শূণ্য_কৌটা (পর্বঃ-০৫ শেষ)

0
485

#শূণ্য_কৌটা (পর্বঃ-০৫ শেষ)
-সুহাসিনী

সেদিন রাতে মেয়েটা আর খেতে বের হলো না। ঘরের কোণে আড়ালে আবডালে চোখের জল ফেললো শুধু। পুরনো সংসারে হঠাৎ গুরুত্ব কমে গেলে “যা হবার, হয়েছে” বলে সয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু নতুন সংসার হবার আগেই সেটা বিষ হয়ে উঠলে সেই মুহূর্তটা একজন নারী কিভাবে সামলায়?

শিরিন কিছুই ভেবে পায় না। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এই পরিবারের মানুষ এতদূর ভাবছে। অথচ এখানে ভাবার মতো কোনো বিষয়ই নেই। ভালোবাসায় পাগল হয়ে সিদ্ধান্তটা এত তাড়াহুড়ো করে না নিলেও পারত সে। বুঝতে বড় দেরি হয়ে গেল তার! এতবড় আফসোস এখন কোথায় লুকোবে মেয়েটা?

ঘন্টাখানিক সময় নোমানের অপেক্ষায় জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে। সামনের সরু রাস্তা দিয়ে শহরের কতশত গাড়ি যায়, গাড়ি আসে। মানুষ মানুষের গলার স্বরে হাসে, কেউ ভাসে। শুধু নোমান আসে না। বরঞ্চ তার পরিবর্তে ঘরে ঢোকে সাহারা জামান। ভারি শরীরের ভারে মেঝেতে থপথপ আওয়াজ করছে। শিরিন সেই শব্দটুকুও টের পায়নি।

সাহারা জামান খাটের উপর পা দুলিয়ে বসলেন। তারপর বললেন,
-শিরিন, আজকাল এত কী ভাবো?

শিরিন চমকে উঠে তাকায়। এই মানুষগুলোকে কেন জানি দুই চোখের কোনো কোণাতেও আর দেখতে ইচ্ছে করছে না। ভীষণ কষ্টে সমস্ত রাগ, অভিমান চাপা দিয়ে সে হেসে বললো,
-মা! আপনি কখন এলেন?
-মাত্রই। তোমার কি মন খারাপ?
-কই, না তো।
-মনে হচ্ছে একটু। যাই হোক, তোমাকে কিছু কাজের কথা বলি। কেমন?

শিরিন চুপ করে আছে। সে জানে, এই মুহুর্তে সাহারা জামানের কথাগুলো তার জন্য মোটেও কাজের কথা হতে পারে না। তবুও তাকে শুনতে হবে। সাহারা বলতে শুরু করে,
-তোমরা প্রেম করে বিয়ে করেছো, আমি কিছুই বলিনি। বর্তমানে এসব খুবই সাধারণ বিষয়। আমার ছেলের খুশিই আমার খুশি। তুমি মনে করতে পারো-তোমার মায়ের প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনে আমি রাগ করেছি। কিন্তু এসব কিছুই নয়। আমার রাগে আর কীইবা আসে যায়, বলো দেখি! বিষয়টা কী, জানো মা? কারো যদি নিজে থেকে বিবেক বোধ না থাকে, তাহলে আমি যতই বলি না কেন, বিশেষ লাভ হবে না। এসব আসলে মানুষের বিবেকের বিষয়, বুঝলে?

শিরিন কটাক্ষ দৃষ্টিতে শাশুড়ীর দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে এক তীব্র রাগের প্রতিচ্ছবি। সাহারা জামান বোধহয় একটু ভয়ই পেলেন। নীরব মানুষ যখন মাথা চাড়া দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, তারা স্বাভাবিক ভয়ংকরের চেয়েও কয়েকগুন ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তিনি আর কাল বিলম্ব না করে চুপচাপ উঠে চলে গেলেন। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে আরেকটু দেখার চেষ্টা করতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু সাহস হলো না।

অনেক রাতে নোমান বাসায় ফিরলো। শিরিন তখন বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
নোমান তাকে জিজ্ঞাসা করলো না-“শিরিন,তোমার কি মন খারাপ?” বরং শিরিন নিজে থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
– বাড়িতে আমার মায়ের ব্যাপার নিয়ে তোমাদের ভিতর কোনো সমস্যা হয়েছে?

জবাবে নোমান কী অদ্ভুতভাবে উত্তর দিল,
– সমস্যা থাকলে একটু আধটু কথা হবেই। এসব নিয়ে আর অযথা ভেবো না। ঘুমাও।

– কীসের ঘুম? তুমি কিছু বুঝতে পারছো না? এটা আমার মায়ের জন্য কত বড় অপমানের! সেই বিয়ের শুরু থেকেই আমি লড়ছি! আর কত! বলতে পারো?

-লড়াই ভাবছো কেন? তোমাদের মধ্যবিত্ত সোসাইটিতে এটা খুবই নরমাল। কিন্তু আমাদের কথাও একবার ভাবো। হাতের পাঁচ আঙ্গুল তো এক হয় না। অযথা এটা নিয়ে কথা বাড়িয়ে ইস্যু বাড়িও না।। আমার মায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে একবার ভাবো।

নিজের কথাগুলো বলে নোমান বালিশ টেনে শুয়ে পড়লো। শিরিন বিছানা ছেড়ে উঠে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে উদাস হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল। এতদিন সে ভালোবাসার নামে আবেগ পুষেছিল। আসলে ভালোবাসাটা একজন ধ্বজ ভাঙ্গা মানুষের কাছে অনেক আগেই ভুলের ভেতর ডুবে গেছে।

পরদিন নোমানের যখন ঘুম ভাঙ্গে, আশেপাশে কোথাও শিরিনকে খুঁজে পায় না। বেশ কয়েকবার ডেকেও সাড়াশব্দ না পেয়ে সে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। তার বালিশের পাশেই একটা চিঠি!

কিছুটা কাঁপা কাঁপা হাতেই চিঠিটা তুলে নেয় সে।

নোমান,
লোকে বলে- অল্প বয়সী মেয়েদের আবেগ বেশি। হয়তো সে কারণেই আমিও ভালোবেসে একটু ভালোবাসা পাবার লোভে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। আমি এখনো জানি না, আমার এই সিদ্ধান্তটা ভুল নাকি সঠিক। কিন্তু আমার মন বলছে , যা করতে যাচ্ছি, সেটাই এখন উচিত। তোমাকে দোষ দেবো না, এমনকি তোমার মাকেও দোষ দেবো না। তবে একটা কথা বলার ছিল- সভ্যতার নামে তোমরা যে দেওয়াল তুলেছ, সেখানে শুধু নিষ্প্রাণেরা ঘুরে বেড়ায়। আর মানুষের রোজ মৃত্যু হয়। আমি সেই মৃত্যু দেখতে চাই না। তোমার সভ্যতায় আমার দম আটকে আসে। কোন একটা দিন নিজের স্বার্থের জন্য আমি একটি পবিত্র আত্মার সাথে অন্যায় করতে চেয়েছিলাম, আমার গর্ভধারিনীকে কাঁদিয়েছিলাম। আজ হয়তো সেটারই ফল পেলাম, তোমার ওই মিথ্যে সভ্যতার অবহেলা পেয়ে। আল্লাহর সৃষ্টিতে যা কিছু বৈধ, তা চির সত্য। পৃথিবীর কোন সমাজ, সভ্যতা সে সত্যকে ভুল প্রমাণ করতে পারবে না। আমি আমার ভুলের শাস্তিটুকু মাথা পেতে নিয়ে এই শূণ্য হাতেই আমার ঘরে ফিরলাম। ঠিক সেই মানুষটার কাছে, যার কাছে মিথ্যে সমাজের চেয়েও আমি ছিলাম মূল্যবান। ওই মানুষটার এখন আমাকে ভীষণ প্রয়োজন। আমার ভুল সিদ্ধান্তের শূন্য কৌটাটি নাহয় এইটুকু দিয়েই পূরণ করব।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here