সেই তুমি?
পর্ব -১৩
Samira Afrin Samia(Nipa)
ইশিতা ওয়াশরুমে চলে গেলে ইয়াশ বেডের উপর থেকে তার ফোন টা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। ইশিতা ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি ছিঁটা দিয়ে নেয়। হঠাৎ করে ইশিতার ওয়াশরুমের আয়নার দিকে চোখ চলে যায়। ইশিতা আয়নায় নিজেকে দেখছে আর ভাবছে এই কিছু দিনে তার সাথে কত কিছু ঘটে গেল। কি থেকে কি হয়ে গেল তার সাথে। সে যেমন ভেবেছিল তেমন কিছুই হয়নি। উল্টো যা কখনও ভাবেনি তা ই হয়ে গেল। যাকে ভালোবাসে তাকে স্বামী হিসেবে না পেলেও এমন একজন কে স্বামী হিসেবে পেয়েছে যে তাকে অনেক সন্মান করে তার অনেক খেয়াল রাখে। ইয়াশ ইশিতা কে ভালোবাসে কিনা তা ইশিতা জানে না তবে এটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে ইয়াশ আর যাই করুক কোনো দিনও ইশিতা কে বিন্দু মাত্র কষ্ট পেতে দিবে না।
ইশিতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রুমে আসে। ইশিতা রুমে এসে রুম টা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। রুমের সব কিছুই অনেক গুছানো। কোনো ছেলের রুম যে এতোটা গুছানো হতে পারে তা ইশিতার জানা নেই। রুম টা ধরতে গেলে অনেক টা ই বড়। জিনিস পত্র দিয়ে পুরো রুম পরিপূর্ণ। প্রত্যেক টা জিনিস খুব দামী বলে মনে হচ্ছে। ইয়াশের রুম দেখে বুঝা যায় ইয়াশের রুচি খুব উন্নত। ইশিতা হাঁটতে হাঁটতে ব্যালকনি তে গেল। ইশিতা ব্যালকনিতে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইয়াশের এই রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শহরের প্রায় অনেক টা অংশ দেখা যায়। রাতে যে বাইরের জগৎ টা এতো সুন্দর হয় তা ইশিতা আগে কখনও দেখেনি। ছোট থেকেই তো সন্ধ্যার পর নিজের রুম থেকে কখনও বের হয় নি। মামা মামী কখনও রাতে বাইরে যেতে দেয়নি।
বিভিন্ন ধরনের লাইট রাতের অন্ধকারের মাঝেও আলো করে রেখেছে। নিচে রোড দিয়ে কত গাড়ি, কত মানুষ যাতায়াত করছে বুঝা ই যাচ্ছে না এখন রাত। ইশিতা মন ভরে রাতের পৃথিবী টা কে উপভোগ করছে। কিছু মুহূর্তের জন্য নিজের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গেছে ইশিতা।
ইয়াশ রুমে এসে ইশিতা কে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল। ইয়াশ ভাবছিল ইশিতা হয়ত নিচে মায়ের কাছে গেছে কিন্তু মায়ের কাছে গিয়েও যখন ইশিতা কে পেল না। তখন ইয়াশ সত্যি সত্যিই অনেক ভয় পেয়ে যায়। ইশিতা কোথাও চলে গেল না তো?
ইয়াশ আবার রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে কাকে যেন কল করতে নিছিলো। তখন ইয়াশের মনে হলো ব্যালকনিতে কেউ একজন আছে। এতো রাতে ইয়াশের রুমের ব্যালকনিতে ইশিতা ছাড়া আর কে ই বা হবে। তাহলে ইশিতা ব্যালকনিতে আছে। ইয়াশ ব্যালকনিতে গিয়ে ইশিতার পেছনে দাঁড়ায়। ইয়াশ রুমে এসেছে এটার দিকে ইশিতার কোন খেয়াল নেই। ইয়াশ ইশিতার দিকে তাকিয়ে দেখে ইশিতা গভীর মনোযোগ নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশিতা বাইরের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে কি দেখছে তা ইয়াশ বুঝতে পারছে না। মিনিট কয়েক হয়ে গেল তার পরও ইশিতা এখনও ওভাবেই বাইরে তাকিয়ে আছে দেখে ইয়াশ একটু শব্দ করে উঠলো।
ইশিতা পেছন থেকে কারো শব্দ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখে ইয়াশ এসেছে। ইয়াশ কে দেখে ইশিতা কিছু না বলে,একটুও দেরি না করে ইয়াশের পাশ কাটিয়ে রুমে চলে এলো।
ইয়াশ ও ইশিতার পেছন পেছন রুমে আসে। ইয়াশ রুমে এসে টেবিলের উপর থেকে একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ইশিতার দিকে এগিয়ে ধরে।
— এটা তোমার জন্য।
ইশিতা ব্যাগ হাতে না নিয়েই ইয়াশের দিকে জিঙ্গাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকায়।
— হাতে নিয়েই দেখো না এটাতে তোমার জন্য কি আছে।
ইশিতা ব্যাগ টা হাতে নিয়ে বেডে বসে ব্যাগ টা খুলে। ব্যাগের ভেতর থেকে ইশিতা বেশ কয়েকটা শাড়ি বের করে।
— শাড়ি?
— হুম। তুমি তো বাড়ি থেকে আসার সময় সাথে করে কিছু নিয়ে আসো নি। এক কাপড় পড়ে তো আর থাকতে পারবে না তাই এখন মার্কেটে গিয়ে এগুলো আনছি। শাড়ি আনতাম না কিন্তু তোমার কোন সাইজের ড্রেস লাগে আমি তো তা জানি না। তাই কিছু বুঝতে না পেরে শাড়ি ই নিয়ে আসছি।
ইশিতা কিছু না বলে চুপচাপ শাড়ি গুলো দেখছে। পাঁচ থেকে ছয়টা শাড়ি হবে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক দামী। একটা জর্জেট গোল্ডেন কালারের মাঝে পুরো বডি তে গোল্ডেন কালারের ছোট ছোট স্টোন বসানো। একটা নীল কালারের সুতির মাঝে আঁচলের দিকে লাল ডোরা কাটা। আর একটা বেগুনী কালারের আর দুই টা প্রায় এক রকম ই আকাশী কালারের মাঝে। সব গুলো শাড়ি ই ইশিতার কাছে অনেক ভালো লেগেছে।
— আচ্ছা তুমি শাড়ি পড়তে পারো তো?
ইশিতা মাথা নিচু করে আস্তে করে উত্তর দিলো
— হুম।
— আচ্ছা তাহলে ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নেও। অনেক রাত হয়ে গেছে চেঞ্জ করে এসে শুয়ে পড়ো।
— হুম।
ইয়াশ রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। কোথায় গেল তা ইশিতা জিঙ্গেস করেনি। ইশিতা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে। ইয়াশের কাছে তো খুব সুন্দর করে বলে দিল সে শাড়ি পড়তে পারে। কিন্তু আসলে ইশিতা তো শাড়ি পড়তে পারে না। আগে কখনও শাড়ি পরেনি। ইশিতা একবার মনে মনে নিজেকে বকছে আবার নিজেই নিজেকে শান্তনা দিয়ে বলছে
— আগে কখনও শাড়ি পরিনি তো কি হয়েছে?
শাড়ি পড়া টা এমন কোন কঠিন কাজ না। যা চেষ্টা করলে পারা যাবে না।ভালো করে একবার চেষ্টা করলেই পারবো।প্রায় অনেকক্ষণ ধরে ইশিতা শাড়ি পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না। কুচি দিতে গিয়ে বার বার খুলে যাচ্ছে।
— ধ্যাত আমার দ্বারা সত্যিই কিছু হবে না মামী ঠিকই বলতো।
সেই কখন থেকে একটা শাড়ি পরতে পারছি না। বাঙালি নারী হয়ে শাড়ি পরতে পারি না এটা লোকে শুনলে কি বলবে।
এখন মামী থাকলে এতক্ষণে কিছু কথা শুনিয়ে শাড়ি টা পড়িয়ে দিত।
মামীর কথা মনে হয়ে ইশিতার মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই কি করছে এখন? সবাই কি ইশিতার কথা মনে করছে?
মামা কি করছে এখন মামা তো ইশিতা কে চোখের সামনে না দেখে এক মুহূর্ত ও থাকতে পারতো না।
এসব ভেবে ইশিতার খুব কান্না পাচ্ছে।
ইয়াশ নিচে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানি নিতে গিয়ে মনে পড়লো ইশিতা তো রাতে কিছু খায়নি। মামার বাড়ি থেকে আসার সময় তো ইয়াশ খেয়ে এসেছিল কিন্তু ইশিতা খেয়ে আসেনি। এখন এই অবস্থায় ইশিতার না খেয়ে থাকা টা কি ঠিক হবে?
না এমনিতেই মনে হয় ইশিতা এই কিছু দিন ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করেনি। তার উপর আবার সে প্রেগন্যান্ট। এখন তো ইশিতা একা না তার ভিতরে ছোট একটা প্রান বেড়ে উঠছে। এখন ইশিতার না খেয়ে থাকলে চলবে না।
ইয়াশ কিচেনে গিয়ে প্লেটে করে ইশিতার জন্য খাবার নিয়ে রুমে যেতে লাগলো।
— দূর ভাল্লাগে না। এখন তো মনে হচ্ছে শাড়ি পড়া পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ গুলোর মধ্যে থেকে একটা। নাহলে এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পর ও পারছি না কেন?
ইচ্ছে তো করছে শাড়ি গুলো কে ই আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেই। এগুলো মানুষে পড়ে?
ইশিতা নিজে নিজে কথা বলছে। আর ইয়াশ খাবার নিয়ে হঠাৎ করেই রুমে এসে গেছে। ইশিতা ইয়াশ কে দেখার সাথে সাথে পেছনে ঘুরে গেল। ইয়াশ ও ইশিতা কে এভাবে দেখে সাথে সাথেই নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো। ইয়াশ ভাবতে পারেনি এখন রুমে এসে ইশিতা কে এভাবে দেখবে। ইশিতা ও রুমের দরজা লক করে নেয়নি। কারণ ইশিতা বুঝতে পারেনি ইয়াশ আবার রুমে আসবে। ইশিতা যদি আগে জানতো ইয়াশ এভাবে না বলে হঠাৎ করে রুমে চলে আসবে তাহলে কখনও ই দরজা খোলা রেখে শাড়ি পরতে নিতো না।
ইয়াশ চোখ বন্ধ রেখেই হাতে খাবারের প্লেট টা বেড সাইড টেবিলের উপর রাখে।
ইশিতা পিছন দিকে ঘুরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে
— আপনি রুমে আসার আগে নক করে নিবেন তো নাকি?
— আসলে আমি বুঝতে পারিনি তুমি এখন শাড়ি চেঞ্জ করছো জানলে কখনও আমি রুমে আসতাম না।
ইশিতা ইয়াশ কে ই বা কি বলবে দোষ তো ওর নিজের ই। সে কেন দরজা লাগিয়ে নিলো না।
— আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। তোমার জন্য খাবার দিয়ে গেলাম খেয়ে নিও।– হুম।
— মনে করে খাবে কিন্তু।
— আচ্ছা।
ইয়াশ রুম থেকে বের হতে নিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো।
— ওয়েট ওয়েট। তুমি কি সত্যি ই শাড়ি পড়তে পারো?
তুমি যদি শাড়ি পড়তে জানতে তাহলে তো শাড়ি পড়তে এতো সময় লাগার কথা না।
ইশিতা কি করবে তা বুঝতে না পেরে বলেই দিলো
— আমি শাড়ি পড়তে পারি না। আসলে শাড়ি কিভাবে পড়ে তা ই জানি না। কিন্তু একবার দেখলে ঠিক পারবো।
— হুম আমি দেখছি।
ইশিতা ভাবলো ইয়াশ হয়ত এখন ওকে শাড়ি পড়িয়ে দিতে আসবে এটা ভেবে ইশিতা ভয় পেয়ে বলে উঠলো
— না নাহ! আমি আপনার কাছে শাড়ি পড়বো না। আপনার শাড়ি পড়িয়ে দিতে হবে না।
ইয়াশ ইশিতা কে ভয় পেয়ে এভাবে বলতে দেখে একটু হেসে উঠলো।
— টেনশন নিও না। আমি তোমাকে শাড়ি পড়াতে আসছি না। তুমি তো বলেছিলে একবার দেখলে শাড়ি পড়তে পারবে।
তাই ফোনে নেট থেকে দেখে নেও শাড়ি কিভাবে পড়তে হয়।
ইয়াশ কে এভাবে হাসতে দেখে ইশিতা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।
— আমি তো তোমাকে জিঙ্গেস করেছিলাম তুমি যদি তখন বলতে তুমি শাড়ি পড়তে জানো না। তাহলে তো আমি তোমার জন্য অন্য কোন ড্রেস আনিয়ে নিতাম।
যাক অনেক চেষ্টার পর অনেক কষ্টে ইশিতা শাড়ি পড়তে পারলো। ইয়াশ এতক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল। আর ইশিতা দেখে দেখে শাড়ি পড়ছিল। শাড়ি পড়া শেষে
— হয়ে গেছে।
— সিউর, হয়ে গেছে?
— হুম।
ইয়াশ চোখ খুলে সামনে ইশিতা কে দেখে ইশিতার উপর থেকে নিজের চোখ সরাতে পারছে না। নীল রঙের শাড়ি তে ইশিতা কে কতটা সুন্দর লাগছে তা বলে বুঝানো যাবে না। ইশিতা অনেক ফর্সা হওয়ার কারনে নীল রঙে একেবারে ফোটে উঠেছে। ইয়াশ সব কিছু ভুলে গিয়ে হা করে ইশিতা কে দেখে যাচ্ছে। ইয়াশ কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশিতা একটু অপ্রস্তুত পরিস্থিতি তে পড়ে গেল।
ইশিতা ইয়াশ কে কিছু না বলে ইয়াশের সামনে থেকে চলে আসলো। এসে শুবার জন্য বেড গোছাতে লাগলো। ইশিতা সামনে থেকে চলে যাওয়ায় ইয়াশের ঘোর কাটলো।
চলবে…..