হরিপুর যাত্রা পর্ব-৩(হরিপুর নিবাসীরা)

0
144

হরিপুর যাত্রা
পর্ব-৩(হরিপুর নিবাসীরা)

অরুপ শম্ভুনাথকে শান্তনা দিয়ে নিজেকেও শান্ত করলেন।শম্ভুনাথ এ গ্রামে আর এক মুহূর্ত থাকতে চাইছেন না। শোকের রেশ না কাটতেই অরুপকে নিয়ে র‌ওনা হলেন রাজার বাড়ি।রাজার সাথে কথা বলেই শম্ভুনাথ চলে যাবেন। অরুপের পড়নে ছিল সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট এর উপর দিয়ে কালো ব্ল্যাজার। হরিপুরের লোকজন বলাবলি করতে করতে পুরো গ্রাম রটানো শেষ যে গ্রামে একজন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসেছে। বাচ্চা রা অরুপ ও শম্ভুনাথের পিছু পিছু হাঁটছে। তাদের সামনে যে ই পড়ছে অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে থাকছে তার দিকে। গ্রামের দুই বদ ছোকড়া সেই খবর পেয়ে আতংকিত হয়ে গেলেন। একজনের নাম বিভীষণ আরেকজনের নাম চন্দন। বিভীষণ দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চন্দনের কাছে এসে বলল,”এরে চন্দন শুনেছিস গিরামে নুতন আপিসার আইসেছে।শম্ভুনাথ পণ্ডিত তারে নিয়ে রাজার বাড়ি চ‌ইল্লো। নির্ঘাত তোর বাড়ির গান্জা গাছের সন্ধান দিয়েছে রে।এখন মহারাজ আর আপিসারকে এক করে নালিশ দিয়ে তোকে হাওলাতে ঢুকাবেনে।আমি ব‌ইলেছিলাম পন্ডিত মশাইয়ের দোকানের সামনে গান্জা খাইস নে।শুনলি নে।”

“বাড়া তাকি ভেবেছিলেম নাকি যে শম্ভুনাথ এতো তুচ্ছ কারণে আপিসার ডাইকে আনবেন।”,চন্দন বলল।

“এখন উপায়?”

“কুর্ছোতে কতখানা টেকা আছে বের কর”

“আরে বাপু আমি গরীব মানুষের ছাওয়াল।টেকা সিকি কি আমাগের কুর্ছোতে থাকে নিকি।কিসব বকিস”, ভয়ে আতকে উঠে বিভীষণ বলল।

বিভীষণের চেহারা দেখে চন্দনের সন্দেহ হলো।চন্দন আচমকা বিভীষণের ধূতির গিট টেনে খুলতে চাইলো।

“এ চেঙরা,কি করছিস? তোর লাজ শরম কি সব ভাগারে গেছে নিকি।চন্দনরে আমার ধূতি ছাইড়ে দে।ধূতি ছিঁড়ে গেলে বাবু আমাক মাইরে ফেলবে।কুর্ছো ছাড় চন্দন।”, চন্দনের হাত ধরে ধূতি খুলতে বাঁধা দিচ্ছে আর আর্তনাদ করছে বিভীষণ।

অবশেষে চন্দন সফল হলো। বিভীষণের ধূতির গিট খুলতেই পাঁচটি দশ আনি সিকি খপ করে মাটিতে পড়ে গেল। বিভীষণ ধূতি সামলাতে সামলাতে সিকি গুলো নিজের কাছে নিয়ে নিল চন্দন। বিভীষণ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,”চন্দন রে সিকি গুলো যে আমার না।বাবু দিয়েছে বাজার থেইকে চাল ডাল কিনে আনার জন্যে।যদি তুই এগুলি নিয়ে নিস আমাগের পরিবারের সব না খাইয়ে মরবে।সিকি গুলো দিয়ে দে।”

চন্দন খুব শান্ত ভাবে উত্তর দিল,”ক্যারে বিভু,গান্জা কি দু’জন এ মিলে খাই নে? তাইলে ভর্তুকির সময়ে এতো নাটক করছিস কেনো?আপিসার কে দুই চার খান টেকা দিয়ে যদি বিপদ মোচন করা যায় তা কি ভালো না? নয়তো বুইঝে নে আমি ফাসলি তোর নাম খানা সবার আগে ব‌ইলে দিব।”

“আচ্ছা থাকগে।আইজ না হয় ধার কয্য করে ডাল ভাত খায়া নিবোনে। কিন্তু তুই আপিসারকে টেকা দিবি কেমন ক‌ইরে?শম্ভুনাথ পণ্ডিত যে তার সাথে সাথেই হাঁটছে।”

“তা কেমনে দিব তা দেখবি নে, তোর মিত্রকে কি কম মনে করিস নাকি? চলন্ত রেলগাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে ছিলেম মনে আছে তো?”

“চলেক,আপিসার কত দূর জানি চ‌ইলে গেছে।”

শম্ভুনাথ ও অরুপ রাজার বাড়ির কাছাকাছি এসে পরেছে। এর মধ্যে তাদের সামনে দাঁড়ায় চন্দন। অরুপের দিকে অঘাত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চন্দন।চোখ গুলো খুবই তীক্ষ্ণ ও ছোট মনে হচ্ছে চন্দনের।বড় রহস্যময় চাহনি তার।শম্ভুনাথ ও ভাবছেন এই ছেলে এই ভাবে কেনো রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়েছে। চন্দন ধীরে ধীরে তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।শম্ভুনাথ আবার ভাবলো এই ছেলেটি কি নতুন করে ডাকাতি করা শুরু করলো নাকি।আর চন্দন খুবই রোমাঞ্চকর ভাবে হেঁটে আসছে তাদের দিকে। কিছু পা এগুতেই অঙ্গিভঙ্গি করে হাঁটতে গিয়ে কাঁদার মধ্যে পা পিছলে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো চন্দন। মাথা,ঘাড়,পিঠ,কোমর,প্রশ্চাৎদেশ,পা সব কিছু তেই ব্যথা পেয়েছে চন্দন। অরুপ ও শম্ভুনাথ টেনে তুললেন তাকে।তার শরীরের পিছনে কাঁদা দিয়ে একাকার হয়ে আছে।শম্ভুনাথ চন্দনকে বললেন,”এই ছোকরা গায়ে হাত দিবি নে। তোর হাতে প্যাক ভ‌ইরে আছে।ওরম চডং চডং হাঁটতে কে বলেছে তোকে হতচ্ছাড়া।”

“ও কাকু আমাক ধরেক।পায়ে ভর দেয়া যাচ্ছে নে।ও মা!মাজার হাড্ডি খান ভেঙ্গে গেছে মনে হচ্ছে।ও কাকু গো আমাক একটু ধরেক।ও মা গো…পরাণ খানা বেরিয়ে গেল রে।”,চন্দন বললো।

“তোমার কোমর পা সব ঠিক আছে। বাসায় গিয়ে শুয়ে আরাম করো।ব্যাথা ভালো হয়ে যাবে।”, অরুপ বলল।

“বাবু আপনি বৈদ্য না কবিরাজ? আপনি কি ক‌ইরে বুঝবেন যে আমি আমার মাজা অনুভব ক‌ইরতে পারছি না। দারোগা মানুষ তো আপনি তাই মনে দয়া মায়া নেই আপনার”,চন্দন বলল।

“এই চেঙরা, কি বকিস এসব?উনি দারোগা নয়,উনি বৈদ্য‌ই।”, শম্ভুনাথ বললেন।

চন্দন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অরুপের দিকে। মনে মনে ভাবতে শুধু শুধু আতংকিত হলো সে। মনে মনে খুশি হয়ে গেল বিভীষণের পঞ্চাশ সিকি এখন তার। ভাঙ্গা কোমর আর পায়ের কথা ভুলে হেঁটে চলে গেল চন্দন। অরুপ ও শম্ভুনাথ ভাবতে লাগলেন ছেলেটার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি।
শম্ভুনাথ ও অরুপ রাজার বাড়িতে বসে আছেন।রাজসভা চলছে। মহারাজ রাজ দরবারের সদস্যদের সাথে অতি জরুরী বিষয়ে কথায় ব্যস্ত।শম্ভুনাথ বসে মুখ গোমড়া করে মেয়ে স্মৃতিচারণ করছেন।আর অরুপ আপাতত রাজা মশাইয়ের জরুরি আলোচনার কথা গুলো শুনছেন।

“শুনিচ্ছো নাকি অশ্বিনী,এই ভারতবর্ষ নাকি ভাগাভাগি হবে। ইংরেজদের থেইকে স্বাধীন হ‌ইতে পারলেই নাকি দেশ বন্টন হবে। গান্ধীর নাকি এই ই ইচ্ছে”মহারাজ রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন।

“কি আর বলবো মহারাজ,বন্টন নাকি হিন্দু আর মুসলমান গের সংখ্যা হিসেবে হ‌ইবে।আমাগের এদিকে তো মুসলমান ই বেশি।আমাগেরো কি তাইলে মুসলিমস্থানে থাইকতে হ‌ইবে। বন্টনের দরকারটা কি তা ই বুঝি নে।”,অশ্বিনী রায় বলল।

“ইংরেজদের কি আসলেই ভাগাবার পারে কি না তা ই ঠিক নেই।”,রাজা মশাই।
মহারাজের ধ্যান গেল শম্ভুনাথের দিকে।শম্ভুনাথকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”শম্ভু, তুমি কি তালি চ‌ইলেই যাবে? নিজের ভিটে বাড়ি ছাইড়ে দার্জিলিং চ‌ইলে গিয়ে কি ক‌ইরবে তুমি?”

“এখানে আর মন টিকছে না মহারাজ।জ্যান্ত মাইয়্যেটারে পোড়ায়ে আইসলাম, এখানে থাইকে তার স্মৃতি গুলো মনে ক‌ইরে আমি বাঁচতি পারবো না।আমি আইজি মেলা দেবো। শুধু একটা অনুরোধ নিয়ে আইসেছিলেম আপনার কাছে।”,শম্ভুনাথ বললেন।

“কি সিটা?”

“এই ছেইলেটার নাম অরুপ চ্যাটার্জি।ডাক্তারি পাস করেছে।এখন একটি বৈদ্যখানা দিতে ইচ্ছুক। বাজারে আমার দোকানটা ওর কাছে বিক্রি ক‌ইরেছি।এখন আপনি অনুমতি দিলে আর কিছু টেকা ধার দিলে আপনার গিরামের প্রথম বৈদ্যখানা হবে এটি।”

“এ তো খুশির সংবাদ।আমার গিরামে দোষজ্ঞ থাকিবে। আশেপাশের গিরামের সকলে আমার গিরামে আইসবে আরোগ্য হতি। আমার বাহ বাহ হবি সবখানে।আমি অবশ্যই সাহায্য ক‌ইরবো। কিন্তু খাজনা দ্বিগুণ দিতে হবি।”

রাজা রাজেন্দ্রনাথ ঠাকুর চিকিৎসালয়ের অনুমতি আর এক হাজার টাকা দিয়ে দিলেন। অরুপকে দোকান আর বাকি সব বুঝিয়ে দিয়ে শম্ভুনাথ তার পরিবার নিয়ে চলে গেলেন। কলকাতা থেকে ঔষধ সামগ্রী নিয়ে আসলেন অরুপ।চেয়ার টেবিল দিয়ে ডাক্তারের চেম্বার ও সাজিয়েছেন খুব সুন্দর করে।এ খবর শুনে আশপাশের এলাকার অনেক লোক আসছেন চিকিৎসালয়ে সেবা নিতে।রোগে ভুগে মরতে হবে না ভেবে সবাই খুশি। কিন্তু কিছু অজ্ঞ হরিপুর বাসি এই কাজে মোটেও খুশি নন।যেমন চন্দনের বাবার কথা ধরা যায়। চন্দনের বাবা বিষ্ণু হরিপুর গ্রামের একমাত্র বৈদ্য ছিলেন।যে কিনা গাছের ডালপালা,পাতা, ফুল,ফল দিয়ে ভেষজ চিকিৎসা দিতেন। গ্রামের যে কোনো লোক অসুখে আক্রান্ত হলে আসতেন তার কাছে।দুই একটা গাছের ডালপালা বা পাতা বেঁটে বড়ি বানিয়ে রোগীকে দিয়ে ভালোই ব্যবসা করছিলেন। কিন্তু তার ভন্ডামির ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হলো অরুপ আসায়। দু’দিন ধরে রোগী আসছে না তার কাছে।বাপ বেটা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন।এখন সিদ্ধান্ত নিলেন অরুপকে যে করে হোক দমাতে হবে।দুজন এসে অরুপের বৈদ্যখানার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছেন কি হচ্ছে এসব।বৈদ্যখানার সামনে সারি দিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য।আর চেয়ারে বসে রোগীদের সমস্যা শুনে ঔষধপত্র দিচ্ছেন অরুপ।চন্দন ও তার বাবা সারি ভেঙ্গে চেম্বারের ভিতরে ঢুকে গেলেন। রোগীদের সামনে যে করেই হোক তাকে ভন্ড প্রমান করবেন। তাদের দেখতেই অরুপ হাসি দিয়ে বলল,”দাদা, সারিতে দাঁড়াতে হবে।এভাবে ভিতরে ঢুকে গেলে হবে না।আরো লোক আছে আপনাদের পূর্বে এসেছেন”

রেগে গিয়ে বিষ্ণু বললেন,”এরে চেঙরা চিকিস্যে করেক।আমরা তোর চিকিস্যে নিবার আসিনি।দেইখতে আইসছি কি ভন্ডামি শুরু করিচ্ছু তুই”

বিষ্ণু হাসি দিয়ে রোগীর সাথে কথা বলতে লাগলো।রোগীকে অরুপ বলল,”আপনার পায়ে লোহার যে তারকাঁটা ঢুকেছে সেটা মরিচা ধরা। ইনফেকশন হতে পারে। আপনাকে একটা সুই দিতে হবে যাতে পায়ে পঁচন না ধরে।”

অরুপের কথা শুনে বাপ বেটা চিৎকার করে হাসতে লাগলো।চন্দন বাকি মানুষদের শুনিয়ে বলতে লাগলো,”শুনিচ্ছো নাকি মনিষীর কথা।একখানা পুইট্টে ঢুকলে নাকি পা প‌ইচে যায়। জীবনে শুনিছেন নাকি আপনারা এরম কথা”

সবাই দ্বিধায় পড়ে গেল আসলেই কি একটা ছোট্ট তারকাঁটা পায়ে ঢুকলে পায়ে পঁচন ধরা সম্ভব? কেউ কেউ আবার বিষ্ণু আর চন্দনের সাথে একমত হয়ে গেল।রোগী স্বয়ং চটে গেলেন অরুপের উপর।বলতে লাগলেন,”কি মশাই,একটা পুইট্টে ঢুকিছে তাই পচনের ভয় দেখিয়ে সূচ ফুটিয়ে পয়সা কামাতি চাচ্ছেন।আপনি তো দাদা বড় ভন্ড।আপনাকে ভালো ভাইবছিলেম।”

অরুপ হাজার বুঝিয়ে ও লাভ হলো না।চন্দন আর বিষ্ণু লোকজন জড়ো করে অরুপকে ভন্ড বানিয়ে ছাড়লেন। সেই রোগীর পায়ে ক্ষত তে কাঠি ঘুটে রক্ত ঝরিয়ে তার মধ্যে এক পাতার রস লাগিয়ে রোগীকে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন কিরাম লাইগছে?”
রোগী অবাক হয়ে বলল,”বিষ্ণু কাকু আসলেই বেশ ভালো ঠেকছে। কেমন শীতল হয়ে গেল পা”
চন্দন বলল,”আমার বাবুর চেয়ে বড় কোনো বৈদ্য আছে নিকি সারা গিরামে?আমার বাপ জরিবুটি দিয়ে দোষজ্ঞ করেন লোকেক।কোনো ভন্ডামির ব্যবসা করেন না।চলো সবাই এই ভন্ডের কাছ থেকে।এই লোক কিছুই পারে না,পুরো পেতারক।”

সব লোকজন চলে গেল বিষ্ণু আর চন্দনের পিছু পিছু। অরুপের চিকিৎসালয় ফাঁকা হয়ে গেল। অরুপ সারা দিন,সারা রাত বসে র‌ইল। কিন্তু কোনো রোগী আসলো না। চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো অরুপ।
যে রোগীর পায়ে তারকাঁটা ঢুকেছিল তার নাম তালেব আলী,রাতে তার বাড়ি থেকে চিকাৎরের আওয়াজ আসছে। লোকটি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে।তার পায়ের পাতা ফুলে গিয়েছে। তালেব আলীর স্ত্রী তাকে খুব শান্ত করার চেষ্টা করছেন কিন্তু যন্ত্রনায় তিনি কাতরাচ্ছেন।বিষ্ণুর দেওয়া সে পাতার লেপ পায়ে ঘষছেন বারবার কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।তালেব ব্যাথায় পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগলো।কোনো উপায় না পেয়ে তার স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন বিষ্ণুকে খবর দিতে….(পরের অংশ পর্ব-৪ এ)

#আকুজি
#হরিপুর_যাত্রা
#হরিপুর_নিবাসীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here