#গল্প
#অন্তর্ধান
শেষ পর্ব
নয়.
দারোয়ান মন্টু থাকত ফারিয়াদের এপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোরের স্টাফ রুমে। শিফটে ডিউটি করত। রাতে ডিউটি থাকলে দিনে ঘুমাতো আর দিনে ডিউটি করলে রাতে ঘুমাতো। সেদিন দিনের বেলা ডিউটি শেষ করেই কাজ আছে বলে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু রাতে আর ফিরে আসে না।
-মন্টু কি তোমাকে জানিয়েছিল যে রাতে ফিরবে না?
আরেক দারোয়ান শাজাহান আলীকে প্রশ্ন করতেই বলল,
-না স্যার।
-তুমিখোঁজ নাওনি কেনো ফেরেনি?
-জ্বি না।
-একটা লোক ফিরলো না আর তুমি একটা খোঁজ পর্যন্ত নিলে না!
শাজাহান আলী কাচুমাচু করতে লাগল।
-কি হলো,কথা বলছো না কেনো? নাকি তুমি জানতে যে ওর খোঁজ নিয়ে কোনো লাভ নাই। ও এই দুনিয়াতেই নাই।
-না না স্যার,আমি কেমনে জানমু?
-তাহলে কল দিলেনা কেনো?
-ওই তো মাঝে মাঝেই বাইরে রাত কাটাইতো।
-কেন,বাইরে কেন রাত কাটাতো?
-না মানে ঐ বাজারি মাইয়া মাইনষের কাছে যাইতো। হের বৌ বাচ্চা দেশের বাড়িত থাকে। বছরে এক দু’বার বাড়িত যায়। তাই মাঝে মাঝে একটু ঐসব জায়গায় যাইতো।
-তুমিও কি এমন যাও মাঝে মাঝে?
দাঁতে জিব কেটে শাজাহান বলে ওঠে,
-নাউজুবিল্লাহ,আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি স্যার। ঐসব দিকে আমার নজর নাই স্যার।
-বুঝলাম, তো মন্টু কি কালকেও এমন কারো কাছে গেছিলো।
-আমি জানি না স্যার।
-সত্যিই জানো না?
-নবীরাসূলের কসম স্যার।
-থানায় নিয়ে গেলে ঠিক কথা বের হবে । একসাথে ডিউটি করো আর কিছুই জানো না!
-মায়ের কসম আমি জানি না স্যার। তয় একটা কথা মনে পড়ছে স্যার।
-এইতো থানার কথা শুনেই মেমোরি কাজ করতে শুরু করছে।
-দুইদিন আগে কার লগে জানি ফোনে কথা কইতেছিলো মন্টু। টাকা পয়সা নিয়া কি যেন বলতেছিল।
কি বলতেছিলো?
আমি পুরা শুনি নাই। তয় এইডা কানে আসছে কারে জানি বলতেছে,
এরচেয়ে কম হইলে মুখ বন্ধ হইবোনা।
-কারো নাম নিতে শুনছো?
-না স্যার,আর কিছু শুনি নাই।
শ্যাওড়াপাড়ায় মন্টু কি কোনো মেয়ের কাছে গেছিলো? সেসব নিয়েই কোনো ঝামেলা লেগে মরতে হয়েছে? নাকি মেহরিন হত্যাকাণ্ডের সাথে এই খুনের কোনো সম্পর্ক আছে? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকল মেহমিতের।
এটা কি কাকতালীয় যে পুলিশ যেদিন মন্টুর সাথে দেখা করবে বলে জানিয়েছে সেদিনই ওর লাশ পাওয়া গেলো।
শ্যাওড়াপাড়ায় সোর্স লাগিয়েও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না। মানে ঐ এলাকায় মেয়েঘটিত কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা তা নিয়ে কেউ কিছুই জানেনা।
মন্টু হত্যাকাণ্ড আরও বেশি জট পাকিয়ে দিলো সব।
মন্টুর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এসে গেলো। ধারালো কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। খুব সম্ভবত খুনি পেছন দিক দিয়ে এটাক করেছে।
ফোনের কল রেকর্ড থেকেও কিছু পাওয়া যায়নি। আগের দিন মন্টু কথা বলেছে ওর বাড়িতে বৌয়ের সাথে। আর একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে যেটা একটা ফ্লেক্সি লোড দোকানের নাম্বার।
ঐ দোকানে গিয়েও কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না। কে কখন কল করছে সেসব মনে রাখা সম্ভব না।
দশ.
আদনানের মন খুবই খারাপ। সে ভেবেছিল মেহরিন কোনো কারণে অভিমান করে ঘর ছেড়েছে। কিংবা হয়তো আদনান কে সারপ্রাইজ দেবে। তাই এমন করে লুকিয়েছে। কারণ দুদিন পরেই ওদের বিবাহবার্ষিকী ছিলো। কিন্তু আবীরের সাথে মেহরিন এর একটা সম্পর্ক হয়েছিলো এটা জানার পর থেকেই ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছে আদনান।
আবীর আদনানের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছে। এক বছর আগে একবার হলে ঝামেলা হলো। কতৃপক্ষ রাতারাতি হল ছাড়ার নির্দেশ দিলো। ঢাকায় আত্মীয় বলতে আদনান ভাই। এতো রাতে উপায় না দেখে আবীর ফোন দিলো আদনানকে,
-ভাইয়া হলতো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। এতো রাতে কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না। তোমার ওখানে কি যাওয়া যাবে?
-কেনো যাবে না! পাগল নাকি। ওখানে আর একটুও থাকার দরকার নেই। কখন কি বিপদ হয়, তুই জলদি চলে আয়।
এক দিন দু’দিন করে প্রায় একমাস থাকল আবীর। তবে আদনানের আপত্তি না থাকলেও মেহরিন খুব বিরক্ত হয়ে গেলো। আদনান কে বলেই ফেলল,
-এমন ফ্লাট বাসায় বাইরের একজন সবসময় ঘরে থাকলে কেমন লাগে?
-কেনো কি সমস্যা?
-কি সমস্যা মানে! বাসায় ফ্রিভাবে চলাফেরা করা যায়? হুট করে ডাইনিং এ না হয় ড্রইংরুমে যদি অন্য কোনো পরপুরুষ ঘুরঘুর করে ভালো লাগে?
-পরপুরুষ কাকে বলছো। আবীর আমাদের পরিবারেরই একজন।
-তোমার কাছের লোক কিন্তু আমারতো অস্বস্তি লাগে।
-আচ্ছা আমি ওকে বলে দেব যেন যতটা সম্ভব ওর রুমেই থাকে।
-আরে না,ওসব বলতে যেও না একদম।
কিন্তু মেহরিনের বিরক্তি দিনকে দিন চরমে পৌঁছাল । এ নিয়ে আদনানের সাথে খুটখাট লেগেই থাকল। ভাগ্যিস এক মাস পর হল খুলে দিলে আবীর চলে গেলো। না হয় হয়তো মেহরিন কবে কখন কি যে বলে বসত আবীরকে আদনান সেই ভয়েই থাকত।
সেই আবীরের সাথেই মেহরিন অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে গেলো! ওর জন্য আদনানকে, একমাত্র সন্তান রাহিকে ছেড়ে যেতে পারল!
কিভাবে কি হলো!
মানুষের মন এতো বিচিত্র কেনো!
সম্পর্ক কি তবে এতোটাই ঠুনকো আর মূল্যহীন। এতোদিনে সে একেবারের জন্যও বুঝতে পারেনি মেহরিন তাকে ভালোবাসে না। শুধু জীবন যাপনের দৃশ্য টুকু এঁকে গিয়েছে। ভেতরে ভেতরে যে মেহরিন তার ছিলো না এটা বিশ্বাস করতেই বুকটা হা হা করে উঠছে আদনানের।
মেহরিনের কপট রাগ,আদরে গলে যাওয়া, আদনানের সেবা যত্ন সব, সবটাই নিতান্তই অভ্যাস ছিলো মাত্র অথবা কর্তব্য। আদনানের ভীষণ রাগ হতে লাগল মেহরিনের ওপর। কপালের রগ দুটো ফুলে উঠেছে। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করলো আদনান। ওয়াশরুমে ঢুকে কলের নীচে মাথা দিয়ে থাকল বেশ খানিকটা সময়।
এগারো.
আদনানের ফোনে ওসি মেহমিতের কল আসল বিকাল চারটা নাগাদ।
আদনানকে এখুনি একবার থানায় যেতে হবে। ভীষণ জরুরী দরকার। অফিস শেষ করেই বেরিয়ে পড়ল ও।
জ্যামে বসে নানা কথা মাথায় ঘুরতে লাগল আদনানের। তাকে এতো জরুরী তলব করেছে থানায় । খুনির কথা কি কিছু জানা গেছে? জরুরী কি এমন কথা যে এতো জোরালোভাবে ওকে থানায় আসতে বলল অফিসার!
-গত আঠারো তারিখ রাতে আপনি কোথায় ছিলেন আদনান সাহেব?
-আঠারো তারিখ মানে বুধবার?
-জ্বী, বুধবার।
-আমিতো বাসাতেই ছিলাম।
-ঐদিন ছুটিতে ছিলেন আপনি। তা বাসায় থাকার জন্য কি ছুটি নিয়েছিলেন?
-হুম, ঐদিন ছুটি নিয়েছিলাম। একটু রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। তবে রাতেই ব্যাক করেছি।
-ক’টা নাগাদ এসেছিলেন।
-রাত দেড়টা বেজে গেছিলো।
-হুম। ঐদিন মেহরিন এর বান্ধবী ফারিয়ার বাসার দারোয়ান খুন হয়।
-সো স্যাড! তো এর সাথে আমার রাজশাহী যাবার সম্পর্ক কি!
-সম্পর্ক আছে। ঐ দারোয়ান হয়তো মেহরিনের খুনের বিষয়ে কিছু জানতো। মেহরিন ঐদিন ঐ এপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভেতরে যাবার আগেই কারো সাথে গাড়িতে উঠে আবার চলে যান। আমরা এই বিষয়ে মন্টুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আঠারো তারিখ সকালে আমাদের ওখানে যাবার কথা আর সেই রাতেই খুন হয় দারোয়ান মন্টু।
-ও মাই গাড!
মেহমিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদনানের মুখের দিকে। ওর এক্সপ্রেশন দেখে বুঝতে চাইছে আদনান সত্যি বলছে কি না।
-এতো অবাক হচ্ছেন কেনো! আমার তো মনে হয় আপনার ঐদিন রাতে বাইরে থাকার সাথে এর কিছু একটা সম্পর্ক আছে।
-হোয়াট!
-I think you better understand what I mean?
-But officer. আমি সত্যিই ঐদিন রাজশাহী গিয়েছিলাম। আমার ওয়াইফের কবর জেয়ারত করতে। আপনি চাইলে আমার শ্যালক মারুফকে কল করে জানতে পারেন। ওর সাথে আমার দেখাও হয়েছিল।
-সে দেখা যাবে। আমি শুধু আমার সন্দেহের কথাটা বললাম। শুধু মারুফ সাহেবের কথার ওপর তো আর সব কিছু নির্ভর করবে না। আচ্ছা, ওনার কন্টাক্ট নাম্বার টা দিন প্লিজ।
আদনান মারুফের ফোন নাম্বার দিলো। যদিও থানাতেও ওদের কন্টাক্ট নাম্বার আছে আদনান জানে।
সাথে সাথেই মারুফের নাম্বারে কল করল মেহমিত।
আদনান দেখতে পেলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অফিসারের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। ফোন রেখে আদনানের দিকে তাকিয়ে মেহমিত বলল,
-আপনি মিথ্যা বলছেন আদনান সাহেব। আপনার সাথে ঐদিন মারুফের দেখাই হয়নি। আপনাকে আপাতত যেতে দিতে পারছি না। আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আছে।
বারো.
আদনানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তেমন কিছুই পাওয়া গেলো না। আদনান যে ঐদিন রাজশাহী গেছে তার বিশ্বাসজনক কোনো প্রুফ দিতে পারলোনা। ওকে চুয়ান্ন ধারায় গ্রেফতার দেখালো পুলিশ। সন্দেহজনক আচরণের কারণে তিনশত দুই ধারা মোতাবেক আদালতে প্রেরণ করা হলো । সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করলে চারদিনের আবেদন মঞ্জুর করল আদালত।
রিমান্ডের প্রথম দিন। একটা ছোট ঘরে টিমটিমে বাতি জ্বলছে। ঘুলঘুলি দিয়ে অল্প রোদ এসে পড়েছে। এককোনায় একটা ছোট টেবিলের একপাশে আদনান। অপরদিকে মেহমিত আর রায়হান।
-মন্টুকে কেনো ডেকেছিলেন আদনান সাহেব?
-আমি মন্টুকে ডাকিনি।
-ঐদিন মন্টুকে আপনিই ডেকে নিয়ে গেছিলেন কারণ মেহরিন কে বাসার সামনে থেকে পিক করার সময় মন্টু আপনাকে দেখে ফেলেছিলো। পরে এটা নিয়ে আপনার কাছে টাকা দাবি করলে ওকে সরিয়ে দিলেন।
-এসব মনগড়া কথা। আমি কেনো ওকে টাকা দেব!
কারণ মেহরিন কে যে আপনি মেরেছেন এটা মন্টুর বয়ানে প্রমাণ হয়ে যেতো।
-আমি মেহরিনকে ভালোবাসতাম । ওকে কখনও মারতে পারতাম না।
-তাহলে কি পেশাদার কাউকে দিয়ে খুন করিয়েছেন?
-আমি খুন করাইনি। কতবার বলব?
-ভালোয় ভালোয় সবটা স্বীকার করুন।
-আমি কিছু করিনি।
-আপনিই করেছেন। আপনার ওয়াইফ আবীরের সাথে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ফিরে আসার পর আপনাকে সব যখন বলল,তখন রেগে গিয়ে আপনিই ওনাকে খুন করেন। আপনার ওয়াইফের এই প্রতারণা আপনি নিতে পারেন নি।
-না,এমন কিছুই হয়নি। মেহরিন আমার কাছে আসেই নি।
-সব স্বীকার করবেন। আজ মাত্র প্রথম দিন। তাই এখানেই আপাতত শেষ করছি। আপনাকে সময় দিলাম। আমাদের কে হার্ড লাইনে যেতে বাধ্য করবেন না আশা করি।
তেরো.
মারলিন ক্যাফে এন রেস্টুরেন্ট থেকে একটা কল এলো থানার নাম্বারে। একজন লোক ব্যতিব্যস্ত হয়ে মেহরিন এর কেইসের ইনচার্জ কে চাইল।
মেহমিত ফোন রিসিভ করে বলল,
-হ্যালো ওসি মেহমিত বলছি।
-স্যার খুব জরুরী একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই।ঐযে মেহরিন মেয়েটার খুনের বিষয়ে।
-জ্বি বলুন।
-ঘটনার দিন ঐ ম্যাডাম আমাদের এখানে এসেছিলেন।
-কি! আচ্ছা আপনার এড্রেসটা বলুন । আমি আসছি আপনার ওখানে দেখা করতে।
এড্রেস টুকে নিয়ে রায়হানসহ মারলিন ক্যাফে এন রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো মেহমিত।
ছোটখাটো চেহারার রেস্টুরেন্ট মালিক কফিল উদ্দিন বসে আছে কাউন্টারে। মেহমিত গিয়ে পরিচয় দিতেই উঠে দাঁড়াল কফিল। একটা কোনার টেবিলে গিয়ে বসল তিনজন।
-আপনি কি জানুন বলুন।
-স্যার ঐদিন মেহরিন নামের ঐ ম্যাডাম এসেছিলেন
আমাদের এখানে।
-উনি একাই এসেছিলেন?
-না আরো একজন ভদ্রলোক সাথে ছিলেন।
-উনি কেমন ছিলেন দেখতে?
-উনার ছবি আছেতো।
-ছবি আছে মানে? সিসিটিভি ফুটেজ আছে?
-না স্যার, এখনো সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়নি। নতুন রেস্টুরেন্ট। সব কাজ এখনও শেষ করতে পারিনি। তবে ঐদিন রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন উপলক্ষে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান করা হয়েছিলো। সেজন্য কিছু ছবি তোলা হয়েছিলো। সেইসব ছবিতে ঐ ম্যাডামের ছবিও আছে।
-তা আপনি কিভাবে এতোটা জানেন ঐ ম্যাডাম সম্পর্কে।
-কয়দিন আগের পুরোনো পেপার ছিঁড়ে ঐদিন একটা কাজ করতেই নিউজটা চোখে পড়ে। সেখানে ওনার ছবি দেখেই চিনতে পারি। এখানে কয়টা ছবিতেই ওনার মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
-আচ্ছা আনুন দেখি ছবিগুলো।
-এখুনি আনছি স্যার।
ছবিগুলো হাতে পেয়েই মেহমিত মনোযোগ সহকারে দেখতেই কপাল কুঁচকে গেলো ওর। এস আই রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-যাক, অবশেষে কিছুটা স্বচ্ছ আলোর দেখা মিলল ।
চৌদ্দ.
থানার একটি কক্ষে আদনান,ওর মা, মেহরিনের বাবা,মা,ভাই মারুফ বসে আছে। ওসি মেহমিত আজ খুনের তদন্ত নিয়ে কথা বলবেন। এই খুনের তদন্ত প্রায় শেষের দিকে।
সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে। যদিও আদনান খুনটা করেছে এটা সবাই মোটামুটি জেনে গেছে। কিন্তু কেনো কিভাবে এই খুন হলো সেটাই এখন জানতে বাকি।
আদনানের মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে চলেছেন। প্রথমে ছেলের বৌ চলে গেলো এখন সেই অভিযোগে ছেলেটাকেও হারাতে বসেছেন।
-আপনারা সবাই যে খুব খারাপ সময় অতিবাহিত করছেন জানি। কিন্তু সবাই নিশ্চয়ই চান মেহরিনের খুনি ধরা পড়ুক। তাই আমি আপনাদের এখানে ডাকতে বাধ্য হয়েছি।
মেহরিনের মা বলে উঠলেন,
-ঐ আদনান যে এমনটা করতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার মেয়েটা,,,
-হুম, মেহরিন হয়তো একটা ভুল করে বাড়ি ছেড়েছিলো কিন্তু ঐদিন আবীরের সাথে ও যায়নি। আবীর সেদিন ট্রেনেই ওঠেনি। আর মেহরিন যখন আবীরকে খুঁজে না পেয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে তখন ওর ফোনটা চুরি হয়ে যায়।
তাই ফ্লেক্সি লোডের দোকান থেকে ফোন করে খুব কাছের জনকে। কিন্তু ওতো জানতো না যে এই কাছের মানুষটাই ওর জীবনটা মাঝপথে থামিয়ে দেবে।
আমি কি ঠিক বলছি মিস্টার মারুফ ?
চমকে উঠে মারুফ। সবাই তখন অবাক হয়ে মারুফের দিকে ঘোরে।
-আআআ মি কি বলব!
-হুম,আপনিইতো বলবেন। কারণ মেহরিন সেদিন আপনাকেই ফোন দিয়েছিল।
-মিথ্যা কথা।
-তাহলে সত্যিটা কি আপনিই বলুন।
-আমিতো রাজশাহী থাকি।
-কিন্তু ঐদিন আপনি ঢাকায় এসেছিলেন একটা কাজে। আর মেহরিনকে জানিয়েওছিলেন। মেহরিন যখন আবীরের আসল রুপ জানতে পারল তখন আদনানকে কল করতে সাহস পায়নি। তাই আপনাকেই কল করে ওকে নিয়ে যেতে বলেছিল।
– আপনি বানিয়ে বলছেন। আদনানকে বাঁচাতে আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন।
-আপনার সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু আপনার হয়তো মেহরিনের সাথে শত্রুতা ছিলো।
-না,না,না।
-এখন আর অস্বীকার করে লাভ নেই সব প্রমাণ এখন আমাদের হাতে আছে। আপনি মেহরিনকে নিয়ে যে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন সেখানে আপনার সাথে ওর ছবিও পেয়েছি আমরা যেটা ঐ রেস্টুরেন্টের ক্যামেরায় তোলা হয়েছিল ঐদিন। কারণ ওদের একটা অনুষ্ঠান চলছিলো তখন।
মেহমিত সবাইকে ছবিগুলো দেখালো।
মারুফ এবার মাথা নীচু করে ফেলল।
মেহরিনের বাবা চিৎকার করে বলতে থাকলেন,
-এটা কি শুনছি আমি! মারুফ কেনো এমনটা করলি?নিজের বোনকে কেনো খুন করলি?
-ঠিক করছি আব্বা। আমাদের এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আব্বা।
-কি বলছিস এসব!
-আপনার একের পর এক ব্যবসায় ধ্বস নামছে। বিশাল ঋণের বোঝা আমাদের মাথায়। দু’দিন পর পথে নামতে হবে আমাদের।
-এর সাথে মেহরিনের কি সম্পর্ক? ওকে কেনো খুন করলি তুই!
-ওর নামে যে কোটি টাকার ইন্সুরেন্স করা আছে ওটার নমিনী তো আপনি আব্বা। তাই ও মরে গেলে আপনি টাকাটা পাবেন। আমাদের সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে। আর মেহরিন এর মতো মেয়ের বেঁচে থেকে কি হতো। বংশের কুলাঙ্গার একটা। ওর মরে যাওয়াটাই ভালো হয়েছে। হুম আমিই মেরেছি ওকে অফিসার। ও যখন আমাকে সব খুলে বলে তখন ওকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাই। জুসে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে খাইয়ে দেই। তারপর ওকে বলি যে,ঐ বিল্ডিংয়ে আমার এক বন্ধু থাকে বৌ সহ। রাতটা ওখানে থাকতে হবে। তারপর সকালে সব ঝামেলা আমি ঠিক করে দেব।
ঘুমের ঘোরে থাকায় ও বুঝতেও পারেনি যে ঐটা নির্মাণাধীন ভবন। তারপর সাততলায় উঠে কিনারায় নিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই আমি। ভেবেছিলাম সব দোষ আবীরের কাঁধে গিয়ে পড়বে। কিন্তু,,,,,।
ঘরের প্রতিটা মানুষ স্তব্ধ হয়ে রইল। স্বার্থপরতা আর ধোঁকা বাজি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখছে সবাই।
মেহরিন ধোঁকা দিয়েছে স্বামী সন্তানকে। তার শাস্তি ও পেলো আর মারুফ নিজ স্বার্থে নিজের বোনকে খুন করল কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারলো না।
আদনানকে আদালত বেকসুর খালাস দিলো আর মারুফের বিচার শুরু হলো। দু’ দুটো পরিবার শোকের অতলান্তিকে ডুবে গেলো।
আদনান মেহরিনকে মাফ করে দিয়েছে। ওর রাহির মাকে ও ঘৃণা করতে চায়না। ছোট্ট রাহিকে বুকে নিয়ে মেহরিনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলল । তারপর মেহরিনের জন্য দোয়া করল । রাহিও হাত তুলে দোয়া করল মায়ের জন্য।
পরকীয়ার মতো ঘটনাগুলো এভাবেই সমাজের কত কত জীবনকে আঁধারে ডুবিয়ে দিচ্ছে সেই সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। তবে আমরা আশা করতেই পারি একদিন শুধু সম্পর্কের শুদ্ধতম চর্চা হবে। আমরা মানুষরা সত্যি সত্যিই মানুষ হবো একদিন।
(সমাপ্ত)