অন্তরীক্ষে_অন্ধকার পর্ব ১২

0
254

#অন্তরীক্ষে_অন্ধকার
পর্ব ১২
লিখা- Sidratul Muntaz

মায়ের মৃত্যুর পর জিসানের দুনিয়াটাই কেমন বদলে গেল। মাথার উপর বিরাট এক মায়াময় ছায়া ছিল। সেই ছায়া মুছে গেল। জিসান জানতো না তার মা ক্যান্সারের পেশেন্ট ছিলেন। মৃত্যুর পর সেটা জানা গেছে। এ কারণেই মা বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকতেন। সেখানকার ডাক্তার ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। জিসানের ইচ্ছে ছিল মা’কে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করাবে। এর আগেই মা চলে গেলেন। তবে মায়ের মৃত্যুর কারণ ক্যান্সার নয়। হঠাৎ স্ট্রোক করেই মা’রা গেছেন তিনি। জিসানের নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল। বার-বার মনে পড়ছিল মায়ের শেষ কথা,” এই বিয়েতে আমি মত দিতে পারবো না। যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে আমি ম’রার পর করিস। এর আগে না।”
মা তো ম’রেই গেলেন। কিন্তু জিসানের বিয়ের ইচ্ছে আর রইল না। রাইসার সাথে কথা-বার্তা বন্ধ করে দিল। তার অবচেতন মন অকারণেই মানতে চাইতো যে মায়ের মৃত্যুর কারণ রাইসা। এমনটা যে জিসানের কেন মনে হতো! রাইসা বাড়ি এলে জিসান দেখা করতো না। কাজের বাহানায় ঘরে দরজা আটকে বসে থাকতো। ফোন ধরতো না। রাইসাকে যথাসম্ভব অবহেলা করতো। জেসমিনের মৃত্যুর পর জেসি জিসানের সাথেই ঢাকায় চলে আসে। ভাই-বোন একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। জেসি ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে ভর্তি হয়ে যায় ঢাকার কলেজে। রাইসা বাসায় এলে জেসির সাথে বসে গল্প করে। জিসান তার সামনে আসে না। একদিন রাইসা জেসির জন্য বিয়ের একটা সম্বন্ধ আনল। পাত্র জেসিকে দেখেই পছন্দ করেছে। তাদের রেস্টরন্টে দেখা করানো হলো। তবে রেস্টরন্টে যাওয়ার আগে জেসি জানতো না যে রাইসার সাথে কোনো ছেলেও আসবে। রাইসা শুধু বলেছিল জেসিকে সে ট্রিট দিতে চায়। জেসির অজান্তেই বিয়ের পাত্রের সাথে দেখা হলো। ছেলেটি রাইসার কাজিন। নাম আরাফাত হোসাইন। অস্ট্রেলিয়ার সিটিজেন। প্রথম দেখাতেই ছেলেটিকে মনে ধরল জেসির। দু’জনই দু’জনকে পছন্দ করে ফেলল। কিন্তু জিসান বিয়েতে রাজি না। তার বক্তব্য হলো,
” এতো অল্প বয়সে আমি জেসির বিয়ের কথা চিন্তাও করি না। জেসির ভবিষ্যৎ আছে, পড়ালেখা আছে। বিয়ে করলে ওর ক্যারিয়ার নষ্ট হবে।”
রাইসা ঠান্ডা মাথায় জিসানকে বোঝানোর চেষ্টা করল,” এই বিয়ে করলে জেসির ক্যারিয়ারের কোনো ক্ষতি হবে না। সে আরাফাতের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবে। সেখানকার কলেজে ভর্তি হবে। ওর ফিউচার ব্রাইট হবে। এখানে থেকে ও করবেটা কি?তাছাড়া এখন আন্টিও নেই। মা-বাবাহীন একটি মেয়েকে বিয়ে দেওয়া সহজ কথা নয়। আরাফাত খুব ভালো ছেলে। জেসিও ওকে পছন্দ করেছে। তুমি কেন ওদের মাঝখানে দেয়াল হতে চাইছো জিসান? বিয়েটা হয়ে যাক না! আমি কথা দিচ্ছি, তোমার বোন ভালো থাকবে।”
” আমার বোনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার এতো চিন্তা করার দরকার নেই রাইসা। আমি এতোদূরে জেসিকে পাঠাতে পারবো না। জেসি ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। ও চলে গেলে আমি থাকবো কিভাবে?”
রাইসা আর্দ্র কণ্ঠে বলল,” কেউ নেই মানে? আমি কি তোমার কেউ না?”
জিসান উত্তর দিল না। খুব সুক্ষ্ণতার সাথে প্রশ্নটি এড়িয়ে গেল। বলল,” আমি না চাইলে জেসি বিয়ে করবে না।”
” সেটা তো বাধ্য হয়ে করবে না। তোমাকে খুশি রাখার জন্য ও বিয়েতে নিষেধ করবে। কিন্তু ওর মন ভেঙে যাবে।”
” মন ভাঙলে ভাঙবে। আমার বোন আমি বুঝবো।”
” সেলফিশের মতো কথা বোলো না। তুমি জেসিকে বিয়ে দিতে চাইছো না কারণ জেসি চলে গেলে তুমি একা হয়ে যাবে। শুধু নিজেরটাই ভাবছো। কিন্তু এতে যে জেসির ক্ষতি হবে সেটা বুঝতে চাইছো না। ও একটা টিপটপ জীবন পাবে। তুমি ভাই হয়ে বোনের জন্য এইটুকু সেক্রিফাইস করতে পারবে না?”
জিসানের মেজাজ চড়ে গেল। রাগী কণ্ঠে চিৎকার করে জেসিকে ডাকল। জেসি পাশের ঘরেই ছিল। হয়তো ওদের কথাও শুনতে পাচ্ছিল। জিসান গরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” তুই কি আরাফাতকে বিয়ে করতে চাস?”
জেসি ভয়ে ভয়ে রাইসার দিকে তাকাল। রাইসার চোখের ইশারায় জেসিকে সাহস দিল৷ জেসি মাথা নিচু করে বলল,” হ্যাঁ চাই।”
জিসান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কপালে হাত ঠেকালো৷ তার আর কিছুই বলার রইল না। বিয়ের ব্যবস্থা করা হলো। জেসি চলে যাওয়ার পর জিসানের পৃথিবী সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গেল।অফিস যায়, বাড়ি ফেরে, রাতে ঘুম হয় না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটে। মাঝে মাঝে মায়ের কণ্ঠ শুনতে পায় সে। মা শুধু একটাই কথা বলেন,” রাইসাকে বিয়ে করিস না বাবা। মেয়েটা ভালো না।”
মা কি শুধু এই কথা বলতেই জিসানের কাছে আসেন? এই একটি কথা ছাড়া কি জিসানকে আর কিছুই বলার নেই মায়ের?
একদিন রাস্তায় একটা কুকুরের সাথে পরিচয় হলো। কুকুরটি ক্ষুধায় কাতর ছিল। দূর্বল হয়ে রাস্তায় শুয়ে ছিল। জিসানের মায়া লাগল। কুকুরটিকে একটা রুটি কিনে দিল সে। কিন্তু কুকুর রুটি খাচ্ছে না। হয়তো খাবার পছন্দ হয়নি। জিসান বাড়ি থেকে প্লেটে করে খাবার দিল। তখন দেখা গেল কুকুরটি খাচ্ছে। প্লেটের এক কোণে রুটিটাও রাখল সে। কুকুরটি তখন রুটিও খেল। এতে বোঝা গেল প্লেটে করে খাবার না দিলে সে খাবে না। তাকে সমীহ করে খাবার দিতে হবে। মনে হচ্ছে খুব খানদানি কুকুর। ভাব-ভঙ্গি দেখেই জিসান তার নাম দিল প্রিন্স। এরপর থেকে জিসান অফিসে যাওয়ার সময় এবং আসার সময় প্রিন্সের খোঁজ নিতো। জিসানের জীবন প্রিন্সকে নিয়েই কাটছিল। এদিকে রাইসা প্রায়ই এসে বাড়িতে বসে থাকে জিসানের অপেক্ষায়। জিসান কথা বলে না। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখল রাইসা বসে আছে। জিসানের জন্য খাবার রান্না করে এনেছে। দু’জন একসাথে খাবে আর মুভি দেখবে। জিসান নাকচ করল। তার শরীর খুব ক্লান্ত লাগছিল। রাইসাকে চলে যেতে বলল। কিন্তু রাইসা চলে যাওয়ার পরেই জিসান অনুভব করল তার ভালো লাগছে। সে বাহিরে গিয়ে প্রিন্সের সাথে সময় কাটাল। ভোর পর্যন্ত প্রিন্স আর সে রাস্তায় হেঁটে বেড়ালো। পরদিন প্রিন্সের মৃত লাশ পাওয়া গেল রাস্তার পাশে। জিহ্বা বের করা অবস্থায় পড়ে আছে নিথর দেহটি। মায়ের মৃত্যুতে জিসানের কান্না আসেনি। বোনের বিয়ের সময়েও সে কাঁদেনি। অথচ রাস্তার একটি কুকুরের মৃত্যুতে জিসান শব্দ করে কাঁদল। এমনভাবে কাঁদছিল যে প্রত্যেকটি মানুষ তাকে অবাক হয়ে দেখছিল। সারাদিন প্রিন্সের লা’শ নিয়ে সে বসে রইল। রাইসা টেনে-হিঁচড়েও জিসানকে বাসায় নিতে পারল না। সন্ধ্যায় দু’জন মিলে প্রিন্সের জন্য একটি কবরের ব্যবস্থা করল। প্রিন্সকে রেখে আসা হলো অন্ধকার গহ্বরে। তারপর থেকে জিসান কাঁদতো। প্রায়ই কাঁদতো। ঘুমের মধ্যে দেখা যেতো সে কাঁদছে। এর মধ্যে আসাদ সাহেব তিনমাসের জন্য বিদেশ চলে গেছেন। সুযোগ পেয়ে রাইসা সারাদিন জিসানের ঘরে এসে বসে থাকে। নিজের বাড়ি সে ফিরে যায় কদাচিৎ। দুঃসময়ে রাইসাকে কাছে পেয়ে জিসান সবকিছুই ভুলে যেতে লাগল। রাইসা নানা কান্ড-কারখানা করতো জিসানকে হাসানোর জন্য। হুটহাট এসে বলতো, চলো লংড্রাইভে যাই, চলো ফুচকা খেতে যাই, এসো বৃষ্টিতে ভিজি। ইদানীং জিসান আর মা’কে স্বপ্ন দেখে না। মায়ের আত্মা ঘুমের মধ্যে এসে রাইসাকে বিয়ে করতে নিষেধাজ্ঞাও দেন না। জিসান আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যেতে লাগল। তার ছোট্ট জীবনে রাইসা ছাড়া অন্যকারো অস্তিত্ব ছিল না৷ রাইসাই হলো জিসানের বেঁচে থাকার কারণ। একদিন রাইসা আর জিসান রেস্টরন্টে গিয়েছিল। সেখানে জিসানের দেখা হলো খুব পুরনো বান্ধবীর সাথে। মেয়েটার নাম জয়ী। জিসান আর রাইসার সাথে বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিল৷ এক পর্যায় জয়ী বলল,” তুমি জানো রাইসা? জিসান কিন্তু ক্লাস টেনে থাকতে আমাকে প্রপোজ করেছিল। তখন যদি আমি এক্সেপ্ট করতাম তাহলে এতোদিনে আমাদের একটা বেবি থাকতো।”
এই কথা বলেই জয়ী হাসতে লাগল। জিসান লজ্জা পেল খুব। জয়ী তার কৈশোর জীবনের আবেগ ছিল। তখন তো সে ভালোবাসার মানেটাও বুঝতো না। রাইসার চেহারা গম্ভীর ছিল। সে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,” তাহলে আপনি কেন প্রপোজ্যাল এক্সেপ্ট করেননি আপু?”
” কারণ তখন আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল। তবে এখন আফসোস হয় জানো? ওই বয়ফ্রেন্ডের সাথে বহু আগেই ব্রেকাপ হয়ে গেছে। তারপর থেকে প্রেম-ভালোবাসার প্রতি আগ্রহ নেই৷ তাই সিংগেল আছি। তবে জিসানকে এক্সেপ্ট করলে সিংগেল থাকতে হতো না। তুমি না থাকলে আমি কিন্তু ওকে এখনি এক্সেপ্ট করে নিতাম।”
জয়ী এই কথা বলে আবার হাসল। একদম হৃদয়ে সূচ ফোটানোর মতো কথাবার্তা। রাইসা কেবল মৃদু হাসছিল। তবে রেস্টরন্ট থেকে বের হয়ে সে একটা ভয়ংকর কান্ড ঘটালো। সচরাচর রাইসা ড্রাইভিং সিটে বসে না। সেই সময় রাইসা ড্রাইভিং সিটেই বসল। আর ইচ্ছে করে গাড়ি দিয়ে জয়ীর এক্সিডেন্ট করালো। জিসান রাইসার কান্ড দেখে হতভম্ব। রাস্তায় মানুষ জমে যাচ্ছে। গাড়ির পেছনে অনেকে ঢিল ছুঁড়ছে৷ জয়ী গুরুতর আহত। রাইসা এক মুহূর্তের জন্যেও থামল না। ওভারস্পিডে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। জিসান ঘটনাটা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। সে বার-বার রাইসাকে জিজ্ঞেস করছিল,” তুমি এটা কিভাবে পারলে রাইসা? কিভাবে পারলে?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here