#সেদিনও_বৃষ্টি_ছিল,পর্ব-১
সাদ দুম করে বাইকের ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে বসে থাকা সৈকত হুমরি খেয়ে সাদের উপর পরল, সে অবাক হয়ে বলল-
-কিরে কী হলো, এভাবে থামলি কেন?
-ওই দেখ বর্ষার রূপ!
-সৈকত তার ডানে তাকিয়ে বলল- যাহ বাবা, বের হলাম ঘোর বর্ষার কদম দেখতে আর সামনে পড়ল আস্ত কোলাব্যাঙ!
-রিকশা উল্টে পড়ে গিয়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া মেয়েটা তখন কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে বিমূঢ়ের মত হয়ে আছে। একবার এদিকে তাকাল তারপর সে উঠবার চেষ্টা করল…
সাদ বলল- কিন্তু কোলাব্যাঙ পানি ছেড়ে কাদায় কী করছে?
সৈকত বলল- মনেহয় বৃষ্টির অপেক্ষা… বলেই দুজন হেসে ফেলল, তারপর বাইক থেকে নেমে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলল- ব্যথা পাননি তো? উঠতে পারবেন? তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল হাতটা ধরুন…
মেয়েটা কিছু না বলে একাই উঠে দাঁড়াল। এমনভাবে কাদায় পড়েছিল যে তার মুখের ভৌগোলিক চিত্রের কিছুই বুঝবার উপায় নেই। কী বিশ্রী অবস্থা! আজকের সকালটাই তার কাছে খারাপ বলে মনে হল। মেজাজ খারাপ করে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল এখন পড়ে গিয়ে এই অবস্থা। সিনেমার মত নায়কের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে যেতে নায়ক স্লো মোশনে তাকে ধরে ফেলবে তারপর দুজন দুজনার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকবে আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শুরু হয়ে যাবে “লা লা লা লা লা…” সেটা আর তার কপালে কই? তার তো আটার বস্তার মত কাদায় পড়ে যাওয়া কপাল, তাও আবার স্মার্ট সুন্দর নায়কমার্কা ছেলের সামনে! আর পড়েছেও এমনভাবে যে তাকে কোলাব্যাঙ ছাড়া অন্য কিছু ভাবাও যাচ্ছে না! তখন খেয়াল করল তার বাম হাতের কব্জির উপর কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে! সে তখন ইচ্ছে করে এমন ভাবে হাত ঝাড়া দিল যে তার হাতে লেগে থাকা কাদা ছিটকে সৈকতের গায়ে গিয়ে পড়ল। সৈকত একটু সরে গিয়ে বলল- করছেন কী! এটা আপনার বিছানা পেয়েছেন যে ইচ্ছে মত হাত পা ছুড়ছেন? দিলেন তো আমার গায়েও কাদা লাগিয়ে… কাউকে সাহায্য করতে আসাটাও তো বিপদ!
ততক্ষণে আরও কিছু লোকজন জমা হয়ে গেছে। সবাই যেন মেয়েটার অসহায় অবস্থা দেখে মজা পাচ্ছিল। সৈকত আর সাদ তখন অন্য একটা রিকশা ডেকে মেয়েটাকে উঠিয়ে দিল। আর বলে দিল “সাবধানে যাবেন”।
মেয়েটাকে রিকশায় তুলে দিয়ে সাদ আর সৈকত বাইক স্টার্ট দিল। সৈকত সাদের বড় মামার ছেলে। গতকালই বড় মামা পরিবার সহ তাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। আসার অবশ্য আরও একটা কারণ আছে আর সেটা হলো সৈকতের জন্য পাত্রী দেখা। তার বাবার এক বন্ধুর মেয়ের ব্যাপারে তাদের মোটামুটি পর্যায়ের কথা এগিয়ে রাখা হয়েছে। এখন শুধু সরাসরি মেয়ে দেখা আর সম্ভব হলে আজই বিয়ে পাকা করে ফেলা। বিকেলেই সেখানে যাবার কথা। সৈকত সাদের ভীষণ পছন্দের একজন মানুষ। এবার অনেকদিন পর সৈকত এসেছে তাই তারা বাইক নিয়ে একটু ঘুরতে বের হয়েছে। তারা বাইক নিয়ে আরও কিছুদূর যেতেই বৃষ্টি নেমে গেল। ভরা বর্ষা এখন, কখন যে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় বলা যায় না।
সাদ বলল- ভাইয়া কোথাও দাঁড়াব?
-না। অনেকদিন ভিজি না। চল আজ ভিজি। বাইকে চড়ে ভেজার আলাদা একটা মজা আছে।
-সৈকতের সব কথাই সাদের ভালো লাগে তাই সে বিনা বাক্যে তার কথা মেনে নিল। যদিও বৃষ্টি বাদলে ভিজে তার কিছু হয় না তবু তার কখনো বৃষ্টি বিলাস করা হয় না। আজ নাহয় সৈকত ভাইয়ার সাথে করল। টানা দেড় ঘন্টা ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে তারা কাক-ভেজা হয়ে বাড়ি ফিরল দু-হাত ভরে কদম নিয়ে। এত কদমফুল কেন এনেছে তারা কেউ জানে না।
সৈকত ভীষণ বিরক্ত মুখে বসে আছে, কারণ পাত্রী দেখার জন্য বাসার সবাই হৈ হৈ করতে করতে চলে এসেছে। রীতিমত বরযাত্রীর যাত্রা যেন। কোনো মানে হয়? ঘরে এত মানুষের বসার জায়গাই হচ্ছে না। বাসের মহিলা সিটের মত চাপাচাপি করে বসতে হয়েছে। এত করে বলেও কাউকে সে রেখে আসতে পারেনি। এ বাসার দাদী তো বলেই বসলেন “বাসায় কাউরে রাইখা আসো নাই, না?” লজ্জায় তার মাথা কাটা যাবার মত অবস্থা। ওদিকে তার শরীরও কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। বৃষ্টিতে ভেজা তার সয় না তবু কেন যেন আজ বৃষ্টি দেখে সে না ভিজে পারল না। এখন হয়ত এইজন্য তাকে কিছুদিন ভুগতে হবে। তাদের সামনে এত এত খাবার রাখা হয়েছে কিন্তু সে অধৈর্য হয়ে পাত্রী দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। যত দ্রুত এখান থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়া যায় আর কী। সবার এত কথাবার্তাও তার বিরক্ত লাগছে। কিছুই ভালো লাগছে না, সে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়। তার বিছানা তাকে ডেকে যাচ্ছে যেন।
অপেক্ষার প্রহর শেষ করে পাত্রী এন্ট্রি নিল ঘরে। সে একবার ভালো করে তাকাল তারপর বাকিদের কথায় মন দিল। কিছুক্ষণ পর আবার তাকাতেই মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মেয়েটার চোখে সে কনফিউশন দেখতে পেল। কারণ সে ঘুরেফিরে তার দিকে আর সাদের দিকে তাকাচ্ছে। বুঝল মেয়েটা বুঝতে পারছে না পাত্র আসলে কে? সে মনে মনে হাসল। হঠাৎ-ই তার কানে দুম করে এসে গেল তার বাবা বলছে “আলহামদুলিল্লাহ্, মেয়ে ভীষণ লক্ষ্মী, ছেলে আর মেয়ে একটু আলাদা কথা বলুক তাদের নিজেদের মধ্যে হালকা জানাজানি আর কি…” মেয়ের পরিবারও দেখল বেশ খুশি। এদের সবার কথায় মনে হচ্ছে বিয়ে ফাইনাল হয়ে যাবে আজই! অবশ্য তার নিজেরও মেয়েটাকে ভালো লেগেছে, এখন একটু একা কথা বললে বাকিটা বোঝা যাবে।
গাছগাছালিতে সুন্দর করে সাজানো একটা বিশাল খোলা বারান্দায় দুজনকে বসিয়ে দেয়া হলো একা কথা বলার জন্য। সৈকত বলল-
-বাহ বারান্দাটা সুন্দর, মন ভালো হয়ে যাবার মত। এত গাছ… কে করে এগুলো?
-আমি করি।
-ও আচ্ছা… আচ্ছা আপনি আন-ইজি ফিল করছেন না তো?
-না, ঠিক আছে।
-আপনার নামটা যেন কি?
-ভেতরে বসে একবার বলেছিলাম তো।
-একবার বললে দ্বিতীয় বার বলা যাবে না নামটা কী এমন শর্ত দিয়ে রাখা হয়েছিল?
-না। তবে আপনি পাত্রীর নামটা অন্তত জেনে আসবেন সেটা আশা করেছিলাম। “বুশরা আঞ্জুম” নাম আমার।
-ও… ছোট করে এক্স প্রেসিডেন্ট “বুশ” নামে কী ডাকা যাবে?
-ছোট করে ডাকবার জন্য আমার একটা নাম আছেই, “শর্মী”।
-সুন্দর। আসলে নাম জানতে চাওয়াটা কথা বলার ভূমিকা মাত্র। এর থেকেই শুরু হবে বাকি গল্প। তাই নাম জানতে চাওয়া বিষয়টা অতি গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট। এটা আপনার মুখ থেকে শোনার খুব অল্প সময় পরই নির্ধারণ হবে নামটা কোথায় রাখা হবে?
-কোথায় রাখা হবে মানে?
-মানে, শুধুই মনে রয়ে যাবে নাকি বুকে গেঁথে যাবে সেটা।
-কী মনে হচ্ছে?
-নাম নিয়েই তো জটিলতা বেঁধে গেল গল্পই হলো না, সিদ্ধান্ত নেব কীভাবে?
-জটিলতা থাকা ভালো। সহজে পাওয়া জিনিসের মূল্য কম হয়।
-সৈকত মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল… এর চোখে কী যেন একটা আছে যা ভীষণভাবে টানছে। মেয়েটা চোখে কাজল পর্যন্ত পরেনি তবু চোখটা অদ্ভুত রকম সুন্দর। সেটা কি দীর্ঘ আঁখি পল্লবের কারণে? কাজল না পরা মেয়ে হয় কখনো? সে কাজল চোখে মেয়েটাকে কল্পনা করল… সেই চোখে সে আটকে গেল!… বলল- “হুম… ভালো লাগল।”
-কী ভালো লাগল?
-সৈকত কল্পনা ছেড়ে এসে বলল “আপনাকে”।
শর্মী কিছু বলল না, সে সৈকতের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল- ঠান্ড হয়ে যাচ্ছে…
সৈকত কাপ হাতে নিতে গেলে কাপটা তার গায়ের উপর কীভাবে যেন পড়ে গেল! শর্মী সাথে সাথে “সরি” বলে টিস্যু বাড়িয়ে দিল। আর মনে মনে হাসল।
সৈকতের এমনিতেই ভালো লাগছিল না এখন চা পড়ে বিশ্রী অবস্থা হয়ে গেল। বলল-
-আপনার কিছু বলার না থাকলে চলুন ভেতরে যাই। এখানে তো শুধু সংঘাতই হচ্ছে! আর তাছাড়া কে যেন দরজার পাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে, এটা বিব্রতকর।
শর্মী মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর তারা ড্রইং রুমে গেল। যেতেই সৈকত শুনতে পেল বড়রা সবাই “আলহামদুলিল্লাহ” বলল। তারপর ওর বাবা বলল-
-তাহলে আর দেরি করব না শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেলাই উত্তম। বাকিরাও তাতে সায় দিল। শর্মীর দাদী তখন বলে বসলেন-
-সবাই যেহেতু রাজি তাহলে আজ রাতেই বিয়ে হয়ে যাক।
শর্মীর বাবা বললেন- এটা কীভাবে হয় মা? আমরা সবাই মিলে একটা তারিখ ঠিক করি?
-না। আজকালকার যুগ হইল মোবাইলের যুগ। ছেলে মেয়ে সারা দিন রাত মোবাইলে কথা বলবে, বাইরে আগানে বাগানে ঘুরতে যাবে তাতে গুণাহ হবে। আমি তা হইতে দিব না। বিয়ে আজ রাতেই হবে, তোমরা সব ব্যবস্থা করো।
শর্মীর দাদীকে কিছুতেই কিছু বোঝানো গেল না। তিনি এক কথা বলে গো ধরে রইলেন। অগত্যা দুই পক্ষ অনেক বিচার বিশ্লেষণ আর কথা খরচের পর আজ রাতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন।
বিয়ের জন্য যা না হলেই নয় আপাতত সেই সব শর্মীর জন্য কিনে আনা হল। রাত ১১টা নাগাদ বিয়ে হয়ে গেল। জীবনে প্রথম কেউ চায়ের দাগ লাগানো শার্ট পরে বিয়ে করল! আর ১২টা নাগাদ নববধূ নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরল। নববধূ বরনের ছোটখাটো আয়োজন শেষ করে সৈকতের ছোট বোন শর্মীকে একটা ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে দিল। বলল-
-ভাবি, সব কিছু তো হুট করে হয়ে গেল তাই কোনো আয়োজন করা যায়নি। তাছাড়া রাতও হয়ে গেছে। এত রাতে চাইলেও কিছু করার উপায় নেই। ভাইয়া সকালে এত্তগুলো কদম ফুল নিয়ে এসেছিল। সেগুলো দিয়েই ঘর সাজিয়েছি। হাতের কাছে পেয়ে ফুলগুলো এনেছিল। ও জানতও না এই ফুলগুলো এভাবে কাজে আসবে। কী অদ্ভুত তাই না?
-হুম… আজকের পুরো দিনটাই অদ্ভুত ছিল আমার জন্য। এভাবে যে বিয়েটা হয়ে যাবে সেটাই বা কে ভেবেছিল?
-হুম… ভাবি, ভাইয়া বলছিল ওর ভালো লাগছে না। কী হয়েছে কিছু বলল না। দেখো তোমাকে বলে কী না? হুট করে বিয়ে হওয়ায় তোমাদের তো চেনা জানার সুযোগ হলো না, আমি হলে জিন্দেগীতেও এভাবে বিয়ে করতাম না। বিয়ের আগে এক মাস তো প্রেম করতেই হবে তার সাথে আমার। তাকে দিয়ে প্রতিদিন মশারি টানানো যাবে কিনা সেটা শিওর হতে হবে না? আচ্ছা এসব গল্প পরে করব। আমার ভাইয়া কিন্তু খুব ভালো। অবশ্য দুষ্টুও ভীষণ। ওকে তোমার খুব পছন্দ হবে। কিছুক্ষণ গল্প করলেই বুঝে যাবে ভাইয়া কেমন। আচ্ছা আমি এখন যাই, পরে গল্প করব। বলেই সুপ্তি চলে গেল। সুপ্তি চলে যাবার ১০ মিনিট পর সৈকত ঘরে এলো। তার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাটা আর সম্ভব হচ্ছে না সে শর্মীর মুখোমুখি বসে বলল-
-আমি যদি এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ি তুমি কী মন খারাপ করবে?
শর্মী আহত গলায় বলল- পুরো দিনটাই কেটেছে অদ্ভুত সব ঘটনা দিয়ে, শেষটা আর বাকি থাকবে কেন? ঘুমান আপনি।
-যাক তুমি অতটা অত্যাচারী বুশ নও। আজকের রাতে বলার জন্য আমাদের দুজনেরই হয়ত অনেক কথা আছে কিন্তু না বললে ট্রেন মিস হয়ে যাবে এমন কিছু নয়, তাই কথা তোলা থাক পরে বললেও চলবে কিন্তু এই মুহূর্তে যেটা না বললেই নয় সেটা হল, “তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। বিকেলে কল্পনায় তোমাকে কাজল চোখে দেখেছিলাম সেটা যে কয়েক ঘন্টা পরেই বাস্তব হয়ে যাবে ভাবিনি। কাজল চোখের মেয়ে আমার জীবন কাটুক তোমার চোখের তারায় ভালোবাসায় জড়িয়ে” বলেই সে বিছানায় শুয়ে পড়ে বলল- তুমিও ঘুমিয়ে যাও বুশ।
-আমার নাম শর্মী।
-ওকে বুশ, মনে থাকবে।
শর্মী বুঝে গেল বাকি জীবন তাকে “বুশ” নামটাই বহন করতে হবে!
নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ঘুমাতে মেয়েদের অস্বস্তি হয়। শর্মীও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কিছু করার নেই। সে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে এসে দেখে সৈকত ঘুমিয়ে গেছে। সে ঘুমিয়েছে ছোট্ট বাচ্চাদের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে! আশ্চর্য, এভাবে কেউ ঘুমায়? শর্মী বিছানায় তাকিয়ে দেখল কোনো কাঁথা নেই এখানে। ঘরে একটা ওয়ারড্রব আছে সেটাতে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা কাঁথা পেল সে। সেটা নিয়ে সৈকতের গায়ে দিতে গিয়ে দেখে ও বিড়বিড় করে কী যেন বলছে… শর্মী কী মনে করে ওর কপালে হাত রাখল… একি, এর গায়ে যে উথাল পাথাল জ্বর!
শর্মী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কী করবে এখন ও? কাউকে ডাকা দরকার, কিন্তু ডাকবেই বা কীভাবে? এত রাত হয়ে গেছে… সে ঘরের দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিল, নাহ কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে চিন্তায় পড়ল, সৈকতের মাথায় তো এক্ষুণি পানি ঢালতে হবে, গা স্পঞ্জ করে দিতে হবে। এখন পর্যন্ত এর সাথে ভালো করে কথাই হলো না আর এখন এসব করতে হবে! উফফ কী যে বিপদ… এত জ্বর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ কাউকে কিছুই বলেনি, এমন কেন লোকটা? সৈকতের পাশে এসে দঁড়াল সে… সৈকত দেখতে বেশ সুপুরুষ, একেবারে হিরো টাইপ। যে কেউ এর প্রেমে পড়ে যাবে। অথচ এখন কেমন মলিন দেখাচ্ছে মুখটা জ্বরে! শর্মী খেয়াল করল হুট করেই সৈকতের জন্য তার ভীষণ মায়া লাগছে। কী আশ্চর্য, মাত্র কয়েক ঘন্টার পরিচয়ে কারো প্রতি এমন অনুভূতি হয়? নাকি বিয়ে ব্যাপারটাই এমন? ভাবতে ভাবতে সে তার লাগেজ থেকে টাওয়েল বের করে ওয়াশরুম থেকে এক বালতি পানি নিয়ে এলো। পানি ঢালার জন্য সৈকতকে আড়াআড়ি শোওয়ানো দরকার। সেজন্য সৈকতকে বার দুই ডাকল কিন্তু ওর তো কোনো হুশই নেই! তখন সে কোমরে আচঁল গুঁজে নিজেই ওকে ঠিক করতে গেল। বাপরে দেখতে তো চেঙ্গিস খান অথচ নড়ানোই যাচ্ছে না! মাথাটা বালিশে রাখতে যেতেই সৈকত ওকে দু’হাতে জাপটে ধরে বলতে লাগল- “সাদ ব্যাঙটা ধর ধর কাদায় ঢুকে যাচ্ছে… এই ধরেছি ধরেছি…” জ্বরের ঘোরে সৈকতের এভাবে ব্যাঙ ধরা দেখে শর্মীর হাসি পেয়ে গেল। সে সৈকতের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর মাথায় পানি ঢালতে লাগল। আর সৈকত ক্রামাগত আবোলতাবোল বলেই যাচ্ছিল। কখনো ব্যাঙ ধরছে, কখনো সুপ্তির সাথে ঝগড়া করছে, কখনো আম্মুর সাথে কথা বলছে, একবার বলল- “বউ সাজে হোয়াইট হাউস থেকে বুশ গ্রেফতার!” যদিও এসব সৈকত খুব আস্তে বিড়বিড় করে বলছিল তবু শর্মী সব শুনতে পাচ্ছিল। সে সৈকতের মাথায় পানি ঢালছে আর ভাবছে- সকালে রিকশা থেকে পড়ে যাবার পর সৈকত ওকে সাহায্য করেছিল তখন কেউই জানত না আর কয়েক ঘন্টা পরই এরা আজীবনের জন্য একে অপরের সব কিছুর অংশীদার হয়ে যাচ্ছে! কাদায় পড়ে গিয়ে একজন হিরোর উপস্থিতি ফিল করেছিল সে, হিরো তো এসেছিলই শুধু সে চিনে নিতে পারেনি। উফফ কী কপাল! তবে একটা ব্যাপার খুব ভালো হয়েছে যে সৈকত চিনতে পারেনি যে কাদায় পড়ে থাকা মেয়েটা শর্মীই ছিল। নয়ত এটা নিয়ে হাসাহাসি করে কী করত আল্লাহ্ জানে!
অনেকটা সময় পানি ঢালার পর সৈকতের জ্বর কিছুটা কমে এলো আর আবোলতাবোল বলা বন্ধ হল কিন্তু জ্বর পুরো নামল না। শর্মী এবার একটু ভাবনায় পড়ে গেল। সে সারা ঘর খুঁজতে লাগল কোথাও প্যারাসিটামল জাতীয় কিছু পাওয়া যায় কি না? অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে একটা বক্স পেল যেখানে একপাতা প্যারাসিটামল দেখা যাচ্ছে। সেটা নিয়ে এসে যখন খাওয়াতে যাবে তখন ভাবল, সৈকত কিছু খেয়েছে কিনা? রাতে তো মনে হচ্ছে কিছু খায়নি এখন খালি পেটে এটা খাওয়া তো ঠিক হবে না। কিন্তু শর্মী এখন খাবার কোথায় পাবে? সবাই ঘুমাচ্ছে ওদিকে রান্নাঘর কোন দিকে তাও তো সে জানে না… কোনো উপায় না পেয়ে সে ঘর থেকে বের হল রান্নাঘরের খোঁজে আর মনে মনে দোয়া পড়তে লাগল কেউ যেন দেখে না ফেলে। নতুন বউ এই মধ্যরাতে খাবারের সন্ধানে বের হয়েছে এটা কেউ দেখে ফেললে কী না কী ভেবে বসবে আল্লাহ্ জানে। ঘরের বাতি গুলোও জ্বালানো যাচ্ছে না তাই সে মোবাইল জ্বেলে রান্নাঘর খুঁজতে লাগল। ডাইনিং রুমের কাছে আসতেই পাশের ঘরে বাতি জ্বেলে উঠল। শর্মী “সর্বনাশ” বলে মুখ চেপে এক কোনায় চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। ঘর থেকে অবশ্য কেউ বের হল না। তবে সেই আলোয় দেখল টেবিলে কিছু খাবার ঢাকা দেয়া আছে আর রান্নাঘরটা কোথায় সেটাও দেখে নিল। তারপর টেবিলের কাছে গিয়ে ঢাকনা তুলে দেখল, সেখানে তাদের বাড়ি থেকে পাঠানো বিয়ের খাবার আছে। কিন্তু এগুলো তো এখন ওকে দেয়াটা ঠিক হবে না। রিচ খাবার, বমি হয়ে যেতে পারে। সে রান্নাঘরে ঢুকল, সেখানে গিয়ে ভাত, বেগুন ভাজি, ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজা আর ডাল পেয়ে গেল। সে অনেক সাবধানে একটা প্লেট নিয়ে ভাত, একটুকরো মাছ আর বেগুন ভাজা নিল। ঢাকনা রাখতে গিয়ে গেল হাত থেকে ছুটে আর সেটা ঝনঝন আওয়াজ তুলে মেঝেতে পড়ে গেল ! উফফ কোনো মানে হয়? শর্মী তাড়াতাড়ি ঢাকনা তুলে রেখে প্লেট নিয়ে নিজের ঘরে দৌড় দিল। অন্ধকারে টেবিলের সঙ্গে খেল গুতো! দাঁত চেপে ব্যথাটা হজম করে ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢুকতেই শুনতে পেল “উফ এত শব্দ কিসের? শান্তিতে একটু ঘুমাতেও পারব না নাকি?” শর্মীর গা জমে গেল, সে অন্ধকারে তড়িঘড়ি করে ভুল করে অন্য কারো ঘরে ঢুকে পড়েছে!!! তাড়াতাড়ি দোয়া ইউনুস পড়ে ফেলল তারপর আস্তে করে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। এসে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে আটকে রাখা দমটা ছেড়ে দিল আর তখনই সৈকত বলে উঠল-
-তুমি আলো না জ্বেলে অন্ধকারে ভূতের মত কোথায় গিয়েছিলে? আর এত শব্দই কিসের?
-আচমকা সৈকতের কথায় শর্মী ছিটকে ওঠে। বলে- রান্নাঘরে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনি কখন জেগে উঠলেন?
-তুমি যখন অন্ধকারে ভূতের মত রান্নাঘরে ঘুরছিলে তখন। খিদে পেয়েছে সেটা সুপ্তিকে তখন বললেই হত?
-খাবারটা আমার জন্য আনিনি, আপনার জন্য এনেছি। জ্বরে তো বেহুশ হয়ে ছিলেন। জ্বর নামাতে প্যারাসিটামল খেতে হবে আর খালি পেটে তো সেটা খাওয়া যায় না সেজন্যই খাবার আনতে গিয়েছিলাম। নিন ধরুন আর চটপট খেয়ে নিন। জ্বরে যা খেল দেখাচ্ছেন!
-সৈকত দেখল বিছানার পাশে একটা বালতি রাখা, মাথায় হাত দিয়ে দেখল চুল ভেজা! সে বুঝল মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। মেয়েটা এত কিছু করেছে আর সে কিছুই টের পায়নি! বলল- আমার তো হুশ ছিল না সত্যি করে বলো তো কী কী করেছ আমার সাথে? একা ঘরে একজন smart, handsome, good looking ছেলেকে একা পেয়ে উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলনি তো?
-শর্মী চোখ পাকিয়ে বলল- আপনি যা যা ভাবছেন তার চেয়েও বেশি কিছু করেছি। খুশি? এবার খাবেন নাকি খাবারটা রেখে আসব?
-সে হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিয়ে বলল, oh God সমাজে এখন এই চাঁদমুখ কীভাবে দেখাব? তার চেয়েও বড় কথা শত মেয়ের হৃদয় ভেঙে যাবে এসব শুনে… কী হবে এখন?
-মুখ দেখাতে না পারলে ঘোমটা দিয়ে রাখবেন। আর আজ যাদের হৃদয় ভেঙেছে কাল তাদের মাথাও ভাঙব।
-জেলাস গার্ল তুমি রেসলারের বংশধর নাকি?
-খাবেন নাকি শুধু বকবক করবেন?
-আমার একদমই খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না… মনে হচ্ছে বমি করে ফেলব।
-আপনি রাতে কিছু খেয়েছিলেন?
-না।
-একটু কষ্ট করে খান, অল্প হলেও খেতে হবে।
-সৈকত প্লেট হাতে নিয়ে বসে রইল চুপ করে…
-শর্মী বুঝল সৈকত এভাবে খেতে পারবে না। সে ওর পাশে বসে হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে বলতে শুরু করল- জানেন আপনার জন্য খাবার আনতে গিয়ে কী হয়েছে? রান্নাঘর কোন দিকে সেটা তো জানি না তবু রিস্ক নিয়ে গেলাম… তারপর যা কিছু ঘটেছে সব একে এক সময় নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগল। পুরোটা বলা হলে বলল, কেউ আমাকে দেখে ফেললে কী হত ভাবুন? নির্ঘাত চোর ভেবে বসত! আপনার জন্য এত কষ্ট করে খাবার নিয়ে এলাম আর আপনি বলছেন খাবেন না!? এই অত্যাচার মানা যায়? সৈকত শুনে হাসতে লাগল। বলল-
-না, মানা যায় না। তবে তোমার এই আইডিয়াটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
-কোন আইডিয়া?
-এই যে গল্প বলার ছলে আমাকে খাবারটা খাইয়ে দিলে!
-এখন প্যারাসিটামলটা খেয়ে ফেলুন।
-ওষুধটা খেয়ে বলল, আমি প্রথম দিনেই তোমাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি… সেজন্য দুঃখিত আর… অনেক ধন্যবাদ এত কষ্ট করার জন্য।
-আপনি এত জ্বর নিয়ে বসে আছেন কাউকে কিছু বলেননি কেন?
-কাউকে বাড়তি টেনশন দিতে ইচ্ছে হয়নি।
-সব আমার উপর চাপানোর ইচ্ছে ছিল?
-সৈকত মুচকি হেসে বলল- ভাবলাম, আমার প্যারা ভোগ করার পার্টনার যখন এসেই পড়েছে সে কতটা কাজের সেটা একটু দেখি?
-“বেহুশ থেকে ভালোই দেখেছেন” বলে শর্মী সৈকতের কপালে হাত দিয়ে জ্বর কতটা আছে বোঝার চেষ্টা করল সৈকত তখন মিনমিন করে বলল- “শুধু আমাকে ছোঁয়ার বাহানা”
শর্মী তখন ওর কানটা টেনে ধরে বলল- আমি কিন্তু খুব ডাকাত মেয়ে, আমার সঙ্গে লাগতে আসবেন না। একেবারে সিধে করে ছেড়ে দেব।
সৈকত তখন আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে বসে এক হাতে শর্মীর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল- আর আমি কিন্তু খুব ত্যাঁদড় ছেলে, আমার ভালোবাসায় তোমাকে একেবারে ডুবিয়ে মেরে ফেলব।