলল,” আপনার রান্না খুব ভালো হয়েছে। থ্যাংকস। ”
” শুধু থ্যাংকস? আপনার জন্য কষ্ট করে এতো ভালো ভালো রান্না করে আনলাম। এজন্য আমাকে কিছু গিফট দিবেন না?”
” কি গিফট চান?”
” যা চাইবো তাই দিবেন নাকি?”
” সামর্থ্য থাকলে দিবো।”
রাইসা বিনা দ্বিধায় বলল,” দশটা কিস চাই।”
জিসানের বিষম উঠে গেল। রাইসা হাসতে হাসতে বলল,” আপনি এতো লজ্জা পান এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। আজ-কাল ছেলে মানুষের মধ্যে থেকে তো লজ্জা ব্যাপারটা উঠেই গেছে। এদিক দিয়ে আপনি আলাদা।”
জিসান গলা খাকারি দিয়ে বলল,” কিস কি এখনি দিতে হবে?”
” তাহলে কখন? কিস দেওয়ার জন্যেও কি দিন-তারিখ ঠিক করতে হবে নাকি?”
“না।”
” তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? দিন।”
” দশটাই কি দিতে হবে?”
” অবশ্যই। আমি গুণবো।”
জিসান প্রথমে রাইসার গালে কিস করল। রাইসা আঙুল উঠিয়ে গুণতে লাগল,” এক।”
জিসান ওর আঙুল নামিয়ে বলল,” গুণতে হবে না।”
” কেন হবে না? যদি আপনি চিটিং করেন?”
” করলে করবো। আপনার কোনো সমস্যা?”
রাইসা নিচু স্বরে বলল,” না।”
চৌদ্দই আগস্ট জিসানের জন্মদিন। রাইসা রাত বারোটায় কেক নিয়ে হাজির৷ ঘুমো ঘুমো ভাব নিয়ে দরজা খুলল। জিসান। রাইসাকে দেখে সে হতভম্ব। রাইসা হাসিমুখে বলল,” হ্যাপি বার্থডে।”
জিসান ভুলেই গিয়েছিল আজ যে তার বার্থডে। জীবনে কখনও কেউ এভাবে উইশ করেনি। জিসান সামান্য হেসে বলল,” থ্যাংকস৷ কিন্তু আজ সারাদিন তুমি ফোন ধরোনি কেন?”
রাইসা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,” সারাদিন ধরে তোমার জন্য কেক বানিয়েছি। ফোন ধরার সময় কই? আর যদি আমি ফোন ধরতাম তাহলে কি তুমি এতো সারপ্রাইজড হতে বলো?”
কথা সত্যি। সারাদিন ফোন বন্ধ পাওয়ার পর হঠাৎ রাত বারোটায় রাইসাকে নিজের দরজায় দেখে অনেক বেশিই সারপ্রাইজড হয়েছে জিসান। রাইসা ক্যান্ডেলস জ্বালিয়ে জিসানের হাতে ছুরি দিয়ে বলল,” নাও, কেক কা’টো। তার আগে বলোতো, আমাকে কেমন লাগছে?”
” খুব সুন্দর”
” থ্যাঙ্কিউ!”
জিসান কেকের দিকে তাকিয়ে বলল,” এটা তুমি বানিয়েছো নাকি?”
” অবশ্যই। কেন? সন্দেহ আছে?”
জিসান জানে রাইসা মিথ্যে বলছে। সে প্রায়ই এমন করে। রেস্টরন্ট থেকে খাবার এনে বলবে সে নিজে রেঁধেছে। সেদিন জিসান বুঝে ফেলেছিল। খাবারের প্লেটে মানি রিসিট পাওয়া গেছে। আজকের এই কেকটাও নিশ্চয়ই রাইসা কোথা থেকে অর্ডার করে এনেছে। এটা যে বেকারীর তৈরী কেক সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবুও জিসান এই ব্যাপারে কিছু বলল না। চুপচাপ কেক কা’টল। প্রথম বাইট রাইসাকে খাওয়ালো। তারপর নিজে খেল। রাইসা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কেমন হয়েছে?”
” খুব দারুণ। কিন্তু… আমার গিফট কই?”
” আবার গিফটও লাগবে? আমি যে এসেছি এটাই তোমার গিফট।”
” উহুম। আমার আলাদা একটা গিফট চাই।”
” আলাদা গিফট? ঠিকাছে, দাঁড়াও।”
রাইসা ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করল। শাড়িটা জিসানের হাতে দিয়ে বলল,” নাও৷ তোমার আলাদা গিফট।”
জিসান বিস্মিত হলো।
” শাড়ি দিয়ে আমি কি করবো?”
” তুমিই না বলেছিলে? আমাকে শাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে? আজকে এই শাড়িটা পরে আমি সারারাত তোমার সাথে ঘুরবো৷ এটাই হবে তোমার গিফট। শাড়ি আমার। কিন্তু শাড়ি পরা আমি’টা তোমার।”
” বাহ, কিন্তু শর্ত আছে।”
” কি শর্ত?”
” আগে শাড়ি পরো তারপর বলছি।”
” ওকে।”
রাইসা ভেবেছিল জিসান তাকে কোনো চিরাচরিত শর্ত দিবে। যেমনটা টিপিক্যাল বয়ফ্রেন্ড তাদের গার্লফ্রেন্ডকে দেয়। কিন্তু রাইসার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ হলো৷ সে শাড়ি পরে বের হয়ে দেখল জিসান ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে তৈরী। রাইসাকে নিয়ে সে ঝিনাইদহ যাবে। মা আর বোনের কাছে। রাইসার মন একটু খারাপ হলো। সে ভেবেছিল আজ সারারাত তারা একাকী সময় কাটাবে। কত মজা করবে। কিন্তু জিসান যেন সমস্ত পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল৷ মানুষটা যে কেন এতো আনরোমান্টিক!
ঝিনাইদহে গিয়ে রাইসা জিসানের পরিবারের সাথে দুইদিন কাটাল। এই দুইদিনেই অনেক রহস্যময় কাহিনী ঘটল। জেসির সাথে রাইসার ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। রাতে জেসির সাথেই সে ঘুমাতো। কিন্তু জেসমিন রাইসাকে সামনা-সামনি দেখে একেবারেই পছন্দ করলেন না। যদিও সেটা রাইসার সামনে প্রকাশ করেননি। কিন্তু আড়ালে জিসানকে ডেকে বলেছেন,” এই মেয়েকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি।”
” কেন পছন্দ হয়নি মা?”
” জানি না। শুধু মনে হচ্ছে মেয়েটা ভালো না। এই মেয়েকে বিয়ে করলে তোর জীবন জাহান্নাম হয়ে যাবে।”
” কি আশ্চর্য কথা বলছো!”
” আশ্চর্য কথা না। এই বিয়ে করলে তোর কপালে জীবনেও সুখ ধরা দিবে না। আমার কথা মিলিয়ে নিস। মা ছাড়া মেয়ে। বাপের আদর পেয়ে বিগড়ে গেছে। অতিরিক্ত চঞ্চল আর জেদী।”
” এগুলো কি একটা মানুষকে রিজেক্ট করার কোনো কারণ হতে পারে মা?”
” এগুলো কি তোর তুচ্ছ কারণ মনে হচ্ছে? এই বিয়েতে আমি মত দিতে পারবো না। যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে আমি ম’রার পর করিস। এর আগে না।”
জিসান এই কথা শুনে হতভম্ব। সেইরাতে মায়ের সাথে অনেক তর্ক-বিতর্ক হলো। আর দূর্ভাগ্যবশত এর পরদিন সকালেই জিসানের মা মা’রা গেলেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here