হরিপুর যাত্রা
পর্ব-২(চিতা আরোহন)
ট্রেনে চড়ে বসলো অরুপ। বিকেলে ট্রেনে চড়লে মীরাঘাট স্টেশনে যেতে গভীর রাত হয়ে যায়। সেখান থেকে গৌড়ি নদী পার হয়ে বাকি রাস্তা হেঁটে পারি দিতে হবে অরুপকে।এতো রাতে কোনো ঠেলাযান বা মোটরগাড়ি পাওয়া যায় না।ট্রেন থেকে নেমে গৌড়ি নদীর তীরে এসে পৌঁছেছে অরুপ।এত কালো ঘন রাত এর আগে কখনো দেখেনি অরুপ। হয়তো আজ অমাবস্যার রাত।বিরাট বিল পার হয়ে নদীর কিনারায় একটি তক্তা বাঁধা।সেটিই রামচন্দ্র ঘাট। গভীর রাতে নৌকা পাওয়া গেল একটি। ছোট একটি নৌকায় অরুপ উঠার আগেই তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ইতিমধ্যে সাতজন উঠে গেছে। বেচারা অরুপ বুঝতে পারলেন না এখানে নৌকায় উঠার রীতি এ রকমের। অরুপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাঝি বললেন,”ও বাবু মশাই,উইঠে পড়েন।এ রাত্তিরে দাঁড়ায় থাইকে কাম নাই।”
“এমনিতেই নৌকায় সাতজন উঠে গেছে। এতটুকু নৌকায় আটজন যাওয়াটা বিপদজনক।এর চেয়ে ভালো তুমি এনাদের দিয়ে এসে আমাকে নিয়ে যাও।”, অরুপ বলল।
“বাবু উইঠে পড়েন। এই জায়গা ভালো না।রাত্তির বেলা একা একা বইসে থেকে কি করবেন।”,মাঝি বললেন।
“সমস্যা নেই তুমি এদের দিয়ে আসো।আমি আছি এখানেই।”, অরুপ বলল।
এই কথা শুনার পর মাঝি চলে গেলেন। অন্ধকারে চারপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না।খোলা বিলে নদীর তীরে বসে মাঝির অপেক্ষা করছেন অরুপ।তার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে বারবার।মাঝি বলেছিল এই জায়গা ভালো না।এর মধ্যে অমাবস্যার রাত।চলে গেলেই ভালো হতো ভাবছে অরুপ। মনে মনে গায়িত্রী মন্ত্র পাঠ করতে লাগলো অরুপ।ভয় যেনো কিছুতেই কমছে না। হঠাৎ বাম দিকে ঘুরতেই অরুপ খেয়াল করলো দূর থেকে একটি আগুনের গোলা বারুদের মত তার দিকে ছুটে আসছে। পুরো শরীর মুহূর্তের মধ্যে ঘেমে গেছে তার।গায়িত্রী মন্ত্রের ধ্বনি তীব্রতর হতে লাগলো। তবুও আগুনের গোলা কোনো মত থামছে না। অরুপ একের পর এক মন্ত্র পাঠ করছে আর পিছন দিক ছুটছে কিন্তু এ যে শক্তিশালী প্রেতাত্মা। কোনো মন্ত্রে নিস্তার নেই আজ। অরুপ প্রাণপনে দৌড়াতে লাগলো তার পিছু পিছু আগুনের গোলা ও তীব্র বেগে ছুটছে। দৌড়াতে দৌড়াতে অরুপ পিছন থেকে শব্দ শুনতে পেলেন-“এই হতচ্ছাড়া চোরা।আইজ তোক ধইত্তে পাইল্লে এখানেই তোর শবদাহ করিবো। দাঁড়া শুয়োরের ছাওয়াল।”
অরুপ বুঝতে পারলেন না আগুন ভূত তাকে চোর বলছে কেনো। অরুপ দৌড়াতে থাকা অবস্থায় পিছনে ঘুরে দেখলেন আগুনের মশাল হাতে এক লোক দৌড়াচ্ছে তার পিছনে। অরুপ একটি পাথরের সাথে আটকে মাটিতে পড়ে গেলেন।মশাল হাতে লোকটি তার উপরে চড়ে উঠে তাকে চড় মারতে লাগলো।চড় খেতে খেতে অরুপ বলছেন,”ভাই তোমার যত মারার আমাকে মারো কিন্তু আমার ঘাড় মটকে দিও না।”
মশালওয়ালা তার কথা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেলেন। সে মারা বন্ধ করে বলল,”এই সালা,আমাক দেখে কি তোর ভূত-প্রেত মনে হয় নিকি?আমি ঘাড় মটকাবো কেন?”
“তুমি ভূত প্রেত নও?”, অরুপ জিজ্ঞেস করলো।
“এ সালা আমি ভূত প্রেত হবো কেন রে।মা কালী কি তোর চোখ অন্ধ কইরে দিয়েছে নিকি?দেখছিস না জলিজ্যান্ত মানুষটা?”
অরুপ মুখ হা করে কেঁদে দিয়ে লোকটিকে জড়িয়ে ধরলো। লোকটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে বলল,”এ সালা তোর নাক থেকে ন্যাটা ঝরিচ্ছে জড়ায়ে ধরার কোনো দরকার নেই।দেখেক গুলো ন্যাটা লাগায়ে দিয়েছিস গোতোরে।”
অরুপ কান্না বন্ধ করে নাক চোখ মুছতে লাগলেন শার্টের হাতা দিয়ে। লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করলো,”তোর জামা কাপড় দেইখে তো মনে হচ্ছে না তুই ঘাঁটের তক্তা চুরি করতে আইসেছিস।তো দৌড় দিলু কেন?”
অরুপ চোখ মুছতে মুছতে বলল,”দাদা আমি তো দূরে থেকে তোমাকে দেখতেই পাই নি।দেখেছি শুধু মশালের আগুন।এভাবে কোনো আগুনের গোলা নিজের দিকে আসতে দেখে কে না ভয় পাবে।বল দাদা”
চোর না ধরার আক্ষেপে লোকটি বিড়বিড় করে কি যেনো বলতে বলতে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে মাঝি ঘাঁটে ফিরে এসে ডাকছে তাকে। অরুপ উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝেরে নৌকায় উঠে পড়লো। নদীর পানি গুলো টল টল করছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে, বাতাসের অনুকূলে দাড় বাইছেন মাঝি। অরুপ মনে মনে ভাবছে এই রকম দৃশ্য কোনো চিত্রকারের চোখে পড়লে সাথে সাথে দৃশ্যখানা কাগজে বন্দি করতেন। কিছুক্ষণ পর ঘাঁটে আসলো নৌকা। ধীরে ধীরে সূর্য উঠার আভা জাগছে আকাশে। অরুপ হরিপুরের এক লম্বা রাস্তা ধরে হাঁটছে।দুপাশে সমান্তরাল ভাবে রয়েছে গাছের সারি, দুই পাশের গাছের মাঝদিয়ে সূয্যিমামা উকি দিচ্ছেন।এ হাঁটার মধ্যেও এক প্রশান্তি রয়েছে।এরকম রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে তারাই প্রকৃতির প্রেমে পড়ে না যারা আত্মিক দিক থেকে মৃত।বাজারের মোড়ে এসে এক লোককে শম্ভুনাথের কথা জিজ্ঞেস করে অরুপ জানতে পারলো তারা শশানখোলা গেছে।তার মেয়ের স্বামীর অন্তেষ্টিক্রিয়া এবং তার মেয়ের চিতা আরোহন হবে। অরুপের খুব মায়া হচ্ছে মেয়েটির জন্য।রাজা রাম মোহন রায় তার জীবন অতিবাহিত করেছেন এই সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য।এই ঊনবিংশ শতাব্দীতে আজও কেউ আত্মহত্যা করবে এই ভুল প্রথা অনুসরন করে। অরুপ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে শশানের দিকে।গৌরী নদীর তীরে হরিপুরের এ শশানখোলা মানুষ ভর্তি।চিতার কাঠ সাজানো আছে হয়তো এর ভিতরেই শুয়ে আছেন শম্ভুনাথের মেয়ের স্বামী।
ঘটনাটি সামনে থেকে দেখার জন্য লোকজন ঠেলে কিছু দূর আগালেন অরুপ।এর মধ্যেই একজন সৈনিক তাকে আটকে দিল। সৈনিকটি তাকে আপাদমস্তক ভালো করে মেপে জিজ্ঞেস করলো,”আত্মীয় স্বজন বাদে চিতের সামনে যাওয়া যাবি নে”
“আমি কৈলাসপুর থেকে এসেছি শম্ভুনাথ পণ্ডিত আমার কাকা হন। আমাকে একটু সামনে যেতে দিন।”, অরুপ বলল।
“আপনি কি চান করেছেন মশাই?
“না।আমি সবে এসে পৌঁছেছি।স্নান করার সময় পেলাম কই।”
“চান ছাড়া অন্তেষ্টিক্রিয়ায় সামিল হওয়া যাবে না মশাই। এখানে দাঁড়িয়েই প্রার্থনা করুন।”
চুপচাপ ভিরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল অরুপ। অরুপ দেখলেন শম্ভুনাথ ও আরেকজন বুড়ো অর্চনা শেষ করে দাঁড়িয়েছেন।দুজন লোক একটি বাচ্চা মেয়েকে ধরে আছেন।বয়স ১২ কি ১৩ হবে।মেয়েটি শম্ভুনাথের মেয়ে।এখন ই তাকে পোড়ানো হবে শবদাহের সাথে। অরুপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক আরেক লোককে বলছেন,”বিয়ে হয়েছে সবে দশ দিবস।ছেইলের বেরামে মরন হয়েছে শুনলেম।আহা মেয়েছিলাটার কি ভাইগ্য দেখ!বিয়ে করানোর সময় কিচ্ছু বুঝে না,তাই জোর কইরে বিয়ে দিলো। এখন নিজের জীবন আত্মত্যাগ দিতে চাচ্ছে না তারপরও হাত-পা ধরে মেলা মারবেনে চিতের কাষ্ঠতে।”
বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে অরুপ আহা কি মায়াবী চোখ।কি সুন্দর চেহারা। শৈশবকালে খেলার বয়সে বিয়ে,মৃত্যু সব তার ভাগ্যে জোর করে লিখে দেয়া হচ্ছে।মেয়েটি চেয়েও নিজের মত প্রকাশে ব্যর্থ।আগেরকার দিনে কেনো ঘরে মেয়ে জন্ম নিলেই জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হতো এখন বুঝা যাচ্ছে।এতো কষ্ট করে একটা প্রাণ পৃথিবীতে এনে তাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারার চেয়ে জন্ম হওয়ার সাথে সাথে মেরে ফেলা উত্তম। মেয়েটির বাবা শম্ভুনাথ তাকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।মেয়েটি চিৎকার করে বলছে,”বাবা আমাকে মাইরে ফেলায়ো না।বাবা আমার কি দোষ?আমি কি ভুল করেছি?”বারবার এই একই কথা বলেই যাচ্ছে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে।শম্ভুনাথের অবস্থা দেখে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসহায় লোক মনে হয় যে কিনা নিজের মেয়েকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন কিন্তু চেয়েও পিছনে টানতে পারছেন না। দুইজন লোক শম্ভুনাথের কোল থেকে তার মেয়েকে টানছে চিতায় আরোহন করানোর জন্য।মেয়েটি বাবা কে ঘামচে ধরে আছে আর শুধু প্রাণভিক্ষা চাইছে।যখন লোক দুজন মেয়েটিকে পশু প্রানির মতো তার বাবার থেকে আলাদা করে ফেলেন মেয়েটি চিৎকার বন্ধ করে দিল।মেয়েটি চুপ হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।হয়তো সে বুঝে গেছে চিৎকার আর্তনাদ করে লাভ নেই এবার নিজ থেকেই প্রাণত্যাগ দেয়াই ভালো।তার নিজের বাবাই তাকে বাঁচাতে চাইছে না।লোক দুটো তাকে চিতার উপর উঠে বসতে বললেন।মেয়েটা চিতার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।সে যেনো কোনো মানুষ নয়, বরং কোনো পশু।মেয়েটি যখন চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাকে জীবিত নয়,মৃতই দেখাচ্ছিল।লোক দুটো এবার তাকে তুলে চিতার উপর শুইয়ে দিয়ে রশি দিয়ে হাত পা বেঁধে রাখেন। ছোট্ট পশুটি এবার চাইলেও পালাতে পারবে না। এবার এই পশুকে বধ করবেন এক যুবক। সম্ভবত ছেলের ভাই। ভাইয়ের মুখে আগুন ধরিয়ে দিলেন।চিতা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। অরুপ যখন আগুন লাগার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখছিল,পশুটি কোনো চিৎকার করলো না।গায়ে আগুন লাগার পর যদিও সে আবার চিৎকার শুরু করল কিন্তু সেটা কারো কাছে বাঁচার অনুরোধের জন্যে নয় সেটা ছিল শুধু মাত্র আগুনে পোড়ার কষ্ট। নিমিষেই ছোট্ট পশুটির আর্তনাদ বন্ধ হয়ে আসলো।পশুটি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।তাকে কেউ স্বামীর সাথে স্বর্গে যেতে না দেখলেও পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ হতে দেখেছে। সেখানে উপস্থিত অরুপ, দাঁড়িয়ে থাকা সকল মানুষ ছিলেন পশু। একটু বিরোধিতা করার সাহস কারো হলো না।তারা সবাই এমন একজনের কাছে হারলো যে কিনা সেখানে উপস্থিত ই ছিলেন না।সে ব্যাক্তিকে পরম্পরা বা রীতিনীতি বলে। অরুপ ভাবলো তার চেয়ে বড় অসহায় সে দেবীরা যাদের পূজা করা হয়।তারা নারীজাতির অপমানের জবাবে কিছু করতে পারেন না। এখানে নারী জাতিকে প্রতিনিয়ত জীবিতবস্থায় পুড়িয়ে ফেলা হয়।তা আবার এক পুরুষের মৃত্যুর দায়ে। কিন্তু নারী মরলে পুরুষকে চিতা আরোহন করানো হয় না।দেবীরা কি এসব দেখেন না?….
(পরের অংশ পর্ব-৩ এ)
#আকুজি
#হরিপুর_যাত্রা
#চিতা_আরোহন