সেই তুমি? পর্ব -২০

0
2906

সেই তুমি?
পর্ব -২০
Samira Afrin Samia(Nipa)

এরই মাঝে ইয়াশ ইফানের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো ইফান রিহাদের বাসায় থাকে।
ইয়াশ সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে বসে আছে।
ইশিতা রুমে গিয়ে ইয়াশ কে দেখতে না পেয়ে ব্যালকনিতে গেল। ইশিতা ইয়াশের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা বুঝতে পারছে আজও ইয়াশ ইফানের কথা মনে করে মন খারাপ করে বসে আছে।
ইশিতা পেছন থেকে আস্তে করে
— শুনছেন?
ইয়াশ ইশিতার ডাক শুনে অজানা চিন্তার ঘোর থেকে ফিরে এসে
— কিছু বলবে?
— কিছু দিন ধরে দেখছি আপনি সব সময় মনমরা হয়ে থাকেন। ঠিক সময়ে বাসায় আসেন না। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া ও করেন না। আপনাকে এই অবস্থায় দেখে মা ও আরো ভেঙ্গে পড়ছে।
আপনি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়েন সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন তাহলে মায়ের কি হবে?
— আমি কেন যেন দিন দিন আমার সব শক্তি হারিয়ে ফেলছি। মনে হচ্ছে আমার পাশে সবাই আছে কিন্তু কেউ আমার আপন না। ইফান কে ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি এখন ও বলে ওর উপর আমার কোনো অধিকার নেই।
ইয়াশের কন্ঠ ভারী হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেছে।
— ইফান কি করছে তা এখন বুঝতে পারছে না। যেদিন বুঝবে সেদিন ঠিকই পস্তাবে।
আপনি নিজেকে একটু শক্ত করে মায়ের পাশে দাঁড়ান। আপনি ছাড়া তো মায়ের ও আর কেউ নেই।
আপনি বাসায় আসেন না বলে মা ও সারা দিন রুম থেকে বের হয় না। আপনার সাথে বসে এক সাথে খাবার খেতে পারবে না বলে মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকে।
আমি অনেক জোর করেও খাওয়াতে পারি না।
— ইফান টা বড্ড র্সাথপর।
অনেক বেশি ভালোবাসা দিয়েছিলাম তো তাই ওর বিহেইভিয়ার গুলো ঠিক মেনে নিতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে খুব। ও কি করে এমন হয়ে গেল?
ইয়াশ ইজি চেয়ার থেকে উঠে রুমে আসতে নিলে ইশিতা ইয়াশের হাত ধরে ফেলে। ইশিতা এই প্রথম নিজে থেকে ইচ্ছে করে ইয়াশের হাত ধরেছে। ইশিতা ইয়াশের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নেয়।
ইয়াশ আজ ইশিতার এমন কান্ড দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল।
— আমি যখন ভিতর থেকে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। নিজের বেঁচে থাকার উদেশ্য টা হারিয়ে নিজেকে নানা ভাবে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম তখন কেউ আমার পাশে ছিল না। সবাই নিজের থেকে আমাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমার কাছে আমার পাশে আপন বলতে কেউ ছিল না। তখন আপনি আমার হাত টা ঠিক এই ভাবে শক্ত করে ধরেছিলেন। কে কি ভাবলো কে কি বললো তার পরোয়া না করে আমার সাথে আমার পাশে থেকেছেন। আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।
আমি যাতে সব কিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন সাজাই সব সময় তা চেয়েছেন।
সত্যি বলতে আপনি যদি আমার হাত টা না ধরতেন তাহলে হয়ত এতদিনে নানা ভাবে আমি আমার জীবন শেষ করে দিতাম।
আমার সাথে যা যা হয়েছে তার পরেও আমি নতুন করে সব কিছু গড়ে তুলেছি। নতুন করে স্বপ্ন সাজিয়েছি। নতুন করে বাঁচতে শিখেছি।এতো কিছুর পরেও আমি সব ভুলে যেতে পেরেছি তাহলে আপনি পারবেন না সব কিছু ভুলে যেতে?
ইয়াশ ইশিতার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে
— তোমার কাছে এমন কেউ ছিল যে তোমার হাতটা ধরবে। সব সময় তোমার পাশে থাকবে। আমার কাছে তো এমন কেউ নেই।
— আপনি ওই দিন বলেছিলেন না। আমি আপনার জন্য নিজের দুঃখ গুলো ভুলে গিয়ে আবার আপনার সাথে নতুন করে পথ চলা শুরু করতে পারবো কিনা।
ওই দিন আপনি বলেছিলেন আজ আমি বলছি।
আপনি কি পারবেন না আমার জন্য আর আমার সন্তানের জন্য যা হয়েছে সব ভুলে যেতে। আমি আমার বাকি টা জীবন আপনার সাথে কাটাতে চাই। আপনার হাত ধরে জীবনে বাকি পথ টুকু চলতে চাই।
ইয়াশ অবাক চোখে ইশিতা কে দেখছে। ইশিতা ইয়াশের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না।
— তুমি যা বলছো ভেবে বলছো তো?
— হুম এতো দিন তো অনেক ভাবলাম। এখন সব ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের মনের কথা শুনছি।
আপনার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিছে নাকি তা জানি না। তবে আপনার প্রতি আমার একটা দূর্বলতা জন্ম নিয়েছে। যে দূর্বলতার মানে আমি খুব ভালো করেই জানি। আমি এখন আপনাকে হারালে নিজেকে আর সামলে নিতে পারবো না। বাঁচতে পারবো না আর। সব কিছু হারিয়ে যাকে পেয়ে আবার নিজেকে দাঁড় করিয়েছি তাকে হারালে আবার দাঁড়ানোর মত আমার মাঝে এক টুকরো শক্তি ও থাকবে না।আপনি যে কখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছেন আমি নিজেও জানি না। আপনি পাশে থাকলে মনে হয় আমার কাছে সব কিছু আছে। আর আপনাকে হারানোর কথা মাথায় আসলে মনে হয় আমার কাছে কেউ নেই আমি সম্পূর্ন একা।আপনি ছাড়া আমি অপূর্ণ। আপনাকে ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনাকে দেখে আমি আবার ভালোবাসায় বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি।
আচ্ছা আপনি সব সময় আমার হাত ধরে আমার পাশে থাকবেন তো?
কথা টা বলার সাথে সাথেই ইশিতার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লো। আবারও চোখের পানি পড়তে নিলে ইয়াশ তার হাত পেতে হাতের তালুতে পানির বিন্দু গুলো ধরে নেয়।– আজকের পর থেকে তোমার চোখ থেকে আর এক ফোঁটা পানি নিচে পড়বে না। আমি পড়তে দিব না। আমাকে ছাড়া তুমি যেমন অসম্পূর্ণ তেমনই তোমাকে ছাড়া আমি ও অসম্পূর্ণ।
আমি আমার জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এই ভাবে তোমার হাত ধরে তোমার পাশে থাকবো।
তোমাকে কখনও নিজের থেকে আলাদা হতে দিব না।কখনোই না। তোমাকে নিয়ে পূর্নতা পাবে আমার জীবন।
ইশিতা ইয়াশের কথায় হু হু করে কেঁদে উঠলো।
আজ ইশিতা জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিস টা নিজের করে পেয়েছে। এমন একজন মানুষকে সারা জীবনের জন্য পেয়েছে। যে মানুষ টার সাথে সে চোখ বুঁজে জীবনের বাকিটা পথ পারি দিতে পারবে।
— দেখো তো এই কয়দিনে খেয়াল ই ছিল না।
— কি খেয়াল ছিল না?
ইয়াশ আলতো করে ইশিতার পেটের উপর হাত রেখে
— আমাদের বাচ্চার কথা খেয়াল ছিল না।
ইয়াশ হঠাৎ করে ই শি ত পেটে হাত রাখলে ইশিতা একটু লজ্জা পেয়ে যায়। ইয়াশ ইশিতা কে দেখে বুঝতে পারলো ইশিতা লজ্জা পেয়েছে। তাই সাথে সাথে ইশিতার পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। ইশিতা কে স্বাভাবিক করার জন্য ইয়াশ আবার বলতে লাগলো
— আমাদের বাবু বলবে ওর বাবা টা খুব বাজে একটু ও ওর খেয়াল রাখে না। ওকে একটু ও সময় দেয় না ভিষণ পঁচা বাবা ওর।
ইয়াশের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইশিতা বলে উঠলো।
— একদম না। বাবুর আব্বু মোটেও বাজে না। বাবু তো বুঝে ওর আব্বু কাজে ব্যস্ত থাকে তাই ওর খেয়াল রাখতে পারে না। ওর আব্বুর কাজ শেষ ঠিক ওকে অনেক সময় দিবে। তাই বাবু আব্বু কে পঁচা বলবে না।ইয়াশ কি বলবে বুঝতে পারছে না। আজ এতো দিন পর নিজের ভালোবাসার মানুষ কে নিজের বলে দাবী করতে পারবে ইয়াশ। ইশিতা যে আর কখনও ইয়াশের হাত ছাড়বে না এটা ইশিতার চোখের দিকে তাকিয়ে ই খুব ভালো করে বুঝতে পারছে ইয়াশ। ইয়াশ আজ নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বড় সুখী মানুষ বলে দাবী করতে পারবে। ভালোবাসার মানুষ টা সাথে থাকলে আর কিছুর ই প্রয়োজন পড়ে না।
— আচ্ছা এখন মায়ের কাছে চলুন। আপনি মা’কে বুঝালে মা ঠিকই বুঝবে। ইফান ভুল বুঝে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তাই বলে তো এখানেই আমাদের জীবন থেমে যাবে না। আমাদের তো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনের পথে আগে এগুতে হবে। ইফান যেদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবে সেদিন ও ঠিকই বাড়ি ফিরে আসবে। আমাদের এখন শুধু সেদিনের অপেক্ষা করতে হবে যেদিন ইফান নিজের কুকর্মের জন্য আফসোস করে বাড়ি ফিরে এসে মায়ের কাছে আপনার কাছে হ্মমা চাইবে।

নাজমা চৌধুরী রুমে শুভ আছে। ইয়াশ আর ইশিতা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াশ দরজায় টুকা দিয়ে
— আসবো মা?
নাজমা চৌধুরী উঠে বসে
— তুই আমার রুমে আসার জন্য পারমিশন নিচ্ছিস?
ইয়াশ কিছু না বলে রুমের ভেতর এসে নাজমা চৌধুরীর পাশে বসলো।
— মা তুমি এমন করলে কিভাবে হবে বলো তো?
ইফানের জন্য সারা চোখের পানি ফেলো। খাওয়া দাওয়া ও করো না। তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে আমাদের কি হবে?
তোমার হাত আমাদের মাথায় না থাকলে আমরা কি পারবো জীবনে একা চলতে?
নাজমা চৌধুরী কিছু বললেন না। ইশিতা এখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভেতর আসছে না। নাজমা চৌধুরী ইশিতার দিকে তাকিয়ে
— কিরে মা তুই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ভেতরে আয়।
ইশিতা মনে হয় নাজমা চৌধুরীর মুখ থেকে এই কথা শুনার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলো।
ইশিতা সাথে সাথে নাজমা চৌধুরীর কাছে চলে আসে।– আমাকে হ্মমা করে দিস মা।
— আপনি আমার কাছে হ্মমা চেয়ে আমাকে ছোট করবেন না মা। আপনি আমাকে নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। আমাকে নিজেকে মেয়ের জায়গায় বসিয়েছেন।
ইশিতা কথা শেষ করার আগে নাজমা চৌধুরী বলে উঠলেন
— আমার ছেলে তোর সাথে এতো অন্যায় করেছে। তার পর ও আমি ওকে কোন শাস্তি দিতে পারলাম না। তোর সামনে দাঁড়ানোর মুখ নেই আমার। তোকে দেখলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
— ইফান আমার সাথে অন্যায় করেছে এতে তো আপনার কিছু করার নেই মা। আর ইফান যেমন আপনার ছেলে হয়ে আমার সাথে অন্যায় করেছে। তেমনই তো আপনার বড় ছেলে সব কিছু জেনে শুনে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। দু’জনই তো আপনার ছেলে একজন ভালো হয়েছে একজন খারাপ হয়েছে এতে কি আপনার কিছু করার আছে?
আপনি তো দু’জনকে সমান শিক্ষা ই দিয়েছেন। একজন আপনার আদর্শ আপনার শিক্ষা সঠিক ভাবে নিয়েছে আর আরেকজন নেয় নি। এতে আপনি কেন নিজেকে অপরাধী মনে করবেন?
আর আমার তো কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশের গালে হাত রেখে
— অনেক ভাগ্য করে এমন লহ্মী একটা বউ পেয়েছিস। দোয়া করি তোরা সারা জীবন খুব সুখে থাকিস। তোদের সংসার ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ থাকুক। তোদের সম্পর্কে কারো নজর না লাগুক।
ইশিতা একটু অধিকারী কন্ঠে
— হুম ছেলের বউয়ের প্রশংসা করা হয়ে গেলে এখন খেতে যাই। কদিন ধরে সবাই এক সাথে বসে খাওয়া হয় না।

ইফান রিহার সাথে বসে ডিনার করছে। বাড়ি থেকে আসার পর রিহাদের বাসায় ই থাকছে। রিহা ইফানের প্লেটে মাছ তুলে দিয়ে
— ইফান তুমি ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করো। তাই আজ আমি নিজের হাতে তোমার জন্য ইলিশ মাছ রান্না করেছি। খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে।
ইফান বিরক্তি নিয়ে
— রিহা এতো টা দিলে কেন?
আমাকে কি তোমার রাহ্মশ মনে হয়?
— ইফান এমন করে কথা বলো কেন? আমি কত ভালোবেসে স্পেশালি তোমার জন্য রান্না করেছি। আর তুমি এমন বিহেইভ করছো।
— এমন বিহেইভ করবো না তাহলে কেমন বিহেইভ করবো তুমি ই বলো।
— তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি এখন খাও। আর খেয়ে বলো আমার রান্না কেমন হয়েছে। ভালো না হলে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না।
ইফান আর রিহা কথা বলতে বলতেই রিহার বাবা ডাইনিং টেবিলে এসে গেল। রিহার বাবা মনির চৌধুরী একটা চেয়ার টেনে বসে।
— তা ইফান দিন কাল কেমন চলছে?
ইফান মাথা নিচু করে খেতে খেতে
— এই তো আঙ্কেল ভালো।
— হুম। কি করছো এখন?
— তেমন কিছু না।আসলে আঙ্কেল
ইফান বলার আগেই রিহা বলে উঠলো
— বাবা ইফান রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছে।
— রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে মানে ?
সত্যি নাকি ইফান?
ইফান মাথা নাড়িয়ে
— হ্যা আঙ্কেল।
— তুমি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে এসে একদম ঠিক করোনি ইফান। ওটা তোমার ও বাড়ি। তুমি ও তোমার বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ পাবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here