ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ২
অরিত্রিকা আহানা
একধ্যানে বিছানার ওপর রাখা মোবাইল ফোনটার দিকে চেয়ে আছে ফাগুন। অনবরত বেজে চলেছে। নাম্বারটা ফাগুনের চিরপরিচিত। আসাদের নাম্বার! দুঃখে কষ্টে ফাগুনের চোখে পানি চলে এলো। আসাদ কথা দিয়ে কথা রাখে নি। ফাগুনকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে সে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। চোখের পানি মুছে ফোনটা রিসিভ করলো ফাগুন। অনেক অভিমান, অভিযোগ ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘কেন ফোন করেছো?’
ফাগুন ফোন রিসিভ করবে কিনা এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলো আসাদ। ফাগুনের গলা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। শান্ত, কোমল গলায় বললো,
‘কেমন আছো ফাগুন?’
ফাগুনের কন্ঠে রাগ ঝরে পড়লো,
‘কেন ফোন করেছো তুমি? জানো না আমি বিবাহিতা। চাইলেই যার তার সঙ্গে কথা বলতে পারি না।’
আসাদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বললো,
‘রেগে আছো?’
ফাগুন ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপলো। বিষাদভরা অশ্রুসজল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কেন আসো নি সেদিন? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম।’
‘এসেছিলাম!
‘এসেছিলে?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু এসে দেখি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।’
আসাদ হাসলো। ওর কন্ঠে আফসোস! বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো ফাগুনের। চোখের পানি আর বুকের বেদনা মিলে ভয়ানক এক যন্ত্রণার সৃষ্টি করলো হৃদযন্ত্রে। সামান্য কিছু সময়ের ব্যবধানে! মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে ফাগুন। নিঃশব্দ বেদনায় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে এলো। অসহায়, দুর্বিষহ মনে হলো নিজেকে।
ওপাশ থেকে আসাদের মোলায়েম কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
‘তুমি ভালো আছো তো ফাগুন?’
ফাগুন এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিলো,
‘ভালো নেই আমি। একদম ভালো নেই।’
ওপাশের সবকিছু নিরব হয়ে গেলো। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলো আসাদ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঠাট্টার সুরে বললো,
‘কেন তোমার বর বুঝি তোমার কাছে আসে না?’
ফাগুন জবাব দিতে পারলো না! আসাদের এই প্রশ্ন ওর ভেতরটাকে লজ্জায়, ঘৃণায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একেবারে ছারখার করে দিলো। ফাগুন চাইলেও মুখ ফুটে নিজের যন্ত্রণার কথা খুলে বলতে পারলো না! এক ভরদুপুরে ঘটে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড় ওর সমস্ত আশাভরসা শেষ করে দিয়েছে। লক্ষ কোটি মাইল দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে ওকে আসাদের কাছ থেকে। ফোন কেটে দিয়ে বিছানায় ঝাপিয়ে পড়লো ফাগুন। চোখের পানি বাঁধ মানলো না! সারাদিন কেঁদে বুক ভাসালো!
★
স্বামী স্ত্রীর কাছে আসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু ভালোবাসার। যেখানে ভালোবাসা থাকে না সেখানে একে অপরকে কাছে পাওয়ার আকুলতাও থাকে না। বিয়ের প্রথম রাতেই ফাগুন মেয়েলি অযুহাত দিয়ে সৃজনের কাছ থেকে দূরে সরে রইলো। বেশ কিছুদিন পাশ কাটিয়ে রইলো এই বাহানায়! কিন্তু সৃজন কি করে জানবে ওর মনের কথা!
তাইতো একদিন হঠাৎ দুপুর বেলা, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে কাছাকাছি আসা হয়ে গেলো দুজনার। সেই ইতিহাস আর দ্বিতীয়বার মনে করতে চাইলো না ফাগুন!
আফসোস শুধু এইটুকুই পরস্পরের এত কাছাকাছি এসেও স্বামী স্ত্রীতে আত্মিক মিলন হলো না! উপরন্তু ফাগুনের কোমলমতী, ছোট্ট মনটা অঘোষিত বিদ্রোহ ঘোষণা করে সৃজনের প্রতি। কেমন পুরুষ! স্ত্রীর মনের খবর জানবার আগেই শরীর কামনা করে। সরল,স্নিগ্ধ মনটায় রাতারাতি অভিযোগের পাহাড় গড়ে উঠলো।
নিতান্ত ক্ষোভের সহিত সেদিন রাতেই আসাদের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথাটা জানিয়ে দিলো সৃজনকে।
তারপর!
তারপর সবকিছু এলোমেলো।
আর একদিনও ওর কাছে যায় নি সৃজন।
সমস্ত অধিকার ছেড়ে দিলো ফাগুনের ওপর থেকে!
আলাদা বিছানা নিলো! বই পড়ার বাহানা দিয়ে ইচ্ছে করে অন্য ঘরে বিছানা পাতলো। শুরু হলো ফাগুনের একাকী, নিঃসঙ্গ জীবন! কেটে যাচ্ছে দিন!
★
সৃজনদের এই বাড়িটা ওর দাদার আমলের। দেখতে অনেকটা আগেকার দিনের জমিদারবাড়ির মতন। অনেকগুলো কামরা, দরজা জানালা। বাড়ির চারদিকে উঁচু করে ঘেরাও প্রাচীর দেওয়া। সামনে পিছনে বাগান। একপাশে পুকুর। অথচ গোটা বাড়িতে ওরা মাত্র চারজন মানুষ। ফাগুন আর সৃজন বাদে কেবল দুটো কাজের লোক!
দিনের বেলাও এই বাড়িতে গা ছমছম করে ফাগুনের। তার ওপর সৃজন সারাদিন বাড়িতে থাকে না। দুপুরে খাওয়ার সময় আসে আর রাতে ঘুমানোর আগে। এছাড়া ছাড়া ওর সঙ্গে সচরাচর দেখা হয় না ফাগুনের। নিজের মত কাজে যায়। ফিরে এসে খেয়ে ঘুম দেয়। খুব দরকার না হলে কথাবার্তা বলে না ওর সঙ্গে।
সারাদিন ফাগুনের কোনো কাজ থাকে না। খাবার দাবারের ব্যবস্থা সব তাহেরাই করে। তাহেরা এই বাড়ির একমাত্র গৃহকর্ত্রী। অনেকদিন যাবত কাজ করছে এখানে। এছাড়া আর কাউকে ফাগুন দেখে নি। এই সংসারে এলে কেউ বুঝবে না এখানে নববিবাহিত দম্পতি বাস করছে। মনে হয় নির্জীব ভুতুড়ে বাড়ি। প্রাণহীন, নিস্তেজ!
বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা,
অনেকদিন বাদে আজকে বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে সৃজন। ঘুম ভাঙ্গার পর ওর সর্ব প্রথম কাজ হচ্ছে ঘড়িতে সময় দেখা। পাশ ফিরে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চাইলো। সাড়ে আটটা বাজে। প্রতিদিন এই সময়টাতেই কারখানায় পৌঁছে যায় সে। কিন্তু আজকে যাবে না। পুকুরে জাল ফেলা হবে। দাঁড়িয়ে থেকে মাছ ধরা দেখবে সৃজন। এই কাজটা ওর অসম্ভব প্রিয়। খুব ছোটবেলার বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখতো। এখন বাবা নেই! কিন্তু বাবার স্মৃতি রয়ে গেছে। যেদিন পুকুরে মাছ ধরা হতো সেদিন সৃজনকে খুব ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিতেন বাবা। সৃজন উদগ্রীব হয়ে জেলেদের আসার অপেক্ষায় বসে থাকতো!
চোখ বন্ধ করে বেশকিছক্ষন বিছানায় শুয়ে রইলো সৃজন। তারপর ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো।
তাহেরা ওকে দেখে তাড়াতাড়ি টেবিলে নাশতা সাজিয়ে দিলো। নাশতা সেরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটির জন্য বাইরে বেরোলো সৃজন।
ফাগুনের ঘুম ভাঙ্গলো সাড়ে দশটায়। অন্যদিনের তুলনায় আজকে একটু দেরীতেই ঘুম ভেঙ্গেছে। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে নামলো। বসার ঘরে হঠাৎ সৃজনকে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো সে। বিয়ের চারমাস পর এই প্রথম সৃজনকে কারখানা মিস দিতে দেখেছে ফাগুন! নিতান্তই কৌতূহল বশতই কি হয়েছে সেটা জানার জন্য কাছে এগিয়ে গেলো। কিন্তু হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বেচারি লজ্জায় পড়ে গেলো! বড্ড দেরী হয়ে গেছে ঘুম ভাঙ্গতে! সৃজন নিশ্চয়ই ভাবছে ফাগুন সারাদিন অকর্মার মতন বসে থেকে ওর অন্ন ধ্বংস করছে। ভাবারই কথা! খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কি কাজই বা করে ফাগুন। ভেতরে ভেতরে খানিকটা লজ্জা বোধ করলো। খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
‘আপনার কি শরীর খারাপ? কারখানায় যাবেন না?’
সৃজন সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছে। পত্রিকা থেকে মুখ না তুলেই বললো,
‘না।পুকুরে জাল ফেলবে। জেলেদের আসার অপেক্ষা করছি।’
তারপর আর কোনো কথা হলো না দুজনের মাঝে। সৃজন খবরের কাগজে মন দিলো আর ফাগুন তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরের দিকে ছুটে পালালো। যেদিন থেকে সৃজন আলাদা বিছানা নিয়েছে সেদিন থেকেই সৃজনের সঙ্গে কথা বলতে ওর কেমন যেন সংকোচ হয়। ওর জন্যই তো সৃজন নিজের কামরা ছেড়ে অন্য কামরায় বিছানা পেতেছে।
★
এই বাড়িতে সবাই সৃজনের ওপর অধিকার খাটায় কেবল যার সবচেয়ে বেশি খাটানোর কথা সে ছাড়া। সুধা যখন ছিলো তখন সুধার কথামতই চলতো সবকিছু। এখন তাহেরা!
দুপুরের খাবার শেষে সামান্য ঘুমিয়ে ছিলো ফাগুন। হঠাৎ জানালার কাছে পাখির কিচিরমিচির শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বাগানে পাখিরা ছুটোছুটি করছে। ফাগুন কিছুক্ষণ হাটাহাটি করবে ভেবে নিচে নেমে গেলো। ডাইনিং টেবিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ তাহেরার গলার আওয়াজ কানে এলো। সৃজনের সঙ্গে ঝগড়া করছে।
সারাদিন মাছ ধরার ঝামেলা শেষে সৃজন সবে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছে। তখনই তাহেরার আগমন। সৃজনের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে মুখ কালো করে বললো,
‘এইসব আপনি কি শুরু করছেন ভাইজান?’
সৃজন খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘কি করেছি? তুই যেই লিস্ট দিয়েছিস ওদের সবাইকেই তো মাছ দেওয়া হয়েছে! তোর খালু আর বোন জামাই এসে মাছ নিয়ে গেছে।’
তাহেরা অত্যন্ত হতাশার সহিত সৃজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
‘আপনি ঘরের জন্য কি রাখছেন?’
‘কেন সামাদ দিয়ে যায় নি?’
সামাদ এই বাড়ির দারোয়ান। প্রায় দেড় মণ মাছের মধ্য থেকে ঘরের জন্য দুটো রুই আর একটা বোয়াল আর এককেজির মতন ছোটমাছ ওর হাতে করে পাঠিয়েছে সৃজন। বস্তুত সেই কারণেই সৃজনের ওপর খেপে আছে তাহেরা। বাদবাকি সব মাছ আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীরা হজম করে নিয়েছে। তাহেরা অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বললো,
‘এই মাছ বিক্রি করলে কতগুলা টাকাগুলা আসতো বলেন তো।’
সৃজন মৃদু হেসে বললো,
‘বিক্রি করবো কেন? আমি কি মাছের ব্যবসা করি? আমি তো করি কাপড়ের ব্যবসা।’
‘এই জন্য আপনি সব দিয়া দিবেন?’
‘এত মাছ ঘরে রেখে কি করবি তোরা? এই মাছ তো ছয়মাসেও শেষ হবে না। তারচেয়ে সবাই মিলে নিয়ে গেছে এই ভালো। ঘরে রেখে নষ্ট করার চেয়ে কেউ নিয়ে গেলে ভালো না?’
‘এমনে চললে রাজা রাজত্বও টিকবে না। আপনি একটু চালাক হন ভাইজান।’
সৃজন হেসে ফেললো। ডালের বাটিটার দিকে ইশারা করে বললো,
‘ডাল দে!’
ডাল দিতে দিতে আরেকদফা সৃজনের সঙ্গে ঝগড়া করলো তাহেরা। ফাগুন আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দেখলো সেই দৃশ্য! নির্ঝঞ্ঝাট, সহজ সরল প্রকৃতির মানুষটির মধ্যে কি যেন আছে! সেই অদৃশ্য বস্তুটিই কি ধরা পড়েছিলো বাবার চোখে! ফাগুন আর বেশি কিছু ভাবার চেষ্টা করলো না। চুপচাপ বাগানের দিকে পা বাড়ালো!