#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১০
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে ইশা। হাঁটুতে দুহাত দিয়ে সে জোড়াল শ্বাস নিল। সূর্যি মামা তার দ্রুতি ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। মানুষের সমাগম বাড়ছে। রাস্তাঘাট ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। তাকে ডিঙিয়ে যাওয়া ছেলেটি কিছুদূর গিয়ে পিছু ফিরে তাকাল। হাঁপাতে হাঁপাতে ডাক দিল, কি হলো ইশু,আর দৌড়াতে পারছিস না।
ইশার মেরুদণ্ডে হঠাৎ চিনচিন ব্যাথা করে উঠল। সে বসে পড়ল ঘাসের উপর। বলল, রিপুদা আমি আর কখনো তোমার সাথে মর্নিং ওয়াকে বের হবোনা।
রিপ হাসল। এগিয়ে এসে ইশার কাছে হাটুগেড়ে বসল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। আর আসিস না। এখন উঠে পড়। মা যদি দেখে এই অবস্থা, সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ইশা উঠতে পারল না। ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছে। সে চোখবন্ধ করে বলল, কিছুক্ষণ বসি। তারপর যাব।
রিপ বসে পড়ল ইশার পাশে। ইশার যন্ত্রণাদগ্ধ মুখটা দেখতেই বুক ধ্বক করে উঠল। কন্ঠে একরাশ উৎকন্ঠা মিশিয়ে জানতে চায়,
ইশা তুই ঠিক আছিস? কি হয়েছে?
ইশা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, তেমন কিছুনা। পিঠে একটু ব্যাথা করে উঠল। অনেকদিন পর দৌড়েছি তো তাই হয়ত।
ইশা চোখ মেলে তাকাল রিপের দিকে। হেসে বলল, চিন্তা করোনা, তেমন কিছু হয়নি।
রিপ মুখ অন্যদিকে করে বলে, কে জানে? তুই তো আজকাল কোনোকিছুই শেয়ার করিস না আমার সাথে।
ইশা রিপের মুখের দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ওড়নার আচঁল দিয়ে রিপের মুখ মুছে দিতে দিতে বলে, কিভাবে ঘেমে গিয়েছ তুমি রিপুদা। ওদিকে ফিরো তো।
একটুখানি অভিমানে দগ্ধ হওয়া মনটা আবার ও প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেল। রিপ তাকিয়ে থাকল মেয়েটির মুখটার দিকে। আজকাল সে প্রচন্ড খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে ইশু কিছু বুঝে যাচ্ছে না তো? বুঝলে তো ভালো। কিন্তু এ মুহূর্তে রিপের মনে হচ্ছে না মেয়েটি কিছুই বুঝতে পারছে। কিংবা পারবে। তার জন্য ছেলেটির এত চিন্তা, এত উৎকন্ঠা এতসব কিছুর ছেলের আড়ালে যে ভালোবাসাটা লুকিয়ে আছে মেয়েটা তা কখন বুঝবে? কখন ও কি বুঝবে না?
বাড়িতে পৌছানোর সাথে সাথে তালহা বেগম অবাক চোখে তাকালেন রিপ আর ইশার দিকে। কিচ্ছুটি না বলে ইশাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। রিপ বলল, মা ওর কোনো দোষ নেই। আমি নিয়ে গেছি ওঁকে।
তালহা ধমক দিলেন। বললেন,তুই চুপ থাক।
ইশা রুমে গিয়ে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ে। তালহা চেঁচিয়ে বললেন, আজ যদি ব্যাথায় কান্নাকাটি করিস তাহলে খবর আছে তোর। আমি কি তোর কামলা কাটি?
ইশা চোখবন্ধ করে শুয়ে থাকল। ব্যাথা ক্রমশ বাড়তে লাগল তার। অনেকক্ষণ পর আর সইতে না পেরে ডুকরে কেঁদে দেয় সে। আবার চেপে রাখে। আওয়াজ সামান্য শুনে যায় তালহা। চোখ পাকিয়ে দেখে বলে,এই তুই কাঁদছিস?
ইশা ধরে আসা কন্ঠে বলে, মামি দয়া করে চিল্লিও না। আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি,ভালো হয়ে যাব।
মুনা আসতেই ইশাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বলে, তোর কি ব্যাথা উঠেছে ইশা? গরম পানি দেব?
ইশা হাত নাড়ায়। মাথা ঘুরিয়ে নেয়। কেউ বুঝেনা তার কষ্ট। তার কষ্ট হচ্ছে তারপর ও তারা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। এভাবে দৌড়াটা উচিত হয়নি। এরকম ব্যাথা করবে জানলে সে কখনোই দৌড়াত না।
সন্ধ্যা নামল। ইশাকে কয়েকবার দেখতে এল রিপ। হাজারটা প্রশ্ন জুড়ে দিল। বড় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে বলল। কিন্তু ইশা নাছোড়বান্দা। সে কোনো ডক্টরের কাছে যাবে না। ব্যাথাটা সবসময় করেনা। মাঝেমাঝে করে। খুব সামান্য ব্যাথা। অন্যদের কাছে এই ব্যাথা সামান্য ব্যাপার। সে হয়ত সহ্য করতে পারছেনা। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আবার হোঁচট খেয়ে পরী আসল ইশার কাছে। ইশা তখন ভাঙা সোফাটাতে মাথা হেলিয়ে বসেছে। পরী কপালের কাছে আঙুল দিয়ে চুলকায়। চোখ পিটপিট করে মাথা হেলিয়ে তাকায় ইশার দিকে। ইশা শুধু চোখ মেলে তাকায় পরীর দিকে। যখন দেখল ইশা কোনো কথা বলছে না। তখন ইশার গায়ের উপর উঠে পড়ল বেয়ে বেয়ে। ইশা বলল, কি করছ পরী?
পরী চুপ থাকল। ইশার গায়ের উপর উঠে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে রাখল। তারপর গাল ইশার গালে লাগিয়ে আমমমা আমমমা আমমমা ছন্দ তুলে শব্দ করতে লাগল। ইশার গালে লালা লেপ্টে গেল তার। ইশা চোখ বন্ধ করে রইল। সে টের পেল তার চোখের কোণা ভিজে উঠেছে। পরীকে বলল, ফিপি ব্যাথা পাচ্ছে পরী,নেমে পড়ো।
পরী কথা শুনল না। ইশার ধমক খেয়ে ইশার ঘাড়ে মুখ গুজে রাখল। ইশা উঠাতে চেয়ে ও উঠাতে পারল। শক্ত করে ধরে পেঁচিয়ে রাখল। তারপর কাঁদতে লাগল। ইশার সম্ভিৎ ফিরতেই বুঝতে পারল কাজটা ঠিক হয়নি। পরী এখনো ছোট বাচ্চা। সে ডাকল, পরী ফিপির কথা শোনো। আর কেঁদো না। ফিপি চকলেট দেবে,চিপস দেবে।
পরী মাথা তুলল। ডাগর ডাগর গোলাটে চোখদুটো লাল টকটকে। ইশা ভড়কে গেল। এ মেয়েটার রাগগুলো এমন কেন? নীরবে রাগ দেখায়। কার সাথে যেন মিলে যায়।
পরী ইশার গালে গাল লাগিয়ে শব্দ করল, পাপ্পি,পাপ্পি।
ইশা বুঝতে পারল পরী কি চাই। পুরোমুখে আদর দিয়ে বলল, হয়েছে? পাপ্পি দিয়েছি, এবার ভালো মেয়ের মতো মাম্মার কাছে চলে যাও। পরী নামল না। ইশার বুকে মাথা রেখে চেপে গেল। মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে কোথাও যাবেনা। ইশার কাছেই থাকবে। ইশা আর যেতে বলল না। কিছুক্ষণ পর পরীর ঘুমিয়ে যাওয়ার নির্দেশ হিসেবে নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেল। ইশা হাসল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। দুজনই এভাবে ঘুমিয়ে গেল। রিপ পরীকে নিতে এসেই এই দৃশ্য দেখে অবাক হলো। এটি অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য মনে হলো তার। সে ফোন বের করে কয়েকটা ছবি নিল। তারপর পরীকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল। ইশাকে ও শুইয়ে দিল। ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হাসল। তারপর তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। ওই ঘুমন্ত মোহনীয় মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাধ্যি তার নেই। সে খুন হয়ে যাবে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে ও । কে জানে কোনদিন একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়?
_______________________________
লাল,নীল,হলুদ নানরকম কালারের লাইটিং। পুরো চৌধুরী বাড়িতে মানুষের সমাগম। কালো সাদা মিশেল ড্রেস পরিহিত অনেকগুলো ছেলে হাতে ছোট ছোট ট্রেতে করে সার্ভ করছে নানা ধরণের পানীয়। একেকজনের রুচি একেকরকম। রান্নাঘরে ব্যস্ত রাইনা। ছেলের জন্য নিজ হাতে সে পায়েস রাঁধছে। ছেলের বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। এই তিনটা বছরে অনেককিছু পাল্টেছে। পাল্টেছে চৌধুরী বাড়ির কিছু মানুষের স্বভাব, অভ্যাস, রুচি। দূর হয়েছে তার একাকীত্ব। ছেলেকে পেয়ে। ছেলে রেহান তার নিজের ছেলে নয়। এই ছেলেটাকে দুই বছর থাকাকালীন সে দত্তক নিয়েছে। রেহান এখন চৌধুরী বাড়ির সকলের চোখের মণি। তার জন্মদিন উপলক্ষে নানা রকমের লোকের সমাগম। অথচ বাবা নামক মানুষটিকে সে যখন কোথাও দেখল না তার বড্ড মন খারাপ হলো। নেশাখোর, নারীআসক্ত আফির খেয়াল নেই আজ তার ছেলের জন্মদিন। সে তার আর ছোট ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে মজামাস্তিতে নিমজ্জিত। মাতাল হয়ে ঢুলছে। রাইনার আজকাল আফির কাজকর্ম দেখলে কষ্ট লাগেনা। তার তো একটা ফুটফুটে ছেলে আছে। আর কি লাগে। আফির একটু দয়া,সহমর্মিতা সে এখন আর চায়না। তার পৃথিবী জুড়ে এখন শুধু মুখোরিত হয় রেহান নামটি।
আলিয়া আর আজিজ চৌধুরী নাতির হাতে বড় বড় গিফটবক্স তুলে দিল। রেহান খুশি হলো। একে একে অনেকের গিফট জমা হলো। কিন্তু সেই গিফটগুলোর দিকে ফিরে ও তাকাল না রেহান। বাবা আর চাচ্চু কি তাকে গিফট দেবে না? কোথায় তারা?
জন্মদিনের শুভেচ্ছান্তে চারপাশ মুখোরিত হলো। কেক কাটা হলো। নাচ গান হলো। সবাই যখন উল্লাসে ব্যস্ত তখনই চুপিচুপি চৌধুরী বাড়িতে ডুকে পড়ে একটি ছেলে। গিফট বক্স মুখের সামনে রেখে শুভেচ্ছা জানায় রেহানকে। রেহান চমকে তাকায়। সাথে অনেকে। কোনো একটি টিয়ে পাখির ডাক ভেসে আসে। হেপি বাথডে প্রিন্স। হেপি বাথডে। মিনির ডাক শুনে সবাই হাসে। রেহান দৌড়ে যায়। জাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ছেলেটিকে। অভিমানী কন্ঠে বলে, চাচ্চু আমার গিফট। দেরী কেন?
ছেলেটি গিফট ধরিয়ে দেয় রেহানের হাতে। রেহান চাচ্চুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু দিয়ে বলে, লাভ ইউ চাচ্চু।
ছেলেটি হাসে নিঃশব্দে। বলে, লাভ ইউ টু মাই প্রিন্স ।
মিনি ডানা ঝাপটায়। ডাকে, লাভ ইউ, লাভ ইউ।
ছেলেটি এদিকওদিক তাকায়। রেহানকে বলে, ম্যাডাম কোথায়?
রেহান জিজ্ঞেস করে, আইমি আন্টি?
ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে বলে, ইয়াহ।
রেহান জবাব দেয়, ছাদে যেতে দেখেছিলাম। ছাদেই আছে হয়ত। রেগে আছে?
রেহানের দুষ্টুমি বুঝতে পারে ছেলেটি। মাথায় চাপড় দিয়ে বলে, হুম। ম্যাডাম আজকাল কথায় কথায় রাগ করে বসে থাকে। রাগ ভাঙাতে হবে। বাই মাই প্রিন্স।
রেহান হেসে দেয়। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলে, চাচ্চু আইমি আন্টিকে আমার বৌমা করে কখন আনবে?
ছেলেটি যেতে হাত নেড়ে বলে, ‘ ভেরি সুন।
রেহান বেজায় খুশি হয়। দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যায়। রাইনাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মাম্মা আইমি এবার আমার বৌমা হবেই।
রাইনা কথার ছলে জিজ্ঞেস করে,কে বলেছে?
রেহান গিফটবক্স রাখতে রাখতে জবাব দেয়, চাচ্চু বলেছে এক্ষুনি।
সাথে সাথে রাইনার হাত থেকে খসে পড়ে চামচ। রেহান ভড়কে যায়। বলে,কি হয়েছে মাম্মা ! এনি প্রবলেম?
রাইনা চট করে কথা ঘুরিয়ে ফেলে। চামচ কুড়িয়ে নিয়ে বলে, নো প্রবলেম রেহান। এটা তো খুশির খবর। কখন হবে বলেছে?
রেহান ভেবে বলে, না তা তো বলেনি? আমি জেনে নেব চাচ্চুর কাছ থেকে ওকে?
রাইনা সম্মতি দেয়। রেহান চলে যাওয়ার আগে রাইনা তার হাত টেনে ধরে। কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ পর চেয়ে থেকে বলে, কষ্ট পেয়েছে কি আমার বাচ্চা? ড্যাড গিফট করেনি বলে?
রেহানের মুখে অন্ধকার নেমে আসে। সে তা লুকিয়ে হাসিমুখে বলে, আমি অনেক গিফট পেয়েছি মাম্মা। বরং আমিই গিফট করব ড্যাডকে।
_________________________
ছাদে ও করা হয়েছে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা। ছাদের মৃদুমৃদু বাতাস মেয়েটির মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে। দূরের সুপারিগাছ গুলো ও মৃদুমন্দ দুলছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কাঁঠাল চাপার গন্ধ। রেলিংয়ে দুহাত রেখে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়ানো মেয়েটি কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় না। ছেলেটি ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে নেয়। মেয়েটির পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটিকে ঘিরে রেলিংয়ে হাত রাখে। মেয়েটির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, মন খারাপ?
এত গভীর গরম নিঃশ্বাস মেয়েটির কানের কাছে পড়ায় মেয়েটি কেঁপে উঠে । জবাব দিতে পারেনা। ছেলেটি প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আবার ও জিজ্ঞেস করে, খুব বেশি কষ্ট দিলাম? চলে যাব?
মেয়েটি এবার সাথে সাথে সামনে ফিরে। মুখোমুখি হয় ছেলেটির সাথে। ছেলেটির শার্টের কলার ধরে তার দিকে টেনে ধরে। বলে, চলে যাওয়ার কথা বললে একদম মেরে ফেলব।
ছেলেটি নিঃশব্দে হাসে। বলে, আদি চৌধুরীর কপালটাই খারাপ। শেষমেশ তাহলে রাগী বউ ই জুটবে? কান্না পাচ্ছে ভয়ে।
মেয়েটি ছেলেটির চেহারার প্রতিক্রিয়া দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হাসি আসলে ও হাসেনা। বলে, একদম ইয়ার্কি মারবে না আদি। আমি এখন সেই মুডে নেই।
ছেলেটি হাসে আবার ও। তারপর গম্ভীর, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে মেয়েটির দিকে। মেয়েটি তাকে কিছু বলতে না দেখে বলে, বিয়ে কবে করছি?
ছেলেটি নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে। এক ঠান্ডা বাতাস মৃদুভাবে নাড়িয়ে দিল ছেলেটির চুল। ছেলেটি হাসল। মেয়েটি চোখ রাঙিয়ে তাকাল। বলল, অযথা হাসবে না। আমার রাগ হয়।
ছেলেটি আবার হাসে। বলে, তোমার রাগ দেখলে বিয়ে করার শখ আমার গুটিয়ে যায় ইমি।
মেয়েটি শার্টের কলার আর জোরে টানে। বলে, এগুলো তো খুব সামান্য রাগ। এখনো রাগের র দেখেছেন মাত্র ডক্টর আদি চৌধুরী। বাকিগুলো তো বাকি আছে ।
ছেলেটি হাসে। নিঃশব্দে তাও। হাসতে হাসতে গলার একপাশ উন্মুক্ত হয়। বাদামী রঙের দাগটি দেখে ভড়কে যায় আইমি । ছেড়ে দেয় শার্টের কলার। আচমকা এমনটা করায় আদি অবাক হয়। জানতে চায়, কোনো সমস্যা ইমি?
মেয়েটি চোখ তুলে তাকায় ছেলেটির দিকে। বলে,গলার পাশে দাগটা কিসের আদি? কোথায় আঘাত পেয়েছ?
আদি গলার পাশে হাত দেয়। বলে, ডোন্ট নৌউ। ড্রপ দিস ম্যাটার।
মেয়েটি চিন্তিত হয়ে তাকায়। ছেলেটি তার ফ্যাকাশে মুখখানা দেখে,পকেটে হাত পুরে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে, কে জানে তুমি হয়ত কামড়ে টামড়ে দিয়েছ।
মেয়েটি আকস্মিক এমন কথায় লজ্জা পায়। মাথা নামিয়ে এই প্রথম হাসে। বলে, যাহ,আমি কখন?
ছেলেটি তার নতবদনে হাসির দিকে তাকায়। পরক্ষণে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। কি আশ্চর্য সে মুগ্ধ হতে পারছেনা মেয়েটির হাসিতে। হারিয়ে যেতে পারছেনা। ডুবে যেতে পারছেনা। হঠাৎ তার মনে হলো তার পিঠে মাথা রেখেছে কেউ। বুকের দুপাশে উদয় হলো দুটো হাত। সে তাকাল। ছুঁয়ে বলল, আমি আছি ইমি।
মেয়েটি ও উচ্চারণ করে, আমি ও আছি আদি । থাকব।
_________________________
গভীর রাতে বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাথে ঝি ঝি পোকার আওয়াজ। রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে সেই শব্দ তীব্রভাবে আঘাত হানছে ইশার কানে। আচমকা তার ঘুম ছুটে যায়। সে কান চাপা দেয়। অদ্ভুত আওয়াজ করে উঠে। বিছানা হাতড়ে কাউকে খুঁজে। কি আশ্চর্য, সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছেনা, সে কাকে খুঁজছে। চট করে বিছানা থেকে সে নেমে পড়ে। মাথা চুলকে চুলকে পুরো ঘর হাঁটে। বলে, কি খুঁজছি আমি?
দূরে উল্টে পড়ে থাকা টেডিবিয়ারটিকে সে দেখতে পায়। কাঁপাকাঁপা হাতে সেটি তুলে নেয়। ধুলোবালি ঝেড়ে বলে, খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না? শোন, আমি একা কষ্ট দিইনি কিন্তু। ডক্টরের ও দোষ আছে জানিস? ডক্টর ও দোষী। ডক্টর আমার কাছে ফিরে আসলে কি এতকিছু হতো? আমার সবকিছু আমার কাছে থাকত। কোনোকিছুই আর হারাত না। ডক্টর ও চলে গেল,আর ফিরল না। আমার শেষ সম্বলটুকু ও আমি হারিয়ে ফেললাম। সব ডক্টরের দোষ। সব।
আবোলতাবোল বকে মেয়েটি। বকতে বকতে টেডিবিয়ার বুকে চেপে শুয়ে পড়ে। গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ ভাসে পুরো ঘরটিতে। ঝাপসা ঝাপসা চোখে সে যখন চোখ তুলে তাকায় তার পাশে। সাদা ধবধবে পান্জাবীটার বদলে শুয়ে আছে সেই পান্জাবী পরিহিত একটি ছেলে। মেয়েটির কান্না থেমে যায়। সে নিজেকে একবার দেখে নেয়। ছেলেটিকে না ছুঁয়ে ডাকে, ডক্টর। ছেলেটি তার দিকে ফিরেনা। সে আবার ডাকে,এই ডক্টর?
ছেলেটি তারপর ও ফিরে না। তার কান্না পায়। গলা ধরে আসে। তারপর ও ডুকরে উঠে ডাকে, এই ডক্টর কথা বলুন না!
সাথে সাথে ছেলেটি তার দিকে ফিরে তাকায়। চোখদুটো ঘন লাল। চোয়াল শক্ত। শান্ত কন্ঠে অসহায় হয় ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে বলে, ‘ আই হেইট ইউ মিষ্টি। রিয়েলি হেইট ইউ। তুমি আমার সাথে নয় তোমার আমার অস্তিত্বের সাথে ও অন্যায় করেছ। তুমি অপরাধী মিষ্টি। আমি ক্ষমা করব না তোমায় কখনো। কখনো না মিষ্টি।
ইশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। এলোমেলো ভাবে উঠে বসে। পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে ডাকে, ডক্টর আপনি কোথায় চলে গেলেন। আপনি আমাকে আবার ভুল বুঝলেন ডক্টর। আমার হাতে কোনোকিছু ছিল না ডক্টর। আমি অসহায় ছিলাম তখন। খুব অসহায়। আপনি না বুঝলে কে বুঝবে আমায়। কোথায় আপনি?
বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শুনে মেয়েটির সম্ভিৎ ফিরে। সে নিজেকে আর ও একবার দেখে নেয়। চোখের পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলে, আমি কাঁদছিলাম কেন? কে এসেছিল?
________________________
ওপাশের মেয়েটিকে রাগিয়ে দিয়ে ছেলেটি ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুতি নেয়। ফোনের ওপাশের মেয়েটিকে রাগাতে তার বেশ ভালো লাগে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে সে বের হয়ে আসে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এসে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় গলার পাশে হালকা বাদামী রঙের দাগটিতে। কিছুবছর আগে ও তো এই দাগটি ছিল না। হুট করে কোথা থেকে ভূমিষ্ঠ হলো। স্পট রিমুভার বের করে সে লাগিয়ে দেয়। তার মনে হলো সেই জায়গায় জ্বলছে। সেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সেই দাগ দেখে আওড়ায়,জ্বলুক।
বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ স্থির হয় একটি পুতুলের সামনে। এই পুতুলটি সে ইন্ডিয়া থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিল। পুতুলটি একটি মেয়ের অবয়ব। শাড়ি পেঁচানো। তাকে পুতুলটি কে দিল মনে পড়ছে না। বাবা বলেছিল, সে নিজেই পছন্দ করে নিয়েছিল এ পুতুলটি। এমন একটি উদ্ভট পুতুল সে কেন কিনবে?মা, বাবা ফেলে দিতে বলেছিল, কিন্তু সে ফেলে দেয়নি। অন্য যাইহোক, পুতুলটি বেশ কিউট। তার পছন্দ হয়েছে। তাই সে ফেলে দেয়নি। সাজিয়ে রেখেছে নিজের বিছানায়। কি আশ্চর্য বিছানায় কোলবালিশ না রাখা ছেলেটির বিছানার অর্ধকে জুড়ে রয়েছে সেই পুতুলটি । সে নিজের কাজে মাঝেমাঝে নিজেই অবাক হয়।
পুতুলটিকে সে যখন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তখন দেখতে পায়। তার পড়নে লাল টকটকে শাড়ি, মাথার চুলগুলো যেন লেপ্টে আছে কাধঁ, গলা,কপাল,মুখের আশেপাশে। চুলগুলো কোমর অব্ধি লম্বা। ঠোঁটদুটো রাঙানো। চোখে মোটা কাজল। ছেলেটি হাসল। বলল, ডল লুকস লাইক এ ইমি।
_______________________
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বিরতিহীন পড়ছে বৃষ্টির ফোটা। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে ইশার। ক্লাস শেষে বাসায় ফিরবে কিভাবে? ছাতা ও আনেনি সে? বিরক্তি বাড়ছে তরতর করে। আশ্চর্য জনক ভাবে তার রাগ লাগছে প্রকৃতির উপর। বৃষ্টি নামার আর সময় পেল না। কয়েক বছর আগে ও বৃষ্টিবিলাস করার ইচ্ছে থাকলে ও এখন তার ইচ্ছে হয় না। মাথায় আসেনা। এমন একটা বৃষ্টির দিনে সে ভিজতে চেয়েছিল ডক্টরের সাথে। ডক্টরের চোখে চোখ রেখে সে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল দূর দূরান্তে। ডক্টর তার চোখে চোখ রেখে বলবে, এই বৃষ্টিবিলাসের দিনটি আদি মিষ্টির হয়ে যাক। আমাদের দুজনের হয়ে যাক। আজ বৃষ্টিটা মন কেমন করা,তাই না মিষ্টি?
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। ঝুম বৃষ্টিতে সে বেরিয়ে পড়ে। আধ-ভেজা হয়ে যায়। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার পাশে। রিকশা আসে বহুক্ষণ পর। রিকশায় উঠে পড়ে সে। আধ-ভেজা হয়ে রিকশায় বসে সে অস্বস্তি ভোগ করে। রিকশা ছেড়ে দিতেই তার কানে বেজে উঠে, মিহি সুরের একটি ডাক,মিষ্টি, মিষ্টি।
সে থমকে যায়। শক্ত হয়ে বসে থাকে। নড়ে না চড়ে না। তার ভেজা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। সে অস্ফুটভাবে ডাকে, মিনি? ডক্টর?
ভেজা চুপচপে হয়ে গেছে ছেলেটি, হাতের খাঁচায় টিয়ে পাখিটি ও। সে ডানা ঝাপটে ঝাপটে শুধু ডেকে উঠল, মিষ্টি, মিষ্টি। ছেলেটি আশপাশ তাকাল। বলল,মিনি স্টপ। বেশি চিৎকার করলে ফেলে চলে যাব।
মিনি তারপর ও চেঁচিয়ে গেল,মিষ্টি, মিষ্টি ।
ছেলেটি হাতের খাঁচাটি গাড়ির ভেতর রাখল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে টিয়ে পাখিটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, মিনি তুমি আমার কাছে কিভাবে এসেছ বলোতো? কে গিফট করেছে তোমাকে? তুমি একটা অসহ্য।
মিনি ডানা ঝাপটে ডাকে, ‘ মিষ্টি। মিষ্টি ।
ছেলেটি রেগে গাড়ি স্টার্ট দেয়। জোরে ড্রাইভিং করে।
মেয়েটি দৌড়াতে থাকে রিকশা থেকে নেমে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তার খেয়াল হয় মিষ্টি ডাকটি থেমে গিয়েছে। চলে যাওয়া গাড়িটির পিছু পিছু সে আশপাশ না দেখে দৌড়াতে থাকে। বৃষ্টিজলে ভিজে একাকার হয়ে যায়। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তার বুকে ব্যাথা শুরু হয়। তারপর ও সে দৌড়ায়। মাঝরাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে। গাড়িটা এগিয়ে যায়। গাড়ির লুকিং গ্লাসে ছেলেটির চোখ আটকে যায়। মাথা নিচু করে সাদা ওড়না পড়া মেয়েটি মাঝরাস্তায় বসে আছে কেন? চেহারাটা তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কে মেয়েটি?
মাঝরাস্তায় পিঠ ধরে বসে পড়ল ইশা। গাড়ি তার সাইড দিয়ে চলে যাচ্ছে। আশপাশের মানুষ তাকিয়ে রইল তার দিকে। পিঠের হাড়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব হয়। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কথা বলতে কষ্ট হয়। বৃষ্টিজলে তার শ্বাস আটকে আসে। ডুকরে ডুকরে সে কেঁদে উঠে। লোকজন ছুটে আসে। অদ্ভুতভাবে কান্নারত মেয়েটির ব্যাগ পড়ে রয়েছে,জুতোজোড়া পড়ে রয়েছে। সবার প্রশ্ন, মেয়েটি কেন এভাবে কাঁদছে?
আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে ইশার চোখের নিশ্চুপ জল ছেড়ে দেয়। ধোঁয়াশা হয়ে যাওয়া গাড়িটির পানে চেয়ে থাকে। বলে, আপনি এসেছেন ডক্টর। কিন্তু আমার কাছে আসেন নি। কেন ডক্টর। কিসের এত রাগ, অভিমান ডক্টর?
মেরুদণ্ডের ব্যাথা দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণত্বর হয়। সে বসে থাকতে পারেনা। কথা বলতে পারেনা। লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। অজ্ঞান হতে হতে ডুকরে ডুকরে উচ্চারণ করে,
‘ কেন এলেন না ডক্টর? আপনি কি আমায় আর ভালোবাসেন না ডক্টর। অন্য কাউকে ভালোবাসেন ? শাস্তিটা যে এবার খুব বড় হয়ে গেল ডক্টর? এত বড় শাস্তি কেন দিলেন আমায়? আপনার মিষ্টি এত বড় শাস্তি যে নিতে পারবেনা ডক্টর। মিষ্টির কথা কেন ভাবলেন না আপনি?
মিনমিন করে বলতে বলতে সে জ্ঞান হারায়। লোকজন জড়ো হয়। মেয়েটির মায়াবী মুখপানে চেয়ে থাকে সবাই। কে বলবে, এ মেয়েটি এক পৃথিবী সমান কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে। হাসিখুশি আছে। কে বলবে, এক পৃথিবী সমান যন্ত্রণা তাকে প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে । কে বলবে, মেয়েটি এক আকাশ ব্যাথা নিয়ে দিনতিপাত করছে। ডক্টর নামক যন্ত্রণাটি কি কখনো তার পিছু ছাড়বে না। ডক্টর ছাড়লে ও মেয়েটি তো নিজেই ছাড়ছেনা। দোষটা ঠিক কার? দোষী কে?
চলবে,
( আপনাদের অনুভূতি জানাবেন)