উল্টোরথে-১৯,২০ অন্তিম পর্ব
১৯
রাতে খেতে বসেছে ডিকেন। ইরিন সামনে আসে নি।সামনে আসেও না একেবারে। ইরিনের বোন খাবার এগিয়ে দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে।
ডিকেন প্লেটে ভাত নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ।
ইরিন কোথায়? -ডিকেন জিজ্ঞেস করল।
আপু রুমে আছে।
বাবু কোথায়? বাবু আম্মার কাছে।
ইরিন রুমে একা?
হ্যা ভাইয়া। আপনাকে মাছ দেই।
না দরকার নাই। ইরিন খেয়েছে?
আর বলবেন না। তিন চারদিন ধরে তো ভাত খেতে পারছে না।
ডিকেন উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে রুমে ঢুকল। ঢুকে ইরিনের রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।
ইরিন বসে ছিল। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
ইরিন, কী শুরু করেছ? চলো খাবে আমার সাথে।
ইরিন উত্তর দিলো না।
ইরিন, প্লিজ, এরকম চুপ করে থেকো না।
ইরিন শান্ত স্বরে বলল, আমার কি তাহলে খুব খুশি হয়ে খাওয়া দাওয়া করা উচিৎ? আমার জায়ায় তুমি হলে তাই করতে?
ডিকেন বলল, আমার কথা শুনো, আমাকে একটু সময় দাও, আমি সব…
ইরিন বিদ্রুপ করে বলল, সব ঠিক করে ফেলবে?
তাই তো!
ডিকেন বলল, ইরিন, আমি একটা প্যাচে পড়ে গেছি। প্লিজ তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।
আমি তো তোমাকে কোনো প্যাচে ফেলে দিই নাই।
আমি চলে যাব। কয়েকটা দিন সময় চাই, আমার তো মা বাপ আছে, তাদের বুঝতে হবে।
আমি তোমাকে যেতে দিব না- ডিকেন বলল।
কিন্তু আমি তো থাকব না-ইরিন বলল।
যেখানে সবটা দিয়েও এক টুকরো কিছু প্রতিদানে পাওয়া যায় না বরং অপমান আর লাঞ্চনা প্রতিদিন, আমি কিছুতেই সেখানে থাকব না। ডিকেন ইরিনের কাছে গিয়ে ইরিনকে জড়িয়ে ধরল।
প্লিজ, এইভাবে বলো না। তোমাকে আমি সব কিছু খুলে বলব, তুমি বুঝতে পারবে আমি জানি৷
ইরিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, কিন্তু পারল না। ডিকেন শক্ত করে ওকে ধরে আছে।
ইরিন বলল, আমি আর এই সংসার করতে চাই না। এতদিন আসলে আমি থাকতামও না। আমার মা বারবার বলতেন, ভালোবাসলে সবার মন ফেরে। আমি ভালোবাসতেই পারি নাই। নাহলে আমার স্বামীর মনে অন্য একটা মেয়ে! তার সাথে কিনা….. ছি ছি, আমি ভাবতেও পারছি না। আগে তুমি আমার গায়ে হাত দিলে আমার মনটা খুশি হয়ে যেত। এখন আমার ঘেন্না লাগতেছে।
ডিকেন ইরিনকে ছেড়ে দিলো।
আমাকো এত নিকৃষ্ট মনে করো তুমি! আমি ধরলে তোমার ঘেন্না লাগতেছে! এত বড় কথা তুমি আমাকে বলতে পারলে!
এর চাইতে অনেক বড় অপমানজনক কথা তুমি আমাকে বলেছ। যে কয়টা দিন আছি তুমি আমার এই ঘরে ঢুকবে না। আমি কোনো ঝামেলা করব না। চুপচাপ চলে যাব, তুমি চুপচাপ ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে।
এখন এই ঘর থেকে যাও!
ডিকেন কিছুক্ষণ ইরিনের দিকে তাকিয়ে রইল। এই সেই ইরিন, যে সারাক্ষণ ওর পিছনে ঘুরঘুর করত! ও একটু কাছে ডাকলে খুশিতে চোখ মুখ ঝলমল করত! ডিকেন মেলাতে পারছে না।
আমি এই রুম থেকে চলে যেতে বলেছি। তুমি না গেলে আমিই যাচ্ছি।
ডিকেন বের হয়ে গেল। খাবার প্লেটে মাছি পড়েছে, বলদ মেয়ে ঢেকে রাখে নি৷ ইচ্ছে করছে ছুড়ে ফেলে দিতে কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না।
ডিকেনের ফোন বাজছে, তিথি ফোন করছে, ডিকেন ফোন কেটে দিলো। অসহ্য লাগতেছে, এত সারাদিন ফোন করার কি আছে! একবার তো বলেছে, ব্যবস্থা হলে জানাবে!
ডিকেন ভাবল, তিথির প্রতি সেই ভালোবাসা বা টান এখন সেটা কোথায় গেল! এখন তিথিকে এত অসহ্য লাগছে কেন!
★★★
তিথি বাবার বাসায় আছে। এখন ওর সাথে সবাই আগের মত ভালো ভাবেই কথা বলছে। তাই থাকতে সমস্যা হচ্ছে না। তিথি ভাবছে, সবাই তিনমাস যে খারাপ আচরন করেছে, সেটা রাতারাতি ঠিক হওয়ার কারন হচ্ছে পারভেজের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে বা পরোক্ষভাবে পারভেজ। তিথি আবার চলে এলে বা ডিকেনকে বিয়ে করলে তখন কি হবে?
তিথি বসে বসে কিছু চাকরির জন্য এপ্লাই করে ফেলেছে। টাকার জন্য কারো কাছে হাত পাতা খুবই অসম্মানের। তিথি নিজে একটা কিছু করতে পারলে বেশি ভালো হবে। তাছাড়া ডিকেনের সাথে থাকলেও তো খরচ থাকবে! ডিকেন কি নিজের সংসারে টাকা না দিয়ে পারবে! তার চাইতে ভালো তিথির নিজের কিছু হোক!
এতদিন তিথি ভেবেছে কারো সংসার ভাঙবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এরকম তো কত হয়, হয় না! সবার জীবন তো সোজা সরল হয় না! ডিকেন ওর সাথে থাকলেই হলো।
তবে ডিকেনকে তিথি বুঝতে পারছে না। আজকাল একদমই কথা বলতে চায় না। চারবার ফোন করলে তিনবারই কেটে দিচ্ছে। তাহলে তিথি কাকে বিয়ে করার কথা ভাবছে!
এত চিন্তার মাঝে কখনো পারভেজের কথা তিথির মনে হয় না! অদ্ভুত!
চলবে
শানজানা আলম
উল্টোরথে
অন্তিম পর্ব
ডিকেন অনেকক্ষণ বসে আছে ইরিনের ঘরে। ইরিনকে সামনে বসিয়ে রেখেছে। ইরিন বসে থাকতেও চাইছে না৷
ইরিন চলে যাবে, ডিকেনের সাথে কিছুতেই থাকবে না৷
ইরিন, আমার ভুল হইছে, বললাম তো৷।
ইরিন কোনো উত্তর দিচ্ছে না৷
ইরিন প্লিজ। আমি এক্ষনি তোমার সামনে তিথিকে ফোন করে বলে দিব, আমার জীবনে আর কারো কোনো প্রয়োজন নেই।
ইরিন একটু তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল, বলে দিলে। আমার সামনে বলে দিলে কী হবে! আমি কি সারাক্ষণ তোমার পেছন পেছন পাহারা দিয়ে রাখব! আমাকে বিয়ে করার পরে তো এই মেয়েটার সাথে সম্পর্ক রেখেছ। রাতে আমার সাথে থেকে সকালে এই মেয়েটাকে চুমু খেয়েছ! এমন কি ওকে বিয়েও করে নিতে, যদি কক্সবাজারে ওই মেয়ে রাজী হতো! গা ঘিনঘিন করে আমার, আমি থাকতে পারব না এসব মনে রেখে! তোমার ঘর আমি সামলাব, তুমি ফুর্তি করে বেড়াবে! ওকে, ফাইন, আমি তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি তো, যা খুশি করো এখন। আমাকে এখন আর কিছুই তুমি বোঝাতে পারবে না৷ তোমার মনটাকে তো আমি বেঁধে রাখতে পারব না!
ডিকেন বলল, তোমার কসম, আমার বাচ্চার কসম, আমি কারো সাথে কোনো যোগাযোগ রাখব না।
ইরিন বলল, মিথ্যেবাদীরা খুব সহজে কসম কাটতে পারে।
ঠিক আছে, তাহলে আমার আম্মা আব্বার সাথে তোমার আব্বা আম্মা বসুক, একটা সিদ্ধান্ত তারা দিক।
না, তাদের সিদ্ধান্ত মানে আমাকে থাকতে হবে, আমি তো থাকব না! কিছুতেই থাকব না।
ডিকেন বলল, তুমি আমাকেও চেনো না ইরিন। আমি তোমাকে এই ঘর থেকেই বের হতে দিব না!
ইরিন বলল, কিন্তু কতদিন! ছাড়তে তো তোমাকে হবেই!
ডিকেন আর কথা বাড়ালো না। রুমের বাইরে নিজের ঘরে গিয়ে তিথিকে ফোন করল। তিথি আকাশ পাতাল ভাবছিল তখন।
তিথি, একটু কথা ছিল, জরুরি।
তিথি ভাবল হয়তো বিয়ের কথা বা ডিভোর্সের কথা কিছু বলবে ডিকেন।
হ্যা বলো, আজ দেখা করতে পারবে?
না। দেখা করতে পারব না তিথি। আজ নয় শুধু, আর কোনোদিনই আমাদের দেখা হবে না।
তিথি বুঝতে পারল না ডিকেন কি বলছে!
আমি বুঝতে পারছি না ডিকেন।
আমি বলছি, আমার একটা বাচ্চা আছে। বউ আছে। আমি ইরিনকে কিছুতেই ছাড়তে পারব না। ইরিন চলে যেতে রাজী হলেও ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারছি না। দম বন্ধ লাগে আমার!
তিথি বলল, এসব কথা আগে মনে ছিল না? মনে হয় নি কখনো?
না মনে হয় নি। এখন মনে হচ্ছে যখন ইরিন চলে যেতে চাইছে, ওকে যেতে দিতে পারছি না।
তাহলে আমার সাথে নাটক করলে কেন?
সরি বললে সব শেষ হয় না তিথি। সরি বলব না। তুমি তোমার সংসারে বাঁচতে চেয়েছিলে, সেখানে নিজের মত করে নতুন ভাবে শুরু করো। আমি রাখছি। আমার নম্বরে আর কখনো চেষ্টা করো না!
তিথির উত্তর না শুনেই ডিকেন ফোনটা কেটে দিলো। অপরাধ বোধ চেপে ধরেছে। জীবন মাঝে মাঝে খুব বেশি জটিল হয়ে যায়।
বাইরে দাঁড়িয়ে ডিকেনের কথাগুলো ইরিন শুনেছে। আড়িপাতে নি কখনো, আজ ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
ইরিন দরজা নক করল, আসব?
হ্যা আসো, আমার ঘরে আসতে তোমার নক করতে হয়।
হ্যা হয়। তুমিই বলেছ।
এতদিন যা বলেছি ভুল বলেছি ইরিন! আমাকে একটা সুযোগ দাও প্লিজ! একটাবার! তারপর তোমার যদি মনে হয় আমি ভালো না, আমার সাথে থাকবে না, চলে যেও!
ইরিন একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে।
ডিকেন ইরিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ইরিনের চোখে পানি এলে ইরিন কাঁদল না। সে কাঁদবে না৷ কান্না তাকে ভাসিয়ে নেয় শুধু! তাকে শক্ত হতে হবে। অনেকটা শক্ত। যেন কেউ তাকে কখনো ভাঙতে না পারে!
★★★
ডিকেনের সাথে কথা বলার পরে তিথির কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। ইরিনকে তো ডিকেন ভালোবাসত না, তাহলে কি এমন হলো, যে ইরিনকে ডিকেন ভালোবাসতে শুরু করল! কি এমন জাদু আছে, যেটা তিথি জানে না! তিথির দোষটা কোথায়! তিথি কিভাবে বাঁচবে!
পারভেজের সাথে মিথ্যে ভালোবাসার কথা বলে নিজেকে প্রতারণা করবে প্রতিদিন, শুধু সামাজিক ভাবে ভালো থাকার জন্য!
এটা খুবই কষ্টের কাজ, মনের বিপরীতে অভিনয় করে যাওয়া! সেটা আর সম্ভব নয়। পারভেজকে আর ঠকানো উচিৎ হবে না। জীবনে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। সবই মায়া, প্রতারণা, সাময়িক মোহ! এই মোহ থেকে নির্মোহ হতে হবে তিথিকে। জীবন এত বার বার তাকে ধাক্কা দিয়েছে, ভেঙে দিয়েছে!
তিথি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল, আর সে ভাঙবে না।
তিথির চোখে কান্না আটকে আছে, তিথি আর কাঁদবে না।
এবারে সে একা বাঁচতে শিখবে! কারো উপর ভর করে নয়।
শেষ
শানজানা আলম