#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১৪,১৫
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
১৪
“ভাবছি তোর মেজআপার ডিভোর্সটা করিয়ে নেবো এবার।” বাবার এমন কথা শুনে তার জন্য আনা চাসহ চায়ের কাপটা হাত থেকে পড়ে গেলো। সামান্য মনকষাকষিতে কারো ডিভোর্স কেন হবে! তাছাড়া আপা প্রেগন্যান্ট এটাও তো বুঝতে হব সবাইকে। তখনই মনে পড়লো আপা প্রেগন্যান্ট এটা তো দুলাভাই,আপা আর আমি ছাড়া কেও জানেনা।
আমার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গরম চা আমার পায়ে ছিটকে পড়লো তবুও যেন আমার হুশ নেই। বাবার কথায় আমি যথেষ্ট শক হয়েছি। বাবা চেচিয়ে মাকে ঠান্ডা পানি আনতে বলল। মা পানি আনতেই আমার পায়ে ঢেলে দিতে বলল। ততক্ষণে পায়ে ছোটো ছোটো দুই-তিনটা ফোসকা পড়ে গেছে। মা ব্যাস্ত কণ্ঠে বলল, “আমারই ভুল তোকে চা দিয়ে তোর বাবার ঘরে পাঠানো। আমার বোঝা উচিৎ ছিলো তুই এখনও বাচ্চাই আছিস। এভাবে কেও নিজের ক্ষতি করে? আমি এখন সায়নকে কিভাবে বলবো এই কথা। তোর শ্বশুরবাড়ির লোককে কি জবাব দেব?
আমি বিরক্ত হয়ে বলি, ” এতোটাও কিছু হয়নি যে তোমার জবাব দেওয়া না দেওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। ফোসকার পানি গেলে দেবো সুই দিয়ে তাহলেই তো হয়ে যাবে। যাও এখন রান্না করোগে সকালের। আমার ক্ষুধা লেগেছে।”
মা একটা গামলায় পানি এনে আমার পা ডুবিয়ে রাখতে বলে চলে গেলো। আপাতত বেশ কিছুক্ষণ বাবার সাথে মেজ আপাকে নিয়ে কথা বলা যাবে। বাবার খাটে বসে ফ্লোরে রাখা পানিভর্তি গামলায় পা ডুবিয়ে রেখে বাবাকে বললাম, “বাবা তুমি তোমার সিদ্ধান্ত পালটিয়ে ফেলো। তোমার সেন্টিখোর মেয়ে মুড সুয়িংয়ের কারণে সেদিন ওসব বলেছে। দুলাভাই যথেষ্ট কেয়ার করে আপার। তবুও কেন যে আপা এমন করছে আমি নিজেই বুঝতে পারছিনা।”
“তোর দুলাভাই নিশ্চয় এমন কিছু করছে যেটা মেনে নেওয়ার মত না। আমার মেয়ের উপর আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে।”
“দুলাভাই যেটাই করুক না কেন এখন চুপ থাকো বাবা। অাপা প্রেগন্যান্ট, এসময় ভুলেও ডিভোর্সের কথা মাথায় এনো না। সব ঠিক হয়ে যবে আস্তে আস্তে। এমন জটিল কিছুই হয়নি যার জন্য ডিভোর্স হওয়া লাগবে।”
আপার প্রেগ্ন্যান্সির কথা শুনে বাবা যেন বো’বা হয়ে গেছে। একদম চুপ হয়ে গেলো। ঘোর থেকে বের হতে পারলোনা যেন। অনেক্ক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাবা আস্তে আস্তে বলল, “এর ভিতর ও বাচ্চা নিতে গেলো কেন! বড়টা প্রেগন্যান্ট, দুই মেয়েকে তোর মা একা সামলাবে কি করে। তুইতো এখানে থাকবিনা সবসময়।”
বাবার কথা শুনে আমার মুখ শুকিয়ে চুন হয়ে গেলো। বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছা উবে গেলো। তাইতো, একবারও ভেবে দেখিনি তিন বোনের বাচ্চা একসাথে আমার মা দেখতে পারবেনা।
বোনদের ভিতর প্রতিযোগিতা লেগে যাবে নানী কোন নাতী-নাতনীকে বেশি আদর করে তার। এরথেকে বরং ওদের বাচ্চা বড় হলেই আমি আমার পুচকো নেবো। সায়নকে বলবো সিদ্ধান্তঃ চেঞ্জ, শিডিউল চেঞ্জ।
একটু পর মেজআপা ঘরে এলো।
হয়তো বাবা ডেকেছিলো ওকে। বড় আপা এখনো ঘুমে, গড়ে দিনে প্রায় বারোঘন্টা ঘুমাচ্ছে সে।
মাহফুজ তার তিন দুলাভাইকে সাথে নিয়ে বিলে মাছ আনতে গিয়েছে। ছোটো ছোটো পুটিমাছ। মা-বাবার জামাইদের ভিতর এই একটা জিনিসই কমন, সবাই ছোটো পুটিমাছ পাগল।
আপা আমার পাশে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করে। আমি শুধু বলি হাত ফসকে চায়ের কাপ পড়ে গিয়ে এমন হয়েছে। আপা কথা না বাড়িয়ে বাবাকে বলে, “বাবা আমি চাই এখানে থাকতে। ওখানে যাবো না।”
বাবা এই কথার উত্তর না দিয়ে অন্যকিছু বলল, “আমি ভাবতাম আমার মেয়েরা এখনো অনেক ছোটো। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে আমার ঘরের রাজকন্যাগুলো পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমার ছোট্টছোট্ট মেয়ে, যাদের কিছুদিন আগেও কোলে নিয়ে ঘুরিয়ে বেড়িয়েছি আর কয়েকমাস পর তারা তাদের রাজকন্যা বা রাজপুত্রকে কোলে নিয়ে ঘুরবে।”
আপা হয়তো আশা করেনি এটা। সে আমার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকায়, যেন আমি কি নাকি ভূল করে ফেলেছি। তার প্রেগন্যান্সির খবরটা বাবাকে বলাটা আমার একদম ভূল মনে হয়নি, হচ্ছে-না।
মেজ আপা বাবাকে বলল, ” বাবা আমি বললাম আমি আর যাবোনা আর তুমি কিনা অন্য কথা বলছো?”
বাবা এবার বলল, “তোর বড় আপা আছে তুইও থাকবি। বাচ্চা হওয়ার আগে মেয়ে বাবামায়ের কাছে থাকে, এটা বারবার বলার কি আছে! তুই থাকবি এতে অসম্মতি জানিয়েছে কেও?”
আপা মিনমিন করে বলল, “আমি আর ওখানে যেতে চাইনা। বাচ্চা নিয়ে তোমাদের এখানেই থেকে যাবো।”
বাবা আমাকে যে কথা বলছিলো এখন সম্পুর্ন সেটার উলটো কথা বলল, “স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলা নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেওয়ায় সবচেয়ে উত্তম। অন্যকে এর মধ্যে টেনে সুন্দর সময়টা না নষ্ট করলেও চলবে। যেটা ভাবছো সেটা ভুলে যাও।”
বাবা প্রচন্ড রেগে গেলে সবার সাথে তুমি সম্মোধনে চলে যায়। এখনও আপার উপর রেগে গেছে তাই আপা এই ঘর থেকে যাওয়ার জন্য উষপিশ করছিলো। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বাবাকে বলি, “বাবা তোমাকে বললাম না আপার মুড সুয়িং হয়। এটাও তারই ফল৷ তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর আপা এখন ঘুরতে যাচ্ছি তুমি থাকো। মাকে আবার চা পাঠাতে বলছি।”
এই বলে গামলা থেকে ভিজা পা তুলে আমার ওড়নার মাথা দিয়ে মুছে নিলাম। গামলাটা হাতে নিয়ে মেজ আপাকে সাথে আসতে বললাম। মেজ আপাও বাবার সামনে থেকে পালাতে চাইছিলো তাই আমার কথায় উঠে পড়লো।
গামলার পানিটা বাথরুমে ফেলে মাকে বাবার জন্য চা দিতে বলে আপার হাত ধরে বাড়ির বাইরে গেলাম। উদ্দেশ্য বিলের ওখানে যাবো। মাছ ধরা দেখবো। আপা প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না মেজ দুলাভাই ওখানে আছে জেনে। পরে আমার জোরা’জোরিতে এরকম বাধ্য হয়েই চলতে লাগলো। কিন্তু আজকে আর কপালে মাছ ধরা লেখা ছিলোনা। বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের রাস্তা ধরে যাওয়ার একটু পরই দেখলাম মাহফুজ আর তার তিন দুলাভাই বাড়ির দিকে ফিরছে। মেজদুলাভাই আর বড় দুলাভাইয়ের হাতে একটা করে ডাব মাহফুজের কাছে পলিথিনে ছোট্ট পুটিমাছ আর সায়নের হাতে দেখলাম টাকিমাছ। আমাদেরকে দেখেই বড় দুলাভাই বলল, “তোমাদের স্বামীদের বউয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে আমি আবেগেআপ্লুত।”
আমি আর মেজ আপা অবাক হয়ে বড় দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। রাস্তাঘাটে এসব কি বলে এই লোক। সায়ন বলল, “ভাইয়া আপনি যখন হিমার লেজে লেজে ঘোরেন তখন কিন্তু আমরা কেও কিছুই বলিনা আর আমরা আমাদের বউয়ের জন্য এইটুকু করলেও ফান করবেন?”
সায়নের কথা শুনে মাহফুজ সহ বাকি সবাই হোহো করে হেসে উঠলাম। বড় দুলাভাই বলল, “আমি হিমার জন্য কিছু করিনা। আমার বাচ্চার জন্য করি। মেয়েটা আমার বাচ্চার জন্য কত কষ্ট করে, তার যত্ন না নিয়ে কি থাকা যায়! ছয়মাস পর সে আমারকে বাবা হওয়ার মত সুন্দর অনুভূতি দিতে সাহায্য করবে আমি কিভাবে তাকে যত্ন না নিয়ে থাকি!”
সায়ন এবার বলল, “তাহলে আমরাও আমাদের বউয়ের জন্য একটু যত্নশীল হলে দোষের কি?”
বড় দুলাভাই হাসতে হাসতে বলল, “দোষের কিছু না। যখন পাব্লিক প্লেসে তুমি বললে তোমার বউ টাকিমাছ পছন্দ করে, আবার ফেরার সময় মেজটা যখন ডাব কিনলো বউয়ের জন্য আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম হাহাহা।”
এবার বুঝলাম আসল কাহিনী। মাছের ভিতর সায়নের যেমন ছোটো পুটিমাছ প্রিয় তেমনি আমার টাকি মাছ প্রিয়। যদিও টাকিমাছের মাথাটা একটুই পছন্দ না আমার। চি’বাতে গেলে পাথরের মত শক্ত কি যেন একটা দাতে বাধে।
হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেলো, আমার জন্য না,মেজ আপার জন্য। মেজ আপা ডাবের পানি ভীষণ পছন্দ করে। কেও যদি আপাকে শুধু ডাবের পানি খেতে দেয় তবু খেয়েই যাবে, পেট খারাপ করলেও খাওয়া বন্ধ করবেনা। এটা আমাদের বাড়ির লোকজনই জানে শুধু। দুলাভাই জানে এটা আজকে জানতে পারলাম। লোকটা বউয়ের জন্য ডাব নিয়ে এসেছে,এটাও ভালোবাসা। আপা বোঝেনা কেন?
আমার হাতের মধ্যে আটকে রেখেছি মেজ আপার হাত নাহলে মেজ দুলাভাইকে দেখলে দৌড়ে পালাতো কখনই। আপার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আড় চোখে দুলাভাইকে দেখছে, যেন তার দিকে তাকাতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে আপা, হাও সুইট!
বড় দুলাভাইকে বললাম, “আপনিও তো নিজের বউয়ের জন্য ডাব নিয়েছেন, সেটা স্বীকার করলেন না তো?”
দুলাভাই হাসতে হাসতে বলল, “বাকি দুই ভাইরা বউকে ভালোবেসে কিছু নিলো আমি বাদ যাবো কেন?”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। তাদের সবাইকে সামনে হাটতে বলে আমি আর মেজ আপা তাদের পিছন পিছন যেতে লাগলাম। আপার কানে ফিসফিস করে বললাম, “একটা মানুষের ভালোবাসা বুঝতে হলে সারাজীবন অপেক্ষা করা লাগেনা আপা। তোর যুক্তি অনুযায়ী ধরেই নিলাম দুলাভাই ভুল করেছে। কিন্তু বর্তমানটাকে দেখ, অন্ধ হয়ে যাসনা। এতো কেয়ার করে তোকে। কেন নিজের জেদ ধরে বসে থাকবি?”
আপা কিছুই বললোনা। হয়তো মানুষটাকে নিয়ে ভাবছে। ভাবুক না একটু, সমস্যাগুলো চুকিয়ে যাক।
রাতে শীত পড়লো হঠাৎ করে। আমি ঘুমুঘুমু হয়ে হাতড়িয়ে সায়নকে খুজতে লাগলাম। লোকটা অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে আছে। নতুন বিয়ে করেছে নিব্বি লেখিকাদের গল্পের মত সবসময় বউকে বুকে নিয়ে ঘুমানো যায়না? গেঞ্জি ধরে টান দিলাম। আমার দিকে ফেরানোর জন্য। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, “কি হলো?”
আমি কিছু না বলে গেঞ্জি টেনেই চললাম। সায়ন হয়তো বুঝলো কিছু, আমার দিকে ঘুরলো।
আমি একটু উষ্ণতা পাওয়ার জন্য তার অনেকটা কাছে সরে গেলাম। আমাকে অনেকটা কাছে পেয়ে সায়ন জড়িয়ে ধরলো আষ্ঠেপৃষ্ঠে। পায়ের কাছ থেকে কাথাটা টেনে নিয়ে দুইজনের গায়ের উপরে দিয়ে দিলো। বেশ আরাম নিয়ে আবার ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম।
একটা সুন্দর স্বপ্ন অসমাপ্ত রেখেই ঘুম ভেঙিয়ে দিলো ঘুম পরীরা। সিকিমের ইয়াংথাম ভ্যালি, বরফের বলয় বানিয়ে সায়নের গায়ে ছুড়ে মারছি। সায়নে গায়ে বলয় লে’গে আবার বালির মত ছড়িয়ে যাচ্ছে। সায়ন হাসি মুখে একটু একটু করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, এতোটাই কাছে যে ওর নিশ্বাস শুনতে পাচ্ছি আমি। এমনকি অনুভবও করতে পারছি, নিশ্বাস যেন আমার মুখের উপর পড়ছে। একটু একটু করে তার ঠোঁট আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে আসছে। আশেপাশের মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে বরফের বলয় ছুড়ে মা’রা ফেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন কোনো সিনেমার ক্লাইম্যাক্স হচ্ছে তাদের কাছে। ঠান্ডায় আমার ঠোঁটগুলো শুকিয়ে কাঠ, সায়নের কাছে আসাতে গলাও শুকিয়ে গেছে। আমার ঠোঁট থেকে সায়নের ঠোঁট মাত্র এক সুতো দূরে আছে। এমন সময় ভুমিকম্প শুরু হলো। স্বপ্নে ভুমিকম্প আর বাস্তবে সায়ন আমার হাত ধরে আমাকে ডাক দিচ্ছে।
ইশ, দুই সেকেন্ড পর ডাকা গেলোনা! ভীষণ বিরক্ত হলাম। আচ্ছা সায়ন যদি সত্যিই এমন কান্ড করে সিকিমে আমি কি লজ্জা পাবো? হ্যা পাবো, লজ্জায় ম’রেই যাবো।
চলবে ইনশাআল্লাহ
#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ১৫
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
“আমি তোকে ভালোবাসিনা তবে তোর সাথে আজীবন থাকতে চাই। আমার মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত তোকে আমার পাশে চাই। শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে তোকে এক পলক দেখে আমার চোখ বন্ধ করতে চাই। আমি তোর আগে ম’রতে চাই, তোকে হারানোর কষ্টটা আমি নিতে চাইনা।”
একটু আগেই আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ায় রাগে মাথায় বলেছিলাম, “জ্বা’লাতন করবেন না ঘুমের সময়। মরে গেলে বুঝবেন।”
ব্যাস, মহাশয় রে’গে আগুন। আমাকে উঠে বসিয়ে দুই বাহু জোরে চেপে ধরে উপরোক্ত কথাগুলো বলল। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “আমাকে হারানোর ভয় পান, আমার সাথে থাকতে চান তবুও ভালোবাসেন না?”
একবার, বারবার হাজারবারের মত একই জবাব, “না একটুও ভালোবাসি না তোকে। তুই প্রেমিকার মত আমাকে তোর প্রেমে পড়াবি। নাহলে তোকে ভালোই বাসা হবেনা এজীবনে।” বলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। এই রাগ এই আদর, এই পুরুষকে আমি ঠিক ভাবে বুঝতে পারিনা কেন!
“সেসব কথা বাদ দেন আপনি আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন কেন আগে বলেন? জানেন না আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলে মাথাব্যথা করে?”
সায়ন জ্বীভে কামড় দিয়ে বলে, “সরি সাথী, আমি এটা জানতাম কিন্তু কেন জানি একদম ভুলে গেছি কথাটা। আর এমন ভূল হবেনা দেখিস।”
“কেমন স্বামী আপনি স্ত্রীর সবকিছু মনে রাখতে পারেন না?”
সায়ন আমার মাথাটা উচু করে আমার নাকে তার নাক ঘষে আমাকে ছেড়ে উঠে দাড়ালো। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বলল, “এই নে ব্রাশ করে নে। অনেক বেলা হয়েগেছে। সকালে এতো ঘুমালে সবাই কি ভাববে বলতো?”
আমি গটগট করে বললাম,” লোকের ভাবনা শুনে কাজকাম নেই আমার। ঘুম লাগলে ঘুমাবো এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক আর চিরন্তন সত্য।”
সায়ন এবার টিটকারি হাসি দিয়ে বলল, “বেশি বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে সবাই বলবে সারারাত রোমান্স করে ঘুমাইনি আমরা।”
ব্যাস, আমার কথা বলার এনার্জি ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো। তার হাত থেকে খপ করে ব্রাশটা নিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে এলাম। বাইরে থেকে তার হাসি শুনতে পাচ্ছি। লজ্জ্বায় ফেলতে একদম ওস্তাদ লোকটা। সায়ন দরজায় টোকা দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়। আমি খাইনি এখনো। সবাইকে তো দেখানো লাগবে আমি বউয়ের প্রতি কতটা কেয়ারিং! সে না খেলে আমি খাইনা।”
এরপর তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার শুনতে পেলাম। এর মানে সে ঘর থেকে চলে গেছে। আমি আনমনে হেসে উঠলাম। আমি জানি সে শুধুমাত্র আমার জন্যই অপেক্ষা করছে, কাওকে দেখানোর জন্য না। জানিনা ভবিষ্যতে এসবের কিছুই সচল থাকবে কিনা তবে আমি বর্তমান নিয়েই অনেক খুশি, একেবারে বাধভাঙা খুশি যাকে বলে।
আটদিন পর শ্বশুরবাড়ি ফিরে এলাম। মেজ আপা আর দুলা ভাইকে ওয়ার্নিং দিয়েছি নিজেদের ঝামেলা ঠিক করে নিতে। দুলাভাই তো কি সমস্যা সেটাই জানেনা বলল। আপা বলেছে সে এখন দুলাভাইয়ের সাথে যাবেনা। দুলাভাই একটুও জোর করেনি। এমনিতেই সে বাইরে থাকে সারাদিন, আপাকে ঠিকভাবে দেখতেও পারবেনা তাই এখানেই রেখে যায়।
এইতো চারকদিন আগে, দুলাভাই যাওয়ার দিন একটা মিষ্টি ঘটনা ঘটেছিলো, আপনাদের বলি!
আপার ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো আপা কি করছে দেখি। দরজা খুলতেই দেখলাম আপা পা ঝুলিয়ে খাটে বসে আছে আর দুলাভাই ফ্লোরে হাটুতে ভর দিয়ে আপার পেটে মুখ গুজে আছে। স্বামী-স্ত্রীর এমন মুহুর্ত আমার দেখা কোনোভাবেই উচিৎ হচ্ছিলো না মনে হয়। দরজাটা একটু টেনে দিয়ে অল্প ফাকা করে রাখলাম। ভিতর যেটা চলছিলো সেটা রোমান্টিক কিছু না, বউকে মানানোর প্রক্রিয়া চলছিলো।
আপা দুলাভাইকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছিলো৷ কিন্তু দুলাভাই নিজের হাত দিয়ে আপার কোমড় একদম টাইটভাবে জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। আপা বিরক্ত হয়ে বলল, “কি করছেন, ছাড়েন? দরজা খোলা আছে।”
দুলাভাই যথাস্থানে মুখ রেখে বলল, “আমি কি রোমান্স করছি নাকি যে দরজা দিয়ে আসতে হবে। আমি আমার বাচ্চাটার সাথে কথা বলছি। মন বলছে ওকে একটু ছুয়ে দিই। আচ্ছা আমার বাচ্চাও কি তোমার মত আমার উপর অভিমান করে থাকবে রিয়া?”
দেখলাম আপার চোখ ছলছল করে উঠলো, “দুলা ভাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বলল। খুব ন্যাকা কথা হচ্ছে তাইনা? ধেয় ধেয় করে প্রেম করে বেড়ানোর সময় কিছু মনে ছিলোনা আপনার?”
দুলাভাই সোজা হয়ে আপার পাশে বসে আমার মুখটা দুইহাতের মধ্যে নিয়ে আদর মাখানো কন্ঠে বলল, “বিশ্বাস করো কেসটা সমাধান করার জন্য আমি মেয়েটার সাথে প্রেমের নাটক করেছিলাম। এর বেশি কিছুই না।”
মেয়েদের মন কি আর এতো সহজে সব মেনে নেয়? আপাও নিলোনা। দুলাইভাইকে বলল, “বউ রেখে যাচ্ছেন বলে যেন ঘনঘন শ্বশুর বাড়ি আসবেন না। বাচ্চার ডেলিভারি ডেইটের আগে যেন আপনাকে না দেখি। যান এখন, আলগা পিরিত দেখাতে এসেছে।”
দুলা ভাই জোরে করে আপাকে জড়িয়ে ধরলো। আপা এবার আর একদম মোচড়ামুচড়ি করলো না। চুপটি করে রইলো দুলাভাইয়ের বুকে মাথা রেখে যদিও নিজ হাতে দুলভাইকে জড়িয়ে ধরেনি। দুলভাই হাসতে হাসতে বলল, “দিনের বেলা রাগ দেখাও আর রাতে যখন আমার ঘুমের সূযোগ নিয়ে মাথায়, কপালে চুমু দাও তখন তো আমি কিছু বলিনা।”
ব্যাস, তারা নিজেরাই তাদের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেছে। এ মুহুর্ত আর আড়িপাতা ঠিক না। চলে যাওয়ার আগে যদি বউকে চুমু টুমু দেয় সেটা আমার দেখা উচিৎ না। তাই সেখান থেকে কে’টে পড়ি।
শ্বশুর বাড়িতে এসেই মনখারাপ হয়ে যায়। একই গ্রামে বাড়ি হলেও আমি আস্তে আস্তে ওই বাড়ির মেহমান হয়ে যাবো। আমি ওখানে গেলে বাড়ির মানুষের থেকে বেশি আমাকে মেহমান হিসেবে ধরা হবে। আসলে এটাই দুনিয়ার নিয়ম।
ঘরে বসেই ছিলাম। সায়ন হন্তদন্ত করে ঘরে প্রবেশ করলো। আমার হাতে দুইটা পাসপোর্ট দিয়ে বলল, ” কালকেই রওনা হচ্ছি আমরা। শীতের কাপড় এনেছিস তো?”
যেহেতু শীতের আবহাওয়া শুরু হয়ে গেছে তাই এবার আশার সময় আমার সব শীতের পোশাক নিয়ে এসেছি। সায়নকে বললাম, “সবই আনা হয়েছে। সিকিমে কি ভীষণ শীত এখন?”
“গাধী নাকি তুই? আমাদের এখানে গরমের সময়ও সিকিমে শীত থাকে আর এখন তো শীতকাল শুরু হয়ে গেছে। তোর শীতের পোশাকগুলো দেখি।”
আমি আমার শীতের কাপড়গুলো বের করে তার সামনে রাখি। চারটা শীতের পোশাকের মধ্যে থেকে মোটা দুইটা সোয়েটার বাছাই করে আমার সামনে রেখে বলে, “এই দুইটা আপাতত নিয়ে গেলেই হবে আশাকরি। তাছাড়া ওখানেও শীতের কাপড় ভাড়া পাওয়া যায়, ভারতীয় ৫০ থেকে ১০০ টাকাতে।”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বাকি পোশাকগুলো আলমারিতে তুলে রাখি।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বড় একটা ট্রলি ব্যাগে আমার অনেক কাপড় নিয়ে নিই। ওখানে যেহেতু সাতদিন থাকা লাগবে তাছাড়া কাপড়চোপড় ধোয়াও যাবেনা তাই প্রতিদিনের জন্য একটা করে ড্রেস নেওয়ায় উচিৎ। সোয়েটার সহ প্রায় ১৪ টা জামা নিয়েছি, পাজামা নিয়েছি ১০ টা, আরও কত কি!
আমার এতো জামাকাপড় নেওয়ার পর ব্যক্তিগত কিছু জিনিস নেওয়ার জায়গা হলো না। সায়নকে তার ব্যাগে সেসব নিতে বললাম। সায়ন হাসতে হাসতে বলল, “আমার ব্যাগও আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে, তোর ব্যাগও। দে যা যা লাগে সব আমার ব্যাগে দে।”
আসলেই সে ঠিক বলেছে আমি এসব ব্যাগ-ট্যাগ টানতে পারবোনা। যা টানার সে নিজেই টানবে, আমি ভাই খালি হাতেই থাকবো। জার্নিটা খুব বড় হবে বলল সায়ন। কাল সকাল দশ-টায় ঢাকার বাসে উঠতে হবে।এরপর সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বাংলাবান্ধার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বাস, বর্ডার পার হওয়া, সেখান থেকে শিলিগুড়ি, এরপর সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। সায়ন হিসাব করে বলল প্রায় ৩০ ঘন্টার জার্নি হবে প্রায় সব মিলিয়ে। কথাটা শুনেই পেটের ভিতর মোচড় দেওয়া শুরু হলো। এতো লম্বা যাত্রা আমি কখনোই করিনি।
ও আগেই বলে রাখি, প্লেনে যাওয়াটা ক্যান্সেল করা হয়েছে। তার জন্য টিকি প্রতি অবশ্য তিন তিন, ছয় হাজার টাকা জরিমানা লেগেছে।
পরদিন সকালে বাবা-মা মেজ আপা আর বড় আপাও এসেছে বিদায় দিতে। শ্বশুরের ঘরে গিয়ে দেখা করে বিদায় নিয়ে আসলাম।
বাস দশটায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ছাড়তে প্রায় ১২টা বাজিয়ে দিয়েছে। আমাদের গ্রামের বাজার থেকে যে বাসগুলো ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে সেগুলোর এই এক সমস্যা। ১২টা সময়টা না দুপুর না সকাল তাই দুপুরের খাওয়াটা না খেয়েই বাসে উঠে পড়তে হলো। সিদ্ধান্ত হলো ঝিনাইদহের বাস স্টান্ডে যাত্রা বিরতি দিলে খেয়ে নেবো কিছু।
সায়ন বাসে বসার বিষয়ে খুব খুতখুতে। জানালার ধারে ছাড়া বসতেই চায়না সে। কিন্তু এ যাত্রায় এটা তার কপালে নেই কথাটা বলতেই সে মুখ ভার করে বলল, “এ যাত্রা না, বল সারাজীবন সেটা আর কপালে নেই। তুই সাথে থাকলেই তো জানালার পাশের সীটে আমার বসা হবে না।”
তার ছোট্ট করে রাখা মুখটা দেখে বেশ মজাই লাগলো আমার। ওই চেহারার ভিতর কোনো রাগ ছিলোনা। একটা দ্বায়িত্বের বেড়াজ্বলে আটকে যাওয়া একটা পুরুষের মুখের কথা ছিলো। আমার পুরুষ। বেশ মজায় হবে, সম্পুর্ন জার্নিতে সীটে মাথা না দিয়ে তার ঘাড়ে মাথা দেবো, ইশ!
,
,
চলবে ইনশাআল্লাহ