চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ২৪ অন্তিম

0
608

#চিরসাথী_তুমি_আমার – পর্ব ২৪ অন্তিম
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী

সায়ন তো মেজ আপাকে ভালোবাসতো তাহলে এই মানুষ গুলোকে আমার কথা, আমার ছবি কেন বলেছে, কেন দেখিয়েছে! মেয়েটাকে প্রপোজ করা ছেলেটাও আমাদের দিকে এগিয়ে এসে হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি আসলেই সায়নের স্বপ্নের পরী, কেমন আছো তুমি?”

অচেনা কারো সাথে কথা বলতে আমি কখনোই সাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা কিন্তু এই মানুষগুলো আমার
অজান্তেই আমাকে চেনে তাই কথা না বলে থাকাও যায়না, খুবই বেয়াদবি হয়ে যায়। তাই আমিও মুখে হালকা হাসি টেনে সামনে থাকা দুইজনকেও তাদের হালচাল জিজ্ঞাসা করি।

ফারিহা নামক আপুটা বলল, “তুমি আমার সাথে চলো, ওরা যাক।”

সায়নের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই সায়ন বলল, “সাথী, তুই ফারিহার সাথেই যা। আমি একটু পরই আসছি। ছোট্ট একটা কাজ সেরে এখনি আসবো।”

আমি কিছু না বলে চুপচাপ থাকি। সায়ন আমার অতি নিকটে এসে আমার সাথে বলে, “আমি এদেরকে চুড়ান্ত পর্যায়ের বিশ্বাস করি।”
আমি অপরিচিত একজন মানুষের সাথে থাকবোনা সায়ন ভালোই বুঝেছে তাই এই কথা বলল। আমিও এরপর হাসি মুখে সায়নকে বলল, “তাড়াতাড়ি চলে আসবেন কিন্তু। ঠান্ডা আপনার একদম পছন্দ না। আমার চোখে চোখে না রাখতে পারলে আমি মোটেও শান্তি পাবোনা।”

ফারিহা আপু হাসতে হাসতে বলল, “বাব্বাহ! ছোট্ট মেয়েটা তো দেখি স্বামীকে শুধু ভালোই বাসেনা তার প্রতি অনেক যত্নশীলও বটে।”

সায়ন সাময়িক বিদায় নিয়ে চলে গেলো। কিন্তু এই দেশে তার কি কাজ থাকতে পারে, এই নিয়ে একটু কৌতুহল জাগলো। তবে ফারিহা আপু সেসব নিয়ে ভাবার টাইম দিলো না। আমার হাত ধরে ইয়াংথাম ভ্যালির একদম একপাশে চলে গেলেন। একটা ছোট্ট টুপরিতে একজন চা বিক্রি করছে। দাম নিচ্ছে ভারতীয় ২০ টাকা করে। দাম বেশী হওয়ায় চা খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে পারলাম না। কৃপন মানুষ না আমি, তবে ৫ টাকার চা ২০ টাকা দিয়ে কখনোই খাবোনা। ফারিহা আপু চায়ের অর্ডার দিতেই আমি বারণ করে বললাম, “চা খাবোনা আপু। চলুন না ওপাশে কি একটু হাটাহাটি করি।”

ফারিয়া আপু হঠাৎ করেই আমার ডান হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। আমার দিকে কেমন মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমার র’ক্তের সম্পর্কের কেও না সাথী। তবুও তোমাকে আমি অসম্ভব রকমের ভালোবাসি। তুমি ভাবতেই পারো কেন কেও তোমাকে নিজের বোনের মত ভালোবাসবে। এর কারণটা হলো সায়ন। সারাক্ষণ তোমার প্রসংশা করতো। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতাম আমরা, কিন্তু সায়ন থেমে থাকতো না। আস্তে আস্তে আমরাও তোমার গল্প শুনে তোমার বৈশিষ্ট্যগুলো মনে মনে কল্পনা করতে থাকতাম। বিশেষ করে আমি, তোমাকে দেখার জন্য এতোটা উন্মাদ হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবোনা। সায়ন বলেছিলো তোমাকে বউ করেই আমাদের সামনে আনবে এর আগে না।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমাকে বউ করার কথা উনি ভার্সিটি লাইফে আপনাদের বলেছে? তাহলে মেজ আপা আসলো কবে এসবের মধ্যে?”

আমার কথা ফারিহা আপু বুঝতে না পারায় অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “কার মধ্যে মেজ আপা এসেছে সাথী আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

আমি কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, “আপু আপনি এখনো বিয়ে করেননি কেন? সায়নের সহপাঠী মানে তো আপনার বয়সও ২৭ এর আশেপাশে।”

“বিয়ে করিনি তোমাকে কে বলেছে? আমার তিন বছরের ছেলেও আছে।”

“তার মানে আপনাকে কেও বিয়ের পর প্রপোজ? ওয়েট ওয়েট, তার মানে ওই ভাইয়াটাই আপনার স্বামী! কিন্তু আপনাদের ছেলে কোথায়?”

“গাড়িতেই ঘুমাচ্ছে, ওর সাথে ওর দাদী আছে।”

এবার সব পরিষ্কার হলো কিন্তু আমি একটা জিনিস এখনো বুঝলাম না। সায়ন যদি ভার্সিটি লাইফে আমাকেই ভালোবেসে থাকে তাহলে পরে মেজ আপাকে ভালোবাসলো কেন!

প্রায় ৩০ মিনিট আমি আর ফারিহা আপু একসাথে ঘুরলাম। এরপর আমাকে বলল, “চলো একটা চমক দিই তোমাকে।”

কি চমক পাবো সে আশায় আমি ফারিহা আপুর সাথে হাটতে লাগলাম। ৫মিনিট পর গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। এদিকটায় মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। হঠাৎ সামনে এসে দাড়ালো কাঙ্ক্ষিত মানুষটা, যাকে এতোক্ষণ মিস করেছি।

আমাকে সামনে দাড় করিয়ে হাটু ভাজ করে আমার সামনে বসে পড়লো। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “প্লিজ আগামী কিছু সময় যা বলবো সেটা পুরোটাই শুনবি।”

আমি মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম। সায়ন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “যেদিন ভার্সিটির কোচিং-এর জন্য শহরে চলে গেলাম তখনও আমার মনে এমন কিছুই হয়নি। কিন্তু যত দিন যেতে থাকে ততোই আমার মনটা খা খা করতে থাকে। আমি এই অনুভূতির নাম জানতাম না। তুই তখন কেবল ক্লাস সিক্সে পড়িস। আমি কিভাবে তোর কাছে অনুভূতির প্রকাশ করতাম বলতো! আমি রিয়াকে আমার মনের কথা বলেই ফেলি ভেবেছিলাম ও রাগ দেখাবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে, তুই নাকি ওর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু আর আমার হাতে তোকে দিতে ওর কোনো সমস্যা নেই। শুধু বাবা-মাকে রাজি করাতে পারলেই হলো।

কিন্তু সেই বয়সে কিভাবে বলি এসব কথা বলতো। ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর আমার মনটাতে তোর জন্য অনেক জায়গা হয়ে যায়। তোকে ভুলতে পারিনি আমি। ভাবলাম একটা প্রেম করলে তোর কথা মনে পড়বেনা। কিন্তু যখন মেয়েটার সামনে গেলাম তখন মনে হলো তুই শুধু আমার জন্য, আমিও তোর। অন্যকাওকে এর ভিতর আসতে দেবোনা। সেখান থেকে দৌড়ে রুমে চলে আসলাম। তোর একটা ছবি হাতে নিয়ে বললাম, কবে বড় হবি তুই। আমার অনুভবগুলো বড্ড নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই প্রেম নামক ব্যা’থায় আমি বারবার ব্যা’থিত হয় অপেক্ষা নামক বেড়া জালে। এরপর সব শেষ হলে মাকে তোদেএ বাড়িতে পাঠায়। মা গিয়ে তোর মেজ আপার সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেলে। আমি মাকে তোর কথা বলতে মা বলে তোর বাবা নাকি আগে রিয়ার বিয়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক কিন্তু মায়ের রাজী হয়ে যাওয়াটা আমার খুব পিড়া দিতো। এরপর আমি আর বাড়িই ফিরে আসিনি। রিয়াকে তোর বাবা বিয়ে দিয়ে দেয়। আমিও এটাই চাইতাম। এরপর বাড়ি এসে তোর বাবা সব কথা বলি, আমার অনুভূতিও বলি নির্লজ্জের মত। এটাও বলি তুই এসবের কিছুই জানিস না। তোর বাবা একবারেই রাজী হয়ে যায়। আমিও কিছু শিখিয়ে দিই ওনাকে। এরপর বিয়ের পর সেদিন তোকে বলি রিয়াকে ভালোবাসি, ওকে আঘাত দিতে চাই। এসব বলার একটাই কারণ যাতে তুই তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করিস, নিজের বোনকে বাচাতে আমাকে ভালোবাসায় জড়ায়ে পারিস। কিন্তু তুইতো জানতিসই না আমি অলরেডি তোর জন্য পাগল হয়ে গেছলাম।”

আমি সায়নের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিনা। চোখটা ভীষণ জ্বালা করছে।সায়নে চোখেও পানি। আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি দেখে সায়ন বলল, “আজকে দুর্বল হবিনা, জ্ঞানও হারাবি না। আজকে সব শুনবি।

আমার সাত বছরের ভালোবাসার অপেক্ষা খুব তাড়াতাড়িই মিটে যায়। অল্পসময়েই তোর মনে আমার নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। এর থেকে আর কি চাওয়া থাকতে পারে আমার। তুই বারবার বলতিস আমি কেন তোকে ভালোবাসি বলিনা। আজকে বলছি আমি। তোকে আমি ভালোবাসি সাথী। কতটা ভালোবাসি শুনতে চাসনা। তুই আমাকে যতটা ভালোবাসিস তার থেকে কোটিগুন বেশি ভালোবাসি তোকে। কিভাবে প্রপোজ করতে হয় তাও জানিনা। তাই আনাড়ি ভাবেই বলছি, তুই কি আমার চিরসাথী হবি? তোকে আগলে রাখবো আমার বুকে, তোর অন্যায়ক আমি প্রশ্রয় দেবোনা, শাস্তি দেবো তবুও তোকে দূরে সরতে দেবোনা। আমার ভালোবাসা নামক আকাশে একমাত্র তারা হবি তুই?”

কেমন যেন কানে আশেপাশের কিছুই শুনতে পারছিনা। এর জন্য তো আমি অপেক্ষা করতাম। কিন্তু সামনের মানুষটা যে আমার জন্যই অপেক্ষা করতো। আমি যে তাকে ভালোবাসতে বড্ড লেট করে ফেলেছি, অর্ধযুগেরও বেশি লেট। আমি ভাবতাম তকেই আমি বেশি ভালোবাসি এখন দেখছি তার ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা তুচ্ছ।

সায়নকে আমি নিজের সাথে জড়িয়ে ধরি। সেই স্বপ্নটা আজ সত্যি হত্র চলেছে। সায়নের ঠোঁট একটু একটু করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি যেন জমে যাচ্ছি আরও। স্বপ্নের থেকে একটু ব্যাতিক্রম কিছুই ঘটলো, সায়ন আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল, “এটা ভালোবাসার ছোয়া, কামনার ছোয়াটা চার দেয়ালের ভিতরেই হবে।”

সিকিম ভ্রমণটা আমার ডায়েরিতে আরও সুন্দর করে লেখার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু পারিনি। ভালোবাসা আর ভ্রমণে ভালোবাসা জয়ী হয়ে থাকে। এখনো মনে আছে ফিরে আসার দিন দিপা আর সুমনদা মন খারাপ করে ছিলো। আমাদেরও মন খারাপ হয়। কিন্তু যার গন্তব্যে তাকে পৌঁছাতেই হবে,এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

বাংলাদেশে প্রবেশ করি নাবিল ভাইয়াদের সাথেই। ঢাকাতে একসাথেই আসি। এরপর আবার তুই দলের গন্তব্য দুইদিকে হয়ে যায়। আন্টি আমার হাত ধরে বলে, “আমি কখনোই তোমার খারাপ চাইনি। নিজের ছেলের বউ ভেবে নিয়েছিলাম তোমাকে। এই আক্ষেপ থেকেই চরম ভুল কিছু বলে ফেলেছিলাম। মাফ আমাকে না করলেও আমি কষ্ট পাবোনা। তবে এখন আর তুলনা দেবোনা মা, যে ছেলে তোমার জন্য ৭বছর নিজের অনুভুতিকে লুকিয়ে লুকিয়ে চলতে পারে তার থেকে ভালো জীবনসঙ্গী আর কেও হতে পারেনা। মন ভরে দোয়া করি তুমি সুখে থেকো।”

আমিও হাসি মুখে বিদায় নিই। মাফ করবোনা বলেও নিজের অজান্তেই তাকে মাফ করে দিই।

বাসের জানালার ধারে বসেছিলাম সায়নের কাধে মাথা দিয়ে। সায়নকে বললাম, “সায়ন জীবন এতো সুন্দর কেন বলেন তো?”

“আমার পাশে তুই আছিস তাই।”

“উহুম, আমার পাশে আপই আসেন তাই।”

এই নিয়ে তর্ক হলো বেশখানিক।
,
,

ডায়েরিটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিই। বাইরে থেকে আদুরে বুলিতে কেও ডাকছে, “ও আম্মু, তাড়াতাড়ি করো, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আব্বু রাগ করছে।”

আমি তাড়াতাড়ি সেজে নিই। মেয়ের আজকে স্কুলের প্রথম দিন, তাই এতো ব্যাস্ত সে। সেজে গুজে বের হতেই মেয়েটা কোলে ওঠে। আমি গালে একটা চুমু দিয়ে বলি, “তোর আব্বু কোথায়।” পুলিশের পোশাক পরা লোকটা সামনে এসে বলে, “এইতো আমি, চল তাড়াতাড়ি।”

সায়ন মেয়েকে কোলে নিয়ে চলতে থাকে। আমি পিছনে পিছনে যেতে থাকি। বাবা মেয়ের খুনসুটি দেখতে মন ভরে যাচ্ছে। আমার সায়ন, সন্ধ্যা এই নিয়েই জীবন চলে যাচ্ছে। আর কি চাই জীবনে।

,
,
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here