উল্টো রথে-১৪,১৫,১৬

0
201

উল্টো রথে-১৪,১৫,১৬

১৪

ইরিন সকাল থেকেই ব্যস্ত। একটু দাঁড়াতে পারছে না। বাবুকে রেডি করছে, খাবার বক্সে ভরছে, আরো কত জিনিসপত্র নিতে হয় একটা রাত বাইরে থাকতে। ইরিনের মা আর বোন তাম্মিমও সাথে যাচ্ছে, তবে তারা ইরিনকে খুব একটা সাহায্য করতে পারছে না। ডিকেন সকালে উঠে গরম পানি চেয়েছে, সেটা ইরিন করে দিয়েছে।

চেক শার্টটা ছিল আলমারিতেই, ডিকেন আবার ইরিনকে ডেকে বলল বের করে দিতে। ইরিন বের করে দিলো
একটা ড্রয়ারে সব আন্ডারওয়্যারগুলো থাকে, ডিকেন আবার ইরিনকে ডেকে বলল, কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। ইরিন আবার বিরক্ত না হয়ে বের করে দিলো। টাওয়েল বারান্দায়, ডিকেন সেটাও না এনে ইরিনকে দিতে বলল। ইরিন ব্যস্ততায় বিরক্ত হওয়ার সময় পাচ্ছে না।

টাওয়েল হাতে নেওয়ার পরে ডিকেনের বিরক্ত লাগল, কেন বিরক্ত লাগল সে বুঝতে পারছে না। এত কাজ করার কি আছে, বাচ্চার খাবার টা নিবে, সেরেলাক দুধ এসবই তো। শাওয়ার নিয়ে নিজে তৈরি হয়ে ড্রয়িংরুমে বসল।
ইরিন এখনো ড্রেস পরে নি।

ইরিন, তুমি এখনো তৈরি হতে পারো নি!

এই জামাটা পরেই যাব-ইরিন বলল।

একটা ঢোলাঢালা জামা মনে হচ্ছে আলমারিতে দলা মোচা করে রাখা ছিল, রঙটা ক্যাটক্যাটে গোলাপি।

এটা পরে যাবে?-ডিকেন জিজ্ঞেস করল।

হ্যা।

ডিকেন কিছু না বলে মোবাইল স্ক্রল করতে লাগল। আচ্ছা ইরিন কেন এই ড্রেস পরে যাচ্ছে! গত মাসেই তো দুটো সালোয়ার কামিজ কিনলো।

ইরিন, তুমি এই জামাটা কেন পরছ, নতুন জামা কোথায়?
-ইরিনকে জিজ্ঞেস করল ডিকেন।

বাবুকে ফিড করাতে সুবিধা হয়। তাই পরেছি। -ইরিন দেরী না করে উত্তর দিলো।

বাবুকে গাড়িতে কেন ব্রেস্ট ফিড করাতে হবে। ও তো এখন বাইরের খাবার খাচ্ছে। ফর্মূলা রেডি করে নাও।

ইরিনের মনে হলো, ঠিকই তো! এটা তো মাথায় আসে নি, মাও তো কিছু বলল না।

দুধটা রেডি করাই ছিল। ডিকেন উঠে ইরিনের রুমে গেল। ইরিনের মা আর তাম্মিম রুমে বসা। আচ্ছা, এরা এসে থাকে কেন, সকাল থেকে মেয়েটা একটা খাটতেছে, বোনটা দেখো মুখে এক পাল্লা মেকাপ দিয়ে রেডি। শাশুড়িও গুছিয়ে বসেছে। শুধু ইরিনের দিকে কারো খেয়াল নেই।

ডিকেন বলল, তাম্মিম, ব্যাগগুলো সামনে নাও তো।
ইরিনের মাও বেবিকে নিয়ে বের হলেন।

ডিকেন আলমারি খুলে একটা নেভীব্লু জামা বের করে ইরিনকে ডাকল, ইরিন!

ইরিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। আবার কী হলো!

ইরিন, এই জামাটা পরো।

এটায় তো বুকে কাজ আছে। বাবুকে ধরব কিভাবে!

তোমার মা আর বোন কি করতে যাচ্ছে! তারা বাবুকে ধরতে পারবে না? না পারলে আমাকে দিও, আমি ধরব।

ইরিন বুঝল, ডিকেনের মাথা গরম হচ্ছে।

আস্তে বলো, আচ্ছা, চেইঞ্জ করে আসছি।

ডিকেন রুম থেকে বের হয়ে গেল না। ইরিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ডিকেন ড্রেসিংটেবিলের সামনে নীল পাথরের কানের দুলটা বের করেছে। কেন যেন ইরিনের মনটা ভালো হয়ে গেল।
নিজেই পরে নিলো।
ইরিনের বিস্ময় যেন কাটছে না।
ডিকেন পাঞ্চ করা চুলটা ছেড়ে আঁচড়ে দিলো।

এখন ঠিক আছে, চলো।

ডিকেন হঠাৎ ভাবল, এই ট্যুরে সে ইরিনকে বলবে, সে আর ইরিনের সাথে থাকতে চায় না। তাহলে এইসব কেন করল! কেউ তো জোর করে নি! নিজে থেকেই করে ফেলেছে।
সামনে বসে থাকলেই চলত!

ডিকেনের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল।

চলবে

শানজানা আলম

উল্টোরথে-১৫

রেন্ট এ কার থেকে গাড়ি আসতে দেরি করেছে। ডিকেনের অস্থির লাগছিল। ড্রাইভারকে ফোনে পাচ্ছিল না। প্রায় মিনিট বিশেক পরে ড্রাইভার ফোন রিসিভ করে বলল, কাছাকাছি আছে।

পেছনের সিটে শাশুড়ী আর শ্যালিকাকে বসতে বলল ডিকেন।

ইরিন বলল, মাঝের সিটটা তো ফাঁকা থাকবে আমি একা বসলে।

ডিকেন বিরক্ত হয়ে বলল, আমি বসব।

ইরিন অবাক হয়ে গেল, এরকম কখনো হয় নি। ডিকেন সব সময় সামনেই বসে।

সিটে বসে ডিকেন বলল, আরাম করে বসো। বাবুকে আমার কোলে দাও।

বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে না। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। এতদিন ইরিনের মনে হয়েছে, ডিকেন কেমন বাবা হলো, একটা দিনও বাচ্চাটাকে নিজে কোলে নিতে চায় নি।
আজ নিজে থেকেই কোলে নিলো!

বাচ্চাটা কোলে নিয়ে ডিকেনের অসহায় লাগতে শুরু করল। এই বাচ্চাটা তার, নিজের অংশ। ইরিনকে ছাড়লে এই বাচ্চাও চলে যাবে। ইরিন হয়তো আবার বিয়ে করবে। তিথি কী অন্যের বাচ্চা আপন করে নিবে, কখনোই না। বাচ্চা মানুষ হবে নানীর কাছে বা মামার কাছে। নিজের বাবা মা থাকা সত্ত্বেও বাচ্চাটা এতিমের মত থাকবে!

কখনোই না! – ডিকেন একা একা বলে উঠল।

কি হলো? – ইরিন জানতে চাইলো।

কিছু না।

আমার কাছে বাবুকে দাও।

না থাকুক আমার কোলে।

এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিলো ডিকেন। বাচ্চাটা হাসছে, প্রায় সাত মাস হয়েছে, কখনো এভাবে এতক্ষণ বাচ্চাটা ধরা হয় নি। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ।

বাতাস চোখে লাগতে আর গাড়ির চলতে শুরু করতেই ঘুমিয়ে পড়ল ডিকেনের কোলে।

ইরিনের বিস্ময় কাটছেই না। তাহলে মায়ের কথাই ঠিক। ধৈর্য্য ধরলে স্বামীর মন ফেরে!

নাকি গতমাসেই সবেদা খালা যে চিনি পরার পায়েস দিলো, সেটা কাজ করছে!

কিন্তু ডিকেন কি খেয়েছিল! সেটাই তো মনে নেই!

ইরিন সাহস করে ডিকেনের হাতটা ধরল। ভাবল ডিকেন এখনি সরিয়ে দেবে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, ডিকেন সরিয়ে দিলো না।

চলবে

শানজানা আলম

উল্টোরথে-১৬

ইশিতা ভাবীর দুই বাচ্চাকে তিথি যত্ন করেই রাখল। বাসায় ফিরে দুই বাচ্চাকে শান্ত দেখে ইশিতার মন ভালো হয়ে গেল।

তিথি, তোমাকে ধন্যবাদ দিলে কম করা হবে বোন, বাচ্চা দুটোকে অনেক যত্ন করে রেখেছ- কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে ইশিতা ভোলে না।

আর তিথির শাশুড়ীও বিষয়টা খুব ভালো ভাবে নিলেন। থাকতেই পারে একটা মেয়ের কিছু অতীত। অতীত নিয়ে বসে থাকলে তো চলে না। বর্তমানে সে কেমন, সেটাই বড় বিষয়। পারভেজ ভালো আছে, পারভেজের কথা তিথি শুনে চলতেছে, এটাই অনেক। মেয়েটা সংসারী হওয়ারও চেষ্টা করছে।

ছোটো বৌমা, তোমাদের ওই বাসার সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয় নি একদিনও। একদিন ডাকো সবাইকে?

-পারভেজের মা বললেন।

তিথি অন্যমনস্ক হয়েছিল।

জি আচ্ছা, বলব।

সব কিছু করে তিথি, কিন্তু মনটা একটুও স্থির হয় না। পারভেজকে তার ভালো লাগে না। এই সংসারেও মন বসে না। কেবলি মনে হয় ভুল করেছে। ভুল তো আগেও করেছে, কি ই বা করার আছে! ডিকেন তো স্বীকার করল, সে পরিস্থিতির চাপে পড়ে গিয়েছিল। সিন ক্রিয়েট না করে তিথির ভালো ভাবে জানা দরকার ছিল! ডিকেনের চাইতে ওর বন্ধুকে বেশি বিশ্বাস করে গুরুত্ব দিলো!
মানুষ এই ভুলটা খুব করে, অন্যের কথায় গুরুত্ব দিয়ে নিজের কাছের মানুষটাকে ভুল বোঝে!

ডিকেন কেমন উত্তাল ছিল, সমুদ্রের মত! পারভেজ এমন হয় না! হলেও হয়তো তিথির মন ভরবে না।

পারভেজের প্রশ্নে হু হা করে উত্তর সারে তিথি।

তিথি, শপিং করবে?

না। কেন?

এমনিই, চলো তোমাকে কিছু থ্রিপিস কিনে দিই।

লাগবে না। তোমার ধারণা জামা কাপড় কিনে দিলেই মেয়েরা খুশি হয়?

না, সেরকম কিছু বলি নি।

তাহলে?

মনে হলো তাই বললাম আর কি! বাইরে কোথাও যাবে?

না।

তিথি বিষন্ন হয়ে থেকো না।

তিথি বলল, বিষণ্ন হয়ে থাকব কেন। আমি এরকমই!

না তুমি এরকম না৷

পারভেজ, একটা কথা বলি। আমি ভীষণ বাজে পরিস্থিতি পার করেছি জীবনে। হয়তো স্বার্থপরের মতো তোমাকে বিয়ে করেও নিয়েছি নিজের ভালোর জন্য। কিন্তু এই জীবনটা আমার নয়। এখানে মানিয়ে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছে।

তাহলে তুমি কি চেয়েছিলে?

জানি না!

তিথি নিজের অস্বস্তি দ্বিধা কাউকে বোঝাতে পারে না।

পারভেজ অন্যরুমে চলে গেল। তিথি ফোনটা হাতে নিয়ে ডিকেন কে কল করে ফেলল।

ডিকেন তখন ইরিন আর বাচ্চাকে নিয়ে রিসোর্টের মধ্যে হাঁটছে। তিথির ফোনটা দেখে অস্বস্তি লাগলেও সে কলটা কেটে দিলো!

তিথির কান্না পেলো খুব। ডিকেন এর সাথে আবার যোগাযোগ করাটা খুব একটা ভালো হয় নি! ওর একটা সংসার, বাচ্চা আছে। তাদের সরিয়ে কি তিথি ভালো থাকবে!
আচ্ছা মরে গেলে কী কষ্ট কমে! তাহলে তিথি মরে যেতে পারে না!

চলবে

শানজানা আলম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here